মন পিঞ্জর পর্ব-২৬+২৭

0
846

#মন_পিঞ্জর
#লেখিকা_আরোহী_নুর
#পর্ব_২৬

আদৃত আঁখিকে একা একটা নদীপাড়ে নিয়ে এসেছে।

আপনি আমাকে এখানে কেনো নিয়ে এলেন?

যাতে আমাদের কথা তৃতীয় কোনো কানে না পৌঁছে।

হুম,বলেন এবার কি লুকোচ্ছেন আপনি সবার কাছ থেকে,আরোহীর আসল সত্যটা আসলে কি?

তবে শুনেন।আজ থেকে ঠিক তিন বছর আগে আমার আর আরোহীর বিয়ে হয়,বিয়ের ব্যাপারে আমি আপনাকে যা বলেছিলাম সব সত্য ছিলো,আমি ওকে বাসর রাতে পরিষ্কার করে বলেছিলাম আমরা আগে একে ওপরকে ভালো করে চেনার এবং বোঝার চেষ্টা করবো একে অপরের পরিপুরকে পরিণত হবো তারপর না হয় স্বামী স্ত্রীর মতো সুন্দর সম্পর্কের শুরু করা নিয়ে ভাবা যাবে,যতোসময় না আরোহী আমাকে নিজের স্বামী রুপে মেনে নিবে ততোসময় আমি ওর উপর নিজের অধিকার খাটাতে যাবো না,আমি ওকে বিয়ের আগেও বলেছিলাম ওর দ্বিতীয় কোনো পছন্দ থাকলে আমায় বলতে আমি না হয় দিদুকে বুঝিয়ে বলে সব ঠিক করে দিবো,যেহেতু আমরা দুজনই দিদুর কারনেই বিয়ের এই সম্পর্কে আবদ্ধ হতে যাচ্ছিলাম তাই ওর ব্যক্তিগত কিছু ব্যাপার আলাদা করে থাকা আমার কাছে বড় কিছু মনে হলো না,আমার অবশ্য এমন কিছু ছিলো না সেটা আমি ওকে পরিষ্কার করে তখন বলে দিয়েছিলাম,তখন ও আমায় বললো ওর ব্যক্তিগত কোনো পছন্দ নেই ও আমাকে বিয়ে করতে চায়,বিয়ের রাতেও আমি ওকে ঠিক একই প্রশ্ন আবার করি তখনও ওর উত্তর মোটেও বদলালো না,আমি কখনো ওর উপর নিজের জোর খাটাতে চাইতাম না ওকে ওর মতোই থাকতে দিতাম,ভালোই কাটছিলো আমাদের দিনগুলো, দুজনের মধ্যে ভালো একটা বন্ধুত্বের সম্পর্কও সৃষ্টি হয়েছিলো,আস্তে আস্তে ওকে নিয়ে আমার মনে আলাদা এক ভালোলাগার অনুভুতি সৃষ্টি হলেও আমি ওকে কখনো তা বুঝতে দেই নি,কখনো ওকে ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে পেতে চাই নি তাই হয়তো,কিন্তু কিছুদিনে আন্দাজ করতে পারলাম ও নিজেও আমাদের সম্পর্ক কে পূর্নতা দান করতে চায়,তারপর একদিন ও আমাকে পরিষ্কারভাবেই বললো ওর আমাকে ভালোলাগে ও আমার সাথে এই সম্পর্ককে এগুতে চায়,ওর ইচ্ছাতেই বিয়ের পাঁচমাস পর আমাদের এই সম্পর্ক পূর্নতা পায়,দুজনই ভালোবাসার এক সম্পর্কে আবদ্ধ হই,তারপর অনেক ভালো কাটছিলো আমাদের দিন,আমি যেনো ওকে ছাড়া কিছুই বুঝতাম না,ও যেনো আমার আত্মার সাথে মিশে গিয়েছিলো,জানি না কিভাবে কিন্তু দিন দিন ওর জন্য আমার ভালোবাসাটা শুধু বেড়েই যাচ্ছিলো,ওর কাছ থেকেও যে আমি আমার ভালোবাসার যথেষ্ট প্রতিদান পেতাম হয়তো তাই।কিন্তু হঠাৎ একদিন, মা-বাবা সায়েদা নোমান আর দিদু আমার নানুর বাসায় বেড়াতে চলে গেলেন আরোহীকে নিতে চাইলেও আরোহী গেলো না বললো ওর ভালো লাগছে না,উনারা বেড়াতে চলে গেলেন সে রাতে আর ফিরলেন না,আমারও হাসপাতালে সেদিন অনেক কাজ ছিলো তাই বলেছিলাম রাতে নাও ফিরতে পারি, কিন্তু সেদিন বেশি রাত হবার আগে কাজ শেষ হয়ে গেলে ভাবলাম বাড়ি গিয়ে ওকে স্যারপ্রাইজ করবো,ওর জন্য সেদিন একটা লাল রঙের শাড়ী আর চুরিও নিয়ে যাই,স্যারপ্রাইজ খারাপ হবার ভয়ে সেদিন কলিংবেল বাজাই নি নিজের কাছে চাবি থাকায় ঘরে ঢুকে গেলাম,সারাবাড়ি অন্ধকার করা ছিলো ঘরে কোনো চাকরকেও দেখতে পেলাম না, তাই আমার মনে আরোহীকে নিয়ে দুশ্চিন্তা কাজ করতে শুরু করে দেয় আমি ছুটে যাই আমাদের রুমের পানে, আমাদের রুমেই তখন আলো জ্বলছিলো, রুম থেকে কারো কথা বলার শব্দও আমার কানে ভেসে এলো আমি এগিয়ে গেলাম, রুমের দরজা অনেকটা ফাঁক করা ছিলো যা দিয়ে ঠিক আমার বিপরীতে চলারত দৃশ্যটা স্পষ্ট আমার চোখে পড়লো,আমারই প্রিয়তমা জড়িয়ে ধরে আছে অন্য পুরুষকে, সে লোকটাও নিজের সাথে আঁকড়ে ধরে ছিলো আরোহীকে,আরোহী তখন কাঁদতে কাঁদতে লোকটির উদ্দেশ্য বলছিলো।

আমি আর পারছি না আদনান, আমি আর পারছি না সে লোকগুলোকে ধোকা দিতে যারা আমায় ভালোবাসে আর আমি তোমাকেও ছাড়তে পারছি না,আমি পারবো না তোমাকে ভুলতে।

তবে আর দেড়ি কিসের,চলো দুজন পালিয়ে যাই।আমিও যে তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছি না আর, চলো না আমার সাথে।

কিন্তু দিদু আমার পরিবার ওদের কি জবাব দিবো? তাছাড়া আদৃত ওর বাচ্চা।

কথাটা শুনে আমি আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না,আমার বাচ্চা কথাটা যেনো এক শিহরন তৈরি করলো আমার শরীরে, আমি দরজা ঠেলে এবার ভিতরে ঢুকে গেলাম,আমাকে দেখে ওরা দুজনই হতভম্ব হলো,কিছুটা অস্বাভাবিকও,ওরা যে তখন আমায় ওখানে একদম আশা করে নি।আরোহীর অবাকত্ব আর ভয়ের পরিমাণ একটু বেশিই ছিলো তা আন্দাজ করতে পারলাম আমি,আরোহী কাঁপা কন্ঠে লোকটিকে বললো।

তুমি যাও আমি ওর সাথে কথা বলছি।

লোকটা চলে গেলো তারপর আরোহী চট করে এসে আমার পায়ে পড়ে গেলো কান্না করতে করতে,আমি কোনো কিছুই বুঝে উটতে পারছিলাম না তখন,ঝটফট ওকে পা থেকে উঠালাম,ও কাঁদতে কাঁদতে অনেকটা হাঁপিয়ে উঠেছিলো তাই ওকে নিয়ে বেডে বসিয়ে পানি খেতে দিলাম,তারপর একটু শান্ত হয়ে ও আমায় বলতে লাগলো ওই ছেলেটার সাথে না কি ওর আমাদের বিয়ের তিন বছর আগ থেকে সম্পর্ক,ছেলেটা ওর সাথে একই ক্লাসে পড়তো।ওখান থেকেই দুজনের প্রেম শুরু,দিদু যখন ওকে বলেন যে ওকে আমাকে বিয়ে করতে হবে তখন ও কি করবে ভেবে পায় না,দিদু ওকে কুড়িয়ে এনে একটা নতুন জীবন, নতুন পরিবার দিয়েছেন, জীবনের সব চাওয়া পাওয়া পূর্ন করেছেন,ওকে মাথায় তুলে রেখেছেন, কখনো ফুলের টোকা অব্দি ওর গায়ে পড়তে দেন নি আর তাই ও দিদুর আর এই পরিবারের ভালোবাসার প্রতিদান দিতে চাইছিলো কিন্তু এভাবে দিতে হবে ও জানতো না,তবে সেদিন না কি আদনানের সাথে কথা বলে অনেক কষ্টে নিজের মনকে মানিয়ে নেয় আমাকে বিয়ে করার জন্য,তারপর আমার সাথে নিজেকে মানিয়ে নেবার চেষ্টায় থাকে,এ ফাঁকে আদনানের সাথেও যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়,কিন্তু কিছুতেই না কি ও আদনানকে ভুলতে পারছিলো না আর আমাকেও মেনে নিতে পারছিলো না,আর তাই ও আমার পাশে আসার চেষ্টা করেছে এটা ভেবে হয়তো আমার সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে গেলে আদনানকে ভুলতে সক্ষম হবে,আমাকে নিজের সাথে মেনে নিতে সক্ষম হবে কিন্তু তারপরও না কি সে ব্যার্থ হয়,ও নাকি আমাকে কখনোই ভালোবাসে নি আর কখনো বাসতেও পারবে না,ও শুধু আদনানকে ভালোবাসে আর ওর সাথেই থাকতে চায়,কথাটা শুনে আমি কি প্রতিক্রিয়া করবো বোধগম্য হচ্ছিলো না আমার,কিন্তু ওর বলা পরের কথাগুলো শুনে আমার মস্তিষ্ক যেনো কাজ করা বন্ধ করে দিলো অল্পতে,ও বললো যে ভুলবশত আমার বাচ্চা ওর গর্ভে চলে এসেছে যা ও রাখতে চায় না,ও আদনানের সাথে নিজের জীবন শুরু করতে চায় যেখানে আমার কোনো অস্তিত্ব ওর চাই না,অতপর আমার কাছেই সবকিছুর সমাধান চাইতে থাকলো,কারন ও জানতো একমাত্র আমি ছাড়া আর কেউ ওকে সাহায্য করতে পারবে না,ও আবারও আমার পায়ে পড়লো সবকিছু ঠিক করে দেওয়ার জন্য,তবে আমি কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না,তবে ওর চোখের জলও যে সয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আমার ছিলো না,অনেক ভালোবাসতাম ওকে,তাই আর কোনোদিক বিবেচনা না করে ওদের সাহায্য করার কথা ভাবলাম,তবে ওকে বলেছিলাম আমাদের বাচ্চাকে না মারতে,ওই নিষ্পাপ প্রাণের তো এখানে কোনো দোষ ছিলো না,আমি ওকে বলেছিলাম কোনোরকম ওকে পৃথিবীর আলো দেখিয়ে দিতে বাকি সব আমি দেখে নিবো কিন্তু ও তা মানতে রাজি হলো না,ওর জীবনে ওর সবকিছুতেই যে ওর আদনানের ছোঁয়াই কাম্য ছিলো,আদনানও না কি এতে সম্মতি দিচ্ছিলো না,তাই আর আমারও কিছু করার থাকলো না, অনেক বোঝানোর পরও মেরে ফেললো ও আমাদের বাচ্চাটাকে,এরপর গর্ভপাতের কারনে খনিক অসুস্থ হয়ে গেলে আমি ওর খেয়াল রাখি কাউকেই কিছু বলি না, তবে সেই সত্যটা একাকিত্বে মেনে নেওয়াটাও সহজ ছিলো না বটে,ও সুস্থ হয়ে উঠলে আমি নিজেই আমাদের ডিভোর্সের সব ব্যবস্থা করি তারপর ডিভোর্স হয়ে গেলে নিজে দাঁড়িয়ে থেকেই ওদের বিয়ে করাই,সাক্ষীটা আমিই ছিলাম,তারপর এক্সিডেন্টের মিথ্যে নাটকটাও আমি করাই,সেদিন আমাদের কারের ভিতর একটা বেনাম লাশ যে আগে থেকেই পুড়া ছিলো তাকে গাড়ির ভিতরে রেখে নিজেরই ভাড়া করা ট্রাক দিয়ে ওকে ধাক্কা লাগাই আর নিজেরই লোক দিয়ে ওতে আগুন ধরাই আর সবার সামনে এভাবে তুলে ধরি যে এটা আরোহী ছিলো যে এক্সিডেন্টে মারা গেছে,তারপর মিথ্যে ডিএনএ রিপোর্টের ব্যবস্থাও আমি করাই,কারন পুলিস লাশ শনাক্ত করনের জন্য ঘর থেকে আরোহীর চিরুনি, টুট ব্রাশ,আরও ব্যবহার্য কিছু জিনিস নিয়েছিলো,স্বাভাবিকভাবেই লাশটার সাথে ডিএনএ মেচ হয় নি তবে তা পুলিশের হাতে পৌঁছার আগে বদলে দেই আমি,সব কিছু ক্লিয়ার করে ওকে আর আদনানকে সবাই থেকে অনেক দূরে কোথাও চলে যেতে বলি।সেদিন আরোহী আমাকে শুকনো মুখে শুধু একটা কথাই বলেছিলো ধন্যবাদ, তারপর আর ফিরেও তাকায় নি,হয়তো অনেক অনেক ভালো আছে সুখে আছে ভালোবাসার মানুষটির সাথে।আমার শুধু একটাই আক্ষেপ রয়ে গেলো…. যে এখানে আমার আর আমার বাচ্চার কি দোষ ছিলো?কেনো আমাদের সাজা পেতে হলো?

নদীর পানে ধ্যানরত দৃষ্টি অটল রেখে কথাগুলো বলে গেলো আদৃত,এদিকে আদৃতের কথাগুলো শুনে আঁখি এখন নিজেই বাকরুদ্ধ হয়ে আছে, চোখ বেয়ে উপছে পড়তে শুরু হয়েছে ওর কিছু জল,একটা মানুষ কি করে একা এতো কিছু করে যেতে সক্ষম হতে পারে,এমনটা কি আদোও সম্ভব, আদৃত এবার আঁখির দিকে এগিয়ে এসে ওর হাতের এলবামটা দেখিয়ে বললো।
এই যে আপনার হাতের এলবাম এটা ওর আর আদনানের সুন্দর মুহুর্তের কিছু স্মৃতি, ওগুলা দেখিয়ে আরোহী আমাকে বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয় যে ও আদনানের সাথে কতোটা গভীর সম্পর্কে চলে গেছে কারন উক্ত বিষয় যে আমার বেহায়া মন মেনে নিতে মোটেও সমর্থ্য ছিলো না।এই যে এই রিপোর্ট এই এলবাম এগুলা আমি নিজের কাছে কেনো রেখেছি জানেন যাতে আমি নিজের বেহায়া মনকে বিশ্বাস করাতে পারি যে আরোহী কখনো আমার ছিলো না আর কখনো আমার হবেও না,ও অন্য কারো,ওর কোনোকিছুতেই আমার অস্তিত্ব খোঁজা শুধুই বোকামি,ওগুলা আরোহীর প্রতিরক্ষার জন্যও রেখেছি কারন এই বেহায়া মন এখনও বার বার আরোহীর নামেই ছুটে যেতে চায় আর আমি চাই না আমার জন্য ওর চোখে আবারও জল আসুক।
আদৃতের চোখ বেয়ে জল উপচে পড়ার উপক্রম হলো যা বইতে দিতে নারাজ হলো সে,তাই নিজেকে স্বাভাবিক করে এবার গম্ভীর কন্ঠে বললো।

আশা করি কথাটা আপনি আর কাউকে জানাবেন না,আপনাকে বিশ্বাস করি আর আমি জানি আপনি আমার বিশ্বাস কখনো ভাঙবেন না।

অতপর আদৃত আঁখির হাত থেকে প্রমাণগুলো নিয়ে স্থান ত্যাগ করে,আঁখি এখনও যেনো নিজের কানে বিশ্বাস করতে সক্ষম হতে পারলো না,ঠায় দাঁড়িয়ে আছে আদৃতের পানে দৃষ্টি অটল রেখে।
___________________

রাত ১২ টা বাজে আয়ানের এদিকে সব কিছুতে ফাঁকা লাগতে শুরু হয়েছে,সব কিছু যেনো হাহাকারে পূর্নতা পেয়েছে ওর,চারপাশে শুন্যতা বিরাজমান,সব সুখ থাকা সত্বেও আজ নিজেকে নিঃস্ব লাগছে ওর,বার বার কানে বেজে উঠছে আঁখির বলা কথাগুলো,আঁখি বিয়ে করে ফেলেছে সত্যটা মানতে কেনো এতো কষ্ট হচ্ছে ওর জানা নেই,এদিকে ওর না খেতে ভালো লাগছে না ঘুমোতে,ওর বেহায়া মন যেনো সবকিছুতে আঁখির ছোঁয়াই পেতে চাইছে এবার,আনমনে ভাবছে আঁখিকে নিয়ে অনেক কথা তখন মাহি কিছু পেপারস নিয়ে ওর সামনে প্রকট হলো।

আয়ান এগুলাতে সাইন করে দাও।

এগুলা কিসের পেপারস।

ওই আসলে ভার্সিটির কিছু ইমপোর্টেন্ট পেপারস যেখানে অভিভাবকের সাইন চাই তাই এগুলাতে সাইন করে দাও।

হুম বলো কোথায় করতে হবে?

এই তো এখানে, হুম তারপর এখানে
হুম এখানে……….এই তো হয়ে গেছে।

সাইন করার সাথে সাথে মাহি পেপারসগুলো টান দিয়ে নিয়ে নিলো তারপর মুখে রাজ্য জয় করা হাসি নিয়ে স্থান ত্যাগ করলো,আয়ানের মাহির উপর বিষয়টা নিয়ে একটু সন্দেহ হলেও পরক্ষণেই তা একসাইড করে আবারও আঁখির চিন্তায় মগ্ন হয়।

আঁখি শুয়ে আছে সোফাতে,আদৃত বেলকোনির দোলনায় বসে চাঁদ দেখতে মশগুল , তবে ঘুম নেই আঁখির চোখে, মেনে নিতে পারছে না আদৃতের বলা চরম সত্যগুলো, লোকটা ভালো জানতো আঁখি তবে এতোটা ভালো কখনো কল্পনায়ও ভাবে নি,আজকে আদৃতের জন্য আঁখির মনে থাকা সম্মানের পরিমাণটা যে আরও হাজারগুণ বেড়ে গেছে,অনেক খারাপ লাগছে আঁখির আদৃতের জন্য,হয়তো ওদের দুজনেরই গল্প কিছুটা একইরকম তাই আদৃতের কষ্টটাও অনুভব করতে সক্ষম হচ্ছে আঁখির হৃদয়,আঁখি এবার উঠে গেলো, তারপর পিলুপায়ে এগিয়ে গেলো আদৃতের পানে ওর পাশে গিয়ে বসলো এবার সহানুভূতিময় হাত কাঁদে রাখলো আদৃতের তৎক্ষনাৎ আদৃত ফিরে গিয়ে ঝাপটে ধরলো আঁখিকে তারপর কান্নায় ভেঙে পড়লো।

চলবে…………….

#মন_পিঞ্জর
#লেখিকা_আরোহী_নুর
#পর্ব_২৭

আদৃত নিজের আবেগ আর ধমিয়ে সক্ষম হতে না পারায় অতি আবেগের বশে আঁখিকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েছে, কান্নার সাথে বেড়িয়ে আসছে ওর মন পিঞ্জরের ভিতর লুকিয়ে থাকা সকল বেদনাদায়ক অনুভুতিও।

কেনো আঁখি কেনো ও এমন করলো,কি দোষ ছিলো আমার?কি দোষ ছিলো আমার সন্তানের?আমি তো ওকে বিয়ের আগেই বলেছিলাম আমি সব ঠিক করে দিবো আমাকে সবকিছু বলে দিতে তবে কেনো ও এমনটা করলো?কেনো আমাকে ব্যবহার করলো?কেনো করলো আমার মন নিয়ে খেলা?কেনো শিখালো আমায় ভালোবাসতে?এমনকি আমায় মিথ্যে বলতেও শিখিয়ে দিলো, ভাবিনি এতো মিথ্যেও আমায় বলতে হবে কখনো,ওর জন্য তো সব করলাম তবে ও কেনো আমাকে ঠকালো?কেনো?আমি যে আর পারছি না এসব মানিয়ে নিতে।

আদৃতের হঠাৎ এভাবে জড়িয়ে ধরায় একপ্রকার হতবম্ভ হয় আঁখি,মনের ভিতর আচমকা এক অনুভুতি খেলা করে উঠে খনিকে,কিন্তু পরক্ষণেই আঁখি নিজেকে স্বাভাবিক করে আদৃতকে সহানুভূতিময় হাতে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয়,অনুভব করতে পারে আদৃতের ব্যাথা,এগুলো যে ওর ভিতর চলা ব্যাথারই সমতুল্য তাই ওর থেকে বেশি আদৃতের এই ব্যাথা আর দ্বিতীয় কেউ অনুভব করতে পারবে বলে আঁখির মনে হয় না,আঁখি এবার আদৃতকে সহানুভূতিময় স্পর্শে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো।

সত্য ভালোবাসার অনুভুতিগুলো যে এমনই হয় ড.আদৃত মানুষকে অসাধ্যও সাধন করার ক্ষমতা দিয়ে দেয়,হয়তো আমরা যারা সত্য ভালোবাসতে জানি তাদেরই প্রতিদানে ঠকতে হয়,আঘাতের সম্মুখীন হতে হয়। স্বার্থপরদের জন্য জীবনে শুণ্যতা অনুভব করে বেঁছে থাকা শুধুই অনর্থক এর থেকে বেশি কিছু না,প্লিজ আপনি এভাবে ভেঙে পড়বেন না নিজেকে সামলান,আপনার সামনে যে সুন্দর ভবিষ্যত হাতছানি দিয়ে ডাকছে পিছুটানে পড়ে থাকা আপনাকে মানায় না ড.আদৃত।আপনিই তো আমাকে সাহস জোটালেন সংগ্রাম করে বেঁছে থাকার সত্যের সম্মুখীন হওয়ার আর নিজের বেলায় আপনি পিছু হাটছেন।

আদৃত এবার কিছুটা স্বাভাবিক হলে আঁখিকে ছেড়ে দিলো,তারপর চোখের জল মুছে মৃদ্যু স্বরে একটা কথাই বললো।
আমি দুঃখীত আসলে অতি আবেগে নিজের গতি হারিয়ে ফেলেছিলাম।কিছু মনে করবেন না

আদৃত আর বসলো না সেখানে,উঠে চলে গেলো রুমে।

আদৃত ঘুমিয়ে পড়েছে অনেক আগেই আঁখির চোখে নিদ্রার ছোঁয়া এখনও নেই,সোফাতে বসারত অবস্থায় তাকিয়ে আছে একধ্যানে আদৃতের পানে, আজ আঁখির আঁখিযোগল যেনো বড়ই বাধনছাঁড়া হয়ে পড়েছে- আদৃতের উপর থেকে সরতেই চাইছে না,মন পিঞ্জর জুড়ে চলছে কিছু অনুভবের খেলা যা শুধু আদৃতকে নিয়েই, সেই অনুভুতির মধ্যে কিছু আছে আদৃতের জন্য খারাপ লাগা আর কিছু অনুভুতি এমনও আছে যার মানে আঁখির মন পিঞ্জরখানি উপস্থিত মুহুর্তে বুঝতে ব্যার্থ,ঘুমন্ত অবস্থায় আদৃতকে বড্ড মায়াবী আর নিষ্পাপ লাগছে আঁখির যতোটা হয়তো কখনো আয়ানকেও লাগে নি,আসলে ভালো মানুষদের মুখের মায়া হয়তো আলাদাই থাকে,আঁখির বড্ড লোভ হলো আজ,মন টা যেনো আজ ডেকে ডেকে বলছে ওকে, সেই আট বছর আগে যদি আঁখির সাক্ষাৎ আয়ানের বদলে আদৃতের সাথে হতো তবে হয়তো আজ আদৃত আর আঁখি দুজনেরই জীবন ঘুছানো থাকতো,এসব ভাবনার মধ্যেই কখন আঁখি ঘুমিয়ে গেছে ওর নিজেরও তা জানা নেই।
__________________

আয়ান ভেবে নিয়েছে আঁখি সত্যিই আদৃতের স্ত্রী কি না সেটার খোঁজ ও লাগাবেই, তাই সে উদ্দেশ্য সকাল থেকেই লেগে পড়েছে।নিজের কিছু লোক আঁখি আদৃতের পিছু লাগিয়ে দিয়েছে, এদিকে নিজেও লাগবে সেটাও ভেবে নিয়েছে।

সকাল সকাল উঠে আদৃত হতভম্ব, যেখানে যেখানে আরোহীর ছবি ছিলো কোথাও আর সেগুলো নেই,এমনকি আরোহীর যে জিনিসগুলো আদৃত নিজের কাছে রেখেছিলো কোনো কিছুই নেই,এদিকে আমাদের আঁখি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে আপন মনে আর গুনগুন করে গান করছে,আদৃত এবার ভ্রুযোগল কুঁচকালো ওর পানে আর বললো।

আরোহীর ছবি আর জিনিসগুলো কোথায়?হঠাৎ করে সবগুলো উদাও কি করে হলো?আমার যতটুকু মনে হয় আপনি জানেন, বলেন আমায় ওগুলো কোথায়?

আঁখি এবার হাসতে হাসতে বললো।

আমি জানি মানে আলবাদ জানি, বেলকোনি দিয়ে নিচে উকি দেন,বাগানের এক কোন থেকে ওগুলার ধোঁয়া উঠা ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাবেন।

আদৃত সত্যি সত্যি এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেলো বাগানের এক কোনে কিছু জ্বলার পর ধোয়া উঠা ধ্বংসাবশেষ দেখা যাচ্ছে।

এসব কি মিস আঁখি?

আর কি যেগুলো আপনি খুঁজছেন।

হোয়াট?আপনার সাহস কি করে হলো আমাকে না বলে ওগুলো জ্বালিয়ে দেবার।

আঁখি টেডি স্মাইল করে বললো।
আঁখির সাহস সম্পর্কে এখনও কোনো উপযুক্ত ধারনা আপনার নেই ড.আদৃত।তবে আরোহীর সাহস কি করে হয় আপনাকে না বলে আপনার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার?ওকে তো কিছু বলেন নি,বরং ওকে বুকের সাথে টাঙিয়ে নিয়ে এখনও ঘুরছেন,শুনের ড.আদৃত কারো চলে যাওয়াতে জীবন থেমে যায় না সেটা আমি আপনাকে আগেই বলেছিলাম,আর আরোহীতো আপনাকে নিজের স্বার্থের জন্য ছুঁড়ে ফেলে গেছে তাই ওর স্মৃতি নিয়ে বেঁছে থাকা বোকামি ছাড়া অন্য কিছুই হতে পারে না,আর আপনাকে বোকামি শোভা দেয় না ড.আদৃত,আপনি জ্ঞানী একজন মানুষ,আমাকে শক্ত হবার সাহসটা জুটিয়ে আপনি নিজে দুর্বলতা আকঁড়ে ধরে বাঁচতে চান জিনিসটা আমি মেটেও মেনে নিতে পারলাম না,তাই যেটা আপনি করতে পারেন নি আমি করে দিলাম,আঁখি কখনো কারো ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাতে যায় না তবে যেখানে নাক না গলালে হয় না সেখানে আঁখি পিছুও হাটে না।

খুব সুন্দর বলে দিলেন না আরোহীকে ভুলে যেতে,সামনে এগিয়ে যেতে,আপনি পেরেছেন আয়ানকে ভুলে যেতে?পারবেন কখনো?

হয়তো ওকে কখনো আমি ভুলতে পারবো না কিন্তু তাই বলে এই নয় ওর পথ চেয়ে বসে থাকবো,এটা হতে পারে আমি এখনও ওকে ভুলে যেতে পারি নি,মনের কোনো কোনে এখনও ওর জন্য ভালোবাসাটা লুকিয়ে আছে তাই বলে এই নয় আমি ওর ছবি বুকের সাথে লাগিয়ে বসে রয়েছি,ওর কোনো স্মৃতি আমি নিজের কাছে রাখি নি আর যে স্মৃতিগুলো মনে আছে সেগুলোও মুছার জন্য দিন রাত নিজের সাথে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি আর সেটাতে জয় আমি একদিন করবোই।ভালোবাসি বলে আমরা সেই বিশ্বাসঘাতকদের পথ চেয়ে বসে থাকলে তো আর হবে না,ওরা যখন নিজেদের সুখটা বেঁছে নিয়েছে আমাদেরও যথেষ্ট অধিকার আছে ভালো থাকার,নিজেদের সুখ বেঁচে নেওয়ার,আমি চেষ্টায় আছি আশা করি আপনিও চেষ্টাটা করবেন।
______________________

আয়ান হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রেডি হয়ে বের হবে তখনি একটা লোক আসে একটা পার্সেল হাতে,ওটার উপরে মাহির নাম লিখা,আয়ান ওটা নিয়ে নেয়,কৌতুহলবশত পার্সেলটা খুলে নেয় যার ভিতর থেকে বেড়িয়ে আসে একটা রিপোর্ট, যেখানে ক্লিয়ারলি লিখা মাহির প্রেগন্যান্সি টেস্ট পজিটিভ ,এক মুহুর্তের জন্য আয়ান মনের সমস্ত অশান্ত ভাব,ব্যাথার্থ অনুভুতি সব ভুলে যায়,বাবা হবার খুশিটা আঁকড়ে ধরে ওকে,খুশিরত ভঙ্গিতে মাহিকে চিৎকার করে ডাকতে শুরু করে পরক্ষণেই,মাহি অল্প বিরক্তি নিয়ে নেমে আসে নিচে।

কি হয়েছে? এতো চেঁচাচ্ছো কেনো?

মাহি,তুমি জানো কতো বড় গুড নিউজ এসেছে?এই দেখো রিপোর্টস,পজিটিভ এসেছে,আমরা বাবা-মা হতে চলেছি।

আয়ান অতিরিক্ত খুশিতে মাহিকে কোলে নিয়ে ঘুরাতে ঘুরাতে কথাগুলো বললে এবার মাহির প্রতিক্রিয়া ঠিক আয়ানের প্রতিক্রিয়ার উল্টোটা হলো।

কি বাচ্চামো শুরু করেছো আয়ান?প্রথমত নামাও আমায়,আর দ্বিতীয় আমি বর্তমানে এই বেবিকে নেওয়ার কথা ভাবছি না,এতো অল্প বয়সে মা হবার কথা ভাবতেও পারি না আমি,তাছাড়া আমার ফিগারের কি হবে?নো ওয়ে,আর এসব বাচ্চা টাচ্চা আমার পছন্দ না,তাই আমি এবোর্ট করবো।তাছাড়া এটা শুধু ভুলবশত এসেছে আর একটা ভুলের জন্য আমি নিজের লাইফ নষ্ট করতে পারি না।

কথাটা শুনে আয়ান আশ্চর্যের শেষ সীমায় চলে গেলো,ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো এবার।

আর ইউ সিরিয়াস,এবোর্ট করবে তুমি?আমাদের বাচ্চাকে তুমি মেরে ফেলবে,ঠোঁট কাঁপলো না তোমার কথাটা বলতে? নিজের ভিতর একটা সুন্দর প্রাণ বেড়ে উঠছে ওকে অনুভব করার বদলে ওকে মেরে দিতে চাইছো তোমার ওই লোক দেখানো আধুনিকতার ছোঁয়ায়।

হাউ ডেয়ার ইউ টু টক টু মি লাইক দিস?বেবি রাখা না রাখা সেটা শুধুই আমার ডিসিশন হবে, আমি কখনো নিজের লাইফে কারো ডিসিশন এলাও করি নি আর এখনও করবো না,তাই তুমি আমায় ওই সব বেচারি সংসারী মেয়েদের মতো ট্রিট করতে এসো না,মাহি রিপোর্টটা নিয়ে হন হনিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো কথাগুলো বলে।আয়ান অসহায়ের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলো।

তাজবীর আজও এসেছে আঁখিকে দেখতে, আজও কলিংবেল বাজতেই সায়েদার দূর্ভাগ্যবশত দরজাটা ওই খুললো আর সেদিনকার মতো আজকেও তাজবীর সায়েদাকে বাচ্চা বলে ব্যাঙ্গ করলো,যাতে সায়েদা আজ একটু বেশিই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো,তাজবীর কি ওকেই পায় শুধু ব্যাঙ্গ করার জন্য?তাই আজ সায়েদা অতিরিক্ত রাগে মনে মনে একটা প্রতিশোধ স্পৃহা তৈরী করে নেয়।

তাজবীরের একটা ফোন আসলে ও বাগানের দিকে যায় একাকিত্বে কিছু কথা বলার সুযোগের খোঁজে, ওখানে বেশ কিছু অংশ মাটি খুড়া হয়েছিলো চারাগাছ লাগানোর সুবিধার্থে যা বৃষ্টির ফলস্বরূপ কাঁদায় পরিনত হয়েছে,সেই কাদার থেকে অল্প দূরত্বে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো তাজবীর তখনি সুযোগ বুঝে সায়েদা ওকে ধাক্কা মেরে কাঁদায় ফেলে ব্যাঙ্গ করতে চায় কিন্তু সেটাও করতে ব্যার্থ হয় সায়েদা, তাজবীর মুহুর্তটা আন্দাজ করতে পেরে সরে যার সাথে সাথেই, যার ফলস্বরূপ সায়েদা মুখ থুবড়ে পড়ে কাঁদায়, এদিকে সায়েদার হাল দেখে তাজবীর হাসতে হাসতে নেই।

হা হা হা হা,ও মাগো এ দেখি কাঁদা পরি,হা হা হা,আরে বাচ্চা তোমাকে তো কাঁদায় ভালোই মানাচ্ছে,আর মানাবেই না কেনো বাচ্চারা তো কাঁদায় খেলবেই,কিন্তু কখনো এতো বড় ধাঙড় বাচ্চা দেখবো তাও কাঁদা নিয়ে খেলতে কখনো ভাবি নি।হা হা হা

ইউ।

সায়েদা এদিকে অতিরিক্ত রাগে কোনোদিন না ভেবেই উঠে এসে তাজবীরকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে দেয় যাতে তাজবীর ব্যালেন্স সামলাতে না পেরে পিছনে ঠাস করে পরে যায়,এবার সায়েদা হাসতে শুরু করে তাজবীর পরে গেছে দেখে ওকে ব্যাঙ্গ করে,কিন্তু খনিকে ওর হাসি মলিনতা পূর্ন হয় কারন পড়ে যাওয়ার পর তাজবীরের আর কোনো হেলদোল পাওয়া যাচ্ছে না,যেভাবে পড়ে ছিলো সেভাবেই পড়ে আছে,সায়েদার মনে অল্পতে হালকা ভয় কাজ করতে শুরু করলো এবার।

চলবে…………..