মনের মানুষ পর্ব-০৮

0
381

#মনের_মানুষ ❤️
#অষ্টম_পর্ব❤️
#কলমে_সাঁঝবাতি 🌸

কিছু কিছু মানুষের আন্তরিক ব্যবহার এতখানি ভালোবাসাপূর্ন হয় যে কিছু সময়ের মধ্যেই সেই মানুষগুলোকে আপন করে নেওয়া যায়।এই যেমন শান্তিনিকেতন থেকে আরো ভেতরের ছোট্ট একটা গ্রামে থাকা মানুষগুলোর ব্যবহার আহেলিকে অবাক করে দিয়েছে।মাত্র কিছুক্ষণের মধ্যেই বাবলু আর ওর বাবা-মায়ের সাথে সকলের একটা দারুন সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।এই মানুষগুলোর মধ্যে অনেক বৈভব বা অর্থ প্রাচুর্য নেই কিন্তু আছে সৌহার্দ্যপূর্ন ব্যবহার…..আপন করে নেওয়ার কৌশল।

আসন পেতে লম্বা সারি দিয়ে বাবলুর মা খেতে বসতে দিলো সবাইকে……প্রান্তিকের কথাতেই একটু আগে কলাপাতা কেটে আনা হয়েছে।মাংস ভাত নাকি কলাপাতায় খাওয়ার মজাই আলাদা……সকলে মিলে একসাথে ওরা খেতে বসলো।বাবলুর মা আর বাবা শুধুমাত্র থেকে গেলেন……আহেলি ওনাদের বসার অনুরোধ করতেই বাবলুর মা জানালো উনি যদি বসে পরেন তাহলে খেতে দেবে কে?আর বাবলুর বাবা নাকি ওর মায়ের সাথে ছাড়া খেতেই চায় না।তবে বাবলু আজ ভীষণ খুশি…..খাওয়ার সময়েও প্রান্তিকের সাথে বকবক করেই যাচ্ছে।

একগ্রাস ভাত মুখে তুলতেই আহেলি বুঝলো প্রান্তিক একটুও বাড়িয়ে বলেনি রান্নার বিষয় নিয়ে…..সত্যিই অপূর্ব।আহেলি এবং বাকি সকলেই খুব তৃপ্তির সাথে খেয়ে নিলো।অনু,সৌমিলি রিয়া আর সপ্তক তো পারলে বাকি দিনগুলোও এখানেই খেয়ে যাওয়ার প্ল্যান করে ফেলে।খাওয়ার পর সকলেই ভীষণ খুশি….সপ্তক তো বলেই ফেললো যে এবার যখনই শান্তিনিকেতন আসবে তখনই এখানে এসে খেয়ে যাবে।প্রায় অনেকটা রাত অব্দি ওখানে কাটিয়ে রিসোর্টে ফেরার জন্য পা বাড়ালো সকলে…।

আহেলি প্রায় অনেকক্ষণ ধরেই ঋষভ এর নাম্বারে কল করে যাচ্ছে…কিন্তু ওদিক থেকে রিসিভ হওয়ার নাম নেই।বারকয়েক লাগাতার কল করার পর একেবারে সুইচ অফ করে দিলো।আহেলি বেশ অবাক হলো…..এতো রাতে ঋষভ তো কোনো কাজে থাকে না,তবে এখন ফোন ধরলো না কেনো?কাল রাত্রেই বলেছিলো যে এবার থেকে আহেলি যখনই ফোন করবে তখনই রিসিভ করে অনন্ত দুমিনিট হলেও কথা বলবে….কিন্তু এতরাতে ঋষভ কোন কাজে ব্যস্ত?

রিসোর্টে ফিরে যখন আহেলি ঘুমাতে গেলো তখনো আরেকবার কল করলো….সুইচ অফ।আহেলির একবার মনেহলো মামনিকে ফোন করে জানতে যে ঋষভ কোথায় আছে জানার জন্য কিন্তু পরক্ষনেই মনেহলো সামনেই ইলেকশন তাই হয়তো ক্লান্তির চোটে ফোন সুইচ অফ করে ঘুমিয়েছে।এসব নানান ভাবনার মধ্যেই আহেলি ঘুমিয়ে পরলো।
🌸🌸🌸

সকাল সাতটা বাজে…..সূর্যের আলো কাঁচের জানলা দিয়ে ঋষভের মুখে পরতেই ঘুম ভেঙে গেলো ঋষভের।চোখ মেলে তাকাতেই চারপাশটা অচেনা মনেহলো……তৎক্ষনাৎ উঠে বসলো ঋষভ।এটা শ্রেয়ার বেডরুমে….কাল রাত্রের কথা মনে পরতেই ঋষভের বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো।চোখের সামনে আহেলির নিষ্পাপ হাসিমাখা মুখটা মনে ভেসে উঠলো…দুহাতে মুখ ঢেকে ফেললো ঋষভ।এটা ও কি করলো?!ঘরে কারোর পায়ের শব্দ পেয়ে মুখ তুলে তাকালো ঋষভ….আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শ্রেয়া চুল মুছতে মুছতে ঋষভ এরদিকে তাকিয়ে লাজুক হাসলো।

খাটের পাশে রাখা ফোনটা হাতে নিয়ে ঋষভ সুইচ ওন করতেই পরপর কয়েকটা মেসেজ ঢুকলো যার মাধ্যমে জানলো আহেলি কাল রাত্রে অজস্রবার ফোন করেছে।ঋষভ কল ব্যাক করতেই ওপাশ থেকে রিসিভ হলো।এদিক থেকে কিছু না শুনেই আহেলি উত্তেজিত গলায় বললো,,,,

“কাল রাত্রে তোমার ফোন সুইচ অফ ছিলো কেনো?আমি কতবার কল করেছি একবার চেক করো,তুমি কাল কোথায় ছিলে ঋষিদা?”

“আ-আমি আ-আবার কোথায় থাকবো?বাড়িতেই ছিলাম….”

“তাহলে এতবার কল করার সত্বেও রিসিভ করলে না কেনো?আমি কতো টেনশন করছিলাম”

“আসলে তুই যখন কল করছিলিস তখন আমি ওয়াশরুম গেছিলাম রে….আর ফিরে এসে কল রিসিভ করার আগেই ব্যাটারি লো হয়ে গিয়ে সুইচ অফ হয়ে গেলো।তাই আর করা হয়নি।”

“চার্জে বসিয়েও তো একবার কল করতে পারতে নাকি?”

“আহেলি তোর কি হয়েছে বলবি?বারবার কাল রাত্রের কথা জিজ্ঞেস করছিস কেনো?ক্লান্ত ছিলাম তাই চার্জ দিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”

“ওহ!আসলে খুব চিন্তা হচ্ছিলো তাই জন্য…..বাদ দাও ও কথা।তোমার আজ নিশ্চই মিটিং আর জনসভা আছে?”

“হুমমম।তুই কোথায় এখন?”

“আমি?আমি তো সারাদিন ঘুরেই চলেছি….আজ ছাতিমতলায় যাবো।আর বিকেলে খোয়াই হাটে যাওয়ার প্ল্যান আছে……বলছি ঋষিদা।তোমার জন্য কি কিনবো বুঝতে পারছি না।না মানে তুমি তো ঘর সাজানো জিনিস নিয়ে গেলে ওতোটা পছন্দ করবে না…..ভালো পাঞ্জাবি পেলে নিয়ে যাবো তোমার জন্য?”

“আমার কিছুই চাই না…..তুই ভালো করে এনজয় কর।আমি রাখলাম।”

বলেই কোনো কথা না বাড়িয়ে ঋষভ কেটে দিলো কলটা।গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঋষভ চোখ তুলে দেখলো ওর সামনে দুহাত বুকের কাছে ভাজ করে শ্রেয়া দাঁড়িয়ে….শ্রেয়ার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখে ঋষভ বললো,,,,

“কি হয়েছে?”

“কে কল করেছিলো?”

“আমিই করেছিলাম আহেলিকে….কাল অনেকবার ট্রাই করে পায়নি তাই জন্য”

“আহেলি?আইমিন তোমার ওই ফিয়ন্সে?”

“হুমমম।কিন্তু শ্রেয়া এটা কি ঠিক হলো?”

ঋষভের কথায় শ্রেয়া মৃদু হেসে ঋষভ এরপাশে বসলো…..ঋষভের একটা হাত জড়িয়ে ওর কাঁধে মাথা রেখে মৃদু গলায় বললো,,,

“তুমি জানো না ঋষি কাল আমি কতটা আনন্দ পেয়েছি…..কাল তুমি বুঝিয়ে দিয়েছো যে তুমি একমাত্র আমাকেই ভালোবাসো।”

“এটা হওয়া উচিত হয়নি….আমার তখন যে কি হলো কে জানে?আর তুমিও বাঁধা দিলে না।”

“বাধা দিতে যাবো কেনো?যাকে ভালোবাসি তাকে কি বাঁধা দেওয়া যায়?আর বাঁধা দিলেই কি মানতে তুমি?”

“আমি একজনের কাছে কমিটেড….মেয়েটা আমায় পাগলের মতো ভালোবাসে।আমি কিকরে ওর সামনে যাবো?”

“রিলাক্স ঋষি!ইউ নো হোয়াট….ওই মেয়েটা তোমায় ডিসার্ভ করে না।আমায় যদি তুমি ভালোই না বাসতে তাহলে কালকের রাত্রের ঘটনাটা ঘটতোই না……তুমি ওই আহেলি কে ভালোবাসো না।আমায় ভুলতে বা সাময়িক মোহে ওকে ভালোবাসা ভেবেছিলে…..আমার দেওয়া আঘাত মানতে না পেরে ওকেই লাইফ পার্টনার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে….কিন্তু তুমি আদতে মেয়েটাকে ভালোইবাসনি।ঋষি সত্যি বলতে কি আমিও চাই না আর তোমার থেকে আলাদা থাকতে।ইলেকশন শেষ হলেই আমরা বিয়ে করবো কেমন?”

“বিয়ে?তাহলে আহেলির কি হবে?”

“ওহ কাম ওন ঋষভ!তুমি কি ভাবলে?শ্রেয়াকে একরাত ইউস করে তারপর ভালো ছেলের মতো বিয়ের পিঁড়িতে বসবে?এটা কিন্তু হবে না…আরে বাবা আহেলির সাথে ব্রেকআপ করে নাও।তাহলেই তো ঝামেলা মিটে যায়।”

“কিন্তু আমি কি বলবো?মেয়েটা খুব ইমোশনাল….ও সহ্য করতে পারবে না এই আঘাতটা”

“ঋষি প্লিস…মেয়েটা তো আর একেবারে ছোট্ট নয় যে বুঝবে না।তুমি ওকে বোঝালেই ও বুঝবে…..দরকার হলে আমি তোমার সাথে থাকবো।”

ঋষভকে চুপ করে থাকতে দেখে শ্রেয়া ঋষভ এর মুখটা দুহাতের মধ্যে নিয়ে বললো,,,

“এতটা চিন্তা করোনা…..যা হলো ভালোই হলো।তুমি এমনিই মেয়েটাকে বিয়ে করলে মেয়েটা সুখী হতো না।তুমি একবার ভেবেই দেখো না,যদি তুমি আহেলি কে সত্যিই ভালোবাসতে তাহলে কি আমায় কাল রাত্রে কাছে টেনে নিতে?নাকি যখন ওর কল আসছিলো তখন নিজের থেকে ফোনটা কেটে সুইচ অফ করে দিতে?তুমিও ভালো করে জানো যে আহেলি কে তুমি ভালোবাসো না।তাই ভালো এটাই হবে যে তুমি ওর সাথে ব্রেকআপ করে নেবে।”

ঋষভ একপলক শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো।শ্রেয়াও মৃদু হেসে ঋষভকে জড়িয়ে ধরে নিজের মনেই হেসে উঠলো।

🌸🌸🌸🌸

খোয়াই হাটে এসে আহেলি একেবারে বাচ্ছাদের মতো এদিকে ওদিকে যাচ্ছে….কোনটা ছেড়ে কোনটা কিনবে ঠিক করতেই পারছে না।এতো সুন্দর হাতে তৈরি সমস্ত জিনিস দেখে আহেলি রীতিমত পারলে গোটা বাজারটাই তুলে নিয়ে যায়…..সবসময়ের মতোই সপ্তক আর রিয়া একসাথে ঘুরছে।আহেলি সৌমিলি আর অনুশ্রী একসাথেই ছিলো…..একটা গয়নার দোকান দেখে আহেলি সেদিকেই এগিয়ে গেলো।এরআগে হাতে তৈরি ফেব্রিকের গয়না আহেলি কিনেছে কিন্তু এখানের পোড়ামাটির কানের দুলগুলো যে এতটা নজরকাড়া হবে তা ও জানতো না….বেশ কয়েকটা কানের দুল বাছাই করলো বাড়ি ফিরে মা,মামনি আর কয়েকজনকে দেওয়ার জন্য…কিন্তু নিজের জন্য কিছু নিলো না।তবে দোকান থেকে বেরোবার আগেই একটা গয়নার সেটের দিকে নজর গেলো….দোকানদারকে বলে সেটা হাতে নিয়ে দেখলো।সবুজ আর মেরুন রঙের কম্বিনেশনে তৈরি পোড়ামাটির হার আর দুল….আহেলির এটা নিজের জন্যেই পছন্দ হলো তবে নেওয়ার আগেই অনুশ্রীর ডাকে সাড়া দিতেই শুনলো ঘর সাজানোর জন্য ভালো কয়েকটা শো-পিস আছে ওই দোকানে তৎক্ষনাৎ আহেলি হাতের জিনিসটা রেখে সেদিকে এগিয়ে গেলো।

আহেলি দোকান থেকে যেতেই প্রান্তিক এসে দাঁড়ালো দোকানের সামনে…..রেখে যাওয়া গয়নার সেটটা হাতে নিয়ে মৃদু হাসলো তারপর নিজেই কিনে নিলো সেটা।গয়নার সেটটা প্যাক করে নেওয়ার ফলে কারোর নজরে গেলো না….প্রান্তিক হাটের বিভিন্ন দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করছিলো।সামনের একটা দোকানে চোখ যেতেই প্রান্তিক থেমে গেলো…..হাতে একটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূর্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আহেলি।পাশে অনুশ্রী ওকে কিছু একটা বলায় আহেলি রাগী অথচ লাজুক ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে…প্রান্তিক তৎক্ষনাৎ ক্যামেরা হাতে নিয়ে মুহূর্তটা বন্দি করে ফেললো।প্রান্তিক আহেলির দিকে তাকিয়ে নিজের মাথাতেই টোকা মারলো।হাটের একপাশে তখন বাউলের একটা দল গাইছে,,,,,,,

যখন ও-রূপ স্মরণ হয়,
থাকে না লোক-লজ্জার ভয়
-লালন ফকির ভেবে বলে সদাই
লালন ফকির ভেবে বলে সদাই
ঐ প্রেম যে করে সে জানে..
প্রেম যে করে সে জানে
আমার মনের মানুষের সনে
আমার মনের মানুষের সনে…
মিলন হবে কত দিনে…
মিলন হবে কত দিনে….
আমার মনের মানুষের সনে……

চলবে