মায়া মহল পর্ব-০৯

0
106

#মায়া_মহল ( ৯) #রহস্য
কলমে #রেহানা_পুতুল
এই ছেমরি আওনের পর মহলে আর কোন,চোর,গুপ্তচর, ডাকাত প্রবেশ করতেছে না।

হুম খেয়াল করলাম। তবে তুমি এত নিশ্চিত হইয়া ক্যামনে এসব কইতাছো রুস্তম?

নিস্তেজ কন্ঠে জানতে চাইলো মায়া মহলের সবচেয়ে পুরাতন ভৃত্য পরশ চাকলাদার।

রুস্তমের দৃষ্টিতে অজানা আতংকের গভীর ছাপ। মুখজুড়ে দুশ্চিন্তার গাঢ় প্রলেপ। সে নিজের গাল ভরা আধাপাকা দাঁড়িতে আঙ্গুল বুলিয়ে নিয়ে বলল,

হারিস যহন মাঝরাইতে শরীরের ব্যথায় গড়াগড়ি করতাছিলো,আমি জানতে চাইলাম উলটাপালটা কিছু খাইছে কিনা?

সে অসহনীয় যন্ত্রণায় কোঁকাতে কোঁকাতে কইলো,

না ভাই। খাইনাই। তবে মায়া নামের মাইয়াটার লগে একটু রাগারাগি করছিলাম। কারণ সে চুরি কইরা ফকির দুজনরে অনেকগুলা চাইল দিছিলো।

আমি জিগাইলাম তারপর?

সেদিন সন্ধ্যারদিকে সে মহলের পিছনে নিরিবিলি হাঁটছিলি। আমার ভিতরে তারে দেইখা বদ মতলব জাগে। অবশ্য এটা আগেও হইছে। আরেকদিকে জিদও আছে তার উপর। মানা করার পরও দুইদিনের মাইয়া আমার কথার অমান্য করলো। পাত্তাই দিল না আমারে। তাই একলা পাইয়া
হাতের গামছা দিয়া তার চোখমুখ বাঁইধা ফেলি। তারপর ঝোপের ভিতরে ঢুকায়া ফালায় মায়ারে। কিন্তু কামের কাম কিছুই করতে পারিনাই। মাত্র জড়ায়া ধরছিলাম। তখন জরিনা মায়া আপা বলে জোরে জোরে ডাকতে লাগলো। আমি মায়ারে ছাইড়া বাগানের ভিতরে পলায়া গেলাম।

এরপর আর কিছু বলতে পারেনাই হারিস। দম বন্ধ হয়ে গ্যালো।

রুস্তমের মুখে হারিসের মৃত্যুর বিবরণ শুনে পরশ আগের মতই রইলো ভাবলেশহীনভাবে। তার মাঝে কোন অবাকতার লেশ নেই। বিশেষ হেলদোলও দেখাল না সে। যেন স্বাভাবিক কিছুই ঘটেছে। সে ঘোলাটে মরা চোখে চেয়ে আছে মহলের একটি নিদিষ্ট স্থানের দিকে। সাদা রঙের দেয়ালে খোদাই করে লাল টকটকে রঙ দিয়ে লেখা মায়া মহল নামটি।

প্রলম্বিত স্বাস ছেড়ে পরশ উঠে গেলো।

দেখতে দেখতে বছর পেরিয়ে গেলো। মায়া কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে উঠে গেলো। কলেজের বিভিন্ন স্যারের কাছে কাছে একাধিক বিষয়ে কোচিং করতে লাগলো। তাই ইদানীং আঞ্জুমান তার তেমন সাহচর্য পাচ্ছে না। এতে আঞ্জুমানের যৎকিঞ্চিত রাগ হলেও তা অপ্রকাশিত রয়ে যায়। কারণ মায়ার প্রতি তার ছোট পুত্র শাহেরের দূর্বলতা তার চোখে আজকাল দৃশ্যমান।

কলেজে একদিন মায়ার অভিভাবক ডাকা হলো। জুবায়েরকে যেতে হলো মায়ার সঙ্গে কলেজে। কেননা শাহের ঢাকায় চলে গিয়েছে। সেখানে তাদের বড় ব্যবসা রয়েছে তাই। এমনিতেই সে এবার অন্যবারের তুলনায় অনেক বেশী বাড়িতে ছিলো নানান জরুরী কাজ দেখিয়ে। তবে তা সব ছিলো গৌণ। মূখ্য ছিলো মায়া নামে মেয়েটি।

জুবায়ের অধ্যক্ষের রুমে গেলো।

তিনি জুবায়েরকে জিজ্ঞেস করলেন,

রুখসানা আখতার মায়া আপনার কেমন খালাতো বোন? আপনার ছোটভাই এই পরিচয়েই কলেজে এডমিট করিয়েছিলো তাকে।

জুবায়ের বিব্রতবোধ করতে লাগল। চিন্তা করলো,

খালাত বোন হিসেবে যেহেতু এরা জানে। তাই বলতে হবে এখন আমাকেও। নয়তো শাহের আমাকে ছাড়বে না। জুবায়ের বলল,

হ্যাঁ স্যার। মায়া আমার দূর সম্পর্কের এক খালাতো বোন। কোন সমস্যা?
রেজাল্ট খারাপ হয়েছে কোন সাবজেক্টে?

অধ্যক্ষর পাশে সহকারী শিক্ষকগণ ছিলেন। একজন বলে উঠলেন,

নাহ। সেসব ঠিক আছে। প্রবলেম অন্যখানে। আমরা তাকে টি.সি দিয়ে দিতে চাই। আমরা খবর পেলাম মায়া মেয়েটা আপনাদের বাড়িতে আসার পর হতেই নাকি একে একে মানুষ মারা যাচ্ছে। এবং সব পুরুষ মানুষ। তাই আমরা ওকে কলেজে রাখা সমীচীন মনে করছি না। কখন কি ঘটে বলা যায় না। একটা সুপ্ত ভয়ও কাজ করছে আমাদের মনে।

হঠাৎ অপত্যাশিত কিছু শুনে জুবায়ের হা হয়ে চেয়ে রইলো তাদের মুখের দিকে। অধ্যক্ষ তাদের কথার সুরে সুর মিলিয়ে বলল,

হ্যাঁ। উনারা ঠিক বলছে। আমাদের বিদ্যালয়ে শতশত ছাত্রছাত্রী অধ্যায়নরত। কিছু ঘটে গেলে কারো সেই দায়ভার কে নিবে?

জুবায়ের তাদের বলল,

একটু অপেক্ষা করুন। বলে সে শাহেরকে ফোন দিলো। ডিটেইলস বলল। শাহের জুবায়েরের মোবাইল দিয়ে অধ্যক্ষর সঙ্গে কথা বলল। বিনম্র ভাষায় অনুরোধ করলো।

স্যার প্লিজ, সামনে ওর ফাইনাল এক্সাম। তারপরতো সে কলেজ ছেড়ে চলেই যাচ্ছে। এখন তাকে নিয়ে কোথায় ভর্তি করাবো? এত কঠিন হবেন না। আপনারা অমূলক ভাবছেন। আমাদের বাড়ির লোকদের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। আমি কথা দিচ্ছি, যদি কোন ইনসিডেন্ট ঘটে তার সম্পূর্ণ দায়ভার আমার। আপনারা চাইলে আমার কথাগুলো রেকর্ড করে রাখতে পারেন। আমার উপর আস্থা রাখুন স্যার।

শাহেরের মোলায়েম কন্ঠে স্যার প্লিজড হয়ে গেলো। তারপর বলল,

আচ্ছা। আপনার কথার উপর ডিপেন্ড করেই ওকে টি.সি দিলাম না কিন্তু।

কলেজের মাঠ পেরোতে পেরোতে জুবায়ের মায়াকে নিয়ে ভাবছে। স্যারদের বলাটা ভুল নয়। সত্যিইতো। মায়া আসার পর একে একে কয়জন মানুষ মারা গেলো। ঝট করেই তার মনে পড়ে গেলো কয়েকমাস আগে বলা কুমকুমের কথাটা। বাতেন কুমকুমকে কি বলতে গিয়েও বলতে পারল না? কি কথা? যা কুমকুম শুনলেও বাতেনকে ভুল বুঝতো। নাহ হেলায় ফেলায় ছেড়ে দিলে হবে না। বিষয়টা এবার সিরিয়াসলি নেওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে।

জুবায়ের বাড়িতে গিয়ে বিষয়টা মাকে জানালো। আঞ্জুমান আরা ঘাবড়ে উঠলো। উৎকন্ঠা নিয়ে পুত্রকে বলল,

কি বলিস এসব? হায় আল্লাহ! দুদিন পরতো মায়ার মা এসে উঠবে এখানে। শাহের বলল তাকে আসতে। আমিও সায় দিলাম অবশ্য। আমাদের এতবড় বাড়ির এককোনে এমন দশটা মায়া ও মায়ার মাকে রাখা যায়। পালা যায়। কিন্তু এখনতো দেখি পরিস্থিতি বেগতিক। মায়াকে মহল থেকে তাড়ানোর ফন্দী করো বাবা।

আম্মা শোনেন,আপনার ছোট ছেলের জন্য তা সহসা পারা যাবে না। কৌশলে যেতে হবে।

হুম তাই কর।

জুবায়ের নিজের রুমে গিয়ে ভাবলো,

তাড়ানোর আগে এত আকর্ষণীয়,কমনীয়, সুবাসিত,পেলব অঙ্গের ফুলটার নির্যাস নিতে হবে নিংড়ে নিংড়ে। বার কয়েক নিবো। তখন নিজেই সম্ভ্রম হারানোর ভয়ে মাকে নিয়ে ভাগবে। ব্যাস। সাপও মরবে লাঠিও ভাঙ্গবে না। খেলা ফাইনাল। এখন কেবল সেই সিচুয়েশন ক্রিয়েট করতে হবে।

______

একদিন ভর দুপুরে মায়া দুলে দুলে হেঁটে বাড়ির পিছনের দিকে গেলো। চোখ পড়লো পথের ধারের আতাফল গাছের উপরে। পাকা আতাফল দেখে সে লোভনীয় চোখে তাকিয়ে রইলো। এমন গাছপাকা আতাফল সে অনেক আগে দেখেছে নানাদের বাড়িতে।খেতে গিয়ে সে কি লংকাকাণ্ড বাঁধলো সমবয়েসী খেলার সাথীদের সঙ্গে। অভিমান করে খেতেও পায়নি সেদিন।
এখন একটা আতাফল পাড়ার জন্য সে বিড়ালের মতো ছোঁকছোঁক করতে লাগল। এদিক সেদিক খুঁজে বাঁশের একটা মোটা কঞ্চি হাতে নিলো। ফল পাড়ার উপযোগী করে তুললো কঞ্চিটিকে। এবার মায়া নিজ হাতে আতাফল পাড়ার চেষ্টা করছে খাওয়ার জন্য। বাগানের ওপাশ হতে তা দেখতে পেলো পরশ। তৎক্ষনাৎ সে ভারি ভারি পা ফেলে এগিয়ে এলো মায়ার নিকট।

নম্র হেসে বলল,

দেন আমি পাইড়া দিতাছি। আপনি পারবেন না।

মায়া সরে দাঁড়ালো। পরশ মাথা উঁচিয়ে আতাফল পাড়তে পাড়তে বলল,

আম্মাজানের মন বেশি ভালো মনে হচ্ছে? পরিক্ষার কোন ফল প্রকাশ হলো নাকি?

নাহ পরশ চাচা। আমার আম্মা আসবে এই বাড়িতে। আমার কাছে। একবারের জন্যই চলে আসবে। মা মেয়ে একসঙ্গেই থাকতে পারব এবার। তাই মন মেজাজ ফুরফুরে আছে।

শুভ্র হাসি দিয়ে বলল মায়া।

মুহূর্তেই পরশের মুখের হাসি উবে গেলো কর্পূরের ন্যায়। বিমূঢ় হয়ে বলল,

তোমার আম্মা?

মায়া আতাফল কোঁচায় নিতে নিতে ভ্রুক্ষেপহীনভাবে জবাব দিলো,

হ্যাঁ আমার আম্মা। কেন চাচা? কোন সমস্যা?

নাহ। এমনিই বললাম।

মায়াকে আতাফল পেড়ে দিয়ে চলে গেলো মায়া মহলের ভৃত্য পরশ।
সে ভাবনার অথই সমুদ্রে তলিয়ে গেলো,

আমি কি তাহলে ভুল ধারণা পোষণ করলাম? মায়ার মা কোথা হইতে আইলো? সেতো বাঁইচা নেই?

সেই সন্ধ্যায় কায়রুস গ্রামে এলো। অর্থাৎ আঞ্জুমানের স্বামী এবং শাহের ও জুবায়েরের বাবা। অসুস্থ শরীরে গাড়ি থেকে নেমে নিজের কক্ষে চলে গেলো কায়রুস। এতটা মাস পরে বাড়িতে তার আগমন ঘটলো। তবে কেউই খুশী হল না তার আসাতে।

কিন্তু মায়া ভীষণ খুশী হলো। এত সুন্দর বাড়ির কারিগরকে আজ দেখতে পাবে বলে।

পরশ বিড়বিড় করে বলল,

মিয়া ভাই, বড় অসময়ে আপনি পা রাখলেন মায়া মহলে। বড় অসময়ে।

চলবে…