#মন_নিয়ে_কাছাকাছি “১”
#জেরিন_আক্তার_নিপা
১🌸
গলির মুখেই তিন চারটা কুকুর নিজেদের মধ্যে ঝামেলা পাকাচ্ছে। ওদের হিংস্র ঘেউ ঘেউ শব্দ শুনেই মীরার কলিজা কেঁপে উঠল। কুকুর কে না ভয় পায়? তার উপর যদি সেই ভয়টা ছোট বেলা থেকেই হয়ে থাকে! মীরা ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে আশেপাশে দেখল। একটা মানুষও নেই। সে প্রাইভেট পড়ে বাড়ি ফিরছিল। সামনেই তার এসএসসি পরীক্ষা। চাচ্চু জোর করে মুবিন ভাইয়ের কাছে পড়তে পাঠাল। ভেবেছিল দু-এক দিন পড়ে কোন একটা বাহানা দিয়ে আর পড়বে না। বাহানা একটা ঠিক করেই রেখেছিল। মুবিন ভাই ভালো করে পড়াতে পারে না। উনার পড়া আমি কিছুই বুঝি না। সব মাথার উপর দিয়ে যায়। এটা বললেই ছোট চাচ্চু বলত, থাক তাহলে আর পড়তে হবে না। তোর জন্য অন্য মাস্টার দেখছি। কিন্তু মুবিন ভাই এত সুন্দর করে পড়ায় মীরার কাছে এখন হায়ার ম্যাথের মতো বিরক্তিকর সাবজেক্টও ভালো লাগতে শুরু করেছে। এখন সে আফসোস করে। ইশশ, আরও আগে কেন মুবিন ভাইয়ের কাছে পড়তে এলো না! এক মাসেই যদি তার এতটা উন্নতি হয়েছে তাহলে এক বছরে নিশ্চয় সব কয়টা সাবজেক্ট তিন চামচ চিনি আর অর্ধেকটা লেবুর রস দিয়ে গুলিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে ফেলত। কিন্তু ওসব কথা এখন ভাবছে না সে। এই কুকুর গুলোকে পার করে কীভাবে বাড়ি যাবে? সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। বাড়ি ফিরতে দেরি হলে বাবা, কাকারা হার্টের রোগী হয়ে বিছানা নিবে।
“ছাতার মাথা! কুত্তা গুলা যায় না কেন?”
মীরার রাগ উঠছে। সে ঠোঁট উলটিয়ে কুকুর গুলোকে গালাগালি করছে। কিছু তো করার নেই। তার ছোট কলিজায় এতটা সাহস নেই যে কুকুরের পাশ কাটিয়ে যাবে। মীরা ঠোঁট কামড়ে দুই হাতে দুই বিনুনি ধরে টানতে টানতে পা দিয়ে রাস্তায় ঠুকাঠুকি করছে। মীরা যখন মনস্থির করে নিয়েছে যতক্ষণ কুকুর গুলো না যাবে ততক্ষণ তাকে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, তখনই তাকে পাশ কাটিয়ে একটা লোক চলে গেল। মীরা পেছন থেকে দেখে যতটুকু চিনলো তাতে মনে হয়েছে, এটা তো মুবিন ভাইয়ের বড় ভাই, জায়িন ভাই। মীরার সাথে লোকটার আলাপ খুব কম। তিনি বাড়িতে থাকেন না। ঢাকা থেকে পড়াশোনা করেন। মুবিন ভাইয়ের মুখে শুনেছিল তার বড় ভাই ডাক্তারি পড়ছে। ইনি বাড়িতে এসেছেন মীরা জানত না। অথচ সে রোজ এবাড়িতে এক দুই ঘন্টা সময় কাটিয়ে যায়। তবুও মানুষটার সাড়াশব্দ পায়নি। তিনি বাড়িতে এলে মীরা যদিও সামনে পড়ে তাহলেও তিনি কথা বলেন না। সেবারের কথাই ধরা হোক না। মীরা জানতো মুবিন ভাইয়েরা দুই ভাই। তার বড় ভাই বাড়িতে থাকে না। লোকটাকে কোনদিনও দেখেনি মীরা তাহলে তাকে কীভাবে চিনতো? আন্টি তাকে ভীষণ পছন্দ করে। পড়া শেষ হলেও মীরা আন্টির সাথে গল্প করে বাড়ি ফিরে। সেদিন মীরা হলরুমে বসে রান্নাঘরে থাকা আন্টির সাথে বেশ উঁচু স্বরেই কথা বলছিল। হঠাৎ ওই লোকটা রুম থেকে বেরিয়ে এসে কেমন রাগ রাগ চোখে মীরাকে দেখে জোরে বলে উঠল,
“মা, এটা কি বাড়ি নাকি অন্য কিছু? শান্তিতে যে রুমে একটু বসব সেটাও তো হচ্ছে না।”
অচেনা এই লোকটাকে এতটা রাগতে দেখে মীরা ভরকে গেল। একেতো এই লোকটাকে সে চিনে না। তার উপর কেমন রেগে কথাগুলো বলল। মীরা থতমত মুখে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে লোকটার দিকে চেয়ে রইল। লোকটা মীরাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আবার রুমে চলে গেল। আন্টি রান্নাঘর থেকে ছুটে এলে মীরা বলল,
“এই শয়তান লোকটা কে আন্টি? কেমন অসভ্য দেখেছ!”
আন্টি মীরার কথা শুনে হাসতে হাসতে বলল,
“এই অসভ্য শয়তান লোকটাই আমার ছেলে। মুবিনের বড় ভাই।”
মীরা জিভ কামড়ে বোকা বোকা হেসে আন্টির দিকে দেখল। আন্টি এখনও হাসছে। মীরা অপরাধী মুখে মিনমিন করে বলল,
“উনি তো বাসায় থাকে না। উনি যে এসেছেন আমি জানতাম না। জানলে পড়া শেষ করেই বাড়ি চলে যেতাম।”
সেদিনের পর লোকটা যতদিন বাড়িতে থেকেছে মীরা পড়া শেষ করে এক সেকেন্ডও দেরি করেনি।
বদমেজাজি মানুষের সাথে কথা বলারও কোন ইচ্ছে নেই ওর।
জায়িন ভাই চলে যাচ্ছে। মীরা দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে এক হাত দূরত্ব রেখে জায়িনের পেছন পেছন হাঁটতে লাগল। কুকুর গুলোর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ভয় লাগছিল। তাই আরেকটু কাছে চলে এলো। মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগল জায়িন ভাই যেন এখন পিছনে ফিরে তাকে না দেখে। গলিটা পেরিয়ে এলে মীরা মুখ মুচড়ে দূরত্ব অনেকটা বাড়িয়ে নিল।
“শয়তান লোক। জন্মের সময় তো মুখে মধু দেয়ই নি। ছোটদের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় এটাও শেখায়নি। আন্টি কত ভালো। মুবিন ভাইও তো ভালো। পড়া না পারলে বকে শুধু। পড়ার বাইরে কত সুন্দর করে কথা বলে। এই লোককে দেখে মনে হয় এক্ষুনি বুঝি গার্লফ্রেন্ড এর সাথে ব্রেকআফ করে এসেছে।”
মনে মনে যার গোষ্ঠী উদ্ধার করছিল পেছন থেকে একটা কুকুর রাগী চোখে ঘেউঘেউ করতে করতে তার দিকেই আসছে দেখে মীরা কূলকিনারা না পেয়ে দৌড়ে আবার ওই লোকটার কাছেই চলে এলো। বুকের ভেতর ধপাস ধপাস শব্দ হচ্ছে। এক্ষুনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে মনে হচ্ছে। কুকুরটা পাশ ঘেঁষে দৌড়ে চলে যেতেই মীরা ভয় পেয়ে “ও বাবাগো” বলে লোকটার শার্ট খামচে ধরল। চোখ বন্ধ করে কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে বিড়বিড় করতে লাগল। মনে হয় কোন দোয়া পড়ছে। তার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। ভয়ে কলিজা বেরিয়ে যাচ্ছে। জায়িন শার্টের হাতায় টান অনুভব করে একটিবার চোখ বন্ধ করে কাঁপতে থাকা ভয়ার্ত মুখটার দিকে তাকাল। মীরার কাঁপা-কাঁপি দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে কতটা ভয় পাচ্ছে। জায়িন ওকে সান্ত্বনা দিতে আলতো করে হাতটা ধরলে মীরা শক্ত করে ওর হাত ধরে ফেলল। অস্ফুটস্বরে বলতে লাগল,
“ভয় লাগছে। ভয় লাগছে জায়িন ভাইয়া।”
মেয়েটার মুখ থেকে নিজের নাম ও ভাইয়া সম্বোধন শুনে না চাইতেও কপালে সূক্ষ্ম কয়েকটা ভাজ পড়েই মিলিয়ে গেল। মেয়েটা তাকে চেনে! জায়িন শান্ত কন্ঠে বলল,
“কুকুর চলে গেছে। কিছু করবে না।”
কুকুর চলে গেছে! মীরা ভয়ে একটা চোখের পাতা একটু ফাঁক করে দেখল। হ্যাঁ, সত্যিই চলে গেছে। সময় নিয়ে দু-চোখই খুলল। মীরা যখন লক্ষ করল সে জায়িনের হাত ধরে রেখেছে, তাৎক্ষণাৎ ছিটকে দূরে সরে গেল। জায়িনের দিকে তাকিয়ে লজ্জিত মুখে হেসে বলল,
“সরি ভাইয়া।”
“হু।”
মীরা লজ্জায় আর জায়িনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। একপ্রকার দৌড়ে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরল। লোকটা কী ভাববে? অসভ্যের মতো হাত ধরে ফেলেছে। নিশ্চয় তিনি বিরক্ত হয়েছেন।
“মীরা তোর যে কেন এত ভয়! কুকুর কি তোকে খেয়ে ফেলত! বেশি বেশি করিস।”
🌸
মীরা বাড়ি এসে দেখল ছোট চাচ্চু তাকে আনতে যেতে বেরুচ্ছে। মীরাকে ফিরে আসতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
“আজ এত দেরি হয়েছে কেন আম্মু?”
“রাস্তায় কয়েকটা কুকুর ছিল চাচ্চু।”
“এ বাবা! ভয় পাওনি তো তুমি আম্মু? কীভাবে এসেছ?”
“ভয় একটু পেয়েছি। তবে একটা লোকের পেছন পেছন চলে এসেছি।”
“কাল থেকে পড়া শেষ হলে তুমি ওখানেই বসে থাকবে। আমি গিয়ে তোমাকে নিয়ে আসব।”
মীরা আহ্লাদ করে চাচ্চুর একহাত জড়িয়ে ধরে বলল,
“তুমি কত ভয় পাও চাচ্চু। আমি কিন্তু এত ভয় পাই না।”
ওরা বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে মীরার ছোট চাচী এসে হাজির। তিনি মীরাকে বকতে লাগলেন।
“এই মেয়ে তুই কি এখনও ছোট। পড়া শেষে সোজা বাড়ি না ফিরে রাস্তায় রঙঢঙ করিস।”
মীরার ছোট চাচী সাত মাসের প্রেগন্যান্ট। তিনি তার বিশাল পেট নিয়ে এতক্ষণ মীরার চিন্তায় পুরো হলরুম জুড়ে পায়চারি করেছে। মীরা চাচীর কাছে এসে হেসে বলল,
“তুমি আমাকে বকছো তো! আমিও কিন্তু তোমার বাবুকে অনেক বকব। মারবও। তখন তুমি কিছু বলতে পারবে না।”
“তোর এসব মন ভোলানো কথাতে আজ আমি ভুলবো না। প্রতিদিন আমাদের এমন টেনশন দিলে তোর বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ।”
মীরা এই বাড়ির একমাত্র মেয়ে না। এবাড়িতে আরও অনেক ছেলেমেয়ে আছে। কিন্তু সবার মধ্যে মীরাই একটু বেশি স্পেশাল। মা হারা মেয়ে বলে? না। আরেকটা কারণ আছে। কারণটা গল্প এগোবার সাথে সাথে জানা যাবে। সন্ধ্যায় মীরা পড়ার টেবিলে বই খুলে বসে আছে। একদিনও সে সন্ধ্যায় পড়তে বসে না। আজ বসার কারণ হলো তার ভাইবোন কেউ বাড়িতে নেই। থাকলে এখন মীরার ঘরে ওদের আড্ডা বসতো। বড়ো মা’র বাবা অসুস্থ। তনি আপু, ইভান ভাই, রুশমি সবাই দুপুরে নানুবাড়ি গেছে। আজকে ফিরবে না। হয়তো কালও ফিরতে না পারে। তনি আপুরা বাড়িতে নেই তাই আবির ভাইও আসেনি আজ। আবির ভাই তার ছোট ফুপুর একমাত্র ছেলে। ছোট ফুপুর বাসা কাছেই। তাই আবির ভাই বেশির ভাগ সময় তাদের সাথে এসেই আড্ডা দেয়। মীরা হাতের উপর মাথা রেখে শুয়ে শুয়ে ভাবছে আজ তার সময় কীভাবে কাটবে? আজকে খাওয়াদাওয়াও হবে না।
চলবে_