ভুলে যেতে ভালোবাসিনি
পর্ব-২১
রোকসানা আক্তার
নাতাশা পড়তে পড়তে নিচের দিকে ঝিমতে থাকে।চোখ দু’টোর পাতা ছোট হয়ে এখুনি যেন ধুপ করে আলো নিভে যাবে।এতটাই ঘুম চেপে বসেছে নাতাশার চোখে। নাতাশা নিবু চোখের পাতা মুহূর্তে আবার মেলে ফেলে,ঘুমটাকে কোনোমতে চোখে কিণারে ঘেঁষতে দেবে না।বোধহয় মিশিতার দিয়ে চাওয়া চায়ে চিনির পরিমাণ একটু বেশিই ছিল যার বদৌলতে কোনো কাজ হয়নি।ঝিমঝিম চোখে নাতাশা বইয়ে চোখ বুলায়,আবার বিরবির করে পড়তে থাকে।হুট করে কেউ খরখর গলায় বলে উঠে,
-অনেক পড়া হয়েছে,আর পড়তে হবে না।এবার ডিনার শেষ করে ঘুমুতে যাও।
নাতাশা চমকে উঠে বাম দিকে তাকায়।নীর দুই হাত দু’পাশে ভাঁজ করে গদগদ গলায় কথাগুলো বলছে।নাতাশা তড়িঘড়ি সোফা ছেড়ে উঠে দাড়ায়।নীর আগের ভঙ্গিমায় মুঁচকি হেসে বলে,
-এত ঘাবড়ানোর কিছু নেই।বাঘ আসে নি,এসছে নীর।সিম্প্যাথি থাকো।
নাতাশা এবার কড়া চোখে নীরের দিকে তাকায়।আর দাঁতগুলো কটমটায়।মনে মনে বলে,
-আহা!কি এমন ভালুক রে,আমি ভয় পাই!দেখতে ত একটা মশা আমার এক আঙ্গুলের ব্যাপার।আসছে ভাব নিতে!
নাতাশার কোনোরকম রেসপন্স না পেয়ে নীর হাতদুটো সরু করে।আর পা থেকে মাথা অব্দি নাতাশাকে দেখতে থাকে।নাতাশার পড়নে গাঢ় হলুদ শাড়িতে বেশ লাগছে ,ঠোঁটে দেওয়া হালকা খয়েরী লিপিস্টিক পূর্ণাঙ্গ ফেইসে কড়া ভাব এনে দিয়েছে।ডাগর ডাগর দু’চোখ খানায় কাজল লেপে দিলে বোধহয় ডানাকাটা পরী লাগত।উফস ক্যান যে দিল না!নীর এসব ভাবে আর ভ্রু কুঁচকায়।নাতাশাকে নীর কখনো অন্যচোখে দেখে নি,তবে আজ যতবার নাতাশার দিকে দৃষ্টি এটছে ততবারই ভ্রু কুঁচকানো আসছে।কারণ,নাতাশাকে আজ অন্যান্য দিন থেকে তার কাছে অন্যতম লাগছে।ইচ্ছে হয় টকটকে লাল দু’খানা গালে হাতের স্পর্শ ছুঁয়ে দিতে,আর স্পন্দন নিতে বুকে আওয়াজ তোলা হার্টবির্টের প্রতিধ্বনি।
নাতাশা তূরী বাজায়। নীর ধ্যান থেকে ফিরে আসে।
নাতাশা ইশারা করে বলে,
-যাওয়ার সাইড!এভাবে পথ আটকে দাড়িয়ে থাকা কেমন বাহবা!
নীর আবার দু’ ভ্রু উপরের দিকে উঁচায়।কিছুক্ষণ পর্যন্ত নাতাশার দিকে তাকিয়ে পথ থেকে সরে দাড়ায়।নাতাশা রুম থেকে নিচে চলে যায়।
ড্রাইনিং এ সবাই ডিনারের জন্যে বসে পড়ে।কোহিনুর বেগম সবার প্লেটে ভাত বেড়ে দিচ্ছেন।কোহিনুর বেগম নাতাশার কাছে ভাতের প্লেট হাতে নিয়ে এসে বলেন,
-নাতাশা?তোমার সবার থেকে বেশি খাওয়া দরকার।।
বলেই নাতাশার প্লেটে দ্বিগুণ ভাতের দানা বেড়ে দেন।তা দেখে নাতাশা হতচকিত এবং পাশে থাকা সবাই।নিহান টিটকারি করে বলে,
-কি মা?বউকে ত প্লেট ভরা ভাত খাইয়ে মটু বানিয়ে ফেলবে!
-দূর ছাই!এখন বেশি খেলেও মোটা হবে না।কারণ,পরিক্ষার পড়ায় অর্ধেক শক্তি ক্ষয়।একখানে দিয়ে ঢোকবে,আরেক খানে দিয়ে শক্তি অপচয় হবে।
-হু,বুঝলাম মা।মন্দ বলো নি।(নিহান)
-কোহিনুর বেগম সবসময় রাইট কথা বলে।(কোহিনু বেগম)
কোহিনুর বেগমের কথায় সবাই খিলখিল হেসে দেয়।ওদিক দিয়ে নাতাশার হাসির মাঝে কেশে দেয়।কোহিনুর বেগম তড়িঘড়ি নাতাশার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলাতে থাকেন।বলেন,
-তোমার হাসতে হবে না।এমনিতেই শীর্ণ শরীরটায় আধ পোয়া শক্তি নেই,সেই কি না এসছে হাসতে।খাবার শেষ করে তাড়াতাড়ি ঘুমুতে যাও।
নাতাশার আরো হাসি চলে আসে।কোহিনুর বেগম রসিকতায় বেশ।নাতাশা আগে হালকা পাতলা বুঝলেও এখন পুরোপুরি ক্লিয়ার।
ডিনার শেষ হলে নাতাশা রুমে যায়।বিছানা থেকে বালিশটা হাতে নিয়ে সোফায় হাতলে ঠেসে দেয় ঘুমানোর জন্যে।আজ সে মনস্থির করেছে এখানে ঘুমুবে।ওই ক’টা দিন জ্বরের বাহবায় বিছানায় শুয়েছে।এখন সুস্থ, তাই সোফাই ঘুমাবে।কারণ,সোফাটা নাতাশার বরাদ্ধ।যদি বাসর রাতে সোফায় ঘুমিয়ে রাত পার করে তাহলে অন্য রাতগুলি কেন বিছানায় কাটাবে!
তা ভেবেই নাতাশা সড়াৎ শুয়ে যায়।একটু পর নীর এসে দরজা ফাঁক করে ভেতরে ঢোকে।নাতাশার সোফায় ঘুমিয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়!ভ্রু কুঁচকে বিছানার কাছে গিয়ে ল্যাপটপ হাতে নেয়।ল্যাপটপ নিয়ে সোফা সামনে আসে।গলা খেচকে বলে,
-ল্যাপটপে আমার কিছু কাজ আছে।বিছানার উপর স্বাভাবিকভাবে বসাটা প্রবলেম।তাই সোফায় বসেই কাজটা সেরে ফেলতে চাই।যদি আপওি না থাকে,তাহলে বিছানায় গিয়ে ঘুমাও।আর আমায় কাজটা সম্পূর্ণ করতে দাওও।
নাতাশা নীরের কথায় ভ্রক্ষেপ না করে চুপ হয়ে থাকে।সে জানে এসব নীরের ড্রামা।সামনে আরেকটা সিট পড়ে থাকতে এই সিট নিয়ে এত লাফালাফি কিসের।ওই সিটে বসেই ত কাজটা শেষ করতে পারে!
নীর তূরী বাজিয়ে আবার বলে উঠে,
-কি শুনছো?
নাতাশা এবার মাথা ঘুরিয়ে আড় নয়নে নীরকে বলে,
-সামনে ত আরেকটা সিট পড়েই আছে।সেটা কি চোখে পড়ে নি?
-সেখানে বসা আমার জন্যে কম্পরেটেবল না।জাস্ট ইট দ্যাট ইউ আর স্লিপড।
-প্লিজজ, কাইন্ডলি রিকুয়েষ্ট! এত খচখচ না করে এখান থেকল যান ত!?আমায় শান্তিতে ঘুমতে দিন।এমনিতে ভীষণ ক্লান্ত!
নীরের হাসি চলে আসে।হাসিটাকে যে করেই হোক চেপে রাখতে হবে।কারণ,নাতাশার চোখ এখন নীরের মুখোমুখি।নীর এবার ভ্রু নাচিয়ে বলে,
-বায় দ্য ওয়ে,কি মনে করে আসলে?কাল গভীর রাতে ত ওই বাড়ি থেকে আমায় তাড়িয়ে দিয়েছিলে।
নাতাশার এবার সত্যি সত্যি রাগ উঠে যায়।রাগকল বেশিক্ষণ সামলাতে না পেরে সোফা থেকে দাড়িয়ে যায়।আর নীর ধপসে শরীরটা সোফার উপর ছড়িয়ে দেয়।
-আহা!এখন একটু শান্তি পেলাম।অন্তত রাতের জন্যে।যাও তুমি গিয়ে বিছানায় ঘুমাও।আমি এখানেই ঘুমাচ্ছি।
নাতাশার রাগের পরিমাণ এতই বাড়তে থাকে যে নিজের চুল নিজেই ছিঁড়তে ইচ্ছে হয়।নীর আবার জোরে বলে উঠে,
-কি হলো দাড়িয়ে আছো যে?যাও?
নাতাশা রাগ চেপে মাথা ঘুরিয়ে বিছানার দিকে চলে যায়।আর জিম্মি বিছানার শুয়ে পড়ে।কিছুক্ষণ কেটে যায়।নাতাশার ঘুম আসছে না।হাই তাই করতে করতে বামে ঘুরতেই কিছু একটা বস্তুর সাথে হোঁচট খায়।চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে নীর শুয়ে আছে।নাতাশার মুখ ফসকে চিৎকার চলে আসতেই নীর নাতাশার মুখ চেপে ধরে।আর ফিসফিস করে বলে,
-চুপ।লজ্জা-সরম নেই নাকি?এভাবে চিৎকার দিলে আশপাশের সবাই কি বলবে হু?
নাতাশা নীরের হাতটা সরাতে চেষ্টা করে,পারে না।নীর নাতাশার মুখ আরো জোরে চেপে ধরে নাতাশার কাছে আসতে থাকে।নীর এবার ও আঙ্গুল দিয়ে শো আওয়াজ তুলে চুপ থাকতে।নাতাশা চুপ হয়ে যায়।নীর গদগদ হেসে হাতটা ছেড়ে দেয়।আর উঠে বসে।নাতাশাও উঠে বসে।আর বলে,
-আপনি চাচ্ছেন টা কি আমার থেকে?
-একফালি ভালোবাসা!
নাতাশা একটা তাচ্ছিল্য হাসি মুখে এঁটে।বলে,
-ভালোবাসার মিনিং বুঝেন?ভালোবাসা কাকে বলে, জানেন আপনি!?
নীর চুপ হয়ে যায়।নাতাশা আবারও বলে,
-আমার ত টাকা নেই।আমি একজন অযোগ্য,খেত-গাঁইয়া,ইম্মিচিউরড,গ্রামের ত্যানাপ্যানা আমার কাছে আবার ভালোবাসা!?হা হা হা হা!আচ্ছা আপনি কি স্বপ্নের ঘোরে এসব বলছেন না ত?ভেবে দেখুন!
নীর মলীন মুখ করে।আর ব্যর্থমনে বলে,
-নাহহ নাতাশা।আমি সত্যিই তোমাকে এখন অনেক ভালোবাসি।আগে হয়তো ভুল করেছি,কিন্তু..
-কিন্তু এখন আরো বেশি ভুল করে ফেলবেন আমায় ভালোবেসে। প্লিজজ?আমি একটু নিরিবিলি তে একা একটু শান্তিতে থাকতে চাই।মা-বাবা আমায় এখানে এমনিতে জোর করে পাঠিয়েছেন।এরকম ক্যাচর ক্যাচর শুনতে আর ভাল্লাগে না।
নীর কোনো ভাবান্তর না পেয়ে টপকে নাতাশার দু’হাত চেপে ধরে।
-প্লিজজ নাতাশা আই এ’ম স্যরি।আমি তোমার সাথে অনেক অন্যায় করে ফেলেছি।আমি জানি ওই সবটাই আমার ভ্রম ছিল।অন্ধ ছিলাম আমি দাম্ভিকতায়।বন্ধুবান্ধবদের মোহে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি অন্য জগতে।আর সে জগৎ থেকে তুমি আমায় নিয়ে আসলে।ভেদ করে তাড়ালে আমার সকল অন্ধ ধারনার খোলসা গুলো।আমি আর নেক্সট বার কোনো ভুল করতে চাই না।আমায় এই লাস্টবার সুযোগ দাওও নাতাশা!?আমি তোমার কাছে হাত জোড় করছি।
নাতাশা নীরের কথায় চুপসে মাথা নিচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকে।নীর আবার তূরী বাজায়।
-প্লিজজ নাতাশা?
নাতাশা এবার নীরের মলীন চেহারার দিকে তাকায়।মুখখানা দেখতে কি নিষ্পাপ!মুখের ভাব-ভঙ্গিমা বলছে নীর তার সব দোষ-ভুল বুঝতে পেরেছে।তাছাড়া নীর গ্রামের বাড়ি গিয়ে পর্যন্তও পদার্পণ করেছে আবার অভিমান ভাঙ্গাতে না পেরে রাগ করে গভীর রাতে শহরে ফিরে আসছে।এসব টাই ত ভালোবাসার ধরুনে।
নাতাশা মায়াবী চাহনি দিয়ে এসব ভাবছে,আর দীর্ঘ প্রশ্বাস নিয়ে নীরকে দেখছে।
মুখে এখন আর সেই আগের নীরের আভা নেই।খুব স্মিত মুখখানা।মায়া মায়া চোখগুলোতে আড়ই জাদু। নাতাশার সারা শরীর শিরশির করে উঠে।নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে পারেনি।ভুলে যায় আগের সব অভিমান,রাগ,ঘৃণা,ক্রোধ। আর মুখে বয়ে নিয়ে আসে এক ঝিলিক হাসির রেখা।নীরও নাতাশার সাথে হেসে দেয়।নীর বুঝতে পারে নাতাশা এখন তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে।নীর খুশির তালে নিজেকে সংযত না রাখতে পেরে নাতাশাকে জড়িয়ে ধরে।নাতাশার সারা শরীরে কাঁপুনি এসে যায়।সেও নীরকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নেয় দু’বাহু ডোরে।পূর্ণ হয় ভালোবাসার মহিমা।
চলবে…