মিষ্টি রোদের হাতছানি পর্ব-২৯+৩০+৩১

0
1017

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_29

পড়ন্ত বিকেলে নিজের অফিস কক্ষে বসে আছে সাবা খানম।টেবিলে রাখা কাপের চা ঠান্ডা হয়ে গেছে অনেক আগেই।গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়ে আছেন তিনি।কোনো ভাবেই একটা হিসাব মেলাতে পারছেন না তিনি।ঠিক তখনই জুবায়ের আহমেদ রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললেন

-“আসবো ম্যাডাম?উফফ!! সরি অলরেডি এসেই পড়েছি।”

সাবা খানম বেশ বিরক্ত হলেন স্বামীর রসিকতায়।জুবায়ের আহমেদ সামনের চেয়ার টেনে বসলেন।বউয়ের সিরিয়াস মুড দেখে রসিকতা থামিয়ে বললেন

-“এতো জরুরী তলব কেনো?”

-“জরুরি কথা আছে।”

-“বাসায় যেয়ে বলা যেত না?কাজ ফেলে আসলাম।”

-“সব কথা বাসায় বলা যায়না জুবায়ের।”

জুবায়ের আহমেদ চেয়ারে হেলান দিয়ে শান্ত হয়ে বসলেন।বললেন
-“কি হয়েছে?”

সাবা খানম জুবায়ের আহমেদের দিকে মলিন মুখে তাকিয়ে একটা কার্ড এগিয়ে দিলেন।জুবায়ের আহমেদ চোখ কুচকে কার্ডটি হাতে নিলেন।দেখেই বুঝা যাচ্ছে কারো বিয়ের কার্ড।কার্ডে নাম দেখে তিনি বেশ শক খেলেন।স্ত্রীর দিকে চমকে তাকালেন।বললেন

-“রওশান এর বিয়ের কার্ড?”

সাবা খানম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন
-“এক্সাটলি।আজ স্যার কার্ড দিয়ে গেলেন।সাথে বেশ আফসোস করলেন আরজুকে ছেলের বউ হিসেবে না পাওয়ার।”

-“রওশান আরজুকে অপছন্দ করেছে? সিরিয়াসলি? ইজ ইট পসিবল?”

-“আমিও সেটাই ভাবছি।যেই ছেলে আরজুর ছবি দেখে অস্থির হয়ে পড়েছে সেই ছেলে আরজুকে মানা করার কোনো প্রশ্নই আসে না।তাহলে হঠাৎ কি হলো?তাছাড়া আরজু নিজেই রওশানের বিষয়ে পজিটিভ বললো।তবে রওশানের আরজুকে পছন্দ হয়নি তেমন নয়।রওশান বলেছে আরজুকে তার ভীষণ পছন্দ হয়েছে কিন্তু তাদের কোথাও একটা মিস ম্যাচ হচ্ছে।”

জুবায়ের আহমেদ মনে মনে নানান চিন্ত করতে লাগলেন।তবে তার মন বলছে এই রিজেকসন আরজুর পক্ষ থেকে হয়েছে।কারণ আরজুর মত রমণীকে কোনো ছেলে অপছন্দ করতে পারবে না।আর আরজুর মত মেয়ের এমন কিছুই নেই যা ম্যাচ হবে না।ঘাপলা যে আরজু করেছে সেটা বুঝতে পারছেন।তাই স্ত্রীকে শান্ত করতে বললেন

-“এতো চিন্তার কিছু নেই সাবা।আরজু তো বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলেনি।ভাবার জন্য সময় চেয়েছে।হয়তো তারও কোথাও মিস ম্যাচ লাগছিলো।আর প্রতিটি মানুষের পছন্দ ভিন্ন হয়ে থাকে সাবা।”

-“তবুও আমার আরজুকে না বলার কোনো কারণ আমি খুজে পাচ্ছি না।”

-“তুমি বেশি চিন্তা করছো আমাদের আরজুর জন্য ভালো ছেলের লাইন লেগে যাবে।সো ডোন্ট ওয়ারি।”

সাবা খানম তবুও নিজের মনকে শান্ত করতে পারছেন না।এতো কষ্ট করে আরজুকে সেদিন ছেলে দেখার জন্য রাজি করিয়েছিল। এর পর কি আরজুকে রাজি করাতে পারবে?

**********
শুভ সন্ধার দিকে বাসায় ফিরে ডোরবেল বাজাতেই কেউ দরজা খুলে দিল।দরজার অপর পাশে আরজুকে দেখে শুভ বেশ চমকে গেলো।নেভিব্লু টপস আর ব্ল্যাক লাগেংস পরা মায়াবতী আরজু তার দিকে রাগী ভাবে তাকিয়ে আছে।ঠিক যেমনটা ঘরের বউ স্বামীর দেরিতে বাসায় আসতে লুক দেয়।সবই ঠিক আছে জাস্ট একটা শাড়ির কমতি।শুভ মুচকি হেসে বললো

-“এই ভর সন্ধায় আমার বাসায় কি করিস?”

-“তোকে বলব কেনো?”

শুভ ভেতরে প্রবেশ করে জুতা খুলতে খুলতে বললো
-“এটা কি শশুর বাড়ি পেয়েছিস যে যখন তখন আসবি আর আমি কিছু বলবো না?”

আরজু দাতে দাঁত চেপে বললো
-“একটা লাথি খাবি।কত দিন পর আসলাম। কোথায় অ্যাপায়ন করবি তা না।আর এটা তোর বাসা না।আংকেল এর বাসা।”

-“হুম বাবা মরলেই আমার বাসা হয়ে যাবে।অবশ্য তুই চাইলে তোর ফিউচার বাচ্চা কাচ্চা ও হতে পারে।কি বলিস?”

আরজু শুভর পিঠে চাপর মেরে বললো
-“দারা আংকেল কে বলছি তার মৃত্যুর অপেক্ষায় আছে একমাত্র গুণধর পুত্র।আর আমার বাচ্চারা তোর বাড়ি নিতে ইন্টারেস্টেড না বুঁজলি?”

-“যা বল।আমি ভয় পাই নাকি বাবাকে?আর তোর বাচ্চা কাচ্চা আমার বাড়ি নিয়ে কি করবে বল?তাদের তো নেতার বিশাল বাড়ি চাই।তাইনা?”

আরজু দুষ্ট হেসে বললো
-“আইডিয়া খারাপ না।আমার বাচ্চারা মিলে নেতার বাড়ি দখল করে নিবে।যেখানে সেখানে পটি করে দিবে।আর নেতা সাহেব সেই পটি পরিষ্কার করবে।ইসস! ভাবতেই মজা লাগছে। নিউজে হেডলাইন হবে “পটি হাতে নেতা,দেশের ফিউচার ভোতা।”

শুভ হো হো করে হেসে উঠলো।আরজুর নাক টেনে বললো
-” ফাজিল।চল ভেতরে চল।”

আরজু শুভর বিছানায় পা মেলে বসে ফোন স্ক্রল করছে আর পা দোলাচ্ছে।মাঝে মাঝে শুভর রুমে চোখ বুলাচ্ছে।দেয়ালের এক পাশের একটা ছবি দেখে আরজু বিরক্ত হলো।ছবিতে বাচ্চা আরজুর চুলে দুই ঝুটি করা।যার একটা ধরে শুভ টানছে।আর আরজু কেঁদে কেটে নাকের পানি চোখের পানি এক করছে।আরজুর ফোলা গাল দুটো কেমন লাল হয়ে আছে।এই ছবিটা শুভর রুম থেকে ঠিক কতবার আরজু নিয়ে ছিঁড়ে ফেলেছে তার হিসাব নেই।কিন্তু কয়দিন পর পর শুভ নতুন করে এই ছবি বাঁধাই করে নিয়ে আসে।তাই আরজু হাল ছেড়ে দিয়েছে।শুভ ফ্রেস হয়ে এসে বললো

-“এতদিন পর কি মনে করে আমার বাসায় আসলি?”

-“এমনি বাসায় ভালো লাগছিলো না।খালামণি,খালুজান অফিসে।অবনি গেছে কোচিং।আমি বোর হচ্ছিলাম।তাই ভাবলাম তোর বাসায় এসে আন্টিকে সারপ্রাইজ দেই।আমাকে দেখেই আন্টি সেই খুশি।দৌড় রান্না ঘরে ঢুকে পড়েছে।আমার পছন্দের কাস্টার্ড বানাতে।”

-“হুম আম্মু তোকে দেখলেই এক্সাইটেড হয়ে পড়ে।”

-“তোর ফিউচার বউ বেশ লাকী হবে।দারুন একটা শাশুড়ি পাবে।”

শুভ আরজুর দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো।মনে মনে ভাবলো
-“সেই লাকী মেয়েটি তুই হলে ভালো হয়।”

-“তুই এতো সময় বাইরে কি করিস?আন্টি আমার কাছে কমপ্লেইন করলো।আমিতো বলে দিয়েছি তার ছেলে আমার বাসায় অন্তত যায়না।নিশ্চই কোনো মেয়ের চক্করে পড়েছে।”

-“কোথায় থাকি তোকে বলবো কেনো?তুই কি আমার বউ যে সব হিসাব দিতে হবে?আর কোনো মেয়ের চক্করে পড়ার সময় নেই আমার।”

-“আমার থেকা পড়েনি তোর বউ হতে।অলরেডি আমি আমার স্বপ্ন পুরুষের বউ।”

শুভ চমকে তাকালো আরজুর দিকে।আরজু নিজেও বেকুব বনে গেলো।আসলেই তার ঠোঁট পাতলা।শুভর সামনে পেটে কথা রাখতেই পারে না।কিন্তু বিষয়টা ধামাচাপা দিতে বললো

-“আরে স্বপ্ন পুরুষকে স্বপ্নে বিয়ে করে বর বানিয়েছি।”

শুভ রাগী চোখে তাকালো।আরজুর সামনের বেবি হেয়ারে জোরে টেনে বললো
-“ছি!!! এই সব অশ্লীল স্বপ্ন দেখিস তুই?”

আরজু বিরক্ত হয়ে মাথার তালু ঘসতে ঘসতে বললো
-“অশ্লীল স্বপ্ন কই দেখলাম?বিয়ে তো ভালো,পবিত্র বিষয়।তাই না?একদিন তো দেখলাম আমার টুইন বেবীরা তোর কাধে চরে মামা মামা ডাকছে।”

শুভ রেগে আরজুর মুখে বলিস ছুড়ে মারলো।আরজু ও শুভকে বলিস দিয়ে মারতে লাগলো।শুরু হলো তাদের যুদ্ধ।শুভর মা চিৎকার চেঁচামেচি শুনে দৌড়ে এসে দেখলো দুইজন বালিশ যুদ্ধ চালাচ্ছে।তিনি মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন।এই দুজনকে এক করে দিলে তার বাড়িতে দিন রাত এমন যুদ্ধ চলবে।তবে তিনি তো বরাবরই আরজুর পক্ষে থাকবে।

আরজু শুভদের বাসায় বেশ কিছু সময় কাটিয়ে রাতের ডিনার শেষ করে বাসায় ফিরলো।শুভ বাসার নিচে নামিয়ে দিয়ে গেছে।আরজুকে দেখে অবনি অভিমান করে বললো

-“একা একা শুভ ভাইয়ার বাসায় চলে গেলে।আমাকে নিয়ে গেলে কি হতো?আন্টির হাতের মজার মজার খাবার মিস হয়ে গেলো।”

আরজু একটা বক্স অবনির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো
-“আন্টি তোর জন্য পাঠিয়েছে।বক বক করে আমার মাথা না খেয়ে কাস্টার্ড খা।”

অবনি সোফায় বসে খেতে শুরু করলো।সাবা খানমের আরজুকে দেখে মন অস্থির হয়ে উঠলো। রওশানের বিয়ের বিষয়টা কি করে জানবে ঠিক বুঝতে পারছে না।মেয়েটা কি এই রিজেকসন মানতে পারবে?কষ্ট পাবে নাতো?
আরজু সাবা খানমকে দেখে বললো

-“কি হয়েছে? সুন্দর মুখটা এমন মলিন করে কেনো রেখেছো?”

-“আরে কিছু না।কাজের প্রেসার।শুভর মা কেমন আছে?”

-“হুম ভালো।তুমি ফ্রী আছো কবে বলো তো? আন্টি তোমার সাথে নাকি মিট করতে চায়।হয়তো কোনো কাজ আছে।”

-“সামনের সপ্তাহে ফ্রি আছি।আমি কল করে কথা বলে নিবো।”

-“ওকে।”

সাবা খানম আর কিছুই আরজুকে বলতে পারলেন না।আরজু রুমের দিকে চলে গেলো।
আরজু বিষণ্ণ মনে বিছানায় বসে আছে।আজকাল তার নেতা সাহেবকে বেশ মনে পড়ছে।মন ভালো করতে শুভর বাসায় গেলো তবুও মন শান্ত হচ্ছে না।বিয়ের পর নেতা সাহেব একটা বার তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলেন না।মানুষটি এমন নিরামিষ কেনো?শত হোক নতুন বউ সে,তার প্রতি কি সামান্য আকর্ষণ বোধ করে না?একটি বার কি তাকে দেখার ইচ্ছে জাগে না?মনের অজান্তেই আরজুর চোখ বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো এই নেতাকে সে এতো সহজে ছাড়বে না।কিছুতেই না।

***********
রাত তখন প্রায় সাড়ে বারোটা। আসফি আর নাহিদ বসে অফিসিয়াল কিছু কাগজ পত্র ঘাটাঘাটি করছে। সুমি এসে তাদের দুই কাপ চা দিয়ে গেলো। আসফি কাউচে হেলান দিয়ে আয়েশী ভঙ্গিতে চায়ে চুমুক দিয়ে নাহিদের দিকে তাকালো।নাহিদ তখনও পেপারে মনোনিবেশ করে আছে।নাহিদের মন বুঝার চেষ্টা করছে আসফি।নাহিদ আগে থেকেই গম্ভীর প্রকৃতির হলেও এখন কঠিন হৃদয়ের হয়ে পড়েছে।সারাদিন কাজের মাঝে ডুবে থাকে।নিজের জন্য এক মুহুর্ত সময় নেই।ছেলেটা কিছু আপন মানুষদের কাছ থেকে অনেক কষ্ট পেয়েছে।তাই তো কাউকে সহজে আপন করে নিতে পারে না।

অথচ নাহিদের মনের দুয়ারে এক সমুদ্র ভালোবাসা এসে কড়া নাড়ছে।কিন্তু ছেলেটার কোনো হেলদোল নেই।অবুঝ মানুষকে বুঝানো সম্ভব।কিন্তু যে জেনে বুঝে মনের দুয়ার তালাবদ্ধ করে রাখে তাকে কি দিয়ে বুঝাবে?দীর্ঘশ্বাস ফেলে আসফি বললো

-“আরজু ভাবীকে কল করেছিস?”

নাহিদ পেপারে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই বললো
-” না।”

-“শুধু আজ করিসনি নাকি বিয়ের পর একবারও করিসনি।”
নাহিদ পেপার উল্টাতে উল্টাতে বললো
-“নম্বর দেইনি।”

আসফি অবাক হয়ে বললো
-“কি? তোর বউকে তুই নম্বর দিস নাই?ভাবী চায়নি?”

-“হুম চেয়েছে।দেইনি।”

-“কেনো?”

নাহিদ আসফির দিকে তাকিয়ে বললো
-“আমার কাছ থেকে দূরে থাকলে ওর জন্যই ভালো হবে।”
-“কাজটা কিন্তু ঠিক করিস নি। বউ হয় তোর।এতো সমস্যা থাকলে বিয়ে করেছিস কেনো?”

নাহিদ চুলে হাত বুলিয়ে বললো
-“বিয়ে করার ভুত ওর মাথায় চেপেছিল।তাই সব কিছুর জন্য ওর নিজেকে প্রিপেয়ার করতে হবে।বিয়ের আগেও ওকে ওয়ার্ন করেছিলাম।এই লাইফ ও নিজে বেছে নিয়েছে।”

নাহিদের কথায় আসফির মেজাজ খারাপ হচ্ছে।খানিকটা রেগে বললো

-“আমার সামনে নাটক করবি না।আরজু ভাবী তোকে ব্লাকমেইল করে বিয়ে করেছে এই গল্পঃ অন্য কাউকে শুনাস।আমাকে না, ওকে? তোর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই সম্ভব হয়নি।যেহেতু বিয়েটা করেই ফেলেছিস সেহেতু সম্পর্কটাকে সম্মান কর।নিজের ইমোশনকে সামলাতে পারিস নি সেটা স্বীকার কর।মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে লাভ আছে?”

নাহিদ কোনো জবাব দিলো না।মুহূর্তেই তার উজ্জ্বল মুখখানা রক্তিম হয়ে উঠলো।হাতে যত্ন সহকারে রাখা পেপার গুলো সামনের টি টেবিলে ছুড়ে ফেলে উঠে চলে গেলো। আসফি নাহিদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।নাহিদ কখনোই নিজের দুর্বলতা কাউকে দেখাতে চায়না।তাই নিজের অনুভূতির কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ায় সর্বক্ষণ।

নাহিদ বারান্দায় বসে সিগারেট টানছে।বুকের ভেতর অসম্ভব যন্ত্রণা হচ্ছে।আরজু নামটাই যথেষ্ঠ তার মন, মস্তিষ্ককে বেসামাল করার জন্য।নাহিদ হাতের কাগজগুলোর দিকে এক পলক তাকালো।আরজুর লেখা চিঠি।চিঠি বললে ভুল হবে।আরজুর অনুভূতি।এই প্রতিটা চিঠি নাহিদের মুখস্ত হয়ে গেছে।

চেয়ারে হেলান দিয়ে নাহিদ চোখ বন্ধ করলো।দৃশ্যপটে ভেসে উঠলো কিশোরী আরজুর মায়াবী মুখখানা।নাহিদ তখন নতুন নতুন ছাত্ররাজনীতিতে এক্টিভ হয়েছে।ভার্সিটিতে একটা ঝামেলায় জড়িয়ে তাকে এক দিনের জন্য জেলে যেতে হয়েছে।সেটাই প্রথম এক্সপিরিয়েন্স ছিলো।দাদাজান তাকে সেদিনই জামিনে বের করে নিয়ে আসে।নাতির জেলে যাওয়া নিয়ে সেদিন দাদাজান ছিলেন ভীষণ খুশি।নাহিদের পিঠে চাপর মেরে বলেছিলেন

-“বাঘের বাচ্চা আমার নাতি।বিরোধী দলের ছেলে গুলোকে না পিটালে কাপুরুষ বলতাম। যারা মেয়েদের সম্মান দিতে জানেনা তাদের এই ভাবেই পিটিয়েই সোজা করা দরকার।সঠিক কাজ করেছিস।”

থানা থেকে বেরিয়ে গাড়ির কাছে আসতেই নাহিদের চোখ পড়ল এক কিশোরীর উপর।বাসন্তী রঙের শাড়ী পরিহিতা কিশোরীর মাথায় কাচা ফুলের ক্রাউন।সম্ভবত বেলী ফুল।সামনের উন্মুক্ত ছোট কেশগুলো বাতাসে এলোমেলো হয়ে মেয়েটার মুখে আছড়ে পড়ছে।মেয়েটা সেই কেশ বার বার বিরক্ত হয়ে কানের পাশে গুজে দিচ্ছে।উজ্জ্বল মুখখানা লালচে হয়ে আছে।হয়তো গরমের তীব্রতায়।এমন মায়াবতী কোনো কিশোরীকে আগে কখনো দেখেছে বলে নাহিদের মনে হয়না।সেই কিশোরী সেখানে অনবরত পায়চারি করছে।তবে নাহিদ ভাবছে এমন সুন্দরী,রূপবতী বালিকা থানার সামনে পায়চারি কেনো করছে? তাও আবার এই হৃদয় ক্ষত করা সাজে।মুহূর্তেই আজকের দিনের কথা মনে পড়লো।পহেলা ফাল্গুন।তাই হয়তো মেয়েটার এই সাজ।

ঠিক তখনই মেয়েটার সামনে একজন নারী উপস্থিত হলেন।নারীটিকে নাহিদ দেখতে না পারলেও পেছন থেকে বুজলো তিনি একজন অ্যাডভোকেট।কারণ তার পরনে কালো কোট।প্রাণোচ্ছল সেই কিশোরী নারীটিকে দেখেই দুই হাত কোমরে গুঁজে রেগে তাকালো।সেটা দেখে নাহিদ মুচকি হাসলো।মেয়েটি ঠোঁট উল্টে অভিমানী সুরে কিছু একটা বললো সামনের নারীটিকে।মেয়েটির সেই অভিমানী মুখখানা মুহূর্তেই নাহিদের হৃদয়ে ঝড় তুললো।এমন ঝড়ের কবলে সে কখনোই পড়েনি।কয়েক মুহূর্ত পর সেই কিশোরী রিক্সায় উঠে বসলো।রিক্সায় উঠার সময় সেই কিশোরীর শুভ্র,কোমল পায়ের নূপুর জোড়ায় নাহিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো।নাহিদ শুকনো ঢোক গিললো।বুকটা কেমন ধুক পুক করছে।সেই কিশোরী চলে গেলো।সাথে নিয়ে গেলো নাহিদের কঠিন হৃদয়কে।

দাদাজান এতক্ষণ নাতিকে লক্ষ করছিলেন।নাহিদের মুগ্ধ দৃষ্টি দাদাজানের দৃষ্টি আড়াল করতে পারে নি।এক কিশোরীকে দেখে তার বিচক্ষণ, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন নাতি কেমন থমকে গেছে।চোখ বন্ধ করে বলা যায় সেই কিশোরী অত্যাধিক রূপবতী।কিন্তু মেয়েটা বয়সে অনেক ছোট।হয়তো ক্লাস সিক্স,সেভেনে পড়ে।আর নাহিদ পড়ে অনার্স সেকেন্ড ইয়ার।প্রায় ছয়,সাত বছরের ছোট কিশোরী তার গম্ভীর নাতিকে তাক লাগিয়ে চলে গেলো?বাচ্চা মেয়েটার মাঝে কিছু তো ছিলো যা তার নাহিদকে আকর্ষিত করেছে।দাদাজান তাই মজা করে বললেন

-“কিশোরীকে মনে ধরেছে নাকি আমার নাতির?ধরলে কয়েক বছর ওয়েট করতে হবে।একজন সমাজ সেবক হয়ে বাল্য বিবাহ প্রমোট করবো নাকি?”

নাহিদ মুচকি হাসলো।পকেটে দুই হাত গুজে বললো
-“যদি মনে হয় এই কিশোরীকে ছাড়া চলবে না তাহলে তোমার সমাজ সেবা আর আইনকে গুল্লি মেরে তাকে নিয়ে আসবো।কেউ আটকাতে পারবে না।কিন্তু আপাদত তেমন কিছু মনে হচ্ছে না।এক দেখায় করো প্রেমে পরা আমার ধাতে নেই।সো তুমি আর সেই কিশোরী দুজনেই নিশ্চিন্তে থাকতে পারো।”

দাদাজান হাসলেন।প্রাণখোলা সেই হাসি।

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_30

আজ স্কুল থেকে একটু জলদি বেরিয়েছে আঞ্জুমান আরা।কয়েকদিন যাবত বেশ অসুস্থ বোধ করছে।কিন্তু তিনি বেশি একটা গ্রাহ্য করেননি।কিন্তু আজ স্কুলে ক্লাস নেওয়ার সময় সেন্সলেস হয়ে পড়ে গেছেন।কেনো এমন হচ্ছে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।ছেলেকে এই বিষয়ে কিছুই জানাননি।রামিম জানলে ভীষণ অস্থির হয়ে উঠবে।তিনি ছাড়া আর কে আছে ছেলেটার?তার একটাই চাওয়া ছেলেকে সেটেল হতে দেখতে চান।মুহূর্তেই সাবিহার মুখটা মনে পড়লো।ইসস!! কি মিষ্টি মেয়েটা।তার সাধ্য থাকলে মেয়েটাকে নিজের ছেলের জন্য নিয়ে আসত।

বাসায় পৌঁছেই তিনি বিছানায় শুয়ে পড়লেন।ভীষণ ক্লান্ত লাগছে।একবার হসপিটালে যাবেন ভাবছেন।কিন্তু বর্তমানে ডক্টরের সরণাপন্ন হওয়া মানেই অনেক অর্থের বিসর্জন।এই টেস্ট ওই টেস্ট করে অস্থির করে তুলে।তিনি হাজারো অভাবের মাঝে অল্প কিছু টাকা জমিয়েছেন ছেলের ভবিৎসতের জন্য।ভাগ্যিস এই বাড়িটা তার স্বামী কিনে রেখেছিলেন।নাহলে হয়তো ছেলেকে নিয়ে পথে বসতে হতো।ভাইদের কাছে কখনই তিনি বোঝা হয়ে থাকতে চননি।হাজারো অভাবেও নিজের আত্মসম্মান কখনোই বিসর্জন দেননি।ছেলেটাও সেই সভাব পেয়েছে।মাঝে মাঝে ছেলের ব্যাক্তিত্ব দেখে তিনি ভীষণ মুগ্ধ হন।

বেশ কিছুক্ষন পর টিউশন শেষ করে রামিম বাসায় পৌছে দেখলো মা ঘুমিয়ে আছে।এই অসময়ে মাকে ঘুমাতে দেখে রামিম মাকে ডাকলো।কোনো সাড়া না পাওয়ায় মায়ের কাছে বসলো।কিছু একটা ভেবে মায়ের কপালে হাত দিয়ে দেখলো মায়ের অনেক জ্বর।রামিম ঘাবড়ে গেল।মাকে কয়েকবার ডাকার পর আঞ্জুমান আরা পিট পিট চোখে তাকালেন।আর কিছু বির বির করলেন।রামিম দ্রুত মায়ের কপালে জলপট্টি দিতে শুরু করলো।কিন্তু জ্বর কিছুতেই কমছে না।দ্রুত এলাকার ছোট চেম্বারের একজন ডক্টরকে ডেকে নিয়ে আসলো।তিনি পরীক্ষা করে কিছু মেডিসিন সাজেস্ট করলো।আর মায়ের গা একটু পর পর মুছে দিতে বললো।ডক্টর চলে যাবার পর রামিম গভীর ভাবনায় পড়ে গেলো।বাসায় কোনো মেয়ে মানুষ নেই।আর যাই হোক মায়ের গা তো সে মুছতে পারেনা।এই বিপদে সর্ব প্রথম যেই নামটা মনে পড়লো সেটা হলো সাবিহা।

সাবিহা রামিমের বাসায় পৌছে গেলো আধা ঘন্টার মধ্যেই।রামিম কে মায়ের পাশে উদ্বিগ্ন হয়ে বসে থাকতে দেখলো।সাবিহাকে দেখে রামিম যেনো প্রাণ ফিরে পেলো।মায়ের বিষয় এলে সে ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়ে।সাবিহা আঞ্জুমান আরার সারা গা মুছে দিলো। জোর করে খাবারও খাওয়ালো।সাবিহাকে দেখে তিনি মুচকি হেসে বলেছিলেন

-“আমার পাগল ছেলের কান্ড দেখো। সামান্য অসুস্থতায় তোমাকে ডেকে নিয়ে এসেছে।”

-“সামান্য কোথায় আন্টি?সারা শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে আপনার।”

আঞ্জুমান আরা মুচকি হেসে বললেন
-“আমার ছেলে সেদিন যাকে বাসায় আসায় এতো কথা শুনালো, আজ বিপদে দিশা হারিয়ে তাকেই সবার আগে মনে পড়লো?”

সাবিহা কোমল দৃষ্টিতে আঞ্জুমান আরার দিকে তাকালো।আঞ্জুমান আরা সাবিহার হাত ধরে আকুতি করে বললেন
-“আমাকে ছাড়া রামিমের কেউ নেই।আমার কিছু হয়ে গেলে আমার ছেলেটাকে দেখে রেখো মা।আমার ছেলের হাত ছেরো না।”

সাবিহার চোখে অশ্রু কনা জমা হলো। মায়েরা সব সময় এমন মমতাময়ী হয়ে থাকে।মনের সব কথা না বলতেই বুঝে যায়।সাবিহা আঞ্জুমান আরার হাত আরো শক্ত করে ধরে বললো

-“আন্টি আমিতো সেই কবেই হাত বাড়িয়ে বসে আছি।যদি কেউ সেই হাত ধরতে না চায় তবে আমার কি করা উচিৎ?”

আঞ্জুমান আরা সাবিহার হাতের উল্টো পিঠে ছোট্ট করে চুমু খেলেন।বললেন
-“যে এই ভরসার হাত ধরতে না পারবে তার চাইতে অভাগা এই পৃথিবীতে আর একটাও নেই।”

সাবিহা ডুকরে কেঁদে ওঠলো।বললো
-“আমি শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করবো আন্টি।বাকিটা রামিমের হাতে।আপনার ছেলে একটাবার আমার হাত ধরুক, আমি সারা জীবন আপনার ছেলেকে আগলে রাখবো আন্টি।”

আঞ্জুমান আরা পরম মমতায় সাবিহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।আর বললেন

-“দোয়া করি দিন শেষে তোমার মনের আশা পূরণ হোক মা।”

*************
আরজু প্যান্টের পকেটে হাত গুজে দাড়িয়ে সামনের অট্টালিকা পর্যবেক্ষণ করছে।এতক্ষণ যাবত চিবানো চুইংগাম এখন তেতো হয়ে এসেছে।রাস্তার পাশে থু মেরে সেটা ফেললো আরজু।আবার বাঁকা চোখে তাকালো সামনের দিকে।সামান্য গাল চুলকে কিছু একটা ভাবলো।না আর ভেবে কাজ নেই।তাই কাধের ব্যাগটা শক্ত করে ধরে সামনে অগ্রসর হলো।ভয় মানুষকে দুর্বল করে।তাই ভয় পাওয়া চলবে না।

আরজু অফিসে ঢুকে পড়লো।সামনের টেবিলে বসা একটি মেয়ের দিকে চোখ পড়লো।মার্জিত পোশাকের মেয়েটি সামনের লেপটপে বেশ মনোযোগ সহকারে তাকিয়ে আছে।এই অফিসে আরজুর প্রথম আসা।আগে বাইরে ঘুরাঘুরি করলেও আজ প্রথম ভেতরে প্রবেশ করলো।সামনের মেয়েটির সামনে দাড়িয়ে আরজু বললো

-“এক্সকিউজ মি!

মেয়েটি এতক্ষনে আরজুকে খেয়াল করলো।মেয়েটা কয়েক মুহূর্ত আরজুর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো।রূপবতী আরজু শুধু ছেলেদেরই না মেয়েদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম।তাই মেয়েটি মুচকি হয়েছে বললো

-“ইয়েস ম্যাম। হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?”

-“আমি মেয়র সাহেবের সাথে মিট করতে চাই।”

মেয়েটি হয়তো আরজুর কথায় খানিকটা অবাক হলো।কিন্তু নিজের কাজের দক্ষতা দেখিয়ে নিজেকে সামলে বললো
-“অ্যাপয়েনমেন্ট লেটার দিন।”

আরজু অবাক হলো।নিজের স্বামীর সাথে মিট করতে অ্যাপয়েনমেন্ট লেটার লাগবে?

-“আমার কাছে কোনো লেটার নেই।”

-“আই অ্যাম সরি ম্যাম।অ্যাপয়েনমেন্ট লেটার ছাড়া মিট করা সম্ভব না।”

-“মিস্টার নাহিদ আমাকে খুব ভালো করেই চেনে।আপনি তাকে আমার কথা বলুন।”

মেয়েটি প্রথমে একটু বিরক্ত হলো।অনেক রূপবতী মেয়েরাই এমন হুটহাট মেয়রের সাথে দেখা করতে চলে আসে ।তরুণ,সুদর্শন পুরুষটির সাথে কত রমণী দেখা করতে চায় তা গুনে শেষ করা যাবে না।কিন্তু সামনের রূপবতী মেয়েটিকে অন্য সবার চাইতে ভিন্ন লাগছে।তবুও নিজের বাধ্যবাধকতার মাঝে কিছুই করার নেই।তাই বললো

-“সরি ম্যাম।সম্ভব না।এটাই রুলস।তাছাড়া স্যার মিটিংয়ে আছে।”

আরজুর রাগ হচ্ছে।যত সব ফালতু রুলস।কিন্তু রাগলে চলবে না।আজ সে নাহিদের সাথে দেখা না করে যাবে না।নাহিদকে না দেখলে তার বিক্ষিপ্ত মন কিছুতেই শান্ত হবে না।তাই আরজু বললো

-“আপু প্লিজ।আমার তার সাথে মিট করা ভীষণ প্রয়োজন।”

মেয়েটার হয়তো আরজুর জন্য কিছুটা মায়া হলো।তাই বললো
-“কি প্রয়োজন আমাকে বলুন ম্যাম।”

-“আসলে আমি একটা কমপ্লেইন করতে চাই।”

মেয়েটা কপাল কুঁচকে বললো
-“কিসের কমপ্লেইন?”

-“একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির নামে কমপ্লেইন করবো।আমার সমস্যার সমাধান একমাত্র মেয়র সাহেব করতে পারবেন।”

মেয়েটা গভীর চিন্তায় পড়ে গেল।এক পলক আরজুর দিকে তাকালো।দারুন স্মার্ট আর রূপবতী আরজুকে দেখে মনে মনে ভাবলো

-“এতো সুন্দরী মেয়ের পেছনে ছেলেরা তো নিশ্চই লাইন ধরে থাকে।হয়তো কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি বা তার সন্তানদের বদ নজরে পরে গেছে মেয়েটি।একজন মেয়ে হিসেবে এই মেয়েটার হেল্প কর উচিৎ।”

আরজুর ইনোসেন্ট মুখ দেখে মেয়েটা এমন কিছুই আন্দাজ করলো।তাই আরজুকে আশ্বাস দিয়ে বললো

-“এই ভাবে অ্যাপয়েনমেন্ট ছাড়া মিট করার নিয়ম নেই।তবে আমি চেষ্টা করছি কি করা যায়। আজ স্যারের সিডিউল বেশ টাইট।তাই কথা দিতে পারছি না।আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে।মিটিং থেকে বের হলে আমি স্যার কে খবর পাঠাচ্ছি।”

আরজু মুচকি হেসে ধন্যবাদ জানালো।সামনের কাউচে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো।মনে মনে নাহিদকে বেশ কয়েকটা গালি দিলো।কিন্তু আরজুর অপেক্ষার প্রহর বেশ দীর্ঘ হলো।যত সময় অতিবাহিত হচ্ছে আরজুর মনের অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

নাহিদ আজ বেশ ব্যাস্ত দিন পার করছে।মাত্র মিটিং শেষ করে চেয়ারে এসে বসলো।ঘন্টাখানেক পর আরো একটা মিটিং আছে।সারা দিনের ব্যাস্ততায় গায়ের পাঞ্জাবিটা খানিকটা কুচকে গেছে।নাহিদ এটা দেখে বেশ বিরক্ত হলো।অগোছালো কিছুই তার পছন্দ না।নাহিদ মেকি হাসলো।যেখানে তার লাইফটাই কেমন অগোছালো সেখানে কাপড়ে কি আসে যায়।একটা ফাইল বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখছে নাহিদ।আরো কতগুলো ফাইল জমা হয়ে আছে।নিঃশ্বাস ফেলার ও সময় পাচ্ছে না।তখনই তাহেরা নামক মেয়েটি তার রুমে আসলো।বললো

-“স্যার একটি মেয়ে এসেছে কমপ্লেইন করতে।”

নাহিদ চমকে বললো
-“কি কমপ্লেইন?”

-“সেটা নাকি আপনার কাছে বলবে।”

নাহিদ বিরক্ত হলো।এই মুহূর্তে সে ভীষণ টিয়ার্ড। কারো কমপ্লেইন শুনার একদম ইচ্ছে নেই।তাই বললো

-“অ্যাপয়েনমেন্ট ছিলো?”

-“না স্যার।”

নাহিদের বিরক্তি যেনো আরো বৃদ্ধি পেল।এমন অনেক মেয়েরা এসেই তার টাইম ওয়েস্ট করে।তাই বললো

-“কমপ্লেইন লেটার জমা দিয়ে যেতে বলুন।পড়ে দেখে নিবো।”

মেয়েটি নাহিদের মুড বুজে আর কিছুই বললো না।রুম থেকে বেরিয়ে চলে গেলো।তার বেশ কিছুক্ষণ পর তার অ্যাসিস্টেন্ট আসিফ হন্ত দ্বন্ত হয়ে তার রুমে প্রবেশ করলো।নাহিদ কপাল কুঁচকে বললো

-“কি ব্যাপার আসিফ?”

আসিফ বেশ উত্তেজিত হয়ে বললো
-“স্যার সেই মেয়েটা এসেছিলো।কি যেনো কমপ্লেইন করতে।”

-“কোন মেয়ে?আর আপনি এতো এক্সাইটেড কেনো?”

আসিফ দুই হাত মুচড়াতে লাগল আর বললো
-“স্যার আপনাকে সেই চিঠি দেওয়া মেয়েটা।”

এতক্ষণ যাবত নাহিদের নজর সামনের ফাইলে থাকলেও এখন খানিকটা চমকে সে আসিফের দিকে তাকালো।আসিফ লজ্জা লজ্জা ভাব দেখে নাহিদ বিরক্ত প্রকাশ করলো।আর বললো

-“কখন এসেছে?”

-“স্যার তিন ঘণ্টা হবে।একটু আগে বেরিয়ে গেলো।”

নাহিদ চমকে গেলো।এতক্ষণ ধরে আরজু তার জন্য অপেক্ষা করছিলো?সে দ্রুত বললো

-“আমাকে আগে জানাননি কেনো?”

-“স্যার আপনি মিটিংয়ে ছিলেন।”

নাহিদ চেয়ার ছেড়ে উঠে কিছুটা রেগে বললো
-“নেক্সট টাইম উনি আসলে আমাকে সাথে সাথে জানাবেন।”

আসিফ খানিকটা ভয় পেয়ে গেল।বললো
-“জি স্যার।”

নাহিদ আর কিছু না বলে দ্রুত বেরিয়ে পড়লো।আসিফ যেনো বোকা বনে গেলো।তার মানে কি ওই সুন্দরীর মিষ্টি মিষ্টি চিঠির ভাষায় তাদের মেয়র স্যারও পিছলে পড়লো?

********
সূর্য পশ্চিম আকাশে ডুবে গেছে অনেকক্ষণ আগেই।চারপাশ আঁধারে ছেয়ে গেছে।শহরের রাস্তা গুলিতে জ্বলছে সোডিয়ামের আলো।সেই আলোর মাঝ দিয়েই হেঁটে যাচ্ছে আরজু।দু চোখ বেয়ে তার অশ্রু ঝরছে।হাতের উল্টপিঠ দিয়ে সেই অশ্রু বার বার মুছে নিচ্ছে।কিন্তু বেহায়া জলধারা কিছুতেই থামছে না।বুকের ভেতরে অসম্ভব যন্ত্রণা শুরু হয়েছে।নাহিদকে দেখার জন্য,তার সাথে কথা বলার জন্য তার মনটা অস্থির হয়ে উঠেছিলো।তাই সকল ভয় ,লজ্জাকে পেছনে ফেলে সেই মানুষটির কাছে ছুটে গেছিলো।কিন্তু সেই পাষাণ মানুষটি একটাবার দেখা পর্যন্ত করলো না।আরজু নিজেকে নিজে গালি দিলো।কেনো উতলা হয়ে সে পাষণ, ইগোস্টিক মানুষটির সাথে দেখা করতে গেলো?আর কোনোদিন সে যাবে না।সব সময় সাদা পাঞ্জাবি গায়ে থাকলে কি হবে ভেতরে জিলাপির প্যাচ এই লোকের।অসভ্য লোক।

তখনই হঠাৎ পেছন থেকে একটা গাড়ি তাকে ওভারটেক করে দাড়ালো।আকর্ষিক ঘটনায় আরজু খানিকটা ভয় পেয়ে গেলো।নির্জন রাস্তায় কোনো বিপদের সম্মুখীন হলো নাতো?আবারও নাহিদের উপর রাগ হলো।পুরুষ মানুষ হয়ে এতো গার্ড নিয়ে ঘুরে।অথচ সুন্দরী বউকে প্রোটেক্ট করার জন্য একজনকেও রাখতে পারলো না।

আরজু দ্রুত ব্যাগের সাইড পকেটে হাত দিয়ে দেখলো পেপার স্প্রে আছে কিনা?না আছে।কিন্তু আরজুর সকল ভাবনাকে ছাপিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলো নাহিদ।সাদা পাঞ্জাবীর হাতা কনুইয়ে ভাঁজ করতে করতে আরজুর সামনে দাড়ালো।আরজু যেনো কোনো ঘোরের মাঝে হারিয়ে গেছিলো।কিন্তু স্বাভাবিক হতেই আরজুর অভিমান যেনো পাহাড় ছুলো।এই মুখটা দেখার জন্য কত অস্থির হয়ে পড়েছিল আরজু।কিন্তু তার ভালোবাসা,অনুভূতি সব কিছুকে তুচ্ছ করেছে এই মানুষটি।তাই কোনো কথাই বলবে না আরজু।এই বদ লোক গোল্লায় যাক।

আরজু রাগে নাহিদকে পাস কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই নাহিদ আরজুর হাত ধরে আটকে দার করলো।বেশ বুঝতে পারছে তার ব্ল্যাকমেইলার বউ ভীষণ রেগে আছে।অভিমান ম্যাডামের চোখ বেয়ে বেয়ে পড়ছে।তাই বললো

-“শুনলাম কমপ্লেইন করতে এসেছিলে।তো কমপ্লেইন না করেই চলে যাচ্ছ কেনো?”

রাগে আরজুর মুখ দিয়ে কোনো কথাই বের হচ্ছে না।নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো।নাহিদের যেনো কাজটা পছন্দ হলো না।তাই অন্য হাতে আরজুর কোমর চেপে নিজের একদম কাছে নিয়ে আসলো।আরজুর যেনো নিঃশ্বাস বন্ধ হবার জোগাড়।সারা শরীর বেয়ে বিদ্যুৎ খেলে গেলো।উফফ!!কি পাগল করা অনুভূতি।আরজু চোখ বড় বড় করে নাহিদের দিকে তাকালো।নাহিদ দেখলো কিছু বেবি হেয়ার আরজুর কপালে পড়ে আছে।নাহিদ আরজুর মুখে ফু দিলো।মুহূর্তেই নাহিদ বুঝতে পারলো আরজুর দেহের কম্পন।আরজুর হৃদস্পন্দনের অগ্রগতি নাহিদ অনুভব করলো।আরজু আবেশে চোখ বন্ধ করে নিয়েছে।নাহিদ বাঁকা হাসলো।আর বললো

-“হাসলে নাকি মেয়েদের ভালো লাগে।কিন্তু তোমাকে রাগলে বেশি ভালো লাগে।একদম আমার বাসার মিমির মত।মিমি রাগলে এমন দেখায়।”

আরজু ঝটপট চোখ খুলে নাহিদের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়।নাহিদ বাঁকা হেসে বললো
-“মিমি আমার পোষা বিড়াল।ভীষণ কিউট।”

আরজুর রাগে যেনো নাহিদ ঘি ঢেলে দিলো।আরজু নাহিদের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়াতে জোরাজোরি করতে লাগলো।কিন্তু তেমন সুবিধা করতে পারলো না।তাই রেগে বললো

-“ছাড়ুন আমাকে।নাহলে খারাপ হয়ে যাবে।”

-“কি খারাপ হবে?”

আরজু না চাইতেও সাবধানে ব্যাগ হাতড়ে পেপার স্প্রে বের করলো।সামনের মানুষটি তার স্বামী হলেও একে একটা শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন।বউকে অবহেলা করার একটা শাস্তি হওয়া দরকার।আরজু নাহিদের চোখে স্প্রে করার আগেই নাহিদ তার হাত থেকে স্প্রে বোতলটি নিয়ে দেখতে দেখতে বললো

-“দেখি দেখি ডেট আছে কিনা?”

আরজুর আরো রাগ হলো নাহিদের নির্বিকার ভঙ্গি দেখে।রাগে কি করবে বুঝতে না পেরে নাহিদের উন্মুক্ত গলায় জোরে কামড় বসালো।নাহিদ নিচের ছোট কামড়ে সামান্য হাসলো।কৌতুক সুরে বললো

-“তোমার অভ্যাস তো দেখি মিমির মত।সেও রেগে তার ছোট ছোট দাত দিয়ে এমন কুটুস কুটুস কামরায়।যেই কামড়ে ব্যাথা নেই। বাই দ্যা ওয়ে রাস্তায় দাড়িয়ে লাভ বাইট দেওয়ার প্ল্যানটা মোটেও পছন্দ হচ্ছে না।”

আরজু রেগে বললো
-“আমাকে একটা বিড়ালের সাথে তুলনা করছেন?আপনি একটা ফালতু লোক।ছাড়ুন বলছি।”

নাহিদ আরজুর কোনো কথাই শুনলো না।বরং আরজুকে বুকের সাথে চেপে কোমর ঝাপটে ধরে শূন্যে তুলে নিলো।আরজু যেনো অবাকের উপর অবাক হলো।নাহিদ আরজুকে নিয়ে সোজা গাড়ির ভেতরে বসিয়ে দিলো।নিজেও বসে পড়লো।আরজু দরজা খুলতে চেষ্টা করেও সফল হলো না।নাহিদ হাত দিয়ে নিজের চুল ব্রাশ করতে করতে বললো

-“ডোন্ট ওয়ারি।চুমু টুমু খাওয়ার জন্য এই ভাবে তোমাকে আনিনি।তোমার মত রাস্তা ঘাটে লাভ মেকিং আমি পছন্দ করিনা।এতদিনে সেটা নিশ্চই বুঝে গেছ।তাই গাড়িতে এসে কথা বলাটা সেভ মনে হলো।যাই হোক,কি কমপ্লেইন করতে এসেছিলে?”

আরজু রাগে ফোপাতে লাগলো।পারলে নাহিদের মাথা ফাটিয়ে ফেলত।নাহিদ একটা পানির বোতল আরজুর দিকে বাড়িয়ে বললো

-“পানি খেয়ে নাও।রাগী মেয়ে মানুষ আমার পছন্দ না।রিলেক্স হয়ে তারপর বলো।”

আরজুর আসলেই ভীষণ পানি পিপাসা পেয়েছে।নাহিদের সেই স্পর্শ তার ভেতরে তাণ্ডব চালাচ্ছে।উপরে উপরে রাগ দেখালেও ভেতরে আরজু অনুভূতির জোয়ারে ভাসছে।এই মানুষটির স্পর্শ আরজুর হৃদয়ের সব রাগ, অভিমান নিমিষেই পানি করে দেয়।পানি পান করে আরজু নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো আর বললো

-“একটা অসভ্য লোক আমার মনের শান্তি ভঙ্গ করেছে।আমাকে মানুষিক কষ্ট দিচ্ছে।আমার মনে ঝড় তুলে যখন তখন হাওয়া হয়ে যাচ্ছে।লোকটার কঠিন শাস্তি চাচ্ছি।”

নাহিদ এতক্ষণ আরজুর দিকেই তাকিয়ে ছিল।রাগের কারনে আরজুর নাকের ডগা লাল হয়ে আছে।আরজু সামনে তাকিয়ে এক নিঃশ্বাস এই কথা গুলো বলছিলো।নাহিদ কিঞ্চিৎ হাসলো।বললো

-“হুম বুজলাম।তো কি শাস্তির ব্যাবস্থা করা যায় বলোতো?”

-“তার আমাকে নিয়ে একদিন লং ড্রাইভে বের হতে হবে।এটাই শাস্তি।”

নাহিদ এক দৃষ্টিতে আরজুকে দেখে যাচ্ছে।আরজু শাস্তি কথা শুনে সামান্য হেসে বললো

-“এটা কেমন অদ্ভুত টাইপের শাস্তি।”

-“হে অদ্ভুত শাস্তি দিতে চাই।”

নাহিদ সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।মেয়েটা তাকে ভেঙে চুরমার করেই দম নিবে।

আরজু জানালার পাশে বাইরে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।এই নেতাকে তো আরজু দেখে নিবে।তার প্রেমের সুইমিংপুলে নাকানি চুবানি খাইয়ে ছাড়বে।যেমনটা সে খাচ্ছে।

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_31

পশ্চিম আকাশে সূর্য ঢলে পড়েছে কিছুক্ষণ আগে।এই সময় জারা আর তার কাজিন মিরাজ একটা ক্যাফেতে বসে আড্ডা দিচ্ছে।মিরাজ তার একমাত্র মামাতো ভাই।হায়ার এডুকেশন এর জন্য মিরাজ বেশ কিছু বছর ক্যানাডায় ছিলো।সপ্তাহ খানেক হলো দেশে ফিরেছে।জারার সাথে মিরাজের সম্পর্ক বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ।জারা কফিতে চুমুক দিয়ে বললো

-” মামী কিন্তু এবার বেশ সিরিয়াস তোমার বিয়ে নিয়ে।ওইদিন দেখলাম আম্মুর কাছে বেশ কিছু মেয়ের ছবি নিজে হাজির।”

মিরাজ মুচকি হেসে সামনে সিল্কি চুল গুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে বললো
-“মায়ের কথা কি বলবো?আমাকে তো আরো দুই বছর আগে থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে।”

-“তো করে ফেলো।বিয়ের বয়স তো হয়েছেই।পছন্দের কেউ আছে নাকি?”

মিরাজ দুষ্ট হেসে বললো
-” হুম আছে তো।তোর ওই বন্ধুবিকে আমার সাথে সেট করে দে।”

যারা ব্রু কুচকে তাকিয়ে বললো
-“আরজুর আসায় থাকলে ভুলে যাও।আমার বন্ধুবি অলরেডি প্রেমের ঘোলা পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে।”

-“বলিস কি?এই মেয়ে তো কোনো ছেলেকে পাত্তাই দিতো না।কয়েক বছর আগে তোর বান্ধুবিকে প্রপোজ করেছিলাম।আমাকে সবার সামনে ধর্মের ভাই বানিয়ে হালকা করে ছ্যাকা খাইয়ে দিলো।”

জারা উচ্চ শব্দে হেসে বললো
-“হে আমার বেশ মনে আছে।কিন্তু আমাদের আরজু এখন একজনের প্রেমে পরে গেছে।আহা!! কঠিন প্রেম।মজার বিষয় এমন একজনের প্রেমে পড়েছে জানলে অবাক হয়ে যাবে।”

-“কার প্রেমে পড়েছে?”

জারা মিরাজের কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বললো
-“তোমাকে বলা যাবে না মিরাজ ভাই। ইটস টপ সিক্রেট।”

-“আরে বাবা!! কোনো ভিআইপি নাকি?”

জারা মাথা নেড়ে না জানিয়ে বললো
-“ভিভিআইপি কেউ।”

মিরাজ হেসে বললো
-“গ্রেট।”

আরো কিছুক্ষন কথা বলার পর মিরাজ বললো
-“জারা তোর আমাকে একটা হেল্প করতে হবে।”
-“কি হেল্প?”

মিরাজ কিছুক্ষণ হাতে হাত ঘষে মিনমিনিয়ে বললো
-“ক্যানাডায় অ্যাথ্রিন নামের একটা মেয়ের সাথে বেশ ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পক হয়েছে আমার।মেয়েটা অনেক ভালো রে।আমাকে স্টাডির সব বিষয়ে ও বেশ হেল্প করতো।”

মিরাজ কিছুক্ষণ নিরব রইলো।জারা বড়ো বড়ো চোখ করে বললো
-“মেয়েটা তোমার গার্লফ্রেন্ড তাইনা?”

মিরাজ অবাক হলো।জারা কি করে জানলো?জারা মুচকি হেসে বললো

-“তাহলে তো হয়েই গেলো।মামীকে বলে দাও ওর কথা।আমরা একটা বিদেশিনী ভাবী পেয়ে যাই।”

-“আসলে অ্যাথ্রিন খ্রিস্টান। তাছাড়া সে ব্রকেন ফ্যামিলিতে বড় হয়েছে। তুই তো মাকে চিনিস। এসব শুনলে নির্ঘাত আমাকে ঝাটা পেটা করে দেশ ছাড়াবে।এখন কি করবো বুঝতে পারছি না।আমি অ্যাথ্রিনকে ভীষণ ভালোবাসি। আমার লাইফে ওকে ছাড়া অন্য কাউকে কল্পনাই করতে পারছি না। তুই একটু ওর বিষয়ে মাকে বুঝিয়ে বলবি?”

জারা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললো
-“আচ্ছা ঠিক আছে,সেটা নাহয় বলবো।কিন্তু মামীর রিয়েকশন কি হবে সেটা কিন্তু আমি বলতে পারছি না। দেখা গেল এই খবর শুনেই মামী ছোটখাটো হার্ট অ্যাটাক করে বসেছে। আর যদি তোমার বিদেশি গার্লফ্রেন্ড বিকিনি পরে মামীর সামনে চলে আসে আমার মামী তো সোজা পটল তুলবে।”

কথাটা বলেই জারা উচ্চ শব্দে হেসে উঠলো।মিরাজ জারার হাসিতে প্রথমে খানিকটা বিরক্ত হলেও পরে নিজেও হেসে উঠলো।মেয়েটা ভারী দুষ্ট।

ঠিক তখনই কেউ একজন জারার পাশে শরীর ঘেঁষে বসে পড়লো। আকস্মিক এই ঘটনায় জারা এবং মিরাজ দুজনই হতভম্ব হয়ে গেল।হাসি থামিয়ে জারা পাশের মানুষটিকে দেখে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো।মিরাজ চোখ কুচকে বললো

-“এক্সকিউজ মি ব্রো! আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না।”

আগুন্তক ছেলেটি জারার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো
-“জান” আমি কে উনাকে বলো নি? ওকে নো প্রবলেম।আমি নিজেই পরিচয় দিয়ে দিচ্ছি।আমি নাহিয়ান জাহিদ।জারার ফিয়্যান্সে।আপনি?”

কথাটা বলেই মিরাজের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো।মিরাজ অবাক হয়ে জারার দিকে তাকালো।জারা কেমন অবাক হয়ে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আছে।মিরাজ হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলো আর জানালো সে জারার কাজিন।
জারা রক্তিম চোখে জাহিদের দিকে তাকিয়ে বললো

-“হোয়াট ননসেন্স? এই ছেলে তোমার মাথা ঠিক আছে?”

জাহিদ টেবিলে রাখা জারার হাতে আলতো করে হাত রেখে বললো
-“জান” এখনও রেগে আছো?আসলে ভাইয়া ও আমার সাথে রাগ করে আছে।গত রাতে ঝগড়া হয়েছে তো তাই।আত্তো অভিমানী মেয়েটা কি বলবো।”

জারা রেগে বললো
-“এই ফাজিল ছেলে?আর একটা ফালতু কথা বললে থপ্রিয়ে গাল লাল করে দিবো।”

জাহিদ জারার দিকে খানিকটা ঝুঁকে বললো
-“গাল লাল করে কি হবে “জান”? আমি তো লিপস লাল করতে চাই।”

জারা হা করে জাহিদের দিকে তাকিয়ে রইলো।যেনো বেশ বড়ো কোনো ঝটকা খেলো।
মিরাজ হতবম্ব হয়ে তাদের দেখছে।কিছু একটা ভেবে মুচকি হেসে জারাকে বললো

-“ফুপি কি জানে তার আদরের মেয়ে জামাই ঠিক করে ফেলেছে?”

-” মিরাজ ভাই এই ছেলের কথা বিশ্বাস করো না।এক নম্বরের নাটক বাজ।”

জাহিদ জারার হাত আরো শক্ত করে ধরে বললো
-“জান” আন্টিকে ভয় পাচ্ছো কেনো?আমি বিয়ের জন্য তাকে ঠিক ম্যানেজ করে ফেলব। তাছাড়া ভাইয়া তো আছে আমাদের হেল্প করার জন্য।তাই না ভাইয়া?”

মিরাজ মাথা নেড়ে হ্যা জানালো।আর চেয়ার ছেড়ে উঠে বললো
-“বুজলাম তোদের মধ্যে মান অভিমান চলছে।তোরা টাইম স্পেন্ড কর।আমি আজ উঠি।”

জারা নিজেও উঠতে চাইলে জাহিদ হাত ধরে বসিয়ে দিলো।মিরাজ চলে গেলে জারা রাগী চোখে তাকিয়ে বললো
-“এই ধরনের ফাজলামির মানে কি?”

ভাবলেশহীন ভাবে জাহিদ বললো

-“ফাজলামি কখন করলাম?”

রাগে জারার শরীর জ্বলে যাচ্ছে।মিরাজ ভাই কি মনে করলো কে জানে?জারা রেগে বললো
-“ফিয়ন্সে,বউ এসব কি? সবকিছু নিয়ে মজা করা আমার একদম পছন্দ না।”

জাহিদ এবার জারার অনেকটা কাছে ঘেসে বসলো।জারার দিকে নেশাত্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো

-“কোনোটাই মজা ছিলো না।যেটা ভবিষ্যতে হবে সেটাই বলেছি। বুঝলেন মাই ফিউচার ওয়াইফ?”

জারা বেশ ভরখে গেলো।সারা শরীর জুড়ে অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেলো। “ফিউচার ওয়াইফ” শব্দটায় কিছু একটা ছিল যা জারার অন্তরে এসে বিধেছে।জারা অপ্রস্তুত হয়ে জাহিদের কাছ থেকে খানিকটা সরে আসতে চাইলে জাহিদ জারার হাত আলতো ভাবে ধরে রাখলো।জারার সারা শরীর কাঁপতে লাগলো।এই ছেলেকে এই মুহূর্তে মাইর দেওয়া দরকার ছিল।কিন্তু জারা জাহিদকে কিছুই বলতে পারছে না।জারা আমতা আমতা করে বললো

-“এমনটা মোটেও সম্ভব না।আমি তোমার সিনিয়র।আমার কাছ থেকে দূরে থাকবে।”

কথাটা বলেই জারা হাত ছাড়িয়ে দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে গেলো।জাহিদ জারার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো

-“আমার বউ তো আপনিই হবেন।আপনার মায়ায় আমি এমন ভাবে বেধে গেছি যে ফেরার পথ নেই।”

আসলে এই ক্যাফেতে জাহিদ এসেছিল এক বন্ধুর সাথে। কিন্তু সেখানে জারা কে অন্য একটি ছেলের সাথে এত মিষ্টি করে হেসে কথা বলতে দেখে তার বুকের ভেতরে অসম্ভব ব্যথার উৎপত্তি হয়।ছেলেটা যদি জারার bf হয়েও থাকে তবে আজ সে ব্রেক আপ করিয়েই ছাড়বে।তাই বন্ধুকে বিদায় দিয়ে জারার কাছে এসে বসে পরে।তবে কিছুক্ষণ মধ্যেই বুঝতে পাড়ে সামনের ছেলেটি জারার কাজিন।কিন্তু ততক্ষণে যা ব্লান্ডার করার তা সে করে ফেলেছে।মেয়েটা নিশ্চই অনেক রেগে গেছে।

***********

নির্জন রাতে পাশাপাশি বসে আছে এক জোড়া নতুন দম্পতি।কিন্তু তাদের মাঝে আছে বিশাল দূরত্ব।এই দূরত্ব কি করে কমবে সেটা আরজুর জানা নেই।এমন নিরামিষ, ধাম্ভিক লোক আরজু জীবনে একটাও দেখেনি।এমন নির্জন রাতে গাড়িতে পাশে তার নতুন সুন্দরী বউ বসে আছে। কোথায় জড়িয়ে ধরে গভীর চুমু খেয়ে নিবে তা না লোকটা মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে।একটা কথাও বলছে না।আর এই দিকে আরজুর নিজের উপর রাগ হচ্ছে।মানুষটার সামনে আসলে কোথা থেকে এতো লজ্জা তার উপর ভর করে? লজ্জায় কথাই বলতে পারছে না।নাহিদ গাড়ি থামালো আরজুর বাড়ির সামনে।নিরবতা ভেঙে নাহিদ কঠিন সুরে বললো

-“নেক্সট টাইম এমন বোকামি আর করবে না। হুট করে আমার অফিসে আসাটা তোমার ঠিক হয়নি। পলিটিক্সে যেমন ক্ষমতা থাকে তেমনি রিক্সও কিন্তু থাকে।আরজু আমার লাইফের পলিটিক্স এর বদৌলতে অনেক শত্রুর উদ্ভব হয়েছে।তারা সারাক্ষণ আমার ক্ষতির চেষ্টা করে।কিন্তু আমাকে না ছুঁতে পারলে তারা আমার কাছের মানুষের ক্ষতির চেষ্টা করবে।তাই সাবধানে চলবে।প্রতিটা কদম ভেবে চিন্তে নিবে।তুমি আর সেই সাধারণ আরজু নেই।তুমি আমার সম্মান।”

আরজু নাহিদের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে।নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।নেতা সাহেব তাকে কাছের মানুষ বলেছে?নিজের সম্মান দাবী করছে?নাহিদের এতো উপদেশ তার কানেই ঢুকলো না।সে তো সুখের সাগরে ভেসে বেড়াচ্ছে।আরজু যে নাহিদের কথা কানে নেয়নি সেটা নাহিদ ভালই বুঝতে পারলো।এই মেয়েকে কি করে সামলাবে নাহিদ নিজেই বুঝতে পারছে না।খানিকটা বিরক্ত হয়ে নাহিদ গলা পরিষ্কার করে বললো

-“রাত হয়ে যাচ্ছে।বাসায় যাও আরজু।”

আরজু চোখ বুজে ফেললো।ইসস! নেতা সাহেবের মুখে নিজের নাম শুনতে বেশ মধুর লাগছে।আরো কিছুক্ষন ডাকুক না।আরজুর চোখ গেলো নাহিদের গলার দিকে।কামড়ের দাগ স্পষ্ট।আরজু বেশ লজ্জা পেলো।দ্রুত দরজা খুলে বেরিয়ে আসলো।লজ্জায় পেছনে তাকাতে পারছে না।কয়েক কদম সামনে এগুতেই আরজুর ফোন বেজে উঠলো।দেখলো আননোন নাম্বার। আরজু কল রিসিভ করতেই অপর পাস থেকে গম্ভীর শব্দ বেরিয়ে এলো

-“এটা আমার নম্বর।এই নম্বরে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারবে।আমার অফিসে আর হামলা দিবে না।কিন্তু যখন তখন কল করলে আমাকে পাবে না।আমি ভীষণ ব্যাস্ত থাকি।আমি ফ্রি হয়ে তোমাকে কল করবো।”

আরজু পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলো নাহিদ ফোন কানে গুজে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।আহা!! কি মায়াময় সেই দৃষ্টি।আরজু বক্ষস্থল কেপে উঠলো সেই দৃষ্টিতে।নাহিদ মোলায়েম সুরে আবার বললো

-“ভালোবাসা কখন সুন্দর হয় জানো?সঠিক মানুষটিকে ভালোবাসতে পারলে।তুমি সঠিক মানুষটিকে ভালবেসেছ কিনা সেটা সময় বলে দিবে।আমার সাথে পথ চলা অনেক কঠিন হবে আরজু।এই পথ জুড়ে শুধু কাটা।এই কাটা তোমার কোমল হৃদয়কে ক্ষত বিক্ষত করে তুলবে। তুমি অনেক ভালো কাউকে ডিজার্ভ করো আরজু।যে তোমাকে সহজ আর স্বাভাবিক জীবন দিতে পারবে। আই অ্যাম নট পারফেক্ট ফর ইউ।”

নাহিদের প্রতিটা কথা আরজু মন দিয়ে শুনলো। বুকটা কেমন ধুক ধুক করছে।কিন্তু আরজু দুর্বল না হয়ে বললো
-“আমি যাকে ভালোবেসেছি তার প্রতি হৃদয়ে গভীর টান অনুভব করেছি।একবার যখন তার হাতটা ধরেছি সেটা আর ছাড়ছি না।পথ যতই কঠিন হোকনা কেনো মানুষটা পাশে থাকলে হাসি মুখে সেটা পাড়ি দিতে পারবো।জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তার পাশেই থাকবো।সুন্দর গোলাপকে ছুঁতে চাইলে একটু তো কাটার আঘাত সহ্য করতেই হবে।তাইনা?”
নাহিদ আরজুর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো

-“তুমি আসলেই একটা পাগলী। যাও বাসায় যাও।”

আরজু বাসায় চলে আসলো।আর নাহিদ ছুটে চললো তার গন্তব্যে।

আরজু নির্ভয়ে বাসায় প্রবেশ করলো।কারণ সে জানে আজ খালামণি আর খালুজান বাসায় দেরী করে ফিরবে।ডোরবেল বাজালে অবনি দরজা খুলে দিল।আরজু খেয়াল করলো অবনি কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।আরজু বললো

-“কি সমস্যা?এই ভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো?”

অবনি আসে পাশে তাকিয়ে কাউকে খুঁজলো।আরজু জানে অবনি তারা কে খুঁজছে।অবনি আরজুর হাত ধরে দ্রুত রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।আরজু অবাক হয়ে অবনির কান্ড দেখছে।আরজু বিরক্ত হয়ে বললো

-“কি হয়েছে বলবি?”

-“কি হয়েছে সেটা তুমি বলবে?মেয়র জিজু তোমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে যায়।ঘটনা কি?”

আরজু কাচুমাচু করতে লাগলো।এইটা কি হলো?এই বাঁদর তাকে দেখে ফেললো? এখন কি বলবে আরজু?এই বাঁদর মেয়েতো তার পেট থেকে সব কথা বের করেই দম নিবে।অবনি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো

-“কি লুকাচ্ছ আমার কাছ থেকে?এক মিনিট!! তুমি মেয়রের সাথে প্রেম করছো নাতো?”

আরজু নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো।এই অবনির বুধির তারিফ করতেই হবে।একদম খালামনির মতোই বুদ্ধি ওর।বলার আগেই সব ধরে ফেলে।আরজু নিচু স্বরে বললো

-“একদম না।তুই ভুল ভাবছিস।ওই নেতা প্রেম করতেই জানে না।”

-“তাহলে মেয়র সাহেব তোমাকে এমনি এমনি বাসায় পৌঁছে দিয়ে যায়?আমাকে বোকা পেয়েছো?”

-“অবনি এমন কিছুই না।তবে ওই নেতা তোর জিজু হবে সেটা সিওর থাক। ব্যাটাকে আমার প্রেমে ফাঁসিয়ে তোকে জলদি খালামণি বানিয়ে ফেলবো।দারুন হবে না?”

অবনি যেনো আরজুর কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। কিছু একটা নিশ্চই লুকাচ্ছে।কিন্তু কি সেটা ধরতে পর হয়ে না।তবে নাহিদ তার জিজু হলে বেশ হবে।ওই নিশান ব্যাটা বেশি তেড়িবেড়ি করলে জিজুর চ্যালা দিয়ে ক্যালানি খাওয়াতে পারবে।দুই একবার থ্রেট তো দেওয়াই যেতে পারে।আহা কি শান্তি!! মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে বলবে
” তুই ব্যাটা শুধুই আমার।অন্য মেয়ের দিকে তাকালে এই বন্ধুকের সব গুলি তোর চোখে ঢুকিয়ে দিবো। এখন ঝটপট একটা চুমু খেয়ে ফেল।”

কথাটা ভেবেই অবনি নিজেই উচ্চ শব্দে হাসতে লাগলো।তারা দৌড়ে এসে বললো
-” ছোট আপা তুমি হাসো কেন?”

-“এমনি হাসি তারা আপু।শয়তানে নারে চারে তো তাই।”
তারা ভাবলো ছোট আপারে জ্বীনে আছর করলো নাকি?আজকাল এমনি এমনি হাসে।বড়ো আপারেও মনে হয় জ্বীনে ধরছে।খালি মন খারাপ কইরা থাকে।যা সুন্দর চেহারা, জ্বিনের নজর তো পড়বই।দুই বোনরে দুই জ্বীনে ধরছে।ইয়া আল্লাহ! কি হইবো?খাল্লমা তো এই সব বিশ্বাস করে না।না তার কিছু করতে হইবো।হুজুরের কাছ থেইকা পানি আর তাবিজ পরা আনতে হইবো।তাইলে এই জ্বীন দৌড়াইয়া পালাইবো।”