মায়ার বাঁধন পর্ব-১০+১১

0
422

#মায়ার_বাঁধন🍂
১০.
জাহানারা চৌধুরী উশখুশ করতে করতে বললেন,

-“কাল তুই নীরাকে নিয়ে ওদের বাড়িতে যাবি। তিনদিন থেকে, ঘুরেফিরে আবার নীরাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরবি।”

তুরান ঝট করে মায়ের কোল ছেড়ে সোজা হয়ে বসল। কন্ঠে ক্রোধ টেনে বলল,

-“কখনোই সম্ভব নয় মা। তুরান তাসরিফ চৌধুরী দ্বিতীয় বার গ্রামে পা রাখবে না।”

-“আহ তুরান এভাবে কেন বলছিস? এটাই নিয়ম বিয়ের তিনদিনের মাথায় বউ সমেত শ্বশুর বাড়ি যেতে হয় আবার বউকে সঙ্গে নিয়ে ফিরতে হয়। এখন তুই যদি না যাস আমাদের মানইজ্জত কোথায় গিয়ে দাড়াবে ভেবে দেখেছিস?”

-“এটা তোমাদের আগেই ভাবা উচিত ছিল মা। এটা নিয়ে আর কিচ্ছু শুনতে চাই না আমি। যাব না বলেছি ব্যস যাব না। প্রয়োজনে তোমার বউ মাকে সঙ্গে নিয়ে তুমিই চলে যাও।”

-“আমার কথাটা তো শোন বাবা…….”

ওড়নার আঁচলে মুখ চেপে ধরে দৌড়ে ঘরে চলে গেল নীরা। সে এতক্ষণ মা ছেলের সব কথাই শুনেছে। তুরানের ঘরে যাওয়ার আগে বাবা-মায়ের ঘরটা আগে পড়ে। সেভাবেই খাবার গুছিয়ে এ ঘরের সামনে দিয়ে ক্রস করার সময় থমকে দাড়ায় নীরা। কৌতুহল দমাতে না পেরে শুনে নেয় তুরানের ভাষ্য। আর এক মুহূর্ত দাড়ানোর শক্তি হয় না তার। রুমে গিয়ে ধপ করে কম্বল মুড়ি দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। ক্ষণে ক্ষণে শুধু হেঁচকি তুলার আওয়াজ ভেসে আসছে। নীরা কাঁদছে তবে তা প্রকাশ করতে চাইছে না। শত চেষ্টায় আটকে রাখা কান্না গুলো হেঁচকি রুপে বেড়িয়ে আসছে।

—–
তুরান ঘরে আসে বেশ সময় নিয়ে। ঘরে ঢুকে দেখে নীরা শুয়ে পড়েছে। সে ভেবেছে নীরা ঘুমিয়ে পড়েছে তাই কোনো কিছু না বলে সে ও বিছানার আরেকপ্রান্তে শুয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে তলিয়ে যায় ঘুমের রাজ্যে। নির্ঘুম রইল কেবল নীরা। চোখের পাতা চেয়েও এক করতে পারল না। নিজে যেমন পরিস্থিতিতেই থাকুক না কেন পরিবারকে সে বিষয়ে অবগত করতে ইচ্ছুক নয় সে। তাহলে যে তার বাবা – মা বড্ড কষ্ট পাবে। দুশ্চিন্তায় থাকবে তাকে নিয়ে। মায়ের ব্ল্যাড প্রেসার আছে। হাইপার হলে দূ’র্ঘ’ট’না ঘটে যেতে সময় নেবে না। চিন্তায় চিন্তায় নীরা নিজেই ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে।

খুব সকালে বিছানা ছেড়ে উঠে নামাজ সেড়ে নেয় নীরা। কিছু সময় বিছানায় বসে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে তুরানের মুখপানে। কাঙ্খিত সময় পর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে উঠে যায়। চলে যায় কিচেনে। শ্বাশুড়ির সঙ্গে কাজে হাত লাগাতে হবে।

কাজের ফাঁকে জাহানারা চৌধুরী খেয়াল করেছেন নীরার মনটা এখনো বিষন্ন হয়ে আছে। তিনি ভেবে পেলেন না এখনো নীরা উদাসীন কেন? পরপরই ভাবল হয়তো তুরানের সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না বলে মন খারাপ করে থাকে। দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন তিনি। মনে মনে ওপর ওয়ালাকে স্মরণ করে বললেন,

-“হে আল্লাহ! তুমি ওদের সুখী করো।”

—–
প্রতিদিনের ন্যায় আজও নীরার হাতের কফি খেয়ে সকালটা শুরু হলো তুরানের। তবে সে আজকে নীরার মধ্যে কিছু ভিন্নতা লক্ষ্য করেছে। এই যেমন মেয়েটা একেবারে চুপচাপ হয়ে আছে। প্রয়োজন ছাড়া কোনো কথা বলছে না। নীরাকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে কফি শেষ করে তুরান ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। আর নীরা শুরু করে বিছানা গোছাতে।

ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে তুরান নীরাকে ঘরে পায় না। ঘড়ির কাঁটায় লক্ষ্য করে বুঝতে পারে হয়তো ডাইনিংয়ে গেছে। শার্ট,প্যান্ট গায়ে জড়িয়ে সে ও নেমে পড়ে ব্রেকফাস্ট করতে। নিচে নেমে দেখে নীরা খাবার সার্ভ করছে। তুরান চুপটি করে চেয়ার টেনে বসে পড়ে। আড়চোখে একটু পরপর নীরাকে দেখছে। মেয়েটার বিষন্নতায় ঘেরা মুখশ্রী দেখতে তার একদমই ভালো লাগছে না। বুকের মধ্যে কোথাও একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। মনে হচ্ছে জাপ্টে ধরে কী সমস্যা জেনে নিতে। কিন্তু আফসোস সেটাও পারছে না।

সকলকে খাবার বেড়ে দিয়ে শ্বাশুড়ির আদেশে নীরাও বসে পড়ে খেতে। এমন সময় হিয়া,টিয়া হুটোপুটি করে উপস্থিত হয়। দুজনের হাতেই ব্যাগপত্র। বেশ পরিপাটি হয়েও এসেছে। নীরা ওদের দেখে খুশি হয় পরক্ষণেই আবার ওদের এভাবে ফিটফাট দেখে নিজের কাছেই নিজে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ওরা কোথায় যাচ্ছে?

হিয়া,টিয়া সোফার ওপর ওদের ব্যাগপত্র রেখে সোজা এসে চেয়ার টেনে বসে পড়ে। টিয়া প্লেট নিতে নিতে তড়িঘড়ি করে বলে,

-“বড় মা জলদি খেতে দাও। খুব খিদে পেয়ে গেছে। সাজগোজ করতে করতে লেট হয়ে গেছে তাই ভাবলাম হয়তো ভাইয়া-ভাবি আমাদের ফেলে চলে যাবে। এজন্য একেবারে না খেয়েই হাজির হয়ে গেছি।”

হিয়া টিয়ার মাথায় গাট্টা মে’রে বলল,
-“হ্যাঁ নিজে তো এক পা’গ’ল সেই সঙ্গে আমাকেও পা’গ’ল করে ছাড়বি।”

জাহানারা চৌধুরী ওদের পাতে খাবার তুলে দিচ্ছে আর হাসছে। আলহাম চৌধুরী, তুরানও হাসছে। সবার দেখা দেখে নীরাও হাসল তবে তার বোধগম্য হচ্ছে না এদের কথার মানে। তাই কৌতুহল বসত প্রশ্ন করেই বসল। বলল,

-“তোমরা কোথায় যাচ্ছ হিয়া-টিয়া?”

উপস্থিত সকলে যেন আকাশ থেকে পড়ল। সকলেই স্তম্ভিত মুখে নীরার দিকে তাকিয়ে। শুধু তুরান বিপরীত। সে নিজের মতো খেয়ে চলেছে। নীরা পড়ে গেছে অস্বস্তিতে। সে এমন কী ভুল বলল যার কারণে সকলে এভাবে চিড়িয়াখানার জন্তুর মতো তাকে পরখ করছে? নীরার কাচুমাচু ভঙ্গি আর এদিকে টিয়ার সন্দেহী কন্ঠ,

-“কোথায় যাচ্ছি মানে? তোমার আর ভাইয়ার সঙ্গেই তো আমরা যাচ্ছি। বাই এনি চান্স, তুমি আমাদের নিতে ইচ্ছুক নও?”

-“এ মা তা কেন হবে। আমি অবশ্যই তোমাদের নিতে ইচ্ছুক কিন্তু….?

-” কিন্তু কী ছোট ভাবি?”

-“আসলে হয়েছে কী… আমরা যাচ্ছি টা কোথায়?”

এবারেও সকলে আরেকটা ঝটকা খেল। এবার টিয়া কিছু বলার আগেই জাহানারা চৌধুরী তুরানের উদ্দেশ্যে বললেন,

-“কী রে তুই কিছু বলিসনি ওকে?”

তুরান সাবলীল ভঙ্গিতে উত্তর দিল,
-“নাহ সুযোগ হয়নি ৷ রাতে ঘুমিয়ে গিয়েছিল।”

জাহানারা চৌধুরী এবারে বুঝতে পারলেন সকালেও কেন নীরার মন খারাপ ছিল। ও তো এখনো কিছু জানেই না। জাহানারা চৌধুরী নীরাকে এবার কিছু বলতে উদ্ধত হলে তার আগেই টিয়া লাফিয়ে বলে ওঠে,

-” ও মা ছোট ভাবি, কী আশ্চর্য বলো! তোমাদের বাড়িতে যাচ্ছি আর তুমিই জানো না।”

এবারে জাহানারা চৌধুরীও বললেন,
-“হ্যাঁ রে নীরা তুরানের সঙ্গে গিয়ে বাবার বাড়ি থেকে ঘুরে আয় কিন্তু তুরানের আবার একটা শর্ত আছে। সে নাকি এক রাতের বেশি থাকতে পারবে না। তার ভার্সিটিতে নির্বাচন সামনে অনেক ঝামেলা আছে। ফিরতে হবে ওকে। তুইও বরং ওর সঙ্গেই ফিরে আসিস। তুইও তো নতুন ক্লাস জয়েন করলি। এমনিতেই অনেক লেটে ভর্তি হয়েছিস এখন বেশি ক্লাস মিস দিলে পড়ালেখায় ক্ষতি হয়ে যাবে। তারচেয়ে বরং এখন একসঙ্গে দুটো দিন থেকে আয় পরে না হয় সময় সুযোগ করে বেশিদিন থেকে আসিস।”

আলহাম চৌধুরীও স্ত্রীর সঙ্গে সহমত পোষণ করলেন। নীরা নির্বাক শ্রোতার মতো শুধু শুনে গেল। তবে মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়েছে সকলের কথায়। তুরান যে যেতে রাজি হয়েছে এটাই অনেক তার কাছে। শেষমেশ ও বাড়ির সামনে মানইজ্জত টুকু তো রক্ষা হলো।

নীরার বিষন্নতায় ঘেরা মুখশ্রীতে এবার যেন উৎফুল্লতা নেমেছে। তুরান বার কয়েক খেয়াল করেছে সেদিক। মনে মনে ভেবেছে,

-“ওহ তাহলে মহারানীর মন খারাপের কারণ এটাই। আগে জানলে বহুত আগেই জানিয়ে দিতাম। এভাবে হু’তু’ম’প্যাঁচা সেজে ঘুরতে দিতাম না কখনোই।”

.
চলবে,

#মায়ার_বাঁধন🍂
১১.
বেশ হইহই করে ব্যাগপত্র গোছাতে ব্যস্ত নীরা। এতক্ষণের দুশ্চিন্তা মুহুর্তেই আনন্দ উচ্ছ্বাস হয়ে ধরা দিয়েছে তার নিকট। কতগুলো দিন পর নিজের বাড়িতে যাবে। চেনা বাড়ি, চেনা মানুষজন, নিজস্ব সেই ঘরটি। সব মিলিয়ে এক আবেগী অনুভূতি। তুরান তৈরি হয়ে গেছে অনেক আগেই। এখন বসে বসে ফোন স্ক্রলিং করছে। অপেক্ষা নীরার জন্য। আধঘন্টা হয়ে গেছে অথচ নীরা এখনো তৈরি হতে পারে নি। অবশেষে তুরান বিরক্ত হয়ে বলল,

-“এক রাতেরই তো ব্যাপার। এতো আটঘাট বাঁধার কী আছে? আধঘন্টা ধরে তৈরি হচ্ছো আর কত সময় নেবে?”

তুরান পুনরায় ফোনে মনোযোগী হয়। নীরা এক ভেংচি কেটে নিজের কাজে মন দেয়। আর যাই হোক এই খুশি খুশি আমেজটায় তুরানের সঙ্গে ঝগড়া করে কিছুতেই মুড খারাপ করতে চায় না।

সবই তো ঠিক ছিল কিন্তু বিপত্তি বাঁধল অন্য জায়গায়। যখন নীরা কামিজের চেইন আটকাতে পারছিল না। সচরাচর কামিজের পেছনে চেইন সে লাগায় না। কারণ একা হাতে চেইনের লাগাল পাওয়া কঠিন। কিন্তু বিয়ের মৌসুমে তার অগোচরেই দর্জি চেইন লাগিয়ে ফেলেছে। এখন তো পড়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তাড়াহুড়ো করে তৈরি হতে গিয়ে সেখান থেকে একটি ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকেছে সে। ভুলেই গিয়েছিল এই জামাটাতে চেইন আছে। এখন সম্পূর্ণ ড্রেস পড়ার পড়ে মনে পড়েছে। পুনরায় ড্রেস চেঞ্জ করে আবার ড্রেস এনে পড়তে বেশ সময় লেগে যাবে। সেই সঙ্গে রেগে যাবে তুরান। কিন্তু এখন উপায়?

—–
বেশ সময় নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো নীরা। কেমন কাচুমাচু ভঙ্গিতে এগিয়ে আসছে সে। কাঁধ জুড়ে ওড়না চাপিয়ে রেখেছে। ওয়াশরুমের দরজার শব্দে একপল সেদিকে তাকাল তুরান। নীরার এমন অবস্থা দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। পরপরই কর্কশ গলায় বলল,

-“এখনো এমন পিনপিন করে চললে যেতে যেতে তো দুপুর গড়িয়ে যাবে। নাকি তোমার যাওয়ার ইচ্ছেটাই নেই। একবার শুধু বলে দাও তারপর দেখো এখনি সব ছেড়ে ছুড়ে কীভাবে একটা জম্পেশ ঘুম দেই।”

নীরা আঁতকে উঠল। না না বলে আর্তনাদ করল। পরপরই ধীর পায়ে এগিয়ে এসে তুরানের সম্মুখে দাড়িয়ে পড়ল। দু-হাত সমানে কচলে যাচ্ছে সে। তুরান পুনরায় সেদিক একপল তাকিয়ে তীব্র বিরক্তি নিয়ে বলল,

-“আবার কী হলো…..?”

নীরা আমতা আমতা করল। বলল,

-“ইয়ে মানে, আ আমার…. ”

-“হ্যাঁ তোমার কী?”

-“জামার চেইন টা……. ”

তুরানের কুঁচকানো ভ্রু প্রসারিত হলো। নীরাকে আগামাথা একপল দেখে নিয়ে সোজাসাপ্টা জবাবে বলল,

-“পেছন ঘোরো।”

নীরা কাচুমাচু করে পেছন ঘোরে। আঁটসাঁট বেঁধে দাড়িয়ে রয়। যেন তার সঙ্গে ভ’য়ং’ক’র কিছু ঘটতে চলেছে। তুরান ভালো ভাবে দেখে নেয় নীরার পৃষ্ঠদেশ। কিন্তু তেমন কিছুই বোধগম্য হয় না। ওড়নার আস্তরণে পুরো পৃষ্ঠ ঢেকে রাখা। তুরান বুঝল তাকে আন্দাজ মোতাবেক কাজ করতে হবে। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে নিজের ডান হাত কিছুটা এগিয়ে নেয় সে। পরপরই লক্ষ্য করল তার ধীর গতিতে এগোনো হাতটি থরথর করে কাঁপছে। এ কেমন অনুভূতি। নীরাকে বউ হিসেবে স্বীকৃতি না দিলেও তার অভ্যন্তরিণ আ’ত্মা ঠিক জানে নীরা তার বউ। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে খোদা তায়ালা এমনিতেই এক ঐশ্বরিক টান সৃষ্টি করে দেন। যার ফলে সম্পূর্ণ অজানা অচেনা মানুষটির সঙ্গেও গড়ে ওঠে এক সুদীর্ঘ মায়ার বাঁধন। সে বাঁধনে আবদ্ধ হয়ে মানুষ পার করে দেয় গোটা জীবন। তৈরি করে সুখের সংসার। নীরার প্রতিও তেমনই টান অনুভব করে তুরান। শত হোক বয়সের দিক দিয়ে সে এক তরতাজা-টাগরা যুবক। সহধর্মিণীর সঙ্গে একই ছাদের নিচে থেকেও যে কামবাসনা জাগ্রত হবে না এমনটা কখনোই হতে পারে না। তুরানেরও হয়নি। গভীর রাতে যখন নীরা পরম নিশ্চিন্তে বাচ্চা শিশুর মতো ঘুমিয়ে থাকে অজান্তেই ছটফটিয়ে ওঠে তখন তুরান। বিছানার এপাশ ওপাশ ধরফর করেও যখন মেলে না প্রশান্তির দেখা তখন বাধ্য হয়ে উঠে চলে যায় বেলকনিতে। ডিভানে বসে শেষ করে একের পর এক সিগারেটের প্যাকেট। ইদানীং প্রায় রাতই তার এভাবে কাটছে। তবে তা সম্পূর্ণ নীরার অগোচরে। এখনই সে এ পথে পা বাড়াতে চায় না। নিজেকে সময় দিতে চায়৷ নীরাকে পুরোপুরি বুঝতে চায়। পূর্ণাঙ্গ ভালবাসায় আবদ্ধ হতে চায়। তারপরই না হয় পূর্ণতা পাক তাদের সম্পর্ক। ততদিন না হয় হোক অপেক্ষা। অপেক্ষার ফল সর্বদাই সুমিষ্ট হয়ে থাকে।

দীর্ঘক্ষণ পরেও যখন তুরানের থেকে কোনো রেসপন্স এলো না তখন নড়েচড়ে উঠল নীরা। মিনমিনে কন্ঠে বলল,
-“লে..লেট হচ্ছে।”

সম্ভিৎ ফিরে পেল তুরান। ছোট্ট করে ‘হু’ বলে এগিয়ে গেল পুনরায়। নিজেকে সর্বস্ব শক্ত করে নীরার ওড়নার নিচ দিয়ে হাত গলিয়ে দিল। নিমেষেই হাতে পেয়ে গেল চেইনের ঘাট। খুব সন্তপর্ণে তুলে আটকে দিল সেটা। নীরা ঠায় দাঁড়িয়ে। তুরানের ভারী নিশ্বাস পড়ছে তার কাঁধ বরাবর। শিউরে ওঠছে ক্ষণে ক্ষণে। দু’জন দু’জনের নিশ্বাসের গতি গুণতে পারছে যেন কিন্তু বেশিদূর এগোনোর সা’হ’স বা ইচ্ছে কোনটিই কারোর নেই। দু’জনেই রয়েছে এক তুমুল অপেক্ষায়। তুরান রয়েছে নিজেকে বোঝার অপেক্ষায় আর নীরা রয়েছে তুরানের সদ্বুদ্ধি ফেরার অপেক্ষায়।

কাজ শেষে এক মুহূর্ত দাড়াল না তুরান। জোর কদমে ঘর ছাড়ল সে। যেতে যেতে শুধু বলে গেল, ‘অপেক্ষায় আছি।’
ব্যস,পরপরই উধাও হলো সে। সজ্ঞানে ফিরে নীরাও ঝটপট লেগে পড়ল বাকি গোছগাছ টুকু সেরে নিতে। কিন্তু পারছে কই? ক্ষণে ক্ষণে লজ্জায় রক্তিম হয়ে আঁচলে মুখ ঢেকে মৃদু হাসছে।

—–
লং-টার্ম জার্নি ড্রাইভারের সঙ্গ আবশ্যক। বাড়ির বিশ্বস্ত ড্রাইভার শফিক সঙ্গে আছে। ড্রাইভ করছে আপনমনে। তার পাশের সীটে বসেছে তুরান। তার গভীর মনোযোগ ফোন অব্দি সীমাবদ্ধ। পেছনের সীটে বসেছে হিয়া,টিয়া আর নীরা। হিয়া বসেছে মাঝে। তার দুইপাশে দুইজন। টিয়া ও নীরা। নীরা ইচ্ছাকৃত জানালার সাইডে বসেছে। লং-টার্ম জার্নিতে মাঝেমধ্যে সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। বমি পায়। শরীর ফুরফুরে রাখতে তখন বাহিরের খোলা হাওয়ার প্রয়োজন পড়ে। আর টিয়া সে তো বরাবরের বিচ্ছু। জানালার সাইডে ছাড়া সে কখনোই বসবে না। এটা নিয়ে স্কুল পিকনিকে যাওয়ার সময় বাসে বসে বেশ কয়েকবার হট্টগোল বাধিয়েছে। মোট কথা জানালার সাইড তার চাইই চাই। শুরুতে সবাই আপত্তি করলেও এখন সকলেই জানে জানালা যেখানে টিয়া সেখানে। ক্লাস রুমে বসেও এটাই করে সে।

জানালার সাইডে বসে একহাত বাহিরে বের করে গুনগুনিয়ে গান গাইছে টিয়া। অপর পার্শ্বে বসে নীরা আপনমনে দেখছে প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্য। সীটে মাথা এলিয়ে দিয়ে বেশ উপভোগ করছে প্রকৃতির বাহারি সাজসজ্জা। হিয়া মাঝে বসে ফোন স্ক্রল করছে। সে একেবারে শান্তশিষ্ট প্রকৃতির মেয়ে। হৈ হুল্লোড়, কোলাহল থেকে দূরত্ব মেপে চলে। সর্বদাই শান্ত থাকা তার স্বভাব। ভীষণ মিষ্টি একটা মেয়ে। টিয়া যতটা চঞ্চল হিয়া ঠিক ততটাই শান্ত। একজনে আগুন হলে আরেকজন তবে পানি। পাঁচ মিনিটের বড় হবার সুবাদে হিয়া সর্বদাই টিয়াকে শাসনে রাখে। টিয়ার করা ছেলেমানুষী গুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়। ভালোওবাসে প্রচুর বোনকে।

হিয়া ফোন ক্রল করতে করতে সটান হয়ে বসে। ফোন দেখতে আর ভালো লাগছে না। তাই ফোনটা অফ করে আড়মোড়া ভেঙে পাশ ফিরে তাকায়। অকস্মাৎ চমকে ওঠে সে। কম্পিত কণ্ঠে আর্তনাদ করে বলে ওঠে, ‘টিয়ায়ায়ায়া।”

.
চলবে,