ভেতরে বাহিরে পর্ব-০৭

0
889

#ভেতরে_বাহিরে
পর্বঃ০৭
লেখিকাঃ #রুবাইদা_হৃদি
আবেশ মাধুর্যকে ধরে উঠে বসাতেই তার মাথার সাথে মাধুর্যের মাথায় হালকা ধাক্কা লাগে৷ ব্যথায় শব্দ করে উঠে মাধুর্য ৷ আবেশ অস্থির চিত্তে বলল,

‘ বেশি ব্যথা পেয়েছো?’

মাধুর্য ‘না’ সূচক ভাবে মাথা নাড়ালো ৷ আবেশ মাধুর্যের কপালে হাত দিতে গেলেই পিছিয়ে যায় মাধুর্য৷ আবেশ তবুও জোর করে মাধুর্যের কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল,

‘ এখনো জ্বর নামে নি৷দাড়াও আমি ইরা ভাবীকে ডেকে দিচ্ছি৷’

আবেশ বলেই উঠে চলে যেতে গেলে মাধুর্য হাত টেনে ধরে আবেশের ৷ আবেশের হৃৎপিন্ড কেঁপে উঠলো ৷ শীতল শিহরণ বয়ে গেলো অন্তর জুড়ে৷ সকালের সদ্য নীড় ছাড়া পাখি গুলো সবেই আবেশের বারান্দায় এসে বসেছে ৷ তারস্বরে সুমিষ্ঠ কন্ঠে ভারী করছে পরিবেশ ৷ আষাঢ়ের বারিধারা একটু আগেই থেমেছে ৷ গাছের পাতা নুইয়ে পড়ছে বিন্দু বিন্দু মুক্তোর দানার মতো পানি ৷ টুপ টাপ আওয়াজ হচ্ছে ৷ আবেশের মনেও দ্রিমদ্রিম আওয়াজ করে উঠলো৷ মাধুর্য অবিশ্রান্ত গলায় বলল,

‘ আমার আব্বু যদি আমাকে নিতে আসে,প্লীজ আমাকে তার কাছে ফেরত পাঠিয়ে দিবেন না,আবেশ৷’

মাধুর্য জ্বরের ঘোরে আছে বেশ বুঝতে পারছে আবেশ৷ তাই মাধুর্যের পাশে বসে হাত রাখলো মাধুর্যের মাথায়৷ আদরের পরশ পেয়ে মাধুর্য মাথা ঠেকাল আবেশের বুকে ৷ আবেশ আরেকদফা কেঁপে উঠলো ৷ কেমন অস্থিরতা ঘিরে ধরলো তাকে সেই সাথে মোহনীয় অনুভূতিতে ভারী হলো পরিবেশ ৷ মাধুর্য কান্নামিশ্রিত গলায় বলল,

‘ জানেন আবেশ? তারা সম্পত্তির জন্য আমাকে মারতো৷ আমার নিজের আব্বু৷ যার প্রাণ ছিলাম আমি ৷ আমার সব থেকেও ছিলো না আবেশ৷ অনেকদিন গিয়েছে আমি না খেয়ে থেকেছি৷ অসুস্থতায় আধমরা হয়ে পড়ে থেকেছি৷ ওরা আমার সম্পত্তি চায় ৷ ওরা আমার কাছে দলিল চায়৷ কিন্তু কিছু আমার কাছে নেই৷ আমি বারবার বলতাম ওরা আমায় বারবার মারতো৷ জানেন? রাব্বি আমাকে দিয়ে খারাপ কাজ করাতে চেয়েছি….’

মাধুর্য আর বলতে পারলো না৷ গলা ভেঙে কান্না আসছে তার৷ হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছে৷ সব যন্ত্রণা একের পর এক মনে পড়ছে৷ কোথায় তার আম্মু? কেন করলো বেইমানি?

আবেশ থমকালো৷ রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো তার৷ শাহেদ শেখ যে এতোটা নিম্নমানের মস্তিষ্কের অধিকারী হয়ে গেছে সে ভাবতেও পারে না ৷ মাধুর্যের দিকে তাকালো৷ হাত টা মাথায় রেখেই নম্র গলায় বলল,

‘ মাধু,কিছু হবে না৷ সব ঠিক হয়ে যাবে৷ এইদেখো আমি আছি তো৷’

‘ কী ঠিক হবে আবেশ? আর মাধুর্য কাঁদছে কেন?’ মাহফুজা রুমে ঢুকেই অস্থিরকন্ঠে বলল৷ মাধুর্য তখনো আবেশের বুকে মাথা ঠেকিয়ে আছে৷ আবেশ কী বলবে বুঝতে পারলো না৷ নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল,

‘ ও খারাপ স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছে,আম্মা৷ আর জ্বর ও এসেছে৷’

‘ সে’কী! আগে বলবি না আমায়? দেখি সর.. ‘ মাহফুজা মাধুর্যের পাশে বসে তার মাথা নিজের কোলে নিয়ে বসে বলল৷ তার চোখে-মুখে চিন্তার ছাপ৷ আবেশের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ দ্রুত ইরা কে ডেকে নিয়ে আয়৷ আমি আছি আমার আম্মু’মায়ের কাছে৷’

আবেশ তাকিয়ে রইলো তার আম্মার দিকে৷ মুখে তার ফুঁটে উঠেছে একজন চিন্তিত মায়ের প্রতিচ্ছবি৷ মাধুর্যকে ধরে দোয়া দুরুদ পড়ে ফুঁ দিচ্ছেন তিনি। সযত্নে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে৷ আবেশ তৃপ্তির হাসি হাসলো৷ সব মায়েরা তার আম্মার মতো কেন হয় না?
_______

আবেশ রাগী চোখে তাকালো মাধুর্যের দিকে৷ রাগে তার শরীর কাঁপছে ৷ মাধুর্যের হাতে থেকে ঘড়িটা ছিনিয়ে নিতে গেলে মাধুর্য সরে যায়৷ আবেশ রাগী সুরে বলল,

‘ বাচ্চামো করবে না,মাধুর্য৷ আমার ঘড়িটা দাও৷’

‘ আগে বলুন ঘড়িটা কে দিয়েছে আপনাকে?’

আবেশের রাগ বাড়ছে৷ মাধুর্য জ্বর শরীরেই ছুটোছুটি করছে ৷ কে বলবে কাল রাতে এই মেয়ে ভয় আর জ্বরে বিছানার সাথে লেগে ছিলো? তার সারারাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে।আবার তার উঠার আগেই নিজে উঠে তার ঘড়িটা নিয়ে লাফালাফি করছে৷ আবেশ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘ কে দিয়েছে ? কেন দিয়েছে?সেই সব কথা তোমার না জানলেও চলবে,মাধুর্য৷ ঘড়িটা দাও৷’

মাধুর্য দিলো না৷ ঘড়িটা উল্টেপাল্টে দেখছে ৷ এতো বছর ধরে আগলে রেখেছে,আবেশ? সে তার ছোট ছোট হাত দিয়ে আবেশকে ঘড়িটা পরিয়ে দিয়ে বলেছিলো,

‘ আবেশ ভাইয়া,তোমার যখন আমার কথা মনে পড়বে এই ঘড়িটার দিকে তাকাবে৷’

আবেশ সেদিন অবাক চোখে তাকিয়ে ছিলো সাত বছর বয়সী মাধুর্যের দিকে ৷ সে তখন সবেমাত্র চৌদ্দ বছর বয়সের কৈশোরে পা দেওয়া কিশোর৷ ঘড়িটা পরার পর আবেশের সে’কী হাসি৷ পিচ্চি একটা মেয়ে তাকে উপহার দিয়েছে তাও তাকে মনে করার জন্য ৷ মাধুর্য তখন গাল ফুলিয়ে বলেছিলো,

‘ হাসবে না আবেশভাইয়া,জানো? আমি আম্মুর থেকে টাকা জমিয়ে জমিয়ে আব্বুকে সাথে নিয়ে তোমার জন্য ঘড়ি কিনেছি৷ আর নাজিফার জন্য একটা মেয়ে পুতুল৷ আমাদের যখন আবার দেখা হবে তখন আমার ছেলের সাথে ওর মেয়ের বিয়ে দিবো৷’

আবেশ সেদিন খুব হেসেছিলো মাধুর্যের কথায়৷ মাধুর্য সেইসব কথা মনে করে নিজে হেসে উঠলো৷ বিষাদময় হাসি ৷ আবেশ মাধুর্যের দিকে এগিয়ে গিয়ে ঘড়ি আবার নিতে গেলে মাধুর্য ছিটকে দূরে গিয়ে দাঁড়ায় ৷ হাসতে হাসতে’ই বলল,

‘ আবেশ আপনি তো এখনো আমার সাথে দৌড়ে পারেন না৷ এতো বড় হয়ে কী লাভ হলো?’

‘ ফাজলামো করবে না,মাধুর্য৷ ভালো ভাবে বলছি আমার জিনিস আমাকে ফেরত দাও৷’

‘ সেদিন তো খুব হেসেছিলেন! আজ ও হাসুন৷ দেবো না ফেরত৷’ মাধুর্য খামখেয়ালী ভাবে বলছে৷ আবেশের রাগ তরতর করে বেড়ে চলেছে ৷ কারণ,মাধুর্যের পেছনেই খোলা বারান্দার দরজা৷ যেভাবে পিছিয়ে যাচ্ছে আর কয়েক কদম গেলেই নীচে পড়বে ৷ আবেশ তার নিজের শখের জন্য’ই দুটো বারান্দা বানিয়েছে ৷ একটা আটকানো আরেকটা খুলে রাখা৷ মাধুর্যের দিকে তাকিয়ে নিজেকে ঠান্ডা করে বলল,

‘ ওকে,ফাইন৷ তুমি সামনে আসো৷ আই সোয়্যার,কিছু করবো না৷’

‘ ছোটবেলার মতো ধোঁকা দিবেন,তাই না? আমি সামনে গেলেই খপ করে ধরে ফেলবেন আমার হাত৷’

মাধুর্যের বাচ্চাসুলভ কথায় রাগ গলে পানি হয়ে গেলো আবেশের৷ তবুও নিজের গাম্ভীর্যতা ধরে রেখে বলল,

‘ আমাকে তোমার বাচ্চা মনে হয়! যে,বাচ্চামো করবো?’

‘ আপনি তো বাচ্চা’ই৷ বাচ্চা না হলে কেউ মায়ের কাছে কাঁদতে যায়,এখনো?’

মাধুর্যের কথা শুনে নাজিফাকে ঠাটিয়ে চড় মারতে ইচ্ছা হলো আবেশের ৷ তার সব সিক্রেট ফাঁস করে দিচ্ছে সে ৷

‘ তোমার সাথে চোখে নেই?পেছনে তাকিয়ে দেখো খোলা বারান্দা৷’

আবেশের কথায় মাধুর্য তাকালো ৷ সত্যি সত্যি খোলা বারান্দা ৷ বিভিন্ন গাছ দিয়ে ঘেরা ৷ বুনোফুল ছেয়ে আছে লতানো গাছের মধ্যে৷ বৃষ্টির জন্য জমে আছে পানি ৷ সবুজ ছোট ছোট ঘাস ঘিরে আছে মেঝেতে ৷ বিশাল একটা পাত্রের মাঝে রাখা গুটিকয়েক পদ্মফুল ৷ হাওয়ার তালে ঢেউ খেলছে জমে থাকা পানি ৷ বুনোফুলে থেকে মন মাতানো সৌরভ ভেসে আসছে৷ মাধুর্য অবাক হয়ে গেলো ৷ এতো সুন্দর!
আবেশের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ এইটা আপনার বারান্দা?’

‘ আমার কেন হবে! পাশের বাসা থেকে ধার করে এনেছি৷’

আবেশ কাঠখোট্টা জবাব দিলো ৷ তার রুমের সাথে লাগোয়া দেখেও বোকার মতো প্রশ্ন,’এইটা আপনার বারান্দা?’ হাও রিডিউকুলাউস কোয়েশ্চেন৷

‘ কতো সুন্দর!’

মাধুর্যের উচ্ছ্বসিত চোখ-মুখ দেখে আবেশ মনের অজান্তেই বিরবির করে বলল,

‘ এখানে যখন আকাশ বেয়ে বৃষ্টি ঝরে, বুনোফুল হাওয়ার তালে দুলে উঠে,পদ্মপাতা তিরতির করে কাঁপে তখন আমার অতি প্রিয় একজনের কথা মনে হয়,যে আমাকে অতল সাগরে রেখে হারিয়ে গিয়েও দুঃখের পসরা নিয়ে ফেরত এসেছে৷’

‘ কিছু বললেন?’ মাধুর্য প্রশ্নসূচক চোখে তাকিয়ে বলতেই আবেশ ঠোঁট নাড়ানো বন্ধ করে দেয়৷ মাধুর্য সে দিকে পাত্তা না দিয়ে বলল,

‘ আমি বারান্দায় যাই,একটু?’

‘ না যাবে না৷’

আবেশের ‘না’ শুনে মাধুর্যের মন খারাপ হয়ে যায়৷ হাতের ঘড়িটা পাশে থাকা ড্রেসিংটেবিলের উপর রেখে আবেশের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ আমি যাবো৷ আর সেটা এখুনি৷’

‘ মাধুর্য আমি মানা করেছি,তুমি যাবে না৷’

আবেশ দ্রুত হেটে মাধুর্যের দিকে এগিয়ে যায় ৷ সম্পূর্ণ বারান্দার মেঝে শ্যাওলায় পিচ্ছিল হয়ে আছে বৃষ্টির কারণে৷ তারউপর সামনে কংক্রিট নড়বড়ে হয়ে গেছে কিছুদিন হলো৷ সেখানে পা পড়লে যেকোনো সময় ভেঙে পড়বে৷ আজকে মেরামতের করার জন্যই খুলে রেখেছিলো সে ৷

‘ মাধুর্য,ওখানে পা দিয়ো না৷ আর রুমে আসো দ্রুত৷’

আবেশ ভেজা মেঝেতে পা রেখে শাসনের সুরে বলল৷ মাধুর্য পদ্ম ছুঁয়ে দিতেই তার ভেতর শিরশির করে উঠে ৷ পদ্মপাতা দোল খাচ্ছে৷ পদ্ম ফুল যেন মুখ উঁচিয়ে তাকে কিছু বলতে চাইছে ৷ মাধুর্য উপরের দিকে তাকাতেই টুপ করে একবিন্দু পানি তার চোখে পড়ে৷ সাথে সাথেই খিলখিল করে হেসে উঠে সে ৷ আবেশ ঘোরে চলে গেলো মুহূর্তেই৷ তার দৃষ্টি অস্থির ৷ কন্ঠনালী তে সব শব্দ দলা পাকিয়ে আছে ৷

‘ কাঠগোলাপ,বেলী৷ এতোকিছু!’ মাধুর্য কখন উঠে গেছে আবেশ টের পায় নি ৷ বিশাল টবে রোপণ করা কাঠগোলাপের গাছ৷ যা বারান্দার একদম কিনারা ঘেঁষে লাগানো ৷ আবেশ হুঁশ ফেরে ৷ আবারো কঠোর গলায় বলল,

‘ মাধুর্য ওখানে যাবে না ৷ জায়গাটা নড়বড়ে৷ ফেরত আসো৷’

‘ দেখুন ফুল ফুটছে৷ আমি একটা ফুল ছিড়েই চলে আসবো৷’

মাধুর্য ভাবছে আবেশ তাকে মিথ্যা বলে সরিয়ে আনতে চাইছে ৷ সে কথা না শুনেই এগিয়ে যায় ৷ সাথে সাথেই পা পড়ে নড়বড়ে জায়গায়৷ কেঁপে উঠে মাধুর্য ৷ আবেশের দিকে মাধুর্য অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল,

‘ এই জায়গাটুকু কাঁপছে কেন,আবেশ?’

আবেশ যা ভয় পেয়েছিলো সেটাই হলো৷ বৃষ্টির জন্য জায়গা আরো নড়বড়ে হয়ে গেছে৷ মাধুর্যকে বলল,

‘ বারবার মানা করার পরেও কেন গেলে ওইখানে? তোমার একরোখা স্বভাব কবে যাবে? ছোটবেলায় যেমন জেদ ধরতে এখনো সেই একই জেদ ধরে রাখো৷ ড্যাম…’

‘ আবেশ আমি পড়ে যাবো,কিছু একটা করুন৷’

‘ যাও সমস্যা নেই৷ ছেড়ে তো চলে যেতে চাও সেটা না’হয় এখুনি হোক৷’

আবেশের কথাশুনে মাধুর্য অবাক হলো৷ অনবরত কাঁপছে৷ নীচে তাকিয়ে দেখলো সম্পূর্ণ খালি জায়গা ৷ চারতলার উপর থেকে পড়লে সে কী বাঁচবে?
বাঁচার কথাটা মাথায় আসতেই সে হাসলো ৷ কয়েকদিন আগেও নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলো কোনোকিছু না ভেবেই৷ আর আজ? বাঁচার প্রশ্ন মাথায় আসছে৷

‘ হাত দাও৷’ আবেশ হাত বাড়িয়ে বলল৷ মাধুর্য অস্থির কন্ঠে বলল,

‘ আপনি এখানে এসেছেন কেন? দূরে যান৷’

‘ একটা কথাও বলবে না৷’ আবেশ ধমকে উঠে বলল ৷ মাধুর্য এইবার ভয় পাচ্ছে৷ সে মরে গেলে যাবে কিন্তু আবেশের কিছু হলে?

‘ পেছনে যান আপনি৷ এখানে আসবেন না৷’

‘ হাত দিতে বলেছি মাধু৷’

আবেশের কন্ঠে আকুলতা৷ মাধুর্য দেখলো আবেশ তার কাছাকাছি এসে দাঁড়াচ্ছে ৷ নড়ে উঠলো কংক্রিটের শক্ত আস্তরণ ৷

চলবে…

[মোড় ঘুরবে আবার৷সো,রেডি থাকুন৷আর অবশ্যই বলবেন কেমন হচ্ছে]