#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
Jerin Afrin Nipa
২৮
জায়িনের পরনে সাদা পাঞ্জাবি। বাম হাতে সবসময়ের মতো একটা ঘড়ি। খুব সিম্পল লুক। তবুও দূর থেকে জায়িনকে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মাহিমা গদগদ গলায় মীরাকে বলল,
“জায়িন ভাই কি দিনদিন আরও হ্যান্ডসাম হচ্ছে রে মীরা? লোকটা মনে হয় এলাকার সবগুলো মেয়েকে পাগল করে তবেই শান্ত হবে।”
মীরার চোখও জায়িনের উপর পড়েছে। কিন্তু মাহিমাকে জায়িন ভাইয়ের উপর দুই নাম্বারি নজর দিতে দেখে পিঠে দুম করে কিল বসালো।
“যাকে তাকে দেখেই গলে যাস না। হতে পারে ভবিষ্যতে গিয়ে সম্পর্ক উল্টেপাল্টে গেছে।”
মাহিমা বিরক্ত চোখে মীরার দিকে দেখল। চুল নষ্ট হয়েছে কিনা দেখতে দেখতে বলল,
“দুনিয়ার কাউকে নিয়ে তোর সমস্যা নেই? জায়িন ভাইয়ের কথা এলেই তোর বদহজম শুরু হয়। কেন রে?”
“না জেনে ভবিষ্যত ভাসুরের উপর নজর দিচ্ছিস। বদহজম হবে না তো কী করবে? ওদিকে ছোট ভাই তার উপর লাড্ডু হয়ে আছে। এদিকে সে বড় ভাইয়ের উপর হারাম দৃষ্টিতে দেখছে।”
“কী বিড়বিড় করছিস? ইদানীং খুব বেশি বিড়বিড় করিস।”
“তুই জায়িন ভাইকে মাথা থেকে বের করে চোখ মেলে আশেপাশে দেখ। তোকে দেওয়ার জন্য কত মজনু হৃদয় খুলে হাতে নিয়ে বসে আছে।”
মাহিমা জবাব দেওয়ার সুযোগ পেলো না। তনি ওদের ধাক্কা দিয়ে জায়িনের দিকে এগিয়ে গেল।
“ওহ-হো হিরো! আজ আমার ছোপা রুস্তম নিজের ফর্মে বেরিয়ে এসেছে। আগুন লাগছিস বেটা।”
জায়িন হাসলো। তনির দিকে তাকিয়ে চোখ বাঁকিয়ে বলল,
“বাংলায় আগুন বললি তাতে কিন্তু অপরাধ হবে না। কিন্তু আমি তোকে হট বললেই তোর বয়ফ্রেন্ড আমাকে মারতে আসবে।”
“মোটেও না। হট একটা মেয়েকে হট না বললেই বরং অপরাধ হবে।”
তনির সাথে ফ্লার্ট করে অন্তত কেউ পারবে না। জায়িন তো তার বন্ধু। অচেনা একটা ছেলের সাথেও তনি এরকম ভাবেই কথা বলবে।
“তোর বয়ফ্রেন্ড এরকম সুন্দরী একটা গার্লফ্রেন্ড রেখে কোন মেয়ের পেছনে ঘুরছে?”
“ঘুরুক, মরুক যা খুশি করুক। ওর কপালে আমি ছাড়া আর কেউ নেই।”
ইভা জায়িনের সামনে এসে দু’হাতে লেহেঙ্গা মেলে ধরে বলল,
“আমাকে কেমন লাগছে?”
জায়িন বোনকে দেখে মৃদু হেসে জানাল,
“ইভান ভাই হার্ট অ্যাটাক করবে।”
“যাহ!” ইভা লজ্জা পেলো। জায়িনও এমন মজা করবে আশা করেনি। আবির এখনও পৌঁছায়নি। ইভা তনিকে জিজ্ঞেস করল,
“তোমরা আমাদের সাথে যাবে? আবিরের আসতে কতক্ষণ?”
“জানি না। একঘন্টা আগে বলেছে রাস্তায় আছে। তার রাস্তা এখনও শেষ হচ্ছে না।”
জায়িন আবিরকে কল করল। আবির ত্রিশ মিনিট ধরে জ্যামে আটকা পড়ে বসে আছে। আরও ত্রিশ মিনিটেও জ্যাম ছুটবে কি-না সন্দেহ। তাই ওদেরকে জায়িনের সাথে চলে যেতে বলল।
“এক গাড়িতে সবার জায়গা হবে?”
জায়িন দেখল ইভা আপুকে নিয়ে পাঁচ জন। পাঁচজন যাওয়া যাবে জানালে আবির বলল,
“তাহলে তুই ওদেরকে নিয়ে কমিউনিটি সেন্টারে পৌঁছা। আমি পেছনে আসছি।”
“হুম।”
তনি সামনে জায়িনের পাশে বসেছে। বাকিরা ঠেলাঠেলি করে পেছনে উঠেছে। মাহিমা হিল জুতা দিয়ে মীরার পায়ে পাড়া দিলে মীরা চিৎকার করে উঠে মাহিমাকে মারতে লাগলো।
“আল্লাহ! মোটির বাচ্চা আমাকে মেরে ফেলল। হাতির বাচ্চা চোখে দেখিস না। আমার পা পিষে ফেলেছিস। উফ, আল্লাহ।”
মাহিমা দেখে পাড়া দেয়নি। তবুও অপরাধী হয়ে বলতে লাগল,
“সরি সরি। সরি রে। আমি দেখিনি সত্যি।”
“তোর সরি দিয়ে আমি আচার দিব খবিশ! তোর সরি তুই নিজের কাছে রাখ।”
“সরি বলছি তবুও মানছিস না। এখন কিন্তু আরেকটা পাড়া দিব।”
“আর আমি তোকে লা’থি দিয়ে গাড়ি থেকে বের করে দিব।”
“গাড়ি তোর? তুই আমাকে বের করার কে?”
মুহূর্তে এদের ঝগড়া লেগে যাওয়া দেখে জায়িন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। সামান্য একটা ব্যাপারে এরকম ঝগড়া! তা-ও এরা নিজেদের বেস্ট ফ্রেন্ড দাবী করে! তনি এদের ক্যাঁচক্যাঁচানিতে অসহ্য হয়ে বলল,
“তোরা চুপ না করলে দু’টাকেই গাড়ি থেকে বের করে দিব। ফেলে চলে গেলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঝগড়া করিস।”
একেতো মীরা পায়ে ব্যথা পেয়েছে। তনি আপু উল্টো তাকেই বকছে। মীরা অভিমানী গলায় বলল,
“ফেলে চলে যাও। আমি হেঁটে যাব। না যেতে পারলে এখানেই বসে থাকব।”
মীরাকে মন খারাপ করতে দেখে মাহিমা নিজের ভুল বুঝতে পারল। এমনকি তনি আপু মীরাকে কেন বকেছে এজন্য তনিকে বলতে লাগল,
“মীরাকে রেখে গেলে আমিও তোমাদের সাথে যাব না। চল মীরা আমরা গাড়ি থেকে নেমে যাই।”
তনি কপাল চাপড়াল। যার জন্য করলো চুরি সে-ই বলে চোর! তনির অবস্থা কিছুটা এরকম। ওদের ঝগড়া থামানোর জন্যই দুইটাকে ধমক দিয়েছিল।
“তোদের ঝগড়ার মাঝে কথা বলে জীবনের সবথেকে বড় ভুলটা করে ফেলেছি বোন। আমাকে ক্ষমা কর। তবুও গাড়ি থেকে নেমে যাস না। আজ ইভান ভাইয়ের বিয়ে। মনে আছে তো?”
মীরা মাহিমা ঝগড়া করেও মিলে গেছে। মাঝখানে তনি ভিলেন হয়েছে। ইভা এদের কাণ্ড দেখে হাসলো। গাড়িতে বসে পুরোটা পথ মীরা মাহিমা সেল্ফি তুলে গেছে। সাথে ওদের ননস্টপ বকবকানি। জায়িন ড্রাইভ করতে করতে আড়চোখে বার কয়েক রিয়ারভিউ মিররে তাকিয়েছে। খুব অল্প সময়ের জন্য দেখে সামনের রাস্তায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে।
🌸
মুবিন মাহিমাকে দেখে স্থান, কাল, পরিস্থিতি ভুলে হাঁ করে দেখতেই থাকলো। মাহিমা গাধী মীরাকে ঠেলা দিয়ে বলল,
“দেখ দেখ! কীরকম হ্যাংলার মতো তাকিয়ে আছে।”
মীরা এই গাধার গাধামিতে বিরক্ত হয়ে বলল,
“হ্যাংলা, গাধা, ঘোড়া, পাঠা যা খুশি ডাক। তোর অধিকার আছে।”
“ডাকবোই তো। দুলাভাই বলে কথা!”
এই গাধীটা কি এখনও কিছু বুঝতে পারছে না? মুবিন ভাইয়ের হাবভাব বুঝেছে। কিন্তু সেটা যে মীরার জন্য না এটা বুঝতে এত সময় লাগছে কেন? এমনিতে তো ক বলার আগে কলকাতা বুঝে যায়। শুধু মুবিন ভাইয়ের মনটাই বুঝছে না।
“কিরে কোথায় ডুবে গেলি?”
“গভীর ভাবনায়।”
“অত ভাবতে হবে না। ভাবাভাবি সাইডে রেখে প্রপোজ করলে ফট করে হ্যাঁ বলে দিবি।”
“মুবিন ভাইকে তোর কেমন লাগে?”
“ভালোই। কিউট। জায়িন ভাইয়ের মতো এতটাও হ্যান্ডসাম না হলেও চলে।”
মীরা রেগে বলল,
“এখানে জায়িন ভাই কোত্থেকে এলো? কথা তো হচ্ছে মুবিন ভাইকে নিয়ে।”
মাহিমা মীরার রাগের অন্য মানে ধরে নিয়ে বলল,
“আচ্ছা বাবা মুবিন ভাইও হ্যান্ডসাম। চেহারা সুরত লম্বা চওড়া পড়াশোনা সবদিক দিয়েই পারফেক্ট।”
“এমন পারফেক্ট একটা ছেলে প্রপোজ করলে তুই রাজি হবি?”
মাহিমা ভাবছে মুবিন ভাই প্রপোজ করলে মীরা এক্সেপ্ট করবে কি-না সেটা জানতে চাচ্ছে। তাই মাহিমা কিচ্ছু না ভেবে বলে বসল,
“অবশ্যই। কেন করব না? কী কমতি আছে মুবিন ভাইয়ের মাঝে? আজকাল এমন ছেলে পাওয়া যায়?”
মীরা ঠোঁট বাঁকিয়ে রহস্যময় হাসলো।
“কথাটা মনে রাখিস। ভুলে গেলে খবর আছে।”
🌸
জায়িন মেয়েদের ভীড়টার মাঝে একজনকে খুঁজছে। অনেকক্ষণ ধরে দেখছে না। কোথায় গেল? কয়েকজন গেস্টকে অ্যাটেন্ড করতে তাকে যেতে হয়েছিল। নইলে চোখে চোখেই রেখেছিল। এখন এসে খুঁজে পাচ্ছে না।
“কাকে খুঁজছিস রে?”
তনির কথায় জায়িন চোখ বন্ধ করে ছোট্ট করে দম ফেলল। তনিটার ভুল জায়গায় ভুল মুহূর্তে টপকে পড়ার অভ্যাসটা এখনও পাল্টালো না। জায়িন ঘুরে তাকাল। তনি কৌতূহলে চিকচিক করা চোখে জায়িনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
“কোন মেয়েকে দেখছিলি, না? হ্যাঁ। মেয়েকেই দেখছিলি। কোন মেয়েটা রে? আশেপাশে এত সুন্দর সুন্দর মেয়েরা ঘুরছে। এক আধটা তো পছন্দ হয়ে যাওয়ারই কথা। কোন মেয়েটা আমাকে দেখা না। শুধু কি চোখে চোখেই মন দেওয়া নেওয়া করে বসে আছিস? নাকি কথাও এগিয়েছিস? তুই না পারলে আমাকে বল। আমি মামলা সেট করে দিব।”
জায়িন তনির কথার কোন গুরুত্বই দিল না। বরং তনিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চলে যেতে নিলে তনি পথ আটকে দাঁড়াল।
“চোরের মতো পালিয়ে যাচ্ছিস কেন চোর? বল কোন মেয়েকে দেখছিলি?”
“তোর বোনকে।”
তনি ঠোঁট কামড়ে সরু চোখে জায়িনের দিকে তাকাল। জায়িনও এমন মজা করতে শিখে গেছে দেখে হাসল। জায়িনের পেটে চিমটি কেটে বলল,
“আমার কোনো বোনকে দেখলে আমি এক্ষুনি তোদের দুইটাকে ধরে বিয়ে দিয়ে দিতাম।”
জায়িন মনে মনে হাসলো। তনি নাছোড়বান্দা। তাগাদা দিতেই লাগল,
“মেয়েটা কে বল না। এমন করছিস কেন? আমাকে বন্ধু মনে করিস না?”
“তনি প্লিজ জ্বালাস না। কোন মেয়েকে দেখব?”
“মেয়ে না দেখলে মহিলাদের দেখছিলি লু’চ্চা?”
জায়িন তনির দিকে ঝুঁকে এসে গলা খাদে নামিয়ে বলল,
“কাকে দেখছিলাম শুনবি?”
তনিও কৌতূহলী হয়ে আরও ঝুঁকে এসে। নিচু গলায় বলল,
“হুম। বল বল।”
“মাইন্ড করবি না বল।”
“মাইন্ড করব কেন? আমার মতো ফ্রি মাইন্ডের মেয়ে তুই আরেকটা খুঁজে পাবি!”
“ঠিক আছে, শোন তাহলে।”
“হুম। বল।”
“বলছি।”
“বল।”
“তোর বোনকে।”
তনি কটমট করে জায়িনের দিকে তাকিয়ে ফুঁসতে লাগল। জায়িন হেসে ফেলল। তনি রেগেমেগে জায়িনের চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল,
“মর শালা। তোর কপালে মেয়ে নাই। সিঙ্গেলই মরবি তুই।”
তনি চলে গেলে জায়িন গম্ভীর হলো। সে সত্যিই বলেছে। কিন্তু তনি মরে গেলেও তার কথা বিশ্বাস করবে না। আবির, তনির এই বিশ্বাসটাই জায়িনের পায়ে শেকল হয়েছে। তার উপর এত বিশ্বাস কেন? এই বিশ্বাস ভাঙলে ওরা কি জায়িনকে ক্ষমা করবে?
চলবে..
#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
Jerin Afrin Nipa
২৯
মীরার ওড়নায় টান পড়লে সে দাঁড়িয়ে গেল। কিসের সাথে ওড়না আটকেছে দেখার জন্য মীরা পেছন ফেরার আগেই জায়িন এসে লোকটাকে বলল,
“এক্সকিউজ মি, আঙ্কেল। আপনার পায়ের নিচে..
লোকটা নিচে তাকিয়ে লক্ষ করতেই দেখল তিনি কারো ওড়নায় পা রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। লোকটা জায়িনের দিকে তাকিয়ে লজ্জিত মুখে হেসে বলল,
” ওহ সরি ইয়াংম্যান। আন্তরিক সরি।”
মীরা এদিকে তাকালে দেখতে পেল জায়িন তার ওড়না হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে একটা লোকের সাথে কথা বলছে। মীরা অবাক হওয়ার সাথে সাথে কিছুটা বিরক্তও হলো। জায়িন ভাই কোন সুখে তার ওড়না ধরে রেখেছে? ব্যাপারটা দেখার জন্য মীরা ওদের কাছে এসে দাঁড়াল। লোকটা মীরাকে দেখে জায়িনের দিকে তাকিয়ে উদেশ্য পূর্বক হেসে বলল,
“নতুন বিয়ে? এমনই হয়। এসময় বউয়ের আঁচল ধরেই ঘুরতে হয়। আমিও এমনভাবেই তোমার চাচীর আঁচল ধরে ঘুরতাম। একমুহূর্তের জন্য চোখের আড়াল হতে দিতাম না। আর এখন দেখো। বিয়ের ছাব্বিশ বছর পেরিয়েছে। আমি কোথায় তোমার চাচী হয়তো জানেই না। সে-ও মিসেস সালেহ নয়তো মিসেস হকের সাথে গসিপ করছে। হা হা। এমনই হয়। শুরুতে প্রেমটা যেমন থাকে বিশ বছর পর তার কিছুই থাকে না।”
লোকটা নিজে নিজেই ওদের স্বামী স্ত্রী কল্পনা করে এতগুলো কথা বলে গেল। জায়িন চেয়েও বাধা দিতে পারল না। মীরা চোখ বড় বড় করে লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। পাগল লোক কাকে কার বউ বলছে? দিনেদুপুরে চড়িয়ে এসেছে নাকি? মীরা জায়িনকেও দেখল। জায়িন ভাই লোকটার ভুল শুধরে দিল না! মীরার জায়িন ভাইয়ের উপরও রাগ হলো।
“না না না। আঙ্কেল আপনার ভীষণ বড় ভুল হচ্ছে। আমরা..
লোকটা মীরাকে থামিয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বলল,
” শুরুতে সবাই এটাই বলে মা। আমাদের প্রেম আমৃত্যু থাকবে। কিন্তু দু’জন মানুষ একসাথে থাকা শুরু করলে একে অপরের অনেক খুঁত জানতে পারে। শুরুতে পার্টনারের যে অভ্যাসে ভালোবাসা পেত বছর কয়েক গেলে সেটাই বিরক্তিকর হয়ে উঠে।”
মীরা নাকের পাটা ফুলিয়ে আগুন চোখে জায়িনকে দেখছে। জায়িন ভাই কিছু বলছে না কেন? আশ্চর্য!
“আঙ্কেল আপনি থামবেন? না জেনে কতকিছু বলে যাচ্ছেন!”
লোকটা মীরার রাগ দেখেও হাসলো। মীরার রাগের পাত্তা না দিয়ে জায়িনের দিকে তাকিয়ে মুখের হাসি চওড়া করে বলল,
“অনেক ভালোবাসে। তাই মানতে পারছে না। ভালো ভালো। এই ভালোবাসা থাকাটা ভালো। তবে যত ভালোবাসাই থাকুক। এটাই বাস্তব ইয়াংলেডি।”
লোকটার কথা শুনে মীরার রেগেমেগে আগুন হওয়া চেহারা দেখতে জায়িনের ভালোই লাগছে। লোকটার কথাগুলোও শুনতে তেমন খারাপ লাগছে না। বিবাহিত জীবনে হাঁপিয়ে ওঠা একটা লোক মীরাকে তার স্ত্রী ভেবে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছে। লোকটাকে বাধা দেওয়ার কোন অধিকার তো তার নেই। সব মানুষের বাকস্বাধীনতা আছে।
মীরা এই বুড়োর মাথা ফাটিয়ে দিবে। তোর জীবনে সুখ নাই বুড়ো এখন তুই যারে তারে জামাই বউ বানিয়ে জ্ঞান ঝাড়বি! জায়িন লক্ষ করল মীরা কঠিন কিছু কথা বলার জন্য তৈরি হচ্ছে। তার আগেই সে লোকটাকে অন্যদিকে পাঠিয়ে দিল।
“আঙ্কেল আন্টি হয়তো আপনাকে খুঁজছে।”
এই অসহ্যকর লোক যাবার আগেও একটা কথা বলে মীরার গা জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। তিনি আসলে মীরাকে উদ্দেশ্য করে জায়িনকে বলেছে,
“জিতে গেছো ইয়াংম্যান। তোমার লাক ভালো। তোমার মতো ভাগ্য সবার হয়না। আমার মতো অবহেলায় হারিও না। ভালোবাসা দিয়ে আগলে রেখো।”
লোকটা চলে গেলে মীরা জায়িনের উপর ফেটে পড়ল। ঝাড়া মেরে জায়িনের হাত থেকে ওড়নার কোনা ছাড়িয়ে নিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বলল,
“আপনি লোকটার ফালতু কথা কেন শুনছিলেন জায়িন ভাই? উনি আমাদের…! আপনি উনার ভুল কেন ভাঙেননি? চুপ করে শুনলেন! একটা কথাও বলেন নি! কেন?”
“বয়স্ক লোক। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ব্যক্তিগত জীবনের বেচারা সুখে নেই।”
“বুড়োর নিজের জীবনে সুখ নেই বলে যাকে তাকে..। আপনি নিজেও ওই লোকটার মতো পাগল। দুই পাগলের পাগলামির মাঝে আমাকেও ফাঁসিয়ে দিয়েছেন।”
“আমি তো উনাকে কিছু বলিনি। উনি নিজে নিজে ভেবে নিয়েছেন। এতেও কি আমার দোষ?”
“অবশ্যই। আপনি ভুল ভাঙানোর চেষ্টা করেননি। উল্টো উনাকে এমনটা ভাবতে দিয়েছেন।”
“আচ্ছা মানলাম, কিন্তু উনার ভুল ভাঙালে কী হতো?”
“কী হতো মানে? উনি এমনটা ভাবত না।”
“এখন উনি এমনটা ভাবছেন। তাতে তোমার আমার কারো ক্ষতি হচ্ছে কি?”
“ক্ষতি না হোক। একটা মানুষ কেন না জেনে এমনটা ভাববে!”
“সেটা উনার ভাবনা মীরা। আমাদের তো কিছু না। উনার ভাবনা উনাকে ভাবতে দাও। কারো ভাবনার উপর নিশ্চয় আমাদের কন্ট্রোল নেই।”
জায়িনের কথার প্যাঁচে ফেঁসে গিয়ে মীরা আর তর্ক করার মতো কোন কথা খুঁজে পেলো না। শেষে রেগেমেগে শুধু এটুকু বলল,
“আপনি ডাক্তার না। আপনি নিজেও একটা মস্ত বড়ো পাগল।”
কথাটা বলেই মীরা গটগটিয়ে জায়িনের সামনে থেকে চলে গেল। মীরার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে জায়িন শব্দ করে হেসে ফেলল।
“পাগলি!”
জায়িনের কাঁধে কারো হাত পড়তে জায়িন চমকে তাকালো। আবির অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে সামনের দিকে চোখ রেখেই বলল,
“পাগলিটা কে রে? ওই মেয়েটা? এখানে এসেছে!”
মীরা ততক্ষণে পুরোপুরি চোখের আড়ালে চলে গেছে বুঝতে পেরে জায়িন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। যাক আবিরের চোখে পড়েনি। আবিরটার টাইমিংও মাশাল্লাহ। যখনতখন যেখানে সেখানে টপকে পড়ে। জায়িন কিছু বলছে না দেখে আবির ওর পেটে খোঁচা মারল।
“পাগলিটা কে বল। আমি কিন্তু স্পষ্ট শুনে ফেলেছি। আর লুকাস না। বলে ফেল। ভাবী এখানে উপস্থিত আছে?”
জায়িনের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। স্বর্ণে বাঁধানো কপাল তার। একবার তনি এসে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফেলে। একবার আবির এসে কথা শুনে ফেলে। এই দুইটার কি আর কোন কাজ নেই? গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড দুইটা নিজেদের ফেলে তার পেছনে গোয়েন্দা খাটছে। এরা থাকতে তার প্রেম তো এই জীবনে হবে না। এখন দেখা যাচ্ছে এদের যন্ত্রণায় দুনিয়ায়ও থাকা যাবে না। গাট্টিগুট্টি বেঁধে সে কি এখন মঙ্গল গ্রহে চলে যাবে? আবির জায়িনের কাঁধে চেপে ধরলো। তনিকে ভুলভাল বোঝানো গেলেও আবিরকে উল্টাপাল্টা বোঝ দেওয়া সহজ হবে না।
“তনিকে মনে হয় এতদিন আমি ভালো করে দেখিনি। নইলে ওকে শুধু বন্ধুর নজরেই দেখেছি। তনিও যে একটা মেয়ে এটা মিস করে গিয়েছিলাম।”
আবির সানগ্লাসের উপর দিয়ে বড়ো বড়ো চোখে জায়িনকে দেখল। এই শালা বলে কি! আবির সানগ্লাস খুলে ফেলে আতঙ্কিত গলায় বলল,
“তুই আমার না হওয়া সংসার শুরু হওয়ার আগেই ভাঙতে চাচ্ছিস! বন্ধুর সম্পদের উপর কুদৃষ্টি দিচ্ছিস?”
“কী করব? তুই ঠিকঠাক মতো বন্ধুর দায়িত্ব পালন করলে এই দিন আসতো না।”
“কীভাবে দায়িত্ব পালন করব শালা। তুই তো কিছু বলিসই না। পছন্দের মেয়ে থাকলে বল। না থাকলে সেটাও বল। তোকে কি আমি সিঙ্গেল মরতে দিতাম? বল কেমন মেয়ে পছন্দ। আশেপাশে না পেলে সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে হলেও তেমন মেয়ে খুঁজে আনবো।”
“প্রজাপতির মতো একটা মেয়ে।”
“কিহ! এইটা আবার কোন প্রজাতি?”
“প্রজাপতি দেখেছিস কখনও? প্রজাপতির সব বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে থাকবে। তার পৃথিবী প্রজাপতির ডানার মতোই রঙিন হবে। প্রজাপতির মতো ছটফটে চঞ্চল।”
“ওরে ভাই, প্রজাপতি যেমন এক ফুলে বেশিক্ষণ বসে না ওই মেয়ের মনও তোর উপর বেশিদিন টিকবে না। তখন দেবদাস হয়ে আমার কাছেই তো আসবি। তার থেকে ভালো কচ্ছপ প্রজাতির মেয়ে খুঁজে দিই? কচ্ছপের মতো ওই মেয়ের মন তোর উপর থেকে নড়বে না।”
🌸
মাহিমা বাম হাতে কানের পেছনে চুল আটকে রেখে ঝুঁকে নিচে তার কানের দুলটা খুঁজছে। একটু আগে চুল ঠিক করতে গিয়ে আবিষ্কার করল তার বাঁ কানের দুল হারিয়ে গেছে। এখানেই হয়তো কোথাও পড়েছে। আবার অন্য জায়গায়ও পড়তে পারে। বিয়ে উপলক্ষে নতুন একজোড়া দুল কিনেছিল। তার থেকে বড় কথা দুলটা না পেলে এখন এক কান খালি নিয়ে কীভাবে ঘুরবে? মাহিমা মানুষের ভীরের মধ্যেই এর ওর পায়ের ফাঁকে দুলটা খুঁজে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে এক-দুজনের সাথে ধাক্কা খেয়ে সরিও বলছে। মাহিমা কুঁজো হয়ে ঝুঁকে ছিল ওর সামনে এসে একজোড়া পা থেমে গেলে মাহিমা মাথা তুলে মুবিনকে দেখলো। মুবিন মাহিমার দিকে মুঠো করা হাত বাড়িয়ে দিয়ে মুঠো খুলে বলল,
“এটা খুঁজছিলে?”
মাহিমা দেখল তার হারিয়ে যাওয়া কানের দুলটা মুবিন ভাইয়ের হাতে। মনে মনে দুলটা পাওয়ার আশা ছেড়েই দিয়েছিল। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে দুলটা পেয়ে গিয়ে মাহিমা খুশি হয়ে গেল। সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মুবিনের দিকে তাকিয়ে মুখে হাসি নিয়ে বলল,
“হ্যাঁ। হারিয়ে গিয়েছিল। আপনি এটা কোথাও পেয়েছেন মুবিন ভাই?”
দুলটা মাহিমার কান থেকে খুলে পড়ে যাওয়ার সময়ই মুবিন দেখেছিল। সাথে সাথেই সে দুলটা তুলে নেয়। মাহিমা মুবিনের হাত থেকে দুলটা নিয়ে কানে পরতে লাগল। মুবিন মুগ্ধ হয়ে এই দৃশ্য দেখছে। মাহিমা দুল পরা শেষে বলল,
“ধন্যবাদ মুবিন ভাই। আপনি জানেন না দুলটা আমার কত পছন্দের ছিল। একটা হারিয়ে গেলে অন্যটাও পরতে পারতাম না।”
মাহিমা চলে যাওয়ার সময় মুবিন লক্ষ করল মাহিমার হাঁটতে যেন একটু কষ্ট হচ্ছে। হয়তো জুতার জন্য অসুবিধা হচ্ছে। মুবিন সাহস করে পেছন থেকে মাহিমাকে ডাকল। মাহিমা ফিরে তাকিয়ে বলল,
“কিছু বলবেন?”
মুবিন মাহিমার কাছে এগিয়ে এলো। পাশ থেকে একটা চেয়ার টেনে এনে মাহিমাকে বসতে ইশারা করলে মাহিমা বুঝতে পারল না।
“বসো।”
মাহিমা অবাক হলো। বসবে কেন সে? এটা কেমন আবদার!
“তোমার মনে হয় হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে। হয়তো সমস্যাটা জুতোর জন্য হচ্ছে।”
মাহিমা বিস্মিত হলেও তর্ক না করেই চেয়ারে বসল। মুবিন একহাঁটুতে মেঝেতে ভর দিয়ে মাহিমার সামনে বসলো। মাহিমা মুবিনের আচরণে যথেষ্ট চমকাচ্ছে। মুবিন নিজে মাহিমার জুতো খুলতে নিলে মাহিমা আঁতকে উঠে পা সরিয়ে নিয়ে বলল,
“কী করছেন মুবিন ভাই!”
চলবে…
#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
Jerin Afrin Nipa
৩০
হাই হিল পরার অভ্যাস না থাকলেও আজ শখ করে পরেছিল। সেই শখই কাল হলো। এমনিতে মাহিমা যথেষ্ট লম্বা হলেও উঁচু জুতোতে আরও লম্বা লাগে। উঁচু জুতো পরার এটাও অবশ্য একটা কারণ। কিন্তু এই জুতো পরে বেচারির পা বাজে ভাবে ছিলে গেছে। চামড়া উঠে লাল মাংস বেরিয়ে পড়েছে। এজন্যই তো এভাবে জ্বলছিল। হাঁটার সময় ব্যথা হচ্ছিল। কিন্তু মাহিমা খেয়াল করেনি। এখন জুতো খুলে ছিলে যাওয়া জায়গাটা দেখে রীতিমতো আঁতকে উঠতে হচ্ছে। ক্ষতটা দেখার আগে ব্যথা এতটাও অনুভব হচ্ছিল না। কিন্তু এখন ক্ষত দেখে যন্ত্রণা যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। মাহিমা নিচের ঠোঁট ফুলিয়ে কাতর গলায় বলল,
“কতটা ছিলেছে! উফ, ভীষণ জ্বালা করছে।”
মুবিন হতাশ নয়নে এই মেয়েটাকে দেখলো। কিছুটা শাসন মেশানো গলায় বলল,
“যেটা পরে কম্ফোর্ট ফিল করো না সেটা পরতে যাও কেন? কেউ নিশ্চয় জোর করেনি।”
“কিন্তু লেহেঙ্গার সাথে হিল না পরলে লেহেঙ্গা মাটিতে গড়ায়।”
মুবিন কী বলবে এই মেয়েকে? রাগ লাগলেও কঠোর ভাবে কিছু বলার অধিকার এখনও তার হয়নি।
“পরেছ, এখন হয়েছে? ভালো লাগছে?”
“না। ব্যথা লাগছে।”
মুবিন চাইলেও এখন মাহিমার জন্য নতুন একজোড়া জুতা এনে দিতে পারবে না। আনলেও মাহিমা নিজেই হয়তো নিতে চাইবে না। উল্টো তার এরকম আচরণে সন্দেহ করবে। ভুলও বুঝতে পারে। কিন্তু মাহিমা পুরোটা অনুষ্ঠানে এই জুতা পরে হাঁটবে কীভাবে? মুবিন পকেট হাতড়ে টিস্যু খুঁজে পেলো। বুদ্ধি বের করে গোড়ালির দিকে জুতোতে টিস্যু গুঁজে দিল। মাহিমা মনোযোগ সহকারে মুবিনের প্রতিটা কাজ দেখছে। মুবিন এবার বলল,
“এবার পরো দেখি। এখনও ব্যথা পেলে পরতে হবে না।”
মাহিমা জুতো পরে উঠে দাঁড়াতে নিলে মুবিন বলল,
“হেল্প লাগবে?”
“না, ঠিক আছে।”
মাহিমা নিজে নিজেই দাঁড়াল। নিচে পা ফেলে দেখল টিস্যু থাকায় এখন আর জুতোয় ঘষা লেগে কষ্ট হচ্ছে না। মাহিমা কৃতজ্ঞতার চোখে মুবিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ধন্যবাদ মুবিন ভাই। আপনাকে অনেকগুলো ধন্যবাদ দিলেও কম পড়বে।”
মুবিন হাসলো। সে ভালোবাসা চায় কিন্তু এই মেয়ে তাকে ধন্যবাদ দিয়ে কৃতজ্ঞতা জানায়। যাক এটাই বা কম কিসে? কৃতজ্ঞতাই হয়তো একদিন ভালোবাসার রুপ নিবে। মুবিন ততদিন অপেক্ষা করবে।
মুবিনের কাছ থেকে চলে এলেও মাহিমা এখনও মুবিনকে নিয়েই ভাবছে। মুবিন ভাইয়ের আজকের আচরণ তার কাছে অবিশ্বাস্য হলেও খারাপ লাগেনি। মুবিন ভাই তার জন্য কতটা ভেবেছে! আচ্ছা, উনি মীরাকে পছন্দ করে বলেই কি তার এতটা খেয়াল রেখেছে? শালিকে ইমপ্রেস করে মীরাকে পটাতে চাচ্ছে? কোন মেয়েকে পটানোর আগে প্রথম শর্তই হচ্ছে তার বান্ধবীকে পটাও। বান্ধবী পটে গেছে মানেই মেয়েটাও পটে গেছে। মুবিন ভাইও এই পথই ধরেছে। তবুও মুবিন ভাইয়ের আজকের কেয়ারটুকু মাহিমা কোনদিন ভুলবে না। ছেলে ফার্স্ট ক্লাস। মীরাটার কপাল আছে বলতে হবে।
“কোথায় ছিলি এতক্ষণ? খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হচ্ছি। চল ভাবীর সাথে সেল্ফি তুলে আসি। ভাইয়া ভাবীর ছবিও তো তুলতে হবে।”
মীরা মাহিমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। মাহিমা পড়ে যেতে যেতেও সামলে নিয়ে হাঁটছে। ভাবছে, মুবিন ভাইয়ের কথাটা মীরাকে বলবে কি-না। অবশ্যই বলবে। বেচারা কত কষ্ট করে মীরাকে ইমপ্রেস করার জন্য তার সেবা আত্তি করেছে। এই কথা মীরা না জানলে ইমপ্রেস হবে কীভাবে?
“তোর সাথে কথা আছে।”
“কী কথা?”
“দরকারি কথা।”
“দরকারি অদরকারি সব কথা পরে শুনব। এখন তুই আমার কয়েকটা সুন্দর সুন্দর ছবি তুলে দে। আমি পোজ দিচ্ছি দাঁড়া।”
🌸
মীরারা নতুন ভাবী নিয়ে রাতে বাড়ি ফিরলো। এখনও সবাই ইভান ভাইয়ের ঘরে নতুন ভাবীকে ঘিরে বসে আছে। মীরাও এতক্ষণ ওখানেই ছিল। কাপড় চেঞ্জ করতে মাত্র রুমে এসেছে। ওয়াশরুম থেকে চেঞ্জ করে এসে বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে কানের দুল, চুড়ি, টিকলি খোলার সময় পায়ের দিকে চোখ গেল। তার এক পায়ে নূপুর নেই। মীরা ব্যস্ত হয়ে আশেপাশে খুঁজতে লাগল। কখন হারিয়েছে এটা? বাড়িতে আসার পর? নাকি বিয়েতে? রুমে পড়লে পেয়ে যাবে। কিন্তু অন্য কোথাও পড়ে থাকলে? মীরা ফ্লোরে বসে উঁকিঝুঁকি দিয়ে বেডের নিচে দেখছে। এমন সময় ছোট চাচী ঘরে এলো। ছোট চাচী মীরাকে নিচে বসে থাকতে দেখে বলল,
“কী করছিস তুই? নিচে কী খুঁজছিস?”
মীরা মুখ তুলে চাচীর দিকে চাইল। মুখ কালো করে বলল,
“আমার নূপুর হারিয়ে… ” মীরা লক্ষ করল চাচীর হাতে ফোন ধরা। সে বুঝে গেল। আজকের এত খুশির দিনটাও ওই মহিলা নষ্ট করতে চাচ্ছে? ওই মহিলা কি তাকে খুশি থাকতে দেখতে পারে না? মীরার চোখ মুখ কঠিন হয়ে গেল। তীক্ষ্ণ গলায় সে বলল,
“আজও কেন বাইরের একটা মানুষের সাথে তুমি কথা বলছো ছোট চাচী? ওই নোংরা স্বার্থপর জঘন্য মহিলার কথা কেন শোনো।”
মীরার কথা মানুষটা শুনতে পারছে ভেবে ছোট চাচী ফোনের স্পিকার চেপে ধরলো। তাতেও অবশ্য শেষ রক্ষা হলো না। মীরা আরও চেঁচিয়ে বলতে লাগল,
“একটা বাইরের মানুষের সাথে আমি জীবনেও কথা বলবো না। আমার জন্য উনার এতই দরদ থাকলে উনাকে বলো আমাকে যেন শান্তিতে বাঁচতে দেয়। আমি উনার ছায়াটাও আমার জীবনে চাই না।”
ছোট চাচী অসহায় মুখে মীরার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোর মা হয় মীরা। মা কি সন্তানের সাথে… ”
“কে সন্তান ছোট চাচী? কাকে মা বলছো তুমি? উনি মা হলে সন্তানকে ছেড়ে চলে যেত? তুমি মাহাকে ফেলে চলে যেতে পারবে? উনি আমাকে তখন ছেড়ে গেছেন যখন আমার শুধু উনাকেই লাগত। এখন তো আমার উনাকে লাগবে না। উনাকে ছাড়াই তো এতগুলো বছর থেকেছি। বাকি জীবনও থাকতে পারব।”
কথাগুলো বলে মীরা কাঁদতে লাগল। এই মহিলা যখনই কল দেয় মীরার কষ্ট হয়। সবকিছু ভুলে থাকতে চাইলেও পারে না। মনে হয় সে কতটা দুর্ভাগা। তার মা তাকে ছেড়ে চলে গেছে। সে কি এতটাই খারাপ ছিল? ছেড়েই চলে যাবে তাহলে দুনিয়ায় এনেছিল কেন? ছোটবেলা যখন বুঝতো না, সব জায়গায় মা’কে খুঁজত। মা কেন আসে না? কেন তাকে আদর করে না এই কথাই জিজ্ঞেস করতো। স্কুলে সব বাচ্চাদের বাবা মা যেত। শুধু তার মা-ই যেত না। কোন বাচ্চারা তার সাথে খেলতো না। মীরা অনেক কাঁদত। সেই সময় গুলো মীরা কখনও ভুলতে পারবে না। আর না ওই মানুষটাকে ক্ষমা করতে পারবে। তিক্ত অতীত মনে পড়ায় মীরার কষ্ট হচ্ছে। সে হাতপা ছেড়ে মেঝেতে বসে কাঁদতে লাগল। ছোট চাচীও তার কান্না থামাতে পারল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাকি সবাই নতুন বউকে ছেড়ে মীরার ঘরে হাজির হয়েছে। মীরাকে কাঁদতে দেখে অস্থির হচ্ছে। তার কান্নার কারণ বারবার জিজ্ঞেস করছে। বড় ফুপু মীরার মাথা, মুখে হাত বুলিয়ে বলছে,
“কী হয়েছে আমার মা’টার? কেন কাঁদছে? ও মা বল না। আমাদেরকে কেন টেনশন দিচ্ছিস?”
আবির সবসময় মীরাকে ক্ষেপায়। মজা করে। কিন্তু মীরার একটু মন খারাপ হলেই তার দুনিয়া ভার লাগে।
“ও মীরাবাঈ, কী হয়েছে চাঁদ? কেন কাঁদছিস তুই? কেউ কিছু বলেছে?”
মীরা কারো কোন কথার জবাব দিচ্ছে না। ছোট চাচী আসল কারণ বলার জন্য মুখ খোলার আগেই মীরা বলল,
“আমার নূপুর হারিয়ে গেছে। কোথাও পাচ্ছি না।”
মীরা কেন কাঁদছে এটা জানতে পারলে সবাই ছোট চাচীকে বকবে। ফুপু তো ভীষণ রাগ করবে। তাই মীরা নূপুর হারানোর বাহানা দিয়েছে।
মীরার কান্নার এই সামান্য কারণ শুনে সকলে হতাশ। কিন্তু মেয়েটা এরকম ভাবে কাঁদছে তাই কেউ কিছু বলতে পারল না। ইভান মীরাকে ধরে বিছানায় বসিয়ে আশ্বস্ত করল,
“তোর কতগুলো নূপুর লাগবে? আমাকে বল। আমি তোকে এনে দেব। তবুও এভাবে কাঁদিস না লক্ষী। তুই না ভালো মেয়ে। এভাবে কেঁদেকেটে কেন আমাদের কষ্ট দিচ্ছিস? তুই কাঁদলে আমাদেরও তো কান্না পায়।”
মীরা হেঁচকি তুলতে তুলতে চোখ মুছছে। যতবার চোখ মুছছে ততবারই আবার জল গড়িয়ে পড়ছে। ইভান মীরার চোখ মুছে দিল। মাথার চুল ঠিক করে দিতে দিতে বলল,
“তোর দুইটা ভাই থাকতে তুই কেন একটা নূপুরের জন্য কাঁদছিস পাগলি!”
মীরা নাক টেনে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,
“ওইটাও তুমিই এনে দিয়েছিলে।”
“তাতে কি? আবার এনে দেব। পৃথিবীতে নূপুর আবিস্কারই হয়েছে আমার বোনের সুন্দর সুন্দর দুইটা পায়ের জন্য।”
🌸
মীরা দু-হাত ভরে মেহেদি পরেছে। ইভা আপু, উঁহু ভাবী। এতো সুন্দর করে মেহেদি দিতে পারে মীরার জানা ছিল না। ইভা আপু ইভান ভাইয়ের বউ হয়ে আসার পর থেকে এই বাড়িটা যেন আগের থেকেও সুখী সুখী হয়ে গেছে। তার ভাবী সবকিছু পারে। মীরা ইভার এত গুণ দেখে মুগ্ধ হয়। একটা মানুষ এতটা পারফেক্ট কীভাবে হতে পারে? যেমন রূপবতী তেমনই গুণবতীও। তার হাতের মেহেদি দেখানোর জন্য মীরা সিঁড়ি দিয়ে উড়ে উড়ে নামছে। নিচে নেমেই সে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। কারণ জায়িন ভাই সহ পুরো পরিবার এসেছে। আজ ভাবীর বাড়ির মানুষ আসবে মীরা জানতো । সে অপ্রস্তুত হয়ে হেসে সবাইকে সালাম দিল। সুমনা মীরার হাত দেখে বলল,
“মেহেদি দিয়েছিস?”
“হ্যাঁ ইভা আপু, এই আপু বলার অভ্যাসটা এখনও ছাড়তে পারছে না। ভাবী ডাকতে গিয়েও মুখ দিয়ে আপু চলে আসে।
” ভাবী দিয়ে দিয়েছে।”
ইভার বিয়ের পর জায়িন অনেকদিন বাড়িতে আসেনি। গতকাল রাতে ফিরেছে। আজকে শুনলো সবাই এখানে আসছে। তার মানে আজ পড়া বন্ধ। তার প্রেয়সীকে দেখতে হলে কাল বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। জায়িন এই দীর্ঘ অপেক্ষা করতে পারল না। যাকে দেখার জন্য এসেছে তাকে যতক্ষণ না দেখবে ততক্ষণ অস্থিরতা কমবে না। তাই মা, খালামনি কয়েকবার বলার পরেই এখানে আসতে রাজি হয়ে গেছে। এখানে এসে কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখতে পেয়ে তৃষ্ণার্ত হৃদয় শান্ত হয়েছে।
মীরা ইভাকে ডাকতে চলেই যাচ্ছিল। এর মাঝে আরেকটা কাণ্ড ঘটলো। ফ্লোরে মাহার রাবারের খেলনা হাঁসটা পড়ে ছিল। মীরা ওটার উপর পাড়া দিয়ে স্লিপ খেয়ে সোজা হুমড়ি খেয়ে পড়ল। পড়লো তো পড়লো, সেটাও অন্য কারো উপর না। তার দু’হাতের মেহেদির ছাপ জায়িনের সাদা শার্টে ফোটে আছে। মীরা চোখ তুলে জায়িনকে দেখে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলে আরেকটা অঘটন ঘটালো। সরি বলতে বলতে শার্ট থেকে মেহেদি মুছতে গিয়ে আরও লেপটে দিল। সে ভুলেই গিয়েছিল এটা মেহেদি। যত ধরবে ততই লাগবে।
চলবে_