মিষ্টি রোদের হাতছানি পর্ব-৩২+৩৩+৩৪

0
1332

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_32

রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটা।আঞ্জুমান আরার জ্বর তখন অনেকটা কমে এসেছে।সাবিহা রুম থেকে বেরিয়ে দেখলো রামিম সোফায় হেলান দিয়ে বসে ঘুমিয়ে পড়েছে। রামিমের মুখে ভেসে বেড়াচ্ছে ক্লান্তির দলেরা।সাবিহার ইচ্ছে করছে রামিমের ললাটে উষ্ণ পরশ একে দিতে।হয়তো এতে তার ভালোবাসার মানুষটির ক্লান্তি খানিকটা দুর হতো। রামিমের মুখটা শুকনো লাগছে।ছেলেটা সারা দিন কিছু খায়নি নাকি?সাবিহা দ্রুত রান্নাঘরে চলে আসলো।একটা প্লেটে কিছু খাবার বেড়ে টেবিলে রাখলো।এই কাজ করতে নিজেকে কেমন বউ বউ লাগছে। রামিমের বউ।নিজের ভাবনায় নিজেই হাসলো সাবিহা। রামিমের পাশে বসে চুলে হালকা হাত বুলিয়ে দিলো।রামিম হয়তো গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে।সাবিহা নিজের সেই অদম্য ইচ্ছে পূরণ করার উদ্যোগ নিলো। রামিমের ললাটে উষ্ণ পরশ একে দিলো।এতে রামিম খানিকটা নড়ে চড়ে উঠলো।সাবিহা ভয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে গেলো।ভীষণ ভয় পেয়েছে।রামিম ধীরে ধীরে চোখ খুলে সাবিহাকে আতঙ্কিত হয়ে বসে থাকতে দেখে বললো

-“মায়ের কি অবস্থা?”

সাবিহা ঢোক গিলে বললো
-“ভা…ভালো।আন্টি ঘুমাচ্ছে।”

-“ও।”

-“টেবিলে খাবার দিয়েছি খেয়ে নে।”

-“তুই খেয়েছিস?”

-“না।”

-“চল তুই ও খেয়ে নে।তারপর তোকে বাসায় পৌছে দিবো।”

-“লাগবে না।আমি একাই যেতে পারবো।”

রামিম একটু কঠিন গলায় বললো
-“বেশি বুঝিস না।অনেক রাত হয়ে গেছে।আমি দিয়ে আসবো।”

সাবিহা আর কিছুই বললো না।টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো।রামিম আলতো করে নিজের ললাটে স্পর্শ করে মুচকি হাসলো।তারপর টেবিলে এগিয়ে গেলো।
খাওয়া শেষ করে রামিম সাবিহাকে নিয়ে রিক্সায় উঠে পড়লো।রাতের আঁধারে কঙ্খতি পুরুষটির পাশে বসে সাবিহার পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখ অনুভূতি হচ্ছে।মানুষটি সারা জীবন এই ভাবে পাশে থাকে জীবনটা অনেক বেশি আনন্দপূর্ণ হতো।সাবিহার বাসার সামনে রিক্সা থামলে সাবিহা নেমে পড়লো।রামিমের দিকে কোমল দৃষ্টি ফেলে বললো

-“আন্টিকে নিয়ে চিন্তা করিস না।খুব জলদি ঠিক হয়ে যাবে।সময় মতো মেডিসিন দিস।”

রামিম মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বললো
-“নিজের খেয়াল রাখিস। বায়।”

রামিম চলে যেতেই সাবিহা বাসায় চলে আসলো।সাবিহার বাবা ঘড়িতে সময় দেখে বললো
-“এতো লেট হলো কেনো মা?”

সাবিহা বাবাকে ভীষণ ভালোবাসে।বাবার মুখে এই মা ডাকের প্রতি ভীষণ দুর্বল সে।বাবার এই আদুরে শব্দকে কখনোই ইগনোর করতে পারে না।খুব ছোট বয়সেই তার দাদী মারা যায়।তাই মায়ের ভালোবাসা তার বাবার কপালে জুটেনি।তাইতো সাবিহার জন্মের পর থেকেই তিনি মা বলে ডাকেন।মেয়েকে ভীষণ ভালোবাসে তিনি।সাবিহা নিচু স্বরে বললো

-“বাবা সরি লেট হয়ে গেলো।আসলে আন্টি অনেক সীক হয়ে পড়েছিল।তুমি তো জানো আন্টি ছাড়া রামিমের কেই নেই। ও অনেক ভীত হয়ে পড়েছিল।”

-“এখন কেমন আছে উনি?”

-“জি বাবা ভালো।”

-“আচ্ছা রুমে যাও মা।”

সাবিহা রুমে চলে গেল।সাবিহার বাবা সাবিহার এতো রাত অব্দি রামিমের বাসায় থাকা মোটেও পছন্দ করলেন না।রামিম ছেলেটার প্রতি মেয়ের অতিরিক্ত কনসার্ন তিনি মোটেও পছন্দ করেন না।রামিম ছেলেটা নিঃসন্দেহে ভালো।কিন্তু সাবিহার যোগ্য না।তার আদরের মেয়ের জন্য তিনি কোনো রাজপুত্র খুঁজে আনবেন।তার মেয়ে থাকবে রানীর মতো।

*********
আরজু শপিং মলে এসেছে রিমির জন্য একটা গিফট কিনতে।সামনেই রিমির বার্থডে।জারার আজ শুটিং আছে।আর সাবিহা বাঁদর কল রিসিভ করেনি।হয়তো বিকেলে ভাত ঘুম দিচ্ছে।আর শুভ বেয়াদব গেছে ফুয়াদের সাথে আড্ডা দিতে।আসলে কোনো ক্লাব ঘরে বসে কেরাম খেলছে।আরজু আসতে বললে উল্টো তার পক্ষ থেকেও রিমির জন্য একটা গিফট কিনতে বললো।ফাজিল একটা।আরজু অমনোযোগী ভাবে হাঁটতে যেয়ে কারো সাথে ধাক্কা খেল।পেছন ফিরে দেখলো সুদর্শন এক পুরুষ।পরনে কালো পাঞ্জাবি আর চুল গুলো খানিকটা এলোমেলো।লোকটির চেহারায় একটা নম্রতা বিরাজ করছে।আরজু দেখলো লোকটি ফ্লোর থেকে একটা ফোন তুলে নিলো।যার স্ক্রিন ভেঙে চৌচির।আরজু জিবে কামড় দিলো।তার ভুলের কারণেই যে ফোনটা ভেঙেছে সেটা বেশ বুঝতে পারলো।কেনো যে অমনোযোগী হয়ে হাঁটতে গেলো।আরজু অস্থির হয়ে বললো

-“আই অ্যাম রিয়েলি সরি।আমার জন্য আপনার ফোনটা ভেঙে গেলো।আসলে আমি একদম খেয়াল করিনি।”

লোকটি নম্র ভাবে মুচকি হেসে কোমল সুরে বললো
-“ইটস ওকে।এটা জাস্ট একটা অ্যাকসিডেন্ট।”

আরজু নিজেকে কিছুতেই শান্ত করতে পারলো না।দেখেই বোঝা যাচ্ছে ফোনটি বেশ এক্সপেন্সিভ।আরজু আবার অনুনয় করে বললো

-“তবুও আমার খেয়াল করে চলা প্রয়োজন ছিল।”

লোকটি চমৎকার হেসে আরজুকে শান্ত হতে বললো।এতে করে আরজুর গিলটি ফিল যেনো বেড়েই গেলো।তাই আবার বললো

-“আমার জন্য আপনার কতবড় লস হয়ে গেলো।plz বলুন আপনার জন্য কি করতে পারি?কি করে ক্ষত পূরণ করতে পারি?”

-“ম্যাডাম আপনি শুধু শুধু হাইপার হচ্ছে।তবে আপনি যেহেতু এতো ইন্সিস্ট করছেন তাহলে এই অধমের সাথে এক কাপ কফি খেতে পারেন।তাতেই আমার ক্ষতি পূরণ হয়ে যাবে।”

লোকটির বলার ধরনে আরজু হেসে দিলো।লোকটিকে দেখে বেশ ডিসেন্ট মনে হচ্ছে।তাই আরজু উপরের ফ্লোরের একটা কফিশপে বসলো।কথার মাদ্যমে আরজু জানতে পারলো লোকটির নাম সাদমান।সাদমান নিজেও আরজুর সাথে বেশ সুন্দর ভাবেই পরিচিত হলো।সাদমানের সাথে কথা বলে আরজুর বেশ ভালো লাগলো।সাদমান আরজুকে উদ্দেশ্য করে বললো

-“এই রূপবতী লাইলীর মজনু আছে নাকি?”

আরজু লাজুক হাসলো।বললো
-“হুম!!আমার পার্সোনাল মজনু আছে।একদম হিরোর মতো।যাকে দেখলেই আমার প্রেম প্রেম পায়।”

সাদমান মুচকি হাসলো।বললো
-“বাহ!!বেশ মাখো মাখো প্রেম মনে হচ্ছে।ইসস!! আমার কোনো চান্স নেই।”

বলেই বুকে তীরে বিধার অ্যাক্টিং করলো।আরজু খিল খিল করে হেসে ফেললো।দারুন মজার লোক সাদমান।

*********

নাহিদের সাথে দেখা হয়েছে আজ দুদিন হয়ে গেলো। ফ্রি হয়ে কল দিবে বলেও কোনো কল করেনি।লোকটি আবার উধাও হয়ে গেলো কেনো?এতো কি ব্যস্ততা যে বউকে কল করার সময় পায়না?অনেক ভেবে আরজু নাহিদের নাম্বরে কল করলো।কিন্তু একবার রিং হওয়ার পরই কেটে গেলো।আরজু বুঝতে পারলো অপর পাস থেকে কেটে দিয়েছে।আরজুর বেশ অভিমান হলো।নেতা সাহেব এমন কেনো?তাকে কি একবারও মনে পড়েনা?

নাহিদ পার্টি অফিসে নেতাদের সাথে গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে ছিলো।আরজুর কল দেখে জলদি সেটা কেটে দিলো।তার কারণে মিটিংয়ে ডিস্টার্ব হোক সেটা চায়না।তাছাড়া একজন নেতা কর্মীকে কাজের সময় পার্সোনাল লাইফ ফেলে আসতে হয়।দেশের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে হয়।

আরজু আরো কয়েকবার কল করলো।কিন্তু নাহিদ প্রতিবার কল কেটে দিলো।আরজু অভিমানে রাতে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লো।প্রায় অনেক রাতে নাহিদ আরজুকে কল ব্যাক করলো।মূলত নাহিদ মাত্রই বাসায় এসেছে।এসেই গোসল করে আরজুকে কল করলো।তার অভিমানী বউ নিশ্চই অভিমান করে বসে আছে।

আরজু ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে নাহিদের কল রিসিভ করলো
-“হ্যালো কে?”

নাহিদ মুচকি হাসলো।মনের মাঝে প্রশান্তি বয়ে গেলো।সারা দিনের ক্লান্তি যেনো এই এক শব্দেই নিঃশেষ হয়ে গেলো।নাহিদ গম্ভীর স্বরে বললো

-“নাহিদ বলছি।”

আরজু তখনও ঘুমে বিভোর।তাই বললো
-“কে নাহিদ?কোথাকার নাহিদ?”

নাহিদ গলা পরিষ্কার করে আরো গম্ভীর হয়ে বললো
-“নিবারাস নাহিদ।আর এই সিটির মেয়র নাহিদ।”

আরজুর ঘুম যেনো ছু মন্তর হয়ে গেলো।এক লাফে বসে পড়লো।এক হাতে মাথার চুল খামচে বললো
-“সরি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”

-” হুম বুঝতে পেরেছি।তুমি সন্ধায় কল করেছিলে? কেনো?”

আরজুর রাগ হলো।একে তো কল রিসিভ করেনি।আবার জিজ্ঞেস করছে কেনো কল করেছে।আশ্চর্য বরের সাথে কথা বলতে কি কোনো কারণ লাগবে?অকারণে কি কথা বলা যায় না?আরজু বললো

-“আমি কল করায় বিরক্ত হয়েছেন?”

নাহিদ বুজলো আরজু রেগে গেছে।তাই আরজুকে আরো রাগতে বললো
-“না বিরক্ত হইনি।আসলে মিটিংয়ে ছিলাম।কি কারণে কল করেছ বললে নাতো?”

-“কারণ ছাড়া কল করা যাবে না?”

-“অবশ্যই না।কারণ ছাড়া পৃথিবীতে কিছুই হয় না।তাই আমাকে কল করতে অবশ্যই তোমার কোনো সলিড কারণ থাকতে হবে।আমি হাজারো কাজে ব্যাস্ত থাকি।অপচয় করার মতো সময় আমার কাছে নেই।”

আরজুর অপমানে নাক লাল হয়ে আসলো।তার সাথে কথা বললে সময়ের অপচয় হবে? আরজু রেগে বললো
-“বউকে সময় দেওয়া সময়ের অপচয় হয়?”

-” হুম অবশ্যই।বউকে তো আরো বেশি ভেবে চিনতে সময় দিতে হবে।বউ জাতি সময়ের অপচয় করায় উস্তাদ।তারা কাজের কথার চাইতে অকাজের কথা বেশি বলে।”

আরজু রাগে ফেটে পরলো।এই রাতে কল করে এমন অপমান করার কোনো মানে হয়?রাত যতো গভীর হয় মানুষের রোমান্টিকতা বারে।কিন্তু এই লোকের গা জ্বালানো কথা শুরু হয়।আরজু প্রচন্ড রেগে কল কেটে দিলো।রাগে ফোন বিছানায় আছার মারলো।

অপর দিকে নাহিদ বাঁকা হাসলো।বউকে খেপিয়ে সে বেশ মজা পেলো।আহা! সামনে থেকে আরজুর রাগী মুখটা দেখলে বেশ ভালো হতো।

নাহিদের মনে পড়লো বেশ কয়েক বছর আগের কথা।একদিন একটা কাজে অন্য এলাকায় এসেছিলো।কাজ শেষে রাস্তায় অনেক ভিড় দেখে সে এবং তার বন্ধুরা এগিয়ে যায়।দেখে একটা স্কুল পড়ুয়া ছেলে অন্য এক স্কুল পড়ুয়া ছেলেকে কান ধরে উঠ বস করাচ্ছে।নাহিদের চোখ যায় পাশে দাড়ানো কিশোরীর দিকে।নাহিদ অবাক হয়।সেই বাসন্তী শাড়ি পরা কিশোরী।কিন্তু সেদিনের মেয়েটিকে আর আজকের মেয়েটিকে অনেক ভিন্ন লাগছে।সেদিন মেয়েটিকে লেগেছিলো লাস্যময়ী কিশোরী।আর আজ স্কুল ড্রেস পরা, মাথার উপরে একটা ঝুঁটি করা দেখে নিতান্তই বাচ্চা মনে হচ্ছে।।মেয়েটা রাগী চোখে কান ধরা ছেলেটিকে দেখে যাচ্ছে আর পাশে ছেলেটিকে বলছে

-“কি সব কান ধরে উঠ বস করাচ্ছিস।এক থাপ্পর মেরে অজ্ঞান করে ফেল।”

পাশের ছেলেটি বিরক্ত হয়ে বললো
-“আমি কি তামিল মুভির নায়ক নাকি?যে থাপ্পর মেরে অজ্ঞান করে ফেলো।”

-“শুভ তোকে দিয়ে কিছু হবে না।আমি দিচ্ছি।এই ফাজিল আমার নোট খাতা চুরি করে স্যারের কাছ থেকে মার খাইয়েছে।একে তো আমি..”

বলেই সেই কিশোরী সামনের ছেলেটিকে মারতে গেলো।কিন্তু কিশোরীর পাশের ছেলেটি পেছন থেকে ঝাপটে মেয়েটিকে থামালো।আর তাকে থামতে বললো।সেদিন প্রথম নাহিদ জানতে পারে এই কিশোরীর নাম আরজু। নামটা নাহিদের মন ,মস্তিষ্ককে একদম গেথে যায়।
তার এক বন্ধু বলেছিল

-“বাহ!!!!পিচ্ছি তো বেশ কিউট আছে। এখনি যেই রূপের আগুন আর তেজ দেখা যাচ্ছে।বড়ো হলে ছেলেদের মাথা খারাপ করে ছাড়বে।পিচ্চিকে মনে ধরেছে।”

নাহিদ এক দৃষ্টিতে আরজুর দিকে তাকিয়ে সেই বন্ধুর উদ্দেশ্য কঠিন সুরে বললো

-“মন থেকে ডিলিট করে ফেল।তোদের ফিউচার ভাবী হয়।মায়ের নজরে তাকাবি।দাদাজান এই পিচ্চিকে অলরেডি নতবৌ করার প্ল্যান করে রেখেছেন।”

নাহিদের সেই বন্ধু যেনো খানিকটা মনঃক্ষুণ্ণ হলো। আসফি হেসে বললো

-“দাদাজান প্ল্যান করেছে নাকি তুই?যেই ভাবে তাকিয়ে আছিস দোস্ত।বাচ্চা মেয়েটা ভৎস হয়ে যাবে।তুই তো দেখা যায় বাচ্চা ভাবির উপর ভালই স্লিপ করে গেছিস।”

নাহিদ বাঁকা হেসে বললো
-“নিজের জিনিসে এই ভাবেই তাকাতে হয় আসফি।এই কিশোরী তো আরো বেশ কিছুদিন আগেই আমার নজরে লক হয়ে গেছে।শুধু সময়ের অপেক্ষা।”

*********

সামনের সপ্তাহ থেকে লামিয়ার এইচ এস সি ফাইনাল এক্সাম শুরু।এক দিকে যেমন পড়ার চাপ।অন্য দিকে কাজের চাপ।লামিয়া টিউশন আর কাজ শেষ করে বাকি সময় মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করে।কারণ তার বিশ্বাস একমাত্র বিদ্যা অর্জনের মাধ্যেমে সে নিজের জন্য আর বোনের জন্য একটা ভালো লাইফ ইন্সেওর করতে পারবে।সকাল বেলা আজ লামিয়া নাস্তা রেডি করে ফেললো।কিছু মুহূর্ত পর ফুয়াদের মা আর বাবা আসলো নাস্তা করতে।লামিয়া ভয়ে ভয়ে ফুয়াদের মাকে বললো

-“ম্যাম সামনের সপ্তাহ থেকে আমার এইচ এস সি এক্সাম।আমার জন্য দোয়া করবেন।”

লিপা খানিকটা বিরক্ত হয়ে বললো
-“ঠিক আছে।কিন্তু পরীক্ষার দিন গুলো বাদে আর একদিন ও বন্ধ দিতে পারবে না।বসিয়ে বসিয়ে আমি টাকা দিতে পারবো না।”

লামিয়ার বেশ খারাপ লাগলো।কিন্তু কিছু বললো না। লিপা আবার বললেন

-“ফুয়াদকে কি সব আন হাইজিনিক খাবার খাইয়ে অভ্যস্ত করে ফেলেছ।তুমি না আসলে এই সব কে রান্না করে দিবে?আর ফুয়াদের টেস্ট এতো লো ক্লাসের কবে থেকে হলো বুজলাম না।এই সব অয়েলি খাবার সকাল বেলায় খেতে বসে যায়।তোমাদের ক্লাসে নিয়ে যাচ্ছো আমার ছেলেটাকে।”

লামিয়া নিচের ঠোঁট চেপে নিজের কান্না থামালো।নিয়তির কারণে আজ তাকে এই কাজ করতে হচ্ছে।বাবা বেচেঁ থাকতে তার বায়নার কোনো শেষ ছিলো না। লামিয়ারা ছিলো মধ্যোবিত পরিবারের।তার বাবা বেশ ভালো একটা কোম্পানিতে চাকরি করতো।কিন্তু বাবার আকর্ষিক মৃত্যুতে তাদের সচ্ছল,প্রানবন্ত পরিবারে নেমে আসে শোকের ছায়া।বাবার বিরহে মাও কিছু দিনের মধ্যে তাদের ছেড়ে পরপারে চলে যান।আর রেখে জান অসহায় দুই মেয়েকে।বাবা মায়ের মৃত্যুর পর তার চাচা বেশ কয়েক বছর তাদের ভরণ পোষণ চালান।কেনো চালান সেটা লামিয়া তখন না জানলেও পরবর্তীতে জানতে পেরেছে।কিন্তু তার চাচী কোনোদিন তাদের পছন্দ করত না।লামিয়াকে দিয়ে ঘরের সকল কাজ করাতো।তাদের ঠিক মত খেতে দিতো না।

চাচা নিজেও তাদের সাথে খারাপ আচরণ করতো।কিন্তু একবার তার চাচাতো বোনকে ছেলে পক্ষ দেখতে এসে যখন তারা কিশোরী লামিয়াকে পছন্দ করে ফেলে তখন চাচীর রাগের কোনো সীমা ছিলো না।লামিয়াকে প্রচন্ড মারধর করেন।তারপর বেশ কিছুদিন পর বাবার সব সম্পত্তি আত্মসাৎ করে তাদের দুই বোনকে একদিন হঠাৎ এই ভাড়া বাড়িতে তুলে দিয়ে যান।এই অচেনা শহরে দুটো মেয়ে কি করে থাকবে বুঝতে পারছিল না।লামিয়া সেদিন এত বেশি অসহায়বোধ করেছিলো যা বলার বাইরে।চাচা মাঝে মজে এসে তাদের দেখে যান।তখন ঘৃণায় লামিয়া সেই চাচার দিকে তাকাতে চায় না।কিন্তু তার বোন চাচাকে দেখে অনেক খুশি হয়।হয়তো অচেনার মুখের ভিড়ে এই ঘৃণ্য পরিচিত মুখটা দেখে প্রশান্তি পায়।

লামিয়ার হুস ফিরে একটা গম্ভীর কণ্ঠ শুনে।পাশে ফিরে দেখে ফুয়াদ পকেটে হাত দিয়ে দাড়িয়ে মায়ের উদ্দেশে বলছে

-“ক্লাস তো মানুষের আচরণে প্রকাশ পায়।কিছু মানুষ নিজের লো মেন্টালি কে হাই ক্লাস ভেবে ভুল করে থাকে।তাদের নিজের দিকে তাকানো উচিৎ।কত নর্দমা যে নিজের গায়ে লেগে আছে সেটা দেখতে পেত।”

লিপা ভীষণ অপমান বোধ করে।আর বলে
-“এই মেয়েটার জন্য তুই আমাকে অপমান করছিস?”

ফুয়াদ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়লো।আর বললো

-“আমি তো তোমাকে কিছু বলিনি।তুমি কেনো অপমান নিজের গায়ে মাখছো?”

ফুয়াদের বাবা গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো
-“আহা!! ফুয়াদ বেশি কথা বলছো।তুমি আজকাজ অনেক বেশি অবাধ্য হয়ে গেছো।”

-“আপনাদের বাধ্য আমি ছিলাম কবে?”

ফুয়াদের বাবা কিছুই বললেন না।টেবিল ছেড়ে উঠে চলে গেলেন। লিপা লামিয়ার উপর রাগান্বিত হয়ে বললেন

-“তুমি আসার পর থেকে আমার ঘরে অশান্তি বেড়েছে।”

ফুয়াদ দাতে দাঁত চেপে বললো
-“এই ঘরে শান্তি কবে ছিলো? ওকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।ঘরের শান্তি তোমাদের কারণে নষ্ট হয়।লামিয়ার কারনে না।”

লামিয়ার মনে দমকা হাওয়া বয়ে গেলো।এই পৃথিবীতে একটাই মানুষ আছে যে তাকে প্রোটেক্ট করে।তাকে সম্মান করে।একবার মানুষটির পা ছুঁয়ে সালাম করা প্রয়োজন।এতো আপন কেনো মনে হয় মানুষটিকে?”

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_33

রাত তখন বেশ গভীর।প্রায় দেরটা বাজে।নাহিদ মাত্রই বাসায় পৌঁছালো।গাড়ি থেকে নামতেই গ্যারেজে আরো একটা গাড়ি পার্ক করা দেখতে পেলো।নাহিদের চোখ মুখ কঠিন হয়ে আসলো।সারা দিনের ব্যাস্ততার পর এই মানুষটির মুখোমুখি সে হতে ইচ্ছুক না।নাহিদ বাসায় প্রবেশ করতেই বসার ঘরে সেই মানুষটিকে বসে থাকতে দেখলো।তার হাতে কফি।টেবিলে চোখ বুলিয়ে দেখলো আরো বেশ কয়েক কাপ পড়ে আছে।তার মানে অনেকক্ষণ যাবত তিনি এসেছেন।নাহিদকে দেখেই তিনি কিছুটা বিচলিত হলেন।নাহিদ অনিচ্ছা সত্বেও তার বাবার সামনের সোফায় বসলো। সাঈদ মাহমুদ আজ অনেক দিন পর ছেলের মুখটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলেন।সাদা পাঞ্জাবিতে তার ছেলেকে কত সুন্দর লাগছে।নিঃসন্দেহে তার ছেলে সুদর্শন।এমন সুদর্শন ছেলে এতটা রগচটা স্বভাবের কেনো হলো?নাকি এই আচরণ শুধু মাত্র তার সাথে।বাইরে মানুষের সংস্পর্শে আসলে বা জনসাধারণের কাছে তার এই ছেলেটা একদম ভিন্ন।কত সহজেই সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশে যায়।মানুষের দুঃখ,কষ্ট উপলব্ধি করে তাদের সাহায্য করে।কিন্তু ব্যাক্তি জীবনে ছেলেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন।গম্ভীর প্রকৃতির।এইযে এতো দিন পর জন্মদাতা পিতাকে দেখে সামান্য কুশল বিনিময় করাটাও জরুরী মনে করে না।এতটাই ঘৃনা করে তাকে?নাহিদ কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে হাত ঘড়ি দেখে বললো

-“এতো রাতে এখানে কি করছেন?”

নাঈম মাহমুদ নিজেও বেশ রগচটা স্বভাবের।ছেলে তো এই গুন তার কাছ থেকেই পেয়েছে।তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন
-“রাত গভীর হয়েছে সেটা স্বীকার করছো তাহলে?এতো রাত অব্দি বাইরে না থাকলে হয়না তোমার?এতো শত্রু ছড়িয়ে রেখেছো যে,কোন দিন কে এসে বুলেট দিয়ে বুক ঝাঁজরা করে দিয়ে যায় তার কোন নিশ্চয়তা নেই।”

নাহিদ বিরক্তি প্রকাশ করে বললো
-“আমাকে নিয়ে আপনার চিন্তা করতে হবে না।কি কারণে এসেছেন সেটা বলুন।”

নাঈম মাহমুদের ইচ্ছে করছে ছেলের গালে কষিয়ে থাপ্পর মারতে।কিন্তু যুবক ছেলের গায়ে হাত তোলা যায়না।তাছাড়া তার ছেলের সাথে সম্পর্কটাও তেমন ভালো না।তার এই ধরনের পদক্ষেপ সম্পর্কটার আরো বাজে অবস্থা করতে পারে।তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন

-“একটা নিউজ আমার কানে এসেছে।সেটা কি সত্যি?”

নাহিদ ভাবলেশহীন ভাবে বললো
-“কি নিউজ?”

-“তুমি নাকি বিয়ে করেছো?”

নাহিদ চমকে বাবার দিকে তাকালো।এই অতি গোপন খবরটিও বাবার কানে পৌঁছে গেলো?নাহিদ সোফায় হেলান দিয়ে বসে বললো

-“আমার পেছনে স্পাই লাগানো বন্ধ করুন।”

-“তার মানে ঘটনা সত্যি?”

-“সেটা আপনার স্পাই কে জিজ্ঞাসা করুন।”

নাহিদের বাবা খানিকটা ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন
-“তোমাকে কবে থেকেই আম্মা বিয়ের কথা বলছে।তুমি মানা করে দিয়েছো।যদি কাউকে পছন্দ করেই থাকো, তবে আগে বললে না কেনো?এই ভাবে গোপনে বিয়ে করার মানে কি?নিজের ছেলের বিয়ের খবর আমার অন্যের মাধ্যেমে জানতে হয়।”

নাহিদ চোখ মুখ শক্ত করে বললো
-“আমার ব্যাক্তিগত জীবনের ব্যাপারে কারো হস্তক্ষেপ আমি পছন্দ করিনা।”

নাঈম মাহমুদ রেগে বললেন
-“চরম বেয়াদব তুমি। তোমার মত একটা বেয়াদবকে বিয়ে করে কোন মেয়ে তার জীবন নষ্ট করেছে?”

নাহিদ রাগে কিছুই বললো না।মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাগ সংবরণ করার চেষ্টা করলো।নাহিদের বাবা আবার বললেন

-“মেয়েটা কে? কোথায় থাকে?তাকে আমাদের সামনে নিয়ে আসছো না কেনো?”

এতো প্রশ্নে নাহিদ বেশ বিরক্ত।তাই শক্ত গলায় বললো
-“সময় আসলে নিয়ে আসবো।তাছাড়া আমার বউকে জনে জনে দেখিয়ে বেড়ানোর কোনো ইচ্ছা আমার নেই।সে একান্ত আমার ব্যাক্তিগত সম্পদ।”

সাঈদ মাহমুদ বেশ বিচক্ষণ বুদ্ধিমত্তা সম্মপন্য মানুষ।তাই কপাল কুচকে বললেন

-“মেয়েটার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হচ্ছো?নাকি আরো কোনো কারণ আছে?মেয়েটার নিরাপত্তা নিয়ে ভেবো না।তাকে নিয়ে বাসায় ফিরে আসো।তার নিরাপত্তার দায়িত্ব সম্পূর্ণ আমার।”

-“আমার বউকে আমি নিজেই প্রোটেক্ট করতে পারবো।আপনার ভাবতে হবে না।আমার ক্ষমতা সম্পর্কে নিশ্চই ধারণা আছে?”

নাঈম মাহমুদ ক্ষিপ্ত গলায় বললেন
-“তোমার ঐ ক্ষমতার জন্যই আজ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছো।”

নাহিদ দাতে দাঁত চেপে বসে রইলো। নাঈম মাহমুদ কিছুটা শান্ত হয়ে বললেন
-“মেয়েটার বাসার এড্রেস দাও।তার বাবা মার সাথে কথা বলবো।”

নাহিদ রেগে বললো
-“আপনার স্পাই কে বলুন খুঁজে বের করতে।”

কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে নাহিদ আবারও কঠিন গলায় বললো
-“আমার ব্যাপারে আপনি নাক গলানো বন্ধ করুন।আপনার কোনো কনসার্ন আমার প্রয়োজন নেই।”

বলেই নাহিদ উপরে চলে গেলো।নাঈম মাহমুদ নাহিদের যাবার দিকে তাকিয়ে ভাবলেন

“এই ভাবে হুট করে বিয়ে করার কারণ কি?আর করলেও সেটা গোপন কেনো করছে?শুধু মাত্র মেয়েটার নিরাপত্তার জন্য নিশ্চই না।অন্য কোনো কারণ অবশ্যই আছে।মেয়েটা কে সেটা জানতে হবে।”

*************
মেঘের আড়ালে উজ্জ্বল চাঁদ একটু পর পর উকি দিচ্ছে।বারান্দার চেয়ারে বসে রিমি এক দৃষ্টিতে সেই চাঁদের লুকোচুরি খেলা দেখে যাচ্ছে।রিমি আজকের দিনটি নিয়ে ভাবতে লাগলো।আজ বিকেলে ভার্সিটি থেকে বের হতেই শুভ তাকে ডেকে বললো

-” রিমি তোর সময় হবে?একটু হেল্প লাগতো তোর।তোকে নিয়ে এক জায়গাতে যাবো।”

রিমির মন আনন্দে ভরে উঠলো।শুভ তাকে কোথাও নিয়ে যাবে ভাবতেই মন আনন্দে নেচে উঠলো।সচরাচর শুভর সাথে তার একা বের হওয়া হয়না।রিমি লাজুক হেসে চোখের চশমা ঠিক করে বললো

-“কি হেল্প লাগবে?”

-” চল গেলেই বুজবি।”

পাশ থেকে আরজু এসে রিমির কাধে হাত রেখে দুষ্টু হেসে বললো
-“আমাকে রেখে কোথায় যাওয়ার প্ল্যান করছিস তোরা?”

শুভ চোখ গরম করে বললো
-“তোকে বলতে হবে?যা ভাগ।”

আরজু রেগে শুভর পিঠে চাপর মেরে বললো
-“ফাজিল পোলা। দারা আন্টিকে যেয়ে বলবো তার ছেলে ডেট করতে বের হচ্ছে।”

রিমি বেশ লজ্জা পেলো।ইসস! আসলেই শুভর সাথে যদি একটাবার ডেটে যেতে পারতো।লজ্জায় হয়তো রিমি শুভর দিকে তাকাতেই পারতো না।
শুভ আরজুর চুল টেনে বললো
-“যা খুশি বল।আমি ভয় পাই নাকি?উল্টো আম্মু শুনলে খুশি হবে।এই রিমি চল তো ডেটে যাই।ফুয়াদ এই ফাজিলকে বাসায় পৌছে দিয়ে যাস।”

ফুয়াদ রিমির চোখে মুখের সেই আনন্দ দেখতে পেলো।মেয়েটা ভুল জায়গায় নিজের অনুভূতি ইনভেস্ট করছে।যেই ছেলের ধ্যান জ্ঞান সবটা জুড়ে আরজুর বসবাস সেখানে রিমির কোমল অনুভূতি শুভ কি করে উপলব্ধি করবে?
আরজু মুখ ভেঞ্চি দিয়ে বললো

-“আমি কি বাচ্চা নাকি? একাই যেতে পারবো।ফুয়াদ তুই যা তো।আর শুভ ছাগল আমার বাসায় আর আসিস?তোর ঠ্যাং ভেঙে গলায় ঝুলিয়ে দিব।”

শুভ বাইকে উঠতে উঠতে বললো
-” তোরা দুই বোন হলি বান্দরের নানী।তোদের ধারা সব সম্ভব।ঝুলে থাকা তোদের প্রজাতির স্বভাব।”

আরজু রেগে বললো
-“অবনি জানলে না, বাসায় যেয়ে তোর ঘাড় মটকে আসবে।”

-“হুম!!ওইটা তো বান্দরনী প্লাস পেত্নী।”

আরজু আবার শুভকে মারতে গেলো।ফুয়াদ আরজুকে আটকে বললো
-“থাম এইবার।ক্লাস ওয়ান টু পরা বাচ্চা নাকি তোরা?”

শুভ হেসে বললো
-“ওই সময় তো এই ফাজিল ক্লাসে বসে ভ্যা ভ্যা করে কাদতো।ফোলা ফোলা লাল গালে ওকে কি বিচ্ছিরি লাগতো তুই যদি একবার দেখতি।”

আরজু বেশ ক্ষেপে গেলো।ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করতে উদ্যত হলে শুভ দ্রুত বললো
-“রিমি জলদি বাইক উঠ।বাঁদর নাচ দেখানো শুরু করে দিচ্ছে।”

রিমি খিল খিল করে হেসে উঠলো।আর দ্রুতই বাইকে উঠে পড়ল।শুভ সময় নষ্ট না করে বাইক স্পিডে চালিয়ে চলে গেলো।আরজু রেগে সেদিকে তাকিয়ে ফোঁস ফোঁস করতে লাগলো।ফুয়াদ বললো

-“নাগিনের মতো ফোঁস ফোঁস করছিস কেনো?তুই কি নাগিন?যা ওই নাহিদ ব্যাটাকে দংশন করে আস।”

আরজু বোতলের পানি ফুয়াদের মুখে ছুড়ে মেরে বললো
-“ব্যাটা কি?নেক্সট টাইম থেকে দুলাভাই বলবি।”

বলেই আরজু চলে গেলো।ফুয়াদ মুখের পানি মুছতে মুছতে বির বির করলো
-“শুভর বাচ্চা কবে এই নাগিনকে প্রপোজ করবি?ওই নেতাকে ম্যাডাম কোন দিন যেনো বাচ্চার বাপ বানিয়ে দেয়।”

শুভ রিমিকে নিয়ে শপিং মলের সামনে দাড়ালো।রিমি চিন্তিত মুখে বললো
-“শপিং করবি নাকি?”

-“আগে চল।”

শুভ রিমিকে নিয়ে একটা জুয়েলারির দোকানে ঢুকলো। দোকানীকে বললো কিছু রিং দেখাতে।রিমি অবাক হয়ে সব দেখে যাচ্ছে।অনেক গুলো ডায়মন্ডের রিং তাদের সামনে রাখা হলো।শুভ বললো

-“একটা চুজ কর।”

রিমি অবাক হয়ে বললো
-“আমি চুজ করবো? কার জন্য?”

-” বলা যাবে না।সারপ্রাইজ।”

-“কিসের সারপ্রাইজ?”

-“আরে এতো কথা বলিস কেনো? দেখ কোনটা ভালো লাগে।এই সব ব্যাপারে আমার নলেজ একদম জিরো।”

রিমি ভাবনায় পড়ে গেলো।শুভ কার জন্য রিং কিনছে?অনেক দেখে রিমি একটা রিং চুজ করলো।শুভ সেটা দেখে বললো
-“তোর চয়েজ তো বেশ ভালো।আর সময় ও অনেক কম নিয়েছিস।তোর জায়গায় আরজু থাকলে ঘন্টা খানেক দেখেও চুজ করতে পারতো না।”

রিমি মুচকি হেসে বির বির করে বললো
-“আমার চয়েজ ভালো বলেই তোকে চুজ করেছি।”

শুভ হঠাৎ সেই রিংটি রিমির হাতে পরিয়ে দিলো।রিমি তো হতবম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। বক্ষস্থলে ধুক পুক শুরু হয়েছে।শুভ তাকে কেনো পড়াচ্ছে?রিমির অবাক হওয়া দেখে শুভ বললো

-“যার জন্য নিচ্ছি তার হাতের মাপ তোর মতোই। তবে এখন মনে হচ্ছে রিংটা তোর হাতের জন্যই বানিয়েছে।তোর হাতে বেশ মানিয়েছে।”

রিমি বেশ লজ্জা পেলো।শুভ রিংটি খুলতে চাইলে সেটা কিছুতেই খুলতে পারছিলো না।কিছুটা চেষ্টা করে বললো

-“তোর হাতেই তো আটকে গেলো।মনে হয় তোর হাতটাই রিংটার পছন্দ হয়েছে।”

বলেই হেসে দিলো।রিমির সারা শরীর শিউরে উঠলো।অদ্ভুত সেই অনুভূতি।রিমি নিজেই অনেক চেষ্টা করে রিংটি খুলতে সক্ষম হলো।রিমির মনে হচ্ছে এই রিং যদি কোনোদিন খুলতে না হতো তবে বেশ হতো।কারণ তার ভালোবাসা নিজ হাতে তাকে এটি পরিয়ে দিয়েছে।

*************
রাত তখন অনেক গভীর।সারা শহর গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে হয়তো।আরজু তার ব্যাতিক্রম নয়।আরজুর গভীর ঘুমের বেঘাত ঘটে ফোনের রিংটোনের শব্দে।আরজু বালিশের পাশ থেকে ফোন নিয়ে চোখ বন্ধ অবস্থায় রিসিভ করলে অপর পাশ থেকে কেউ বলে উঠলো

-“ঘুম ভেঙেছে?”

-“কে?”

-” চোখ খুলে ফোনের স্ক্রিনে কি লেখা আছে দেখে বলো তো?”

আরজু পিট পিট করে তাকিয়ে স্ক্রিনে নাম দেখে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো
-“নেতা সাহেব লেখা।”

নাহিদ মুচকি হাসলো।তাহলে তার বউ তার নাম নেতা সাহেব লিখে সেভ করেছে?আরজু ঘুমের মাঝে কথাটা বলেই ফট করে চোখ খুলে তাকালো।এক হাতে চোখ কচলে ফোনের স্ক্রিনে আবার তাকালো।তার নেতা সাহেব কল করেছে?চোখের ঘুম নিমিষেই হাওয়া হয়ে গেলো।আরজু খুশিতে নিচের ঠোঁট কামড় ধরলো।আর নিচু স্বরে বললো

-” জি বলুন।”

-” ভালো আছো আরজু?”

ইসস!! কি মায়া জড়ানো কন্ঠ।আরজুর মন ভালোলাগায় ছেয়ে গেল।এই সাধারণ প্রশ্ন আরজুর কাছে অসাধারণ মনে হচ্ছে।প্রায় সপ্তাহ খানেক পর মানুষটির গলা শুনতে পারছে।আরজু অভিমানী সুরে বললো
-” না ভালো নেই।একদম ভালো নেই।”

-“কেনো?”

-” জানিনা।”

নাহিদ মুচকি হেসে বললো
-“আমার কাছে একটা কমপ্লেইন করেছিলে।সেই ব্যক্তির শাস্তির ব্যবস্থা করেছি।”

আরজু কিছুই বুঝতে পারলো না।তাই বললো
-“মানে?”

-“তোমাকে লং ড্রাইভে নেওয়ার জন্য অপরাধী তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।”

আরজু কয়েক মুহূর্ত সময় নিলো কথাটা বুঝতে।তার পর হুর মুর করে বিছানা ছেড়ে বেলকনি এসে দাড়ালো।বাসার সামনে রাস্তায় একটা কালো গাড়ি দাড়িয়ে আছে।আর এই গাড়িটা নাহিদের।আরজু অস্থির হয়ে বললো

-“এতো রাতে আপনি আমার বাসার সামনে?”

নাহিদ গাড়ির গ্লাস খুলে আরজুর দিকে তাকালো।আবছা আলোয় এলোমেলো আরজুকে ভীষণ কিউট লাগছে।নাহিদ বললো

-“পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসতে পারবে? অলরেডি দেড়টা বাজে।”

আরজু অবাক হয়ে কয়েক মুহূর্ত নাহিদের দিকে তাকিয়ে রইলো।তারপর এক দৌড়ে রুমে ছুটে গেলো।আরজুর কান্ড দেখে নাহিদ ঠোঁট চিপে হাসলো।মেয়েটা আসলেই পাগলাটে আর দুরন্ত।

আরজু দ্রুত ওয়াসরুমে যেয়ে ফ্রেস হয়ে আসলো।একটা ব্ল্যাক ডেনিম প্যান্ট আর উপরে হোয়াইট শার্ট দ্রুত পড়ে নিলো।অলরেডি আট মিনিট পার হয়ে গেছে।আরজু ঠোঁটে সামান্য লিপস্টিক দেওয়ার সময় টুকুও পেলো না।তাই হাতের কাছে পাওয়া লিপ বাম দিয়ে দ্রুত বের হয়ে গেলো।মনে মনে নাহিদকে বকা ঝকা করলো।এই প্রথম কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাচ্ছে তারপরও রেডি হতে সময় দিয়েছে মাত্র পাঁচ মিনিট।পাঁচ মিনিটে কি রেডি হওয়া সম্ভব? কেমন এলোমেলো অবস্থায় বের হতে হচ্ছে।আরজু সাবধানে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো।এমন হুট করে রাতে বের হওয়ার কাজ সে আগেও শুভর সাথে করেছে। কিন্তু আজ অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে।আরজু দ্রুত সিড়ি দিয়ে নামলো।কারণ যা ঘাড় তেরা লোক।দেরি হলে চলেও যেতেও পারে।আরজু নাহিদের গাড়ির সামনে আসতেই নাহিদ দরজা খুলে আরজুকে ভেতরে বসতে ইশারা করলো।আরজু নাহিদের পাশে বসে খেয়াল করলো তার জামাই টা আজ পাঞ্জাবীর বদলে ব্ল্যাক টিশার্ট পরা।যা সচরাচর দেখা যায় না।ইসস!!! কি কিউট লাগছে।আরজুর নিজের নজর না লেগে যায়।নাহিদ আরজুর দিকে তাকিয়ে বললো

-“বাসায় কোনো প্রবলেম হবে?”

আরজু মাথা নেড়ে না জানালো।নাহিদ গম্ভীর স্বরে বললো
-” কোথায় যাবে বলো?”

আরজু নাহিদের দিকে নেশাত্ব চোখে তাকিয়ে বললো

-“আপনি যেখানে নিয়ে যাবেন সেটাই আমার গন্তব্য।”

নাহিদ কিঞ্চিৎ ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো।তারপর গাড়ি চালাতে শুরু করলো।

গভীর রাত বলেই রাস্তা ঘাট সব ফাঁকা।মাঝে মাঝে দুই একটা যানবাহনের দেখা মিলছে।আরজু এবার কিছুটা বিরক্ত হচ্ছে।কারণ নাহিদ কোনো কথাই বলছে না।এই ভাবে চুপ করে কি গাড়ি চালিয়ে যাবে নাকি?শহর থেকে কিছুটা দূরে এসে নাহিদ একটা টঙ দোকানের সামনে গাড়ি দার করলো।সিট বেল্ট খুলতে খুলতে বললো

-” বাইরে এসো আরজু।তোমাকে বেস্ট চা খাওয়াবো।”

আরজু বেশ আগ্রহ নিয়ে বেরিয়ে আসলো।নাহিদের মতো মানুষ এই ছোট্ট দোকানে চা খাবে ভেবেই আরজু অবাক হলো।তবে মনের মাঝে একটা প্রশান্তি বয়ে গেলো।আরজু বেরিয়ে আসতেই নাহিদ আরজুর হাত নিজের হাতে আবদ্ধ করে হাঁটতে লাগলো।আরজু সারা শরীর জুড়ে বিদ্যুৎ বেয়ে চলছে।হৃদস্পন্দনের গতি বেড়ে গেলো।শক্ত,রুক্ষ হাতটি আরজুর হৃদয়ে ঠিক কতটা ভরসা যোগাচ্ছে নাহিদ হয়তো ঠাহর করতে পড়ছে না।অসম্ভব ভালোলাগা আরজুর হৃদয়কে ঘিরে ধরলো। নাহিদ দোকানের সামনে দাড়িয়ে দোকানীকে উদ্দেশ্য করে বললো

-” কেমন আছেন চাচা?”

দোকানের বৃদ্ধ লোকটি নাহিদকে দেখে আনন্দে আত্নহারা হয়ে বললো
-“আরে বাবা তুমি আইছো? ভালা আছো বাবা?”

নাহিদ চমৎকার হেসে বললো
-” জি চাচা ভালো আছি।”

-” কতদিন পরে আইলা।হুনছি তুমি শহরের মেলা বড়ো নেতা হইছো?”

নাহিদ হেসে বললো
-” জি চাচা সবই আপনাদের দোয়ায়।”

বৃদ্ধ লোকটির চোখ পড়লো আরজুর দিকে।তিনি আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন
-” এই হুর পরী কেডা বাবা?”

নাহিদ আরজুর দিকে একপলক তাকিয়ে বৃদ্ধ লোকটির উদ্দেশ্য বললো
-” আমার বউ।আপনাদের বৌমা।”

এক দমকা হাওয়া আরজুর হৃদয়ে গভীরে অনুভূতির ঝড় তুলে গেলো।এই প্রথম নাহিদ তাকে “আমার বউ” বলে সম্মধন করলো।শব্দটা এতো মধুর লাগলো শুনতে যে আরজুর চোখ ভিজে উঠলো।এতো সুখ সুখ কেনো লাগছে?
বৃদ্ধ লোকটি বিস্ময় প্রকাশ করে বললো

-” ওমা!!এতো সুন্দর মাইয়া মানুষ আমি জীবনে দেহিনাই।কই পাইলা এই পরী?”

লোকটির কথায় নাহিদ দুষ্ট হেসে বললো
-“আকাশ থেকে টুপ করে একদম আমার সামনে এসে পড়েছে চাচা।তবে এই পরী কিন্তু বেশ ডেঞ্জারাস চাচা।”

আরজু কপাল কুঁচকে নাহিদের দিকে তাকালো।নাহিদ বাঁকা হেসে বললো
-” আমাকে নিজের জালে ফাঁসিয়ে নিয়েছে। জাদু টাদু জানে হয়তো।”

আরজু অভিমানী চোখে নাহিদের দিকে থেকে নজর সরিয়ে নিলো।বৃদ্ধ লোকটি হেসে বললো
-” এমন সুন্দর পরীর জালে তো পুরুষ মানুষ নিজের ইচ্ছায় ধরা দিবো।”

লোকটির কথায় আরজু বেশ লজ্জা পেলো।নাহিদ বললো
-” চাচা ঝটপট দুই কাপ স্পেশাল চা দিন।”

আরজু আর নাহিদ বেঞ্চে বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছে।আরজু চুমুক দিয়েই বললো

-” বাহ !! দারুন তো।”

-” হুম চাচা বেশ ভালো চা বানায়।স্টুডেন্ট লাইফে এই জায়গায় আমাদের বন্ধুদের বেশ আড্ডা জমতো।প্রায়শ চলে আসতাম।”

-“এই গভীর রাতে চাচা দোকান কেনো খুলে রেখেছেন?”

-” চাচার দোকান সারা রাতই খোলা থাকে।”

-” আমি আর শুভ আমাদের এলাকার সব টঙ দোকানের চা টেস্ট করে ফেলেছি। একটার চাইতে আরেকটা বেস্ট।শুভকে চিনেছেন?আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।”

-” হুম জানি।”

আরজু অবাক হয়ে বললো
-” কি করে জানেন?”

-“সাজেকে দেখেছিলাম।তোমার বেশ কেয়ার করে।”

-“হুম।শুভ আমার সাপোর্ট সিস্টেম।আমার লাইফে ভালো মুহূর্ত গুলোর বেশির ভাগটাই ওর সাথে কাটানো।”

চা শেষ করে আরজু আশেপাশে চোখ বুলালো।চারপাশ গাছে ঘেরা।দূরে একটা গ্রাম দেখা যাচ্ছে।চারপাশে মিষ্টি বাতাস বইছে।আরজুর নাকে মিষ্টি সুভাষ ভেসে আসছে।আরজু পাশে বসা মানুষটির দিকে তাকালো।এই সুভাষ তার প্রিয় মানুষটির কাছ থেকেই আসছে।নাহিদ আরজুর দিকে আড়চোখে তাকালো।আবার সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নিলো।কিন্তু আরজুর বেহায়া চোখ কিছুতেই ফেরাতে পারছে না।হঠাৎ করেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো।আর আরজুর হুস ফিরলো।এই গভীর রাতে ভালোবাসার মানুষটির পাশে বসে বৃষ্টি উপভোগ করার অনুভূতি অন্যরকম।আরজুর হৃদয়ে ভালোলাগারা বার বার দোলা দিয়ে যাচ্ছে।আজকের রাতটা আসলেই সুন্দর।নাহিদ এই অসময়ের বৃষ্টিতে বেশ বিরক্ত হলো।আর আরজু নাহিদের সেই বিরক্তি মাখা মুখখানা দেখে আবারও প্রেমে পড়ল।

দোকানের সামনেই তারা বেশ কিছুক্ষন অপেক্ষা করলো।রাত তখন প্রায় তিনটা বিশ।এক্ষনি বেরিয়ে না পড়লে বাসায় পৌঁছাতে দেরী হয়ে যাবে।তাছাড়া আরজু বাসায় কাউকে কিছুই জানায়নি।তাই আরজুকে নিয়ে বৃষ্টির মাঝেই দৌড়ে গাড়িতে চলে আসলো।এতো অল্প সময়ের মধ্যেই তারা অনেকটা ভিজে গেলো।আরজু গাড়িতে বসে চুল ঝাড়তে লাগলো।আর নাহিদ এক দৃষ্টিতে সেই দৃশ্য দেখতে লাগলো।নাহিদের হঠাৎ নজর পড়লো আরজুর শরীরের দিকে।সাদা শার্ট ভিজে আরজুর শরীরের সাথে লেপ্টে আছে।আরজুকে ভীষণ আবেদনময়ী লাগছে।নাহিদের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে ওঠলো।নাহিদের মনে হচ্ছে সে ভীষণ তৃষ্ণার্ত।যেই তৃষ্ণা একমাত্র এই রমণী মিটাতে পারবে।

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_34

চারদিকে ঝড়ো হাওয়া বইছে।সাথে ঝুম বৃষ্টি।নিস্তব্দ রাস্তায় গাড়ির ভেতরে বসে আছে এক জোড়া দম্পত্তি।দুজনের হৃদয়ে যেনো তুমুল অনুভূতির ঝড় বয়ে যাচ্ছে।সম্পর্কের বৈধতা থাকলেও কোথাও যেনো একটা দূরত্ব রয়েই গেছে।সেই দূরত্ব মনের নয়।দূরত্বটা দ্বিধার।

নাহিদ খুব সহজেই নিজের আবেগকে কন্ট্রোল করতে জানে।সামনে তার বিবাহিত লাস্যময়ী, আবেদনময়ী, মায়াবিনী স্ত্রীকে দেখে মনে যেই উথাল পাথাল ঝড় সৃষ্টি হয়েছে সেটা দমানো ভীষণ জরুরী।মাঝে মাঝে একান্ত নিজের জিনিসে ও অধিকার ফলানো যায়না।নাহিদ নিজের দৃষ্টি সরিয়ে সামনের রাস্তায় নিক্ষেপ করলো।জোরে নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে বির বির করলো

-” কন্ট্রোল নাহিদ,কন্ট্রোল ইয়োরসেলফ। ইউ ক্যান ডো ইট।”

আরজু তখনও নাহিদকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।তার মোহনীয় দৃষ্টিভঙ্গি নাহিদকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে।বৃষ্টিতে ভিজে নাহিদের হাতের লোম ভিজে ঘন হয়ে পড়ে আছে।কপালে বেশকিছু ভেজা চুল লেপটে পড়েছে।যেখান থেকে টুপ টুপ করে পানি ঝরছে।একজন পুরুষ এতটা সুদর্শন কি করে হতে পারে?সবাই তাকে রূপবতী বলে।একটা বার সামনের পুরুষটিকে এই রূপে দেখুক।রূপের ডেফিনেশন হয়তো বদলে যাবে।একজন পুরুষ কতটা মোহনীয় হতে পারে তার নেতা সাহেবকে না দেখলে জানতেই পারত না। এমন সুপুরুষ কে দেখে যে কোনো যুবতী নিজেকে সংযত করতে পারবে না।এই মানুষটি আরজুর সুন্দর চরিত্রে কালিমা একেই দম নিবে।আরজুর সারা শরীর শিরশির করছে।দুই কান গরম হয়ে আসছে।গলা শুকিয়ে আসছে।বর্ষণের রাতে প্রথম ভালোবাসার মানুষটিকে এতটা কাছে পেয়ে আরজুর আবেগ যেনো ডানা মেলে উড়তে চাইছে।নাহিদকে ঝাপটে ধরতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু অজানা এক দ্বিধা তাকে আটকে রাখছে।

নাহিদ আড়চোখে আরজুর দিকে তাকালো।আরজুর মোহনীয় দৃষ্টি নাহিদকে আরজুর প্রতি আরো বেশি আকর্ষণ করছে।দুজনের দৃষ্টি মিলিত হতেই আরজু আর নিজেকে সামলাতে পারলো না।নাহিদের সেই দৃষ্টিতে কি ছিল তা আরজুর জানা নেই।কিন্তু সেই দৃষ্টিতে আরজু ধ্বংস হয়ে গেলো।নিজের সব দ্বিধা ভুলে নাহিদকে হুট করেই ঝাপটে ধরলো।যার ফলে নাহিদ গাড়ির দরজার দিকে হেলে পড়লো।নাহিদের পরনের টিশার্টি এর কলার টেনে নিচে নামিয়ে গলায় নাক ডুবালো আরজু।কি মাতাল করা সুভাষ!!!!

নাহিদ খানিকটা হতবম্ব হয়ে পড়লো।আরজু হঠাৎ এই ভাবে আক্রমণ করে বসবে এটা ধারণাও করতে পারেনি।গলার কাছে কোমল স্পর্শ নাহিদের মস্তিষ্ক এলোমেলো করে দিচ্ছে।আরজু এতেই দমে গেলো না।নাহিদের গলায় গভীর চুম্মন একে দিলো।নাহিদ অনুভূতির তাণ্ডবে পড়ে আরজুর কোমর ঝাপটে ধরে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলো।অন্য হাতে আরজুর চুল খামচে ধরলো।আরজুর বক্ষস্থলের উঠানামা নাহিদ অনুভব করছে।লোক ঠিক বলে,সকল ধ্বংসের মুলে রয়েছে নারী জাতি।এইযে নাহিদকে ধ্বংস করে দিচ্ছে এই সাধারণ নারী।স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা হয়তো এই নারীমূর্তির অবয়ব সৃষ্টি করে মুগ্ধ হয়েছেন।

আরজু যেনো আরো উন্মাদ হয়ে উঠলো।চুমু বর্ষণের মাঝেই নাহিদের গলায় জোরে একটা কামড় বসিয়ে দিলো।নাহিদ হালকা আহা! শব্দ করে উঠলে আরজুর হুস ফিরল।দ্রুত নাহিদকে ছেড়ে দিলো। নাহিদও নিজের হাত আলগা করে নিলো।আরজু তীব্র লজ্জায় চোখ বুজে নিজের সিটে বসে পড়লো।আর দুই হাতে মুখ ঢেকে লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়তে লাগলো।

আরজুর অবস্থা দেখে নাহিদ নিচের ঠোঁট চেপে মুচকি হাসলো।গলায় কামড় দেওয়া জায়গায় হাত বুলিয়ে বললো

-” কি ধারালো দাত তোমার।আমার গলা থেকে মাংস ছিঁড়ে নিয়েছো। নাহ!! আমার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষের পথে।লোকে বলবে যেই মেয়র একটা মেয়ের হাত থেকে নিজেকে প্রোটেক্ট করতে পারেনা সে আবার জনগণকে কি করে প্রটেকশন দিবে?”

আরজুর লজ্জায় মরি মরি অবস্থা।এতটা বেহায়া সে কি করে হলো।সোজা ঝাঁপিয়ে পড়লো মানুষটির উপর?যতই নিজের বর হোক।একটু সংযত রাখতে পারলনা নিজেকে। ইসস! মান সম্মান কিছুই আর অবশিষ্ট রইলো না।নেতা সাহেব কি ভাবছে?নিশ্চই তাকে বেহায়া মেয়ে ভাবছে।লজ্জায় আরজুর কান্না পেয়ে গেলো।কিন্তু সে কেঁদে আর মান সম্মানের ফালুদা করবে না।তাই মুখ থেকে হাত সরিয়ে মাথা নিচু করে ভাঙ্গা গলায় বললো

-” আমি বাসায় যাবো।”

নাহিদ আরজুর অবস্থা দেখে মুচকি হাসলো।আর বললো
-” তোমার মুখ কেমন লালচে রঙের হয়ে আসছে।কোনো ভাবে তুমি ভ্যাম্পায়ারে রূপান্তরিত হচ্ছো নাতো?যা ধারালো দাত তোমার?তুমিও কি সেই প্রজাতির নাকি?”

আরজু মনে মনে ভাবলো এই নেতাকে যতোটা শান্ত ভেবেছে সে ততটা শান্ত না।বেশ ফাজিল।কেমন করে মজা নিচ্ছে।আরজু যেনো মাথা তুলে তাকাতে পারছে না।তাই নিচু কন্ঠে ফিসফিস করে বললো

-” আপনি যাবেন নাকি আমি নেমে যাবো।”

-” থাক নামতে হবে না।রক্তের পিপাসা লাগলে আমাকে বলো।আমার গলা নিয়ে উপস্থিত হয়ে যাবো।যত খুশি রক্ত চুষে খেয়ো।”

আরজুর আর কিছুই বললো না।নাহিদ মুচকি হেসে গাড়ি স্টার্ট দিলো।রাস্তায় আর কেউ কিছুই বললো না।নাহিদ মিউজিক প্লেয়ারে গান বাজিয়ে দিলো।

যদি ডেকে বলি এসো হাত ধরো
চলো ভিজি আজ বৃষ্টিতে
এসো গান করি মেঘো মল্লারে
করুনাধারা দৃষ্টিতে
আসবে না তুমি জানি আমি জানি
অকারনে তবু কেনো কাছে ডাকি
কেনো মরে যাই তৃষ্ণাতে
এইই এসো না চলো জলে ভিজি
শ্রাবণ রাতের বৃষ্টিতে।

প্রায় সাড়ে চারটার দিকে তারা আরজুর বাসার সামনে পৌঁছায়।অন্ধকারাচ্ছন্ন রাস্তাটি নিস্তব্ধতায় আচ্ছন্ন।একটু পরই আযান দিয়ে দিবে।তখন মানুষের আনাগোনা বেড়ে যাবে।আরজু গাড়ি থেকে নামতে লাগলে নাহিদ থমথমে গলায় বললো

-” তুমি বড়ো বেসামাল আরজু।নিজের আবেগ, অনুভূতিকে সামলাতে পারো না।একজন নেতার বউ হলে অনেক কিছু বিসর্জন দিতে হয়।আর নিজেকে সংযত রাখতে শিখতে হয়।জেনে বুঝে আমার জ্বলন্ত রাজ্যে পা বাড়িয়েছো।পুড়তে তো হবেই।আমার সাথে পথ চলা তোমার জন্য সহজ হবে না আরজু।নিজেকে কঠিন করে গড়তে শিখো।”

আরজু নাহিদের দিকে তাকালো।আর বললো
-“ভালোবাসার মানুষটি শক্ত করে হাতটি ধরলে অতি দুর্গম পথ ও পাড়ি দেওয়া সম্ভব।আপনিকি জীবনে শেষ পথ পাড়ি দেয়া পর্যন্ত আমার পাশে থাকবেন?”

নাহিদ আরজুর দিকে কোমল দৃষ্টিতে তাকালো।কিঞ্চিৎ ঠোঁট প্রসারিত করে আরজুর মাথায় পরম আবেশে হাত বুলিয়ে বললো

-” তুমি অনেক বড়ো হয়ে গেছো আরজু।”

আরজু অবাক হলো নাহিদের এই কথায়।নাহিদ এমন ভাবে বলছে যেনো আরজুকে বহু বছর আগে থেকেই চেনে।তাই বড়ো হয়ে গেছে বুঝতে পারছে।

**********
সকাবেলায় রিমির ঘুম ভাঙ্গলো কারো কোমল স্পর্শে।চোখ খুলে মাকে দেখতে পেলো সে।রিমির মা মুচকি হেসে বললো

-” শুভ জন্মদিন মামণি।”

রিমি আড়মোড়া ভেঙে বললো
-” ধন্যবাদ মা।”

-” জলদি উঠ।তোর বাবা আর ভাই তোর জন্য নাস্তার টেবিলে অপেক্ষা করছে।”

রিমির মা চলে যেতেই রিমি ফোন চেক করলো।বন্ধু মহলের সকলেই তাকে নিয়ে নানান পোস্ট করে শুভেচ্ছবার্তা জানিয়েছে।রিমির চোখে পড়লো শুভর পোস্ট।শুভ একটা ফোটো আপলোড করেছে।যেখানে রিমি ক্যামেরায় তাকিয়ে সুন্দর করে হাসছে আর শুভ তার পেছনে দাড়িয়ে হাতের আঙ্গুল দিয়ে সিং বানিয়ে রেখেছে।ছবিটা দেখে রিমি হাসলো।শুভর ছবিতে একটা চুমু খেয়ে লাজুক হেসে বিড়বিড় করলো

-” এই দিনে আমার জন্মই হয়েছে তোর জন্য। আই লাভ ইউ শুভ।”

রিমি ফ্রেস হয়ে টেবিলের কাছে আসতেই দেখতে পেলো বাবা আর ভাই অলরেডি নাস্তা শুরু করে দিয়েছে।রিমি সবাইকে গুড মর্নিং জানিয়ে বসে পড়লো।রিমির বাবা মেয়েকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে বললো

-“জন্মদিনের দিনই তুমি আধা ঘণ্টা লেট রিমি। দেটস নট ফেয়ার।”

রিমি মাথা নিচু করে বললো
-” সরি বাবা আর হবে না।”

নিশান গম্ভীর সুরে বললো
-” নাস্তা করে আমার রুমে আসিস।তোর জন্য গিফট আছে।”

রিমি বেশ খুশি হয়ে দ্রুত নাস্তা শেষ করে নিশানের রুমে চলে গেল।নিশান একটা ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে বললো

-” দেখ পছন্দ হয় কিনা?”

-” ওয়াও!!! এতো সুন্দর ড্রেস।তুমি এতো সুন্দর ড্রেস চুজ করলে কি ভাবে?তোমার চয়েজ তো ভীষণ বাজে।”

কথাটা বলেই রিমি চুপ হয়ে গেলো।বেশি এক্সাইতেড হয়ে কি সব বলে ফেলেছে।ভাইয়া কি রাগ করলো?রিমি মেকি হেসে বললো
-” না মানে তোমার চয়েজ এতটাও খারাপ না।দেখো কত ভালো ড্রেস চুজ করেছ।”

নিশান মনে মনে অবনীকে ধন্যবাদ জানালো।সেদিন এই পিচ্ছি তাকে এইগুলো চুজ না করে দিলে সেই কমলা রঙের জামাটাই হয়তো সে আনতো।যা রিমির হয়তো কখনোই পছন্দ হতো না।পিচ্চির পছন্দ বেশ ভালো।