মন পিঞ্জর পর্ব-৪৪

0
698

#মন_পিঞ্জর
#লেখিকা_আরোহী_নুর
#পর্ব_৪৪

তাজবীর নিজের কেবিনে বসে ছিলো তখনি ওর একজন কর্মচারী ওকে একটা খাম দিয়ে যায়।

স্যার এই খামটা একটা লোক এসে দিয়ে গেলো বললো আপনাকে দিতে।কোনো এক সায়েদা নামের কেউ আপনার জন্য পাঠিয়েছেন।

তাজবীর সায়েদার নাম শুনে খামটা হাতে নিলো,দেখলো উপরে সায়েদা লিখা,তাজবীর হাতের ইশারায় ওর কর্মচারীকে যেতে বললো।

এবার আবার কি ঢং শুরু করেছে,তাজবীর খামটা ডাস্টবিনে ফেলে দিতে চাইলেও পরক্ষণেই ফেলতে চাইলো না,বরং খনিক কৌতুহল নিয়ে খামটা খুলতে লাগলো।ওটাতে একটা চিঠি পেলো,তাজবীর চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করলো।

তাজবীর,

হয়তো চিঠিটা তোমার হাতে পৌঁছানোর আগেই আমি তোমার থেকে অনেক দূরে চলে যাবো,কি করবো, পারলাম না যে আর নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে, আমি যে কোনো ভুল করি নি পাপ করেছি,যার জন্য হয়তো পরম করুনাময় মহান রাব্বুল আলামিনও আমায় ক্ষমা করবেন না আর তুমি তো একজন মানুষ মাত্র,তবুও তুমি আমায় ক্ষমা করে দিলেও নিজের জীবনে আর আমায় ভরে নিবে না আমি জানি,কিভাবেই নিবে ছলনাময়ীদের যে কেউ বিশ্বাস করতে চায় না দ্বিতীয়বার,আর তোমাকে ছাড়া যে এই পাপী ছলনাময়ী মেয়েটা বেঁচেও থাকতে পারবে না আর,নিজের থেকে যে বড্ড বেশি ভালো তোমাকে বেসে ফেলেছে ওর বেহায়া মন পিঞ্জর ,কখনো বুঝতে সক্ষম হই নি যে আমি এই ছলনা তোমার সাথে না নিজের সাথেই করছি,কি করবো বলো মানুষ নির্বোধ হলেই হয়তো এমনটা করে,জানি এই পাপের আর কোনো ক্ষমা নেই,তাই আর পারলাম না এই পাপ মাথায় নিয়ে বেঁচে থাকতে,চলে যাচ্ছি তোমার থেকে অনেক দূরে আর আসবো না জ্বালাতে তোমায় ,তোমাকে ছাড়া তিল তিল করে মরার থেকে একেবারে মরে যাওয়া সহজ মনে হলো আমার কাছে, ভালো থেকো।আর পারলো ক্ষমা করো আমায়।

সায়েদা………….

কথাগুলো পড়ে মনে অল্প ভয় কাজ করলো তাজবীরের কিন্তু পরক্ষণেই তা বিশ্বাস করতে নারাজ হলো।

সায়েদা আবার কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেললো না তো?আরে না না কারো জন্য জীবন দেওয়া কি এতো সহজ,সায়েদা এমনটা কিছুতেই করবে না,আমার জন্য তো একদমই না,হয়তো এটাও ওর নতুন কোনো ফন্দি, আমার মিটিং আছে এসবে মন দিলে হবে না আমার।

তাজবীর চিঠিটা ডাস্টবিনে ফেলে চলে গেলো মিটিং এ,দীর্ঘ ২ ঘন্টা পর মিটিং শেষে আবার কেবিনে আসলো,তবে ওর মন কিছুতেই শান্ত হতে পারছে না,মিটিংটাতেও ভালো ভাবে মন বসাতে পারে নি বার বার মনে হয়েছে যদি সায়েদা সত্যিই কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলে,এবার মনের অশান্ত ভাববে কিছুটা শান্ত করতে তাজবীর আঁখিকে ফোন করলো,তারপর আঁখির বলা কথা শুনে তাজবীর আর নিজের জায়গায় স্থির হয়ে থাকতে পারলো না ছুঁটে গেলো বাইরের দিকে।

তাজবীর হতভম্ব হয়ে হাসপাতালে প্রবেশ করলো, চৌধুরী পরিবারের সবাই আছেন সেখানে,সবার মুখে কান্নার ছাঁপ স্পষ্ট ভেসে আছে,তাজবীরের মনটা যেনো খক করে উঠলো নিমিষেই সবার হাল দেখে,একটু দূরে একটা বেঞ্চে বসে আছে আদৃত,পাশেই আঁখি বসে,ওদের বসার ভঙ্গিতে তাজবীর আন্দাজ করতে পারছে আঁখি আদৃতকে সহানুভূতি দিচ্ছে কারন আদৃতের মনের হাল ভালো নয়,আদৃতের মুখের দিকে তাকিয়ে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে কান্না করছিলো ও তখন,তাজবীর এবার এগিয়ে গিয়ে কাঁপা কন্ঠে আঁখিকে জিজ্ঞেস করলো।

সায়েদা কোথায় আঁখি?তুই না বললি ও সুইসাইড……

আর বলতে পারলো না তাজবীর,মুখটা যে কেঁপে উঠলো ওর কথাটা বলতে গিয়ে,আঁখি এবার আদৃতকে শান্ত হয়ে বসতে বলে তাজবীরকে নিয়ে এলো একটা কেবিনের সামনে,তারপর কেবিনের গ্লাস দিয়ে সায়েদাকে দেখালো,আঁখির চোখে মুখেও কান্নার ছাঁপ স্পষ্ট, তাজবীর এবার গ্লাসের পানে তাকিয়ে দেখলো আইসিইউ রুমের বেডে শান্ত রুপে শুয়ে আছে সায়েদা,মুখে অক্সিজেন লাগানো, হাতে রক্ত চলছে।কেমন নিস্তব্ধ হয়ে পরে আছে সে।মনটা অস্থিরতায় ভরে উঠলো এতে তাজবীরের।

তাজবীর প্রশ্নময় ভঙ্গিতে আঁখির পানে তাকালে আঁখি কান্নারত অবস্থায় বললো।

ওকে নিজের কক্ষে রক্তাক্ত অবস্থায় পরে থাকতে পাই ভাইয়া,নিজের পেটে নিজেই ছুরি আঘাত করেছে পরপর তারপর নিজের হাতটাও কেটেছে,ওর সারা রুমে যে ওর রক্তের ছড়াছড়ি ছিলো তখন,আমরা কোনোরকম ওকে এখানে নিয়ে আসি,দীর্ঘক্ষন ওর চিকিৎসার পর ওকে এবার আইসিইউ তে শিফ্ট করা হয়েছে,২৪ ঘন্টার মধ্যে ওর জ্ঞান না ফিরলে নাকি ওকে বাঁচানো যাবে না।

কথাটা শুনার পর তাজবীরের মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো,চোখ দিয়ে নিজের অজান্তেই জল নেমে এলো,কখনো ভাবে নি সায়েদা সত্যিই ওকে এতোটা ভালোবাসে যে ওর জন্য নিজের জীবন দিয়ে দিতে চাইবে,এবার নিজেকে দোষারোপ করতে শুরু করে ও,ওর আচরনে কিছুটা অস্বাভাবিকতা ধরা দেয়,পাগলের মতো বলতে লাগে।

এ আমি কি করলাম?আজ আমার জন্য ও মরতে বসলো,বার বার বলছিলো ওকে ক্ষমা করে দিতে,ওকে একটা সুযোগ দিতে ও আমাকে ছাড়া বাঁচবে না কিন্তু আমি ওর একটা কথাও শুনি নি,কি হয়ে যেতো ওকে একটা সুযোগ দিয়ে দিলে,আজ হয়তো ওকে এভাবে ওখানে পরে থাকতে হতো না।

তাজবীরের কথাগুলো শুনে হতভম্ব আঁখি,সাথে সেখানে উপস্থিত সবাইও,তাজবীর যে কথাগুলো খনিক জোরেই বলতে শুরু করেছিলো।

তারপর সবাই প্রশ্নের পর প্রশ্ন করলে তাজবীর সবাইকে সবটা খুলে বলে,কথাগুলো শুনে সবার বিরহের পরিমাণ আরও বেঁড়ে যায়। দুশ্চিন্তা আর চোখের জ্বলের পরিমান সময়ের সাথে বেঁড়েই চলেছে সবার।

আদৃত এখনও বেঞ্চে বসে আছে,আবারও আঁখি এসে পাশে বসলো ওর,তারপর ওর কাঁধে সহানুভূতির হাত রাখলে ওকে চট করে জড়িয়ে ধরে আদৃত,চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরছে ওর জল,ব্যাথার্থ কন্ঠে বলছে আঁখিকে।

আঁখি,সায়েদা আমাদের একমাত্র বোন,ওকে কখনো ফুলের টোকাও লাগতে দেই নি আমরা,আর আজ ও ওভাবে চোখের সামনে মরণের সাথে লড়াই করছে,আমি যে তা মেনে নিতে পারছি না,লোক বলে ডাক্তারেরা না কি প্রাণ বাঁচায়,কিন্তু কেউ জানে না ডাক্তারেরাও অসহায় হয়,ওরা তো শুধু চেষ্টা করে প্রাণ বাঁচানো তো উপরওয়ালার হাতে,তবে কি উনি আমার সায়েদাকে বাঁচাবেন না,আমার কলিজার টুকরোকে কেঁড়ে নিবেন।

আঁখি এবার আদৃতকে নিজে থেকে ছাঁড়িয়ে ওর চোখের জল মুছে দিলো আলতো হাতে,তারপর ওর দুই গালে ভালোবাসাময় স্পর্শে দুই হাত রেখে বললো।

আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন,উনার উপর আপনার বিশ্বাস আমাকেও মরার ঘাট থেকে ফিরিয়ে এনেছে,তবে সায়েদারও কিছু হবে না,আল্লাহ এতোটা লোককে খালি হাতে তো ফিরাতে পারেন না,আপনি চিন্তা করবেন না,আপনার জন্য বর্তমানে দুঃশ্চিন্তা করা একদম ঠিক না,দেখবেন আমাদের সায়েদা একদম ঠিক হয়ে যাবে।

সবাই নামাযের রুমে একে একে নামায পরে সায়েদার জন্য দোয়া করছেন,তাজবীরও এইমাত্র নামায পরে মোনাজাতে সায়েদাকে ভিক্ষা চাইলো আল্লাহর কাছে হাত পেতে।অনেক কান্নাও করলো,এবার ওর কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে কাঁচ দিয়ে দেখছে সায়েদাকে।

আমাকে ক্ষমা করে দাও সায়েদা,তুমি আমাকে এতো ভালোবাসো জানলে কখনো তোমাকে ফিরিয়ে দিতাম না,অভিমান করে চলে যেও না প্লিজ,তোমার সাথে রাগ করে থাকলেও তোমাকে নিয়ে মনে ঘৃণা কখনোই আনতে পারি নি আমি,বড্ড ভালো যে বেসেছি আমি তোমায়,হারিয়ে গেলে যে সইতে পারবো না,প্লিজ ফিরে এসো।

পুরে এক দিন পর জ্ঞান আসে সায়েদার,যখন খেয়ালে যায় ও বেঁচে আছে তখন প্রায় অচেতন অবস্থায়ই উত্তেজিত হয়ে নিজেকে শেষ করে দেবার আবারও চেষ্টা করে,মুখ দিয়ে ধিমি কন্ঠে শুধু একটা কথা বলছে আমি বাঁচতে চাই না,কিন্তু তখন আদৃত নোমান দুজনই ওর কাছে থাকায় ওকে ইনজেকশন দিয়ে অজ্ঞান করে দেয়,ওকে এবার আইসিইউ থেকে কেবিনে শিফ্ট করা হয়,যেহেতু ও অস্বাভাবিক বিহেইব করছে তাই ও বেঁচে গেলেও দুঃশ্চিতা এখনও কারো মন থেকে এক চুলও সরে নি,অবশেষে তাজবীরকে ওর পাশে পাঠানো হলো,হয়তো জ্ঞান ফিরে ওকে দেখলে একটু স্বাভাবিক বিহেইব করবে।

তাজবীর বসে ছিলো সায়েদার পাশে হঠাৎ সায়েদার জ্ঞান ফিরলো,আলতো করে চোখ খোলে তাজবীরের চেহারা দেখলে মুখে মৃদ্যু হাসি ফুঁটিয়ে চট করে উঠে যেতে নিলো কিন্তু পারলো না,বরং ব্যাথা পেতে গেলে তাজবীর ওকে আটকে নিলো,ওকে ভালো করে শুইয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগলো।

একদম উঠবে না,আমি আছি তো তোমার কাছে,কেনো এমন পাগলামি করলে বলো?

তোমার ভালোবাসা যে পাগল করে দিয়েছে আমায়,অনেক কষ্টে কন্ঠস্বর টেনে বললো সায়েদা।

তাজবীর এবার এগিয়ে গিয়ে ওর কপালে নিজের অধর ছুঁয়ালো,এতে সায়েদার মনে প্রাপ্তির খুশি ঝলকে উঠলো,সায়েদা আবারও মৃদ্যু স্বরে বললো।

আমাকে ক্ষমা করে দাও তাজবীর,আমি আর কখনো এমন করবো না,প্লিজ ক্ষমা করো।

তাজবীর এবার নিজের পকেট থেকে সেদিনের সেই ডায়মন্ডের আঁটিটা বের করে সায়েদার অনামিকা আঙুলে পরিয়ে দিলো,তারপর বললো।

তোমাকে আর কোনো ভুল যে আমিই করতে দিবো না,আবদ্ধ করে নিলাম আজ নিজের মনের বন্ধনে তোমায়।খুব জলদি আমার অর্ধাঙ্গিনী করে নিয়ে আসবো আমার জীবনেও।

তুমি আংটিটা সবসময় নিজের কাছেই রাখতে।

হুম,ওটাতে যে তোমার স্মৃতি মিশে ছিলো,এতো কিছুরও পরও যে তোমাকে কোনোরুপে ঘৃণা করতে পারি নি,ভেবেছিলাম তোমাকে না পেলেও সারাজীবন তোমার স্মৃতি হিসেবেই ওটা নিজের কাছে রেখে দিবো।

৭-৮ দিন পর সায়েদাকে বাড়ি আনা হলো,চারিদিকে পরে গেছে সায়েদা তাজবীর আর আঁখি আদৃতের বিয়ের তোড়জোড়, ফায়সাল সাহেব সায়েদার ব্যাপারে জানার পর উনার বন্ধুর সাথে কথা বলে বিয়েটা ভেঙে দেন।
এদিকে সবাই শোরগোল করলেও ভালো নেই একটি হৃদয়,চারিদিকে যে দুটি না তিনটি বিয়ের বাদ্য বাজতে শুরু হয়েছে,নোমান পুষ্প যে তৃতীয় ঝুটি,যা খুঁড়ে খাচ্ছে আয়েশার মন,নোমানও এখন ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছে না,মন যে সায় দিচ্ছে না ওর।আয়েশা সবাইকে বলে দিয়েছে আগামীকাল সকালেই এখান থেকে চলে যাবে,এদিকে আয়ানের হাল ভালো নেই,জীবনে তো শুধু টাকা আর উন্নতি চাইছিলো কিন্তু আজ সব থাকা সত্ত্বেও মনের আসল সুখটাই নেই,কি হলো এতো টাকা এতো নাম কামিয়ে কোনো কিছুই যে এখন আয়ানের একটু প্রশান্তির কারন হয়ে উঠতে পারছে না,আঁখি বিহীন জীবন যে শুকনো পাতার ন্যায় হয়ে গেছে ওর,যার কোনো গতিবিধি নেই,কোনো মর্ম নেই,মনের অল্প শান্তির খোঁজে মা বোনকে এখন পাশে চাইছে বড্ড ওর উতলা মন,আয়েশা ফোন করে বলেছে সকালে এসে ওদের নিয়ে যেতে যাতে অল্প প্রশান্তি খেলা করলো আয়ানের অসহায় হৃদয়ে।

আয়েশা চলে যাবে কথাটা কানে যেতেই কেমন মন খচ করে উঠলো নোমানের,এগিয়ে গেলো ওর রুমের পানে।
আয়েশাও তখন নোমানের খোঁজেই ওর রুমের দিকে আসছিলো হাতে কফি নিয়ে।নোমানকে দেখে মুখে মিথ্যে হাসি টাঙিয়ে বললো এবার।

আরে আপনি কোথায় যাচ্ছেন?আমিতো আপনার খোঁজেই আসছিলাম,ওই ভাবলাম কাল সকালে তো চলে যাবো তার আগে আপনাকে এককাপ কফি বানিয়ে খাইয়ে যাই,আপনার যে আমার হাতের কফি আবার বড্ড ভালোলাগে তাই।

আয়েশার চলে যাওয়ার কথাটা বড়ই হৃদয় পোড়াচ্ছে নোমানের,মুখ ফুঁটে ওকে কিছু বলবে তখনি সেখানে পুষ্প এসে আয়েশার হাতে ঝাপড় দিয়ে কফির কাপটা ছিটকিয়ে ফেলে দেয় অতঃপর ঝাঝালো কন্ঠে বলতে শুরু করে।

ইউ রাসকেল,সাহস কি করে হয় সারাদিন ওর পিছু ঘুরঘুর করার,এমন বেহায়া মেয়ে আমার জন্মে দেখি নি এতো কিছু বলার পরও নোমানের পিছু ছাঁড়ে না,ছাড়বে কি করে বড় লোকের ছেলে দেখলে যে আর ছাড়তে ইচ্ছে হয় না,ভাই তো লাথি দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে আর এখন যাওয়ার নামে ঢং করছে ছোটলোক কোথাকার।

পুষ্প মাইন্ড ইওর লেঙ্গুইজ তোর সাহস হলো কি করে ওর সাথে এমন ব্যবহার করার।

আয়েশা আর সেখানে দাঁড়াতে পারলো না,আর কতো ভালোবাসার টানে পরে থাকবে এখানে,পারলে অনেক আগেই চলে যেতো তবে নোমানকে ছেঁড়ে যে চলে যেতেও ইচ্ছে হতো না ওর,মন সায় দিতো না,তাই বিভিন্ন বাহানায় থেকে যেতো ওর পাশে কিন্তু আজ মনে হয় আর পারবে না,কথাগুলো ওর আত্মসম্মানে লেগেছে খুব,ছুটে চলে গেলো রুমে উল্টো হাতে চোখের জল মুছে।

তোকে আমি পরে দেখছি পুষ্প।

রাগে রক্তিম বর্ণ ধারন করা চোখে পুষ্পকে ধমকিয়ে আয়েশার পিছু যায় নোমান,আয়েশা রুমে গিয়েই নিজের আর নিজের মায়ের কাপড়চোপড় প্যাক করতে শুরু করে ও এখনই বাড়ি যাবে বলে।এদিকে নোমান এসে ওকে আটকানোর চেষ্টা করছে।

এসব কি করছেন আপনি ব্যাগ গোছাচ্ছেন কেনো?

আমরা এখনই চলে যাবো নোমান সাহেব।ছাড়েন আমাকে,আমায় আমার কাজ করতে দিন।

আয়েশা পুষ্পর হয়ে আমি তোমাকে সরি বলছি,আমি ওকে দিয়ে তোমার কাছে ক্ষমা চাইয়ে নিবো,ওকে ক্ষমা চাইতেই হবে, তুমি প্লিজ মাথা গরম করে কোনো স্টেপ নিয়ো না,শুধু শুধু ব্যাগ গোছাচ্ছো কেনো ছাড়ো ওটা,মাথা ঠান্ডা করো,তুমি কোথাও যাচ্ছো না।

এবার নোমানের কথায় আয়েশার মাথা চটকালো,গর্জে উঠে বললো।

কেনো থেকে যাবো আমি বলতে পারেন?কেনো থাকবো?কোন সম্পর্কের টানে এখানে থাকবো?কোনো টান নেই,আমার এখানে একটাই পরিচয় আমি এখানকার কেয়ারটেকার, কারন শুধু আঁখির ফ্রেন্ড হয়ে এখানে থাকার কোনো মানে হয় না আমার,আমি এখানে শুধুই কেয়ারটেকার হয়ে ছিলাম এতোদিন,এর থেকে বেশি কোনো সম্পর্ক নেই এই বাড়ির সাথে আমার,আর না আছে আপনার সাথে,তাই সরে যান আমার রাস্তা থেকে, চাকরিটা আমি একটু আগেই ছেঁড়েছি,কাল সকালে যাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু আজকে রাতেই চলে যাওয়া এখন আমার কাছে বেশি যুক্তির মনে হচ্ছে,এক রাতেই না আবার আমার জন্য আপনার বিয়েতে কোনো বিঘ্ন আসে।

নোমান বাকরুদ্ধ হয় আয়েশার কথায়,এই প্রথম আয়েশা ওর সাথে এতো জোরে চেঁচিয়ে কথা বললো,আয়েশা যে সবসময়ই সবার সাথে নম্র ভদ্র ভাষায় কথা বলে এমনকি ব্যবহারও ওর অনেক শান্ত, নরম,তবে নোমান যেনো ওর এমন ব্যবহারে স্পষ্ট অসীম অভিমান আন্দাজ করতে পারছে তাও ওকে নিয়ে।হয়তো মুখে প্রকাশ করতে পারছে না তবে যেনো ওর চোখে তা স্পষ্ট ধরা দিচ্ছে।আজ যে আয়েশার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙেই গেছে একদম তাই আর নিজেতে সীমাবদ্ধ থাকতে পারলো না,বেড়িয়ে গেলো কক্ষ থেকে,নিজেকে স্বাভাবিক করে সবার কাছ থেকে বিদায় নিলো,তারপর মাকে নিয়ে যেতে লাগলো,সবাই ওর হুট করে যাওয়া নিয়ে চিন্তিতো তবে কাউকে কিছু আন্দাজ করতে দিলো না আয়েশা,আঁখিকে আড়ালে নিয়ে সব কিছু বলে গেলো,আয়ান বাড়ির বাইরে থেকে এসে নিয়ে গেলো মা বোনকে,বাড়ির ভিতর এলো না আঁখিকে দেখে যে নিজেকে ঠিক রাখতে পারবে না সে।

আঁখি দাঁড়িয়ে আছে নিজের রুমে বেলকোনির সামনে আকাশের পানে নিরাশাগ্রস্থ ভঙ্গিতে তাকিয়ে ,তখনি কেউ একজন ওর সামনে কফি ভর্তি কাপ ধরলো,চোখ ঘুরিয়ে তাকালে দেখতে পেলো আদৃতকে,আঁখি কাপটা হাতে নিয়ে নিলো, অল্পক্ষণ নিরবতা বজায় রেখে আদৃত কফি কাপে আলতো চুমুক দেয় তারপর বলে উঠে।

আমার জেদি বাঘিনীর দুঃশ্চিতার কারন জানতে পারি?

আঁখিও এবার কফির কাপে আলতো চুমুক দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললো।

আয়েশাকে নিয়ে বড্ড দুঃশ্চিতা হচ্ছে আমার,মন ভাঙার ব্যাথা যে বড্ড পীড়াদায়ক ড.আদৃত,তা সয়ে উঠা যে সবার পক্ষে সম্ভব হয় না।হয়তো আপনি বুঝতে পারছেন না আমার কথা,তবে কথাটা পুরো বলা ঠিক হবে কি না আপনাকে বুঝে উঠতে পারছি না আমি।

আদৃত এবার আলতো হাসলো যাতে আঁখি অল্প চমকে উঠে ভ্রুযোগল কুঁচকে বললো।

হাসছেন যে?

কারন আপনি যে কারনটার কথা বলছেন সেটা আপনি না বললেও আমি ঠিকই আন্দাজ করতে পেরেছি মিস আঁখি।

মানে? আপনি কি বলতে চাইছেন ড.আদৃত?

দেখেন মিস আঁখি জীবন অনেক কিছুই উপলব্ধি করতে শিখিয়ে দেয়, আমিও অনেক কিছুই উপলব্ধি করতে সক্ষম, তাই সে অনুযায়ী আয়েশা আর নোমানের ক্ষেত্রে আমি ভালোবাসার মতো সুন্দর সম্পর্ককে উপলব্ধি করতে পেরেছি,আমি আজকাল প্রায়ই লক্ষ্য করছিলাম নোমান আয়েশাকে নিয়ে আলাদা করে ভাবে,ওর মনে আয়েশার জন্য আলাদা একটা জায়গা তৈরী হয়ে গেছে,যার সম্পর্কে হয়তো ওর নিজেরও জানা নেই,আপনি যখন হাসপাতালে ছিলেন তখন তো আয়েশাও অসুস্থ ছিলো সেসময় আয়েশাকে নিয়ে নোমানের অস্থিরতা দেখে সবারই অনুমানে অনেককিছুই গেলো,তারপর বাবা আমায় জিজ্ঞেস করলেন নোমান কি আয়শাকে পছন্দ করে?এমনটা হলে উনি ওর উপর পুষ্পকে বিয়ে করার চাপটা আর দিবেন না,বাবার সে কথার আলোকে আমি নোমানকে তা জিজ্ঞেস করলে ও আমায় বলে যে কথাটা ও ভেবে জানাবে,তবে আমি তখনই বুঝতে পারি ও আয়েশাকে ভালোবাসে,তারপর আমি খেয়াল করতে সক্ষম হই আয়েশাও নোমানকে পছন্দ করে।আসলে কথা হলো যে নোমান নিজের মনের ভাব বুঝতে ব্যার্থ হচ্ছে,হয়তো আয়েশা পাশে ছিলো তাই ওকে হারানোর ভয় ছিলো না,আর এজন্যই নিজের মনের সুপ্ত ভাব বুঝতে সক্ষম হয় নি,তবে একটা কথা কিন্তু মানতে হবে মিস আঁখি কিছু ক্ষেত্রে ভালোবাসার আসল স্বাদ পেতে গেলে একটু দূরত্ব আনাই ভালো হয়। আয়েশা চলে যাওয়াতে একরকম ভালোই হয়েছে হয়তো এবার নোমান নিজের মনের অজানা অনুভুতির সাথে সাক্ষাৎ করতে সক্ষম হবে।

আশা করি যেনো তাই হয়।

এমনটাই হবে আপনি চিন্তা করবেন না।

আঁখির গালে আলতো স্পর্শ করে বললো আদৃত।যাতে আঁখি অনেকটা সাহস পেলো মনে।

কেটে গেঁছে তিনটে দিন,আয়েশার চোখ থেকে জল সরে নি,খাওয়া দাওয়া ছেঁড়ে দিয়েছে,মন থেকে মুছে ফেলতে চাইছে নোমানের স্মৃতি তবে পারছে না,আসার পর যে নোমান একটা ফোন করেও খোঁজ নেয় নি ওর যা অভিমানের পরিমান আরও বাড়িয়ে দিয়েছে আয়েশার,এদিকে মা হুট করে ওকে বিয়ে দেবেন উঠে পরে লেগেছেন,আয়ান না কি অনেক ভালো একটা সমন্ধ এনেছে আয়েশার জন্য,আয়েশার পড়ালেখাও যে প্রায় শেষের দিকে,তাছাড়া এতো ভালো সমন্ধ না কি এতো সহজে পাওয়া যায় না,তাই আয়ান আর আয়েশার মা সমন্ধটাকে হাত ছাড়া করতে নারাজ,এমনকি আঁখিও ফোন করে ওকে বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলতে অনেক বোঝাচ্ছে,হয়তো অন্য সময় হলে এসবে অনেক খটকা লাগতো ওর তবে মনের অফুরন্ত বেদনার কাছে এখন যেনো সব বুদ্ধি দমে গেলো আয়েশার,মনে মনে নিজেকে শান্তনা দিলো।

নিজে যখন অন্যকে বিয়ে করে সুখি থাকতে পারবেন তবে আমিও উনাকে দেখিয়ে দিবো যে আমিও উনি ছাড়া ভালো আছি,হ্যাঁ আমিও এবার বিয়ে করে নেবো,উনার আগেই করবো।

আয়েশা বিয়ের জন্য রাজি হয়ে গেলো,আজ পাত্র পক্ষ দেখতে আসবে ওকে,এদিকে আঁখি বলেছিলো সকাল সকাল ওর পাশে চলে আসবে তবে এখনও ওর খোঁজ নেই,এদিকে পাত্র পক্ষ আসার সময় হয়ে গেছে,ইতিমধ্যে না কি এসেও গেছেন কাজের মেয়ে কাজল এসে বললো,আয়েশা পারছে না নিজেকে মানিয়ে নিতে তাও অনেক কষ্টে নিজেকে স্বাভাবিক করে ফরমাল ড্রেসআপেই সবার উদ্দেশ্য চা বানিয়ে নিয়ে গেলো।

চলবে……..