মন নিয়ে কাছাকাছি পর্ব-১৩+১৪

0
482

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
১৩
🌸

কলেজের সামনেই ভ্যানে করে ফুলগাছ বিক্রি করে। মীরা মাহিমা দাঁড়িয়ে গাছ দেখছিল। মীরা অনেকদিন ধরে একটা কামিনী ফুলের গাছ খুঁজছে। কিন্তু কোথাও পাচ্ছে না। মাহিমা আবোলতাবোল ফুল গাছ কিনতে চাইলে মীরা ওকে ধমকে নিষেধ করল। গাছ না কিনলেও মাহিমা লোকটার কাছে সব গাছের দাম জানতে চাচ্ছে। লোকটা প্রথম দিকে দাম বললেও ওরা গাছ কিনবে না বুঝতে পেরে বিরক্ত হচ্ছে।

“আপা গাছ না কিনলে হুদাই দরদাম কইরেন না। আর আপনারা সাইড হয়ে দাঁড়ান। আরও কাস্টমার আসব।”

লোকটার কথায় মাহিমা তেতে উঠে বলল,

“আমরা গাছ কিনব না আপনাকে বলেছি? দশটা দেখে একটা কিনব। আপনার দামাদামি করতে এত কষ্ট লাগলে গাছ বেচবেন কীভাবে? আর আমাদের যে সাইড হয়ে দাঁড়াতে বলছেন, আমরা আপনার কাস্টমার না?”

লোকটা ঝগড়া না করে অনুরোধ করে বলল,

“গাছ তো কিনতাছেন না। খালি দামই জিগাইতাছেন।”

“তো? পছন্দ না হলেও গাছ কিনে নিয়ে যাব নাকি? দেখছি, পছন্দ হলে অবশ্যই নিব।”

“আচ্ছা দেখেন।”

ঝগড়ায় জিতে গিয়ে মাহিমা বিশ্ব জয় করা হাসি দিল। মীরা এতক্ষণ ওর ঝগড়া দেখেছে। মেয়েটা এত ঝগড়ুটে কেন? মীরার একটা জিনিয়া ফুলগাছ পছন্দ হলো। সে এটার দাম জিজ্ঞেস করছে। ওরা দাম ঠিক করে টাকা দেওয়ার সময় একটা মেয়ে এসে ওদের পেছনে দাঁড়িয়ে বলল,

“আপু একটু সাইড দিবেন?”

দু’জনই একসাথে ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়েটাকে দেখল। এবং দেখতেই থাকল। এত সুন্দর মেয়ে এর আগে মনে হয় কোনদিন দেখেনি। নিজের দিকে ওদেরকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেয়েটাও হাসল। হাসিটাও কী সুন্দর! মীরা মাহিমা সরে দাঁড়াল। মাহিমা মীরার হাত চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল,

“মেয়েটা কী সুন্দর, না মীরা?”

“হুম। হাসিটাও কতো সুন্দর দেখেছিস!”

“ইশ! আমরা এমন সুন্দর হলাম না কেন? হলে এলাকার সব ছেলেরা আমাদের জন্য পাগল হয়ে যেত।”

“কিন্তু এই মেয়েকে তো আগে কখনও এদিকে দেখিনি। নতুন এসেছে?”

মাহিমা মাথা নেড়ে জানাল সে জানে না। মীরা বলল,

“জিজ্ঞেস করি?”

“কর।”

মেয়েটাও ফুলগাছ কিনেছে। কিন্তু ওদের মতো দরদাম করেনি। মেয়েটা চলে যাবার সময় মীরা জিজ্ঞেস করে ফেলল।

“আপু আপনি কি এখানে নতুন এসেছেন? আগে কোনদিন দেখিনি তো।”

মেয়েটা মীরার দিকে তাকিয়ে ভীষণ মিষ্টি করে হেসে বলল,

“হ্যাঁ। এখানের স্কুলে জব নিয়েছি। এই এলাকায় নতুনই।”

মাহিমা কৌতূহল ধরে রাখতে না পেরে বলে উঠল,

“আপনি টিচার?”

“হুম। তোমরা কিসে পড়ো?”

“আমরা দু’জনই ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি।”

“ওহ। তোমাদের বাসা কি এদিকেই?”

ওরা হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছে। মেয়েটার সাথে কথা বলতে পেরেই ওরা খুশি। মীরা জবাব দিল।

“হ্যাঁ। আপনি কোথায় থাকেন?”

“সামনেই।”

মাহিমা ফস করে বলে ফেলল,

“আপু আপনার কি বিয়ে হয়ে গেছে?”

কথাটা জিজ্ঞেস করে বুঝলো মানুষের পার্সোনাল লাইফ নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করা ঠিক না। তবুও জিজ্ঞেস করে ফেলেছে এখন আর কি করবে? মেয়েটা সন্দেহের চোখে তাকিয়েও মিষ্টি হেসে বলল,

“কেন আমাকে তোমাদের পছন্দ হয়েছে বুঝি?”

মেয়েটা এত ভালো কেন? একটুও রাগছে না। মীরাও মুখ ফসকে বলে ফেলল।

“আপনি অনেক সুন্দর। অনেক ভালোও।”

মেয়েটা ওদের দু’জনের ছেলেমানুষি দেখে হাসছে। মীরা মাহিমা দু’জনই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে।
🌸
মাহিমা বাড়ি গেল না। মীরার সাথে মামার বাড়ি চলে এসেছে। এবং এসেই বড় মামী, ছোট মামীকে মেয়েটার কথা বলেছে। একজন মানুষের যতটুকু প্রশংসা করা যায় তার থেকেও বেশি করেছে। সব শুনে ছোট মামী বলল,

“তোমাদের কি মেয়েটাকে অনেক বেশি পছন্দ হয়েছে?”

দু’জনই একসাথে মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানাল। ছোট মামী আবার বলল,

“মেয়েটা কি অনেক বেশি সুন্দর?”

“হুম। অনেক! আর মিষ্টিও। অনেক ভালো।”

ওদের কথা শুনে ছোট মামী হাসতে হাসতে বলল,

“তা এখন কী করবে দু’জন? তোমরা তো ছেলে না। ছেলে হলেও মেয়েটা তোমাদের সিনিয়র হতো। আর তার থেকেও বড় কথা। দু’জনই কি মেয়েটাকে প্রপোজ করতে?”

দূর! ছোট মামী মজা করছে। কেউই ওদের কথায় তেমন একটা পাত্তা দিচ্ছে না। মীরা মাহিমা রাত হওয়ার অপেক্ষায় থাকল। সন্ধ্যা থেকেই ইভান ভাইয়ের ঘরে গিয়ে বসে থাকল। ইভান অফিস থেকে ফিরেই দুই বিচ্ছুকে নিজের ঘরে দেখে কিছুটা অবাক হলো। অফিসের ব্যাগ রাখতে রাখতে দু’জনকে দেখল। ওরা কিছু বলার জন্য মুখিয়ে আছে বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করল,

“কী চায় বলে ফেল। আজকে আমি অনেক ক্লান্ত। আজ কোন আড্ডা হবে না।”

মীরা মাহিমা এই অপেক্ষাতেই ছিল ভাইয়া কখন শুনতে চাইবে। মাহিমা হেলান দিয়ে বসা থেকে সোজা হয়ে বসে বলল,

“ইভান ভাই তুমি বিয়ে করবে?”

ইভান শার্টের হাতার বোতাম খুলছিল। থেমে গিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল,

“মানে?”

মীরাও মাহিমার সাথে সুর মেলালো। সে উঠে এসে ইভান ভাইয়ের সামনে চেয়ারে বসে বলল,

“আমাদের পছন্দের একটা মেয়েকে তুমি বিয়ে করবে?”

ইভান অনেকটা সময় নিয়ে দুইটার মুখের দিকেই ভালো করে দেখল। এবং বুঝলো এরা কোন মজা করছে না। যা বলছে সিরিয়াস হয়েই বলছে।

“মানে তোরা কী বলছিস আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। কিসের বিয়ে? কাকে বিয়ে করব?”

“একটা মেয়েকে আমাদের দু’জনেরই ভীষণ পছন্দ হয়েছে। ছেলে হলে আমরা ওকে প্রপোজ করতাম। এখন তো তা পারব না। তাই ওই মেয়েকে ভাবী করে আমাদের বাড়িতে আনতে চাই।”

মাহিমা কাকুতি মাখা কন্ঠে বলল,

“প্লিজ ইভান ভাই তুমি রাজি হয়ে যাও।”

“মেয়েটা অনেক সুন্দর।”

“আর স্কুলের টিচারও।”

“তোমাদের দু’জনকে ভীষণ মানাবে।”

ইভান এদের পাগলামি দেখছে। কলেজে পড়া দুইটা মেয়েও কি এতটা অবুঝ হবে! ইভান মজা করেই বলল,

“সব তো বুঝলাম। কিন্তু মেয়েটাকে তোরা কোথায় পেয়েছিস?”

“আজ কলেজ থেকে ফেরার সময় ফুলগাছ কিনতে গিয়ে রাস্তায় দেখা হয়েছে।”

“আজই দেখা হয়েছে?”

“হুম।”

“মেয়ের বাড়ি কই?”

হায় হায়! মেয়ের বাড়ির ঠিকানা তো জানে না ওরা। ওদের দু’জনের মুখ দেখে ইভান মুখ টিপে হেসে বলল,

“বাড়ি কই জানিস না?”

“না। এই এলাকায় উঠেছে এটা জেনেছি। কিন্তু ঠিকানা জানি না।”

ইভান পাগল গুলোর পাগলামিকে আরও বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

“তোরা দুই গোয়েন্দা বাড়ি খুঁজে বের করতে পারবি না?”

ইভান ভাই কি তাহলে রাজি? দু’জনই খুশি হয়ে বলল উঠল,

“অবশ্যই পারব।”

“ঠিক আছে। মেয়েটা অবিবাহিত কি-না এটা জেনেছিস তো? দেখা গেল অন্য বেডার বউয়ের পেছনে ঘুরছিস।”

“না না। বিয়ে হয়নি। আমরা জিজ্ঞেস করেছিলাম। তখন মেয়েটাও বলেছে, কেন আমাকে কি তোমাদের পছন্দ হয়েছে? মেয়েটা অনেক ভালো।”

হায়রে! বোনেরা রে! তোরা কোন গ্রহ থেকে উঠে এসেছিস! ইভানও এদের পাগলামি তেমন গুরুতর ভাবে নিল না। অচেনা একটা মেয়েকে প্রথম দেখায় জান্নাতের হুরপরী বানিয়ে দিয়েছে। দু’মিনিটের আলাপে বোঝা যায় কে, ভালো কে খারাপ। তার উপর এটা ভালো কাজ হয়েছে মেয়েটার বাড়ি চিনে না। নইলে দেখা যেত দুই পাগল মেয়েটার বাড়ি গিয়ে বসে আছে। আবদার ধরেছে, একে ভাবী না করলে বাড়িই ফিরবে না।
ইভান শার্ট খুলতে খুলতে বলল,

“মেয়েটার বয়ফ্রেন্ড থাকলে কী করবি? সুন্দর মেয়েরা সিঙ্গেল থাকে না জানিস তো?”

সত্যিই তো! এটা তো ভাবেনি ওরা! মেয়ে দুইটার মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। ইভান ওদের দেখে হাসছে। মাহিমা বলল,

“বয়ফ্রেন্ড থাকলেও ব্রেকআপ করিয়ে দিব। ওই মেয়ে শুধু আমাদের ভাবী হবে। তোমার জন্য ওকে পছন্দ করেছি আমরা।”

“আর সব সুন্দর মেয়েরই বয়ফ্রেন্ড থাকে না ইভান ভাই। তুমিও তো কত সুন্দর। কই তোমার তো একটাও গার্লফ্রেন্ড নেই। আমি শিওর ওই মেয়েরও বয়ফ্রেন্ড নেই।”

এদের সাথে যুক্তি তো দূর অযুক্তিক তর্ক করেও পারা যাবে না। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের মাঝে ম্যাচিউরিটি আসে। আবার অনেক সময় পরিবেশ, পরিস্থিতি ম্যাচিউরিটি এনে দেয়। এরা আজ পর্যন্ত তেমন কোন পরিস্থিতির সম্মুখিন হয়নি। আর বয়সটাও নিতান্তই অল্প। তবে এদের পাগলামি কমানো দরকার। নইলে রাস্তাঘাটে মানুষকে ভাবী ডেকে অস্বস্তিতে ফেলে দিবে। সবাই তো আর এই মেয়ের মতো ভালো মানুষ হবে না। কেউ কেউ ঠাটিয়ে চড়ও মারতে পারে।

“মীরা মাহিমা, পাগলামি করিস না তোরা। যাকে তাকে এভাবে পছন্দ হয়ে গেলেই কি ভাবী বানানো যায়? তোরা চাইছিস মেয়েটাকে ভাবী বানাতে। কিন্তু ওই মেয়ে কি চায় এটাও তো দেখতে হবে, না? আর বিয়ে কি শুধু দু’জনের মাঝে হয়। পুরো পরিবারের বোঝাপড়া নিয়ে বিয়ে হয়। হতে পারে ওই মেয়েকে আমারই পছন্দ হলো না। বা আমাকে ওই মেয়ের পছন্দ হলো না। তখনও কি তোরা জোর করতে পারবি?”

জ্ঞানের কথা কাদের সামনে বলছে ইভান? এরা কোনদিন কার জ্ঞান যুক্তি শুনেছে? একটুও না ভেবে মাহিমা বলল,

“ওই মেয়েকে তোমার অপছন্দ হতেই পারে না। হ্যাঁ, মেয়েটার তোমাকে পছন্দ না-ও হতে পারে।”

নিজের বোনদের মুখে মেয়েটার সম্পর্কে এত কথা শুনে ইভানও মনে মনে কিছুটা কৌতূহলী হয়ে পড়েছে। নিজের ভাইকেও পাত্তা দিচ্ছে না এরা! ওই মেয়ের মাঝে এমন কী দেখেছে হ্যাঁ?

“নাম কি ওই মেয়ের?”

এই যা! সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ যেটা, নামই তো জিজ্ঞেস করেনি। ওরা মেয়েটার নাম জানে না। কিন্তু ওর সম্পর্কে যেমন ভাবে প্রশংসা করছিল তা শুনে ইভান শরীর কাঁপিয়ে শব্দ করে হাসতে লাগল। মীরা মাহিমা দু’জনই নিজেদের নির্বুদ্ধিতায় লজ্জায় মুখ নামিয়ে বসে রইল। ইভান হাসতে হাসতেই বলছে,

“তোরা মেয়েটার নাম জানিস না! ওরে মীরা মাহি, মানুষকে হাসিয়ে হাসিয়ে মেরে ফেলার প্ল্যান করেছিস নাকি? তোদের দুইটাকে নিয়ে আমি কোথায় যাব। তোরা কি থ্রি ফোরের বাচ্চা পোলাপান? কবে বড় হবি বোনেরা আমার? এখন তো কলেজে পড়িস। একটু তো বড় হ।”

ইভান ভাইকে অমন করে হাসতে দেখে মীরা মাহিমা মুখ ভোতা করে বসে আছে।

চলবে…

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
১৪
🌸

“মাহি তুই কি প্রাইভেট পড়বি না? কলেজে ভর্তি হয়ে মুবিন ভাইয়ের কাছে পড়তে যাবি বলেছিলি।”

“আমার কষ্ট লাগে রে মীরা। প্রতিদিন কলেজ থেকে এসে বিকেলে আবার প্রাইভেট! আমি পারব না। বিকেলে যে আরামের ঘুম হয় রে।”

“তুই ঘুমা। ঘুমিয়ে ঘুমিয়েছে ইন্টারমিডিয়েট পাস কর।”

“পড়ব। আরও কয়টা দিন যাক। এই আমাদের পরীক্ষা কবে হবে রে?”

“কী জানি। শোন না, কাল ছুটির পর ওখানে যাবি?”

“কোথায়? ওহ হ্যাঁ। না গেলে পাব কীভাবে?”

“আচ্ছা ঠিক আছে। আমি এখন প্রাইভেটে যাব।”

🌸

মীরা প্রাইভেটে চলে এসেছে। মুবিন ভাই ভালো করে পড়ায়। কিন্তু তার কাছে সব কঠিন লাগে। মুবিন শুনে বলল,

“তুমি কঠিন মনে করলেই কঠিন লাগবে মীরা।”

“সহজ সহজ করে তসবিহ জপছি। তবুও তো সহজ মনে হয় না।”

“এখন তো নতুন। কয়েক দিন পড়লেই সহজ লাগবে।”

“পড়াশোনা কে আবিষ্কার করেছিল মুবিন ভাই? এত কঠিন কেন? পড়াশোনা না থাকলে জীবনটা কত সহজ হতো ভাবুন একবার।”

মীরার কথা শুনে মুবিন শব্দ করে হাসতে লাগল। মীরা ঠোঁট ফুলিয়ে বসে আছে। এটা কি পড়াশোনা করে চুল পাকিয়ে ফেলার বয়স? কোথায় বাড়িতে একটা বিয়ে হবে। একটু আনন্দ করবে। কিন্তু বড় মা তো ছেলেকে বিয়ে করাতেই চায় না। একটা মেয়ের সন্ধান দিল। তবুও কেউ পাত্তা দিল না।

“আন্টি বাড়িতে নেই মুবিন ভাই?”

“না। আমার খালামনিরা এখানে শিফট করেছে। আম্মু খালামনির ফ্ল্যাটে গেছে।”

“আন্টিরা কয় ভাই বোন?”

“দুই বোনই।”

“আপনার মামা নেই?”

মুবিন চোখ পাকিয়ে মীরাকে শাসন করল,

“মীরা তুমি কিন্তু পড়ছো কম কথা বলছো বেশি।”

“আজকে পড়তে ইচ্ছে করছে না মুবিন ভাই। একা একা পড়তে ভালো লাগে না। মাহিটা বলেছিল পড়বে। এখন নাকি তার কষ্ট লাগে। আমারও তো কষ্ট লাগে। তবুও তো আমি পড়ি।”

মীরা আজ এক অক্ষরও পড়লো না। পড়তে ভালো লাগছে না। এর উপর আর কোন কথা আছে? মুবিন বলল,

“আজ তাহলে বাড়ি যাও।”

মীরা বেরুবার সময় জায়িনের সামনে পড়ল। জায়িন মাত্র ঘুম থেকে উঠে এসেছে। চোখ মুখ ফোলা ফোলা। মাথার চুল এলোমেলো। মীরা জায়িনের দিকে তাকিয়ে গতকালকের কথা মনে করল। জায়িন ভাই টাকা নেয়নি। উল্টো জায়িন ভাইকে কোলে নিয়ে তিনতলায় উঠার কথা বলেছে। এত বড় একটা মানুষকে কোলে নিয়ে সে কীভাবে তিনতলায় উঠবে? দুইটা সিঁড়িও তো উঠতে পারবে না। জায়িন মীরাকে এরকম ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালে মীরা মাথা নাড়িয়ে জানাল, কিছু না। সে আর দেরি না করে জায়িনের সামনে থেকে চলে এলো। তাড়াহুড়ো করে দরজা দিয়ে বেরুতে গিয়ে ঠুস করে মাথায় বাড়ি খেল। জায়িন হতাশ নয়নে মীরার কাণ্ডকারখানা দেখছে।

🌸

কলেজ ছুটি হয়েছে অনেকক্ষণ হয়েছে। মীরা মাহি আজও ওই জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে আছে যেখানে সেদিন ওই মেয়েটার সাথে দেখা হয়েছিল। মাহিমা চিন্তিত কন্ঠে বলল,

“তোর মনে হয় মেয়েটা আজও এখান দিয়ে ফিরবে?”

“জানি না। আরেকটু অপেক্ষা করি। না পেলে চলে যাব।”

“হুম। আমার প্রচুর খিদে লেগেছে। তাড়াহুড়ো করে আজ ফুচকাও খেলি না। পেটের ভেতর মোচড় দিচ্ছে।”

“আমারও তো পেটের ভেতর পুটপুট শব্দ করছে। খিদে লাগলেই এমন শব্দ করে।”

কথা বলতে বলতেই ওই মেয়েটাকে দেখা গেল। মীরা চাপা স্বরে চেঁচিয়ে উঠে বলল,

“মাহি দেখ। ওই মেয়েটা। দেখ দেখ এদিকে আসছে।”

মেয়েটা দূর থেকেই ওদের দু’জনকে লক্ষ করেছে। আজও মেয়ে দুইটাকে দেখে কিছুটা অবাক হয়েছে। মেয়েটা কাছে এসে জিজ্ঞেস করল,

“তোমরা কি আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছো?”

ওরা নিঃশব্দে উপর নিচে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানাল। মেয়েটা হাসল। চোখ ছোট ছোট করে জিজ্ঞেস করল,

“কেন বলো তো?”

মীরা বলল,

“সেদিন আপনার নাম জানি নি। আপনার নাম কী?”

মেয়েটা ঠোঁট টিপে হাসল। নাম জানার জন্য আজ এসেছে! মজার ব্যাপার তো।

“আমার নাম ইভা।”

মেয়েটার নাম শুনে মীরা মাহিমা একে অপরের দিকে তাকাল। খুশিতে ওদের চোখ ঝলমল করছে। ওদের চোখে ভাষা পড়তে জানলে ইভা বুঝতে পারত ওরা কী বলতে চাচ্ছে।
ওরা বলছে,

“ইভা! দেখলি উনার নাম ইভান ভাইয়ের সাথে মিলে গেছে।”

“হ্যাঁ। ইভান ভাইয়ের সাথে উনার বিয়ে হলে ওদের বাবুর নামও ‘ই’ দিয়েই রাখা যাবে।”

ইভা ওদের চোখে ইশারা করতে দেখে জিজ্ঞেস করল,

“তোমাদের দু’জনের নাম কী?”

মাহিমা বলল,

“আমার নাম মাহিমা। ওর নাম মীরা। আমাদের নাম মিলিয়ে রাখা হয়েছে। আপনার নামের সাথেও আমার ভাইয়ার নাম মিলে যায়।”

ইভা ডান ভ্রু উঁচিয়ে ঠোঁট কামড়ে জিজ্ঞেস করল,

“তোমার ভাইয়ার নাম কী?”

“ইভান আহমেদ। আমাদের ভাইয়া সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার।”

“ওহ।”

ওরা ইভার সাথে সাথে হাঁটছে। ইভা এবার এদের আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পারছে। বাচ্চা বাচ্চা দু’টো মেয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ওকে পাত্রী দেখছে। এবং ওকে তাদের ভালোই পছন্দ হয়েছে বোঝা যাচ্ছে। ইভা রাগ করতে পারল না। বরং মনে মনে হাসল।
মীরা বলল,

“আমাদের বাড়িতে কে কে আছে আপনি শুনবেন?”

“বলো শুনি।”

“বড় আব্বু, বড়মা। মানে ইভান ভাইয়ার বাবা মা। তনি আপু, রুশমি ইভান ভাইয়ার আপন বোন। আব্বু, আমি। ছোট চাচ্চু, ছোট মা। ছোট মা’র একটা মেয়ে। ও এখনও অনেক ছোট। ওর নাম মাহা। এই নাম আমি রেখেছি। বড় ফুপা, ফুপুর মেয়ে প্রিয়া আপু। ছোট ফুপা, ফুপু মাহি আর আবির ভাইয়ার মা।”

ইভা বুঝলো মীরার মা নেই। কারণ সে সবার কথা বলেছে। কিন্তু নিজের মা’র কথা বলেনি। হয়তো ভুলে গেছে। ইভা ওকে আর জিজ্ঞেস করল না।
মাহিমা বলল,

“আপনার বাসায় কে কে আছে আপু?”

“আমার আব্বু বর্তমানে সৌদি আছে। বাসায় আমি আর আম্মু।”

দু’জনই বিস্ময় নিয়ে একসাথে বলল,

“আপনি একা?”

ইভা হেসে বলল,

“হুম।”

মাহিমা বলল,

“ইশ! আপনার ভাগ্য কত ভালো। সব ভালোবাসা একা পাচ্ছেন। আপনার ভালোবাসায় কেউ ভাগ বসাচ্ছে না। আমাদের ভালোবাসায় সবাই ভাগ বসায়। রুশমি হওয়ার পর ছোট বলে সবাই ওকে আদর করতো। এখন তো আরেকটা ছোট বাবু এসেছে। এখন সবাই ওকে আদর করে।”

ইভা হাসছে। এদের চিন্তাভাবনা এখনও ছেলেমানুষী। কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে এরা শুধু শরীরে বড় হয়েছে। মনের দিক দিয়ে এখনও নিষ্পাপ। পবিত্র। ইভা বলল,

“তোমরা তো আমার সাথে চলে এসেছ। তোমাদের বাসা তো এদিকে না।”

দু’জনই মন খারাপ করে ফেলল। ইভা আপুকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। মীরা মুখ কালো করে বলল,

“আপু আপনি একদিন আমাদের বাসায় যাবেন?”

“অবশ্যই যাব। কেন যাব না বলো? তোমরা কত মিষ্টি।”

মীরা খুশি হয়ে উঠল। মাহিমার হাত ধরে বলল,

“আপনি গেলে সবাই অনেক খুশি হবে।”

🌸

এভাবে কয়েকদিন কেটে গেল। কিন্তু মীরা মাহি তাদের বাড়ির মানুষকে বোঝাতেই পারছে না। ওই মেয়েটাই ইভান ভাইয়ার বউ হবে। সবাই তাদের ছোট বলে গুরুত্ব দিচ্ছে না। মাহিমা মীরার সাথে বড় মামীকে অনুনয় করছে।

“বড় মামী তোমাকে যেতেই হবে।”

“হ্যাঁ বড় মা যেতেই হবে। প্লিজ।”

বড় মামী ডাইনিংয়ে বসে রাতের রান্নার জন্য সবজি কাটছে।

“আমি যেতে পারব না। তোরা তোদের ছোট চাচীকে নিয়ে যা।”

বড় ভাবী বিপদ তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে দেখে ছোট চাচীও বাহানা দিল।

“না। আমি কীভাবে যাব? আমার মেয়ে ছোট।”

“প্লিজ কেউ তো চলো। তোমাদের ছেলেকে কি বিয়ে করানোর ইচ্ছে নেই।”

“মেয়েটা অনেক সুন্দর। আমাদের কথা কেন বিশ্বাস করছ না।”

বড় মামী উঠতে উঠতে বলল,

“বিশ্বাস করছি। কিন্তু তোদের কথায় মেয়ের বাড়িতে চলে যাওয়ার মতো বোকা আমরা না।”

ছোট চাচীও মেয়েকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে বলল,

“হ্যাঁ এই রিস্ক কিছুতেই নেওয়া যায় না।”

“কিচ্ছু হবে না মামী। মেয়ের সাথে আমরা কথা বলেছি। বলেছে তোমাদের নিয়ে যেতে।”

বড় মামী অবাক হয়ে বলল,

“মেয়ে নিজে বলেছে!”

ছোট চাচী এদের কথা বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে বলল,

“আরে ভাবী ওদের পাগলামি দেখে হয়তো এই কথা বলেছে।”

“হবে হয়তো।”

“চলো না প্লিজ। মেয়েকে পছন্দ না হলে আর জীবনেও বলব না। চলো না। চলো না। ছোট চাচী।”

এদের পেঁচালে অতিষ্ঠ হয়ে বড় মা বলল,

“তোরা ভাইবোনরা গিয়ে আগে দেখে আয়। তোদের সবার পছন্দ হলে আমরা গিয়ে নাহয় দেখে আসব।”

মীরা চিৎকার করে উঠে বলল,

“সত্যি?”

চলবে_