মজিলো_প্রেম_সখার_সনে পর্ব-০৯

0
179

#মজিলো_প্রেম_সখার_সনে_০৯

চুপচাপ সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে ফিহা, তিহা আর মোহনা । ফিহা মাথার নিচে একটা হাত রেখে এক দৃষ্টিতে কাব্যের দিকে তাকিয়ে আছে আর মনে মনে ভাবছে কেন ফিরোজ এমন করলো।কি এমন করেছে কাব্যে যার জন্য ওকে ভয় দেখানোর প্রয়োজন!ফিহা কোনোভাবেই বুঝতে পারছে না কাব্যের অন্যায়টা কি হতে পারে । কাব্যে তো বেশ ভালো ছেলে;সব টিচারদেরও খুব সম্মান করে;সব সময় তো সবার সাথে ভদ্র ভাবে ব্যবহার করে;তাহলে কি হতে পারে ফিহা মনে মনে ভেবেই যাচ্ছে।

তিহা আর মোহনা তখন থেকেই খেয়াল করছে ফিহা যেন কি নিয়ে ভাবছে।কিন্তু সাহস করে জিজ্ঞেস করতে পারছে না।কফি নিয়ে আসার পর থেকেই সে এমন চুপচাপ কিছু একটা নিয়ে ভেবেই চলছে।কিন্তু কি সেটা?দ্বন্দ্ব কাটিয়ে আমতা আমতা করে তিহা ফিহাকে জিজ্ঞেস করে ,,

”কি হয়েছে ফিহা ?কফি নিয়ে আসার পর থেকেই দেখছি তুই কি যেন ভাবছিস! কি নিয়ে এত ভাবছিস?”

তিহার কথা শুনে ফিহা মাথা তুলে সোজা হয়ে বসে।তারপর জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে তিহাকে কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই মোহনা চেঁচিয়ে উঠে বলে ,,

” ফিহা দেখ কাব্যের ডান হাতের আঙ্গুল গুলো নড়ছে।তারমানে ওর জ্ঞান ফিরেছে। ”

মোহনার কথায় ফিহাও কাব্যের দিকে তাকায় ।ও দেখে সত্যি কাব্য ডান হাতের আঙ্গুল গুলো হালকা করে নাড়াচ্ছে।সেটা দেখে ফিহার মুখে হাসি ফুটে উঠে।ফিহা সোফা থেকে উঠে কাব্যের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।তারপর তিহাকে উদ্দেশ্য করে বলে,,

”দোস্ত সামনেই দেখ ডাক্তারের কেবিন;প্রান্ত ভাইয়া সেখানেই আছে।তুই একটু উনাকে গিয়ে বলে আয় যে কাব্যের জ্ঞান ফিরেছে।”

তিহা মাথা নেড়ে বলে,
”ঠিক আছে যাচ্ছি।”

কাব্য ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায়।চারপাশে চোখ বুলিয়ে বুঝার চেষ্টা করছে সে এখন কোথায় আছে।ডান দিকে ফিরে ফিহাকে দেখতেই কাব্যের মুখে হাসি ফুটে উঠে;কাব্যের হাসি দেখে ফিহাও মৃদু হাসলো।তারপরে জিজ্ঞেস করলো এখন কেমন আছেন?

কাব্য হাসার চেষ্টা করে বলে ,,
”চিন্তা করিয়ো না মরিনি বেঁচে আছি।”

কাব্যের কথায় ফিহা রেগে ব্রু কুঁচকে বলে ,,,

” আপনি আর মানুষ হবেন না। এই সময়ও আপনার মুখ দিয়ে ত্যারা ত্যারা কথা বের হবেই তাই না। ”

ফিহা কথায় কাব্যে হালকা হাসে।ততক্ষনে প্রান্ত আর ডাক্তারও কাব্যের কেবিনে চলে আসে।কাব্যেকে দেখে প্রান্ত নিচু হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে ভেজা কন্ঠে বলে ,,,
”কেমন আছিস ভাই ?”

কাব্য আলতো হাতে ভাইকে জড়িয়ে ধরে বলে ,,

”তোর ভাই অলওয়েজ ভালো থাকে।এইরকম ছোট খাটো ব্যাপার তোর ভাইকে এতো সহজে কাবু করতে পারবে না বুঝেছিস?”

কাব্যর কথায় মুচকি হেসে মাথা তুলে প্রান্ত। তারপর ডক্টরের দিকে তাকিয়ে বলে,
”ডাক্তার সাহেব এখন আমার ভাই একদম সুস্থ আছেতো?আর কোনো সম্যসা নেয় তো?”

ডাক্তার কাব্যর হাতের পালস চেক করতে করতে বলে ,,,
” আলহাদুলিলাহ এখন আগের থেকে অনেকটাই বেটার।কয়েকদিন হসপিটালে থাকতে হবে। ব্যান্ডেজ খুলা পযর্ন্ত ফুল বেড রেস্ট হসপিটালে নিতে হবে। তবে হ্যা পেসেন্টকে এক্ষুনি কিছু জিজ্ঞেস করা যাবেনা। নাহলে ব্রেইনের সমস্যা হতে পারে। ”

প্রান্ত ডাক্তারকে আশ্বস্ত করে বলে ,,

”না ডাক্তার চিন্তা করবেন না ।কাব্যর প্রব্লেম হবে এমন কোনো কাজই আমরা করবো না।”

ডাক্তার স্টেথোস্কোপটা গলায় রাখতে রাখতে বলে ,,

” ঠিক আছে।আপনারা উনার কাছে থাকুন।আর এখনি আমরা উনাকে কোনো মেডিসিন দিচ্ছি না।বিকেলের পর উনার মেডিসিন দেয়া হবে;তার আগে উনাকে একটা সুপ্ খাওয়ানো হবে যেটা আমাদের ক্লিনিক থেকেই দেয়া হয়।সুপ্ খাওয়ানোর পরই উনাকে মেডিসিন দেওয়া হবে।আমি আমার কেবিনে আছি;কোনো প্রয়োজন হলে ডাকবেন;আর উনাকে বেশি ডিস্টার্ব করবেন না। ”

”ওকে ডক্টর”

ডাক্তার সাহেব রুম থেকে বেরিয়ে গেলে প্রান্ত কাব্যর মাথায় হাত রেখে বলে ,,,

” জানিস ভাই আমি তোকে এইভাবে দেখে কত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।কিছুক্ষনের জন্য মনে হচ্ছিলো আমার পুরো পৃথিবী বুঝি অন্ধকার হয়ে এসেছে;তোর কিছু হলে যে আমিও মরে যেতামরে ভাই ”

ভাইয়ের কথা শুনে কাব্য মৃদু হেসে বলে ,,,

” তোর ভাইয়ে প্রাণ হলো কৈ মাছের প্রাণ;সহজে মরবে না।তাই এত চিন্তা করিস না।তোকে জ্বালানো তো এখনো শেষ হয়নি;তোকে আগে প্রচুর জ্বালিয়ে নেই;তারপর একটা শাকচুন্নি মার্কা বউ খুঁজে তোর বিয়ে দিয়ে তবে গিয়েই আমি শান্তিতে মরতে পারবো এর আগে না।বুঝেছিস ভাইয়া?”

কাব্যর কথা প্রান্তর মোটেও পছন্দ হয়নি।তাই সে রেগে গিয়ে বলে ,,,

” তুই কিন্তু এখনি আমার হাতে মার খাবি বলে রাখলাম আর একটাও উল্টা পাল্টা কথা বললে ।”

প্রান্তের কথা শেষ হতেই অনু বলে উঠে ,,,

” জি ভাইয়া ওকে মারারই প্রয়োজন।দেখুন না জ্ঞান ফিরার পর থেকেই এমন উল্টা পাল্টা বকে যাচ্ছে।মাথার স্ক্রু তো আগে থেকে ঢিলা ছিলই এখন মেবি ওই ঢিলা স্ক্রু খুলে গিয়েছে তাই এই আজাইরা প্রলাপ শুরু করেছে ।”

ফিহার কথায় কাব্য ওর দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলে ,,

” কি করবো বলো তোমাকে দেখলেই তো আমার মাথার সব স্ক্রু ঢিলা হয়ে যায়।এতে আমার কি দোষ?”

প্রান্ত সামনে না থাকলে বোধ হয় ফিহা কাব্যর এমন কথায় ওর সাথে রাগ দেখাতো কিন্তু প্রান্তর সামনে ফিহার রাগটা লজ্জায় পরিনিত হয়েছে।আর প্রান্ত গলা খাকরি দিয়ে বলে,,

”ভাই এখানে তোর বড় ভাইও আছে।তাই একটু সাবধানে কথা বলিস।”

কাব্য ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,
”আরে ভাই এত চাপ নিয়ো না;যা শুনেছ তা ভুলে যাও;ওকে!”

ফিহা এবার কড়া গলায় বলে,,
”এই আপনি চুপ করবেন ;ডক্টর আপনাকে রেস্ট নিতে বলেছে।আপনি এতো কথা বলছেন কেন?”

কাব্য বাঁকা চোখে ফিহার দিকে তাকিয়ে বলে ,,
”ঠিক আছে তুমি বলছো যখন তখন না হয় চুপই থাকলাম ।”

ফিহা আর কাব্যকে কিছু না বলে প্রান্তকে বললো ,,,
”ভাইয়া ভার্সিটিতে একবার জানিয়ে দেয়ার প্রয়োজন যে কাব্যর জ্ঞান ফিরেছে।”

ফিহার কথা শুনে প্রান্ত বলে ,,
”ওহ হ্যাঁ।আমি এক্ষনি প্রিন্সিপাল স্যারকে কল করে বলে দিচ্ছি।”

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই ফিহা, তিহা আর মোহনা নিজ নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।যদিও ফিহার আরো কিছুক্ষন থাকার ইচ্ছে ছিল কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে যাওয়াই স্যাররা ওদের সেখানে থাকতে না দিয়ে নিজ নিজ বাড়িতে চলে যেতে বলে।আজ আর হসপিটালে পুলিশ যাবে না কাব্যর স্টেটমেন্ট নিতে; প্রান্ত না করেছে।ডাক্তার বারণ করেছে বিধায় সে ও চায় না তার ভাইয়ের কোনোপ্রকার অসুবিধা হোক।তাই কাল থেকে কাব্যর মামলার তদন্ত শুরু হবে;আর ফিহাও মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে কাল কাব্যর স্টেটমেন্ট নেয়ার সময় ফিহাও হসপিটালে থাকবে আর ও যা জানে সবটা পুলিশকে বলবে।তারপর বাকিটা কালই বুঝা যাবে।

(★)

রাত বারোটা খান বাড়িতে সবাই রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ছে। ফিহা টেবিলে বইয়ের উপর মুখ গুজে রেখে গভীর চিন্তা করতেছে। আচ্ছা ফিরোজ স্যার কাব্যকে কেন ভয় দেখাইতে চাইলো? কাব্য কি করেছে এমন। যারজন্য এভাবে ভয় দেখাতে হবে। ফিরোজ স্যার কি ভালো মানুষ। নাকি ভালো মানুষের উপর আরেকটি রুপ রহস্য রয়েছে। আচ্ছা ফিরোজ ক্যান শাফখাত ভাইকে তার পরিচয় গোপন রাখতে বলেছিলো। ফিরোজ স্যারের এই দুটি যুক্তির পিছনে আসল কারণ কি? ফিরোজ স্যার আগ থেকে তিহা ও শাফখাতের সম্পর্কের ব্যাপারে জানে এরপরেও বাড়িতে কাউকে কিছু বলে নাই কেনো? আর আমি বন্ধুদের ডেয়ারে চাপে তাকে চুমু দিয়েছিলাম। আমিতো অনেক শঙ্কায় ছিলাম আমার বোধহয় টিসি নিশ্চিত। কিন্তু ফিরোজ স্যারতো প্রিন্সিপালকে বলেছিলো সামান্য কারণ। এসবের মানে কি এতগুলা প্রশ্ন। উত্তর দিতে পারবে শুধু একজন সে শুধুই ফিরোজ। ফিরোজ স্যার তো জানে আমার বাবার ব্যাপারে। ফিরোজ স্যার আমার আটবছরের বড়। বাবা যখন বিয়ে করছিলো তার বয়স ০৫ ছিলো? তারমানে তার স্মৃতিতে অবশ্যই বাবা ছিলো। আচ্ছা বাবাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার পর কি ফিরোজ স্যারের সঙ্গে বাবার সম্পর্ক কি স্বাভাবিক ছিলো। আমার মন বলছে ফিরোজ স্যার আমাকে অনেকদিন আগ থেকে চিনে। নাহলে ভার্সিটিতে অনেক স্টুডেন্টের মধ্যে আমাকেই কড়া শাসন করতো। আবার আমাকেই স্পেশাল স্পেশাল ফিল করাতো। উফফ দম বন্ধ লাগছে এতো প্রশ্ন মাথায় কেনো ঘুরপাক খাচ্ছে।

ফিহা টেবিল থেকে মাথা তুলে। এরপরে বইটা বন্ধ করে। এতো প্রশ্নের মাঝে দম বন্ধ লাগছে রুমে। তাই ছাঁদে যেতে চাইলো। কিন্তু রাত বারোটা একা একা ছাঁদে যেতেও ভয় লাগছে। ডিলনাসিন, পারিজাত ঘুমিয়ে রয়েছে। ফিহার মাথায় চাপ দিয়ে আসলো ফিরোজের ব্যাপারে রহস্যময় প্রশ্নগুলো। বুকে সাহস সঞ্চয় করে আকাশের চাঁদ,প্রকৃতির বাতাস উপভোগ করার জন্য রুম থেকে বেরিয়ে ছাঁদে আসলো।

ছাঁদে এসে ফিরোজকে দেখতে পাবে কস্মিনকালেও ভাবতে পারে নাই ফিহা। ফিরোজকে দেখে ফিহার মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। মনে মনে বলে আপনি কি আমাকে শান্তি দিবেন না ঘরের মাঝে মস্তিকে ভর করেন। ছাঁদে আসলাম আপনাকে মস্তিষ্কে থেকে সরাতে এখানেও আপনি। ফিরোজকে দেখে চলে যেতে লাগলো ফিহা। পিছনে থেকে ডাক দেয় ফিহা এতোরাতে ছাঁদে ক্যানো? ঘুম ধরতেছে না।

ফিহা থেমে উত্তর দেয় ফিরোজের কথায়! যেখানে আপনিনামক চিন্তা মাথায় ভর করে আছেন সেখানে ঘুমাই কি করে? এরপরে ফিহা হাটা শুরু করে সিড়িতে ডান পা ফেলে বামপা ফেলানোর জন্য পা বাড়ায়। তখন ফিরোজ এসে পিছন দিক থেকে ফিহার ডানহাত চেপে ধরে টান দেয়। ফিহা একটানে ফিরোজের বুকে মাথা গুঁজে দেয়। সময়টা যেনো থমকে দিতে ইচ্ছে করলো ফিরোজের। এভাবেই ফিহাকে নিয়ে আটকে থাকতে চায় কিছুক্ষণ। ফিহার চুলে স্যাম্পুর ঘ্রাণ ফিরোজকে বিমোহিত করছে। ফিহা ধাক্কাধাক্কি করেও ফিরোজকে সড়াতে পারছেনা। একটা সময়ের পর ফিরোজ নিজেই ছেড়ে দেয়। এরপরে বলে আমায় নিয়ে কি চিন্তা করছিলে। যারজন্য তোমার চোখের ঘুম হারাম করে নিলাম!

ফিহা ফিরোজের ব্যবহারে কম্পিত। কারণ ফিরোজ আজ তাকে একটুআগে যেভাবে জড়িয়ে ধরছিলো। ফিহার মনে খটকা লাগা শুরু করে। মনে মনে বলে ধলাবিলাইয়ের আজ হলো টা কি?

কি হলো ফিহা কথা বলছো না কেনো? আমি তোমাকে কি টেনশন দিলাম যারজন্য তোমার চোখের ঘুম হারাম হয়ে গেলো। ফিহার ধলাবিলাইয়ের কাছে দাঁড়াতেও আজ দমবন্ধ লাগছে তাই ফিরোজের কথার উত্তর না দিয়ে দৌড়ে পালায় সেখান থেকে।

ফিরোজ ঠোঁটের কোণে হাসি রেখা ফেলে। এরপরে পকেট থেকে সিগারেট বের করে লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে টান দেয়। ধোঁয়াগুলো আকাশে উড়িয়ে দিলে বলে__

❝ আর কতো পালাবে প্রেয়সী একদিন ঠিক সিগারেটের ধোঁয়া হয়ে আমার কাছে আসবে। তোমার গোপন কথাগুলো বলবে। ❞

চলবে,,,

®️ রিয়া জান্নাত