মাশুল পর্ব-০২

0
171

#মাশুল (দ্বিতীয় পর্ব)।

সবসময়ই স্বীকার করি পুরোপুরি আমার দোষেই শিলার সাথে আমার প্রায় পাঁচ বছরের সম্পর্কটা শেষ হয়ে গেলো। আমি ই এই গল্পের ভিশেন। শিলা হয়তো এক প্রকার বাধ্য হয়েই আর্মি অফিসারকে বিয়ে করে ফেলে, হয়তো শেষ মুহুর্তে আমার প্রতি তার অসীম ঘৃণাটাও ছিল! ইনোসেন্ট ঐ মেয়েটা যে পরিস্থিতির শিকার, এটা আমার ভালো করেই জানা।

এরপর আর আট দশটা ব‍্যর্থ প্রেমিকের মতো আমার জীবনটাও একই নিয়মে চলে যেতে পারতো! পাশ করে চাকুরী নিয়ে বিয়ে থা করে সংসার নিয়ে ব‍্যস্ত হয়ে যেতে পারতাম, শিলার মতো করেই অন‍্য কারো সাদে। শিলাও স্বাভাবিক নিয়মে ঘরকান্না চালিয়ে যেতো, স্বামী সন্তানের ব‍্যস্ততার মধ‍্য দিতে। কিন্তু প্রকৃতি মাঝে মধ‍্যে খুবই নিষ্ঠুর, আমাদের দুজনের কাউকেই কিন্তু স্বাভাবিক জীবনের নিয়মের মধ‍্যে রাখেনি। নিষ্ঠুর একটা খেলা খেলে গেল, এখনো যাচ্ছে। গত দশ বছর ধরে, দুজনকে নিয়েই এক নিষ্ঠুর খেলা। আমরা দুজনেই যে বড়ই দূর্ভাগা।

বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর শিশা মাস্টার্সটা আর কন্টিনিউ করেনি। পুরোদস্তুর গৃহিনী! সত‍্যি বলতে কি, বিয়ের পর শীলার সাথে আমার আর কখনো দেখা হয়নি, এমনকি ফোনে কোন কথাও না!

প্রায় বছর ছয়েক আগে একবার ওকে ফেসবুকে খুঁজে পেলাম ।তবে যোগাযোগ করার সাহস পাইনি। ওর প্রোফাইল ফ‍্যামিলি পিকচারটা দেখে বুকটা হাহাকার করে উঠলো। ওর হ‍্যাসবেন্ড শিহাব আর একমাত্র মেয়ে আরিয়ানাকে আমি সেদিনই প্রথম দেখেছিলাম, ঐ ছবিটাতে!

আপনাদের নিশ্চয় এরই মধ‍্যে আমার সম্পর্কে জানার আগ্রহ তৈরী হয়েছে। এখন কি করছি? পরবর্তীতে কোন সম্পর্কে জড়িয়েছি কিনা? এখনই বা কি চিন্তা করছি? এই সব আর কি!

তাইতো সংক্ষেপে এবার আমার জীবনের গল্প বলছি, প্রিয়তমার বিয়ে হয়ে যাবার পরের সময়টা থেকে।

কিছু বুঝে উঠার আগে, এভাবে হঠাৎ শিলার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছিলাম। ওর বিয়েটাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারিনি, আজো পযর্ন্ত নয়! প্রতিদিনই এই মেয়েটাকে খুব করে মনে পড়ে। ওর প্রতি প্রচ্ছন্ন ভালোবাসা থাকার কারণেই হয়তো বিয়েতো দূরে থাক, কখনো অন‍্য কোন মেয়ের প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ তৈরী হয়নি!

মূল গল্পে ফিরছি।

শিলার বিয়ে হয়ে যাওয়ার খবরটা আমাদের ক্লাসমেট সামিনাই আমাকে প্রথম জানায়। সামিনা আর শিলা প্রীতিলতা হলে থাকতো, ওদের ভীষণ সখ‍্য। খবরটা শোনার পর থেকেই অনেকদিন অপ্রকৃতস্হ ছিলাম। বারবার শিলাকে নিয়ে কাটানো সুন্দর মুহুর্তগুলোর কথাই মনে পড়ে গেল। নিজের মধ‍্যে একটা চাঁপা অপরাধবোধে, শিলার নিজে থেকে দেওয়া বিয়ের প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দেওয়ার জন‍্যই।

তবুও ক্ষীণ একটা আশায়, শিলা হয়তো সহসাই ক‍্যাম্পাসে ফিরে আসবে, মাস্টার্স শুরু করতে। আবারো ওর সাথে আমার দেখা হবে! ক্ষমা চেয়ে নিব, এটাও ভেবে রেখেছিলাম। না, মেয়েটা আর কখনোই ক‍্যাম্পাসে আসেনি! হয়তো আমার মতো কাপুরুষকে ওর আর দেখার আগ্রহ ছিল না বলেই।

শিলা ছাড়া আমার জীবনটা সত‍্যই অসহনীয় ঠেকলো! একটা সময় পর জাহাঙ্গীরনগরের পরিচিত পরিবেশে আমার দমবন্ধ হয়ে আসতে লাগলো! সবার চোখেই আমার দিকে দেওয়া করুনার দৃষ্টি, অবশ‍্য মুখে কেউই কিছু বলতো না! সবমিলিয়ে দেশে আর মন টিকছিল না।

মাস্টার্স শেষ করে, তড়িঘড়ি করে নির্বাসনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আয়ারল্যান্ডে চলে এলাম ইউনিভার্সিটি অব লিমেরিকের ক‍েমিক‍্যাল সাইন্সের স্কলারশিপের সুযোগটা আসতেই, দ্বিতীয়বার চিন্তা না করেই লুফে নিলাম।

খুব সুন্দর আর ছিমছাম শান্ত শহর এই লিমেরিক। অনেকটা রূপকথার গল্পের এক দেশ। আর নিজেকে লুকিয়ে ফেলার জন‍্য এ যেন আদর্শ এক শহর! বাংলাদেশী হাতে গোনা কয়েকজন আছে, সবাই আমার অচেনা আর ওরা কারো ব‍্যাপারে তেমন আগ্রহী নয়! শহরের মানুষগুলো রক্ষণশীল ঘরানার, ভদ্রতায় ওদের জুড়ি নেই।

প্রথম থেকেই আমি মনোমুগ্ধকর এই ক‍্যাম্পাসের ডর্মেটরিতে থাকি। রুমের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে অপরূপা শ‍্যানন নদী। বারান্দা থেকে নদীটাকে দেখে মনে হয় এ যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা অপরূপ এক ছবি!

এই শ‍্যানন, ক‍্যাম্পাস আর শান্ত শহরকে নিয়েই আমার শেষ দশ বছরের নির্বাসিত জীবন। এমনকি একবারের জন‍্যও দেশে আসিনি, আসার ইচ্ছাও হয়নি। আমার বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন। মা মারা গেলেন আমি দেশে থাকতে, মাস্টার্সের ফল বেরুনোর ঠিক আগে আগে। ভাইবোনেরাও নিজেদেরকে নিয়ে এখন যে যার মত ব‍্যস্ত! তাইতো দেশে যাওয়ার তাড়াটা কখনোই তেমনভাবে ফিল করিনি। আর সেই সঙ্গে শিলাকে হারানোর প্রচ্ছন্ন কষ্টটাতো আছেই।

লিমেরিকে আসার পর মোটামুটি জগত সংসার থেকে এক প্রকার বিচ্ছিন্নই ছিলাম। সারাদিন শুধু ল‍্যাব আর পড়াশোনা নিয়ে ব‍্যস্ত থাকি। বন্ধু বলতেও তেমন কেউ নেই, ঐ ল‍্যাবেরই পরিচিত কয়েকজন। বাংলাদেশী যে কয়েকজন আছে তাদের সাথে মূলত জুমার নামাজের সময়টাতেই মসজিদে দেখা হয়। নিজে থেকে দেশি ভাইদের সাথে একটু দুরত্ব রেখেই চলি। সবকিছু মিলে লিমেরিকের জীবন আমার বেশ ভালো যাচ্ছে, একাকিত্বের মাঝেও।

পিএইচডি শেষ করে পোস্ট ডক্টরেটও করলাম একই ডিপার্টমেন্ট থেকেই। অনেক মনোযোগ আর পরিশ্রম দিয়ে গবেষণার কাজ করে গেলাম। ভালো মানের কিছু পাবলিকেশনও হল। এর কিছুদিন পর শিক্ষক হিসাবে নিজের ডিপার্টমেন্টেই জয়েন করার সুযোগ পেলাম। ভালো পারফরম্যান্সের স্বীকৃতি স্বরূপ এরই মধ‍্যে আমি এসোসিয়েট প্রফেসর।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার অনার্স ব‍্যাচম‍্যাটদের করা ডিসেম্বরের রিইউনিয়নটায় কখনোই আমার আসা হতো না, যদি না শিলা আমাকে অনুরোধ করতো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমি এক নিভৃতচারী, মাঝে মধ‍্যে ফেসবুকেই উকি দেই। তাও আবার আমার বন্ধু লিস্টে অল্পকিছু বন্ধু। হঠাৎ করেই একদিন চোখে পড়লো, বন্ধুদের কেউ একজন আমাকে কেমেস্ট্রির ব‍্যাচম‍্যাটদের ফেসবুক গ্রুপটাতে এড করেছে। কৌতূহল বশত দেখলাম ঐ গ্রুপটাতে শিলারও উপস্হিতি।

প্রাইভেট গ্রুপটাতে এডেড থাকলেও আমি কোন মেসেজ পোস্ট করতাম না, ইনএকটিভ পার্টিসিপেন্ট আর কি। শিলাকেও কখনো মেসেজ দিতে দেখিনি। তবে গ্রুপে অন‍্য বন্ধুদের হালকা কথাবার্তায় খুব আপ্লুত হই। ওরা সবাই প্রান খুলে আড্ডায় বসে। ওদের ঐ সব কথাবার্তায় বারবার ফিরে যাই জীবনের সেরা সময়টাতে, শিলার সাথে কাটানো স্বপ্নের সেই দিনগুলোয়।

আমাদের বন্ধু পলাশ, এমএইচ হলে থাকতো। অন‍্য হলে থাকতো বলে ওর সাথে আমার খুব বেশি অন্তরঙ্গতা ছিল না। এই পলাশই ম‍্যাসেঞ্জারে পার্সোনালি নক করে শিলার জীবনে ঘটে যাওয়া দূর্ঘটনাটার কথাটা আমাকে প্রথম জানায়।

শিলার হ‍্যাসবেন্ড জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে সুদানে থাকা অবস্থায় মারা গেছে! প্রায় বছর দুয়েক হতে চললো এই ইনসিডেন্ট!

খবরটা শুনে আমি রীতিমতো হতভম্ব। শিলার জীবনে এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেলো, তাও দুবছর হতে চললো অথচ আমি এর কিছুই জানি না! ভীষণ কষ্ট পেলাম, চোখ দিয়ে অজান্তেই পানি ঝরলো। ওর জীবনটাতো এমন হওয়ার কথা ছিল না! আমার কি দায় নেই? একটা চাঁপা অপরাধবোধ ভর করলো।

চলবে।