মন নিয়ে কাছাকাছি পর্ব-২৫+২৬+২৭

0
470

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
Jerin Afrin Nipa
২৫
🌸
কন্ঠস্বরটা শুনে মীরা কোমর ধরে বসে থাকা অবস্থায় মাথা তুলে উপরে তাকিয়ে দেখলো। জায়িন ওর দিকে ডান হাত বাড়িয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটু আগে কী কী বলেছে মনে করে মীরা ঢোঁক গিললো। জায়িন মাহিমার দিকেও তাকিয়ে বলল,

“তোমারও কি কোমর ভেঙেছে? হাসপাতালে নিতে হবে?”

জায়িনের কথা শেষ হবার আগেই মাহিমা ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। জায়িনের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টেনে হেসে বলল,

“আমার তো কিছুই হয়নি জায়িন ভাই। দেখুন আমি একদম ঠিক আছি। কোন ব্যথাই পাইনি।”

মাহিমা ঘুরে ফিরে জায়িনকে দেখাচ্ছে সে যে ঠিক আছে। জায়িন দৃষ্টি মীরার উপর আবদ্ধ করলো। মীরা এখনও বসে আছে। মাহিটা কত তাড়াতাড়ি দল পাল্টে ফেলল সেটাই দেখছে। জায়িন ভাইয়ের পক্ষ নিয়ে কী সুন্দর বলছে, কোন ব্যথাই পায়নি। কিন্তু মীরা যথেষ্ট ব্যথা পেয়েছে। জায়িন বাড়িয়ে দেওয়া হাত ফিরিয়ে নিয়ে মীরার দিকে ঝুঁকে আসার আগে মীরা নিজে নিজে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। সে মনে করেছে জায়িন ভাই হয়তো তাকে কোলে তুলে নিবে। সেই ভয়েই কোমর ধরে কোনরকমে দাঁড়িয়ে বলল,

“ডাক্তার হয়েছেন বলে কি মানুষের কোমর ভাঙার লাইসেন্স পেয়ে গেছে!”

জায়িন ভ্রু কুঁচকে বলল,

“তুমি ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেছো। সেটা কি আমার দোষ ছিল?”

“অবশ্যই। আপনি নামার সময় দেখে নামেননি।”

“আমিও তো বলতে পারি, তুমি কেন দেখে উপরে ওঠোনি?”

মাহিমা এদের ঝগড়া দেখছে। মীরা কি সত্যি সত্যিই জায়িন ভাইয়ের সাথে এভাবে ঝগড়া করছে! কী পাষণ্ড! এত হ্যান্ডসাম একটা ছেলের সাথে কেউ ঝগড়া করে? মাহিমা মীরাকে থামিয়ে দিয়ে কানে কানে বলল,

“তুই ভাঙা কোমর বেঁধে জায়িন ভাইয়ের সাথে ঝগড়া করছিস কেন মীরা? দোষ কিন্তু তোরই।”

মীরা ভস্ম করে দেওয়া চোখে মাহিমাকে দেখলো। তার সমস্ত উল্টাপাল্টা কাজের পার্টনার আজ তার বিরুদ্ধে কথা বলছে! ছি, একটা হ্যান্ডসাম ছেলের জন্য বান্ধবী প্লাস বোনের সম্পর্ককে এভাবে ছোট করে দিবে! মীরা কিড়মিড় করে আওড়াল,

“হারামির বাচ্চা মীরজাফর।”

জায়িন সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়েছিল। কিন্তু মীরার মনে হয় তার সাহার নেওয়ার ইচ্ছে নেই। তাই জায়িনের আর কিছু করার থাকলো না। মীরা কোমর ধরে নড়াচড়া করতে গেলে কোমরের কোন এক হাড্ডি মট করে শব্দ করে উঠল। মাহিমা ওকে ধরতে নিলেও মীরা ঝাড়া মেরে হাত সরিয়ে নিল। চোখ পাকিয়ে বলল,

“একদম দরদ দেখাবি না।”

মীরা মাহিমা ইভাদের বাসায় ঢুকছে। জায়িনও ওদের পেছনে এসেছে। মুবিন এখানেই ছিল। একেতো মীরা মাহিমাকে এখানে দেখে সে যথেষ্ট চমকিত। ওরা কখন এসেছে? মীরা মাহিমার মুখ দেখেই মুবিন বুঝে নিল কোথাও তো গণ্ডগোল বেঁধেছে। সে ভাইকে জিজ্ঞেস করল,

“ওদের কী হয়েছে ভাইয়া?”

“দুইটাই সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়েছে। ব্যথা ট্যথা পেয়েছে হয়তো। দেখ গিয়ে।”

মুবিন চিন্তিত মুখে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। এক ভাই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। আরেক ভাই চিন্তিত হয়। মীরা ভেবেছিল মুবিন ভাই আগে তাকেই জিজ্ঞেস করবে কী হয়েছে। কিন্তু মুবিন মীরাকে উপেক্ষা করে মাহিমাকে জিজ্ঞেস করতে লাগল,

“বেশি ব্যথা পেয়েছ? কীভাবে পড়েছিলে?”

মীরা হাঁ করে মুবিন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। এটা কী হলো? ব্যাপারটা এমন হয়ে গেল না যে, বউয়ের থেকে শালির দরদ বেশি! মাহিমা হেসে জবাব দিচ্ছে,

“তেমন কিছু হয়নি মুবিন ভাই। আমাদের যেখানে সেখানে পড়ে যাওয়ার অভ্যেস আছে।”

মীরার এবার কিছুটা সন্দেহ হতে লাগল। কিন্তু মীরার সন্দেহ গুরুতর হওয়ার আগেই মুবিন মীরার জন্যও একইরকম চিন্তিত হয়ে বলল,

“তোমরা কি এখনও বাচ্চা, মীরা? সিঁড়ি থেকে পড়ে যাও কীভাবে? তোমার লাফঝাঁপ করার বয়স কবে যাবে শুনি?”

“আমি কী করেছি মুবিন ভাই? আপনি আমাকে কেন বলছেন? দোষ যে করেছে তাকে বলুন না।”

“কে দোষ করেছে? কার কথা বলছো?”

মীরা মুখ বাঁকিয়ে জায়িনের দিকে দেখাল। জায়িনের এদিকে মনোযোগ আছে বলে মনে হচ্ছে না। সে খালামনির সাথে কথা বলছে। মুবিন মীরার দৃষ্টি অনুসরণ করে জায়িনকে দেখে বলল,

“ভাইয়ার দোষ!”

“অবশ্যই। উনি দেখে নামতে পারলেন না? আমাদের কথাবার্তার শব্দও উনার কানে যায়নি। নিজেই ধাক্কা দিয়ে আবার উল্টে আমাকে দুষেছে জানেন।”

“ভাইয়া মনে হয় সত্যিই তোমাদের দেখেনি।”

“না দেখুক। তবুও তো আমাদের সান্ত্বনা দিয়ে হলেও এই কথাটা স্বীকার করতে পারত।”

“আচ্ছা আমি ভাইয়াকে বলব।”

মীরা মনে মনে ভাবল, মুবিন ভাই কত ভালো। তার হয়ে ভাইয়ের সাথে কথা বলবে! ইভার বাবা ওদের বাড়ি পৌঁছে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু ওরা তা চাইছে না। কারণ আঙ্কেলের সাথে বাড়িতে গেলে সবাই জেনে যাবে ওরা এখানে এসেছে। কিন্তু এতকিছু করেও তো কোন লাভ হলো না। ফেরার সময় দু’জন ঠিক করেছিল বাড়িতে গিয়ে কোমর একটু আধটু ব্যথা করলেও কাউকে বলবে না। কিন্তু ওরা বাড়ি পৌঁছানোর আগেই ওদের সিঁড়ি থেকে পড়ে যাওয়ার খবর বাড়ির প্রতিটা মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। ওরা সদর দরজায় পা রাখতেই বড়মা আর বড় ফুপু ওদের বকাঝকা করতে লাগল, কেন ওরা না বলে আজ ইভাদের বাড়িতে গিয়েছিল। তার সাথেই ছোট ফুপু আর ছোট চাচী ওরা কতটা ব্যথা পেয়েছে তা নিয়ে চিন্তিত। বাড়িতে এখন মিশ্র পরিবেশ। অবশ্য সবসময়ই এমন থাকে। তাই বরাবরের মতো এবারও ইভান ভাই এসে ওদের বাঁচিয়ে নেওয়ার কাজটা করলো। বড় ফুপু তখনো বলছেন,

“মীরা আর তোর মেয়েটা কিন্তু বড্ড পার পেয়ে গেছে। এরা কি এখনও নিজেকে দশ/বারো বছরের বাচ্চা শিশু মনে করে নাকি? বয়সটা তো আঠারোর ঘরে পড়বে। বাংলাদেশের আইনে বিবাহযোগ্যা বয়স। কিন্তু এখনও এদের চালচলন থ্রি ফোরের বাচ্চাদের মতোন। দোষ তোমাদের। তোমাদের আদরে এদের এখনও বাচ্চামি যায়নি। এদেরকে এখন থেকেই শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে হবে। নইলে পরের বাড়ি গিয়ে সংসার করবে কীভাবে?”

উপরে নিজের ঘরে যেতে যেতে ফুপুর কথা শুনে মীরা মুখ ভেংচাল। ফুপুকে সবসময় তার ভালো লাগে। শুধু যখন বিয়ের কথা বলে তখনই আর ভালো লাগে না। মাহিমা খালার স্বর নকল করে ভেঙ্গিয়ে বলল,

“আঠারো বছর বাংলাদেশের আইনে বিবাহযোগ্যা বয়স। তুমি নিজের বয়সটা দেখো না। আমাদের বয়স নিয়ে মাথা ঘামিয়ে তো মাথার চুল পাকিয়ে ফেলে নিজের বয়সটা আরও কয়েক বছর বাড়িয়ে নিয়েছ।”

মীরাও ফুপুকে ভেঙাচ্ছে।

“এখন থেকেই শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে হবে। হইলে পরের বাড়ি গিয়ে সংসার করবে কীভাবে? তোমার ভাগ্য ভালো তোমার একটা ছেলে নেই। নইলে ছেলের বউয়ের জীবন তেজপাতা করে ফেলতে।”

🌸

ইভাদের বাড়িতে তেমন কেউ নেই। দুই ছেলে জায়িন, মুবিন হলুদ নিয়ে যাবে না। কিন্তু তাই বলে কি মীরারাও আসবে না! অসম্ভব। বরের বাড়ি থেকে বউয়ের বাড়িতে হলুদ যাবে। বিয়ে বাড়িতে হাজারটা কাজ। সকলের হাত বন্ধ। মীরা শাড়ি নিয়ে ঘুরছে কে পরিয়ে দিবে। তনি আপু আবির ভাইয়ার সাথে রঙঢঙ করে মাত্র গোসলে ঢুকেছে। প্রিয়া আপু তাদের থেকেও বেশি ন্যাকা। সে নিজেও শাড়ি পরতে পারে না। ওদিকে মাহা কাঁদছে। ছোট চাচী কী করছে? মাহিমা ইউটিউবে ঢুকে শাড়ি পরানোর ভিডিও দেখছে। তার কাছে সহজই মনে হচ্ছে। শাড়ি পরানো কঠিন কিছু না। অবশ্য ইউটিউব দেখে মানুষের অপারেশন করাটাও কঠিন কিছু মনে হয় না।

“মীরা আয় আমরা নিজেরাই শাড়ি পরি।”

“যদি ভালো না হয়।”

“চেষ্টা করি অন্তত।”

“আচ্ছা তাহলে তুই আগে পড়।”

ভিডিওতে মহিলাটা যেভাবে যেভাবে দেখাচ্ছে মীরা সেভাবেই মাহিমাকে শাড়ি পরানোর চেষ্টা করছে। তনির গোসল শেষ। সে গুনগুন করতে করতে রুমে এসে দেখে এরা নিজেরাই শাড়ি পরছে।

“শাড়ি পেঁচিয়ে মমি সাজছিস কেন? এভাবে শাড়ি পরে নাকি?”

মীরা মুখ বাঁকিয়ে বলল,

“তুমি এত দেরি করলে কী করব?”

“আমি তো আর সারাদিন গোসলে থাকতাম না। দুইটা মিনিট অপেক্ষা করতে পারলি না! আচ্ছা এবার আয়, কে আগে পরবি।”

মীরা আগে পরবে। নইলে পরে সাজতে দেরি হয়ে যায়। মাহিমাও আগে পরতে চায়। তাই সে ছুটে আগে তনি আপুর কাছে আসতে নিচ্ছিল। কিন্তু পা বাড়াতে নিলে শাড়িতে আটকে মাহিমা মুখ থুবড়ে নিচে পড়লো। ওকে পড়তে দেখে মীরা তোলার চেষ্টা না করে হাসতে লাগল।

🌸

মেয়েরা কোথাও যাওয়ার আগে তাদের যদি আগের দিন থেকেই সাজতে দেওয়া হয়, তবুও বেরুবার সময় বলবে, সময় কম হয়েছে। আর পাঁচ মিনিট। এই পাঁচ মিনিট দশ মিনিট গড়িয়ে বিশে পড়লেও শেষ হবে না। একটু তাড়া দিলে আসছি, এসে পড়েছি বলে আরও আধঘন্টা। তার পর রাগারাগি শুরু করলে উল্টো গাল ফুলিয়ে যাবে না বলে বসে থাকবে। তখন ওদের রাগ ভাঙাতে ভাঙাতে আরও কত ঘন্টা যে লাগবে!
আবির এই রিস্ক নিতে চাইল না। তনির যত সময়ই লাগুক সে আদর্শ বয়ফ্রেন্ডের ভূমিকা পালন করে তনিকে কিছুই বলল না। কোনরকম তাড়াই দিলো না। নিজে রেডি হয়ে বসে ফোনে গেমস খেলছে। এদিকে কাজল দিতে গিয়ে প্রিয়ার চোখে পানি এসে কাজল লেপ্টে সাজ নষ্ট হয়েছে। তার মা ধমকে বলেছিল, কাজল দিতে না পারলো জোর করে দিতে গেলি কেন? ব্যস! এতেই সে কেঁদেকেটে চেহারার অবস্থা আরও বেহাল করে ফেলেছে। মীরা, মাহিমা রেডি হয়ে বসে আছে। ছোট হওয়ায় বড়দের মাঝে কথাও বলতে পারছে না। তনি দ্বিতীয় বার প্রিয়াকে সাজাতে বসেছে। মাহিমা মীরাকে দেখে বলল,

“আজ মুবিন ভাই তোকে দেখে পাগল হয়ে যাবে। উনার ডাক্তার ভাইও কিছু করতে পারবে না। প্রেমের পাগলামি ঠিক করতে মুবিন ভাইকে তোর মনের পাগলাগারদে বন্দী হতে হবে।”

“আমার মনে পাগলাগারদ দিয়ে বসে আছি নাকি? প্রশংসা করবি সুন্দর শব্দ দিয়ে কর। পাগলাগারদ বলে আমার মনকে অপমান করছিস কেন?”

চলবে…

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
Jerin Afrin Nipa
২৬

অবশেষে রাগ, অভিমান মানিয়ে সবাইকে নিয়ে বের হতে পেরেছে। ওরা ইভাদের বাসায় গিয়ে ইভাকে হলুদ দিয়ে আসবে। কিন্তু ওখান থেকে কেউ ইভানদের বাসায় আসবে না। কারণ মানুষই নেই। ইভা আপুকে হলুদ লাগিয়ে বাড়ি এসে ইভান ভাইকেও লাগাতে হবে। রুশমির কান্নার চোটে ওকেও সাথে নিতে হলো। ইভাদের বাড়িতে পৌঁছে সবাই একটা একটা করে হলুদের ডালা হাতে অন্যান্য ত্বত্ত্ব নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। রিমু সহ আরও কয়েকটা মেয়ে ওদের উপর ফুল ছিটিয়ে পার্টি স্প্রে লাগিয়ে ভূত বানিয়ে স্বাগত জানালো। রিমু মীরা মাহিমাকে দেখে বলল,

“আসুন বিয়াইন আসুন। সুন্দরী বিয়াইন দুইটারে কালি দিয়ে নজর টিকা লাগিয়ে দিই।”

এমনিতেই স্প্রে ছিটিয়ে মাথা ভরে ফেলছে। মীরা মাহিমা রিমুর দুই পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ওর কাঁধ চেপে ধরে বলল,

“বেশি লাফাবেন না বিয়াইন। আপনি একা। আমরা দু’জন। তার উপর গায়ে পিঁপড়ার মাংস নিয়ে ঘুরেন। বুঝেশুনে লাগতে আইসেন।”

রিমু সারেন্ডার করে নিল। দুই হাত মেলে বান্ধবীর কাঁধ ধরে বলল,

“দূর কিসের বিয়াইন! আমরা বান্ধবী। চল চল। ছাঁদে অনেক মজা হবে।”

ছাদে এসেই সবার আগে মুবিনের সাথে দেখা হলো। মুবিন সাদা পাঞ্জাবি পরেছে। মাহিমা মীরার পেটে খোঁচা দিয়ে বলল,

“আজ প্রপোজ করে ফেললেও অবাক হবো না। আগুন লাগছে তোকে।”

“এখন পানি ঢেলে দে। আগুন নিবে যাবে।”

দু’জন ফিসফাস করতে করতে ছাঁদে জায়িনকে আসতে দেখা গেল। সবাই পরেছে সাদা হলুদ এই লোক পরেছে কালো। কেন এটা কি শোক সভা পালন করা হচ্ছে। মীরা মুখ মোচড়াল। মাহিমা জায়িনকে দেখে চাপা গলায় চিৎকার করে উঠে বলল,

“আল্লাহ, জায়িন ভাইকে দেখেছিস মীরা! হায়! কত্ত হ্যান্ডসাম লাগছে। আজ থেকে আমার পছন্দের রঙ কালো।”

মীরা অস্বীকার করছে না। মানছে জায়িন ভাইকে হ্যান্ডসাম লাগছে। কিন্তু তাই বলে এত ওভার এক্সাইটেড হওয়ার মানে কি?

“তুই কি হ্যাংলা নাকি? এমন করছিস যেন জীবনে ছেলে দেখিসনি।”

জায়িন পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে গোটাতে একপলক ওদের দিকে তাকিয়ে সামনে দিয়ে হেঁটে চলে গেল। কী সুন্দর পারফিউমের ঘ্রাণ! ব্যান্ডটা জেনে রাখা উচিত ছিল। মুবিন দূর থেকে ওদের দেখছিল। আজ যেভাবেই হোক পিছিয়ে যাবে না সে। নিজেকে সে ভীতু মনে না করলেও এই কাজটা করতে সাহসের অভাববোধ হচ্ছে। মুবিন মীরা মাহিমার দিকে এগিয়ে আসছে। বুক ধুকপুক করছে। তবুও মুবিন মনে মনে নিজেকে সাহস দিচ্ছে।

“তোকে পারতেই হবে মুবিন। আজ না পারলে আর কোনদিন পারবি না। আজই সুযোগ। পিছিয়ে যাস না।”

মুবিনকে এদিকে আসতে দেখে মাহিমা মীরাকে ইশারা দিয়ে দেখাল,

“তোর রোমিও আসছে।”

মাহিমা যতই ক্ষেপাক কিন্তু মীরা মুবিন ভাইকে নিয়ে ওরকম কিছুই অনুভব করে না। এই ভালো লাগাটা হয়তো সাধারণ ভালোলাগা। ভালোবাসা টাইপ ভালো লাগা না। মুবিনকে দেখে মীরার বুক ধুকপুক করে না। বাতাসে চুল উড়ে না। এমনকি মীরা নার্ভাস ফিলও করে না। ওর কাজকর্মে গণ্ডগোল বাঁধে না। যত রোমান্টিক মুভি আর ড্রামা দেখেছে তাতে প্রেমে পড়লে নায়ককে দেখে নায়িকার সাথে এসবই ঘটে। কিন্তু মুনিন ভাইকে দেখে মীরার সাথে এসবের একটাও ঘটেনি। তার মানে মুবিন ভাইকে সে ভালোবাসে না। মীরা যেদিন প্রেমে পড়বে সেদিন তার মনই বলে দিবে, মীরা তুই প্রেমে পড়েছিস। আর যতদিন না মীরা হাত-পা ভেঙে ল্যাংড়া হয়ে প্রেমে না পড়বে ততদিন ছোটখাটো এসব ভালোলাগাকে পাত্তা দিবে না।
মাহিমা মীরার আগে বলে উঠল,

“মুবিন ভাই কেমন আছেন? ”

সহজ একটা প্রশ্নের উত্তর দিতেও মুবিনের জিহবা প্যাঁচ লেগে গেল। ভালো আছি কথাটা বলতেই পারলো না। মুবিন ভাই কিছু বলছে না দেখে মাহিমা চোখ ছোট ছোট করে ওকে দেখছে। মাহিমাকে এভাবে তাকাতে দেখে মুবিনের ঘাম হচ্ছে। সে সবকিছু গুলিয়ে ফেলছে। ছাদে বাতাস আছে। আবার পাশে থেকে বড় বড় দুইটা ফ্যানও ঘুরছে। তবুও তার গরম লাগছে। মাহিমা মুবিনের অবস্থা দেখে মুচকি হাসছে। মীরা পরিস্থিতি সহজ করতে বলল,

“ইভা আপুর কি সাজা শেষ মুবিন ভাই? আমরা গিয়ে ইভা আপুকে নিয়ে আসি।”

মীরা মাহিমার হাত টেনে নিয়ে যেতে লাগলে মাহিমা বলল,

“শিওর আজ তোকে প্রপোজ করবে। হাবভাব দেখেই বোঝা যাচ্ছে।”

মীরা পাত্তা দিল না। মনে মনে খুব করে চাইল মুবিন ভাই যেন এরকম কিছু না করে। তাহলে মুবিন ভাইকে ফিরিয়ে দিতে হবে তার। মুবিন ভাই কষ্ট পাবে। সাথে ওদের সম্পর্কটাও আর আগের মতো থাকবে না। মুবিন ভাইয়ের কাছে হয়তো সে আর পড়তেও আসবে না।
ইভাকে নিয়ে এসে স্টেজে বসিয়ে নিজেরাও ইভার পাশে বসেছে। জায়িনকে দেখা গেল ছাদের অন্য পাশে। একটা ছেলের সাথে কথা বলছে। মাহিমাকে জায়িন ভাইয়ের দিকে হাবলার মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে মীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। রুশমি ভাবীর কোলে বসে আছে। ইভা আপুও ছোট্ট ননদিনীকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছে। আবির তনির সাথে খোঁচাখুঁচি করছে। প্রিয়া সেল্ফি তুলতে ব্যস্ত। জায়িন ছেলেটার সাথে কথা শেষ করে ওর সাথেই নিচে যেতে নিলে ইভার মা আটকে নিলো।

“কোথায় যাচ্ছিস তুই? উহু, এখন কোথাও যাওয়া চলবে না। ইভাকে হলুদ না মাখাস এখানে দাঁড়িয়ে দেখবি। দিনদিন অসামাজিক হয়ে যাচ্ছিস। ডাক্তার মানুষ নিজেই মানুষের থেকে দূরে দূরে থাকলে তাদের সমস্যা বুঝবে কীভাবে?”

খালামনি জায়িনের হাত ধরে ওকেও সবার কাছে নিয়ে এলো। জায়িনকে দেখেই আবির তনির ঝগড়া শেষ হয়ে গেল। আবির জায়িনের কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

“মেয়েটাকে দেখালি না। আজ ইভা ভাবীর সাথেই তাকেও বসিয়ে দিতাম। বন্ধুর উপর ভরসা করলি না।”

তনি আবিরকে খোঁচা দিয়ে বলল,

“নিজের কথাই পরিবারকে জানাতে পারে না। ভয়ে হাঁটু কাঁপে। সে আবার অন্যকে ভরসা করতে বলছে। জায়িন তুই একদম এই ভীতুর কথা শুনিস না। তোকে মাঝ সাগরে নিয়ে একা ছেড়ে দিবে। হাতে একটা বইঠাও দিবে না।”

“আরেকবার আমাকে ভীতু বললে সবার সামনে আই লাবু বলে চুমু খাবো। তখন সামাল দিস।”

জায়িন এদের কথা শুনে হাসছে। পাগল দুইটা এখনও বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করে। জায়িন এদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকলেও তার চোখ অন্য কাউকে দেখছে। আবির তনি নিজেদের খুনসুটি থেকে বেরুলে দেখতে পেত জায়িন কতটা মুগ্ধতা নিয়ে সামনের মানুষটাকে দেখছে। এই চোখে শুধু মুগ্ধতা না ভালোবাসাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। যেই ভালোবাসা জায়িন ভীষণ যত্ন করে বুকের ভেতর লুকিয়ে রেখেছে।
মীরা দুই হাতের মুঠো ভরে হলুদ নিয়ে ইভার পুরো মুখে মাখিয়ে ওকে ভূত বানিয়ে দিল। ইভাকে এই অবস্থায় দেখে খিলখিল করে হাসছে। ইভা আপুকে হলুদ মাখানো শেষ হলে মীরা মাহিমা নিজেদের গালে হলুদ লাগানোর চেষ্টা করছে।
মুবিন চোখ বন্ধ করে বড় বড় করে দম নিল। বিড়বিড় করে বলল,

“আজ আমাকে পারতেই হবে। পারতেই হবে।”

যে যাকে যেমন পারল হলুদ মাখাল। আবির প্রথমে তনিকে হলুদ মাখিয়ে ভূত বানাল। তনি প্রতিশোধ নিতে মুঠো ভর্তি হলুদ নিয়ে আবিরের পেছনে ছুটছে। কিন্তু আবিরকে ও ধরতে পারলে তো! আবির এর ওর মাঝখান দিয়ে পুরো ছাদ জুড়ে ছোটাছুটি করছে। তনি কিছুতেই আবিরের সাথে পারছে না। শেষে সে হঠাৎ চিৎকার করে পা ধরে নিচে বসে পড়ল। বোঝাই যাচ্ছে দৌড়াতে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে। গুরুতর ব্যথা পায়নি তো? সবাই চিন্তিত হয়ে তনির কাছে আসার আগে আবির এসে তনির পায়ের কাছে বসে পড়ল। তনির পা ধরে অস্থির গলায় বলতে লাগল,

“কোথায় লেগেছে? লাগল কীভাবে? দেখে চলতে পারিস না?”

আবির বেচারা তনির মনের শয়তানি বুদ্ধি জানলে জীবনেও এভাবে ধরা দিত না। কিন্তু এখন যখন ধরা দিয়েই ফেলেছে তাহলে তনিও কেন ছেড়ে দিবে? তনি সুযোগের সদ্ব্যবহার করে আবিরের মুখে হলুদ মাখিয়ে সমানে হাসতে লাগল। ততক্ষণে বাকিরাও তনির প্ল্যান ভালো ভাবেই বুঝে গেছে। ব্যথা পায়নি তনি। আবিরকে ধরার জন্য ছোট্ট একটা নাটক করেছে। আবির বোকার মতো তনির দিকে তাকিয়ে আছে। বাকি সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ছে। এরপর আবির তার আসল রুপে ফিরে এলো। প্রিয়া, মীরা, মাহিমা ওদের সব কয়টাকে হলুদ মাখিয়ে গোসল করিয়ে ফেলল। একেক জন আবিরের হাত থেকে বাঁচতে ছাদ জুড়ে এদিক ওদিক ছুটছে। ইভা এদের ছেলেমানুষী দেখে রুশমিকে কোলে নিয়েই হেসে গড়িয়ে পড়ছে। মীরা আবিরের হাত থেকে বাঁচতে চিৎকার করতে করতে ছুটছে।

“না, না আবির ভাই! আবির ভাই, ভালো হবে না কিন্তু। আমি কি তোমাকে হলুদ মাখিয়েছি? তনি আপু মাখিয়েছে। তুমি ওকে মাখাও। আমাদের পেছনে কেন ছুটছো?”

“তোরা তনিকে বাধা দিলি না কেন? এখন তনির কাজের শাস্তি তোদেরও পেতে হবে। একটাও বাঁচতে পারবি না।”

মাহিমা ভাইয়ের উপর রাগ করলেও তার রাগ এখন কে দেখছে?

“ভাইয়া আমি তোমার বোন। চাচাতো মামাতো খালাতো ফুপাতো না। মায়ের পেটের আপন ছোট বোন। আমার সাথেও তুমি এমন করছো? নিজের বোনের প্রতি একটুও দয়ামায়া নেই?”

“আমার চোখে সবাই সমান। বোনদের মাঝে দোচোখা গিরি করে আমি পাপ কমাই করি, না?”

আবির মীরার দিকে ধাওয়া করলে মীরা ছুটে জায়িনের পেছনে গিয়ে লুকালো।

চলবে…

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
Jerin Afrin Nipa
২৭

আবির মীরার দিকে ধাওয়া করলে মীরা ছুটে জায়িনের পেছনে গিয়ে লুকালো।
জায়িনের লম্বা চওড়া বিশাল দেহের পেছনে মীরার ছোট দেহ আড়াল হয়ে গেছে। মীরা জায়িনের পেছনে থেকেই বাঁচার জন্য বলছে,

“আবির ভাই তুমি যা বলবে আমি সব করে দিব। মাথা টিপে দেব। পানি এনে দিব। তুমি বললে তোমার পা-ও টিপে দেব। তুমি শুধু আমাকে বাদে ওদের হলুদ লাগাও।”

“উঁহু। এখন বাঁচতে এই কথা বলছিস! কিন্তু তুই-ই সবচেয়ে বেশি আমার কথার অবাধ্য হোস। তাই আগে তোকে মাখাব। জায়িন তুই সরে দাঁড়া।”

জায়িন ভাই সামনে থাকলে আবির ভাই তাকে ধরতে পারবে না বুঝতে পেরে মীরা পেছন থেকে জায়িনের পাঞ্জাবি খামচে ধরল। জায়িন ভাই সামনে থেকে সরে গেলেই আবির ভাইয়ার হাত থেকে তার রক্ষে নেই। আবির জায়িনকে বলছে,

“জায়িন তুই ওটাকে তোর পেছন থেকে বেরিয়ে আসতে বল। আজ কেউ রক্ষা পাবে না।”

মীরা জায়িনের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসবে তো দূর উল্টো শক্ত করে জায়িনের পাঞ্জাবি আঁকড়ে ধরল। বলল,

“না জায়িন ভাই প্লিজ। আপনি আবির ভাইয়ার কথা শুনবেন না।”

“না শুনলে। জায়িন নিজেও ভিক্টিম হবে। আমার কিছু করার নেই।”

“জায়িন ভাই আপনি আবির ভাইকে একটা শিক্ষা দিন না। আমরা ছোট মানুষ বলে আমাদের সাথে কেমন করছে দেখুন।”

জায়িন একবার ঘাড় ঘুরিয়ে মীরাকে দেখলো। মীরা ঠোঁট উলটিয়ে অসহায় মুখে অনুরোধ করলো। জায়িন আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল,

“আবির ছেলেমানুষী করিস না তো। বাচ্চাদের সাথে বাহাদুরি করে মজা নেই। সমানে সমানে টক্কর দিতে হয়।”

“তাহলে তুই আয় শালা।”

বলেই আবির জায়িনের উপর ঝাপিয়ে পড়ল। ঘটনা আকষ্মিক ভাবে ঘটলেও জায়িন আবিরের দুই হাত হাওয়ায় ধরে ফেলল। মীরা উঁকিঝুঁকি পেরে জায়িনের পেছন থেকে আবিরকে দেখছে। আবির ভাই জায়িন ভাইকে নাগালই পাচ্ছে না। মীরা মনে মনে হাসল।

“খুব তো আমাদের সাথে বেডা গিরি দেখাচ্ছিলে। এবার জায়িন ভাইয়ের সাথে পারছো না কেন?”

🌸

এই যাত্রায় জায়িন ভাইয়ের জন্য মীরা বেঁচে গেল। নইলে আবির ভাই সত্যি সত্যিই হলুদে ডুবাতো।
বিকেল গড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। সন্ধ্যা নেমে চারদিক অন্ধকার হওয়ার আয়োজন চলছে। এবার মীরাদের ফেরার পালা। ইভান ভাইকেও তো এখনও হলুদ দেওয়া হয়নি। মীরা মুখ ধুয়ে টিস্যু খুঁজছিল। একটা তোয়ালে টোয়ালে পেলেও হতো। আবির ভাইরা বেরিয়ে পড়েছে। মীরা মুখ ধোয়ার জন্য ভেতরে এসেছিল। টিস্যু, তোয়ালে পায়নি কিন্তু মুবিন ভাইকে পেয়ে গেল। মীরা মুবিনকে দেখেই বলল,

“মুবিন ভাই টিস্যু বক্স কোথায় জানেন?”

মুবিন মীরাকেই খুঁজছিল। বুকে যথেষ্ট সাহস সঞ্চয় করে রেখেছে। কিন্তু মীরাকেই একা পাচ্ছিল না।
মুবিন ফুসফুস ভরে দম টানলো।

“মীরা! তোমাকে কিছু বলতে চাই।”

মীরার আত্মা ধক করে উঠল। কলিজায় চিলিক দিল। শ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। মাহিটা ঠিকই বলেছিল। মুবিন ভাই আজ তাকে প্রপোজ করবে! মীরা মনে মনে বলছে,

“না। মুবিন ভাই না। প্রপোজ করবেন না। রিজেক্ট হলে আপনিই কষ্ট পাবেন। বোনের বিয়েতে প্রেমে ছ্যাকা খাওয়া প্রেমিক হয়ে ঘুরে বেড়াবেন। তার থেকে ভালো প্রপোজই কইরেন না।”

“মীরা! কী ভাবছো?”

মীরার ভাবনার সুতো কাটলো। হুঁশে ফিরে এসে বলল,

“আমার তো সময় নেই মুবিন ভাই। আমাকে রেখে আবির ভাইরা চলে যাবে। আমাকে যেতে হবে। সামনে থেকে সরুন তো। ওইযে গাড়ির শব্দ হচ্ছে। ওরা আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছে নাকি? হায় আল্লাহ!”

মীরা কোনরকমে মুবিনকে পাশ কাটিয়ে চলে আসতে নিচ্ছিল। মুবিন ভাইয়ের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। মীরা দু’কদম বাড়িয়েছে তখনই মুবিন পেছন থেকে বলে উঠল,

“আমি মাহিমাকে পছন্দ করি মীরা।”

মীরার পা থেমে গেল। ভ্রু কুঁচকে ঝট করে মুবিনের দিকে ফিরল। সে যা শুনেছে মুবিন ভাই কি তা-ই বলেছে? মুবিন মীরার চোখের দৃষ্টি বুঝতে পেরে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।

“হ্যাঁ মীরা। আমি মাহিমাকে পছন্দ করি।”

মীরা কতক্ষণ থম মেরে থেকে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল,

“মুবিন ভাই।”

মুবিন ভয় পেয়ে গিয়েছিল। মীরা হঠাৎ এমন চেঁচাবে আশা করেনি। মীরা থপথপ পা ফেলে মুবিনের সামনে এসে দাঁড়াল।

“আপনি আমার সাথে মজা করছেন?”

“না মীরা। মজা করবো কেন? আমি সত্যি বলছি।”

“এই কথা তাহলে আমাকে বলছেন কেন?”

“মীরা তুমি কি রেগে যাচ্ছ? রাগ কোরো না প্লিজ।”

মীরা মনে মনে বলল,

“রাগ করব না। আমি খুশিতে মাটিতে শুয়ে সাপের মতো মোচড়ামুচড়ি করে নাগিন ডান্স করব। এতদিন হাবভাবে আমাকে পছন্দ করেন বুঝিয়ে এসেছেন। এখন এন্ড মোমেন্টে আমার বোনকে প্রপোজ করছেন? আপনাকে ফিরিয়ে দিলে কষ্ট পাবেন ভেবে আমি নিজেকে অপরাধী ভাবছিলাম। কিন্তু এখন ছ্যাঁকাটা তো আপনি আমাকেই দিয়েছেন।”

“তোমাকে বলছি কারণ, মাহিমা মনে হয় আমার ব্যাপারে এমনটা ভাবে না। কিন্তু আমি অনেকদিন ধরেই মাহিমাকে পছন্দ করি। ওকে কীভাবে বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। তুমি তো মাহিমার বেস্ট ফ্রেন্ড আবার বোনও। তুমি আমার হয়ে ওকে..

“এজন্যই আমরা কলেজ যাওয়ার সময় আপনি দোকানে বসে থাকতেন?”

“তোমরা লক্ষ করেছিলে? মাহিমা লক্ষ করেছে?”

“মুবিন ভাই!”

মীরা রাগে দুঃখে শুধু শুধু চেঁচাচ্ছে। মুবিন ভাই তাকে প্রপোজ করলে সে নিজেই না করে দিত। কিন্তু এখন মুবিন ভাই মাহিমাকে পছন্দ করে। মীরার কেমন ছ্যাঁকা খাওয়া ফিলিংস হচ্ছে।

“কী মীরা?”

“আপনি মাহিমাকে দেখার জন্য দোকানে বসে থাকতেন?”

কথাটা শুনে মুবিন লজ্জা পেল। লজ্জিত ভঙ্গিতেই বলল,

“ইয়ে মানে..

” এখন আর ইয়ে মানে করছেন কেন? যা করার তা তো আগেই করে ফেলেছেন।”

“মাহিমা কি আমাকে পছন্দ করে মীরা?”

“দুধ কলা দিয়ে ঘরে এত হ্যান্ডসাম একটা ভাই পালছেন। তাকে রেখে কোন মেয়ে কেন আপনার দিকে ফিরবে? ভাইটাকে একটু কম হ্যান্ডসাম হতে বলতে পারলেন না। আপনি যাকে বাবুর আম্মু বানানোর স্বপ্ন দেখছেন সে আপনাকে চাচা বানানোর চেষ্টায় আছে।”

মনের কথা মনেই রয়ে গেল। এসব কথা মীরা মুবিনের সামনে বলতে পারল না। কইতরি শালি দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা তার কানে মন্ত্র পড়ত, মুবিন ভাই তোকে পছন্দ করে। কানা কইতরি চোখ খুললে দেখতে পেত মুবিন ভাই কাকে পছন্দ করে। কানার বাচ্চা আন্ধা, মুবিন ভাই তোকে পছন্দ করে।

“আপনি এখন কী চান মুবিন ভাই?”

“তোমার সাহায্য ছাড়া আর কী চাইব মীরা? প্লিজ তুমি আমাকে হেল্প করো।”

“কেন?”

মুবিনের কপালে ভাঁজ পড়ল।

” কেন মানে কি?”

“আপনাকে আমি কোন স্বার্থে সাহায্য করব?”

“স্বার্থ?”

“অবশ্যই। মীরা কাউকে মাগনা সার্ভিস দেয় না। মীরার সার্ভিসের দাম আছে।”

“তুমিই বলো কী চাও তুমি?”

“আমি যেদিন বলব ছুটি দিতে হবে। পড়ার চাপ তো একেবারেই দেওয়া যাবে না। কোন হোমওয়ার্ক করব না। আমার যতক্ষণ চন চাইবে পড়ব, তারপর গল্প করব। পরীক্ষায় কম মার্কস পেলেও আপনি বকবেন না। বাবা, চাচা, ভাইয়ারা জানতে চাইলে বলবেন, মীরার মতো ব্রিলিয়ান্ট, ইন্টেলিজেন্ট মেয়ে এই ওয়ার্ল্ডে দু’টা নেই।”

মুবিন হাঁ করে মীরার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়ে এসব শর্ত রাখছে? একটু বেশি বেশি হয়ে গেল না! হলেও এখন চুপচাপ মেনে নিতেই হবে।

“আরও কিছু শর্ত আছে। সেগুলো এখন মনে পড়ছে না।”

“ঠিক আছে। মনে পড়লে বলে দিও।”

মুবিন ভাই তার সব কথা মেনে নিয়েছে দেখে মীরা বিশ্ব জয় করা হাসি দিল।

“আর হ্যাঁ, এখন থেকে তো আপনাকে মুবিন ভাই ডাকব না।”

“তাহলে?”

“দুলাভাই ডাকব। আমার বোনের সাথে প্রেম করলে সম্পর্কে আমি আপনার শালি হবো না।”

“এই না, না। তোমাকে কেউ দুলাভাই ডাকতে শুনে ফেললে প্রবলেম হয়ে যাবে মীরা।”

“এরকম পিঁপড়ার কলিজা নিয়ে তো প্রেম করতে পারবেন না দুলাভাই। মাহির ভাই জানতে পারলে ছেঁচা দিয়ে আপনার এটুকু সাহসও নিগড়ে দিবে। আমি তো শুনেছিলাম প্রেমে পড়লে ছেলেদের ছাতি ছত্রিশ হয়ে যায়। শোনায় ভুলও থাকতে পারে। তাই তো দেখছি, আপনারটা কমেছে।”

🌸

মীরা গাড়িতে এসে বসলে মাহিমা জিজ্ঞেস করল,

“এতক্ষণ কোথায় ছিলি?”

“তোর বন্দোবস্ত করে এলাম।”

“মানে?”

“মানে তোর মাথা। তুই আর কোনদিন ছেলেদের দেখে বলবি না এই ছেলে ওই মেয়েকে পছন্দ করে। ওই ছেলে ওই মেয়েকে পছন্দ করে। তোর ধারণা আকাশ পাতাল ভুল বেরোয়।”

“জীবনেও না। আমি ছেলেদের চোখ দেখেই বলে দিতে পারি মনে কী চলছে।”

“এই কথাটা দ্বিতীয় বার তোর মুখে শুনলে লা’থি মেরে চাপা ত্যাড়া করে ফেলব।”

মাহিমা কিছুই বুঝতে পারল না মীরা হঠাৎ তার উপর এত ভড়কে গেল কেন? সে কী করেছে? আজব!
🌸

বিয়ে কমিউনিটি সেন্টারে হবে। বাড়ির মেয়েরা সবাই পার্লারে চলে গেছে। আবির ইভানকে পার্লারে যাওয়ার কথা বললে ইভান বলল,

“সাবান দিয়ে ঘষে মুখ ধুয়ে ফেললেই আমি সুন্দর করে যাব।”

এই কথা শুনে আবির হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল। মীরাদের পার্লার থেকে নিয়ে যেতে হবে। ইভাকেও পার্লার থেকে তুলে নিতে হবে। জায়িন মুবিনকে যেতে বললে মুবিন জানাল, তার শেরওয়ানি চেঞ্জ করতে যেতে হবে। সে মল থেকে সোজা কমিউনিটি সেন্টারে চলে যাবে।
জায়িন গাড়িতে হেলান দিয়ে পার্লারের সামনে দাঁড়িয়ে ইভাকে কল করছে। ইভা আপুই তাকে কল করে আসতে বলেছিল। একঘন্টা আগে বলেছে সাজা শেষ। কিন্তু এখনও বের হচ্ছে না। জায়িনের মেডিকেলের একটা বন্ধুর কল এলে জায়িন ফোন কানে কথা বলছিল। হঠাৎ তার চোখ সামনে পড়তে জায়িন ফ্রিজড হয়ে গেল। ফোন হাত থেকে পড়েই যাচ্ছিল। জায়িন নিজেকে সামলে নিয়ে ফোন পকেটে রাখল। সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বুকে হাত বাড়ল। ইভা সহ মীরা মাহিমা সবাই বেরিয়ে আসছে। মীরার পরনে লাল টুকটুকে লেহেঙ্গা। স্ট্রেইট করা চুলগুলো খোলা রেখেছে। ডান কাঁধে ওড়না ফেলে বাঁ দিকে কিছুটা চুল সামনে এনে রাখা। দু’হাতে লেহেঙ্গা উঁচু করে ধরে হেঁটে আসছে। মাঝে মাঝে বাঁ হাতে কানের পেছনে চুল গুঁজে দিচ্ছে। জায়িনের হাঁসফাঁস লাগছে। বাতাসে অক্সিজেনের অভাব দেখা দিয়েছে মনে হচ্ছে। ওরা যতটা কাছাকাছি আসছে জায়িনের নিজেকে সহজ শান্ত স্বাভাবিক রাখতে তত বেশি কষ্ট হচ্ছে।

চলবে…