মন গহীনের গল্প পর্ব-৩৮+৩৯+৪০

0
556

#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব -৩৮
#রূবাইবা_মেহউইশ
💞
ঘোর কাটেনি ঘুমের, উষ্ণ চুমুর আর অপার্থিব সৌন্দর্য মিশ্রিত ভোরের। নিষ্পাপ চাহনি মেলে রিশাদের দিকে তাকিয়ে থেকেই ডান হাতের মধ্যমা আর তর্জনী তুলে তার অধর ছুঁলো। সত্যিই কি রিশাদ এই মাত্র তাকে চুমু খেল! মুখ ফিরিয়ে অন্যদের আসা যাওয়া মনযোগে দেখতে লাগলো রিশাদ। সংকোচোর সমুদ্রের আকন্ঠ ডুবে গেছে তার। প্রথম, এই প্রথম সে সংকোচে কারও সামনে থেকে দৃষ্টি সরিয়েছে। আজই প্রথম তার ভেতরে জড়তার আকাশ নেমেছে মাথার উপর।মেহউইশ যখন একটু সরলো তখনি রিশাদ বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে।

-‘ফেরা দরকার।’

ঘোর কাটলো রিশাদের কথায়। উঠতে ইচ্ছে করছে না তার তবুও বলল, ‘ হুম।’

মেহউইশও উঠলো বসা থেকে ; কেউ কারো দিকে দেখছে না। কারো মুখের ছায়ায় কতোটা সংকোচ একটিবার মুখোমুখি দাঁড়ালেই দেখতে পেত। ভালোবাসা নাই’বা হলো ভালোলাগাটা তো হয়েই গেছে। একটা মানুষের খোলসের আবরণে যে রূপটা ঢাকা আছে সেটাই হয়তো আসল রূপ। মেহউইশ দেখছে খুব কাছ থেকে খোলসবিহীন রিশাদকে৷ যতটুকু দেখেছে ততটুকুতে আবর্জনার ছিঁটেফোটাও নেই। খোলসটাই যা ময়লা হয়েছে,নষ্ট হয়ে গেছে, ভেতরকার মানুষটা পরিষ্কার । চেষ্টা করলে আবরণটাকেও হয়তো ধুয়েমুছে নেওয়া যেত তবে তা করার জন্যও যোগ্য একজন মানুষ দরকার। সূর্যের লালচে আলো ঘন হয়ে রঙ বদল করছে। মেহউইশের ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই তারা হোটেলে পৌঁছে গেছে৷ রিশাদ সত্যিই তাকায়নি তার দিকে একটিবারও। বসার মত জায়গা কোথায় ভাবতে ভাবতে মনে পড়লো সুইমিংপুলের পাশে কচি ঘাস আছে। শরতের এই শুরুটাতে ওই ঘাসগুলোকে খুব সতেজ লাগে। এই ভোরে শুধু সেখানটাতেই বসতে আরাম লাগবে।

-‘ তুমি সুইমিংপুলের পাশে লনে গিয়ে বসো আমি দেখছি কফির ব্যবস্থা হয় কিনা।’ কথাটা বলেই রিশাদ দোতলার দিকে এগোচ্ছিলো।

-‘কফি না চা।’

– ‘আমি চা বানাতে পারি না৷ রেস্টুরেন্টের কুকরা এখনও কেউ উঠেছে বলে মনে হয় না।’

মেহউইশ লনের দিকেই এগোচ্ছিলো, রিশাদের কথা শুনে উল্টো ঘুরলো।

-‘আমি কি সেখানের কিচেনে ঢোকার অনুমতি পাবো?’

রিশাদ না করতে গিয়েও করলো না। ইচ্ছেই হলো না বাঁধা দেওয়ার৷

-‘এসো’

দুজন মিলে আবার পায়ে পা মিলিয়ে চলল। দোতলায় রেস্টুরেন্ট খালি পড়ে আছে৷ কোথাও কোন শব্দ নেই, এমনকি তাদের পায়ের আওয়াজটাও নেই। রেস্টুরেন্টের রান্নাঘরের স্লাইড দরজাটা সরিয়ে দুজন চুপিসারে ভেতরে ঢুকলো। মেহউইশ স্তব্ধ হয়ে গেল ভেতরে প্রবেশ করতেই। সুবিশাল কিচেন, বড় বড় ক্যাবিনেট,ড্রয়ার, ইলেকট্রিক ওভেন,হিটার,প্রেসার কুকার আবার একপাশে ক্রোকারিজ সেট। মেহউইশ হা করে চেয়ে রইলো সেদিকে। এত এত জিনিসপত্র তাও আবার রান্নাঘরের সে একসাথে কখনোই দেখেনি৷ রিশাদ মশলার কাঁচের কৌটো গুলো একে একে সবগুলো নামিয়ে দেখছে। কোথাও চা পাতা খুঁজে পেলো না। সে ভাবছে চা করতে চা পাতা লাগবে, দুধ লাগবে, চিনিও এগুলো কোথায় খুঁজবে।মেহউইশ মেয়ে মানুষ হয়তো সে তাড়াতাড়িই খুঁজতে পারবে তাই ডাকলো, মেবিশ,,,

মেহউইশ এ জগতেই যেন নেই। সে শুনতে পায়নি রিশাদের ডাক৷ তার চোখ জ্বলজ্বল করছে এতসব দামী, অত্যাধুনিক জিনিসপত্র দেখে। ফ্রিজটার সাইজও এত বড় যা সে কখনোই দেখেনি।

-মেবিশ চা পাতার কৌটো পাচ্ছি না।

-হু!

-বলছি চা পাতা ছাড়া চা সম্ভব নয়। কফিও পেলাম না তবে নিচের ক্যাবিনেটে নুডলস আছে খাবে?

এবারে সম্বিৎ ফিরলো মেহউইশের৷ লজ্জিত হলো নিজের এমন হা মুখো আচরণে। ছিহ, রিশাদ কি তাকে ছ্যাঁচড়া ভাবছে? জীবনেও দেখেনি এসব তা নিশ্চয়ই বুঝে গেছে! মুখটা কাচুমাচু করে রিশাদের দিকে তাকাতেই সে ইশারা করলো নুডুলসের প্যাকেটের দিকে।

মেহউইশ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতেই রিশাদ একটা প্যানে পানি বসালো। গ্যাস চালু করে ফ্রিজ খুলে দেখলো কি কি আছে তাতে। কাঁচা মরিচ, ক্যাপসিকাম আর সস বের করল। কপাল কুঁচকে কিছু সময় দাঁড়িয়ে থেকে মনে করার চেষ্টা করলো নুডুলসে আর কি দেয়? সে ভার্সিটি থেকে বন্ধুদের সাথে যেবার ট্র্যাকিংয় করতে পাহাড়ে গেল সেবারই ছিলো তার শেষবার নিজে হাতে নুডুলস রান্না করা৷ সেটাতো খুব সিম্পল ছিলো ফুটন্ত পানিতে নুডুলস ছেড়ে মশলা ঢেলে নেড়েচেড়ে নামিয়ে নিয়েছিলে। এখন কিভাবে রাঁধবে!

মেহউইশ চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখতে থাকল তবুও এগিয়ে এসে বলতে চাইলে না, ‘দিন আমি রাঁধছি।’

পানি ফুটে উঠেছে। নুডলসের প্যাকেট ছিঁড়ে তাতে নুডলস দিতে গিয়ে অসাবধানতাবশত চুলোর পাশে থাকা আরেকটা প্যান নিচে পড়লো। নিশ্ছিদ্র নীরবতায় ছেদ ঘটিয়ে জোর আওয়াজ হলো, চমকে উঠলো মেহউইশ । ধড়মড় করে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই রেস্টুরেন্টের শেফ আলাউদ্দিনও এসে ঢুকলো। এতভোরে তার রান্নাঘরে কিছু পড়ার শব্দ শুনেই সে দিকদিশা ভুলে দৌড়ে এসেছিলো বেচারা৷ তার সুরতহাল দেখে মেহউইশ চোখ বন্ধ করে উল্টোদিকে ঘুরে দাঁড়ালো তৎক্ষনাৎ ।

-স্যার আপনি রান্নাঘরে! বেশ আশ্চর্যজনক মুখভঙ্গি করেই প্রশ্ন করলো আলাউদ্দিন। রিশাদ খেয়াল করেছে মেহউইশ মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

-আলাউদ্দিন সাহেব আপনি দয়া করে কাপড় পরে আসুন।

‘ওহ, স্যরি স্যার ‘ বলে লজ্জায় লাল হয়ে আবার দৌঁড়ে বের হলো আলাউদ্দিন৷ এই রান্নাঘরে কখনো কোন মেয়ে কাজের লোক ছিলো না। বলা যায় কিচেন শেফ আলাউদ্দিন এর আর্জি ছিলো তার রান্নাঘরে যেন কোন নারী না আসে৷ সে চুয়াল্লিশের ঘরে পা রাখা অবিবাহিত পুরুষ। হয়তো জীবনে নারীঘটিত কোন দূর্ঘটনা ছিলো অথবা অন্যকোন কারণ যার দরুণ সে মেয়ে জাতিকে তেমন একটা পছন্দ করে না। আর যেখানে নারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ সেখানে সে এত ভোরে তার পোশাকের দিকে খেয়াল দেওয়ার চিন্তা মাথায় ভুল করেও আনেনি৷ রাতে ঘুমানোর সময় পরা প্যান্ট, যার লম্বা তার হাঁটু পর্যন্তও নয় সেটা পরেই এখন এসেছিলো সে। তা দেখেই মেহউইশ অপ্রস্তুত হয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। আবার এলো আলাউদ্দিন কাপড়চোপড় পরে বাবু সেজে। লজ্জায় তার মুখ এখনও রক্তিম তা দেখে রিশাদের হাসি পাচ্ছে।

-‘ মেয়েদের মত গাল গোলাপি করার আর দরকার নেই আলাউদ্দিন সাহেব৷ আমি নুডুলস বানাচ্ছিলাম ভুল করে এই কড়াইটা পড়ে গেছে।’

-স্যার আমাকে ডাকলেন না কেন? আমি করে দিচ্ছি এক্ষুনি৷

– ‘আপনার করতে হবে না আপনি শুধু বলে দিন চা পাত্তি,চিনি কোথায় আমি চা করবো।’ মুখ খুলল এবার মেহউইশ। আলাউদ্দিন এগিয়ে গিয়ে সব কিছু এগিয়ে দিতেই রিশাদ তাকে চলে যেতে বলল। মেহউইশ নিজেই নুডুলস আর চা করে একটা ট্রে তে সাজিয়ে নিয়ে রান্নাঘর থেকে বের হচ্ছিলো। রিশাদকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, ‘ এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবেন না চা খাবেন?’

‘কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এসব।’

-‘লনে বসে খাবো৷ এখনও সাতটা বাজেনি। আর যাইহোক লোকজনের ভীড় হবে না।’

-‘চা ঠান্ডা হয়ে যাবে নিচে যেতে যেতে।’

-‘হোপফুলি আমি অতোটা বোকা আর গর্দভ নই।’

-‘মানেহ!’ রিশাদ ভ্রু কুঁচকালো আবারও তা দেখে মেহউইশ যেন সুযোগ পেল টিপ্পনী কাটার মত।

-‘ কথায় কথায় ভ্রু দুটোকে ওরকম কষ্ট না দিয়ে মাথাটা একটু খাটালেই বেশি উপকৃত হবেন, আমার ধারণা।’ মেহউইশ আর দাঁড়ায়নি । সত্যিই চলে গেল সিঁড়ি বেয়ে নিচ তলায়। লনে ছোট গোল একটা টেবিলে ট্রে নামিয়ে রেখে চেয়ার টেনে বসলো৷ রিশাদও পেছন পেছন এসে আরেকটা চেয়ার টেনে বসলো। এবার খেয়াল করলো চা ছোট্ট একটা ফ্লাক্সে করে এনেছে সে সাথে দুটো কাপও৷ নুডুলসের বাটি টেনে নিয়ে রিশাদ খাওয়া শুরু করলো, মেহউইশও তাই করলো। তারপরের সময়টা দুজনে টুকটাক গল্প করেই কাটিয়ে দিলো। কল্পনার চেয়েও সুন্দর অনেক বেশি সুন্দর ছিলো আজকের সকাল মেহউইশের জীবনে। রিশাদের জীবনেও তাই নয় কি! কৈশোরের প্রেম ভ্রমণ যৌবনের শুরুতে একটা মেয়ের প্রেমে পড়লেও প্রেম করা তার হয়নি। সময়মত বিয়ে হলো ভুল মানুষের সাথে যে কিনা সময়ের সাথেই আবার হারিয়ে গেল। প্রেম না হলেও নীলিমার জন্য মায়া জন্মেছিলো৷ সেই মায়াকে সম্বল করে আজীবন পার করতে চাওয়ার সাধে ঘুন ধরলো। নীলিমা পালালো আর সন্তানকে করে গেল মা হারা। এরই মাঝে নিজেরই এক ভুল ধারণার জন্যই ইভানের কাছ থেকে মেহউইশকে আলাদা করলো। সে চেয়েছিলো এক ঢিলে দুই পাখি মারতে কিন্তু ভাগ্য তো তার বরাবরই সংকুচিত রইলো। যতদূর খবর নিয়ে জানা গেল রাইমা ইভান নয় অন্যকাউকে ভালোবাসে। সেই এক ভুল তার জীবনে মেহউইশকে বেঁধে দিলো। বাবার পদচিহ্ন অনুসরণ করেই সে চলল। বাবা যা করলো খালার সাথে সেও কি তাই করেনি মেহউইশ এর সাথে! তাই তো করলো পার্থক্য শুধু তার কাজ বৈধতাযুক্ত৷ এক ভোরেই যে আজ সকল ভুলত্রুটি, অন্যায় – পাপ তাকে এমন গাঢ়ভাবে নাড়া দিবে কে জানতো৷ আজই উপলব্ধি হলো মেহউইশকে সে সম্মানের সাথে নিজের কাছে বেঁধে রাখতে পারে আর আজই মনে হলো মেহউইশের একটা সুন্দর জীবন সে ধ্বংস করেছে৷ তার প্রায়শ্চিত্ত করা দরকার। মেহউইশ কি চায়!

সারাটা দিন খুব হৈ চৈ এর সাথে কাটলো রাইমাদের। তানভীর নিজের পরিচয় হিসেবে রাইমা যে কলেজে পড়ে সেখানেই ইউনিভার্সিটি লেভেলের সিনিয়র বলেছে রিশাদকে। মেহউইশের সাথে আলাদাভাবে বেশ ক’বার কথা বলার চেষ্টা করেছে তানভীর । মেহউইশ এড়িয়ে গেছে তাকে বিভিন্ন ব্যস্ততার অজুহাতে। ইভান সম্পর্কিত কোন কথাই আলোচনা করতে আগ্রহী নয় সে এখন। ইভানকে ভুলে যাওয়া অসম্ভব কিন্তু রিশাদের সংসারে ভালো একজন বউ আর মা হওয়া অসম্ভব নয়৷ তাই সে এ বিষয়েই সততার পরিচয় দিতে চায়। সুযোগ পেলে অবশ্যই তানভীরের কৌতূহলও মিটিয়ে দেওয়া যাবে৷ দুপুরের পর রিশাদকে আর দেখা যায়নি। মেহউইশ নির্জন আর তার মায়ের সাথেই বেশি ব্যস্ত ছিলো। রেহনুমাও খুব উৎসাহ নিয়ে লনের ডেকোরেশন দেখছিলো ঘুরে ঘুরে। জন্মদিনের অনুষ্ঠানটা তেমন বড় করে না হলেও মোটামুটি নিজেরাই আছে প্রায় বিশ,বাইশজন। আজকের জন্য লনের সাইডে ট্যুরিস্টদের জন্য ঢোকা বারণ৷ তিশমা এসে রাইমাদের সাথে যোগ দিলো সোৎসাহে। ম্যানেজার বেচারা এখানেও ছাড় পেলো না৷ মি.হাংকি পাংকি নামেই তাকে সকলের সামনেই খুব জ্বালিয়ে মারলো।

দিনের আলো যখন নিভু নিভু , রাত যখন আসি আসি করছে সন্ধ্যের শেষ আলোটুকু গায়ে মেখে রিশাদ এলো। দু হাত ভর্তি তার শপিং ব্যাগ। সব নিয়ে সে প্রথমে নিজের ঘরেই ঢুকলো। রাইমারা দুপুরেই নিজেদের রুম পেয়ে গেছে তাই সে রুমেই শিফট হয়েছে। মেহউইশ রুমেই ছিলো নিজের৷ দু দিনের জন্য হোটেলে আসা তাদের তাই বেশি কিছু না নিয়েই এসেছিলো। রিশাদ হাতের ব্যাগগুলো ড্রেসিংটেবিল এর পাশেই ডিভানের উপর রাখলো।

‘ফুপি আর আন্টি কোথায়?’ রিশাদ জানতে চাইলো।

-‘ নিচেই মনে হয় লনের পাশে ডেকোরেশন দেখছে।’ কানে দুলজোড়া পরতে পরতে কথাটা বলল মেহউইশ।

– এখানে দুটো শাড়ি আছে একই রঙের। আমার ফুপি কখনও রঙচঙে কাপড় পরেননা আর আন্টিকেও আমি যে কদিন দেখেছি তিনিও সাদামাটা পরেন৷ এ দুটো শাড়ি একই রকম তাদের দিয়ে দিও৷ আর এখানে তিনটে ব্যাগ মিহাদের ‘ বলতে বলতে ব্যাগ তিনটা আলাদা করে দেখালো মেহউইশকে৷ শার্ট,প্যান্ট আর একরাতে মোবাইল ফোন এগুলো মিহাদের জন্য কেনা।

-এতকিছু কেন আনতে গেলেন৷ মিহাদের মোবাইল দরকার নেই।

-‘ভয় পেয়ো না আমাদের মত বিগড়াবো না তাকে৷ শুধু ফোনটাই দিচ্ছি সে খুব খুশি হবে৷ আর এদিকে একটা শাড়ি আর একটা গাউন আছে। গাউনটা রাইমা নিজেই পছন্দ করে ছবি পাঠিয়েছিলো। তাকে ডেকে দিয়ে দিও৷’ কথা শেষ করে রিশাদ বাথরুমে ঢুকলো। মেহউইশ ভাবছে শাড়িটা কার! সবগুলো ব্যাগের কথাই বলেছে কার কোনটা শুধু নির্জন আর তার জন্যই কিছু এনেছে কিনা বলল না। মন খারাপ করে শাড়িটা শপিং ব্যাগ থেকে বের করতেই ছোট্ট একটা চিরকুট বেরুলো, নির্জনের মায়ের জন্য এই উপহারটা ।’

চলবে
(ভুল গুলো শুধরে দিবেন আশা করি। )

#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব ৩৯
#রূবাইবা_মেহউইশ
💞
হৈচৈ পূর্ণ জন্মদিনের অনুষ্ঠানে ছোট ছোট শিশুরাই বেশি মাতিয়ে তুলেছে সুইমিংপুলের পাশের লনটা। আলোয় আলোয় পরিপূর্ণ অংশটুকুতে নির্জন ছাড়া বাকি প্রত্যেকটা শিশুই এতিম এখানে। আর এই এতিমদের খাওয়ানোর ইচ্ছেটা রেহনুমার। সে চায় জন্মদিন উপলক্ষে যদি কিছু করতেই হয় তবে এতিম কিছু ছেলেপেলেকে খুশি করুক। হতে পারে সেটা একবেলা ভালোমন্দ খাইয়ে অথবা শীত আসছে কিছু ভালো শীতের কাপড় অথবা এতিমখানায় বাচ্চাদের স্বার্থে কোন উন্নতিমূলক কাজ করতে। রিশাদের ভালো লেগেছিলো রেহনুমার ইচ্ছের কথা শুনে সে মেহউইশের ইচ্ছে জানতে চেয়েছিলো। সেও একই জবাব দিয়েছে তাই আজকের আয়োজন শুধুমাত্র তাদেরই জন্য করা। রাইমা একটিমাত্র বোনকে ছেড়ে করতে ভালো লাগবে না তাই রাইমাকে বলেছে আসতে। এই সুযোগ মেহউইশের মা’কেও বলা যায় মেয়ের বাড়ি আসতে তাই তাদেরকেও দাওয়াত করা। আর রাইমার আবদারে তার বন্ধুরাও আমন্ত্রিত হয়েছে। এই আয়োজনে বাদ পড়েনি নির্জনের জন্মদাত্রী নীলিমাও। নীলিমাকে দাওয়াত করার আগে মেহউইশের অনুমতি নেওয়াটাও ভুল হয়নি রিশাদের। আর এখানেই ভুল হয়েছে রিশাদের চিরকুট লেখায়। মেহউইশ শাড়ির প্যাকেট খোলার আগ পর্যন্তও খুব খুশি ছিলো এই অনুষ্ঠান নিয়ে। চিরকুটের লেখাটা পড়েই তার মন খারাপ হলো, বুক জুড়ে হাহাকারের সৃষ্টি হলো।

নির্জনকে দ্বিতীয় দফায় তৈরি করছে মেহউইশ । সন্ধ্যায় একবার নতুন পোশাক পরিয়ে ঘুরিয়ে আনা হয়েছে নিচ থেকে। এখন আবার রিশাদ নতুন যা এনেছে তাই পরানো হলো। সাদা শার্ট, কালো ডেনিম প্যান্ট আর শার্টের উপরে কালো রঙের কোট। কোটের কলার দেখে বোঝা গেল নির্জনের মায়ের শাড়ির অংশ বিশেষভাবে লাগানো আছে এতে। যাকে বলা যায় ম্যাচিং ম্যাচিং। সবগুলো ব্যাগ হস্তান্তরিত করার পরও তিনটে ব্যাগ বাড়তি রইলো। একটি নির্জনের ছিলো যা সে পরে আছে অন্যটি শাড়ি নির্জনের মায়ের তৃতীয়টি খুলতেই বুঝলো এটা রিশাদের নিজের জন্য । বাপ, ছেলে একইরকম পোশাক পড়বে সেই সাথে তার মায়ের পোশাকও মিলবে তাদের সাথে। বুক ফেটে কান্না এলো। নির্জনকে তৈরি করে রাইমার কাছে দিয়েই সে দ্রুত পায়ে বাথরুমে ঢুকলো। ডানা ভাঙা পাখির মত ছটফট করতে করতে পানির ট্যাপ চালু করলো। যতটুকু সম্ভব চিৎকার করে কান্না করলো৷ নয়টা মাস একেবারেই কম সময় নয়। বিয়ের বন্ধনটাও ঠুনকো নয় ; জোর করে হলেও বিয়েটা হয়েছে ধর্মীয় এবং আইনগত দুভাবেই৷ নয়মাসের এতগুলো দিনরাত্রি ওই বাচ্চা ছেলেটাকে বুকে আগলে কেটেছে তার। মা না হোক মায়ের চেয়ে কমও করেনি। যে মেয়ে কখনও বাচ্চা কোলেই নেয়নি সেই মেয়ে একটা তিন মাসের বাচ্চাকে কোলে তুলেছে, খাবার খাইয়েছে,ঘুম পাড়িয়েছে, মলমূত্র পরিষ্কার করেছে নিজ হাতে সেই মেয়েটা আজকে মায়ের জায়গা পেলো না! কান্না থামছে না মেহউইশের। অসহ্যবোধ করা সম্পর্কটা আজ তাকে কাতর করে ছাড়লো। অপাপবিদ্ধ সেই ছোট্ট মুখখানি চোখের পাতায় ভেসে উঠলো তার। ওই মুখের মায়ায় পড়ে গেছে অনেক আগেই। আর সেই মায়া থেকেই তার যত্ন নেওয়া,আদর করা কখন যে অধিকারের ভাবনাটাও মাথায় ঢুকেছে কে জানে! রিশাদ যখন অনুমতি চাইলো নির্জনের জন্মদিনে নীলিমা একটিবার তাকে দেখতে চায় সে কি দিবে! তখনও মনে হয়েছিলো রিশাদের পর নির্জনের উপর একমাত্র অধিকার তারই আছে। তার ভাবনা ভুল যতোই নীলিমা অন্য কারো অর্ধাঙ্গী হোক মা তো সে নির্জনের আজীবনই থাকবে।

মেবিশ!

বাথরুমের দরজায় নক করলো রিশাদ। ডাকলো বার কয়েক মেহউইশের নাম ধরে। মেহউইশ জবাব দিলো না ইচ্ছে করেই । কেন দিবে সে জবাব , রিশাদের ফরমায়েশ শুনতে! তার কি এত দায় পড়েছে? শুনবে না আর কারো কথাই এখন থেকে; চলে যাবে দূরে। অভিমানে বুকের ভেতর চাপা কষ্টের উদ্রেক হলো। রিশাদ ডেকেও জবাব না পেয়ে রুমেই নিজের কাপড় বদলে নিলো। রাইমা ফোন করলো নিচে যেতে কেক কাটার পর্ব শুরু করতে৷ নীলিমাও এসেছে অনেকক্ষণ হলো।

– ‘সবাই প্রস্তুত কেক কাটার জন্য আমি নিচে যাচ্ছি। তোমার হলে গেলে এসে জলদি।’

সুইমিংপুলের নীল পানিতে ভাসছে অসংখ্য ফুলেল প্রদীপ।প্রদীপগুলো নকল যাকে বলা হয় আর্টিফিশিয়াল ঠিক ওরকম। পানিতে থেকেও নিভে যাওয়ার ভয় নেই আবার এতে তেল, সলতেরও দরকার নেই। ভেতরে হয়তো ব্যাটারি জাতীয় কিছু আছে আর প্রদীপগুলোর আকৃতি দেখতে ফুলের মত। হঠাৎ দেখলে মনে হয় লাল,কমলা,কাঁঠালি রঙের জারবেরা ছড়িয়ে আছে পানিতে। তাতে আগুনের ছায়াটাও নেই। জলন্ত প্রদীপগুলোর দিকে একমনে তাকিয়ে আছে মেহউইশ। তার সামনেই বড় টেবিলটাতে সাজানো বড় সাইজের কেক । রিশাদের কোলে নির্জন তার একপাশে মেহউইশ অন্যপাশে রেহনুমা তার সাথে রাইমা। নীলিমা সামনেই দাঁড়িয়ে আছে । সে এসেই নির্জনকে নিয়ে অনেকটা সময় আলাদা কাটিয়েছে তবে সেই সময়টাও রিশাদের বেঁধে দেওয়া নির্দিষ্ট সময় ছিলো। তারপর আর এক সেকেন্ডের জন্যও নির্জনকে ছুঁতে দেওয়া হয়নি।

-মেবিশ, নির্জনের হাত ধরো।

-হু!

‘বলছি কি হাত ধরো নির্জনের। কেক কাটবে।’

-‘মিসেস নীলিমাকে ডাক’,,,,,

মেহউইশ কথাটা শেষ করার সাহস পেলো না। সে বলতে গিয়েই দেখলো রিশাদের চোখ বড় বড় হয়ে আছে। তার দৃশ্যজোড়া কঠিন আর চোয়াল শক্ত হয়ে আসায় চুপ হয়ে গেল মেহউইশ। ভয়ে ভয়ে হাত রাখলো রিশাদের হাতে। দুজনের হাতের মাঝে নির্জনের ছোট্ট হাতখানা বন্দী পড়লো। তিনটি হাতের বন্ধন দূর থেকেই চোখে জ্বলে উঠলো নীলিমার। চিকচিকে হলো তার চোখের কোণ৷ হারিয়েছে কি তা যেন সে আজ বুঝতে পারলো।

কেক কাটার আগেই বাচ্চাদের প্রত্যেককে খাবার খাওয়ানো হয়েছিলো। তখনি রিশাদ প্রত্যেকের পোশাকের ব্যাগও তাদের হাতে দিয়েছে। কেক খেয়ে বাচ্চারা চলে যাবে তাই রিশাদ নিজ দ্বায়িত্বে তাদের পৌঁছে দিতে যেতে চাইলো। নির্জন তার কোলে থাকায় মেহউইশের কাছে এগিয়ে গেল। অন্যমনস্ক মেহউইশের তখনও খেয়াল নেই কোন কিছুর। চুপ এক কোণে চেয়ার টেনে বসেছিলো সে৷ নির্জনকে মেহউইশের কোলে বসিয়ে দিয়ে আস্তে বলল, ‘ সোনা বাবা আমার তোমার মায়ের কাছে থাকো বাবা এক্ষুনি ফিরে আসবো।’ চকিতে তাকালো মেহউইশ । রিশাদের চোখে ইশারা সেইসাথে আশ্বাস । নির্জন তার কোলে বা বা বলে কান্না করছে, রিশাদের হাত খামচে ধরেছে সে। মেহউইশের কানে এখনও বাজছে, ‘তোমার মায়ের কাছে থাকো।’

রিশাদ কি তাকেই নির্জনের মা বলে সম্মোধন করেছে! রিশাদের চোখের ভাষা তো তাই বোঝালো। তবে সেই চিরকুটে নির্জনের মা কি তাকেই বলেছে? শাড়িটি কি তারই জন্য ছিলো! নীলিমা তো গাউনের মত ড্রেস পরে এসেছে। মেহউইশের মাথা ঘুরে গেল। এত বড় ভুল সে কি করে করলো? সকল আনন্দ নিজের ভুল ধারনার জন্য খারাপ হয়ে গেল।ফোলা ফোলা চোখ, আর গুমোট থাকা মুখের আবহাওয়া বদলে গিয়ে লজ্জায় লালচে হলো মেহউইশের গাল। কোলের উপর থাকা নির্জনকে সীমাহীন আনন্দে জড়িয়ে ধরে গালে গাল ছুঁলো। এত বোকামি সে কি করে করলো! আজকে ভোরটা তার সবচেয়ে আনন্দময় আর সন্ধ্যাটা গেল বোকামিময়৷ কি যে করিস না মেবিশ তুই! অস্পষ্ট স্বরে স্বগোতক্তি করলো আবার অবাকও হলো। সে কি রিশাদের সুরে নিজেকে ডাকলো! নিচে আর এক মুহূর্তও নয়। রিশাদ চলে গেছে এতিম বাচ্চাদের নিয়ে। ফিরতে তার দেরিই হবে । রাইমারা এখনও হৈ চৈ করছে নিজেদের মত সেই সাথে কেক মাখামাখিও৷ নীলিমা এখনও বসেছিলো কাছেই কোথাও উঠে এসে মেহউইশের কাছে নির্জনকে চাইলো। ইচ্ছে না হলেও দিয়ে দিলো নীলিমার কোলে। ছেলেটা কেঁদে উঠলো ভাঙা স্বরে মা মা করে ডাকলোও মেহউইশকে। কিন্তু নীলিমা জোর করেই তাকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে শান্ত করার বৃথা চেষ্টায় লেগে গেল। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টদায়ক হবে তাই মেহউইশ চলে গেল অনুষ্ঠানের জায়গা ছেড়ে। নিজের ঘরে গিয়ে শাড়ির ব্যাগটা হাতে নিতেই মনে হলো ভুল করেছে। রিশাদ নিশ্চয়ই নিচে তাকে পুরনো ড্রেসটাতে দেখে অবাক হয়েছিলো। রাগও কি হয়েছিলো তার! বলতে তো পারতো নতুন শাড়িটা কেন পরলে না? তাতেই নিশ্চয়ই মেহউইশের ভুল ভাঙতো৷ বড্ড বদখত স্বভাব লোকটার। চাইলেই শুধরে যেতে পারে, শুধরে দিতে পারে। কিন্তু নাহ, সে তো রিশাদ রায়হান খান, মিঃ যা তা। তার ভাবসাবই আলাদা, হুহ। নির্জনটা কি এখনও কাঁদছে! রাইমাকে ফোন করে জেনে নিলো মেহউইশ। নির্জনের কান্না থেমেছে এখন সে রেহনুমার কাছে আছে। ফোনটা রাখতে গিয়ে সময় দেখলো রাত এগারোটা বেজে গেছে। নিস্তব্ধতার বিন্দু মাত্র সুযোগ নেই আজ হোটেলটাতে। দোতলার রেস্টুরেন্ট কি তিন তলার কাপল স্যুট অথবা চার তলার সিঙ্গেল রুম সবগুলোতেই পর্যটকের ভীড়৷ গিজগিজ করছে আজকে সমুদ্রের তীরও। আজকে কি কোন বিশেষ দিন? নাকি বাংলাদেশের সব মানুষ আজকেই এসেছে কক্সবাজারে! শাড়িটাকে এলোমেলো করে আবার গায়ে জড়িয়ে নিতেই মন ভরে গেল। আয়নায় নিজেকে দেখে মনে হলো এই কালো রঙটা আজকে তাকে দ্বিগুণ সুন্দরী করে তুলছে৷ আর ভাবতে ইচ্ছে করছে না বরং শাড়িটা গায়ে দিতেই ইচ্ছে হচ্ছে ভীষণ।

ঘড়ির কাটা বারোটা ছুঁই ছুই; রিশাদ এসে নক করলো। নির্জন ঘুমিয়ে গেছে অনেকক্ষণ হলো। ঘরে মৃদু আলো জ্বলছে কমলা রঙের। দরজা খুলতেই রিশাদের মুখটা হা হয়ে রইলো। অল্প আলোতেই মেহউইশের ঠোঁটের গাঢ় লাল রঙ স্পষ্ট চোখে পড়ছে। সন্ধ্যাতেও তার ঠোঁটে এত গাঢ় রঙ ছিলো না। পরনে তার চকমকে কোন পোশাক ছিলো না।

-বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকবেন?

মেহউইশ এর কথায় সম্বিত ফিরলো যেন রিশাদের। সে ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়েই সোজা বাথরুমে প্রবেশ করলো। মেহউইশও পেছন পেছন বাথরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকলো, ‘শুনুন।’

রিশাদের মন বলল আজ সে চমৎকার কোন কথা অথবা দারুণ কোন উপহার পেতে চলেছে মেহউইশের কাছ থেকে। প্রথম ডাকেই সে জবাব দিলো না। মেহউইশ পুনরায় আগের মতোই ডাকলো, শুনুন।’

‘হ্যাঁ বলো’ অনেকটা নিজের গাম্ভীর্য অবদল রেখেই সে জবাব দিলো।

‘ সকালে তো চা ব্রাশ না করেই খেলেন এখন সময় হলে ব্রাশ করে তবেই আসুন।’

-কিহ!

চলবে

#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব ৪০
#রূবাইবা_মেহউইশ
💞
দরজা,জানালা এমনকি বেলকোনির দরজাটাও লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে ঘরের। যতটুকু অক্সিজেন আর কার্বনডাইঅক্সাইড আসা যাওয়া করছে তা বোধহয় ওই দেওয়ালের উপর ঘুলঘুলির ফাঁক বেয়েই৷রাতের নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে বিনিদ্র কোন প্রাণী কি আছে কক্সবাজারের বালুভূমিতে! মেহউইশ মৃদু আলোতেই আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ । তার দৃষ্টি সামনে থাকলেও সে দেখতে পাচ্ছে না কিছুই। চোখের পাতা অনড় আর ঝাপসা। ঝপাৎ ঝপাৎ পানি ছিটিয়ে মুখ,হাত,পা ধুয়ে তবেই বাথরুম থেকে বের হলো রিশাদ। হাসির দমকে সোজা দাঁড়াতে পর্যন্ত পারছিলো না একটু আগেও৷ কি বোকা মেয়ে সেই সকালে ব্রাশ না করে চা খেয়েছিলো। ধরেই নিয়েছে রিশাদ আর দাঁতই মাজেনি। দুপুরেই তো গোসলের আগে সে ব্রাশ করেছে,শেভ করেছে তারপরই গোসল। বাথরুম ছেড়ে বেরিয়েই সে মুখ হাত মুছে বিছানায় বসলো। তখনো মেহউইশ আয়নার সামনে তবে এখন আর অন্যমনস্ক নেই। হাতের চুড়ির ঝনাৎ ঝনাৎ শব্দ তুলে হাত নাচিয়ে লোশন মাখছে৷ রিশাদের একবার মনে হলো বলে, এত শব্দ করলে ছেলেটা উঠে যাবে। পরক্ষণেই মনে হলো থাক, আজ নির্জনও জানুক তার আধ পাগল মা এই মাঝরাতে কেমন পাগলামি করছে৷ মেহউইশের মনের খবর রিশাদের অনেক আগেই পড়া হয়ে গিয়েছে তবুও সে আগ বাড়িয়ে ধরা দেয়নি।ইচ্ছে হয়নি তা নয়, বরং তীব্র আকাঙ্ক্ষা জেগেছিলো ঝড় বাদলের রাত গুলোতে বুকের কাছে জড়িয়ে রাখতে তাকে৷ মনের মধ্যে শুঁয়োপোকারা কুটকুট করে কামড়ে ধরে উত্যক্ত করতো মেহউইশকে ছুঁয়ে দেখতে৷ ঘুম ভাঙানিয়া পাখিরাও পাহাড়ি বাড়িতে যন্ত্রণা দিতো মেহউইশের কাছে ক্ষমা চাইতে। কোনটাই করা হয়নি রিশাদের এ পর্যন্ত৷ সুযোগ এসেও আসেনি কখনও মন খুলে কথা বলার। স্বাভাবিক স্বামী স্ত্রীর মতো আচরণ তারা লোক সম্মুখে অনেক আগে থেকেই করছে কিন্তু কখনও আড়ালে তাদের ভাব হয়নি। আজকে মেহউইশের আচরণ অন্যরকম। সন্ধ্যেবেলায় মেহউইশ যে নাক ফুলিয়ে, গাল ফুলিয়ে কেঁদেছে খুব তা রিশাদ বুঝতে পেরেছে।

‘নির্জন কে ঘুমানোর আগে খাইয়েছিলে কিছু? সন্ধ্যায় তো কিছুই খায় নি।’

-‘ আপনার কি মনে হয়! ‘

-‘সোজা করে বললেই হয় খাইয়েছো।’

-‘না, আমি সোজা কথা বলতে পারি না।’

-‘কবে থেকে?’

-‘যবে থেকে আপনি এসেছেন আমার জীবনে’ কথাটা বলেই চোখ মুখ বন্ধ করে জ্বীভে কামড় বসালো। কথাটা এভাবে না বললেও হতো।হঠাৎ করেই ঘরের আবহাওয়াটা ভারী হয়ে গেল। মেহউইশ যে কথাটা বাজে ইঙ্গিত করে বলেনি তা যেন রিশাদ বুঝে গেল। সে কথা ঘোরাতেই ফটাফট বিছানা ছেড়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘ ঘরে কি কিছু খাওয়ার মত আছে?’

-ইয়ে মানে, আমতা আমতা করে কিছু বলতে চাইলো মেহউইশ, রিশাদ তাকে থামিয়ে দিলো।

-‘আচ্ছা আমি রেস্টুরেন্টে দেখছি। তুমি কিছু খেলে বোলো।’

‘শুনুন’ রিশাদ দরজা খুলতেই ডেকে উঠলো মেহউইশ । মাথা নত করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে সে রিশাদের দিকে। কন্ঠস্বরও ভারী হয়ে এসেছে তার। ধরা গলায় আবার বলল, ‘ আমি অন্যকিছু মিন করে বলিনি কথাটা শুধু মজা করে’ থেমে গেল মেহউইশ। তার কথা শেষ হওয়ার আগেই রিশাদ দরজা আবার লাগিয়ে ফিরে এসেছে তার কাছে। মুখোমুখি, চোখাচোখি হলো দুজনের। অল্প আলোয় অস্পষ্ট দেখছে দুজন দুজনকে। ঘরময় নিস্তব্ধতার রেখায় আচর কাটছে দুজনের নিঃশ্বাস। পা থেকে মাথা পর্যন্ত মন ভরে দেখার ব্যর্থ চেষ্টা রিশাদের। নিজের একটা হাত সামনে তুলে ধরে ইশারা করলো। আধো আলোয় ইশারাটুকু বিফলে গেল না। নিঃশব্দে মেহউইশ হাত বাড়িয়ে ধরে নিলো রিশাদের বাড়িয়ে দেওয়া হাত। হাতে হাত রেখেই দুজন এগিয়ে গেল বেলকোনিতে। কাঁচের স্লাইডিং ডোর খুলতেই এক দমকা হাওয়া ছিটকে দুজনের চোখেমুখে। বেলকোনির সবগুলো কাঁচ লাগানো নেই বলেই হয়তো মধ্যরাতের বাতাসের গর্জন কানে এসে তালা লাগিয়ে দিলো। রিশাদ গ্রিলের সামনের পর্দা সরিয়ে কাঁচ লাগালো৷ দেয়াল হাতড়ে বাতি জ্বালালো আর মেহউইশ এগিয়ে পর্দা টানলো। এখন আর বেলকোনিটাকে আগের মত লাগছে না। রূপ বদলেছে তার। বেলকোনিটাকে এখন ডিম্বাকৃতি একটা ঘরই মনে হচ্ছে । রিশাদ মনে মনে প্রস্তুতি নিলো, এই তো সময় ক্ষমা চাওয়া নিভৃতে মনের সকল কথা বাতাসে বাতাসে ছড়িয়ে দেওয়ার। ভুল শুধরে মেহউইশকে আপন করে একটা জীবন কাটিয়ে দেওয়ার অনুমতি নিতে এখনই সময়।

আলোয় আলোয় পূর্ণ হয়ে উঠেছে বেলকোনি রূপী কক্ষটা। মেহউইশের চোখের কাজল,ঠোঁটের লিপস্টিক, কানের দুল এমনকি গলায় থাকা পাতলা চিকন চেইনটাও ঝকমকিয়ে চোখ ধাঁধালো রিশাদের। চোখ বুঁজে গুছিয়ে নেওয়া কথাগুলো নিঃসীম প্রায় তাকে ছেড়ে পালিয়ে গেল বহুদূরে। ফ্লোরে পাতা ম্যাট্রেসের উপর আলতো করে বসে পড়লো মেহউইশ যেন সে বসতে গেলেই ফ্লোর কাঁপবে, ধূলো উড়বে! মুখোমুখি রিশাদ যেন বলতে চায় হাজারো কথা অথচ তার চোখ বলছে চুপিসারে সময় যাক স্রোতের মত।হাতের তালুতে হাত মিলিয়ে কাছে টেনে আনলো মেহউইশকে। গুছিয়ে রাখা কথারা নেই আর ধারেকাছে, গুছিয়ে রাখা কল্পনাটা ঠিকই আছে মস্তিষ্কে।

-‘আমি কিছু বলতে চেয়েছিলাম তোমায়’ রিশাদের গলার স্বর নিজের কাছেই অচেনা ঠেকলো। মেহউইশ কিছু বলল না শুধু চুপচাপ এগিয়ে আসলো আরও কাছে। যতোটা আসলে দেহের তপ্ততা অনুভব করা যায়। সেই তপ্তায় অজস্র প্রজাপতি উড়াউড়ি করে ফরফর শব্দ তুলছে রিশাদের কানের কাছে। খেই হারিয়ে ফেলছে সে ধীরে ধীরে। কি বলতে চেয়েছিলো তাই তো ভুলে গেছে এখন। শক্ত পুরুষালী হাতটা রিশাদের আপনাআপনিই উঠে এলো মেহউইশের গ্রীব্রাদেশ ছুঁয়ে গালের কাছে। গা শিরশিরানি উত্তেজনা মেহউইশের পাতলা দুটি ঠোঁটে কাঁপন তুলল। শাড়ির আঁচল সরে গেছে অনেকটা। আবেশে চোখ বুঁজে আছে মেহউইশ, রাতের আঁধার ঘন হোক তারই চোখের পাতায়।কত কথা বলার ছিলো তার নিজেরও । কোথায় গেল সেই কথার ঝুড়ি! স্পর্শের মত্ততায় বিভোর হয়ে কথারা আজ ছেড়ে গেছে তাদের। রিশাদের অবাধ্য হাতের নিষিদ্ধ বিচরণ মেহউইশের অষ্টাদশীতে ফেলে আসা মনটাকে আজ টেনে হিঁচড়ে তেইশে পড়া দেহের ভেতর নতুন করে বসিয়ে দিচ্ছে। ঠোঁটের কাছে ঠোঁটে এনেও থমকে গেছে রিশাদ। গভীর মনযোগে দেখতে লাগলো মেহউইশের রক্ত রঞ্জিত পেলব দুটো ঠোঁট, মেঘের ছাউনির মত ঘন পাপড়িতে ঢাকা বন্ধ দুটি চোখ, আর খাঁজ কাটা চিবুকটাকে। এত মায়াবী এতোটা গভীর এতোই মনোহারিণী রূপ কি সে এই প্রথম দেখলো! থমকে গেছে নিঃশ্বাস তার মেহউইশের এই রূপ দেখে। দম কি আছে তার নিজেকে সামলানোর!

রিশাদের থমকে যাওয়ায় চোখ খুলে নেয় মেহউইশ। চোখে চোখ রেখে বুঝতে চায় রিশাদের চোখের ভাষা। আগ বাড়িয়ে আলতো ছোঁয়ায় রিশাদের ঠোঁটে চুমু খেয়ে যেন আহ্বান জানালো রিশাদকে সে।এই আহ্বানের সুপারিশ ছিলো কাছে আসার যা রিশাদের অগ্রাহ্য করার মত সাধ্য হলো না। নিমেষেই ভুলে গিয়ে সকল ভয়,জড়তা আর নিজের করা ভুল। এই মুহূর্ত একান্তই হঠাৎ পাওয়া প্রেয়সীর লতার মত দেহখানায় নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়ার। তারপরের সময়টুকু কেটেছে তাদের প্রথমবার ভালোবাসায় দেহের খেলায়।রাত গড়িয়ে ভোর নেমেছে জগৎসংসারে মিষ্টিমধুর আদরে মেখে।

ভোর রাতে ঘুমে ঢুলুঢুলু মেহউউশ রিশাদের কানের কাছে মুখ রেখে বলল, ‘ অনেক হয়েছে এবার ছাড়ুন ঘুমাবো।’

ছাইরঙা অন্ধকারে গুমরে থাকা বেলকোনিটায় অনেক আগেই আলো নিভেছে। দুজন মানুষ আচম্বিতেই মেতে উঠেছিলো দেহের ক্ষুুধায় আদিম নেশায়। নগ্ন মেহউইশ শীতের রাতের বালাপোষের মতোই রিশাদকে জড়িয়ে নিয়েছিলো নিজের মাঝে ।

সকাল থেকেই সমুদ্র পাড়ে তানভীর চিন্তিত মুখে হাঁটছে।কালকে সে ঢাকায় ফিরবে সাথে রাইমার বন্ধুরাও। রাইমা থেকে যাবে আরো কিছুদিন তার দাদাভাইয়ের বাড়িতেই।চিন্তার কারণ তার সেটা নয় চিন্তা হলো মাস অনেক হলো মায়ের কাছে শুনেছে ইভান ভাই বিয়ে করেছে। আত্মীয়স্বজন সবাই জানতো ভাইয়া মেহউইশ নামের এক মেয়েকে ভালোবাসে আর তানভীর তো সেই মেয়েকে সামনে থেকেও দেখেছে। রাইমার ভাবী মেহউইশ তার ভাবী মেহউইশ হওয়ার কথা ছিলো। তবে কি ঘটনা সত্যি রাইমার ভাই জোর করে,,

‘ একা একা ঘুরতে বেরিয়েছো?’ রিশাদের কথায় তানভীরের ভাবনায় ছেদ ঘটল। চমকেছেও খুব আচানক কথা শুনে। খালি পায়ে তীর ঘেঁষে হাটার ছলে দূর থেকে আসা ঢেউয়ে পা ভিজিয়ে নিচ্ছে তানভীর।

‘জ্বী! না মানে সবাই এখনও ঘুমুচ্ছে। ঘুরতে এসে যদি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সময় পার করবে তবে আসার কি দরকার ছিলো! তাই আমি একাই বেরিয়ে পড়েছি।’

রিশাদ খেয়াল করেছে তানভীর তাকে দেখে ভরকে গেছে। হয়তো নিজেকে স্বাভাবিক দেখাতেই ওরকম ফটাফট জবাব দিচ্ছে।

‘হুম, ঘুমাতেই যদি আসা তবে বাড়িতে থেকে ঘুমানোই ভালো।পাহাড়, নদী,সমুদ্র আর জঙ্গল এদের পাশে এসে যদি গভীর ভাবে অনুভবই না করো তবে আসাটাই বৃথা। সমুদ্রের ঢেউ আর গর্জন মন আর মনের ভেতর জমে থাকা সকল ক্লেশ নিংড়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। তা তুমি কি নিয়ে পড়াশোনা করছো যেন?’

শেষের কথাটা বলেই রিশাদ তানভীরের দিকে তাকালো। চলতে চলতে কথা হচ্ছিলো দুজনে হঠাৎই যেন পা থেমে গেল। রিশাদের চোখে চাইতে সাহস হয় না তার তবুও একবার চেয়ে দেখলো। রিশাদ কি কিছু আন্দাজ করেছে!

‘কেমিস্ট্রিতে অনার্স লাস্ট ইয়ার।’

– রাইমা খুব ভীতু স্বভাবের, তার ধারণা দাদাভাই শুধু তাকে শাষণই করে। সে কারণেই মন খুলে কখনো মনের সবটা আমায় বলতে পারেনি। অথচ সে জানেই না তার দাদাভাই তাকে শুধু নিজের বোন নয় সন্তানের মতোই ভালোবাসে, স্নেহ করে। তুমি শুধু সিনিয়র হিসেবেই আসোনি কালকে তা আমি আগেই জেনেছি।’

তানভীর জমে গেল নিজের জায়গায়। রিশাদ কি তাকে ওয়ার্ন করতে চায়! অর্থবিত্তের সমতা নিয়েও কি কোন কথা বলবে? সে তো রাইমাকে সত্যিই খুব ভালোবাসে । অর্থের দিকে সে রাইমাদের যোগ্য কখনোই হতে পারবে না কিন্তু সম্পর্কের দিক থেকে সে পরিপূর্ণ সুখী রাইমাকে অবশ্যই রাখতে পারবে।

‘ভাইয়া আমি, আমরা ‘ ইতস্তত করছে তানভীর তা দেখেই রিশাদই আবার বলল, ‘ পড়াশোনা করে ভালো কিছু করো ততদিনে রাইমাও নিজের পড়ালেখায় আরেকটু এগিয়ে যাক। আর হ্যাঁ আমার বোন ঠিক ততদিনই পড়বে যতদিন সে চায়।’ রিশাদের কন্ঠস্বর কঠিন আর গাম্ভীর্যের ধার অতুলনীয়। তানভীর ভয় পাবে না পাবে না করেও যেন ভয় পেল কিছুটা। তবে সে সৎ এই ভেবে আশ্বাসও দিলে নিজেকে। রিশাদের ফোন আসায় সে কথার সমাপ্তি টেনে চলে গেলো হোটেলে।

ঘুম থেকে উঠেই মেহউইশ মাইমুনার পেছন পেছন ঘুরছে সুই সুতা নিয়ে। একটু পরই তারা আবার ফিরে যাবে তাদের পাহাড়ি বাড়িতে। মাইমুনা আর মিহাদ ঢাকায় ফিরবে বলেছে এখান থেকে আজকেই তাই মেহউইশ বলছে, ‘যেতে হয় যাও আটকাবো না আগে আমার নাক ফুরিয়ে দাও।’

চলবে