মিষ্টি রোদের হাতছানি পর্ব-৮৫+৮৬

0
616

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_85

নিস্তব্দ রাতে যখন সবাই গভীর নিদ্রায় তখন এক দম্পতি বেচেঁ থাকার লড়াই করে চলছে।নিস্তব্দ এই পাহাড়ে বিকট গোলাগুলির শব্দে গম গম করছে চারপাশ।আশেপাশে কোনো বসতি বাড়ি নেই।নাহলে আজ এই তাণ্ডবের সাক্ষী হতো।নাহিদ বুঝতে পড়ছে সে হাঁটতে পারবেনা।তার পা পুরোপুরি নিস্তেজ।কিন্তু এই ভাবে হেরে গেলে চলবে না।সে হারতে শেখেনি।নিজের মনের জোর আর শরীরের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো নাহিদ। উঠে দাড়াতে চাইলে আরজু অস্থির হয়ে বললো

-“এই অবস্থায় আপনি কি করে উঠে দারাবেন?আপনার খুব কষ্ট হবে। ক্ষত আরো গভীর হবে।”

-“আমাকে তো উঠে দাড়াতেই হবে আরজু।তোমাদের জন্য আমাকে এই দুর্গম পথ পাড়ি দিতেই হবে।এতো সহজে হেরে যাওয়ার লোক নিবরাস নাহিদ না।”

আরজু নাহিদের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো।এই দুঃসাহসী পুরুষটি সত্যি সবার চাইতে আলাদা।এমন একটা মানুষকে জীবনে পেয়ে সে সত্যিই ধন্য।এই মানুষটিকে শারীরিক ভাবে দুর্বল করতে পারলেও মানুষিক ভাবে কখনোই দুর্বল করা সম্ভব না।আরজু কেঁদে বললো

-” আমাদের সাথে এমনটা কেনো হচ্ছে নেতা সাহেব।আমি তো বহুদিন আপনাকে নিয়ে বাঁচতে চেয়েছি।একটা সুন্দর সংসারের স্বপ্ন দেখেছি।আমাদের সব স্বপ্ন একদল মানুষ এসে ধূলিসাৎ করে দিচ্ছে।”

নাহিদ আরজুর অধরে চুমু খেয়ে বললো
-” কতো দিন এক সাথে ছিলাম সেটা গুরুত্তপূর্ণ না বউ।সেই সময়টা আমরা কতটুকু ভালো কাটিয়েছি,কতটুকু উপভোগ করেছি সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।আমার জীবনের অদ্ভুদ সুন্দর মুহূর্ত গুলো তোমার সাথেই কেটেছে।তোমাকে জীবনে পেয়েছি এটাই আমার জন্য সৌভাগ্যের।”

পেছনের লোক গুলো তাদের খুব কাছাকাছি চলে আসছে।নাহিদ কোনো মতে উঠে দাড়ালো।ব্যাথায় টনটন করে উঠলো সমস্ত কায়া।এক কদম ও ফেলতে পারলো না।আরজু নাহিদের হাত শক্ত করে ধরে রাখলো।মনে মনে হাজার বার সৃষ্টিকর্তার নাম উচ্চারণ করছে।দুর্বৃত্তরা কাছে আসার আগেই হঠাৎ কেউ শত্রু পক্ষর দিকে হামলা করলো।আরজু নাহিদ দুজনেই বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে।নাহিদ দেখলো রতন তাদের সামনে।ছেলেটা গাছের আড়ালে দাড়িয়ে শত্রুদের দিকে গান তাক করে সুট করতে করতে এসে নাহিদের উদ্দেশে বললো

-” স্যার,ম্যাম আপনারা ঠিক আছে?”

নাহিদ মৃদু হেসে বললো
-” তোমাকে সুস্থ দেখে খুশি হলাম রতন।”

-” স্যার আমি এই জানোয়ারের বা*চ্চাদের দেখছি।আপনি ম্যাম কে নিয়ে এগিয়ে যান।”

নাহিদ বুঝতে পাড়ছে এই অবস্থায় তার পক্ষে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব। ডান পা সম্পূর্ণ অসাড় হয়ে গেছে।সে পা মোটেও নাড়াতে পারছে না।এই ক্ষত বিক্ষত পা জোড়া বিশাল দেহকে বয়ে বেড়াতে পারবে না।তাছাড়া প্রচুর রক্তক্ষরণের ফলে তার শরীর ভীষণ দুর্বল।নাহিদ রতনকে বললো

-” তুমি আরজুকে নিয়ে এগিয়ে যাও রতন।ওদের আমি দেখছি।”

আরজু আতঙ্কিত হয়ে বললো
-” কি বলছেন এসব?আমি আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।”

রতন বললো
-“স্যার আপনাদের রক্ষা করা আমার দায়িত্ব।আপনাকে রেখে আমি কি করে যেতে পারি?”

নাহিদ শক্ত গলায় বললো
-“আমি অর্ডার করছি আরজুকে নিয়ে যাও রতন।আর কোনো কথা না।আমার জীবনের সবচাইতে গুরুতুপর্ণ মানুষটির নিরাপত্তার ভার তোমাকে দিচ্ছি। আশা করি নিষ্ঠার সাথে পালন করবে।”

আরজু নাহিদকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে বললো
-” আমি আপনাকে রেখে কোথাও যাবো না নেতা সাহেব।”

-” প্লিজ আরজু বুঝতে চেষ্টা করো।আমি হেঁটে যেতে পারবো না।তুমি রতনের সাথে যাও।”

আরজু জেদি গলায় বললো
-” আপনি আমার কথা কেনো বুঝতে পারছেন না? বললাম তো আমি একা যাবো না।ভাগ্যে যা আছে তাই মেনে নেবো,কিন্তু আপনাকে ছেড়ে যাবো না।”

নাহিদের কথা জড়িয়ে আসছে।কিছুতেই চোখ খুলে রাখতে পারছে না।আরজুকে এই মুহূর্তে এই জায়গা থেকে সরাতে না পারলে সব শেষ হয়ে যাবে।সে আরজুকে কি করে বুঝাবে বুঝতে পারলো না।নাহিদ আরজুর চিবুকে আলতো স্পর্শ করে বললো

-” তোমাকে যেতেই হবে আরজু।আমার সন্তানের জন্য হলেও যেতে হবে।তাকে সুন্দর একটা জীবন দিতে হবে।”

আরজু নাহিদের গলা জড়িয়ে ভেজা কণ্ঠে বললো
-” আমাকে এতো বড়ো শাস্তি দেবেন না নেতা সাহেব।আমি আপনার সব কথা শুনবো কিন্তু এই কথা ছাড়া।আপনাকে ছাড়া আমাদের জীবন কখনোই সুন্দর হবে না।বিবর্ণ,বিষাদময় হবে।”

নাহিদ বুঝলো আরজু এই ভাবে যাবে না।রতন তখনও শত্রু পক্ষের সাথে লড়ছে।নাহিদ রতনকে বললো

-” রতন তোমার ম্যাম কে যেভাবে পারো নিয়ে যাও।”

আরজু মানা করতে লাগলো।নাহিদ আরজুকে জড়িয়ে ধরে প্রিয়তমার অধরে গভীর চুমু খেয়ে বললো

-” আমার আরজু কখনোই হেরে যাবে না।একজন নেতা যোগ্য অর্ধাঙ্গী হয়ে দেখাবে।জীবনে সব সমস্যা সাহসিকতার সাথে মোকাবেলা করবে।নাহিদের স্ত্রী কখনোই ভীতু হতে পারে না।আমার আরজু হবে সাহসী।প্লিজ আরজু প্রমিজ করো,আমি পাশে থাকি বা না থাকি তুমি আমার জুনিয়রকে নিয়ে সুন্দর একটা জীবন উপভোগ করবে।আমার সন্তানকে তার বাবার সাহসিকতার গল্প শুনাবে।আর আমি যদি কোনোভাবে ফিরে আসতে না পারি তবে বাবাকে বলো, তার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই।সে যেনো মনে কোনো গিল্ট না রাখে।”

আরজু তখনও নাহিদকে জড়িয়ে ধরে অনবরত কাদঁছে।এসব কেনো বলছে নেতা সাহেব? সে কি বুঝতে পারছে না এসব শুনে আরজুর কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে।নাহিদ আরজুর চোখের জল মুছে বললো

-” এই অশ্রু কনা খুব দামী আরজু।এভাবে ঝরিও না।।আমি আমার আরজুর নিটোল চোখে অশ্রু মোটেও সহ্য করতে পারিনা।সর্বদা চঞ্চল,হাসি খুশি আরজু আমার বেশি পছন্দ।তুমি সবসময় হাসি খুশি থাকবে।আমি যেখানেই থাকি না কেনো তুমি আমার অনুপস্থিতিতে দুর্বল হয়ে পড়বে না।এই নেতা সাহেব তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে আরজু।তুমি আমার জীবনে পাওয়া সবচাইতে দামি উপহার। যদি আর দেখা না হয় তবে মনে রেখো, তোমার জন্য আমি অন্য কোথাও অপেক্ষায় থাকবো।”

আরজুর বুকে যেনো কেউ ধারালো ছুরি বসিয়ে দিয়েছে।বুকের ভেতর রক্তক্ষরণ হচ্ছে।মেয়েটা নিঃশ্বাস নিতে পারছে না।কেমন দম বন্ধ হয়ে আসছে।নেতা সাহেবের বলা প্রতিটি বাক্য আরজুর মস্তিষ্ককে সাংঘাতিক আঘাত করছে।আরজু নাহিদের ওষ্ঠে স্পর্শ করে বললো

-” এই আরজু আপনাকে অসম্ভব ভালোবাসে।এই পাগলাটে আরজুকে সামলানোর জন্য নেতা সাহেবের প্রয়োজন।তাকে ছাড়া এই আরজু মৃত লাশ ছাড়া আর কিছুই না।তাই দয়া করে আমাকে যেতে বলবেন না।আমি শেষ নিশ্বাস অব্দি আপনার পাশে থাকতে থাকতে চাই।”

নাহিদ রতনকে ইশারা করলো।রতনের নিজেকে অসহায় লাগছে।এই দম্পতির ভালোবাসার বহঃপ্রকাশ দেখে তার কঠিন হৃদয়ও ব্যাথিত হলো।এই দেশে ভালো মানুষ গুলো বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনা।অসাধু লোক গুলো তাদের টেনে হিচরে সরাতে উঠে পড়ে লাগে।নাহলে নাহিদের মতো যোগ্য নেতার আজ এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো না।স্বামীর প্রতি আরজুর আনুগত্য দেখে রতন নিজেই ইমোশনাল হয়ে পড়লো।স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক অদৃশ্য মায়ার বাঁধনে আটকে থাকে।এই বাঁধনে ছিঁড়ে গেলে কেমন নিঃস্ব হয়ে পড়ে তারা।একারণেই তারা একে অপরের পরিপূরক।

সে আদেশ পালন করে আরজুকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো।আরজু তখনও নাহিদের হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে।এই হাত সে কিছুতেই ছাড়তে রাজি না।রতন এক প্রকার টেনে হিচড়ে আরজুকে নিয়ে যেতে লাগলো।নাহিদ নিজেও জানে না এই হাত পুনরায় ধরতে পারবে কিনা?

আরজু আর রতন যাতে সুস্থ ভাবে যেতে পারে তাই নাহিদ হামাগুড়ি দিয়ে অন্য গাছের আড়ালে চলে গেলো।আর সেখান থাকে শত্রুদের হামলা করতে লাগলো।এতে করে শত্রুদের মনোযোগ সম্পূর্ন নাহিদের দিকে চলে যাবে। অন্ধকারে আর আরজু পিছু করবে না।

আরজু যেতে যেতে দেখতে পাচ্ছে নাহিদ শত্রুদের দিকে গুলি ছুঁড়ছে।আরজুর দিকে চোখ পড়তেই সে আরজুর দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো।হাত দিয়ে ফ্লাইং কিস ছুড়ে মারলো।আরজু চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলো নেতা সাহেবের গালে চিক চিক করা অশ্রু কনা।আরজু রতনের হাত ছাড়িয়ে নেতা সাহেবের দিকে যেতে চাইলো।কিন্তু বিশাল দেহী রতনের হাত থেকে ছুটতে পারলো না।ধীরে ধীরে নাহিদ আধারে মিলিয়ে গেলো।আরজু কষ্টে ক্ষোভে রতনের হাতে খামচি,কামড় দিতে লাগলো।কিন্তু রতন যেন নিজ দায়িত্বে অনড়।সে শক্ত করে আরজুকে ধরে হাইওয়ে রাস্তায় উঠে পড়লো।

কিছু সময়ের মধ্যেই বেশ কিছু আর্মির ফোর্স এসে তাদের সামনে থেমেছে।গাড়িতে নকীব মাহমুদকে দেখে আরজু কান্নায় ভেংগে পড়লো।উদ্বিগ্ন নকীব মাহমুদ কাছে আসতেই রতন আরজুকে ছেড়ে দিল।আরজু ধপ করে মাঝ রাস্তায় বসে পড়লো।মাথার চুল টেনে চিৎকার করে কাদল মেয়েটা।নকীব মাহমুদ দ্রুত আরজুকে জড়িয়ে ধরলেন।বললেন

-” তুমি ঠিক আছো আরজু মা?”

আরজু পাগলের মতো আওরালো
-” আমার নেতা সাহেব ঠিক নেই।একদম ঠিক নেই।তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।তার পায়ে গুলি লেগেছে।পিঠেও আঘাত পেয়েছে।অনেক রক্ত ঝরছে তার।তাজা লাল রক্ত।ওকে বাঁচান চাচু।ওকে বাঁচান।আপনার পায়ে পড়ি আমার নেতা সাহেব কে এনে দিন।”

আরজুর পাগলামো দেখে নকীব মাহমুদ মাথায় হাত বুলিয়ে বললো

-” কিছু হবে না নাহিদের।তুমি অপেক্ষা করো আমি ওকে নিয়ে আসছি।”

নকীব মাহমুদ জঙ্গলের দিকে ফোর্স নিয়ে অগ্রসর হলেন।আরজুকে যাওয়ার অনুমতি দিলেন না।আরজু বাধ্য হয়ে সেখানে দাড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো।নেতা সাহেবের উপর আরজুর তীব্র অভিমান জমেছে।সর্বদা পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাকে নিজের কাছথেকে সরিয়ে দিলেন।বিপদ দেখে নিজে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে দূরে ঠেলে দিলেন।এই ভুলের শাস্তি আরজু তাকে দিবে।খুব করে দিবে।
_______________

অন্ধকার আকাশের চাঁদটাও আজ ঘন কালো মেঘে ঢেকে আছে।রাস্তার ল্যাম্প পোস্টের নিচে দাড়িয়ে আরজু অস্থির চিত্তে নেতা সাহেবের অপেক্ষা করছে।তার পাশে দাড়িয়ে আছে কয়েকজন অফিসার।রাতের আধারে হঠাৎ করে এলোমেলো,বিধ্বস্ত আরজুকে দেখে যে কেউ ভয় পেয়ে যাবে।চোখ দুটো অসম্ভব ফুলে লাল হয়ে আছে। চোখে মুখে উদ্বিগ্নতার ছাপ।হাত পায়ের বেশ কিছু জায়গায় ছিলে সামান্য রক্ত পড়ছে।

আরজু তীর্থের কাকের মতো জঙ্গলের পানে তাকিয়ে আছে।এই বুঝি সে আসলো। এসে আরজুকে জড়িয়ে বললো

“নিবরাস নাহিদকে এতো হালকা ভাবে নেওয়া ঠিক হয়নি তোমার।”

কিছুক্ষণ পরই দেখলো আর্মির ফোর্স জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসছে।পেছনে আছে নকীব মাহমুদ।আরজুর মুখে হাসি ফুটে উঠল।কিন্তু পেছনে নাহিদকে দেখতে পাচ্ছে না।চিন্তিত আরজু দৌড়ে নকীব মাহমুদের সামনে দাড়িয়ে বললো

-” নেতা সাহেব কোথায় চাচু।উনি ঠিক আছেন?”

নকীব মাহমুদ অসহায় দৃষ্টিতে আরজুর দিকে তাকালেন।আরজু ভরকে গেল।শুকনো ঢোক গিলে বললো
-“কথা বলছেন না কেনো? উনি কোথায়? চাচু তাকে জলদি হসপিটালে নিতে হবে।অনেক আহত সে।উনি অনেক কষ্ট পাচ্ছেন।দ্রুত আসতে বলুন তাকে।”

নকীব মাহমুদের চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।আরজু আতঙ্কিত হয়ে নকীব মাহমুদের কলার টেনে ধরলো।প্রচন্ড রেগে বললো

-” আপনি উনাকে ছাড়াই এসে পড়েছেন? কেমন অফিসার আপনি? আর কেমন ফোর্স আপনার।শত্রুদের ভয়ে ফিরে এসেছেন? ওইদিকে আমার নেতা সাহেব একা তাদের সাথে লড়ছে।আপনি কেমন চাচা তার? নিজের ভাতিজাকে ছেড়ে চলে এসেছেন?আপনাদের কাউকে আমার প্রয়োজন নেই।আমি নিজেই আমার নেতা সাহেবের কাছে যাচ্ছি।”

বলেই আরজু সামনে অগ্রসর হতে গেলেই দেখলো দুজন লোক স্ট্রেচারে করে কাউকে নিয়ে আসছে।রাতের আধারে মানুষটিকে স্পষ্ট না দেখলেও আরজু অনুমান করতে পাড়লো এটা নেতা সাহেব।সে দৌড়ে গেলো সেখানে।দেখতে পেলো নেতা সাহেবের বিবর্ণ,বিষাদময় মুখখানা।চোখ জোড়া বন্ধ।আরজু নাহিদের সারা মুখে হাত বুলিয়ে দিলো।ডাকলো তার নেতা সাহেব কে।

-“আপনি ঠিক আছেন? নেতা সাহেব?শুনতে পাচ্ছেন?”

নাহিদ কে সাড়াশব্দ করতে না দেখে আরজু রতনের উদ্দেশে বললো

-” তোমার স্যার কি সেন্সলেস হয়ে পড়েছে।সারা দিচ্ছেনা কেনো?”

রতন কিছুই বলতে পাড়লো না।আরজুর হঠাৎ চোখ পড়ল নাহিদের শরীরের দিকে।সাদা পাঞ্জাবি লাল রক্তে ভেসে যাচ্ছে।বুক আর পেটের বেশ কিছু জায়গা গুলিবিদ্ধ।সেখান থেকেই তাজা রক্ত ঝরছে।আরজু থমকে গেলো।তার পুরো পৃথিবী যেনো মুহূর্তেই থেমে গেলো।আরজু ঠোঁট জোড়া অসম্ভব কাপছে।সারা শরীর ঝাকুনি দিয়ে উঠলো।কাপা কাপা হাতে নাহিদের গালে হাত রেখে ডাকলো

-” নেতা সাহেব? শুনতে পাচ্ছেন? আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না?আপনার কিছু হবে না।রতন জলদি নেতা সাহেবকে গাড়িতে তুলো।তাকে হসপিটালে নিতে হবে।দেখছ না তার গায়ে কতো গুলো গুলি লেগেছে? এতো পেইন আমার নেতা সাহেব নিতে পারবে না।জলদি চলো।”

নাহিদকে দ্রুত গাড়িতে তুলে নেওয়া হলো।আরজু নাহিদের পাশে বসে নাহিদের হাত জড়িয়ে রইলো।আর এক দৃষ্টিতে নেতা সাহেবের নিথর দেহটির দিকে তাকিয়ে রইলো।

নকীব মাহমুদ রাস্তার মাঝেই বসে পড়লেন।জঙ্গলে পৌঁছে তিনি দেখেছেন তার সাহসী ভাতিজা একাই শত্রুদের সাথে লড়াই করছে।তারা দ্রুত নিজেদের পজিশন নিয়ে শত্রুদের ঘেরাও করে ফেললো।কিন্তু শত্রু দল আক্রমণ থামালো না।ফলে নকীব মাহমুদকে একে একে সকলকে শুট করতে হলো।কিন্তু নাহিদের কাছাকাছি আসতেই তিনি থমকে গেলেন।নাহিদের বুকে আর পেটে পরপর তিনটা গুলি করা হয়েছে।কিন্তু এই ছেলে তখনো দমে যায়নি।সে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত শত্রুদের কাছে হারতে নারাজ।নিজের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছিলো।হাতের মুঠোয় গান শক্ত করে ধরা।সারা শরীর থর থর করে কাপছে।নাহিদ চাচু কে দেখে মলিন হাসলো।যেই হাসি জানান দিচ্ছে তার অসম্ভব যন্ত্রণার।নাহিদ সামনের সবকিছুই আবছা দেখছে।নিঃশ্বাস নিতে পারছে না।ফলে বুক অস্বাভাবিক ভাবে উঠানামা করছে।বুকের বা পাশের একটু নিচে দুটো গুলি এসে লেগেছে।পেটের ডান পাশে আরেকটা। এতো যন্ত্রণা এই ছেলেটা সহ্য করছে কি করে?সে বহু কষ্টে বললো

-” চাচু আরজু?

নকীব মাহমুদ নাহিদকে বুকে টেনে নিয়ে কেঁদে বললেন
-” তোর আরজু একদম ঠিক আছে।”

নাহিদ সস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো।তীব্র ব্যাথায় তার চোখ মুখ কুচকে আসছে।সে অনেক কষ্ট ভাঙ্গা গলায় বললো

-” আমার আরজুকে দেখে রেখো চাচু।আমার অনাগত সন্তানকে দেখে রেখো।ওকে দেখতে না পারার আফসোস আমার কোনোদিন মিটবে না।নিজের সন্তানকে একবার কোলে তুলতে পারলাম না।আমি মা হারা হয়েছিলাম আর আমার সন্তান বাবা হারা হবে।ওদের খেয়াল রেখো চাচু।”

নকীব মাহমুদ চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন।সন্তান সমতুল্য নাহিদকে তিনি অসম্ভব ভালোবাসেন।আর আজ নাহিদের এই করুন অবস্থা তার হৃদয় ভেঙেচুরে দিচ্ছে।তিনি নাহিদের রক্ত মাখা মুখটায় হাত বুলিয়ে বললেন

-” তোর কিছু হবে না।দেখিস তোর সন্তান বাবা হারা হবে না।”

তিনি দ্রুত নাহিদকে স্ট্রেচারে তুলতে বললেন।নাহিদ তখনও তীব্র যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছিল।কিন্তু কিছুদূর আসার পর আর নাহিদের সারা শব্দ পাওয়া গেলো না।নাহিদের হার্ট রেট ধীরে ধীরে কমতে লাগলো।অজানা ভয়ে,আতঙ্কে নকীব মাহমুদ মূর্ছা গেলেন।তাই আরজুর সামনে কিছুই বলতে পারলেন না।
____________________

পার্থিব জীবনে সব কিছুই অনিশ্চিত।তবুও মানুষ এই অনিশ্চয়তার মাঝেই স্বপ্ন দেখে।সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যায়।জীবন কখন আপনাকে কোন মোড়ে নিয়ে যাবে সেটা পূর্বে ধারণা করা বেশ কঠিন।তবুও আমরা থেমে থাকি না।কারণ জীবন সময়ের গতিতেই চলতে থাকে।সুখ দুঃখ জীবনেরই একটা অংশ।সবটা মিলিয়েই মানুষের জীবন।

হসপিটালের করিডোরে সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে পায়চারি করছে। চেয়ারে বসে সাবা খানম চিন্তায় হাসফাস করছে।তাকে একটু পর পর পানি খাওয়াচ্ছে জুবায়ের আহমেদ।অবনি দাত দিয়ে নখ কামড়াতে কামড়াতে কামড়াতে ওটি রুমের দিকে তাকাচ্ছে।চঞ্চল মেয়েটাও কেমন গভীর চিন্তায় মগ্ন। নাঈম মাহমুদ,নূরজাহান বেগম,নিবিত মাহমুদ আর জাহিদ একপাশে দাড়িয়ে আছে।নাঈম মাহমুদের দৃষ্টি দূরের মেঘলা আকাশের দিকে।মনটা তার ভীষণ বিক্ষিপ্ত।আর ওটির দরজার মুখোমুখি দাড়িয়ে আছে শুভ।অনেক ক্ষন যাবত ভেতর থেকে একজন নারীর আর্তনাদ ভেসে আসছে।শুভ দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বুজে নিজেকে সামলাতে ব্যাস্ত।এই চিৎকার তার মস্তিষ্ক অব্দি আঘাত করছে।বুকের ধুকপুকানি বেড়েই চলছে।এক ছুটে তার কাছে চলে যেতে মন চাইছে।তার ঠিক পাশেই দাড়িয়ে রিমি।শুভর কাধে হাত রেখে তাকে শান্ত করার চেষ্টায় ব্যস্ত।তাছাড়া ফুয়াদ,জারা,সাবিহা সবাই করিডোরে দাঁড়িয়ে।সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় রয়েছে নতুন ভোরের।

সকলের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে একজন নার্স বেরিয়ে আসলো।তার হাতে তোয়ালের ভেতর মোড়ানো ফুটফুটে একটি নবজাতক শিশু। নার্সকে দেখে সবাই হুড়মুড় করে সামনে এগিয়ে আসলো।নার্স এতো লোক দেখে কনফিউজড হয়ে পড়লো। কার কাছে এই বাচ্চাটি দিবে ভেবে পেলো না।সাবা খানম এগিয়ে আসলেন।বাচ্চাটিকে কোলে নিয়েই তিনি চাপা কান্নায় ভেংগে পড়লেন।এমন চাঁদ মাখা মুখ তিনি শেষ কবে দেখেছেন মনে পড়ছে না।কি মায়াবী মুখখানা।তিনি গভীর ভাবে বাচ্চাটিকে পর্যবেক্ষণ করলেন।আলতো স্পর্শে কপালে চুমু খেলেন।শুভ পাশেই দাড়ানো ছিলো।সাবা খানম অশ্রুসিক্ত নয়নে মৃদু হেসে বাচ্চাটিকে শুভর কোলে দিলেন।এতো ছোট,কোমল বাচ্চাটি কোলে নিতে সে ভীষণ ভয় পাচ্ছিল।তবুও নিজেকে থামাতে পারলনা।পরম যত্নে কোলে নিতেই শুভর অদ্ভুদ অনুভূতি হলো।এমন অনুভূতি জীবনে কখনোই হয়নি।এই অনুভূতির কোনো নাম নেই।একটা ছোট্ট প্রাণ কেমন করে তার পুরো সত্তাকে নাড়িয়ে দিচ্ছে।সে পরম আদরে বাচ্চাটির কপালে চুমু খেল। এ যে আরজু অংশ।
নাঈম মাহমুদ বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে চমকে গেলেন।মনে পড়ে গেলো বহু বছর আগে ঠিক এমন একটি নবজাতক তার কোলে ছিলো।দেখতে হুবহু এক।ছোট ছোট হাতপা মুচড়াচ্ছে।নাঈম মাহমুদ নিশব্দে অশ্রু বিসর্জন দিলেন।বাচ্চাটি কানে মধুর সুরে আযান শুনালেন।এতে বাচ্চাটি চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো।নাঈম মাহমুদ ভেজা চোখে হেসে মায়ের উদ্দেশে বললেন

-” দেখেছেন আম্মাজান আমার নাতি একদম আমার নাহিদের মতো হয়েছে।আমার মনে হচ্ছে আমার সেই ছোট্ট সোনাকে কোলে তুলেছি।একই রকম অনুভব হচ্ছে।”

নূরজাহান বেগম মন ভোরে দোয়া করলেন।একে একে সকলেই বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিলো।সবাই অবাক হয়ে দেখলো নরম,তুল তুলে বাচ্চাটিকে।বাচ্চাটি দেখতে একদম তার বাবার মতো হয়েছে।যেনো দ্বিতীয় নাহিদ। এতো মিল কি করে হয়?

শুভ ধীরে ধীরে অবজারভেশন রুমের দিকে এগুলো। বেডে ক্লান্ত, নিস্তেজ হয়ে ঘুমিয়ে আছে আরজু।মলিন মুখটায় মিশে আছে হাজারো মায়া।কিছুক্ষণ আগেও প্রসব বেদনায় মেয়েটার মুখ কেমন রক্তিম হয়ে উঠেছিল।শুভ তখন ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিলো।আরজুর সামান্য যন্ত্রণা ও শুভকে উন্মাদ করে তুলে।আরজুর চোখে মুখের এখনো ক্লান্তি ছাপ স্পষ্ট। শুভ আরজুর শিয়রে দাড়িয়ে আরজুর এলোমেলো চুলে হাত বুলালো।ভারী পল্লব জোড়া পিট পিট করে খুলে হালকা তাকালো আরজু।শুভ মৃদু হেসে বললো

-” কীরে ভেবলি, এতো ছোট্ট একটা বাচ্চা জন্ম দিয়ে গিয়েই তোর হালুয়া টাইট?আমাদের দাদী নানীরা এক সাথে কতো বাচ্চা সমলিয়েছে জানিস?”

আরজু দুর্বল শরীরটা নাড়াতে পারলো না।মলিন হেসে বললো

-” তোর বিয়ের পর বউকে বলিস এক গাদা বাচ্চা পয়দা করতে।”

শুভ মৃদু হাসলো।আরজু করুন কণ্ঠে বললো

-“আমি বলেছিলাম তাকে যে ছোট্ট নেতা সাহেব আসবে।কিন্তু তিনি মানতেই নারাজ ছিলো।আমি তো মা।আমি আগেই বুঝতে পেরেছি আমার ছোট্ট নেতা সাহেব আসছে।এইবার ছেলেকে দেখিয়ে আমি তুমুল ঝগড়া করবো তার সাথে।এমনি আকাশ সমান অভিমান জমে আছে।তার সাথে দেখা হলে মোটেও কথা বলবো না।”

শুভ কিছুই বললো না।মলিন দৃষ্টিতে আরজুর দিকে তাকিয়ে রইলো।আরজুর চুলে হাত বুলিয়ে বললো

-” তুই কতো বড় হয়ে গেছিস আরজু।বাচ্চার মা হয়ে গেছিস।আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা।কয়দিন আগেও চুলে ঝুটি বেধে গাল ফুলিয়ে আমার সাথে ঝগড়া করতে আসতি।”
-” আমার গাল মোটেও ফোলা ছিলো না।আমি সর্বদাই কিউট ছিলাম।আর আমি না তুই ঝগড়া করতি।”

শুভ হাসলো।মেয়েটাকে হাসলে এতো ভালো লাগে কেনো? একজন নার্স এসে বাচ্চাটিকে আরজুর পাশে শুইয়ে দিলো।অসম্ভব মায়াবী শিশুটি মায়ের পাশে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে।আরজু এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলো।ভাবলো নেতা সাহেব নিজের সন্তানকে দেখলে নিশ্চই সুখে কাদতেন।সুখ জিনিসটা আরজুর জীবনে কখনোই স্থায়ী ছিল না।জীবনের খাতা খুললে সেখানে না পাওয়ার পৃষ্ঠায় বেশি লেখা পাবে।আরজুর দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।চোখের সামনে ভেসে উঠলো পুরনো দিনের কিছু ভয়ঙ্কর স্মৃতি।

সেদিন নাহিদকে হাসপাতালে নেওয়ার পর ডক্টর তাকে মৃত ঘোষণা করেন।একাধিক গুলির আঘাতের প্রচন্ড যন্ত্রণা ভোগ করে ধীরে ধীরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে নাহিদ।হসপিটালে নেওয়ার আগেই সে নিস্তেজ হয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে।এই খবরটা আরজুর সত্তাকে নাড়িয়ে দিয়েছিলো। একদম পাথর বানিয়ে দেয় মেয়েটাকে।কিছুক্ষণ অব্দি আরজু বুঝতেই পারেনি কি হচ্ছে।এই খবর আরজুর শরীরের রক্ত হিম শীতল করে তুলেছিলো।আরজু যেনো কথাটা বিশ্বাস করতে পারেনি।নাহিদের সারা মুখে অস্বাভাবিক ভাবে হাত বুলাতে বুলাতে পাগলের মতো বলতে থাকে

-” কি বলছেন আপনারা এসব? আমার নেতা সাহেবের কিছুই হয়নি।তার মতো সাহসী ব্যাক্তির কিছুই হতে পারে না।কয়েক ঘন্টা আগেও আমার এই হাত শক্ত করে ধরে রেখেছিল।নেতা সাহেব আপনি জলদি উঠুন তো। এরা কেউ চায়না আমরা সুখে থাকি।জলদি উঠে এদের দেখিয়ে দিন।ওরা সবাই মিথ্যা বলছে।আমার নেতা সাহেবের কিছুই হয়নি।সে আমাকে রেখে কোথাও যাবে না।উঠুন তো জলদি।আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি।এমন করলে আর আপনার সাথে কথা বলবো না।শুনতে পারছেন আপনি?”

আরজু অনবরত নাহিদকে ডাকতে লাগলো আর নাহিদের সারা মুখে চুমু খেতে লাগলো।আরজুর অস্বাভাবিক আচরণ দেখে নকীব মাহমুদ আরো ভেঙে পড়লেন।তিনি ফ্লোরে বসে কাদতে লাগলেন।নাহিদের সাথে তার বাবার সম্পর্কে ফাটল থাকলেও চাচার সাথে ছিলো ভীষণ ভালোবাসার সম্পর্ক।তিনিও নাহিদকে নিজ সন্তানের চাইতেও বেশি ভালবাসতেন।সকলকে নাহিদের কথা গর্ভের সাথে বলতেন।এইভাবে নাহিদের চলে যাওয়া তিনি মানতেই পারছেন না।

রতন আরজুর পাগলামি দেখে নিচের ঠোঁট কামড়ে নিজের কান্না রোধ করতে চাইলো।নাহিদের পাশাপাশি থেকে সে সর্বদা দেখেছে আরজুর প্রতি নাহিদের তীব্র ভালোবাসাকে।আরজুর সকল খবরাখবর দেওয়ার দায়িত্ব বহু বছর আগে রতনের হতেই ছিলো।আরজুর নিরাপত্তার ভার সে অনেক বছর আগেই পেয়েছে।আড়ালে থেকে আরজুর নিরাপত্তা দেওয়া কাজটা সে নিষ্ঠার সাথেই পালন করেছে।

তীব্র ভালবাসার মানুষ গুলোর বিচ্ছেদে এমন মরণ যন্ত্রণা কেনো হয়?এই মেয়েটাও আজ স্বামী হারা হয়ে উন্মাদ হয়ে উঠছে।ভালোবাসার অনুভূতি এতো তীব্র কেনো হয় যে বিচ্ছেদে পো অপর মানুষটিকে মৃত লাশ বানিয়ে দেয়।সেদিন আরজুর উন্মাদনার সাক্ষী হয়েছিল পুরো হসপিটাল।সকলের চোখেই ছিলো অশ্রু।স্বামী হারা এই রমণীর আর্তনাদ সকলের হৃদয়কে নাড়িয়ে দিয়েছিল সেদিন।

নাঈম মাহমুদ হসপিটালে এসে ছেলের নিথর দেহ দেখে সেখানেই স্ট্রোক করেন।এতদিন পর ছেলেকে কাছে পেয়ে আবার হারানোর যন্ত্রণা মানুষটা নিতে পারেনি।তাকে তখনই সেই হসপিটালে ভর্তি করানো হয়।ধীরে ধীরে অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে।

পরের সময়টা দ্রুত কেটে যায়।আরজু পুরোপুরি অস্বাভাবিক হয়ে যায়।সারাদিন অন্ধকার রুমে চুপটি করে বসে থাকে।মাঝে মাঝে পুলের পানিতে পা ডুবিয়ে নেতা সাহেবকে অনুভব করে।কারো সাথেই দেখা করে না।কথা বলে না।নিজেকে চার দেয়ালের মাঝে অবদ্য করে ফেলে।প্রথমে বাবা মা তার পর প্রিয়তম স্বামী হারানোর শোক আরজুকে অস্বাভাবিক করে তুলে। সাবা খানম আরজুর অবস্থা দেখে ভেঙে পড়েন।এতো কষ্টে মেয়েটা স্বাভাবিক জীবনে এসে একটু সুখের সন্ধান পেয়েছিল।কিন্তু সৃষ্টিকর্তা সেই সুখ টুকুও কেরে নিলো।দিন দিন আরজুর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে।

অন্যদিকে আসফি দিন রাত এক করে এই ঘটনার মাস্টারমাইন্ড কে খুঁজতে থাকে।বন্ধুর মৃত্যুতে সে ভীষণ ভেঙে পড়েছিল।কিন্তু মনে মনে পণ করেছে আসল অপরদিকে শাস্তি দিয়ে তবেই খান্ত হবে।তাদের সকলের সন্দেহের তালিকায় প্রথমেই আছে সাদমান।তাই দ্রুতই সাদমানকে অ্যারেস্ট করে রিমান্ডে নেওয়া হয়। টানা তিন দিন রিমান্ডের পরও সাদমান সবটাই অস্বীকার করে। আসফি সাদমানের সাথে জেলে দেখা করে। সাদমানের মুখোমুখি হয়ে আসফি নিজেকে কিছুতেই সংযত করতে পারে না।প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে নাক বরাবর কয়েকটা ঘুষি দিয়ে দেয়।পুলিশ দ্রুত তাকে থামায়।একজন অ্যাডভোকেট কে এমন বিধ্বংসী আচরণে মানায় না। আসফি প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে বললো

-” কেনো করলি এটা?ক্ষমতার লোভে পড়ে মনুষ্যত্ব হারিয়েছিস।যেই মানুষটা তোকে রাস্তা থেকে তুলে আজকের অবস্থানে এনেছে তাকে মারতে তোর হাত কাপল না? এতটা অমানুষ হয়ে গেছিস? ছি!! একসময় তুই আমাদের বন্ধু ছিলি ভাবতেই ঘেন্না হচ্ছে।”

তিন দিনের রিমান্ডের ফলে তার সারা শরীরে অসংখ্য ক্ষত আর ভীষণ দুর্বল। আসফি ঘুষিতে নাক ফেটে রক্ত পড়ছে।সে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না।ঢুলতে ঢুলতে বললো

” নাহিদকে আমি নিজের বন্ধুই ভেবেছিলাম।সর্বদা ওর পাশে থেকেছি।নিজের সর্বোচ্চ দিয়েছি পার্টির জন্য।কিন্তু কেউ আমার পরিশ্রম দেখেনি।সবার মুখে মুখে শুধু নাহিদের নাম।আমাকে কারো চোখেই পড়তো না।নাহিদ যেনো সবাইকে নিজের মায়া জালে বশ করে রেখেছিল। আমার কাছে তখন নাহিদকে বিষাক্ত লাগতো।তবুও ওর বিরুদ্ধে কিছুই করিনি।এসবের মধ্যে আমি প্রথম কোনো মেয়েকে মন দিয়ে ফেলেছিলাম।এক দেখায় মেয়েটাকে ভালো লেগেছিলো।কিন্তু নাহিদ সেখানেও নিজের আধিপত্য দেখিয়েছে।আরজুর উপর তার আরো আগে থেকেই নজর।আরজুর প্রতি সে ওভার পজেসিভ।আমাকে রীতিমতো ওয়ার্নিং দিয়ে রেখেছিল আরজুর কাছ থেকে দূরে থাকতে।সেদিন রাগে আমার সব ধ্বংস করে দিতে ইচ্ছে করছিল।নারী,পাওয়ার,সম্মান সব ওর ঝুলিতে।আর আমি শূন্য।মনে মনে ওকে প্রচন্ড ঘৃনা করতে থাকি।ওর দাদাজানের জন্য সে সবার কাছে সম্মানী ব্যাক্তি হয়ে উঠেছে।আর আমি নাহিদের একজন চেলা হয়ে সাইডে পড়ে ছিলাম।কিন্তু আমি এমন চায়নি।আমি ক্ষমতা চেয়েছি।সবাই আমাকে সম্মান করুক সেটাই চেয়েছি।যেটা এই পার্টিতে থেকে সম্ভব ছিল না।তাই বিরোধী পার্টির সাথে হাত মিলিয়ে ছিলাম।কিন্তু নাহিদ আমাকে এক্সপোজ করে দিলো।আমাকে পার্টি থেকে বহিস্কার করা হলো।পার্টি থেকে বেরিয়ে বিরোধী দলের সাথে হাত মিলিয়ে ছিলাম।আমি সেখানেও প্রাপ্য সম্মান পায়নি।”

সাদমান জোরে নিঃশ্বাস ফেলে আবার বললো

-“নাহিদকে আমি প্রচন্ড ঘৃনা করি এটা সত্যি,কিন্তু তাই বলে তাকে মেরে ফেলবো এতটাও নিকৃষ্ট আমি নই।নাহিদকে আমি ক্ষমতা থেকে সরাতে চেয়েছি।ওর ধম্ভ গুড়িয়ে দিতে চেয়েছি কিন্তু ওর মৃত্যু কামনা কখনো করিনি।বরং যখনই আমি টের পেয়েছি নাহিদের জীবন সংশয় আছে তখনই নাহিদকে ইন্ডেরেক্টলি সাবধান করেছি।আমার ইঙ্গিত কিন্তু বিচক্ষণ নাহিদ বুঝতে পারতো।তাই সাবধান হয়ে যেত।নাহিদ আর আমার মধ্যে বিশাল দ্বন্দ থাকলেও কোথাও না কোথাও আমি বা নাহিদ দুজনই দুজনের প্রতি মায়া অনুভব করতাম।এই কারণেই হয়তো আরজুকে সত্যি বলার পরও সে আমাকে জানে মারতে পারেনি।কিন্তু আমাকে আইনের কাছে উন্মোচন করে দিয়েছে।নাহিদের মৃত্যু আমাকেও ভীষণ কষ্ট দিয়েছে আসফি।বিশ্বাস কর।”

আসফি অনুভব করলো সাদমান সত্যি বলছে।কিন্তু সাদমান আর ছাড়া পায়নি।দুর্নীতি আর চোরাচালানির দায়ে জেলেই থাকতে হয়েছে।খুব দ্রুত আদালত তাকে যোগ্য শাস্তি দিবে।
আসফি তখন পাগল প্রায়।অপরাধী স্বাধীন ভাবে ঘুরে বেড়াবে সেটা সে হতে দিতে পারে না।কে এই কাজ করেছে সেটা বের না করে সে খান্ত হবে না।

নাহিদের মৃত্যুতে সারা দেশে শোকের ছায়া নেমে আসে।একজন দায়িত্ববান,সাহসী যোগ্য নেতার মৃত্যু কেউ মেনে নিতে পারছিলো না।সকলের দাবি অপরাধীকে চিহ্নিতকরণ করে যোগ্য শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক।মিডিয়াতে তোলপাড় চলছে।পুলিশ তাদের কাজ করে যাচ্ছে। আসফি মোটেও থেমে নেই।সে পুরো দমে ইনভেস্টিগেশন চালিয়ে যাচ্ছিল।ফাইনালি সে আসল অপরদিকে ধরতে সক্ষম হয়।

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_86

কোলাহল পূর্ণ চারপাশ।সারা হলরুম জুড়ে মানুষের আনাগোনা।সবার দৃষ্টি স্টেজে বসা রূপসী রমণীর দিকে। গাঢ় লাল বেনারসি শাড়িতে মেয়েটা কে অপ্সরী লাগছে।সবাই দেখছে মেয়েটির মিষ্টি মুখখানা।বাহ!! সত্যি অপুরুপ সেই দৃশ্য।সেখানেই সামনের ফাঁকা জায়গায় ছোট্ট একটি বাচ্চা শেরওয়ানি পড়ে ছুটোছুটি করছে।ছোট ছোট হাত পা দুলিয়ে খেলছে।স্টেজে থেকে মেয়েটি সেই বাচ্চার দিকে তাকিয়ে হাসছে।তার মন চাইছে স্টেজ থেকে নেমে বাচ্চাটিকে একটু আদর করে দিতে।এতো কিউট কেনো ছেলেটা?সারাক্ষণ আদর করতে মন চায়।

হঠাৎ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে গেটে কারো পদার্পণ হলো।জোরে মিউজিক বাজতে লাগলো।সবাই বেশ আগ্রহ নিয়ে গেটের দিকে তাকাচ্ছে।মেয়েটিও উৎসুক দৃষ্টিতে গেটের দিকে তাকিয়ে রইলো।অনেক ছেলেমেয়ে সামনে কোমর দুলাচ্ছে মিউজিকের তালে তালে।হঠাৎ পেছন থেকে মাথায় টোপর পরা সুদর্শন পুরুষের আগমন ঘটে।সে মেয়েটির দিকে দৃষ্টিপাত করে মৃদু হেসে গানের তালে তালে ঠোঁট মিলিয়ে নাচতে লাগলো।

Hey ya … hey ya
Hey ya heeriye sehra bandhke main to aaya re
Hey ya doli barat bhi saath mein main to laya re
Hey ya heeriye sehra bandhke main to aaya re
Hey ya doli barat bhi saath mein main to laya re
Ab to na hota hai ek roz intezar
Soni aaj nahi to kal hai
Tujhko to bas meri honi re
Tenu leke main javanga
Dil deke main javanga
Tenu leke main javanga
Dil deke main javanga

সুদর্শন পুরুষটি নাচ শেষে মেয়েটির সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে হাত বাড়িয়ে দিলো।সকলের দৃষ্টি তখন তাদের দিকেই।মেয়েটা লজ্জায় মূর্ছা যাচ্ছে।এমন ফিল্মি ভাবে সকলের সামনে হাত বাড়িয়ে আছে কেনো পাগলটা?মেয়েটা বুঝলো এই পাগল আজ তাকে লজ্জায় মেরেই ফেলবে।কিন্তু বুকে অদ্ভুদ প্রশান্তি বয়ে যাচ্ছে।এমন একটি দিনের অপেক্ষা সে বহুদিন যাবত করছিলো।আজ যখন সবটা তার সামনে তখন ভীষণ লজ্জা লাগছে।পুরুষটি মৃদু হেসে বললো

-” আমার হৃদয় তোমার কাছে সমর্পণ করেছি বহু আগেই।কিন্তু পরিস্থিতি কখনো সেই কথা মুখ ফুটে বলতে দেয়নি।তবে আজ বলতে দ্বিধা নেই। ভালোবাসি তোমাকে প্রিয়তমা।হবেকি আমার ছোট্ট রাজ্যের রানী?কথা দিচ্ছি কোনোদিন ওই ডাগর ডাগর চোখের অশ্রুর কারণ হবো না।অভিমানের দেয়াল ভেঙে হাত টা একবার ধরে দেখো।”

মেয়েটি অনুভূতির সাগরে ভাসছে।সবটাই যেনো স্বপ্ন মনে হচ্ছে।তার দুচোখ ভিজে উঠলো মুহুর্তেই।পাস থেকে জারা বলে উঠলো

-” কেঁদে কেটে যদি মেকাপ নষ্ট করে ভূত হয় যাস, তবে বাসর ঘরে পরী না পেত্নীর দেখা পাবে বেচারা।”

মেয়েটি রাগী চোখে তাকালো জারার দিকে।ফুয়াদ ছেলেটির কাধে চাপড় মেরে বললো

-” তুই তো শালা হেব্বি রোমান্টিক।তোর কাছে আমিও ফেল।বউ না জানি আমাকে ফেলে চলে যায়।”

পাশে দাঁড়ানো লামিয়া পেছন থেকে ফুয়াদের পিঠে চিমটি কাটলো।ফুয়াদ লামিয়ার দিকে ফিরে মৃদু হেসে বললো

-” স্টেজে উঠে কি শুরু করলে।বাসায় গেলে তখন নাহয় চিমটি,খামচি,কামড়,চুমু সব দিও।”

লামিয়া লজ্জায় লাল হয়ে গেলো।এমন ঠোঁটকাটা লোককে নিয়ে সংসার করা ভীষণ কঠিন।যখন তখন এরা লজ্জা দিয়ে অস্থির করে ফেলে।লামিয়া লজ্জায় দ্রুত স্টেজ থেকে নেমে পড়লো।ফুয়াদ সেদিকে এক নজর তাকিয়ে বললো

-” লজ্জাবতী বউ নিয়ে যত ঝামেলা।মন খুলে প্রেম করা যায়না।যাই হোক,বউ মনে হয় ক্ষেপেছে।আজ খবর আছে আমার। শালা নিজে বাসর করবি আর আমি বিরহ করবো।”

ফুয়াদ চলে যেতেই রামিম সাবিহার উদ্দেশ্য বললো

-“তোর অভিমান ভাঙবে কিনা জানিনা কিন্তু এই ভাবে আর কিছুক্ষন বসে থাকলে আমার পা নিশ্চিত ভেঙে যাবে।পড়ে খোঁড়া জামাই নিয়ে চলতে হবে তোকে।”

সাবিহা মুচকি হেসে রামিমের হাতে হাত রাখলো।রামিম সাবিহার হাতের পিঠে আলতো স্পর্শ ছুঁয়ে দিলো।শিউরে উঠলো মেয়েটা।অনুভূতিরা যেনো আজ বেসামাল।ভালোবাসে মানুষটিকে পাওয়া সত্যি পরম সুখের।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে সাবিহার বাবা তাদের দিকেই তাকিয়ে রইলেন।সেদিন মেয়েটাকে জোর করে বিয়ে দিলে হয়তো মেয়েটার এই মিষ্টি হাসি আর সুখী দেখার সৌভাগ্য হতো না।হয়তো সারাজীবন বিষাদের ছায়া তার জীবনে নেমে থাকতো।একটা মেয়ে তার বিয়ের দিনেই যদি মন খুলে না হাসতে পারে তবে নতুন জীবনের সূচনা কি করে করবে?বুকে বিষাদের পাথর চাপা দিয়ে অন্যের ঘরে আলো ছড়াবে কি করে?আমাদের সমাজে অনেক সময় মেয়েদের জীবনের এই গুরুত্বপূর্ন সিদ্বান্ত টি চাপিয়ে দেওয়া হয়।অথচ এই সিদ্বান্ত নেওয়ার একমাত্র অধিকার তার একার।নিজের জীবন সঙ্গী বাছাই করার তার পূর্ণ অধিকার আছে।তবে আমাদের সমাজে সেটা সর্বদা হয়না।

রামিম নিজের কথা রেখেছে।আজ প্রায় তিন বছর পর তাদের কাঙ্ক্ষিত বিয়ের দিন।সাবিহার বাবার চোখ ভিজে উঠলো।মেয়ের বিদায়ের কথা ভাবলেই বুঝি প্রতিটি বাবার এমন যন্ত্রণা শুরু হয়?বুকে ভারী কিছু অনুভব করে? অতি ভালোবাসার সন্তানকে অন্যের হাতে তুলে দেওয়া কোনো বাবার জন্যই সহজ না।তার কাঁধে হাত রেখে সান্তনা দিলেন সাবিহার মা।বললেন

-” মেয়েকে এতো ভালোবাসেন কিন্তু মুখে প্রকাশ করেননা কেনো?”

তিনি চোখ মুছে বললেন

-” ছেলে মেয়েদের ভালোর জন্যই বাবা মাকে মাঝে মাঝে কঠিন হতে হয়ে।তাদের সর্বোচ্চ ভালো চাওয়াটা কোনো বাবার অপরাধ নয়।মেয়েকে একটা সিকিউর লাইফ দিতে চাওয়াটা সব বাবার স্বপ্ন।তাই তো একজন স্টাবলিস ছেলের হাতে মেয়েকে তুলে দিতে চায়।তার জন্য যদি সেই বাবাকে লোভী বা সুবিধাবাদী উপাধি দেওয়া হয় তবে সেটা মাথা পেতে নিতে সমস্যা নেই।”

————

রামিম মাস্টার শেষ করে সেখানেই বেশ ভালো একটি জব পেয়েছে। মোটা অংকের সেলারি পায়।সেখানেই সেটেল হয়েছে।বিয়ের পর সাবিহাকে সেখানেই নিয়ে যাবে।নিজের দুর অবস্থা থেকে ছেলেটা মেধার জোরে খুব দ্রুতই বেরিয়ে এসেছে। রামিমের শুধু একটাই আফসোস মাকে তার এই সাফল্য দেখাতে পারলো না।মানুষটা তার আগেই চলে গেছে।হয়তো মন থেকে ছেলের জন্য দোয়া করে গেছেন তাই রামিম এতো দূর অব্দি আসতে পেরেছে।রামিম ফিরে এসে সবার আগে সাবিহার জমানো অভিমান ভাঙতে লেগে পড়ে।অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে তবেই প্রিয়তমার মন খুশি করতে পেরেছে।সাবিহার বাবাও রামিমের প্রতি ভীষণ সন্তুষ্ট।মেয়েকে নির্দ্বিধায় তার হাতে তুলে দিতে রাজি হয়েছেন।ফলশ্রুতিতে আজ তাদের বিয়ে।

লামিয়া প্রচন্ড রেগে আছে।ফুয়াদ দ্রুত এসে দুষ্টুমি সুরে বললো

-” রেগে এমন লাল টমেটো হয়ে আছো কেনো?লাল লাল গাল দেখলেই আমার চুমু পায়।সবার সামনে এই কান্ড ঘটিয়ে ফেললে তোমার দোষ।”

লামিয়া রেগে আঙ্গুল তুলে বললো

-” চুপ।একদম চুপ।আপনার মুখে কোনো লাগাম নেই কেনো? যখন তখন আমাকে লজ্জায় ফেলেন।আপনার বন্ধুরা আমার কত বড়ো।তাদের সামনে আমাকে এমন লজ্জা না দিলে হতো না?”

-” আমি কি করলাম বাবা!! আমার মতো এতো ইনোসেন্ট ছেলে এই পুরো হল রুমে একটা খুঁজে পাবে?”

-“আপনি ইনোসেন্ট?মোটেও না।আপনি বদের হাড্ডি।অসভ্য।”

ফুয়াদ মুচকি হেসে লামিয়ার কাছাকাছি এসে বললো
-” আমার অসভ্যতার লেভেল তো জানোই।এতো লজ্জা কেনো তোমার? এতদিনেও তোমার লজ্জা শেষ হলো না। বুঝেছি ঝটপট আরেকটা হানিমুন প্ল্যান করতে হবে।”

লামিয়া থতমত খেয়ে গেল।লজ্জায় আসে পাশে তাকাতে তাকাতে বললো

-” আমি আপনার মতো অসভ্য লোকের সাথে কোথাও যাবো না।সেখানেও অসভ্যতাম করবেন।”

ফুয়াদ লামিয়ার উদরে আলতো স্পর্শ করে নিজের কাছাকাছি এনে বললো

-” হানিমুন মানেই তো অসভ্যতার চূড়ান্ত লেভেলে পৌঁছানো।তোমার এই লজ্জা আমাকে আরো অসভ্য করে তুলে।”

লামিয়া দ্রুত ফুয়াদের কাছ থেকে নিজেকে ছড়িয়ে নিলো।এই ছেলেটা তার দম বন্ধ করে ছাড়বে।সে দৌড়ে চলে যেতে যেতে বললো

-” আপনার জন্য শাস্তি আছে।আজ থেকেই আমি লামিসার রুমে থাকবো।”

ফুয়াদ মৃদু হেসে বললো
-” রুমের বাইরে এক কদম ফেলে দেখো তোমার অবস্থা কি করি।”

লামিয়া ততক্ষণে সেখান থেকে চলে গেছে।ফুয়াদ শব্দ করে হাসলো।জীবন আসলেই সুন্দর।যদি ভালোবাসার মানুষটি পাশে থাকে।ফুয়াদ এমন জীবনই সবসময় চেয়েছে।একজন যত্নশীল,দায়িত্ববান স্ত্রী।যেই মেয়ে মমতাময়ী মা রুপে,দায়িত্বশীল বোন হতে পারে সে নিঃসন্দেহে চমৎকার জীবনসঙ্গিনী হবে।

বছর খানেক আগেই ফুয়াদ বাবা মায়ের সামনে লামিয়াকে বিয়ে করবে বলে জানায়।যেহেতু সে নিজের পায়ে দারিয়েছে।তার মা বাবা দুজনেই এর ঘোর বিরোধিতা করে।ফুয়াদের মায়ের মনে ছেলের জন্য অনুশোচনা থাকলেও লামিয়ার মতো নিম্নবিত্ত মেয়েকে ঘরের বউ করতে রাজি ছিল না।বেশ কিছুদিন যাবত চেষ্টা করে ফুয়াদ যখন দেখলো বাবা মা কেউ মানছে না তখন তার জেদ আরো বাড়লো।একদিন বাবা মায়ের সাথে তুমুল ঝগড়া করে রাতে লামিয়ার বাসায় পৌছে বললো

-” লামিয়া আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।আর সেটা আজকেই।”

জেদি ফুয়াদের এমন কথায় মেয়েটা ঘাবড়ে গেছিলো।ভয়ে ভয়ে সে মানা করেছিলো ফুয়াদকে।ফুয়াদ তো নাছোড় বান্দা।বন্ধু মহলকে সেই রাতেই জড়ো করে কাজী ডেকে এনেছিল।লামিয়া এই পরিস্থিতি কি করবে বুঝতে পারছিলো না।বেচারি কেঁদে বুক ভাসাচ্ছিল।ফুয়াদকে সে ভালোবাসে সত্যি কিন্তু নিজের অবস্থান ভুলে ওমন ধনাট্য পরিবারে ছেলেকে নিজের করে পাওয়ার মতো আকাশ কুসুম কল্পনা সে করেনি। ফুয়াদ লামিয়ার হাতে হাত রেখে বলেছিলো

-” তুমি ভয় কেনো পাচ্ছো? আজ থেকে তোমার আর লামিসার সব দায়িত্ব আমার।বাবার যোগ্যতায় না।নিজ যোগ্যতায় তোমাদের দায়িত্ব নিচ্ছি।”

মেয়েটা সেদিন সুখে কেঁদেছিল।এই অদ্ভুত মানুষটিকে সেদিন নিজের করে পেয়েছিল সে।কে এমন অধিকার বোধ দেখিয়ে তার দায়িত্ব নিতে চাইবে?

তাদের বিয়েটা ফুয়াদের বাবা মা কেউ মেনে নেয়নি।ফুয়াদের তাতে কিছু আসে যায় না।কারণ এই মানুষ গুলো কখনোই তাকে গুরুত্ব দেয়নি।সে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে সেখানেই লামিয়াকে নিয়ে নিজের ছোট্ট সংসার সাজিয়েছে।তাদের সাথে আছে মিষ্টি মেয়ে লামিসা।এই তিনজন মিলেই তাদের সুখের নীড়।

*************

জারার পেছনে দাড়িয়ে আছে জাহিদ।হাতের গোলাপের পাপড়ি ছিঁড়ে জারার দিকে ছুঁড়ে মারছে।জারা প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে বললো

-” সমস্যা কি?”

-” আপনি গতকাল থেকে আমার কল রিসিভ কেনো করছেন না?”

-“বেশ করেছি।তুমি রিফাত ভাইকে কোন সাহসে মেরেছ? সে আমার কো আর্টিস্ট ছিলো।”

জাহিদের মেজাজ মুহূর্তেই ক্ষিপ্ত হতে লাগলো।রেগে বললো
-” ওই বা*স্টা*র আপনাকে বাজে ভাবে টাচ করেছে তাই।”

-” লিসেন আমাদের প্রফেশনে অনেক সময় ঘনিষ্ট দৃশ্য করতে হয়।এই নাটকটা তেমনই ছিলো।”

-” যাই হোক।তবে লোকটার ইন্টেনশন খারাপ ছিল।আমি শুটিংয়ে আপনার চোখে মুখে অসস্তি দেখেছিলাম।”

-” তাই বলে এই ভাবে মারবে? লোকটার বা হাত ভেঙে গেছে।”

জাহিদ অন্য পাশে মুখ ঘুরিয়ে অভিমানী সুরে ক্ষিপ্ত হয়ে বললো

-” আমার ফিয়ন্সের সাথে কেউ এমন করলে আমি তাকে সেখানেই পুতে ফেলবো।ওর কপাল ভালো জাস্ট হাত ভেঙেছি।”

জারা বুঝতে পারছে জাহিদ রেগে আছে।এই ছেলেটার এতো জেদ আসে কোথা থেকে?তবে রাগলে ভীষণ কিউট লাগে।তাই জারা জাহিদের হাতে হাত রেখে বললো

-” এই পিচ্ছি ছেলে তোমার কি আমার উপর রাগ হচ্ছে?”

জাহিদ জারার দিকে তাকিয়ে বললো
-” এটাই সমস্যা।আপনার উপর আমি রাগ দেখতে পারিনা।”

জারা মৃদু হাসলো।বললো
-” আমার প্রফেশন নিয়ে তোমার সমস্যা হচ্ছে?”

জাহিদ জারার অধরে আলতো হাতে স্পর্শ করে বললো
-” মোটেও না।কিন্তু ওইসব বাজে লোকদের নিয়ে ভীষণ সমস্যা আছে।এসব মানুষের সাথে আর কখনোই কাজ করবেন না।”

-” আচ্ছা বাবা।এতো রাগের কি আছে? বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে এই এক ঝামেলা।”

জাহিদ মৃদু হেসে বললো
-” কাকে বাচ্চা বলছেন? একবার বিয়ে হতে দিন তার প্রথম বিবাহ বার্ষিকী বাচ্চা কোলে নিয়ে উজ্জাপন করবো।”

জারা রেগে বললো
-” অসভ্য।”

জাহিদ হেসে বললো
-” আপনার জন্য।”

জারা হেসে উঠলো।এই ছেলে কখনোই সুধ্রাবে না।মাস ছয় এক আগে জারা আর জাহিদের এনগেজমেন্ট হয়েছিলো।জারা কিছুই জানতো না।ভীষণ অবাক হয়েছিল সে।এই ছেলেটা কেমন করে যেনো তার পুরো পরিবারকে পটিয়ে ফেলেছে। সেতো ভাবছে তাদের এজ গ্যাপ নিয়ে সমস্যা হতে পারে কিন্তু যেখানে নাঈম মাহমুদ আর নাহিদ রাজি ছিল সেখানে আর সমস্যা হওয়ার কথা ছিলো না।জাহিদ মাস্টার্স করছে আর পাশাপাশি বাবার ব্যাবসা সামলাচ্ছে। প্রথম দিকে জাহিদের মা সানজিদা মাহমুদের বয়স এর পার্থক্য নিয়ে আপত্তি থাকলেও জারার মতো সুপরিচিত মডেল আর উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়ে হওয়ার কারণে মত পাল্টিয়েছেন।তাছাড়া তার ছেলে ওই নাহিদের সভাব পেয়েছে।বরং নাহিদ তো শান্ত ছিলো কিন্তু এই ছেলে বাউন্ডুলে,দুরন্ত আর প্রচন্ড জেদি।

———-

আরজু খাবার নিয়ে ছেলের পেছনে দৌড়াচ্ছে।ছেলেটা এমনি ভীষণ শান্ত কিন্তু খাবার খাওয়া বেলায় যত বাঁদরামি শুরু করে।স্টেজের সামনে টই টই করে ঘুরছে।আরজু বিরক্ত হয়ে বললো

-” নাবহান আমার প্রচুর রাগ লাগছে কিন্তু। এসো খেতে এসো।”

বাচ্চাটি আরজুর কথায় মোটেও পাত্তা দিলো না।বরং আরো দৌড়াতে লাগলো।হঠাৎ করেই কেউ বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিলো।আর বললো

-” কি লিটলে লিডার?দৌড়াচ্ছে কেনো?”

বাচ্চাটি ছোট ছোট দাত বের করে হেসে ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বললো
-” সুভু চকলেট খাবু।”

-” চকলেট?তুমি নাকি গতকাল আমার দেওয়া এক বক্স চকলেট এক বসায় শেষ করেছ?”

বাচ্চাটি খিল খিল করে হেসে বললো
-” চকলেট মজা।”

-” মজা তাইনা? তোমার একটা দাতে নাকি পোকা ধরেছে।তোমার মাম্মি আমার উপর ভীষণ ক্ষেপা।আমাকে পেলেই পিটাবে।”

বাচ্চাটি হেসে বললো
-” সুভূ তুমি বাবু?মাম্মি ভয় পাও।”

বাচ্চাটির কথায় শুভ হেসে উঠলো।এই আধো আধো বুলিতে বাচ্চটিকে ভীষণ মায়াবী লাগে।শুভ নাবহানের নরম কোমল গালে চুমু খেয়ে বললো

-” আমাদের নাবহান বাবা টা ভীষণ পেকে গেছে।”

বাচ্চাটি হাত নেড়ে বললো
-” সুভু ভালো আত্ত গুলো।”

দুইহাত মেলে দেখালো।শুভ হেসে বললো
-” নাবহান বেবী ও খুব ভালো অনেক গুলো।”

বাচ্চাটির খিল খিল করে হাসলো।আরজু তখনই পেছনে এসে রেগে বললো

-” এই ফাজিল তোর কোলে? না খেয়ে আমাকে দৌড়ের উপর রেখেছে।”
শুভ নাবহানের গালে আদর দিয়ে বললো
-” একদম ঠিক করেছে তাইনা লিটল লিডার?”

বাচ্চাটি মাথা দুলিয়ে হাসছে।আরজু ভীষণ ক্ষেপে বললো
-” তোদের জন্য আমার শান্ত শিষ্ট বাচ্চাটা দিন দিন বাঁদর হচ্ছে। আর একদিন যদি ওকে চকলেট দিস তো তোর খবর আছে।”

শুভ মুখ ভেংচে বললো
-” তোকে ভয় পায় কে? সব জায়গায় নেতার বউ ভাব নিবি না।থাপ্রিয়ে গাল লাল করে দিবো।”

নাবহান শুভর কোলে হাত তালি দিয়ে হেসে উঠলো।আরজু রেগে বললো
-” বাচ্চার সামনে এইসব বলে? ফাজিল একটা।”

আরজু রেগে মেগে চলে গেলো।শুভ জানে আরজুর এতো মেজাজ খারাপ হওয়ার কারণ।সে নাবহানের গালে আলতো ছুঁয়ে বললো

-” আজ তোর বাপের খবর আছে।”

শুভ অনেকক্ষণ যাবত একজনকে খুঁজছে।একটু সামনে আগাতেই দেখলো আরজু,জারা আর রিমি ফুচকার স্টলে দাড়িয়ে একের পর এক ফুচকা সবার করছে।শুভ রিমির দিকে তাকালো।সাদা গ্রাউনে পরিণীত নারীটিকে ভীষণ আকর্ষণীয় লাগছে।তবে কোথাও যেনো কিছু একটা মিসিং।শুভ কপাল চুলকে কমতি খুঁজে বের করতে লাগলো।কয়েক মুহূর্ত পর বুঝতে পারলো রিমির চোখে আজ চশমা নেই।মেয়েটা লেন্স পড়েছে।শুভর মন খারাপ করলো।চশমা তে রিমিকে তার ভীষণ কিউট লাগে।মেয়েটা নিজের সৌন্দর্যই বুজলো না।ফুয়াদ তখনই পাশে এসে দাড়ালো।শুভকে রিমির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুচকি হেসে বললো

-” আর কত দিন মেয়েটাকে অপেক্ষা করাবি?”

শুভ মৃদু হাসলো।দুই পকেটে হাত গুজে একপলক আরজুর দিকে তাকালো।তারপর রিমির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো

-” আর না।ওর অপেক্ষার প্রহরের অবসান খুব দ্রুতই ঘটবে।”

-” আরজুকে ভুলতে পারবি কখনো?”

শুভ আরজুর দিকে তাকিয়ে বললো
-“ভালোবাসা মানে এই নয় যে কাউকে বিয়ে করতেই হবে, কখনও কখনও ভালোবাসার মানুষের সুখের জন্য বুকের ভেতরে শত যন্ত্রণা ঢেকে রেখে হাসি মুখে প্রিয় মানুষটিকে বিদায় দিতে হয়।”

ফুয়াদ মৃদু হাসলো আবার প্রশ্ন করলো
-“ভালোবাসতে পেরেছিস রিমিকে?”

শুভ মৃদু হাসলো।বললো
-“যারা অতিরিক্ত ভালোবাসা পায় তারা ভালোবাসা ধরে রাখতে পারে না। তারা সব সময় ভালোবাসাকে অবহেলা করে। জীবনের একটা সময় গিয়ে ভালোবাসা পাওয়ার জন্য চিৎকার করে কাঁদে কিন্তু ভালোবাসা তখন আর ধরা দেয় না।আমি সেই ভুল করতে চাইনা।রিমিকে ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য আমার নেই। ওকে ভালোবাসি কিনা বুঝতে পারিনা।তবে ওকে আজকাল একটা দিন না দেখলে,একদিন কথা না হলে অস্থির লাগে।”

ফুয়াদ হেসে শুভর কাধে হাত রেখে বললো
-” বন্ধু তুমি ফেঁসে গেছো।প্রেম তোমার জীবনে দ্বিতীয়বার ধরা দিয়েছে।”

শুভ মাথা নিচু করে মৃদু হাসলো।আড়চোখে রিমির দিকে তাকালো।

সাবিহা আর রামিমের বিয়ে পড়ানো হবে।কাজী উপস্থিত।কিন্তু রামিম কারো জন্য অপেক্ষা করছে।একটু পরই গেটে পর পর চারটি গাড়ি উপস্থিত হয়।গাড়ি থেকে একজন সুদর্শন পুরুষ দ্রুত বেরিয়ে আসলো।রামিম মানুষটিকে দেখে হেসে উঠলো।দুর থেকে সেই পুরুষটি রামিম কে চোখের ইশারায় শুরু করতে বললো।রামিম হেসে কাজীকে বিয়ে পড়াতে বললো।ছেলেটি এসে আরজুর গা ঘেসে দাড়ালো।আরজু ছেলেটির দিকে মোটেও তাকাচ্ছে না।ছেলেটি আরজুর অভিমান দেখে বললো

-” সুন্দরী মেয়েদের রাগলে আরো ভয়ঙ্কর সুন্দরী লাগে।”

আরজু তখনও অভিমান করে রইলো।ছেলেটি আরজুর শাড়ীর ফাঁকে উন্মুক্ত উদরে রুক্ষ হাত গলিয়ে আরজুকে একদম নিজের কাছে নিয়ে আসলো।আর ফিচেল স্বরে বললো

-” ম্যাডাম কি খুব রেগে আছে?আচ্ছা সরি,কাজ ছিলো তাই লেট হয়েছে।”

আরজু রেগে বললো
-” সারা রাজ্যের কাজ আপনি একাই মাথায় নিয়ে ঘুরেন?আমাদের জন্য আপনার সময় নেই।”

-” আরে পাগলী আমার।আমি তো তোমাদের মায়ায় বেচেঁ আছি।নাহলে কবেই চলে যেতাম।”

আরজু আঁতকে উঠে ছেলেটির মুখে হাত চেপে বললো

-” ওই বিভৎস দিন গুলোর কথা একদম মনে করবেন না।আমি চাইনা ওই কালো অধ্যায় আর মনে করতে।”

ছেলেটি মৃদু হেসে আরজুর কপালে আলতো স্পর্শ ছুঁয়ে দিলো।আরজু পরম আবেশে চোখ বুজে নিলো।তখনই নাবহান দৌড়ে আসলো তাদের সামনে।ছেলেটিকে দেখে বললো

-” পাপা পাপা!!”

নাহিদ হেসে ছেলেকে কোলে তুলে নিলো।ছেলের কোমল গালে চুমু খেয়ে বললো

-” আমার বাবাটা পাপকে মিস করছিলো?”

-” এত্ত মিস পাপা।”

নাবহান হাত মেলে দেখালো।আরজু আর নাহিদ দুজনেই হেসে উঠলো।দূরে সরিয়ে শুভ তাদের দেখছিলো।এই সুন্দর মুহূর্তটি দেখে শুভর চোখ ভিজে আসলো।নাহিদকে ছাড়া যে আরজু কখনোই ভালো থাকবে না সেটা সে সেদিনই বুঝে গেছে।এই মেয়েটার বেচেঁ থাকার এক মাত্র কারণ নাহিদ।শুভ মন থেকে দোয়া করলো আরজু আর নাহিদের জন্য।এই মিষ্টি পরিবারটি চিরদন এইভাবেই হাসিখুশি থাকুক।ভালোবাসার মানুষটিকে এতো ভালো থাকতে দেখে মাঝে মাঝে ভীষণ সুখ হয়।আরজুর এই প্রাণখোলা হাসি শুভর মনে প্রশান্তি এনে দেয়।রিমি শুভর পাশে দাড়িয়ে আরজুর দিকে তাকিয়ে বললো

-“এই সুন্দর মুহূর্তটি আরজু ডিজার্ভ করতো।তাই তো সৃষ্টিকর্তা তাকে এই সুখ থেকে বঞ্চিত করেনি।”

শুভ রিমির দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো
-” সৃষ্টি কর্তা সবার জন্যই সুখ বরাদ্দ রেখেছেন। শুধু সময় মতো সেটা খুঁজে পাওয়ার অপেক্ষা।”

রিমি শুভর দিকে চমকে তাকালো।শুভ হেসে রিমির হাত শক্ত করে ধরলো।বললো

-” আমি পথভ্রষ্ট আহত প্রেমিক।আমার এই ক্ষত সারিয়ে তোলার দায়িত্ব তোর।সেই দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করতে পারবি?”

রিমি খুশিতে ঠোঁট চেপে কান্না আটকে রাখলো।শুভ রিমির হাতের পিঠে চুমু একে বললো

-“বউ সাজে তোকে চশমা পড়তে হবে।এই লেন্স ফেন্স একদম পরা যাবে না।একদম ফালতু লাগে।পুরো কিউটনেসটাই মিসিং।”

রিমি ফিক করে হেসে উঠলো।শুভ গভীর ভাবে সেই হাসি পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো।কেমন ঘোর লেগে যায়।
__________________________

সেদিন নাহিদকে যখন হসপিটালে নেওয়া হলো তখনই তাকে ওটি তে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।নাহিদ খুব ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ফেলছিল।ডক্টর ইনজেকশন পুস করার সময় খেয়াল করলো নাহিদ মৃদু নড়াচড়া করছে।পিট পিট চোখে তাকিয়ে তীব্র যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।হয়তো সেন্স ফিরে এসেছে।তাইতো ক্ষত জায়গায় যন্ত্রণা আরো বাড়ছে।চোখের সামনে ডক্টরকে দেখে মৃদু ভাঙ্গা গলায় বলেছিলো আসফিকে ডাকতে।ডক্টর অবাক হয়েছিল নাহিদের দৃঢ় মনোবল দেখে।এতো তব্র ভাবে আঘাত পেয়েও ছেলেটা দাতে দাত চেপে সেই যন্ত্রণা হজম করছে।নাহিদ দাতে দাত চেপে ধমকের সুরে বলেছিলো

-” এ…এক্ষনি তাকে ডাকুন।আমি সেন্সলেস হওয়ার আগে তাকে কিছু বলতে চাই।কাজটা খুব গোপনে করুন।”

ডক্টর একজন ওয়ার্ড বয়কে দিয়ে বাইরে উদ্বিগ্ন আসফিকে চুপিসারে ডাকলো। আসফি ওটি রুমে পৌছে নাহিদকে দেখেই জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো।সবচাইতে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর এই পরিণতি কিছুতেই মানা যায়না।নাহিদ ঘন ঘন নিশ্বাস নিচ্ছে। আসফির পিঠে হাত বুলিয়ে বললো

-” আসফি কান্না বন্ধ করে আমার কথা মন দিয়ে শোন।এই সব কিছুর পেছনে যে আছে সে দাদাজানকেও মেরেছে।তারা আসিফকে একটা মাধ্যম বানিয়েছে মাত্র।আমি ভেবেছি এটা লিয়াকত আলীর কাজ।কিন্তু আমি ভুল।যেই কাজটা করেছে তাকে হেল্প করেছে আমাদের বাড়ির কেউ।আমি বুঝতে পারছি আমার পরিবার বিপদের মুখে আছে।আমার কিছু বিষয় নিয়ে সন্দেহ ছিলো।তাই সাইফুলকে ইনভেস্টিগেশনের দায়িত্ব দিয়েছিলাম।তোর কাছে অনুরোধ তুই সাইফুলের ডিটেলস অনুযায়ী এগিয়ে বের কর কে ছিলো।আমি জানিনা ফিরতে পারবো কিনা?তবে আমার পরিবারে যাতে ক্ষতি না হয় দেখিস।আমি যদি বেচেঁ ফিরি তবে শত্রুরা আরো হিংস্র হয়ে উঠবে।তুই ভালো করেই জানিস তোর কি করতে হবে এখন।”

আসফি চমকে তাকালো।নাহিদের হাত ধরে ভরসা দিয়ে বললো
-” তোকে চিন্তা করতে হবে না।তোর কিছুই হবেনা দেখিস।আমি সব সামলে নিবো।”

************

তখন নাহিদ আরজুকে রতনের সাথে পাঠানোর পর পর ঘাতকদের একজন কাউকে কল করে বলে

“চিন্তা করবেন না,ওর দাদার মতো ও মরবে।ওর দাদাকে তো বাড়ির ভেতরেই মারতে পেরেছি।নাহিদের নাকের ডগা দিয়ে ওর বাড়ির ভেতরেই আরেক শত্রু উৎ পেতে বসে আছে।আর বেচারা নাহিদ সারা দুনিয়া খুঁজে বেড়াচ্ছে।কিন্তু এই নাহিদ বহুত চালাক।ওকে মারতে যেয়ে আমাদের অনেক লোক মারা গেছে।তবে বাঁচতে পারবে না।মারাত্বক ভাবে ওকে যখম করা হয়েছে।গুলিও করা হয়েছে।তবে চিন্তা করবেন না।ওকে মেরে ওর লাশ চেক করে তবেই যাবো।”

তারা নাহিদের উদ্দেশে শুট করতে থাকে।কিন্তু হুট করে আর্মির ফোর্স চলে আসায় তাদের প্ল্যান ভেস্তে যায়।নিজদের আত্মরক্ষার জন্য আক্রমণ চালিয়ে যায়।কিন্তু শেষ অব্দি টিকতে পারেনি।সবাইকেই মরতে হয়।কিন্তু একজন বেচেঁ ছিলো।কিন্তু গুরুতর আহত।তাকেও চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়।লোকটি বেশ কিছুদিন চিকিৎসাধীন ছিলো।