#মায়াবিনী
সুরমা
পর্ব : ২১(অন্তিম পর্ব)
কেটে গেলো ১টা সপ্তাহ।এই এক সপ্তাহে প্রতিদিন তিলে তিলে শেষ হয়েছে অপূর্ব।এই সাত দিনে সুপ্তি একবারো অপূর্বের কোনো খোঁজ খবর নেয় নি।অপূর্ব দিন রাত কাটে নেশার মধ্যে।রুমের দরজা বন্ধ করে সব সময় অন্ধকারে সময় কাটে।মদের নেশায় সে নিজেকে ডুবিয়ে রাখে।এতে করে তার কষ্টটা ফিল হয় না।বিছানার কাছে ফ্লোরে বসে অপূর্ব মদ খাচ্ছে।এমন সময় অপূর্বের মোবাইলের রিং টোনটা বেজে উঠে।অপূর্ব মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখে আননোন নাম্বার।অপূর্ব একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে কলটা রিসিভ করে।এই কয়দিনে অপূর্বের মোবাইলে একটাও কল আসে নি।অপূর্ব মোবাইলটা কানে ধরে বলে,,,,
-হ্যালো???
-হ্যালো,অপূর্ব????
-হ্যাঁ,কে বলছেন???????
-সুপ্তিকে শেষবার দেখতে চাইলে এক্ষণি স্কয়ার হসপিটালে চলে আসো।বেশি দেরি করো না।বলেই অপর পাশ থেকে কলটা কেটে দেয়।সুপ্তির কথা শোনে অপূর্বের শরীরের লোমকূপ গুলো সতেজ হয়ে উঠে।হৃদপিণ্ডটা দ্রুত চলতে শুরু করে।অপূর্ব নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।সে কি সত্যি শোনেছে?নাকি ভুল শোনেছে।হঠাৎ হাসপাতাল মাথায় আসতেই অপূর্বের মুখে কালো মেঘ জমা হয়।সুপ্তি হাসপাতালে?কেন?কি হয়েছে সুপ্তির?কথাগুলো ভাবতেই কান্না চলে আসে অপূর্বের।অপূর্ব নিজের রুম থেকে দৌঁড়ে বের হয়ে আসে।অপূর্বের বাবা মা ডয়িং রুমে বসে ছিল।অপূর্বকে বের হতে দেখেই অপূর্বের মা অপূর্বের সামনে এসে দাঁড়ায়।অপূর্ব তার মাকে দেখে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়।অপূর্বের কান্না দেখে অপূর্বের বাবা সহ তার মা অবাক হয়।অপূর্বের মা বলে,,,,,
-কি হয়েছে?কাঁদছিস কেন?আমাকে বল কি হয়েছে??
-আম্মু সুপ্তি,,,,,
-সুপ্তি…..????
-সুপ্তি হাসপাতালে।
-কেন?কি হয়েছে সুপ্তির??
-আমি জানি না আম্মু।আমি কিচ্ছু জানি না।আমি শুধু জানি,,সুপ্তির কিছু হলে আমি বাঁচবো না।আমি সুপ্তিকে ছাড়া নিজেকে কল্পনা করতে পারি না।আম্মু,আমার সুপ্তি…….এই কয়দিনে অপূর্বের মা বাবা খুবই ভালো ভাবে বুঝতে পেরেছে,নিজের ছেলের হৃদপিণ্ড হলো সুপ্তি।সুপ্তিকে ছাড়া অপূর্বকে ভালো রাখা সম্ভব নয়।অপূর্বের বাবা এগিয়ে এসে বলে,,,,,
-সুপ্তি কোন হাসপাতালে আছে?
-স্কয়ারে
-ঠিক আছে চল।না গেলে বোঝা যাবে না কি হয়েছে।অপূর্ব তার বাবার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে,,,,,,
-তুমি হসপিটালে যাবা?
-কেন,আমি গেলে কোনো প্রব্লেম আছে???
-না,তাহলে চলো।১ঘন্টার মধ্যেই অপূর্বের পরিবারের সবাই হসপিটালে উপস্থিত হয়।তারা গিয়ে দেখে কেবিনের সামনে সুপ্তির বাবা,ভাই,ভাবী দাঁড়িয়ে আছে।অপূর্ব এক দৌঁড়ে গিয়ে সুপ্তির বাবার সামনে হাঁটু ভেঙ্গে বসে দুটিহাত জোর করে সুপ্তির বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,,,,
-আঙ্কেল প্লীজ,,আজ আমাকে সুপ্তির থেকে দূরে সরিয়ে দিবেন না।আমি সুপ্তিকে সত্যি অনেক ভালোবাসি।আমি সুপ্তিকে কোনোদিন চুল পরিমাণ কষ্টও পেতে দেবো না।আমাকে বিশ্বাস করুন।আমি সত্যি বলছি।অপূর্বের কথা শোনে সুপ্তির বাবা দেয়ালে কপাল ঠেকিয়ে কান্না করতে করতে বলে,,,,
-এটা বুঝতে বড্ড দেরি করে ফেলেছি বাবা। আমার মেয়েটা যে এখন আর তার মাঝে নাই।আমাদের থেকে দূরে সরে গেছে।আমার মেয়েটা বড্ড অভিমানী । আমাদের উপর অভিমান করেছে।বাবা হয়ে আমি আমার মেয়েকে বুঝার চেষ্টা করিনি।আজ আমার মেয়েটা আমাদের কারো সাথেই আর কথা বলছে না।সুপ্তির বাবার কথার কিছুই বুঝতে পারলো না অপূর্ব এবং তার বাবা মা।অপূর্ব বেকুবের মতো সুপ্তির বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।অপূর্বের বাবা সুপ্তির বাবার কাছে এসে বলে,,,,
-পরিষ্কার করে বলুন তো সুপ্তির কি হয়েছে??সুপ্তি হাসপাতালে কেন?অপূর্বের বাবার কথায় সুপ্তির বাবা কোনো কথা বলে নি।তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।অর্পিতা শশুড় মশাইকে একটা চেয়ারে বসিয়ে বলেন,,,,
-সুপ্তি যাতে অপূর্বের সাথে আর কোনো ভাবে দেখা করতে না পারে সেই জন্য এই ফ্ল্যাট ছেড়ে নতুন ফ্ল্যাট ভাড়া করেছিল।সুপ্তির ভাই আর বাবা মিলে সুপ্তির বিয়েও ঠিক করেছিল।এটা সহ্য করতে না পেরে সুপ্তি বাসার ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে যায়।মাথা ফেটে যায় আর অনেক রক্তক্ষরণ হয়।সুপ্তিকে হসপিটালে ভর্তি করা হলেও……… অর্পিতা এটুকু বলে থেকে গেলে অপূর্ব অর্পিতার সামনে এসে বলে,,
-তারপর সুপ্তির কি হয়েছে?সুপ্তি এখন সুস্থ আছে তো?ভাবী,আপনি কথা বলছেন না কেন?সুপ্তি সুস্থ আছে?ভাবী প্লীজ বলুন,সুপ্তি কোথায়?আমি সুপ্তিকে দেখতে চাই।
-সুপ্তি বেঁচে আছে ঠিক।কিন্তু কোমায় চলে গেছে।সবগুলো নার্ভ অকেজো হয়ে গেছে।ডাক্তার বলেছে আর কোনোদিন সুপ্তির সেন্স আসবে না।যতদিন বেঁচে থাকবে এভাবেই থাকবে বিছানায়।অর্পিতার কথা গুলো শোনে অপূর্ব এতোটা শকট হয় যে,মুহূর্তেই অপূর্বের দুনিয়া উলটপালট হয়ে যায়।অপূর্ব মূর্তির মতো হয়ে যায়।অপূর্ব একটা চেয়ারে ঠাস করে বসে পড়ে।অপূর্বের মা অপূর্বের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,,,,
-শান্ত হো।এভাবে ভেঙ্গে পড়িস না।সব ঠিক হয়ে যাবে।আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।দেখবি,খুব তাড়াতাড়ি সুপ্তি সুস্থ হয়ে উঠবে ইনশাআল্লাহ। সুপ্তিকে ভালো চিকিৎসা করানো হবে।তুই চিন্তা করিস না।
-আমি সুপ্তির সাথে দেখা করতে চাই।সুপ্তি কোন কেবিনে আছে??
অপূর্বকে অনুমতি দেওয়া হয় সুপ্তির সাথে দেখা করার।অপূর্ব সুপ্তির কেবিনে ডুকে দেখে সুপ্তির দেহটা বেডের উপর নেতিয়ে পড়ে আছে।সুপ্তি শুধু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।নিঃশ্বাসের শব্দটাও শোনা যাচ্ছে না।অপূর্ব একটা টোল টেনে সুপ্তির পাশে বসে সুপ্তির হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে বলে,,,
-খুব কষ্ট পেয়েছো তাই না আমাকে ছেড়ে থাকতে??আমার উপর রাগ করেছো?আর আমাকে ছেড়ে থাকতে হবে না।আমি আজই তোমাকে আমার সাথে নিয়ে যাবো।লাল টুকটুকে শাড়ি,গয়না পরিয়ে তোমাকে আমার সাথে নিয়ে যাবো।আর কেউ কোনোদিন আমার থেকে তোমাকে দূরে সরাতে পারবে না।এবার আমার সাথে একটু কথা বলো,,আমার এই মনটা যে বড্ড তৃষ্ণার্ত হয়ে আছে একটি বার তোমার মুখ থেকে আমার নামটা শোনবো বলে।এবার আমার নাম ধরে ডাকো প্লীজ।কথা বলবে না এখনো?ঠিক আছে বলতে হবে না।তুমি রেস্ট করো।আমি সবার সাথে কথা বলে আসি।আজ আমাদের বিয়ে হবে।আমার অনেক কাজ আছে।তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না।তুমি শোয়ে থাকো।অপূর্ব কেবিন থেকে বের হয়ে সবার সামনে গিয়ে বলে,,,,
-আমি সুপ্তিকে বিয়ে করতে চাই।অপূর্বের কথা শোনে সবাই চোখ বড় বড় করে তাকায় অপূর্বের দিকে।সুপ্তির বাবা বলে,,,,
-সুপ্তি সুস্থ হলেই তোমাদের বিয়ের আয়োজন করবো।চিন্তা করো না
-আঙ্কেল,আমি আজকেই বিয়ে করতে চাই।আজকেই আমাদের বিয়ের আয়োজন করুন।
-সেটা কিভাবে সম্ভব?সুপ্তিতো অসুস্থ।
-আমি সুপ্তিকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে চাই।আর দূরে সরিয়ে রাখতে চাই না।আপনি চিন্তা করবেন না।আমিই সুপ্তির সেবা করবো।আপনারা প্লীজ,বিয়ের আয়োজন করুন।অপূর্বকে কেউ বুঝাতে পারলো না।অপূর্বকে বুঝাতে সবাই ব্যর্থ হলো।অবশেষে অপূর্বের আবদার মেনে নিতেই হলো।হাসপাতালেই অপূর্ব আর সুপ্তির বিয়ে হয়।অপূর্ব সেদিনেই সুপ্তিকে নিজের বাসায় নিয়ে আসে।
২বছর পর,,,,,,,,,
এই দুবছরে একটা মিনিটও অপূর্ব সুপ্তির চোখের আড়াল হয় নি।সুপ্তির সেবা করা,খাওয়ানো,গোসল করানো থেকে শুরু করে সব কাজ অপূর্ব নিজের হাতে করেছে।সুপ্তির সাথে একা একাই অনেক গল্প করেছো।সুপ্তিকে সাজিয়ে দিয়েছে।মাঝে মাঝে শাসন করেছে।সুপ্তি শুধু ড্যাবড্যাব করে অপূর্বের দিকে তাকিয়ে থেকেছে।একটু আগে অপূর্ব সুপ্তিকে গোসল করিয়ে এনেছে।বিছানায় খাটের উপর বসিয়ে সুপ্তির পিঠটা নিজের বুকে হেলিয়ে রেখে সুপ্তির চুল গুলো আছড়ে দিচ্ছে আর বলছে,,,,,
-জানপাখি,তুমি জানো আমি তোমার চুলের ঘ্রাণ নিতে পারিনা কতোদিন ধরে।তুমিতো সেই যে আমার সাথে রাগ করলে,আজও আমার সাথে একটা কথাও বললে না।কতো রাত নির্ঘুম কাটালাম তোমাকে পাশে রেখেও। শুধু শূন্যতা বুকের মধ্যে ঘিরে রেখেছে।তোমাকে আমার পাশে রেখে আমি অস্থির হয়ে শুধু চটপট করেছি।কিন্তু তুমি আমাকে শান্তনা দাও নি।এভাবে কি বেঁচে থাকা যায়?তুমি পারতে?জানি পারতে না।একবার আমার সাথে একটু কথা বলো।কথা গুলো বলতে বলতে অপূর্ব সুপ্তির চুল চিরুনি করে। সুপ্তিকে একটা বালিশে শোয়ে দিয়ে বলে,,,,,
-তোমার এই চোখ দুটিতে আজও আমি হারিয়ে যাই।হরিণের চোখের মতো টানা টানা তোমার চোখ,,সারা মুখে সিগ্ধতার ছড়াছড়ি।একরাশ মায়াবী আভা মিশে আছে।বারবার আমি প্রেমে পড়ি তোমার।অপূর্ব সুপ্তির দিকে তাকিয়ে বলে খুব সুন্দর লাগছে আমার মায়াবতীকে।কিন্তু মুখে কি জানি একটা মিসিং। অপূর্ব কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলে,,,
-দেখেছো তোমার জামাইটা কেমন?সব কিছু ভুলে যায়।তোমার চোখে কাজল দেই নি।তাইতো এমন লাগছে।এই চোখ দুটিতে কাজল দিলেই তুমি পূর্ণ।অপূর্ব কাজলটা এনে সুপ্তির চোখে লাগিয়ে দেয়।এবার সত্যি সুপ্তিকে অপরূপা লাগছে।অপূর্ব একটা হাসি দিয়ে বলে,,,,,,
-আমার মায়াবিনী। যার মায়ায় আমি মুগ্ধ। আমি পূর্ণ।এভাবেই বাকিটা জীবন কাটিয়ে দেবো একসাথে।এটাই আমাদের ভালোবাসার সংসার!!!!!কথাগুলো বলে অপূর্ব সুপ্তির কপালে একটা ভালোবাসার পরশ একে দিয়ে সুপ্তির বুকে অপূর্ব মাথা রাখে।আলতো করে সুপ্তিকে জড়িয়ে ধরে।সুপ্তির হাত দুটি নিয়ে নিজের পিঠে পেছিয়ে দেয়।এতে অপূর্ব অনেকটা তৃপ্তি পায়।
সুপ্রিয় পাঠক বাসি।কিছু অপূর্ণতার মাঝেও মানুষ পূর্ণতা খুঁজে পায়।কিছু ভালোবাসা একরাশ কষ্ট নিয়েও মুগ্ধতায় ভরপুর হয়।কিছু না পাওয়ার মাঝেও তৃপ্তিকর পাওয়া লুকিয়ে থাকে।হয়তো সুপ্তি কোনোদিনও সুস্থ হবে না।কিন্তু অপূর্ব এভাবেই নিজের মাঝে আগলে রাখবে সুপ্তিকে।সুপ্তির মায়াভরা চোখে খুঁজে নিবে তার ভালোবাসা।গল্পটা লিখা স্বার্থক হতো যদি প্রত্যেক পাঠকের চোখ দিয়ে একট ফোটা জল বের হয়ে আসতো।কিন্তু আমার কিছু সমস্যার কারনে মনের মতো করে গড়ে তুলতে পারি নি।এটা আমার অপূর্ণতাও মনে করতে পারেন।সবাই দোয়া করবেন,নতুন গল্প যেন মনোযোগ সহকারে লিখতে পারি। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। পাশে থাকার জন্য সবাইকে আমার ভালোবাসা দিলাম।
সমাপ্ত