ভেতরে বাহিরে পর্ব-০৫

0
955

#ভেতরে_বাহিরে
পর্বঃ০৫
লেখিকাঃ #রুবাইদা_হৃদি
মাধুর্য ধীর পায়ে আবেশের একদম সামনে গিয়ে দাঁড়ালো৷ চারদিকে তখন সূর্যের লাল আভা ফুঁটে উঠেছে ৷ ভুবনমোহিনী রুপ যেন মাধুর্যের চোখে-মুখে ফুঁটে উঠেছে এল চিলতে হাসির জন্য৷ মাধুর্যের চোখে টলমল করছে পানি সেই সাথে মুখে ছোট হাসিতে আবেশের কী হলো কে জানে! সে নিজের সব ভুলে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো সেই হাসির দিকে মাধুর্য কিছুটা কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আবেশের হাত ধরে বলল,

‘ ধন্যবাদ৷ জীবনের আরেকটা খুশি আমার দোরগোড়ায় এনে দেওয়ার জন্য ৷ ‘

‘ আমি! ‘

‘ হ্যাঁ আপনি ৷ আপনি যেদিন আমাকে বিয়ে না করলে আমার আম্মু’মা কে পেতাম না৷ ‘

আবেশ অবাক চোখে তাকালো মাহফুজার দিকে৷ মাহফুজা একরাশ হাসি মুখে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ আবেশ ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘ আম্মা,ও কী বলছে? ‘

‘ তোদের বলতাম না? আমার এক মেয়ে আছে৷ পরীর মতো মেয়ে৷ এই সেই মেয়ে যে আমার ছেলের বউ হয়ে আমার বাড়িতে এসেছে ৷ ‘

‘ আম্মা কার কথা বলছো,তুমি? ‘

‘ তোর মেহরুন আন্টির মেয়ে মাধু৷ আমার প্রাণপ্রিয় বান্ধবী৷ ‘

আবেশ খুব করে মনে করার চেষ্টা করলো ৷ যখন মনে পড়লো মেহরুন আন্টির কথা তখন অবাক হয়ে বলল,

‘ তুমি ভুল করছো আম্মা৷ মাধুর্যের মায়ের সাথে মেহরুন আন্টির একদম মিল নেই ৷ ‘

‘ মেহরুন কে কোথায় পেলি,তুই?’

‘ সত্যি বলছি আম্মা উনি মেহরুন আন্টি না৷ ‘

‘ উনি আমার মা নয়৷’ মাধুর্য ভেজা গলায় বলতেই চমকে উঠলো আবেশ ৷ মাহফুজা জড়িয়ে ধরলো মাধুর্যকে৷ তার চোখে পানি চিকচিক করছে ৷ আবেশ কিছু বলতে গেলে মাহফুজা হাত উঁচিয়ে থামতে বলে তাকে ৷ আবেশ চুপ হয়ে যায়৷ তাকিয়ে দেখে মাধুর্যের কান্নায় ভিজে উঠা মুখশ্রী ৷

______

আঁধার নেমেছে ধরণীর মাঝে ৷ পাখির কলতানে বিভোর হচ্ছে প্রকৃতি৷ দূর আকাশে কোনো চিত্রশিল্পী হলদে রঙ দিয়ে মেঘের বুকে আঁকিবুঁকি করছে নিজ মনে ৷ কখনো সুন্দর হয়ে উঠা কোনো সুন্দর চিত্রকর্মের সাথে মিলে আবার কখনো শিল্পীর ছুঁড়ে ফেলা মুচড়ানো কাগজে অসুন্দর চিত্র ফুঁটে উঠে ৷

‘ রুমে আসো৷ ‘ আবেশ রুমের ভেতর থেকে থমথমে গলায় বলতেই মাধুর্য ভাবনা থেকে বেরোয়৷ চোখেমুখে শুষ্কতা বিরাজমান৷ ছোট করে বলল,

‘ একটু পর আসবো৷ আপনার চিন্তা করতে হবে না৷ ‘

‘ তোমায় কে বললো আমি চিন্তা করছি? বারান্দার দরজা আঁটকে দিবো তাই রুমে আসতে বলছি৷ ‘ আবেশ সোফায় ল্যাপটপ নিয়ে বসে বলল৷ মাধুর্য জবাব দিলো না৷ আবেশ ইমেইল চেক করার জন্য ল্যাপটপ খুললেও মনোযোগ দিতে পারলো না ৷ ল্যাপটপ পাশে রেখে কিছু একটা ভেবে বলল,

‘ তুমি সত্যি মেহরুন আন্টির মেয়ে!’

‘ আপনার সন্দেহ আছে? ‘

‘ তোমায় বিশ্বাস করার কোনো অবকাশ পাচ্ছি না৷ সব লুকিয়ে রাখছ৷’ আবেশ সরু চোখে প্রশ্ন করতেই মাধুর্য কিছুটা রেগে বলল,

‘ আপনার বিশ্বাস অবিশ্বাস দিয়ে সব পাল্টে যাবে না৷ ‘

‘ তোমার বাসায় যে আছে তার সাথে মেহরুন আন্টির কোনো মিল নেই৷ আমার খুব করে মনে আছে মেহরুন আন্টিকে৷ ‘

‘ মাধু কে মনে নেই?’ মাধুর্য সূক্ষ্ম কন্ঠে বলল৷

‘ না মনে নেই ৷ কিছু মানুষকে ভুলে যাওয়া ভালো৷’

মাধুর্য জবাব দিলো না ৷ বিষাদময় চোখে তাকিয়ে রইলো আবেশের দিকে ৷ হুট করে তার জীবন একরাশ আলো নিয়ে এসে দমকা হাওয়ার ন্যায় সব হেলেদুলে উঠছে ৷ ভেতরে থেকে নিগড়ে বেরিয়ে এলো বিষাদের হাওয়া৷ সে হাওয়া আবেশকে ছুঁতে পারলো না ৷

বিশাল বড় পর্দা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো আবেশ৷ রুমের ঠিক মাঝামাঝি রাজকীয় চৌকি ৷ চারপাশে কারুকাজ করা আসবাবপত্র৷ আবেশ যখন তার আম্মার রুমে ঢুকে তার চোখ জুড়িয়ে যায়৷ তার আম্মা আর আব্বাজান বড্ড শৌখিন মানুষ যার দরুণ রাজকীয় ছাপ প্রতিটা কোণায়৷ মাহফুজা সবেমাত্র রুমে এসে বসেছে ৷ আবেশের উপস্থিতি বুঝতে পেরে একগাল হেসে বলল,

‘ এতো অধৈর্য কেন,তুমি? ‘

‘ আম্মা আমার ধৈর্য বড্ড কম তুমি সেটা জানো৷’

‘ জানি বলেই তো তোমাকে আসতে বলেছি আমার রুমে৷ ‘ মাহফুজা আবেশকে বসতে বলে বললেন ৷ আবেশ অস্থির কন্ঠে বলল,

‘ আম্মা তুমি জানো,সব? ‘

‘ জানি৷’ বলেই হাফ ছাড়লেন মাহফুজা৷ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,

‘ মেহরুনের সাথে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছিলো আমরা সিলেট আসার পরেই,সেটা নিশ্চয়ই তোমার মনে আছে,আবেশ? ‘

‘ সেটা তো অনেক আগের ঘটনা আম্মা ৷ তবে মাধু সিলেটে কীভাবে? আর ওই বাসায় মেহরুন আন্টির বদলে অন্যকেউ যে মাধুর্যের মা৷ তুমি ভুল করছো আম্মা৷ ও মাধু নয়৷ ‘

‘ আহ্! আবেশ আমাকে সবটা বলতে দেও৷ ‘ মাহফুজা কিছুটা বিরক্তির রেখা কন্ঠে ফুটিয়ে বলতেই আবেশ চুপ হয়ে গেলো৷ মাহফুজ বললেন,

‘ তোমার আব্বুর কোম্পানিতে মাধুর্যের ভাই ইন্টারভিউ দিতে এসেছিলো সেখানে থেকেই কোনো সূত্রে জানতে পারি, সে মাধুর্যের সৎ ভাই৷ মেহরুন হঠাৎ করে’ই হারিয়ে যায় এর পর মাধুর্যের বাবা লতা’কে বিয়ে করেন৷ লতার একান্ত সন্তান রাব্বি ৷ মাধুর্যের আব্বুকে দেখেই তোমার বাবা মাধুর্যের খোজ করে এবং পেয়েও যায় ৷’

আবেশ অবাক চোখে তাকিয়ে শুনছিলো ৷ তারমানে মেহরুন আন্টি নেই? তবে কী মাধুর্যের শরীরের মারের দাগ গুলার জন্য দায়ী তার ভাই আর বাবা? মাহফুজার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ আম্মা!’

‘ হ্যাঁ,বলো ৷’

‘ মাধুর্যের শরীরে মারের দাগ,আম্মা৷ তাকে প্রতিনিয়ত মারা হতো৷’ আবেশের কথায় চমকে উঠলেন মাহফুজা৷ অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললেন,

‘ মারা হতো,মানে? আমি জানি শাহেদ ভাই মাধুর্যকে চোখে হারায়৷’

‘ মাধুর্য নিজে আমাকে বলেছে,আম্মা৷’

‘ তুমি এই বিষয়ে মাধুকে আর প্রশ্ন করো না,আবেশ৷ আমি তোমার আব্বুর সাথে আলোচনা করবো৷’ মাহফুজা কপালে চিন্তার রেখা ফুঁটিয়ে বলতেই আবেশ রুম থেকে বেরিয়ে যায়৷ কেমন অস্থির পরিবেশ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো৷ মাধু তারমানে সত্যি বলেছিলো বাসর ঘরে ৷

________

‘ ছোট ভাবী,আসবো?’ নাজিফা রুমে ঢুকে খাটের উপর বসে বলতেই মাধুর্য একটু হাসলো৷ মেয়েটা রুমে ঢুকে অনুমিত চাইছে ব্যাপার টা মজার।নাজিফা বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

‘ এই ভাবীইইইই..হাসলে তোমাকে মারাত্মক কিউট লাগে ৷ হায়ইই আমার ভাই তো ফিদা হবে এই হাসি দেখেই ৷’

‘ তোমার হাসি আমার হাসির থেকেও সুন্দর৷ ‘

‘ আরে ধুর,আমার হাসি রাক্ষসীদের মতো ৷ জোরে হাসলে’ই বড় ভাইয়া তাই বলে৷’

নাজিফার কথা শুনে মাধুর্য হাসলো ৷ নাজিফাকে শেষবার দেখেছিলো সে যখন ছোট ছিলো ।একদম শিশু ৷ নাজিফা মাধুর্যের হাত ধরে বলল,

‘ ছোট ভাবী শোনো,আমার ভাই আস্ত এক গোমড়া মুখো আর রাগী৷ উপরে স্ট্রিক্ট কলেজ টিচার টাইপ৷ তবে মনের দিক থেকে একদম নাদান বাচ্চা টাইপ৷ জানো? আম্মার কোলে এখনো কাঁদতে যায়৷ শেষবার আপু….’

‘ নাজিফা আমার রুমে থেকে যা৷’ নাজিফার কথা শেষ হওয়ার আগেই আবেশ কাট কাট গলায় বলতেই নাজিফা ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,

‘ ছোট ভাইয়া এইটা মাধুর্য আপুর ও রুম৷ তাই জোর খাটাবে না৷ ‘

‘ নাজিফা..’ আবেশ ধমক দিয়ে বলতেই নাজিফা অসহায় চোখে মাধুর্যের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,

‘ দেখলে,বলেছিলাম না? একদম কলেজ টিচার টাইপ৷

‘ লাস্ট বার বলছি,নাজিফা রুম থেকে যা৷’

আবেশের ধমক শুনে মাধুর্য’ও কেঁপে উঠলো৷ নাজিফা ভোঁ দৌড় দিয়ে বেরিয়ে যায় ৷ আবেশ মাধুর্যের দিকে তাকাতেই মাধুর্য ও বেরিয়ে যেতে চাইলে রুক্ষ গলায় বলল,

‘ তুমি কোথায় যাচ্ছো? ‘

‘ আ.প্প..নি তো রুম থেকে যেতে বললেন৷’

‘ কানে কী কম শুনো? ‘

‘ কী বললেন! দেখুন..’

‘ এখন তো ঠিকই শুনেছো তার মানে বয়রা না,তুমি৷’ আবেশ ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে বলতেই মাধুর্য রেগে যায় ৷ তবে নীরবে বেরিয়ে যেতে চাইলে আবেশ তাড়াহুড়ো করে বলল,

‘ রেডি হয়ে আসো৷ আমি নীচে অপেক্ষা করছি৷’

‘ কোথায় যাবো? ‘ মাধুর্য অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করতেই আবেশ বলল,

‘ ভাবী তোমাকে চেকআপ করাতে নিয়ে যেতে বলেছে৷ ‘

‘ আমি যাবো না৷’

‘ কারণ? ‘ আবেশ থমথমে গলায় বলল ৷ মাধুর্য ভয় পাওয়া কন্ঠে বলল,

‘ আমি ঠিক আছি৷ কিছু হয় নি আমার৷ ‘

‘ তুমি আমার দায়িত্বে৷ তোমার হাফ ডিসিশন নেওয়ার অধিকার আমার আছে ৷ ‘

মাধুর্য থমকালো ৷ সুন্দর অনুভূতি গ্রাস করলো ঝাঁক বেঁধে ৷ নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে রইলো আবেশের দিকে৷ আবেশ কাবার্ড খুলে কিছু একটা নিয়ে বেরিয়ে যেতে আবার বলল,

‘ আর একটা কথাও আমি শুনতে,ইচ্ছুক নই৷ তাই দ্রুত আসো৷ ‘

আবেশের যাওয়ার দিকে বিমোহিত চোখে তাকিয়ে মাধুর্য বিড়বিড় করলো,

‘ সবটা ধোঁয়াশা আপনার কাছে৷ সেই ধোঁয়াশা কখনো না কাটুক আবেশ৷ আপনি সহ্য কর‍তে পারবেন না,যে ৷’

_______

শিরশিরে বাতার প্রবাহিত হচ্ছে ৷ মৃদুমন্দ ছন্দ তুলছে আকাশ বেয়ে নেমে পড়া অবাধ্য জলের ধারা৷ অল্পবিস্তর আলোক ছটা বিলাচ্ছে বৃষ্টির মাঝে সূর্য ৷ দূর আকাশ ঝলমলে তবে হঠাৎ বৃষ্টির আগমণ ৷ মাধুর্য বিরস চোখে তাকিয়ে আছে৷ আবেশ পার্কিং এরিয়া থেকে বৃষ্টি মাথায় করেই পাশে এসে দাঁড়ালো মাধুর্যের ৷গলা খাকারি দিয়ে বলল,

‘ কিছু খাবে? ‘

‘ খিদে নেই৷ ‘

‘ ওকে দ্যান,হাওয়া খাও৷’ আবেশ বিরক্তি নিয়েই বলল৷ এই মেয়েকে যা জিজ্ঞেস করে তার উত্তরে ‘না’ থাকবেই ৷ অসময়ে বৃষ্টি তার উপর ইরা হসপিটালে নেই ভেবেই রাগ হলো আবেশের৷ মাধুর্য হঠাৎ করেই আবেশের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো৷ বিনয়ী সুরে বলল,

‘ আমি বৃষ্টিতে ভিজবো৷ ‘

আবেশ ভ্রু কুঁচকে তাকালো৷ বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ এই বৃষ্টিতে তোমার মাথা ও ভিজবে না৷ ‘

‘ প্লিজ! একটু হলেও ভিজবো আমি৷’

আবেশ উত্তর দিতে পারলো না ৷ বুকে কিঞ্চিৎ কষ্টের আভাস পেলো ৷ তবে মাধুর্য যখন এক পা দু পা করে বাইরে বেরিয়ে গেলো তখন তার চোখে ভেসে উঠলো পুরোনো কিছু তিক্ত সৃতি৷ মাধুর্য হাত উঁচিয়ে ডাকলে আবেশকে ৷ আবেশ সেই ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে গেলো মাধুর্যের কাছে ৷ মাধুর্যের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে তার দুইগালে হাত রাখতেই মাধুর্য কেঁপে উঠে পিছিয়ে যেতে চাইলে….

চলবে…