#মায়া_মহল (১০) #রহস্য
কলমে #রেহানা_পুতুল
সেই সন্ধ্যায় কায়রুস গ্রামে এলো। অর্থাৎ আঞ্জুমানের স্বামী এবং শাহের ও জুবায়েরের বাবা। অসুস্থ শরীরে গাড়ি থেকে নেমে নিজের কক্ষে চলে গেলো কায়রুস। এতটা মাস পরে বাড়িতে তার আগমন ঘটলো। তবে কেউই খুশী হল না তার আসাতে।
কিন্তু মায়া ভীষণ খুশী হলো। এত সুন্দর বাড়ির কারিগরকে আজ দেখতে পাবে বলে।
পরশ বিড়বিড়িয়ে বলল,
মিয়াভাই, বড় অসময়ে আপনি পা রাখলেন মায়া মহলে। বড় অসময়ে।
______
মায়া আড়চোখে বাসার সবাইকে লক্ষ্য করছে। এতদিন পরে পরিবারের কর্তা গ্রামে এলো। অথচ তাকে নিয়ে কারো মাঝে কোন বিশেষ হেলদোল নেই। নেই কোন উচ্ছ্বাস। নজরে পড়ছে না তার বিশেষ খাতির। সবাই সবার মতো করে আছে। কেউ তার কাছে যাচ্ছেও না। সেও রুম থেকে বের হচ্ছে না। তার রুমে কুমকুম গিয়ে খাবার দিয়ে আসলো।
মায়ার কাছে ব্যাপারটা বড় অদ্ভুত লাগছে। কেমন ধোঁয়াশা লাগছে। এতটা মাস হয়ে গেলো তবুও কারো কাছ থেকে কিছুই জানতে পারলো না। কাজের মেয়েগুলোও খুবই অনুগত এদের। কখনো তাদের বিরুদ্ধে বা মহল সম্পর্কে কিছুই বলল না। নাকি তাদের কাছে সবই নরমাল।
মায়া আঞ্জুমান আরার কক্ষে প্রবেশ করলো বাহানা ধরে। কারণ পড়াশোনার জন্য সে নিজের রুমেই থাকে বেশি এখন। তার পড়া ও এসাইনমেন্টের কাজ না কথাকলে রাতে আঞ্জুমান আরার সঙ্গেই ঘুমায়।
মায়া বুদ্ধি খাটিয়ে বলল,
আন্টি কোন প্রয়োজন হলে জানাবেন।
তোমার পড়া আছে রাতে? জানতে চাইলো আঞ্জুমান।
নাহ আন্টি। আংকেল আসলো না বাসায়?
হুম আসছে। কিন্তু উনি উনার কক্ষেই ঘুমাবে। তুমি আমার সাথেই ঘুমাবে।
ওহ আচ্ছা। তাহলে ঘুমাবো। আংকেল কি আমার কথা জানে আন্টি? না মানে আংকেলকে দেখতে ইচ্ছে করছে?
জানে না। তবে দেখা হয়ে যাবে। তুমি এমন কিছু নয় যে ঘটা করে দেখা করিয়ে দিতে হবে।
কিঞ্চিৎ রাগ ঝেড়ে বলল আঞ্জুমান।
মায়া শংকিত অনুভব করলো। হোঁচট খেলো আঞ্জুমানের আচরণের রুক্ষ রূপ দেখে। অথচ কয়দিন আগেও তার সঙ্গে আঞ্জুমানের গলার স্বরে দরদ ছিলো। কোমলতা ছিলো,সহানুভূতি ছিলো। মায়া নিরব থেকে বেরিয়ে গেলো।
তার পরেরদিন মায়া কলেজে যাওয়ার সময় মূল গেইটে গিয়ে চরণ গতি মন্থর করলো। অচেনা একজন বয়স্কা সুঠামদেহী পুরুষকে দেখতে পেলো। লোকটি পরশের সঙ্গে কথা বলছে। মায়া পাশ কেটে যাওয়ার সময় তাকে সালাম দিলো।
সে সালামের জবাব নিয়েই অবাক চাহনি ফেলল মায়ার উপর। মায়াও একটু থামলো। পরশ নিজ থেকেই বলল,
মিয়াভাই, ওর নাম মায়া। বিপদে পইড়ে আমাদের বাড়িতে আছে। ভাবিজান ওরে আশ্রয় দিলো। কলেজে পড়ে। ছোটবাবু কলেজে ভর্তি করায়া দিলো।
মায়া কায়রুসের মুখপানে চাইলো।
আদুরে হাসি দিয়ে বলল,
আংকেল আমার অনেক ইচ্ছে ছিলো আপনাকে দেখার। আজ দেখলাম। ভালো লাগছে।কলেজ থেকে এসে আপনার সাথে গল্প করবো আংকেল। বলেই মায়া ছুটন্ত প্রজাপতির মতন কলেজের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।
চঞ্চল মায়ার কথার নম্রতা ও মাধুর্যতায় বিমোহিত হয়ে গেলো কায়রুস। কিন্তু তার বিস্ময়ের রেশ বিলীন হলো না অস্তমিত সূর্যের ন্যায়। সে পরশকে জিজ্ঞেস করলো,
এ কোন মায়া পরশ? মায়া মহলে মায়া? কিন্তু কিভাবে?
পরশ চিন্তাগ্রস্ত কন্ঠে সহমত প্রকাশ করলো। এবং বলল,
মিয়াভাই একটু অপেক্ষা করুন। দুইদিন বাদে ওর মা পার্মানেন্ট থাকতে চইলে আসবে। তখন খোলাসা হইতে পারবো। সত্য জানা যাবে।
ওর মা আসবে? এক আশ্চর্য সুরে বলল কায়রুস।
হুম ওর মা। সহজ করে বলল পরশ।
ওর মা কেন আসবে ?
ছোটবাবু বলল চইলে আসতে। যেন মেয়ের সান্নিধ্যে থাকতে পারে তাই।
শুনে কায়রুস থম মেরে রইলো। বিষয়টা তারকাছে সুবিধাজনক ঠেকল না। ভীষণ ঘোলাটে লাগছে ভোরের কুয়াশার ন্যায়।
মায়া কলেজ থেকে এলো বিকেলে। সন্ধ্যার পর কুমকুমকে দিয়ে মায়াকে ডেকে পাঠালো কায়রুস। মায়া খুশী খুশী মনে কায়রুসের কক্ষে প্রবেশ করলো। কায়রুস একথা ওকথা বলে মায়ার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলো। এক পর্যায়ে তার পরিবার সম্পর্কে জানতে আগ্রহ প্রকাশ করলো। মায়া আঞ্জুমান আরাকে বলা তার জীবনের গল্পটা হুবহু শুনালো কায়রুসকে। কায়রুস একটু স্বস্তিবোধ করলো কিছু একটা গভীরভাবে ভেবে।
জুবায়ের শাহেরকে ফোন দিলো। মায়ের প্রসঙ্গ টেনে পরপর চারজন ব্যক্তির মৃত্যুর সাথে মায়ার আগমনের সাদৃশ্য থাকতে পারে বলে অভিহিত করলো।
জুবায়ের মোবাইল রাখার পর শাহের ভেবে দেখলো জুবায়েরের বলাটা অমূলক নয়। সত্যিইতো তাই। মায়াকে নিয়ে এমন বিরূপ ধারণা তার মাথায়ই আসেনি কখনো। উল্টো মায়ার প্রতি অসীম দূর্বলতা কাজ করেছে। একটা টান অনুভব করেছে সবসময়।
তার কিছুক্ষণ বাদে শাহের মায়াকে ফোন দিলো। মায়ার পড়াশোনা থেকে শুরু করে শারীরিক অবস্থারও খবর জানলো। এবং জিজ্ঞেস করলো,
তোমার কোনরকম প্রবলেম হচ্ছে চলাফেরায়?
নাতো ছোটবাবু। সবকিছুই ঠিকঠাক আছে। তবে…
তবে কি বল হেজিটেশন ফিল না করে?
তবে কিছুদিন আগে পরপর তিনটা চিরকুট পেয়েছি আমার বালিশের নিচে। কিন্তু এখন আর পাই না। আরেকটা বিষয় হলো আপনাদের বাড়িতে আমি আসার পর চারজন মানুষ মারা গেলো। তাই ভাবলেই কেমন যেন লাগে।
দ্বিধাগ্রস্ত কন্ঠে বলল মায়া।
নাকি তুমি এদের সবাইকে মেরে ফেলছ?
ফোনের অপরপ্রান্তে হোঃহোঃহোঃ করে হেসে বলল শাহের।
মায়া থতমত খেয়ে গেলো এমন অপ্রত্যাশিত বাক্য শ্রবণ হতেই।
শাহের ফের বলল,
কি তব্দা খেয়ে উঠলে মনে হয়?তোমার কথার রেশ ধরেই মুখ ফসকে একথা চলে এলো।
মায়া পট করেই বলে ফেলল,
তাহলে কি আপনিও আমাকে চিরকুট দিতেন? নয়তো আপনি ঢাকা চলে যাওয়ার পর হতেই আর চিরকুট পাইনা কেন?
ধরো আমিই দিতাম। তাহলে কি তুমিই মারলে তাদের? স্বীকার করো ফেলো। আমি গোপন রাখবো। তোমার সুরক্ষা দিব।
কি বলছেন এসব অবান্তর কথাবার্তা? আর তা হলেও স্বীকার করে কেউ?
তাও রাইট। আচ্ছা ফান করলাম। তো পেতে চাও অমন চিরকুট?
নাতো।
কেন চাও না ?
আজব তো ছোটবাবু। কি ভুলভাল বকছেন? রাখি। আল্লাহ হাফেজ।
ওকে। বাই।ভালোথেকো।
মায়া আশ্চর্য হয়ে গেলো তার প্রতি শাহেরের আবেগপ্রবণতা দেখে। যা সে এর আগে ক্ষুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেনি। ভেবেছিলো আর বুঝেছিলো মানবিকতা ও ঔদার্যতার জায়গা থেকেই শাহের তারজন্য এসব করছে। এখন টের পেলো প্রেক্ষাপট ব্যতিক্রম। তবে শাহেরের এই ভুল অনুভব ও অনুভূতিকে কিছুতেই প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। দূরে দূরেই রবে সে৷ একান্ত আবশ্যক না হলে শাহেরের সাথে কথা বলবে না। বাড়ি আসলে সামনে যাবে না।
সময়টা শেষসন্ধ্যা। গ্রীষ্ম ঋতু। মাস চৈত্র। কাঠফাটা গরম পড়েছে প্রকৃতিজুড়ে। ইলেক্ট্রিসিটি চলে গিয়েছে৷ জেনারেটর ও আসছে না। সবাই মহলের বাইরে চলে গিয়েছে হাওয়ায় গা জুড়াতে। আঞ্জুমান আরা মায়াকে ডেকে বলল,
জুবায়েরের রুমে লন্ঠন জ্বেলে দিয়ে আসো তো মায়া। দাসীরা সবাই বাইরে মনে হয়। কত যে ডাকলাম। তবুও শুনল না। তোমার মা কবে আসবে?
আচ্ছা আন্টি এখনি যাচ্ছি। আম্মা দুই তিনদিনের মাঝেই চলে আসবে। আমি বাসস্টপেজ থেকে গিয়ে নিয়ে আসব।
ওহ আচ্ছা ঠিকাছে।
মায়া জুবায়েরের রুমে প্রবেশ করলো আলো নিয়ে। জুবায়ের বিছানায় শোয়া ছিলো। মায়ার উপস্থিতি টের পেয়ে উঠে দাঁড়ালো। বলল,
থ্যাংক ইউ মায়া। বসো। একটু কথা আছে।
মায়া বসল। জুবায়ের দুপা এগিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।
মায়া চোখ কপালে তুলে ফেলল। ঘাবড়ে গেলো। ভয়ার্ত চোখে প্রতিবাদের কন্ঠে বলল,
ভাইয়া দরজা বন্ধ করলেন কেন?
জুবায়ের মায়ার শরীর ঘেঁষে দাঁড়ালো। একহাতকে তার মুঠোবন্ধী করে নিলো। এবং মায়ার নরম অধর যুগলের ভাঁজে আঙ্গুল বুলাতে বুলাতে বলল,
তোমাকে ভালোলাগে মায়া। তুমি যেন গন্ধ ছড়ানো সুবাসিত বেলী।একটু ঘ্রাণ বিলাও আমার মাঝে। তোমার আমার এই গোপন অভিসার না কেউ জানবে। না কেউ শুনবে। এই চারদেয়াল ভেদ করে শব্দগুলোও বাইরে যাবে না।
মায়া চিৎকার দিতে গেলে যুবায়ের তাকে চিৎ করে বিছানার উপরে শুইয়ে দিলো। তার বলিষ্ঠ হাতের নিচে চাপায় পড়ে গেলো মায়ার কোমল মুখখানি। সে মায়ার শরীরে নিবিড় আলিঙ্গন দিতে গিয়েও কেন জানি পারছে না। বারবার ব্যর্থ হচ্ছে ঝড়ের কবলে পড়া দিক হারানো নাবিকের ন্যায়।
মায়া জুবায়েরের হাতে সজোরে কামড় বসিয়ে দিলো। পরক্ষণেই হন্তদন্ত হয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
সেই রাতে জুবায়ের অসুস্থ হলো। ভোর না হতেই তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। জ্বর, গা জ্বালাপোড়া, অসহ্য রকমের শরীর ব্যথা তিনদিন ধরে। কিছুতেই সারছে না। এভাবেই হাসপাতালের বিছানায় থেকে জুবায়ের মারা গেলো। তার আগে পরিবারের সবাইকে সে জানালো তার মৃত্যু হলে একমাত্র মায়াই দায়ী হবে। দ্বিতীয় কেউই নয়।
চলবে…
#মায়া_মহল (১১) #রহস্য
কলমে #রেহানা_পুতুল
সেই রাতে জুবায়ের অসুস্থ হলো। ভোর না হতেই তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। জ্বর, গা জ্বালাপোড়া, অসহ্য রকমের শরীর ব্যথা তিনদিন ধরে। কিছুতেই সারছে না। এভাবেই হাসপাতালের বিছানায় থেকে জুবায়ের মারা গেলো। তার আগে পরিবারের সবাইকে সে জানালো তার মৃত্যু হলে একমাত্র মায়াই দায়ী হবে। দ্বিতীয় কেউই নয়।
জুবায়েরের এমন আকস্মিক মৃত্যুতে গোটা মায়ামহল শোকপুরীতে নিমজ্জিত হলো। মহলের বিশাল আঙ্গিনা জুড়ে কেবলই মানুষের ঢল আর শত প্রশ্ন। আজ নেই কোন পাখির কলরব। বৃক্ষ শাখার পাতাগুলোও কেমন ঝিম মেরে আছে। বাতাস বইছে না। তাদের দুলুনিও বন্ধ। মধুমঞ্জুরিতে শোনা যাচ্ছে না ভ্রমরের গুঞ্জন। ঘরের কোনে ডালিম গাছের ডালে নিত্য বসে চিউ চিউ রবে ডাকা চঞ্চল চড়ুইটিও আজ বড় নিশ্চুপ হয়ে আছে। কাননে ফোটেনি একটি ফুলও। ফুলে ফুলে উড়াউড়ি করছেনা রঙিন প্রজাপতির দল।
পুত্রশোকে আঞ্জুমান আরা বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। থেকে থেকে কেঁদে উঠছেন পিতা কায়রুস। এক গোপন অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে তার অন্তরখানি।
গ্রামে চলে এলো মৃতের ছোটভাই শাহের । ভাই হারানোর বেদনায় সেও বুক চাপড়ে আহাজারি করছে। মর্জিনা,কুমকুম,রুস্তম, পরশ,গাড়ির ড্রাইভার সবাই শোকে বিহব্বল।
আঞ্জুমান আরা প্রায় উম্মাদ। হাসপাতালের শয্যায় বলা জুবায়েরের কথাটা কালক্ষেপণ হলো না তার কর্ণকুহরে পৌঁছাতে। একদিকে লা*শ দাফনের প্রস্তুতি। আরেকদিকে আঞ্জুমান আরার রক্তচক্ষুর কড়া নির্দেশ মায়াকে বন্ধী করার জন্য। রুস্তম মায়াকে টেনে হিঁচড়ে নির্জন একটি কক্ষে বন্ধী করলো। আঞ্জুমান আরা নিজ হাতে মায়াকে শাস্তি দিলো। চুলের মুঠি ধরে শরীরের সমস্ত শক্তি ক্ষয় করে এলোপাতাড়ি মারলো। এবং জিজ্ঞেস করলো,
কি চাস তুই বল? কাল নাগীনি কোথাকার? একে একে সবাইকে মেরে ফেলছিস। কেন আমার পুত্রকে কেড়ে নিলি? বল? নয়তো জ্যান্ত পুঁতে ফেলব আমি। তোর সবকিছু বন্ধ। নাওয়া,খাওয়া,কলেজ সব। এই কক্ষেই তুই পঁচে পঁচে মরবি।
মায়ার আর্তচিৎকার রুমের চারদেয়াল অতিক্রম করে বাইরে গেল না। কেউ শুনতে পেল না। সবাই জুবায়েরের নিথর দেহটা নিয়ে ব্যস্ত।
মায়া বারবার আঞ্জুমান আরার পায়ে পড়লো। নিজের প্রাণ ভিক্ষা চাইলো।
আন্টি আমি কিছুই জানিনা। আল্লার কসম খেয়ে বলছি। আমাকে ছেড়ে দেন। আমি এখনই আপনাদের বাড়ি থেকে চলে যাবো। আমার আম্মার কাছে যেতে দিন আমায়। আম্মাগো…আমাকে বাঁচান।
আঞ্জুমান আরা মায়ার কথায় কর্ণপাত করল না। টলতে টলতে দেয়াল ঘেঁষে মেঝেতে দপ করে বসে পড়লো। রুস্তমকে দিয়েও মায়াকে বেধড়ক পিটালো। মায়া আধমরা হয়ে নির্জিবের মতো পড়ে রইলো মেঝেতে। মায়ার গোঙানির অস্ফুট আওয়াজ অশরীরী আত্মার মতন দেয়ালে ভেদ করে কেবল শূন্যে মিলিয়ে গেলো।
দাফন কার্য সম্পন্ন হলে শাহের মায়াকে এদিক সেদিক খুঁজলো। তন্নতন্ন করে সব খুঁজে কোথাও পেল না। নিরাশ হয়ে ফিরে এলো মহলের অন্দরে। একে একে সবাইকে জিজ্ঞেস করেও মায়ার কোন হদিস পেল না। মায়ের রুমে গিয়ে ধীর গলায় জানতে চাইলো,
আম্মা মায়া কোথায়?
মেরে ফেলেছি।
ওকেতো প্রমাণ নিয়ে আমিই মারবো আম্মা।
কিসের প্রমাণ চাস আর তুই? তোর নিজের মায়ের পেটের আপন ভাইকে সে মেরে ফেলল। কতজন জলজ্যান্ত মানুষকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিলো। আমার ছেলের কি শত্রুতা ওই ফকীরনির বাচ্চার সাথে? মিথ্যা বলবে কেন আমার ছেলে?
আমি কি বলছি আমার ভাই মিথ্যা বলছে?কিন্তু রহস্যটাতো মায়ার থেকে উদঘাটন করতে হবে। নয়তো একে একে আমরাও মারা পড়বো আম্মা।
কাতর স্বরে মায়ের পিঠে হাত রেখে বলল শাহের।
আঞ্জুমান আরা কাত হয়ে পড়ে রইলো। আর কিছুই বলতে পারল না। বিড়বিড় করে শুধু জুবা জুবা বলতে লাগল। শাহের উঠে গেলো ক্লান্ত পায়ে। কি থেকে কি যে ঘটে গেলো। সবই যেন অবিশ্বাস্য! দুঃস্বপ্ন! অলৌকিক!
শাহের মায়াকে বন্ধী করে রাখা রুম খুঁজে পেলো মহলের শেষমাথায়। দেখলো বাইরে থেকে তালা দেওয়া। কিন্তু চাবি তার কাছে নেই। এই রুমের চাবি থাকে আঞ্জুমান আরার কাছে। ব্যক্তিগতভাবে সে কাউকে শাস্তি দিলে এই রুমেই বন্ধী করে শাস্তি দেয়। বিশেষ করে দাসীদের। শাহের রুস্তমকে ডেকে আনলো তালা খুলে দেওয়ার জন্য। রুস্তম ভয়ে কাঁচুমাচু করছে। তালা খুলতে চাচ্ছে না।
বলল,
ছোট বাবু,
বেগম সাহেবা যে মানা করলো।
শাহের রুস্তমের গলা টিপে ধরলে রুস্তম নিজের কোমরে গুঁজে থাকা চাবিটি হাতে নেয়। তালা খুলে দেয়। শাহের তার হাত থেকে চাবিটি কেড়ে নিয়ে তাকে চলে যেতে নির্দেশ দেয়। চাবি রেখে দেয় নিজের হাতে। ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। দেখে মায়ার দুচোখ বন্ধ। অবশ দেহে পড়ে আছে মেঝেতে মৃতের ব্যয়। তার দুঠোঁট গলিয়ে চুইয়ে চুইয়ে পড়া রক্তগুলো জমাট বেঁধে গিয়েছে। শরীরের অনাবৃত অংশগুলোতে কালসিটে দাগ লক্ষনীয়। মায়ার বুকের ওড়না পড়ে আছে একপাশে। তাই না চাইলেও শাহেরের নজর গেলো মায়ার খোলা ঘাড়ে ও বুকে। ফর্সা অঙ্গে কালচে লম্বাটে দাগগুলো ভেসে আছে মরা মাছের ন্যায়।
শাহের হাঁটু ভেঙ্গে বসলো মায়ার শিয়রের পাশে। মায়ার মাথায় হাত রাখতে গিয়েও থেমে গেল শংকা অনুভব করে। পাছে সেই না মরে যায়। তাই শাহের আস্তে করে মায়া বলে বার তিনেক ডাকলো। মায়া নিবু নিবু প্রদীপের মত করে ঘোলাটে চোখে শাহেরের দিকে চাইলো। মায়ার দুচোখ ভর্তি ভয় ও আতংক দৃশ্যমান।
তোমার আঘাতের স্থানগুলোতে মলম দিতে হবে। আমি নিয়ে আসছি।
নিরস ভঙ্গিতে বলল শাহের।
মায়া এক হাত মেলে শাহেরের পা ছুঁয়ে ধরল। মিনতি মাখা স্বরে হাজারো আকুতি নিয়ে অনুরোধ করে বলল,
ছোটবাবু লাগবে না। আমার ভাগ্যে যদি আপনাদের হাতে মরণ থাকে,তা রুখবার ক্ষমতা কারো নেই। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। নয়তো কেন এতসব কিছু হচ্ছে আমি আসার পর হতেই। আপনি বেগম সাহেবার কাছ হতে আমার মোবাইলখানা নিবেন।
তোমার মোবাইল আম্মা নিয়ে নিলো?
হুম।আমার আম্মা কাল আপনাদের বাড়িতে আসবে। আমি বাস স্টপেজে গিয়ে নিয়ে আসার কথা। একটু ফোন করে বলবেন যেন কিছুতেই না আসে। আমিই বেঁচে থাকলে চলে আসব আম্মার কাছে। নয়তো আম্মা ফোন বন্ধ পেয়ে চিন্তায় মরে যাবে।
আচ্ছা ঠিকাছে। তা না হয় মানলাম। কিন্তু তোমার মলমের জরুরী রয়েছে। বলেই শাহের দপদপ পায়ে বেরিয়ে গেলো। অল্প সময়ের ব্যবধানে ফিরে এলো।
ঘাবড়ানো মনে শাহের মায়ার মাথাকে তুলে নিজের কোলের উপর আনলো যত্ন করে। মায়া ওড়না খুঁজছে উদাম বুক ঢাকার জন্য। শাহের ওড়না হাতে দিয়ে বলল,
এটার আর প্রয়োজন নেই এখন। কারণ আমিতো তোমাকে দেখেই গিয়েছি। ব্যপার না মায়া। পরক্ষণেই সে চট জলদি করে মলম লাগিয়ে দিলো মায়ার ক্ষতস্থান গুলোতে। মাথা নামিয়ে দিলো। মায়ার পায়ের পাতার কাছে গেলো। তার দুই পায়ের সেলোয়ার তুলে নিলো হাঁটু অবধি। মলম লাগিয়ে দিলো পুরো উদাম পায়ে। পেটের থেকে কামিজ উপরে তুলতে গেলে মায়া শাহেরের হাত চেপে বাঁধা দিলো। শাহের মৃদু ধমকে বলল,
তুমি ভেবে নাও এখন ডাক্তারের কাছে আছো। তোমার চিকিৎসা জরুরী। দেখবে ইজি লাগবে। ভালোলাগবে।
মায়া মনে মনে তাই ভাবল। তার নরম পেটের ক্ষত স্থানে মলম লাগানোর সময় মায়া যন্ত্রণায় কুঁকিয়ে উঠলো। শাহেরের হাত খামচি দিয়ে ধরলো।
শাহের বলল,
তুমি থাকো। তোমার জন্য খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি। খেয়ে নিবে কিন্তু। তোমার সুস্থ হওয়া দরকার। রহস্য উম্মোচন হওয়া ভীষণ জরুরী।
মর্জিনা বড় এক থালায় করে মায়ার জন্য ভাত ও সালুন সাজিয়ে নিয়ে এলো। শাহের ফের মায়ের রুমে গেলো। দেখলো নিকট আত্মীয় স্বজনেরা ঘিরে আছে তার মা আঞ্জুমান আরাকে। মায়ের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে মিথ্যে বলে মায়ার মোবাইল নিয়ে নিলো। নিরিবিলি একদিকে সরে গেল। ফোনকল দিলো মায়ার মা তফুরাকে। বলল,
মায়া একটু অসুস্থ। আমি ছোটবাবু। চিনতে পেরেছেন আশাকরি?
হ বাবা তোমারে চিনতে পারছি। মায়ার মুখে তোমার বহুত কীর্তন শুনছি।
কাল দুপুরে আপনাকে পরশ নামের একজন মুরুব্বী গিয়ে নিয়ে আসব।
তফুরা স্বস্তির দম ছেড়ে বলল,
আলহামদুলিল্লাহ। আইচ্ছা বাবা।
ফোনকল কেটে শাহের গেলো পিতা কায়রুসের রুমে। কায়রুস বিমূঢ় হয়ে চেয়ে আছে দেয়াল ঘড়িটার দিকে। শাহের বাবা বলে ডেকে উঠলে কায়রুস সম্বিৎ ফিরে পেলো। সে নির্বিকার।পাথরের ন্যায় জমে আছে তার সমস্ত বিবেকবুদ্ধি।
শাহের মায়া নামের মেয়েটি সম্পর্কে যা শুনলাম, তা নিয়ে তোমার কোন অভিমত রয়েছে?
অবসাদ কন্ঠে জানতে চাইলো কায়রুস।
আগে ছিল না বাবা। কিন্তু ভাইয়ের মৃত্যুর পর এখন আমিও সন্দিহান এই মেয়েটার বিষয়ে। আম্মা তাকে মেরে রক্তাক্ত করে ফেলেছে। সারা গায়ে জখম। আমি গিয়ে মলম দিয়ে আসলাম। নয়তো সে কথা বলতেও পারবে না। কাল তার মা আসবে। সকল রহস্য তাকেই পেলে উদঘাটন হবে।
ঠিক বলছিস বাবা। ব্যথিত স্বরে বলল কায়রুস।
তার পরেরদিন দুপুরে মায়ার মা তফুরা এলো বাস স্টপেজে। পরশ দাঁড়িয়ে আছে।মায়ার মোবাইল তার হাতে দিলো শাহের। যেন কন্টাক্ট করতে সুবিধা হয়।
মায়ার মা রূপী নারীটিকে দেখে পরশ স্তব্দ হয়ে গেলো। এতো তার চেনা শিশু মায়ার মা নয়। এই মায়া যদি আঠারো বছর আগের সেই মায়া হয়,তাহলে এর কাছে কিভাবে এলো? আর যদি এই মায়া সেই মায়া না হয়,তাহলে কে এই মায়া? নাকি এই মেয়ে মায়ার অশরীরী আত্মা?
চলবে…