ভুলে যেতে ভালোবাসিনি
পর্ব-২০
রোকসানা আক্তার
নাতাশার জেদ চাপাটা অনেকক্ষণ অব্দি চলতে থাকে।খাবার হীম হচ্ছে সেদিকে নাতাশার কোনোরকম ভ্রুক্ষেপ নেই।এখানে যে খাদ্য নামক কোনো বস্তু তার জন্যে রাখা আছে তা নাতাশার দৃষ্টির বাহিরে।এমনটাই জেদের ভঙ্গিমা নাতাশার মাঝে এখন।
রুব্বান দরজা ঠেলে নাতাশার কাছে আসে।তূরী বাজিয়ে বলে,
-কিরে দুলাভাইয়ের কথা ভাবছিলি?
নাতাশা কড়া চোখে রুব্বানের দিকে তাকায়।রুব্বান মিটিমিটি হাসে,আর বিছানার উপর হাই ছেড়ে বসে।নাতাশাকে আরো বেশি ছ্যাঁতিয়ে দেওয়ার জন্যে বলে,
-বাইত যাইয়া দুলাভাইরে একটু বেশিই আদর কইরা নিস যাতে উনার মনডা একমুহূর্তে মোমের মত নরম হইয়া যায়। আর উনার রাগ,অভিমান,ক্ষোভ বেগগিন বাইর হইয়া যায়।
নাতাশা বিরক্তি নিয়ে রুব্বানকে এবার বলে উঠে,
-তোর কি এই প্যাঁচাল ছাড়া আর কোনো কথা নেইই?
-না।
নাতাশা হাঁক ছেড়ে রুব্বানের থেকে মুখটা অন্যদিক করে নেয়।রুব্বান নাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখে মাছি উড়ছে।
-এই তোর খাওন ডা খাচ্ছিস না ক্যা রে?তোর খাওনে ত মাছি ভনভনাইতাসে।
-আর তুইও সেই খাবারে ভাগ বসানোর জন্যে এখন হাত-পা গুঁটে বসে আসিছ,না?
-হায় আল্লাহ এগিন তুই কি কস!আমি কি খাদক?
-নাহ তুই ভক্ষক।এখন এত ক্যাচাল রাইখ্খা মারে গিয়া বুঝা আমাকে এখন ওই বাড়ি না পাঠাতে।কারণ,তুই ত জানিস আর ক’দিন পর আমার পরিক্ষা!
-হ জানি।কিন্তু সোয়ামীর মনে যে কস্ট দিয়া পেললি হেইডা শুধলাবি কেমতে?
নাতাশার এবার সত্যিই রাগ উঠে যায়।মন চায় রুব্বানকে কয়েকটা চড় বসিয়ে বলতে –তুই বান্ধবী হয়েও আমায় বুঝলি না!
নাতাশার মা সড়াৎ দরজা ঠেলে ঝংকার আওয়াজে বলে উঠেন,
-কি নাতাশা তুই এখনও রেডি হস নি!?কখন রেডি হবি!?আরেহ তোর বাবা বাইরে দাড়িয়ে আছে।
নাতাশা চুপ হয়ে থাকে।পাশ থেকে রুব্বান বলে,
-খালা নাতুর কয় দিন পরতো পরিক্কা।এহন ওই বাড়ি যাইলে ত পরিক্কা দিতে পারবো না।
-কে কইছে পারবো না!?দরকার হলে ওই বাড়ি থেকে আবার এসে পরিক্ষা দিব।তারপরও এখন ওর যাওয়া লাগবে।নাতাশা তাড়াতাড়ি রেডি হ।গেলাম!!
নাতাশা তার মায়ের কথায় জোরে একটা দম ছাড়ে।রুব্বান নাতাশার কাঁধে হাত রেখে বলে,
-নাতু?এহন যা বোন।জামাইর মনে কস্ট দিতে নাইরে।যাইয়া দ্যাক কত জানি রাগ নিয়া বইয়া আছে।আগে গিয়া জামাইর মনডা ভালা কইরা নিস।আর উনারে বইলা আবার পরিক্কা দিতে চইলা আসিস।
নাতাশা মলীন মুখে রুব্বানের দিকে তাকায়।মুহূর্তেই রুব্বানকে জড়িয়ে ধরে কেদে দেয়।।
-কাদিস না।যা রেডি হ।
নাতাশা সম্মতি দিয়ে বাধ্যমেয়ের মতো বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ায় ।বুকটা তার ধুকপুক করছে।জানে না ওই বাড়িতে গেলে আবার কপালে কি আছে!ওই নীরটা ওর সাথে কেমন বিহেভ করে। যাকে চেয়েছিল সারাজীবনকার জন্যে পথ থেকে সরিয়ে দিতে,আর আজই তার কাছে যাওয়া লাগছে!নাতাশা এটা কখনোই আশা করেনি।
নাতাশা সবার থেকে বিদেয় নেয় ভার মুখে।নিদ এবং নিতুকে দুটো চুম্বন দিয়ে বাবার সঙ্গে হেঁটে চলে রাস্তার মোড়ে।পেছন থেকে আটটা নয়ন ছলছল চোখে নাতাশার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।নাতাশার অস্তিত্ব অদূরে মিলিয়ে গেলে নাতাশার মা চোখের পানি মুছে নেন।আর ভার বুকে একটা নিঃশ্বাস ছাড়েন।মেয়েকে বিদেয় দিতে খুব কষ্ট হয়েছে।মুখে শক্ত কথা বললেও অন্তরটা খানিক টুকু বিচলিত হয়েছে।মেয়েকে উচু বংশে বিয়ে দিয়েছেন।নাম-যশ,খ্যাতি সম্পন্ন ঘরের ছেলে ।আর সেখানে মেয়ে কিনা জামাইয়ের সাথে ঝগড়া করে বসে আছে।এটা মানতে গ্রামীণ সমাজের মায়েদের কাছে আকাশ কুসুম কল্পনা।
নাতাশা বাস স্টেশন চলে আসে। তারপর নাতাশার বাবা নাতাশার জন্যে কাউন্টার থেকে একটা টিকিট নিয়ে আসেন। মেয়েকে ব্যাগসম্মেত বাসে বসিয়ে দিয়ে বাস থেকে নেমে পার্শ্বস্ত একটা দোকান যান।সেখান থেকে এক প্যাকেট রুটি,চারটে কলা,আধা লিটার একটা জোশের বোতল আর একটা মাম পানি কিনে নেন,মেয়ে যাতে দীর্ঘপথে ক্ষুধার অনুভব না করে।তারপর খাবারগুলো নাতাশার হাতে দেন।নাতাশা ওগুলো হাতে নিয়ে করুন চাহনিতে বাবার দিকে তাকায়।নাতাশা বুঝতে পারে তার বাবার চোখ পানিতে টলমল করছে।মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে ভাঙ্গা গলায় বলেন,
-মারে ভালো থাকিস।আর জামাই বাবাজীরে বলে আবার পরিক্ষা দিতে চলে আসিস।
মাথা মাথা নেড়ে হা বলে।এরইমধ্যে বাসে যাএী ভরে যায়। আর বাস স্টার্ট হওয়ার সময় হয়ে যায়।তারপর নাতাশার বাবা মেয়ের হাতটা ছেড়ে গাড়ির বাহিরে দাড়িয়ে বিদেয় জানান।গাড়ি চলতে আরম্ভ করে।গাড়ি নাতাশার বাবাকে ক্রস করে।নাতাশা মলীন মুখে পেছনের দিকে ফিরে এখনো বাবা দাড়িয়ে আছে –ঠিক আগের জায়গায়।নাতাশা আক্ষেপ একটা শ্বাস টেনে স্মৃতির পাতার নতুন এক পাতা সৃষ্টি করে।আর ভাবনা চলে যায় মা,বাবা,ভাই-বোন,রুব্বান এবং পাড়া-প্রতিআেশীদের সাথে কাটানো সময় গুলো।
বিকেল চারটায় গাড়ি যাএাবাড়ি এসে পৌছায়।নাতাশার ফোন বেজে উঠে।কোহিনুর বেগম কল করেছেন।নাতাশা ক্ষীণ স্বরে হ্যালো বলে।কোহিনুর বেগম হাসি হাসি মুখ করে বলেন,
-নাতাশা নজিরকে পেয়েছ?
-নাহ,মা।সবে বাস থেকে নেমেছি।খুঁজতে হবে।
-খুঁজা লাগবে না।আমি বলেছি তোমাদের ফিরোজপুর বাস স্টেশন গিয়েই দাড়াতে।
-আচ্ছা,মা।আমি নজির চাচাকে খুঁজে পেলে আপনাকে কল করে জানিয়ে দিব।
-আচ্ছা।টেক কেয়ার।
-আচ্ছা।
নাতাশা কলটা কেটে দিতেই নজির ভতর ভতর পান গালে নাতাশার সামনে এসে হাজির।লাল লাল ঠোঁট দু’খানা ছড়িয়ে বলে,
-মামণি আইছো?
নাতাশা মুঁচকি হেসে সালাম করে।আর বলে,
-হা,চাচা।
-ভালা হইছে মা।তোমারে এতডা দিন অনেক মনে করসি।
-ধন্যবাদ চাচা।
নজির নাতাশার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে গাড়ির দিকে হেটে যায়।আজ নজির নিহানের গাড়ি নিয়ে এসছে।নাতাশা গাড়িতে বসতে বসতে বলে,
-ব্যাপার কি চাচা আজ নিহান ভাই অফিসে যায়নি?
-নাহহ।আইজকা উনার অফিস ছুটি।হেই লিগগা আমি আমি গারি নিয়া আইছি।
-আচ্ছা বুঝলাম।
তারপর নাতাশা বাড়ি আসে।এসেই কোহিনুর বেগমকে সালাম করে জড়িয়ে ধরে।কোহিনুর বেগমও নাতাশাকে আজ অনেকটা দিন পর কাছে পেয়ে কপালে চুমু লাগান।অতঃপর নাতাশা সবার সাথে সখ্য করে ক্লান্ত মনে রুমে যায়।বিছানার উপর ক্লান্ত মনে বসে।।মিশিতা তড়িঘড়ি রুমে ঢুকে বিছানাটা গোছগাছ করতে থাকে।কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলে,
-সাহেব হেই দুপুরের দিগে বাইর হওয়ার পর ভাবসিলাম রুমে আইয়া রুমডা গোছিয়া যামু,কিন্তু রান্নাঘরে যেই কাম পড়ছিল আর রুমডা গোছাবার সময় পাই নাই।
নাতাশা রুমটার চারদিক তাকিয়ে দেখে আসলেই রুমটা অগোছালো হয়ে আছে।সোফার বালিশ ফ্লোরে চিৎ হয়ে আছে,বিছানার চাদর এবড়ো-থেবড়ো,নীরের অবাঞ্চিত কিছু জামাকাপড় সোফার উপর ফেলে রাখা।আর বাদবাকি জিনিসপত্র গুলোও আগের জায়গায় নেই।রুমের সবকিছু কেমন জানি মরা মরা।নাতাশা দৃঢ় শ্বাস ফেলে বলে,
-তুমি যাও।আমি ফ্রেশ হয়ে গুছিয়ে নিব।।
-আরেহ নাহহ আপা।এগিন কি কন।আমিই গোছিয়া নিই।আপনের শরীরটা এহন নড়বড়ে।
কোহিনুর বেগম দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকেন।নাতাশাকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
-নাতাশা? আমি তোমার জন্যে কিছু শাড়ি,কাপড় কিনে রেখেছি।চাইলে ওখান থেকে একটা পড়তে পারো।
নাতাশা হ্যা বলে সম্মতি দিতেই কোহিনুর বেগম ওয়ারড্রব থেকে গাঢ় হলুদ কালারের একটা শাড়ি বের করে নাতাশার হাতে দেন।নাতাশা শাড়িটির নিখুঁত কাজের দিকে কিছুক্ষণ অব্দি তাকিয়ে থাকে।শাড়িটার কালার যতটা সুন্দর,তারচেয়ে বেশি এর তারাখচিত নিপুণ বুনন।
তারপর নাতাশা খুশিমনে শাড়িটি নিয়ে বাথরুমে যায়।ফ্রোশ হয়ে শাড়িটা পড়ে।বাথরুম থেকে বের হয় আয়নার সামনে দাড়ায়।নিজেকে আয়নার সামনে দেখে চোখগুলোকে স্থির রাখতে পারেনি।আজ কপন জানি নাতাশাকে অন্যরকম লাগছে,নাকি এই শাড়িটা তাকে অন্যতম করে তুলেছে।মিশিতা বিছানার চাদর ঠিক করতে করতে বলে,
-আপা,আপনেরে ত সেই লাগতাছে।সাহেব আইজকা আপনারে দেখলে ত টাসকি খাইবো।।
নাতাশা কৃএিম হাসি দেয়।মিশিতা আবার বলে উঠে,
-আপা?একটু হালকা খয়েরী লিপিস্টিক লাগাইলে পরী দেহা যাইত আপনেরে।একটু লাগান না আপা?
নাতাশা মিশিতার দিকে চোখ কাত করে মাথা হেলে।তারপর হালকা খয়েরী লিপিস্টিক ঠোঁটে এটে।আসলেই নাতাশাকে আরো বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে।
সামথিং সাজুগুজু শেষ হলে নাতাশা নিচে নামে।কোহিনুর বেগম সোফার উপর বসা থেকেই নাতাশার দিকে অনড় চোখে তাকিয়ে থাকেন।পএিকাটি টি-টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বলেন,
-নাতাশা?চুম্বক আকর্ষণ!
নাতাশা লজ্জা পেয়ে নিচের দিকল তাকিয়ে মৃদু হাসে।কোহিনুর বেগম নাতাশার হাত টানে কাছো নিয়ে বসান।নাতাশার সারা মুখে হালকা ফু দেন।নাতাশা চমকে উঠে তা দেখে।আলবোলা হয়ে বলে,
-মা ফু এর কারণ বুঝলাম না।
-কারো যাতে নজর না লাগে।
নাতাশা খিলখিল হেসে দেয়।সাথে কোহিনুর বেগমও।
রাত হয়।নাতাশা বই নিয়ে পড়তে বসে।নাতাশা আসার সময় হিসাববিজ্ঞান,বিজনেস মার্কেটিং,অর্থনীতি বই সঙ্গে করে নিয়ে আসে।কারণ,পরিক্ষার কথা ভেবেই সে সময়টা কোনোমতে হেলাপালা করবে না।পরিক্ষায় ভালো মার্কস কেরি করবে।বিগত ইয়ার গুলোতে নাতাশা ৩.৫০ এর উপরে পেয়েছে।তাই বিয়ের জন্যে লাস্ট ইয়ারকে বরবাদ করবে এমন মেয়ে নাতাশা নয়।নাতাশা পড়ার প্রতি ভীষণ চিন্তাশীল।এটা সেই ছোটকাল থেকেই।সেই কারণে গ্রামের অন্যান্য মেয়েদের তুলনায় নাতাশা আজ এত এগিয়ে।
পড়ার ফাঁকে রুমে মিশিতা এসে চা,বিস্কুট দিয়ে যায়।কোহিনুর বেগমও নাতাশাকে এসে দেখে যান। নাতাশার পড়াশুনায় এমন উৎফুল্লতা দেখে তিনি বেশিই খুশি।মেয়েটা যাতে ঠান্ডা, নিরিবিলি পরিবেশে পড়াগুলো রিভাইজ দিতে পারে,রুমে সবাইকে প্রবেশে বারণ করেন এবং নাতাশাকে সোফা ছেড়ে না উঠতে কড়া আদেশ দেন।এতে,নাতাশার মনোযোগ নষ্ট হবে সে ভেবে।
চলবে…