মিথ্যা_অপবাদ পর্ব-২১

0
1789

#মিথ্যা_অপবাদ
#ফারজানা_আফরোজ
#পর্ব_২১

মানহা পিছনে তাকিয়ে একজনকে দেখে চমকে গিয়ে বললো…….

—-” তুমি ?”

—” আমারও তো একই প্রশ্ন তুমি এইখানে?”

—” বোনের সাথে ঘুরতে এসেছিলাম। তুমি এইখানে কেনো নাকি ভাবির সাথে ঘুরতে এসেছো হুম ?”

—” মানহা বিয়ে, বউ এইসব কথা বলে আমার মত বাচ্চা ছেলেটাকে লজ্জা দিও না। তুমি জানোই আমি কোনোদিন বিয়ে করবো না।”

—” এখনও সেই একই কথায় আছো দেখছি।”

—” বাদ দেও তো এখন এইসব। নাহিদ কেমন আছে? ”

নাহিদের নাম শুনে মানহা কিছুক্ষণ নিরব থেকে পরে বললো…..

—-” আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে আয়ান।”

—” আমি তো সেইদিনই বলেছিলাম তোমাকে নাহিদকে বিয়ে না করতে। কিন্তু তুমি আমার কথা না শুনে তোমার সিদ্ধান্তে অনড় ছিলে। আরিয়ানের সাথেও ব্রেকআপ করেছিলে শুধু মাত্র নাহিদের জন্য।”

—” তুমিও কি এখন আমাকেই দোষারোপ করবে আয়ান?”

—” তোমাকে দোষারোপ করার সামর্থ্য আমার নেই। শুধু এইটুকুই জানি অনেক বড় ভুল করেছো তুমি। আরিয়ানকে রিজেক্ট করে এখন সেই ভুলের শাস্তি পাচ্ছো।”

আয়ানের কথা মানহা কাঁদতে থাকে। আয়ান বিচলিত হয়ে পরে…..

—” সরি, এতদিন পর দেখা হলো তবুও তোমাকে কষ্ট দিয়ে ফেললাম।”

—” তুমি আমায় কষ্ট দেও নি। আমি আমার পাপের সাজা পাচ্ছি। আর ওইদিন আরিয়ানকে আমি নিজ থেকে রিজেক্ট করি নাই।”

—” আমি তো তোমাকে জবাবদিহিতা করতে বলিনি মানহা। চলো কিছু খাওয়া যাক মনে হচ্ছে তুমি এখনও কিছু খাও নি।”

—” হুম চলো। আয়ান তুমি কি এখনো মেয়েদের তুমি করে বলো?”

—” হুম। বেস্ট ফ্রেন্ডের তুমি বাকিদের আপনি।”

—” তুমি এখনও সেই অদ্ভুদ মানুষটাই রয়ে গেলে। আমাদের গ্রুপের একমাত্র অদ্ভুদ এলিয়েন মানুষ তুমি।”

আয়ান মুচকি হেসে বললো…..

—” তুমি তো জানোই মেয়েদের সাথে কথা বলতে আমার লজ্জা করে। ভার্সিটিতে তুমি আর তানিয়া ছাড়া আর কোনো মেয়ের সাথে কথা বলতাম না । ”

তানিয়ার নাম শুনে মানহা আয়ানকে বললো…..

—” আয়ান তোমাকে কিছু কথা বলার ছিল তানিয়ার ব্যাপারে?”

—” হুম বলো?”

—” চলো অন্য কোথায় গিয়ে বসি।”

—” হুম।”

।।

।।

।।

।।

🌿🌿🌿

কালো গাড়ি খুব জোড়ে চালিয়ে ভার্সিটির গেইট দিয়ে প্রবেশ করছে আরিয়ান ।সাথের সিটে বসে বসে শিস বাজাচ্ছে নাহিদ। আরিয়ান গাড়ি থেকে নামতেই একটা মেয়ে সবার সামনে আরিয়ানের হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে……

—” তানু কি হয়েছে তোর? এইভাবে রেগে আছিস কেনো?”

তানিয়া কিছু বলছে না। আরিয়ানকে টেনে মাঠের মধ্যে নিয়ে আসে।

—” কি হয়েছে বলবি তো আগে?”

—” এই ছেলে আজ সবার সামনে আমায় প্রপোজ করেছে। তুই যদি এই ছেলের শাস্তি আজ না দিবি তাহলে কোনোদিন কথা বলবি না আমার সাথে।”

আরিয়ান জানে তানিয়ার রাগ উঠলে যখন সে যেটা বলে তাই করতে হয়। তাই আরিয়ান ছেলেটির সামনে গিয়ে অনেক মানুষের সামনে চড় মারে ছেলেটিকে……

—-” আমি এক কথা কতবার বলবো? এর আগেও অনেকজন কে বলেছি কেউ তানিয়াকে বিরক্ত করবে না তবুও সেই একই কাজ। আজ শেষ বারের মতো বলছি এই রকম নালিশ যদি আরো কারো নামে আসে তাহলে জীবন নিয়ে বাঁচতে পারবে না।”

আরিয়ানের চড়া কথায় তানিয়া খুশিতে মাঠ ভর্তি মানুষের সামনে জড়িয়ে ধরে। খুশিতে সে পাগল হয়ে যাওয়ার উপক্রম……

—-” আমি জানতাম তুই আমার অপমান সহ্য করবি না তাইতো সেই কখন থেকে ছেলেটাকে এইখানে দাঁড় করিয়ে রেখেছি তোর অপেক্ষায়। লাভ ইউ দোস্ত ।”

—” সুন্দরী মেয়েদের প্রপোজ করবে এই জন্য এতটা কঠোর হওয়া ঠিক না। বাই দা ওয়ে নাহিদ না আমার সাথে ছিলো কোথায় ও?”

হাতে রুমাল পেচিয়ে তানিয়াকে জিজ্ঞাসা করলো আরিয়ান। তানিয়া তখন বিরক্তি ভাব নিয়ে বললো…..

—” ওর খবর জানিস না আস্ত বদ ছেলে দেখ কোথায় কোন মেয়ের পিছনে লেগেছে।”

—” এই ছেলে একদিন মেয়েদের হাতে সেই লেবেলের মার খাবে দেখিস তুই।”

—” প্রতিদিনই তো খাচ্ছে আবার কি খাবে।”

—” এমন লুইচ্ছা মার্কা ফ্রেন্ড যে কেনো আমাদের কপালে জুটলো আল্লাহ ! ”

—” ওর কাজ ও করুক গিয়া । শুন আমরা অনেকদিন ধরে কোথাও ঘুরতে যেতে পারছি না তাই ভাবছি কিছুদিনের জন্য কোথাও ঘুরতে যাবো।”

—” চল স্যারকে বলে আসি আমরা ট্যুরে যাবো। ট্যুরের অর্ধেক খরচ আমার । ”

—” ভালো হবে। সবাই একসাথে ঘুরা হবে । আচ্ছা শুধু কি আমাদের ডিপার্টমেন্টের এরাই যাবে নাকি অন্য ডিপার্টমেন্টের এরাও যাবে?”

—-” বলা হবে সব ডিপার্টমেন্টের এখন যারা যাবে তারা তো যাবেই।”

—” হুম চল।”

আরিয়ান তানিয়া বারান্দা দিয়ে যেতে নিলে আরিয়ান একটি ছেলের সাথে ধাক্কা খায়। ছেলেটির হাতে থাকা সব বই নিচে পরে যায়। ছেলেটি তখন বই গুলো কুড়িয়ে আরিয়ানকে দেখে বলে……

—” দেখে চলতে পারিস না। এমনি এসে ধাক্কা দিয়ে বই ফেলে দিলি এখন বই গুলো তুলতেও সাহায্য করছিস না এমনকি সরিও বলছিস না।”

—” ওই বই পোকা চুপ থাক তুই? সারাদিন শুধু পড়া আর পড়া। বলি এত পরে কি করবি তুই মহা পণ্ডিত হয়ে যাবি নাকি আজব প্রাণী একটা।”

—” তানিয়া তুমি জানো না আমি বই পড়তে খুব ভালোবাসি। তোমাদের মতো ঘুরাঘুরি করতে আমার ভালো লাগে না। ”

—” তানিয়া অফ যা। শুন আয়ান আমরা ট্যুরে যাচ্ছি তুই কি যাবি? জানি তোর ঘুরতে ভালো লাগে না তবুও আমাদের দায়িত্ব তোকে বলা বলে দিলাম এখন তোর উইশ।”

—” নাহ রে যাবো না আমার প্রচুর পড়ার চাপ আছে। এইবার তোরা যা অন্য বারে আমি যাবো ।”

তানিয়া তখন বললো……

—” ভাই তুই আর এই কথা বলিস না তো। তাহলে ভাই আমাদের ট্যুরের অপমান হবে। তুই তো সব সময় ওই এক ডায়লগ বলিস।”

—” তানিয়া চল এই এলিয়েনের সাথে কথা বললে আরো মাথা নস্ট হয়ে যাবে। শালার মন বলে কিছু নেই আছে শুধু পড়া আর পড়া।”

—” হুম চল।”

।।

।।

।।

।।

আরিয়ান ও তানিয়া স্যারের সাথে কথা বলে সব ঠিক করে আসলো। দুইজন কথা বলতে বলতে যাচ্ছে তখনি আরিয়ান দাঁড়িয়ে যায়……

—” কি হয়েছে?”

—” এই মাত্র এই রাস্তা দিয়ে নাহিদ গিয়েছে?”

—” যৌতিশি হয়ে গেলি নাকি?”

—” নাহিদের পারফিউমের ঘ্রাণ পাচ্ছিস না?”

তানিয়া কিছুক্ষণ শুকতে লাগলো…..

—” আরেহ হতে পারে অন্য কেউ দিয়েছে।”

—” শুন এমন বাজে পারফিউম এক মাত্র নাহিদ ইউজ করে। পৃথিবীতে আর কেউ না ওকে।”

—” কথাটা মন্দ না আরু। চল ঘ্রাণ শুকে খুঁজি ওইটাকে পরে কেউ মেরে রাস্তায় ফেলে দিবে।”

—” হাহাহা চল।”

।।

।।

।।

আয়ান লাইব্রেরী রুমে বসে বসে পড়ছে।তখনি একটা মেয়ে এসে আয়ানকে ডাক দিলো…..

—” মানহা তুমি আজ দেরি করে আসলে কেনো?”

—-” আর বলো না রাস্তায় কি জ্যাম । ”

—” ওহহ। বসে পরো আজ প্রথম ক্লাস হবে না আমাদের তাই বসে বসে ম্যাথ করছি। তুমি ক্লাস করবে না?”

—-” আমাদেরও আজ ক্লাস হবে না বলে গিয়েছে ডিপার্টমেন্টের প্রধান। ওই ব্যাপার কি গো জানো কিছু?”

—” মনে হয় ট্যুরে যাওয়া নিয়ে মিটিং হচ্ছে।”

—-” ওয়াও ট্যুরে নিয়ে যাবে? ”

—” তুমি যেতে চাও?”

—” অবশ্যই।”

—” ওকে যাও ।”

—” তুমি যাবে না?”

—” উহু।”

—” কেনো যাবে না?”

—” পড়ার চাপ অনেক।”

—-” সারাদিন পড়ো তবুও বলছো পড়ার চাপ বলি তোমার মাথায় কি পড়া ছাড়া আর কিছু ঢুকে না।”

মানহা কথাটা জোড়ে বললো। আয়ান ওর আশে পাশে দেখে মানহা কে ফিসফিস করে বলছে…..

—” আস্তে আস্তে কথা বলো দেখো মেয়েরা কিভাবে তাকিয়ে আছে আমার কিন্তু ভীষণ লজ্জা করছে।”

আয়ানের কথায় মানহা কপালে হাত রেখে বললো…..

—” এই সন্ন্যাসীকে নিয়ে যে আমি কি করবো। শুনো তোমার যেতে হবে আমার সাথে। তুমি তো জানো তুমি ছাড়া আমার কোনো ভালো ফ্রেন্ড নাই। যদিও বা আমরা দুজন আলাদা ডিপার্টমেন্টে তবুও আমাদের ফ্রেন্ডশীপটা খুব ভালো।”

—” কেনো তোমার ডিপার্টমেন্টের তোমার কোনো ফ্রেন্ড নাই?”

—-” আছে বাট কেউ তোমার মত অদ্ভুত মানুষ না । তোমার কোনো ফ্রেন্ড নাই?”

—” হুম তিনজন আছে।”

—” কই তুমি তো এই ছয় মাসে তোমার কোনো ফ্রেন্ডের কথা বলো নাই আমাকে এমনকি মিট পর্যন্ত করাও নি।”

—” ওই যে আমি অদ্ভুত প্রাণী তাই তো এমন।”

মানহা মুখ বাঁকা করে রইলো । মানহা যখন প্রথম বর্ষে ভর্তি হয় তখন সে ভার্সিটি শুধু পরীক্ষার সময় আসতো। সেকেন্ড ইয়ারে উঠার পর পরীক্ষা ছাড়াও মাঝে মধ্যে আসতো আর যখনই লাইব্রেরীতে আসতো দেখতো একটা ছেলে বই পড়ছে। সাথে নাই কোনো বন্ধু । কারো সাথে কথা বলতো না। মাঝে মাঝে মানহা কথা বলতে চাইলে বইয়ের দিকে তাকিয়েই উত্তর দিতো। মানহার বেশ ভালো লাগতো তার জন্য প্রতিদিন আসা শুরু করলো ভার্সিটিতে। আয়ানও ধীরে ধীরে কথা বলতে থাকে মানহার সাথে। ছয় মাস ধরে তাদের ফ্রেন্ডশিপ চলছে । আয়ান খুব অদ্ভুত ধরনের মানুষ। পড়ালেখা ছাড়া বেশি কথা বলে না। মানহা তার বাসার সব কথা বলতো।রাস্তায় কি হয়েছে সব বলতো আয়ান শুধু শুনতো মাঝে মাঝে মুচকি হাঁসতো……..

।।

।।

।।

।।

—-” তোমাকে কোথায় যেনো দেখেছি?”

—” সরি, আপনার সাথে আমার আগেও কোথাও দেখা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।”

—” এই দেখা সেই দেখা নয় গো প্রিয়তমা। এই দেখা মনের দেখা।”

—” আপনি কি পাবনা থেকে পালিয়ে এসেছেন মিস্টার?”

—” শুধু মাত্র তোমার জন্য। পড়েনা চোখের পলক কি তোমার রূপের জলক।”

—” তোকে চড় মারিবো নাকি উষ্টা মারবো বাঁচাতে আসবে না তো কেউ।”

নাহিদ এতক্ষণ একটা মেয়ের সাথে কথা বলছিলো। মেয়েটাকে বিরক্ত করার পর যখন গান গাইছিল তখন পিছন থেকে আরিয়ান গাওয়া শুরু করে। নাহিদ আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলে….

—” আবার দেখা হবে বেবি উম্মাহ যাও।”

নাহিদ মাথায় হাত দিয়ে চুল গুলো কিছুটা নাড়িয়ে আরিয়ানের সামনে যায়……

—” তুই কোনোদিন ঠিক হবি না তাই না?”

—-” আমি তো ঠিকই আছি কিন্তু তুই ব্যাটা ঠিক নাই। তোর কপালে বউ জুটবে না দেখিস।”

—” সেইটা দেখা যাবে এখন চল।”

—” হুম চল আমিও চলি। দেখবি চলতে চলতে একদিন আরো সামনে পৌঁছে যাবো।”

—” শালা মাতাল কয় বোতল শেষ করছিস?”

—” বেশি না। তোর ভয়ে তো দুই গ্লাস খেয়ে চলে আসছি।”

—-” এইসব ফ্রেন্ড শুধু আমার কপালেই জুটে। একজন বইপোকা, একজন আনরোমান্টিক আরেকটা তো মাতাল। শালার কপাল খারাপ থাকলে যা হয় এই আর কি !”

তানিয়ার কথায় আরিয়ান নাহিদ হাসতে থাকে। তিনজন মিলে ট্যুরে কি কি করবে তা ঠিক করতে লাগলো…….

।।

।।

।।

ট্যুরে যাবে সবাই বাসে করে। আয়ানকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছে মানহা। সবাইকে বলা হয়েছে ভার্সিটির মাঠে এসে অপেক্ষা করতে। মানহা বাসা থেকে বের হয়ে বাসে উঠে ভার্সিটিতে যাচ্ছে ঠিক তখনই…….

চলবে…..

বানান ভুল হলে ক্ষমা করবেন।