মন গহীনের গল্প পর্ব-১+২

0
1468

#মন_গহীনের_গল্প
#রূবাইবা_মেহউইশ
#পর্ব-১

বিয়েটা করেই ফেলল রিশাদ তার অর্থ আর ক্ষমতার জোরে।বাড়িতে তার তিন মাসের ছেলেকে রেখে এসেছে সৎ মায়ের কাছে।রিশাদের ধারণা অর্থ দিয়ে সে সব নিজের করতে পারে। আর তাইতো ওই দুধের বাচ্চার জন্য আজ মাও কিনতে এসেছিলো। বিয়েটা তো করতে পারলো কিন্তু সংসারটা করবে কি করে? বউ নিয়ে বাড়ি আসার সময় তার সদ্য বিয়ে করা বউ পালিয়েছে মাঝপথেই। মেহউইশ গলা শুকিয়ে গেছে বলেই গাড়ি থামাতে বলল রিশাদকে। আর রিশাদও ভাবলো মেয়েটাকে বিয়ে তো করেই নিয়েছে এখন আর কষ্ট দিয়ে লাভ কি? খুব গরম না হলেও বিয়ের ভারী লেহেঙ্গায় ঘেমে নেয়ে কাহিল মেয়েটা। তার ঘর্মাক্ত মুখের দিকে তাকিয়েই রিশাদ ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলেছিলো। মেহউইশ গাড়ি থেকে নামতে গেলে রিশাদ ড্রাইভারকে বললো সামনে দোকান থেকে কোল্ড ড্রিংক আর পানি আনতে। ড্রাইভারও কথামত বেরিয়ে যেতেই মেহউইশ আবারও বলল, ‘আমি কি একটু গাড়ি থেকে বের হতে পারি? দমবন্ধ লাগছে।’

রিশাদ নিজেও অস্বস্তি বোধ করছিলো গরমে সিল্ক পাঞ্জাবী পরে৷ আর তাই সে বলল, ‘হুম!’

সে কি জানতো তার এই এক সম্মতি তার নতুন বউয়ের পালানোর পথ তৈরি করে দিবে! মেহউইশ গাড়ি থেকে বের হয়ে একপলক এপাশ ওপাশ দেখলো। রাত দশটা বাজেনি এখনও। রাস্তায় মানুষ খুব বেশি না হলেও কম নয় আর জায়গাটা মেইন রোডে হওয়ায় যানবাহন ছিলো অনেক৷ ফুটপাথে মানুষ কম আবার একটু পর পরই একটা করে গলির মোড়। মেহউইশ সুযোগ বুঝে একটা গলির ভেতর ঢুকে গেল। রিশাদ প্রথমে খেয়াল করেনি মেহউইশ গাড়ির সামনে থেকে চলে গেছে। ড্রাইভার যখন কাছে আসলো তখনই খেয়াল হলো মেয়েটা মানে তার বউ এখানে নেই। রিশাদ দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলো, ‘মেবিশ কোথায়?’

ড্রাইভার অবাক হয়ে তাকালো রিশাদের দিকে যার অর্থ সে কি করে জানবে বউ কোথায়? কিন্তু মুখে এই কথাটাই বলার সাহস হলো না ড্রাইভারের। কারণ, রিশাদ মনিব সে কর্মচারী।তারওপর রিশাদের ভয়ংকর স্বভাবগুলো ড্রাইভারের খুব ভালো করেই জানা। এই লোক কখনো কারো প্রতি দয়ামায়া দেখায় না। নিজের ভুলেও অন্যকে শাস্তি দেয়। রিশাদ ক্রোধে ফেটে যাচ্ছে মেহউইশ কি করে পালালো তার সামনে থেকে! মেয়েটা বিয়েতে রাজী ছিলো না শুরু থেকেই কিন্তু এতো তার দেখার বিষয় না। তার তিন মাসের বাচ্চাটাকে যেদিন অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতাল নিয়ে গেল সেদিন খুব কাঁদছিলো সেদিন মেহউইশ নামের ওই নার্সই একমাত্র তাকে শান্ত করতে পেরেছিলো। আর ডাক্তারও বলছিলো, ‘মা ছাড়া এতটুকু বাচ্চাকে কি করে বাঁচাবে!’ ব্যস ওই কথাটাই রিশাদকে পাগল করে দিলো। তার ছেলের জন্য মা হিসেবে মেহউইশকে নিতে৷ সে চাইলেই পারতো মেহউইশকে আয়া হিসেবে নিজের বাড়িতে রাখতে। কিন্তু তার সৎ মা জেবুন্নেসা ইশারা ইঙ্গিতে বুঝিয়েছে সন্তান কখনো আয়ার হাতে ভালোভাবে মানুষ হয় না। এই তো সে নিজেই আয়ার কাছে বড় হয়ে কেমন অমানুষ হলো। রাগ,ক্রোধ দমিয়ে রাখাটাই তো শেখাতে পারলো না তাকে আয়ারা। অথচ মা হিসেবে সৎ হলেও তিনি রিশাদের ভালোই চেয়েছেন সবসময়। এই ব্যপারটাই রিশাদকে প্রচণ্ড ভাবিয়েছিলো কদিন আর তারপরই নিজের ছেলের জন্য এই সৎ মায়ের ব্যবস্থা করা। সে একবারও ভাবেনি মেহউইশ মেয়েটা তার ছেলেকে মা হিসেবে কখনও ভালোবাসবে কিনা? তার ভাবনাশক্তি শুধু অর্থবিত্তে আর তার রাগে পর্যন্তই যেন সীমাবদ্ধ।

রাত তখন একটা পনেরো। ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে আছে রিশাদ পাশেই জুবুথুবু হয়ে বসে আছে মেহউইশ।একটু আগেই তাকে পুলিশ অফিসার কাইয়ূম মেহউইশদেরই মহল্লা থেকে ধরে এনেছে। মেহউইশ যখন পালিয়ে গেল তখনই রিশাদ কাইয়ূমকে ফোন করলো। কাইয়ূম পেশায় পুলিশ হলেও সে কাজ বেশি রিশাদেরই করে। কারণ মাস শেষে সরকারি বেতন আর রেশন কাইয়ূমের পেটের এক কোণাও ভরাট করতে পারে না আর তা সে রিশাদের টাকাতেই ভরে। রিশাদের ফোন পেয়ে কাইয়ূম তার রাতের খাবারটাও খায় নি। ফোর্স নিয়ে বেরিয়ে প্রথমেই সে তল্লাশি চালায় সেই গলিতে যে গলির দিকে মেহউইশ পালিয়েছিলো। এরপর দু চারজনের সাথে কথা বলে অনুমান করলো মেহউইশ নিজের মহল্লার দিকেই গেছে।

রিশাদ বউ ছাড়া বাড়ি ফিরেছে দেখেই তার খালা মানে সৎ মা জেবু ফিঁচেল হেসে বললেন, ‘ বিয়ে হয়নি বুঝি?’
রিশাদ রাগী চোখে তাকাতেই জেবুন্নেসা আবার বললেন, ‘ একা একাই যাওয়ার কি দরকার ছিলো? আমরা তো বেঁচে আছি সাথে নিলেই পারতে৷ অন্তত বউটা ঠিকঠাক বাসরঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিতাম।’

জেবুন্নেসা রীতিমতো টিপ্পনী কেটেই বলছেন রিশাদকে। রিশাদের বাবা রাশেদ দেশে নেই গত একমাস ধরে। তিনি টাকার নেশায় মজে থাকা মানুষ। ব্যবসার উন্নতি যখন যে দেশের দিকে তখন সেদিকেই দৌড়ান। জেবুন্নেসার দু’চোখের বিষ তার স্বামী মুখে না বললেও মনে মনে সবসময় দোয়া করেন যেন তিনি বিধবা হতে পারেন জলদিই। রিশাদকে বারবার বউ নিয়ে খোঁচা মেরে কথা বলায় রাগ দ্বিগুণ হয় তার আর তাই সোফার পাশে ফুলদানীটা উঠিয়ে সজোরে মারে জেবুন্নেসার পায়ের কাছে। রাত একটা পর্যন্ত সে বসার ঘরেই থম মেরে বসেছিলো আর জেবুন্নেসা ভয়ে সেই যে বসার ঘর ছেড়েছে আর আসে নি। এত সময়ের মাঝে একবার এসেছিলো রিশাদের সৎবোন রাইমা। বাচ্চাটা কাঁদছিলো বলে রাইমা তাকে নিয়ে বসার ঘরে আসে৷ ছেলের দিকে তাকিয়েই রিশাদের রাগ কিছুটা কমে যায়। রাইমার কাছ থেকে ছেলেকে নিয়ে রাইমাকে ঘুমোতে পাঠিয়ে দেয়। কাইয়ূম যখন মেহউইশকে ধরে নিয়ে আসে তখন রিশাদ বাচ্চাটাকে সোফায় শুইয়ে দিয়ে প্রথমে কাইয়ূমকে বিদায় করে। এবং তারপরই সে লাগাতার চার, পাঁচটা থাপ্পড় মারে। থাপ্পড়ের কারণে মেহউইশ নিঃশব্দে কান্না করে। সে ভয়ে,আতংকে তার বসে থাকা জায়গা থেকে এক পাও নড়েনি। এখনও ঠিক আগের অবস্থায় বসে আছে। রাতের আঁধার যতো গাঢ় হয়েছে ততোই রিশাদের নিঃশ্বাসের শব্দ মেহউইশকে ভীত,সন্ত্রস্ত করছে। জেগে থাকা মানুষের নিঃশ্বাস বোধহয় সে এতখানি জোর আওয়াজে কখনও শোনেনি। একবার ভাবলো রিশাদ বুঝি হাঁপানি, শ্বাসকষ্টের রোগী। তার তো আগে থেকে রিশাদ সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই। হাসপাতালে একদিন দেখেছে একটা অসুস্থ বাচ্চা নিয়ে এসেছে। যতটুকু বুঝেছে লোকটা দানবের মত এক হাতে তিনমাসের বাচ্চাকে বুকে চেপে ধরেছিলো। গাড়িটাও হয়তো এভাবেই চালিয়েছে। অতি দাম্ভিকতায় ঘাড় উঁচিয়ে হাঁট ছিলো লোকটা। মেহউইশের সামনে আসতেই বলেছে, ‘এখানে বেস্ট শিশু বিশেষজ্ঞ কে আছে?’ কন্ঠে যেন বজ্রপাত ঘটছিলো এত কঠিন আর ভারী কন্ঠ। মেহউইশ হাতের ইশারায় শিশুদের ডাক্তার নাইমা ম্যামের কেবিন দেখালো। তখনই বাচ্চাটা কাঁদতে থাকলে মেহউইশ হাত বাড়িয়ে বাচ্চাটাকে নিতে চাইলো। আর এই দানব লোকটা তাকে অবাক করে দিয়ে পকেট থেকে একটা স্যানিটাইজার পেন এগিয়ে বলল, ‘ হাত জীবাণুমুক্ত করে বাচ্চাকে ধরো।’ ব্যস সেই থেকেই মেহউইশের জীবনে এই দানব লোকের অত্যাচার। হাসপাতাল থেকে ফেরার দুদিন পরই রিশাদের পাঠানো এক লোক এলো হাসপাতালে। প্রথমবার ঠিকানা নিলো,দ্বিতীয়বার বিয়ের প্রস্তাব দিলো এবং তৃতীয়দিন মানে আজকে একদম বিয়ে করে এক বাচ্চার মা বানিয়ে দিলো। মন ভর্তি করা রাগ উপচে পড়ছে মেহউইশের সেই সাথে গাল দুটোতে ভীষণ ব্যথা। বসার ঘরেও বুঝি এসি চলছে! শীতল শীতল অনুভূতি হচ্ছে মেহউইশের। তার ঘরে তো ঠিকঠাক একটা ভালো পাখাও নেই আর এখানে বসার ঘরেও এসি চলে! যারপরনাই অবাক সে রিশাদরা খুব পয়সাওয়ালা তা এ বাড়িতে ঢোকার পথে অর্কিড ফুলের চারা দেখেই আন্দাজ করে নিয়েছে। আমাদের দেশে তো যার তার বাড়িতে এসব ফুল চোখে পড়ে না। কিন্তু এখন গালের ব্যথায় আর রিশাদের ভয়ে ঘাড় উঁচিয়ে ঘরটা একবার দেখতেও পারছে না। তার ওপর এখানে শুধু সোফার এদিকটাতেই আলো বাকি সব জায়গায় অন্ধকার।

প্রায় একঘন্টার মতোই চুপচাপ এক জায়গায় বসেছিলো মেহউইশ। রিশাদ এর মাঝে দু বার উঠেছে। কোন দিকে গেছে তাও খেয়াল করার সাহস হয়নি মেয়েটার।রাত যখন তিনটা তখন রিশাদ এক হাতে বাচ্চাটাকে নিয়ে অন্য হাতে মেহউইশকে অনেকটা টেনে হিঁচড়েই সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরে নিয়ে গেল৷ এবং বিনা বাক্য ব্যয়ে একটা বালিশ ফ্লোরে দিয়ে নিজে বিছানায় শুয়ে পড়লো। কখন চোখ লেগেছে জানে না মেহউইশ তার ঘুম ভেঙেচে ভোর পাঁচটায় এলার্মের শব্দে। চোখ খুলতেই দেখলো রিশাদ উঠে গেছে। তা দেখে মেহউইশ মনে মনে ভাবলো, ‘চোর হলেও মানুষ ভালো৷ নামাজ পড়তে উঠেছে, বাহ্!’ কিন্তু তার এ ভাবনাতে বালতি পরিমাণ জল ঢেলে রিশাদ তার ছেলের ডায়াপার চেন্জ করলো। তারপরই ফোনে কাউকে ঘরে আসতে বলে নিজে পাঞ্জাবী বদলে টি শার্ট ট্রাউজার পরে তৈরি হলো। মেহউইশের দিকে একটিবার তাকিয়েও দেখেনি সে। মিনিট পাঁচেক এর মাঝেই একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা এলো দরজায়। ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে সে দরজা খুলে কিছু বলেই বেরিয়ে গেল।

সারারাতের ধকল সকালেই শরীর জানান দিলো মেহউইশের। কোনমতে ফ্লোর থেকে উঠে মধ্যবয়স্ক সেই মহিলাকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলো সে এই বাড়ির কে। মহিলা জানালো এ বাড়িতে আয়া হিসেবে এসেছে গত মাসে৷ এই বাচ্চা মানে রিশাদের ছেলের জন্য আসা। আর এও বলল মেহউইশ যেন দ্রুত কাপড়চোপড় পাল্টে ভদ্রস্ত হয়ে বাচ্চাকে দেখে। বাচ্চার সবরকম প্রয়োজন খুটিনাটি যেন জেনে নেয়। ক্লান্ত, কাহিল শরীরের সাথে এবার মনেরও অবসন্নতা টের পেল মেহউইশ। এত বড় বাড়িতে তাকে আসতে হয়েছে আয়া হয়ে সেও আবার বিয়ের সিলমোহর মেরে!

জেবুন্নেসা ঘুম থেকে উঠেই দোতলা থেকে ফোন দিলেন তার রান্নাঘরের মেইড সুফিয়াকে। জানতে চাইলেন রিশাদ বাড়িতেই আছে কিনা। কিন্তু মেইড জানালো রিশাদ দৌড়াতে চলে গেছে। নতুন বউ বাচ্চাকে নিয়ে বসার ঘরে হৈ চৈ বাঁধিয়ে বসেছে। মেইডের কথায় চমকে উঠলেন জেবুন্নেসা।

নতুন বউ!

‘হ্যাঁ’ সামনে দাঁড়িয়ে জবাব দিলো রাইমা৷ সেও আজ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেছে। রাতে দেরি করে ঘুমালেই তার ঘুমের সমস্যা হয়। কিন্তু কাল রাতে দাদাভাই বিয়ে করতে যাবে বলে নির্জন মানে রিশাদের ছেলেকে রেখে গিয়েছিলো মায়ের কাছে। মা দাদাভাইয়ের নতুন বউকে দেখে কিছু কটুবাক্য বলবেন ভেবে প্রস্তুতি নিয়ে বসেছিলো। আর তাই নির্জনকে রাইমার কাছে ছেড়ে দিয়েছিলো। এতেই ঘুমের বারোটা বেজেছে রাইমার। এখন সে মায়ের ঘরে ঢুকতেই মায়ের ফোনালাপ শুনে জবাব দিলো।

– ‘রিশাদ তো কাল একা ফিরলো দেখলাম।’ জেবুন্নেসা মেয়েকে প্রশ্ন করলো।

-হুম, পিরেছে একাই। নতুন ভাবীকে তো পুলিশ ধরে নিয়ে এলো।

‘পুলিশ!’

হ্যাঁ, পুলিশ রাতে একটার সময় নিয়ে এসেছে।

ওহ!

‘তুমি আবার নতুন ভাবীকে ঘাটতে যেয়ে না। দাদাভাইয়ের মুড খারাপ হলেই বাড়িতে সবার কপালে শনি লাগে। প্লিজ আব্বু ফিরে আসা অব্দি অন্তত লাগতে যেয়ো না।’ অনুনয়ের সুরে বলল রাইমা। কিন্তু তার এ কথায় বেশ ক্ষেপে গেলেন জেবুন্নেসা।

‘চুপ কর মুখপুড়ী। বাপের মতোই হয়েছিস সব ক’টা। তোদের কি মনে হয় রিশাদের বউয়ের সাথে আমি কেন লাগতে যাবো৷ সম্পর্কে আমি ওর সৎ মা হওয়ার আগে ওর মায়ের বোন কালা ছিলাম। হারামীগুলা একটাও আমায় বুঝলিনা।’ কালো মেঘের মতোই মুখের ওপর ঘোর অন্ধকার নামলো জেবুন্নেসার।

রিশাদ তার প্রতিদিনকার মতো দৌড় শেষ করেই বাসায় ফিরলো। ততক্ষণে ঘড়ির কাটা ছয়টা পেরিয়ে গেছে। নিজের ঘরে ফিরতেই সে টি-শার্টটা খুলে ছুঁড়ে ফেলল ময়লা কাপড়ের ঝুড়ির দিকে। তারপরই বাথরুমের দরজা খুলতেই চিৎকার কানে এলো তার। বাথরুমের ভেতর চোখ পরতেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল সে।

‘তুমি?’

চলবে।

#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-২
#রূবাইবা_মেহউইশ
_________________
তিন মাসের দুধের বাচ্চা ফেলে পুরনো প্রেমিকের সাথে পালিয়ে গেছে নীলিমা । ‘রিশাদ রায়হানের বউ বাচ্চা ফেলে পালিয়েছে’ এই কথাটা কোন ভাবেই কারো মুখে শুনতে চায় না রিশাদ। খালা মানে তার সৎমাকে সে পারলে কবেই খুন করে ফেলতো। শুধু রাইমা আর রিহানকে মা ছাড়া করতে চায় না বলেই করেনি। সে নিজে মা ছাড়া বড় হয়েছে এখন তার ছেলের অবস্থা নিয়ে এমনিতেই আতঙ্কিত তার ওপর যদি রাইমাদেরও মা ছাড়া করে! ভাবতে পারে না সে আর। খালা মানুষটা বড় বেশি কটূবাক্য বলে এছাড়া মহিলার আর কোন দোষ নেই৷

দুপুর বেলায় অফিসে বসে বাড়িতে কল দিলো রিশাদ। বাড়ির ল্যান্ডলাইনে কাউকে না পেয়ে রাইমাকে ফোন দিলো। কলেজ থেকে ফেরার পথেই ছিলো সে। দাদাভাইয়ের কল মানেই ভয়ার্ত কোন ব্যাপার মনে করে রাইমা। কারণ, রিশাদ কখনোই বয়ংকর কিংবা মারাত্মক ঘটনা না ঘটলে তাকে কখনো ফোন দেয়নি। বাড়ির গাড়িতে করেই ফিরছিলো রাইমা সে ফোন রিসিভ করার আগে ড্রাইভার কি জিজ্ঞেস করলো, ‘বাড়ি থেকে আসার সময় কি কোন ঝামেলা দেখে এসেছেন রিয়াজ ভাই?’

খুব সাদাসিধা আর শান্ত স্বভাবের রাইমাকে বাড়ির প্রতিটি কাজের লোক ভীষণরকম ভালোবাসে, স্নেহ করে। রাইমার আচরণই এই ভালোবাসা আদায় করে নিয়েছে। ড্রাইভার রিয়াজও সেদিক দিয়ে তাকে অত্যাধিক স্নেহ করে। রাইমার ফোনের আওয়াজ এবং প্রশ্ন শুনে সে বুঝতে পারলো রিশাদ ফোন করেছে। রিয়াজ জবাব দিলো, ‘ভয়ের কোন কারণ তো টের পাই নাই আপামনি। রিশাদ ভাই অফিসে আছিলো আর খালাম্মাও দেখলাম নতুন বউরে নিয়া বাবুরে গোসল দিতাছে।’

ড্রাইভার রিয়াজের কথা শুনে রাইমা চোখ যেন কপালে উঠলো। ‘এ কি বলছেন রিয়াজ ভাই! নতুন বউ আর আম্মু একসাথে? অবিশ্বাস্য!’

‘আপামনি, অবিশ্বাস্য হইলেও এইডাই সত্যি। নীলিমা ভাবীরে দেখলে যেমন খালাম্মা দূর দূর করতো এ্যাই নতুন বউরে দেইখা তা করে না।’

কথা চলতে চলতে রিশাদের কল দুবার কেটেছে। রাইমা একবারও রিসিভ করেনি। জীবনে বোধহয় এই প্রথম সে তার দাদাভাইয়ের ফোন এভোয়েড করলো। বাড়ি ফিরতেই দেখলো বাড়ির গেইটে রিশাদের গাড়ি। তারমানে রিশাদ ফোন করতে করতে বাড়িতেই চলে এসেছে। আল্লাহ জানে রাইমাকে না কিছু বলে ফেলে! ভয়ে কিছু দোয়া কালাম পড়তে পড়তে বাড়ির ভেতরে গেল রাইমা।

ভর দুপুরে তোয়ালে পেঁচিয়ে বাচ্চাকে বারান্দায় নিয়ে দাঁড়িয়েছিলো মেহউইশ। একদম রোবটের মত চলছে ফিরছে এই অর্ধদিন সে। তার জীবনের মূল উদ্দেশ্য কি? বেঁচে থাকার কারণ কি কিছুই বুঝতে পারছে না। পরশু মধ্যরাত পর্যন্তও তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিলো ছোট ভাইটাকে পড়াশোনা করিয়ে একটা গতি করে দেওয়া। মা আর ভাই যেন স্বচ্ছল জীবন কাটাতে পারে। আর এরপরই সে আর ইভান বিয়ে করে নিজেদের সুন্দর একটা সংসার গড়বে। রাতের শেষ ফোনালাপে ইভান তাকে ‘ভালোবাসি’ বলে ফোন কেটেছিলো। কথা ছিলো কাল হাসপাতালে গিয়ে ভালোবাসি’র জবাব দেবে। যেমনটা সে রোজ দেয়।কিন্তু হায়! কি করুণ দৈবদশা তার। ঘুম থেকে উঠেই জানতে পারলো আজ তার বিয়ে। মাকে জিজ্ঞেস করতেই মা বলল, ‘ চুপচাপ বিয়ের জন্য তৈরি হয়ে যা। কোন আচার অনুষ্ঠান নেই শুধু কালেমা পড়ে বিয়ে। আর দেনমোহর অগ্রিম একটা একতলা পাকা বাড়ি আমার নামে। ফিক্সড ডিপোজিট দশ লাখ টাকার মায়ের নামে। কি আশ্চর্যরকম এক ঘটনা ঘটলো একদিনেই। যেন আলাদিনের দৈত্য এসে প্রয়োজনগুলো সব এক নিমিষেই ফুরিয়ে দিলো। মাও কেমন বদলে গেল কয়েকঘন্টার ব্যবধানে। মা তো জানতো আমি ইভানকে ভালোবাসি। ‘অর্থ’ আসলেই ‘অর্থই সকল অনর্থের মূল। অতগুলো টাকা দেখেই মা লোভে পড়ে গেছে। দুদিন আগ পর্যন্তও মা ইভান আর আমার সম্পর্ক নিয়ে খুশি ছিলো। মেহউইশ যখন নিজের ভাগ্য আর অর্থকে দোষারোপ করায় ব্যস্ত তখনি রিশাদ এলো ঘরে। দরজা খোলার শব্দেই ধ্যান ভেঙেছিলো মেহউইশের কিন্তু বারান্দা ছেড়ে ঘরে যাওয়ার সাহস হলো না। বাচ্চাটিকে দু হাতে বুকের কাছে চেপে মনে মনে আল্লাহর নাম জপতে লাগলো। কাল রাত এবং সকালে রিশাদের সামনে থাকার যে ভয়ংকর অভিজ্ঞতা তার হয়েছে সেই অভিজ্ঞতা তৃতীয়বার চায় না সে। আজ সকালেই মেহউইশ যখন নিজেকে একটু ভদ্রস্ত করতে বাথরুমে গেল তখনও তার পরনে বিয়ের শাড়ী। ক্লান্ত শরীরের শক্তিহীন হাত চালিয়েই মুখ ধুয়ে গোসল সেরে শাড়ী বদলেছে। যখনি সে ভেজা চুলে তোয়ালে পেঁচাবে ঠিক তখনি রিশাদ বাথরুমের দরজা খুলল। তাকে দেখে প্রথমেই প্রশ্ন করেছিলো, ‘তুমি?’

মেহউইশ ভয়ে জবাব দিতে না পারলেও কাঁপছিলো একটু একটু। রিশাদ দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করতেই হাতের তোয়ালে নিচে ফেলে রিশাদকে দরজা থেকে ধাক্কা মেরেছে এবং পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। বৃথা সেই চেষ্টায় রিশাদের ঘরটাও পার করতে পারেনি বেচারি। ফর্সা, মোটামুটি লম্বা,চিকন মেয়েটা তার কাঁপা পায়ে দৌড়াতে গিয়েই হোঁচট খেয়েছে ঘরের দরজায়। ততক্ষণে দৈত্যের মত রিশাদ পাকড়াও করে নিয়েছে মেহউইশকে এবং কোন প্রকার প্রশ্নত্তোর ছাড়াই কষে দুটো থাপ্পড় লাগিয়েছে পুনরায়। রাতে, দিনে মোট ছয় কি সাতটি থাপ্পড় মেহউইশের গালসহ দাঁত সব নড়বড়ে করে দিয়েছে। মেয়েটা সেই থেকে এখন অব্ধি রিশাদের নামটা মনে করতেই ভয়ে কাঁপছে। অফিসে যাওয়ার আগে রিশাদ তার স্বভাবসুলভ রাশভারী কন্ঠে বলে গেছে তার ছেলের জন্য এক সেকেন্ডের জন্যও কোন প্রকার কষ্ট, অযত্ন না হয়। আর এ বাড়ি থেকে পালানোর চেষ্টা তো ভুল করেও করা যাবে না। মেহউইশ আর পালানোর কথা চিন্তা করেনি। বাচ্চাটারও নিজের পক্ষে যতোটা সম্ভব আগলে রাখার চেষ্টা করছে। সমস্যা একটাই সে রিশাদের মুখ মনে পড়লেই নিজের মধ্যে ভয়ের তুফান টের পাচ্ছে। এখন রিশাদ ঘরে এসেছে এখন কোথায় যাবে সে!

– ‘এই ভর দুপুরে বারান্দায় কি?’

বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো রিশাদ।

‘ভিটামিন ডি ব বাচ্চা’ তোতলানো গলায় এর বেশি মেহউইশ আর উচ্চারণ করতে পারলো না। রিশাদ ভ্রু’জোড়া একটু বাঁকিয়ে মেহউইশের সামনে এসে দাঁড়ালো।

-কোন মূর্খের বাচ্চা বলছে এই ভরদুপুরের ঠাডা পড়া রোদে রাখতে আমার ছেলেকে?

রিশাদের মুখের কথা উচ্চারিত হতেই চোখমুখ খিঁচে নিলো মেহউইশ। এ কোন জমের দুয়ারে পড়েছে সে! লোকটা মুখ খুলেই শুধু বজ্রপাত ঘটায়। দেহের ভেতর আত্মাটা যারপরনাই পথ খুঁজে বেড়ায় পালিয়ে যেতে। তপ্ত দুপুরে ঘাম ঝরা সময়টাতে মেহউইশের ঘামগুলোও ভয়ে লোমথেকে কূপের ছিদ্রে চুপ মেরে আছে। চিলের মত ছোঁ মেরে নির্জনকে নিয়ে নিলো রিশাদ এবং ঠিক প্রথম দিনের মতো করেই এক হাতে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো বাচ্চাটাকে। মেহউইশ নিজের মনের ভয়েই আধমরা সেখানে এই বাচ্চাটাকে নিয়ে আতংক হওয়ার সুযোগ তার নেই।ঘরে ঢুকে গেল রিশাদ এবং যাওয়ার সময় বলে গেল পাঁচ মিনিটের মধ্যে খাবার টেবিলে উপস্থিত হতে।

শরতের দুপুর এই রোদ্দুরে ঝলসে নিচ্ছে শহরটাকে এই কোথাও কালচে মেঘে ঢাকা পড়ছে শহরটা। রাইমা নিজের ঘরে ঘাপটি মেরেছে দাদাভাইয়ের ভয়ে। বাড়ি ফিরতেই গরমের কারণে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়েছিলো৷ বাথরুম ত্যাগ করতেই হঠাৎ দমকা এক বাতাস জানালার পাল্লা খুলে শীতল করে দিলো তাকে। এ কেমন হাওয়া! এই ঋতুতে ঝড় হয় বুঝি? দ্রুত পায়ে জানালার কপাট লাগিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। আজ সে অনেক সময় নিয়ে চুল শুকাবে,লোশন মাখবে। ঘড়ির কাটা যখন তিন পেরুবে তখনই সে ঘর ছাড়বে। কারণ, দাদাভাই তিনটার ওপারে আর বাড়িতে থাকবে না। কি জানি আজ কি ঘটেছে তার জন্য তাকে কল দিয়েছিলো। দাদাভাইয়ের কল রিসিভ না করার যে দুঃসাহস দেখিয়েছে তার শাস্তি কি না কি থাকবে! সকাল ঘুম থেকে উঠেই আয়ার কাছে শুনেছে নতুন বউকে নাকি ভাইয়া অনেকগুলো থাপ্পড় মেরেছে। এত সুন্দর মিষ্টি মেয়েটাকে কি করে মারলো দাদাভাই! ইশ, নীলিমা ভাবীর ওপরের সব রাগ বুঝি নতুন বউয়ের ঝাড়লো।

– রাইমা আপা আপনারে ডাকে।

দরজার বাইরে থেকে কাজের মেয়ের ডাক শোনা গেল। রাইমা জিজ্ঞেস করলো, ‘কে ডাকে? আর দাদাভাই কি অফিসে চলে গেছে?’ নাহ ওপাশ থেকে কোন জবাব আসলো না তারমানে মেয়েটা তাকে ডেকেই চলে গেছে। অনেকটা বাধ্য হয়েই নিচে গেল রাইমা।

জর্জেটের শাড়ী কোনকালেই মেহউইশের মায়ের ছিলো না। ভদ্রমহিলা সেলোয়ার কামিজ পরেন সবসময় বেড়াতে গেলে যা পরেন তা সুতির মধ্যে শাড়ী আর মেহউইশও কখনো কোথাও শাড়ী পরে যায়নি। অথচ কাল রাতে বিয়ে উপলক্ষে কোটিপতি নবাবজাদা দিলো তো দিলো একটা ভারী বেনারসি আর আট কি দশ ভরি হবে গয়না৷ তাও আবার সব সোনার গয়না না পাথরের মা তো বলল ওগুলোই নাকি হীরা৷ কে জানে আসল হীরা নাকি নকল ধরিয়ে দিয়েছে! রাতভর সেই সব জঞ্জাল গায়ে দিয়ে পার করলো আর সকালে কোন কাপড়চোপড় না দিয়েই বলল ভদ্র হতে। মেহউইশ কোন কিছু বুঝতে না পেরে ঘরেই বসেছিলো। পালানোর চেষ্টায় পাওয়া শাস্তিতে বসে বসে কাঁদছিলো তখন রিশাদ নিজেই একটা শাড়ি দিয়ে বলল আলমারীর পাশেই আরেকটা আলাদা কেবিনেট আছে। তাতে মেয়েলি পোশাক সব আছে সে যেন কিছু একটা পরে নেয়। ভয়ে আধমরা মেয়ে মেহউইশ দিক্বিদিকশূন্য হয়ে কাপড় খুঁজে এই পরে নিয়েছিলো। তখন অত খেয়াল ছিলো না এই জর্জেট শাড়ি,লুস ব্লাউজ এবং তার উচ্চাতায় বড় এক পেটিকোট পরে সে কোন বিপাকে পড়বে। এখন দোতলা থেকে নিচ তলায় নামতে গিয়েই টের পেল মারাত্মক এক ভুল করেছে সে। এখন হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছে এই বুঝি পেটিকোটে পা বেঁধে হোঁচট খাবে। এই বুঝি শাড়িটা কোমর থেকে খুলে মানসম্মান হারাবে সে। নাহ্ তেমন কিছুই হয় নি। সময় লাগলেও কাপড়চোপড় ঠিক রেখেই টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াতে পেরেছে সে।

‘বিয়ের মেন্দী কি সব পায়েই লাগাইছেন? নাকি ফ্যাশনে নাম লিখছেন কত লেট করে হাঁটা দেখানো যায়?’ মুখ খিঁচিয়ে প্রতিটা শব্দ উচ্চারণ করলো রিশাদ। মেহউইশ কোন কথাই বলতে পারলো না। তবে সেখানে উপস্থিত থাকা জেবুন্নেসা সুযোগে বললেন, ‘ নতুন বউ চলা ফেরায় একটু তো লজ্জা থাকবেই। তার তো আর অন্যদের মত আগে থেকেই বিয়ের অভিজ্ঞতা নেই যার জন্য সকল লাজ লজ্জা লজ্জা ধুয়েমুছে ফেলবে।’

ঝনাৎ করে আওয়াজ হলো খুব জোরে। চেয়ার ছেড়ে সরে দাঁড়িয়েছেন জেবুন্নেসা। টেবিলের কাছ থেকে সরে গেছে মেহউইশ এবং সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকা রাইমাও থেকে গেছে সিঁড়িতেই৷ এবং তখনি খুব জোরে আরো একটি আওয়াজ হলো টেবিলের আড়াই ইঞ্চ পুরো কাঁচের ওপর। রিশাদ প্রথমে টেবিলক্লথ খাবার, থালা বাসনসমেত হিঁচড়ে ফেলেছে এবং তৎক্ষনাৎ টেবিলের ওপর সর্বশক্তি দিয়ে ঘুষিও মেরেছে। জেবুন্নেসার কথার বাঁকা যে অর্থ তা রিশাদ এবং তার বাবাকে উদ্দেশ্য করেই তা সে বুঝতে পেরেছিলো। নাকের ডগায় রাগ লেগে থাকা ছেলেটাকে কটুবাক্য শোনালে এমন হওয়াটা একদমই বেমানান কোন ঘটনা নয়। তবে এসব কিছু খুবই নতুন মেহউইশের জন্য ঃ কান্নার আওয়াজ ভেসে আসলো নির্জনের। এত শোরগোলে বাচ্চাটা ভয় পেয়েছে বোঝাই যাচ্ছে । মেহউইশ আঁড়চোখে খুবই ভয়ে ভয়ে রিশাদের মুখটা একবার দেখলো। সে মুখের অভিব্যক্তি কিছুই বুঝে আসছে না বলে মেহউইশ এগিয়ে গেল আয়ার কাছে। সে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আদর করতে লাগলো যেন, রিশাদ এই আদর দেখেই তাকে কিছু বলবে না।

চলবে।