মায়ার বাঁধন পর্ব-০৯

0
329

#মায়ার_বাঁধন🍂
০৯.
সিঙ্গেল সোফায় বসে আয়েশ করে খাবার খাচ্ছে তুরান।
তা মুগ্ধ দৃষ্টিতে উপভোগ করছে নীরা। খিদের তাড়নায় তুরানের ডানে বামে হুঁশ নেই। নিজের মনে খেয়ে চলেছে।
পেট যখন ভরে এসেছে প্রায় অকস্মাৎ তার চোখ আটকায় নীরাতে। ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত হয়। সন্দিহান কন্ঠে বলে,

-“এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? খিদে পেয়েছে? তাহলে খাবার নিয়ে এসে খেয়ে নাও।”

নীরার চেতনা ভঙ্গুর হয়। তড়িৎ গতিতে মাথা নাড়ায় যার অর্থ না। তার খিদে পায়নি। তুরানের কুঞ্চিত ভ্রু এমন উত্তর পেয়ে দ্বিগুণ কুঞ্চিত হয়। নিরেট কন্ঠে শুধায়,

-“তাহলে?”

নীরা ভ্যাবাচ্যাকা খায়। কী বলবে এখন সে? সে যে ভ্যাবলার মতো চেয়ে চেয়ে তুরানকে দেখছিল এটা তো কিছুতেই বলা চলবে না। সে কী ছ্যাচড়া নাকি? কিন্তু বলবে টা কী এখন? ভেবেচিন্তে হঠাৎ মাথায় এক বুদ্ধি আসে। বলে দেয়,

-“এটাই দেখছিলাম যে, এতো এতো খাবার কীভাবে রা’ক্ষ’সের মতো এক মুহূর্তে ফিনিস করে ফেললেন। দেখতে মনে হচ্ছিল কয়েক বছরের অভুক্ত মানব।”

তুরান এতক্ষণে খাবার শেষ করে হাত ধুয়ে নিয়েছে। নীরা কথাগুলো বলতে বলতে সেই সুযোগে থালাবাসন গুছিয়ে নিয়েছে। বাক্যগুলো সম্পূর্ণ হতেই সেখান থেকে এক প্রকার ছুটে চলে গেল। তুরান আহাম্মকের মতো বসে। নীরার কথাগুলো মস্তিষ্কে ঢুকতেই দাঁতে দাঁত চেপে দু-হাতে নিজের চুল নিজে টেনে ধরে। পরপরই ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বিড়বিড়িয়ে বলে ওঠে,

-“আমাকে রা’ক্ষ’স বলে গেলে? তুমি তো বউ নামে ক’ল’ঙ্ক। ঠিকমতো স্বামী সেবাই করতে পারো না। কোথায় ভাবলাম আটঘাট বেঁধে খায়িয়ে দেবে তা না নিজ হাতেই খেতে হলো।”

—–
রাত ন’টা অব্দি শ্বাশুড়ির সঙ্গে টেলিভিশন দেখে, গল্প করে কাটিয়ে দিল নীরা। তুরান সেই সন্ধ্যায় খাবার খেয়ে ফের বেড়িয়েছে। বলেছে ফিরতে লেট হবে। নীরার মনটা এখনো থেকে থেকে অস্থির হয়ে উঠছে। তবু শ্বাশুড়ির সঙ্গে থেকে আপ্রাণ চেষ্টা করছে দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকার। জাহানারা চৌধুরীর চোখ এড়ায়নি বিষয়টা। তিনি মনে মনে দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন৷ তিনিও বেশ চিন্তিত বোধ করছেন। শেষ পর্যন্ত তুরান কী যেতে রাজি হবে? না গেলে চৌধুরী বাড়ির মানইজ্জত বিকিয়ে যাবে বেয়াই বাড়ির নিকটে।

খাবার পর্ব চুকিয়ে রাত সাড়ে দশটা নাগাদ ঘরে ফিরেছে নীরা। তুরান এখনো অব্দি ফেরেনি। শ্বাশুড়ি মা তাকে স্বামী বাড়ি ফিরলে নিজ হাতে খাবার পরিবেশন করে খাওয়ানোর দ্বায়িত্ব দিয়ে গেছে। সেই দ্বায়িত্ব পালনের অপেক্ষায় রাত জেগে বসে থাকতে হচ্ছে তাকে। অসময়ে সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছে নিজস্ব ফোনটাকে। কখনো ফেসবুক স্ক্রলিং করছে তো কখনো ইউটিউব দেখছে। এভাবেই কোনো মতে সময় পাড় করছে। কিন্তু কিছুতেই স্বস্তি মিলছে না।

অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে তুরান বাড়ি ফিরেছে রাত বারোটার কাছাকাছি সময়ে। কলিং বেল বাজতেই নীরা ওপর থেকে ছুটে এসেছে। তাড়াহুড়োয় ঘড়ি দেখতেও ভুলে গেছে। নীরাকে দরজা খুলতে দেখে তুরান ভ্রু কুঁচকে ফেলে। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে ভারিক্কি কন্ঠে বলে,

-“তুমি? এখনো ঘুমাওনি কেন? এতো রাত জাগতে কে বলেছে?”

নীরার অস্বস্তি হলো। সরাসরি জাহানারা চৌধুরীর কথাটা বলতেও পারছে না। আমতা আমতা করতে করতে বলল,

-“এমনিতেই জেগে ছিলাম। কলিং বেলের শব্দ শুনে এসেছি।”

তুরান আরেক পল নীরাকে ভ্রু কুঁচকে দেখে নিল। অতঃপর ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল,

-“জেগে যখন আছোই আমার খাবারটা সার্ভ করে দাও। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

তুরান চলে যেতেই নীরা মুখ ভেংচি কাটে। ব্যঙ্গাত্নক কন্ঠে বলে,

-“না করলে হয়? এই মহত্ত্ব সাধনের অপেক্ষায়ই তো বসে আছি।”

বিড়বিড় করতে করতে খাবার গুলো সার্ভ করতে যায় নীরা। কিন্তু খাবার গুলো তো একেবারে ঠান্ডা হয়ে আছে। পরপরই দ্রুত পায়ে খাবার গুলো মাইক্রোওভেনে গরম করে নেয় সে। তারপর সুন্দর করে পরিবেশন করতে থাকে। ততক্ষণে তুরান ফ্রেশ হয়ে নিচে নামছে। সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে এক অমায়িক সৌন্দর্যপূর্ণ মুহুর্তের সাক্ষী হয় সে। আহ তার পিচ্চি বধূ কী সুনিপুণ হাতে তার জন্য খাবার পরিবেশন করছে। ভাবতেই প্রশান্তিময় অনুভূতিরা ডানা মেলছে মনে। তুরান টু শব্দবিহীন চেয়ার টেনে বসে পড়ল। খাবারের প্লেট টেনে নিয়ে খেতে আরম্ভ করে দিল৷ নীরা এক সাইডে দাড়িয়ে। তুরান সেভাবেই নীরাকে প্রশ্ন করল,

-“তুমি খেয়েছ?”

জবাবে নীরা মাথা দোলায় যার অর্থ সে খেয়েছে। উত্তর পেয়ে তুরানের কী জানি কী হলো সে একপল নীরাকে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে পরপরই গম্ভীর কন্ঠে বলল,

-“তাহলে এখানে থাকতে হবে না আর। ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।”

নীরা কাঠকাঠ গলায় বলল,
-“এতদূর যখন করেই দিয়েছি বাকিটুকুও না হয় করেই যাই।”

তুরান আর কিছু বলল না। তবে পুরোটা সময়ই ঝকঝকে মুখটা ভারাক্রান্ত করে রাখল। নীরা বুঝল না এমন রিয়াকশনের কারণ। সে ও আর ঘাটল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তুরানের খাবার শেষ হতেই সে উঠে ওপরে চলে গেল। নীরার সঙ্গে আর একটিও বাক্য ব্যয় হলো না। নীরা অবাকান্বিত চাহনি মেলে দেখল। পরপরই দীর্ঘ শ্বাস ফেলে টেবিল গোছাতে মনোযোগী হলো।

—–
আগেকার সময় গুলোতে জাহানারা চৌধুরী নিজে তুরানের জন্য রাত জেগে লিভিং রুমে অপেক্ষা করতেন। কিন্তু আজ হলো ব্যতিক্রম। তাই অভ্যাস বসত তুরান নিজে থেকেই একবার প্রবেশ করল বাবা মায়ের ঘরে। আলহাম চৌধুরী শান্তির ঘুম দিচ্ছেন। কিন্তু ঘুম নেই জাহানারা চৌধুরীর চোখে। যতই ছেলে বড় হোক, বউ আসুক। মায়ের কাছে সন্তান বরাবরই শিশু। অমূল্য ধন। সেই ধন যদি রাত বিরেতে এই ঝু’কি’পূ’র্ণ শহরে চলাচল করে বেড়ায় মায়ের চোখে কী আর ঘুম ধরা দেয় তখন। দুশ্চিন্তা ধামাচাপা দিতে উপন্যাসের বইয়ে মুখ গুজে বসে ছিলেন তিনি। ছেলের আগমন টের পেয়েছে অনেক আগেই। কলিং বাজার সঙ্গে সঙ্গেই। কিন্তু বের হননি ঘর থেকে। ছেলে-ছেলে বউয়ের মধ্যকার দূরত্ব ঘোচাতে তাদের একান্ত ছেড়ে দেওয়া ভীষণ জরুরি। দুজন দু’জনের যত কাছাকাছি থাকবে তবেই তো সম্পর্কে দূরত্ব ঘুচে মধুরতা আসবে।

দরজায় ঠকঠক শব্দে বইয়ের পাতা বন্ধ করলেন জাহানারা চৌধুরী। দরজার পানে তাকিয়ে বললেন,

-“তুরান এলি? ভেতরে আয়।”

আলগোছে দরজা খুলে ঢুকে পড়ল তুরান। মায়ের সম্মুখে গিয়ে বসল। অভিমানী কন্ঠে বলল,

-“দ্বায়িত্ব থেকে যখন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছ তবে শুধু শুধু অপেক্ষা করে সময় নষ্ট না করে ঘুমিয়ে গেলেই পারো।”

জাহানারা চৌধুরী মুচকি হাসলেন। মায়ের কাছে এলে সকল সন্তানই কেমন শিশুসুলভ আচরণ করে বসে। বয়স যতই বারুক না কেন মায়ের কাছে আবদার, অভিমানে সকলেই দক্ষ ভূমিকা পালন করে। জাহানারা চৌধুরী ছেলেকে কাছে টেনে নিলেন। তুরানের মাথাটা নিজের কোলের ওপর শুয়িয়ে দিয়ে বললেন,

-“কে বলল দ্বায়িত্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি? শুধু হস্তান্তর করেছি যথাযথ স্থানে। মানুষ কর্মক্ষেত্রে যেমন বয়স বেড়িয়ে গেলে রিটায়ার্ড হয় তেমনই সেই জায়গা দখল করে অন্য কোনো সুযোগ্য কেউ। আমার সংসার জীবনেও তেমনই হস্তান্তর প্রক্রিয়ার সময় এসেছে। সুযোগ্য মানুষের হাতেই আমি তুলে দিয়েছি আমার ছেলের ভাড়। আমি আর কদিন। বাকি জীবনটা সে ই আমার ছেলের সকল দ্বায়িত্ব বয়ে বেড়াবে। সুখ-দুঃখ, মান-অভিমানের সঙ্গী হবে। শুধু সময়ের অপেক্ষা।”

তুরান মায়ের কোলে শুয়েই সেভাবেই জাহানারা চৌধুরীর পা জড়িয়ে ধরে। দৃঢ় কন্ঠে বলে,

-“কখনোই না। তোমার কিচ্ছু হবে না। তুমি আজীবন আমার সঙ্গে থাকবে। সে যতই দ্বায়িত্ব আরেকজনকে চাপিয়ে পাড় পাও না কেন আমার জ্বালাতন থেকে কখনো মুক্তি পাবে না।”

জাহানারা চৌধুরী ছেলের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলেন,

-“তা কী আর হয় বাবা। সময়ের নিয়মে সকলেরই শেষ সময় আসবে। সঠিক স্থানে পৌঁছতে হবে সকলকেই।
সে যাই হোক, এখন একটা কথা বলি শোন। তুই কিন্তু না বলতে পারবি না। তোকে শুনতেই হবে।”

তুরান ভ্রু কুঁচকে ফেলল। মায়ের এমন আবদারি কন্ঠ শুনে বুঝল নিশ্চয়ই তলে তলে কোনো ঘোট পাকিয়েছে তার জন্য। সে সেভাবেই ভ্রু কুঁচকে বলল,

-“কী কথা বলো দ্রুত?”

.
চলবে,
অহমিকা মুনতাহাজ নিশি