মিষ্টি রোদের হাতছানি পর্ব-৩৮+৩৯+৪০

0
1144

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_38

সময়টা সন্ধার দিকে।আরজু সোফার রুমের ব্যালকনিতে যেয়ে বসলো।পাশেই জুবায়ের আহমেদ চা খাচ্ছেন।আরজুকে দেখে হেসে বললেন

-” কি ফুল পরীর কি মন খারাপ নাকি?”

আরজু নিজের হাতে থাকা কফিতে চুমুক দিয়ে বলল
-” না।”

জুবায়ের আহমেদ আরজুকে আর ঘাটলেন না।কারণ আরজু তার সাথে শেয়ার করার মতো কিছু হলে অবশ্যই বলতো।বাবা মা হীন এই এতিম মেয়েটাকে তিনি সবসময় বাবার মতো স্নেহ ভালবাসা দেওয়ার চেষ্টা করেন।পুতুলের মত মেয়েটিকে সর্বদা ব্যাক্তি স্বাধীনতা দিয়েছেন।আরজু বললো
-“আচ্ছা হিরো!!! আমাদের কি সাধ্যের বাইরে যেয়ে কিছু পাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করা ঠিক? মূল্যবান কোনো বস্তু তুমি নিজের করে পাওয়ার ইচ্ছে রাখেলে,কিন্তু দেখলে সেটা মূল্যবান না অতি মাত্রায় মূল্যবান। যেটা ধরা ছোঁয়ার বাইরে।সেই জিনিসটার মায়া কি তবে ছেড়ে দেওয়া উচিৎ হবে?”
জুবায়ের আহমেদ কপাল কুচকে আরজুর দিকে তাকালেন।আরজুর মনে কি চলছে বুঝতে পারছেন না।তিনি মুচকি হেসে বললেন

-“মূল্যবান আর মূল্যহীন বলে কি কিছু আছে আরজু?প্রয়োজন ভেদে সব কিছুর মূল্য নির্ধারিত হয়।ধর অতি সামান্য ডায়েরী তোর কাছে মূল্যবান হতে পারে। কারণ সেটা হয়তো তোর প্রিয় কোনো মানুষ তোকে দিয়েছে। তার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। সেই ডায়েরির সাথে তোর ভালোবাসা, অনুভূতি,আবেগ সব কিছু জড়িত আছে। স্বাভাবিকভাবেই সে সামান্য ডায়েরী তোর কাছে অসামান্য হয়ে উঠবে।তাছাড়া ভালোবাসার প্রত্যেকটা জিনিসই অতি মূল্যবান হয়। আর ভালবাসার জিনিসের মায়া ছাড়ার তো কোন প্রশ্নই আসে না। ভালোবাসা মানেই তো মায়া, আবেগ,অনুভূতি।”

আরজু মুচকি হেসে আবার কফিতে চুমুক দিলো।এই মানুষটি তার মনের সকল দ্বিধা দ্বন্দ্ব দুর করে দিয়েছে। আরজু বললো

-” এইযে খালামণি কাজের চাপে তোমাকে সময় দিতে পারেনা এতে তোমার কষ্ট বা রাগ হয়না?”

জুবায়ের আহমেদ বলেন
-“লয়ার হওয়ার সপ্ন তোর খালামণি আমার সাথে দেখা হওয়ার আগে থেকেই দেখেছে।এই স্বপ্নকে ভালোবেসেছে।তাহলে তার এই স্বপ্নের ক্যারিয়ার নিয়ে আমার কেনো কোনো কষ্ট বা রাগ হবে? বরং আমার জন্য যদি সাবা নিজের ইচ্ছেকে মাটি চাপা দিতো তবে কখনোই আমরা সুখী হতে পারতাম না।কারণ ভালোবাসার মানুষটির মুখের প্রশান্তির হাসিতেই আসল সুখ।”

আরজু মনে মনে ভাবলো তার আর নাহিদের সংসার কি এমনি স্নিগ্ধ মধুর হবে?কবে আসবে সেই মহেন্দ্র খন।

**********
আরজুদের বাসায় আজ পুরো বন্ধুমহল এসেছে।মূলত সাবা খানম বাসায় একটা ছোট খাটো গেট টুগেদার এর আয়োজন করেছেন।কিন্তু হঠাৎ এই আয়োজনের সঠিক কারণ আরজুর জানা নেই।

সবাই আসলেও রামিম আর শুভ এখনো পৌঁছায়নি।আরজু শুভকে বার বার কল করে যাচ্ছে।সাবিহা রামিমকে কল করলো। বেশ কয়বার রিং হওয়ার পর রামিম রিসিভ করলো।রামিম বললো
-” দেখছিস কল কেটে দিচ্ছি,তাহলে বার বার কল দিচ্ছিস কেনো?”

সাবিহা থতমত খেয়ে বললো
-” আরজু তোকে কল করে জানতে বললো কখন আসবি?”

রামিম খানিকটা রেগে বললো
-“মেয়ে মানুষ আসলেই বেক্কল হয়।তুই তার প্রমাণ।”

সাবিহা অভিমানী সুরে বললো
-” বকছিস কেনো? কি করেছি আমি?”

-” জানিস এই সময় আমি টিউশনে থাকি।তবে বার বার কল করে যাচ্ছিস কেনো?”

-“না মানে আসলে”

-” ফোন রাখ।”

সাবিহা মুখ গোমড়া করে রাখলো।রিমি মুচকি হেসে বললো
-” কীরে তোর জানপাখি বকেছে নাকি?”

সাবিহা রেগে বললো
-” ওই কুত্তা আমার কোনো জান না।আমার জানের দুশমন।”

জারা হো হো করে হেসে বললো
-“জাস্ট রামিমের সামনে এই কথা রিপিট করতে পারবি তো?”

সাবিহা মুখ ভেংচে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো।কারণ এই কথা সে রামিমের সামনে কখনোই উচ্চারণ করতে পারবে না। রামিমকে ভয় পায় তেমন কিছু না।কিন্তু রামিমের সামনে গেলে তার সব কথাই জড়িয়ে যায়।

*************
সাবা খানম তারাকে নিয়ে রান্না ঘরে ভীষণ ব্যাস্ত।কাজের চাপে তিনি এই কয়দিন পরিবারকে একদমই সময় দিতে পারেননি।তাই সবাইকে নিয়ে ছোটখাটো এই আয়োজন।জুবায়ের আহমেদ চেয়ারে বসে স্ত্রীর খুশি মুখখান দেখে বেশ চিন্তিত।এই খুশির কারণটা আরজুর জানতে পারলে কি ভাবে রিয়্যাক্ট করবে কে জানে?

ফুয়াদ ফোনে গেম খেলতে খেলতে আরজুকে বললো
-” আন্টি হঠাৎ আমাদের দাওয়াত করলো ঘটনা কি?”

আরজু চিন্তিত মুখে বললো
-” বিষয়টা নিয়ে আমারও একটু খটকা লাগছে।খালামণি হঠাৎ তোদের মত হুলু বেড়াল দের কেনো রেধে বেরে খাওয়াচ্ছে?”

জারা বললো
-” তুই কিন্তু আমাদের অপমান করছিস।”

আরজু ভাবলেশহীন ভাবে বললো
-” হে করছি।”

জারা রেগে বললো
-” এই চল থাকবনা আর এই বাসায়।”

আরজু বলে উঠলো
-” দরজা ওই দিকে।”

জারা এবার দমে গিয়ে বললো
-” অবশ্যই যাবো।আন্টির হাতের গরু ভুনা খেয়েই চলে যাবো।”

জারার কথায় বাকি সবাই হেসে উঠলো।
ফুয়াদ হেসে বললো
-” এই খাদক নাকি আবার মডেলিং করে।”

-” একদম আমার মডেলিং নিয়ে কিছু বলবি না।আমার ফিগার দেখেছিস?”

ফুয়াদ মুখে হাত চেপে বললো
-” আস্তাগফিুল্লাহ!!! তোর ফিগার দেখে লাভ আছে? আমি দেখবো আমার বউয়ের ফিগার।”

জারা রেগে বললো
-” তোর মত নমুনাকে কে বিয়ে করবে?”

-” ভালো করে দেখ!!মেয়েদের লাইন পরে আছে।”

সাবিহা বিরক্ত হয়ে তাদের ধমকে থামালো।
তার বেশ কিছুক্ষন পর রামিম আর শুভ আসলো।শুভর সাথে তার মা বাবা আর বোন শোভাকে দেখে আরজুর এবার খানিকটা খটকা লাগলো।এতো আয়োজনের পেছনে খালামনির উদ্দেশ্যই বা কি?

*********
অবনি টেবিলে নাস্তা রেডি করা দেখছে আর দাত দিয়ে নখ কাটছে।রিমি অবনির পাশে দাড়িয়ে বললো
-” কি পিচ্ছি এমন আন হাইজেনিক কাজকর্ম কেনো করছো?আমার ভাইয়া থাকলে একটা ধমক দিয়ে ফেলত যে কান্না করে দিতে।”

অবনি মুচকি হেসে বললো
-” আপু আপনার ভাইকে সোজা করার মানুষ মহান আল্লাহ অলরেডি পাঠিয়ে দিয়েছে।তাই চিন্তার কিছু নেই।”

রিমি কিছুই বুঝতে না পেরে বললো
-” মানে?”

-” আরে আপনার ভবিষ্যৎ ভাবি নিশ্চই পয়দা হয়ে গেছে।”

রিমি হেসে অবনির ফোলা গাল টেনে বললো
-” ভীষণ দুষ্টু মেয়ে তুমি। আই লাইক ইট।”

-” দুষ্ট মেয়ে কি আপনার ভায়েরও পছন্দ?”

-” মোটেও না।সে শান্তি প্রিয় মানুষ।তাই তার শান্ত মেয়ে পছন্দ।”

অবনি মুখ ভেংচে বির বির করে বললো
-” শান্তি প্রিয় মানুষের জীবনের সব শান্তি আমি হালুয়া করে ছাড়বো।”

**********
খাওয়ার পর্ব শেষ হতেই শুভর মা আরজুকে নিজের পাশে বসিয়ে মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন।তিনি আগেও আরজুকে ভীষণ আদর স্নেহ করতেন।তবে আজ আদরের মাত্রা আরো কয়েক ধাপ বেরে গেছে।পাশেই সাবা খানম বসে তৃপ্তির হাসি হাসছেন।শুভ পাশে বসে তার মায়ের কান্ড দেখছে।ফুয়াদ শুভর কানে কানে বললো

-“আন্টি যেই ভাবে আরজুকে দেখছে মনে হচ্ছে আজই ঘরে তুলে নিয়ে যাবে।”

শুভ বিরক্ত হয়ে বললো
-” মা সবসময় বেশি বেশি করে।”

-” তোর মায়ের মতি গতি ভালো ঠেকছে না।”

একটু পরই শুভর মা শুভকে ডেকে আরজুর পাশে বসালেন।আরজু শুভকে পিঠে চিমটি কাটছে।এটা তার ছোট বেলার অভ্যাস।সবার আড়ালে শুভকে চিমটি কাটবে,জ্বালাবে।শুভ রাগী চোখে আরজুর দিকে তাকালে আরজু মুখ ভেংচি দিলো।সাবা খানম আরজুর আর শুভর কান্ড ঠিক খেয়াল করলেন।পাশে বসা জুবায়ের আহমেদের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালেন।যেই দৃষ্টি অনেক কথাই বলে গেলো।
শুভর মা হঠাৎ বললেন

-” আজ তোদের জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।আমি আর সাবা মিলে একটা ডিসিশন নিয়েছি।এই ইচ্ছেটা আমার আরো অনেক বছর আগে থেকেই ছিল।”

আরজু সহ বন্ধু মহলের সকলেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।শুভর হঠাৎ টনক নড়ল।সে মায়ের হাত চেপে ধরলো।শুভর মা শুভকে আশ্বস্ত করে বললেন

-“আমি আরজুকে আমার ঘরের লক্ষী করে নিয়ে যেতে চাই।সেই ছোট আরজুকে দেখার পর থেকেই আমার এটাই সপ্ন ছিল।মেয়েটা আমার সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখবে।”

আরজু, শুভ সহ বাকি সবাই ভীষণ অবাক হয়ে গেলো।অবাকের মাত্রা এতো বেশি ছিলো যে আরজু স্তব্ধ হয়ে পড়ল।অবনি মনে মনে বললো

-” এই ছিলো আম্মুর মনে?আমি তো আগেই বুঝেছিলাম।এইবার আপু আর নেতা সাহেবের কি হবে?”

অন্যদিকে রিমির বুকে যেনো কেউ ছুরি চালিয়ে দিচ্ছে।বুকে অসম্ভব যন্ত্রণা শুরু হচ্ছে।ভালোবাসার যন্ত্রণা বুজি এমন তীব্র হয়?
জারা আরজুর দিকে তাকালো।মেয়েটার সুন্দর মুখটা কেমন মলিন হয়ে গেছে।আরজু তো তার নেতা সাহেব ছাড়া অন্য কারো কথা চিন্তাই করতে পারে না।মেয়েটার মনের ভেতর দিয়ে কেমন ঝড় বইছে।

আরজু অবাক হয়ে সাবা খানমের দিকে তাকিয়ে বললো
-” খালামণি এ..এসবের মানে কি?”

সাবা আরজুর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন

-” তোর জন্য একটা বিশ্বস্ত হাত খুঁজছিলাম।যেই হাতে তোকে তুলে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হতে পারবো।যেই হাতের মালিক তোকে বুজবে,সম্মান করবে।চারদিকে সেই বিশ্বস্ত ব্যাক্তিকে খুঁজতে খুঁজতে আমি হয়রান। অথচ আমাদের এতো কাছেই সেই মানুষটি ছিলো আমি পর্যবেক্ষণ করতে পারিনি।আপা প্রস্তাব দেওয়ার পর আমি রিয়েলাইজ করতে পারলাম শুভর চাইতে ভালো বিশ্বস্ত আর কেউ হতে পারে না।তোরা দুজন দুজনকে ছোটবেলা থেকে চিনিস জানিস।এই পৃথিবীতে শুভর চাইতে বেশি ভালো করে তোকে আর কেউ বুঝতে পারবে না আরজু।তোর খালামনির উপর ভরসা রাখ।”

আরজু ছল ছল দৃষ্টিতে খালামনির দিকে তাকিয়ে রইলো।শুভ নিজের অনুভূতি বুঝতে পড়ছে না।আরজুকে অবশ্যই সে নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে চায়।কিন্তু এই ভাবে না।আরজুকে আগে অফিসিয়ালি প্রপোজ করে আরজুর সম্মতি ক্রমে।কিন্তু তার মায়ের বড্ডো তারা।আরজুকে ছেলের বউ করার জন্য তার তর সইছে না।আরজু বিষয়টা কি ভাবে নিচ্ছে কে জানে?হাজারো চিন্তায় শুভর মাথা ফেটে যাচ্ছে।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার মাকে উদ্দেশ্য করে বললো

-” আম্মু হঠাৎ তোমরা এই সিদ্বান্ত কেনো নিলে? আমাদের আগে জানাতে পারতে।হঠাৎ করে এই ভাবে?”

শুভর মা বললো
-“তোদের এসব ভাবতে হবে না।একজনের কিছু হলে অন্যজন যেমন অস্থির হয়ে পড়িস এটা ভালোবাসা না তো কি?”

আরজু অস্থির হয়ে বললো
-” আন্টি আপনি যেমন ভাবছেন তেমন কিছুই আমাদের মধ্যে নেই।আমরা বেস্ট ফ্রেন্ড।”

সাবা আরজুকে আশ্বস্ত করে বললেন
-“স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে বন্ধুত্বটা বেশ প্রয়োজন।আর তোদের মধ্যে অলরেডি সেটা আছে।বন্ধুত্বের টাইটেলের জন্যই তুই হয়তোবা এই সম্পর্ককে গভীরতা মাপতে পারছিস না।আচ্ছা বলতো পরিবারের বাইরে জীবনে সবচাইতে বেশি বিশ্বাস কাকে করিস?শুভকেই তো তাইনা?”

আরজু ছল ছল চোখে মাথা নেড়ে হে জানালো।সাবা খানম আবার বললেন
-” মাঝ রাতে হুট হাট শুভর সাথে বাইরে ঘুরতে বেরিয়ে পড়িস আমি জানিনা ভেবেছিস?শুভর সাথে থাকলে নিজেকে সবচাইতে নিরাপদ ভাবিস তাই তো?”

আরজু আবারও মাথা নেড়ে হ্যা জানালো।সাবা খানম মুচকি হেসে বললেন
-” ব্যাস!! একটা সম্পর্কে আর কি লাগে। এবার আর আমার পরীটাকে নিয়ে কোনো চিন্তা নেই।সব চিন্তা,দায়িত্ব শুভর হাতে দিয়ে দিলাম।”

রিমি ছল ছল চোখে শুভর দিকে তাকিয়ে রইলো।শুভর অনুভূতি সম্পর্কে ধারণা করতে পারছে না।শুভকে চিন্তিত দেখাচ্ছে কিন্তু এই সম্পর্ক নিয়ে ঘোর আপত্তি আছে বলে মনে হচ্ছে না।রিমির সারা শরীর কাঁপতে লাগলো।ফুয়াদ আড়চোখে রিমিকে দেখছে।রিমির মনের অবস্থা ভালো করেই বুঝতে পারছে।একদিন যে এই কষ্টটা পাবে সেটা ফুয়াদ ভালই অনুধাবন করতে পেরেছিল।কিন্তু রিমিকে সান্তনা দেওয়ার ভাষা তার জানা নেই।

আরজুর চোখে শুধু একটা মুখ ভাসছে।তার নেতা সাহেব।সে অলরেডি বিয়ের মতো পবিত্র সম্পর্ককে জড়িয়ে পড়েছে সেটা সবাইকে কি করে বলবে?অন্যদিকে নেতা সাহেব বিয়ের বিষয়টা গোপন রাখতে আদেশ করেছেন।কি করবে আরজু বুঝতে পারছেনা।
শুভর মা আরজুর মলিন মুখ দেখে আরজুর গালে আলতো ছুঁয়ে বললেন

-“এতো কি ভাবছিস? আমার ছেলের মত তোকে অন্য কেউ ভালোবাসতে পারবে না।”

আরজু অস্থির হয়ে বললো
-” আমি এইসবের জন্য মোটেও প্রস্তুত নই।”

এবার জুবায়ের আহমেদ মুখ খুললেন।আরজুর উদ্দেশে বলেন
-“আরজু এই ব্যাপারে কিন্তু আমি তোর খালামনির সাথে একমত।শুভর বিষয়ে আমার কোনো ডাউট নেই।শুভর মতো কেয়ারিং জীবনসঙ্গী সব মেয়েরই কাম্য।তুই অনেক সুখী হবি।তাছাড়া তোদের এক্ষনি বিয়ের সম্পর্কে আবদ্ধ হতে হচ্ছে না।তোর খালামণি ওরা চাইছে এখন আংটি বদল করে রাখতে।পড়ে তোদের গ্র্যাজুয়েশন শেষ হোক তখন নাহয় বাকি সব হবে।”

পরিস্থিতি গম্ভীর দেখে ফুয়াদ বলে উঠলো
-” হায় আল্লাহ!! এক গ্রুপে কয়টা লাভ বার্ডস থাকবে?”

সাবিহা রামিম দুজনেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল।রামিম আড়চোখে সাবিহার দিকে তাকিয়ে দেখলো সাবিহার ফর্সা মুখ একদম লালাভ বর্ণ ধারণ করেছে।রামিম হৃদয় স্থলে উষ্ণ অনুভূতি হলো।

আরজু কিছু বুঝে উঠার আগেই শুভর মা ব্যাগ থেকে একটি বক্স বের করলেন।
জারা মনে মনে বললো
-“পুরো প্রস্তুতির নিয়েই এসেছেন।”

বক্সের ভেতরের রিং দেখে শুভ অবাক হয়ে গেলো।এটা তো সেই রিং যেটা সে আরজুর জন্য কিনেছিল।শুভ অবাক হয়ে শোভার দিকে তাকালো। শোভা ভাইয়ের অবস্থা দেখে মুচকি হাসলো।তার মানে এই বিচ্ছু মেয়ে নিশ্চই এই রিং পেয়ে আম্মুকে দেখিয়েছে।তাইতো আম্মু এমন অস্থির হয়ে প্রস্তাব দিয়েছেন।

এই রিং দেখে অবাক হয়ে রিমি শুভর দিকে তাকালো।শুভর সাথে দৃষ্টি বিনিময় হতেই শুভ মুচকি হাসলো।আর এই হাসিতেই রিমির মনে ঝড় শুরু হলো।তার মানে শুভ আরজুকে ভালোবাসে?আর আরজুর জন্যই আই রিং কিনেছিল।

শুভর মা শুভকে দ্রুত তারা দিতে লাগলো রিং পরিয়ে দেয়ার জন্য।শুভর মনের মাঝে কোথাও না কোথাও সুখ অনুভব হচ্ছে। আরজুকে পাওয়ার সুখ।পরিস্থিতির কাছে শুভ নিরুপায় হয়ে পড়ল।মায়ের তারায় রিং নিয়ে আরজুর হাতে পরিয়ে দেয়ার জন্য আগালো।

সেই সময় আরজুর মনে টর্নেডো চলছে।কি করবে কিছুই বুঝতে পারছেন না।সত্যি বলার সাহস যোগায় করতে পারছে না।তাছাড়া এই সবের জন্য যদি শুভ আর তার বন্ধুত্বে ফাটল তৈরি হয় তবে সেটা কিছুতেই মানতে পারবে না।শুধু মনে মনে ভাবলো এমনটা কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না।অনেক কষ্টে মনে সাহস যুগিয়ে আরজু চোখ বুজে এক নিঃশ্বাসে বলে উঠলো

-” এই বিয়ে আমি করতে পারবো না।কারণ আমি অলরেডি মেরিড।”

আরজুর এক কথায় সাড়া বাড়ি জুড়ে নিস্তব্দতা ছেয়ে গেলো।

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_39

পড়ন্ত বিকেলে পশ্চিম আকাশে যেমন রক্তের নেয় লালিমা ভেসে উঠে ঠিক,ঠিক তেমনভাবেই শুভর দুচোখ লালচে হয়ে আছে।যেকোন মুহূর্তে দুচোখ বেয়ে রক্তধারা ঝরে পড়তে পারে।শুভর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আরজু কি কোনো মজা করছে? এমন জোক্স এর জন্য আরজুর চুল টানা খাওয়া মাস্ট।শুভ নিজের মনকে নানা ভাবে বুঝাতে চেষ্টা করলো।কিন্তু আরজুরকে নিগৃঢ় ভাবে পর্যবেক্ষণ করে শুভর বুকে তীব্র ক্ষত সৃষ্টি হলো।তবেকি এতো বছরের লালিত স্বপ্ন ধুলোয় মিশিয়ে যাচ্ছে? বুকের ভিতর জন্মানো অনুভূতি সবটাই কি মূল্যহীন?সত্যি কি আরজুকে হারিয়ে ফেললো?

অবনি আর জারা কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারছে না।আরজু কি বিয়েটা ভাঙ্গার জন্য মিথ্যা কথা বলছে?নাকি সত্যি এমন ভয়ানক কাণ্ড ঘটিয়ে বসে আছে?করলেও কাকে করছে? নেতা সাহেব,নেতা সাহেব করে পাগল হয়ে যায়।অথচ অন্য কাউকে সোজা বিয়ে করে বসে আছে।এই নাকি প্রেম?

অন্যদিকে সাবা খানম রাশভারী শব্দে বলে উঠলো
-” আরজু এটা ফাজলামি করার সময় না।”

আরজু করুন ভাবে সাবা খানমের দিকে তাকালো।দু চোখে টলমল করা অশ্রু তার কোমল কপোল বেয়ে ঝড় পড়লো।সাবা খানমের বুক ধক ধক করতে লাগলো। এর পর আরজুকে কি প্রশ্ন কি করা উচিত কিছুই বুঝতে পারছেন না।কোনো প্রশ্ন করতে ভয় হচ্ছে।মনে হচ্ছে পরবর্তীতে আরো ভয়ানক কিছু শুনতে হবে।

শুভর মা বাবা দুজনেই হতবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকাচ্ছেন।এটা যদি সত্যি হয় তবে তার ছেলেটা নিঃশেষ হয়ে যাবে।বাবা মা হয়ে সন্তানের কষ্ট কি করে সহ্য করবে?সেই ছোটবেলা থেকে ছেলেটা আরজুকে পাগলের মত ভালোবেসে এসেছে।আরজুর বিষয়ে ভীষণ সেনসিটিভ।তবে এতো বড়ো সত্যি কি করে মেনে নিবে?

জুবায়ের আহমেদ হতবম্ব হয়ে আরজুকে দেখছিলেন।এই মিষ্টি,সরল মেয়েটা এমন কিছু করতে পারে তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না।তাই মনে জাগা প্রশ্ন আরজুর দিকে ছুঁড়ে দিলেন।

-“আরজু যা বলছিস তা কি সত্যি? মজা করে এসব বলছিস না তো?”

আরজু শুকনো ঢোক গিললো।কেমন ভয় ভয় লাগছে। এখানে উপস্থিত প্রত্যেকটি মানুষ তাকে ভীষণ ভালোবাসে। অথচ আজ তার কারণেই প্রতিটা মানুষ চিন্তিত।সত্য জানলে সবাই কি তাকে দূরে ঠেলে দিবে?কিন্তু সে তো ভালোবাসার কাঙাল।সবার ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ছিল এতো দিন।তবে হঠাৎ সবাই তার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে নাতো?আরজুকে চুপ থাকতে দেখে জুবায়ের আহমেদ পুনরায় নরম সুরে বললেন

-“কথা বলছিস না কেন? এসব কি সত্যি?”

আরজু মাথা ঝাকিয়ে সম্মতি প্রকাশ করলো।শুভ তখন এক দৃষ্টিতে রিংটির দিকে তাকিয়ে ছিল।আংটিটা কেমন চক চক করছে।কিন্তু তার মনটা মুগুর্তেই কয়েকশত খন্ডে বিভক্ত হয়ে গেছে।চারপাশে শুধু অন্ধকার ছেয়ে আছে।শোভা ভাইয়ের পাশেই দাড়িয়ে ছিলো।ভাইয়ের অবস্থা দেখে তার অন্তর কেঁদে উঠছে।কি করে থাকবে তার ভাই।সীমাহীন ভালোবাসার মানুষটির মুহূর্তেই হারিয়ে গেলে আদো স্বাভাবিক ভাবে বাঁচা যায়?”

সাবা খানম থমথমে সরে বললেন
-” ছেলেটা কে? কাকে বিয়ে করেছিস?কেউ তোর জীবনে আছে আমাকে বলিসনি কেনো?”

আরজুর গলা যেনো আরো শুকিয়ে গেছে।গলা দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না।ঠিক তখনই তার সামনে দৌড়ে আসলো তারা।হাতে গ্লাস ভর্তি পানি।পানি পেয়ে আরজু যেনো প্রাণ ফিরে পেলো।মনে মনে তারার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো।মেয়েটা তার ভীষণ খেয়াল রাখে।আরজুর প্রতি তারার বিশেষ দুর্বলতা আছে।শত অন্যায় করলেও তারা আরজুর পাশে থাকে।

অন্যদিকে তারা আড়চোখে শুভর দিকে তাকালো।এই ছেলেটাকে তারার মোটেও পছন্দ না। আজও যখন সকালে বড়ো খালা বললো আরজুর বিয়ে শুভর সাথে ঠিক করছেন তখনও তারা অসন্তুষ্ট ছিলো।কিন্তু এই মুহূর্তে তার মাথা নিচু করে শান্ত ভাববে বসে থাকা ছেলেটার জন্য ভীষণ মায়া কাজ করছে।শুভর চোখে আরজুর জন্য অসম্ভব রকমের আসক্তি দেখেছে তারা।আরজুর জন্য শুভর ভালোবাসা যে নিখাদ ছিলো সেটা তারা আজ বেশ করে বুঝতে পারছে।
সাবা খানম এবার রেগে চেঁচিয়ে বললেন

-” ছেলেটা কে আরজু?”

সাবা খানমের ধমকে আরজু সহ সকলেই কেপে উঠলো।আরজু মনে মনে আল্লাহ আল্লাহ করছে।কারণ খালা মনি যেই প্রফেশন আর যেই মানুটিকে ভীষণ অপছন্দ করে সেই প্রফেশনের ঠিক সেই মানুষটিকেই বিয়ে করে বসে আছে।আরজু ভীষণ ভয় নিয়ে আমতা আমতা করে বললো

-“না..ন.. নাহিদ!!! নি… নিবরাস নাহিদ।”

বিয়ের কথা শুনে সবাই যতোটা না শক হয়েছে তার চাইতে কয়েক গুন বেশি শক খেয়েছে নাহিদের নাম শুনে।আরজুর কথা শুনে সাবা খানম থমকে গেলেন।ধপ করে দাড়ানো থেকে সোফায় বসে পড়লেন।শরীরে একদম জোর পাচ্ছেন না।দু চোখে সব ঘোলাটে দেখছেন।জুবায়ের আহমেদ দ্রুত সাবা খানমকে জড়িয়ে ধরলেন।সাবা খানম তখন স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। জুবায়ের আহমেদের মাথায় চিন্তা ভর করছে।সাবাকে কি করে সান্ত্বনা দেবে?

আরজুর কথায় শুভ মাথা তুলে আরজুর দিকে তাকালো।আরজু তখন শুভর দিকে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।যেই দৃষ্টির মানে আজ শুভ পড়তে পারলো না।কারণ আজ মনে হচ্ছে আরজু তার কাছে অনেকটা অচেনা।আরজুকে এখনো শুভ বুজে উঠতে পারেনি।আরজুর বিশ্বাস অর্জন করতে পারে নি।নাহলে জীবনের এতো বড়ো সিদ্বান্ত নিয়ে শুভর কাছে অন্তত গোপন রাখতো না।

শুভর বাবা মা প্রথমে নাহিদ কে সেটা বুঝতে না পারলেও পরবর্তীতে তাদের চোখ ছানাবড়া হয়ে পড়ল।আরজু এই সিটির মেয়র কে বিয়ে করেছে?শুভর মায়ের মনে আরজুর জন্য ঘৃনা, রাগ জন্মালো।শেষ পর্যন্ত আরজু প্রতিপত্তি আর অর্থের কাছে হেরে গেলো।তার ছেলের পবিত্র ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে উচ্চবিত্ত,প্রভাবশালী ব্যক্তির প্রতি ঝুঁকে পড়ল।অর্থ মানুষকে সত্যিই অন্ধ করে দেয়।আরজুর মতো রূপবতী মেয়েরাই রূপ লাবণ্যের জোরে বিত্তশালীদের কুপোকাত করে ফেলে।আরজুকে অন্তত তেমন মেয়ে ভাবেননি।কিন্তু আরজু?

ফুয়াদ মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।সামনের সময় গুলো যে আরো খারাপ কিছু নিয়ে আসছে সেটা ভালই অনুধাবন করতে পড়ছে।সে জানতো আরজু নাহিদ স্যারের প্রতি দূর্বল।তবে এতটা আকৃষ্ট হয়ে পড়বে ধারণা করতে পারেনি।

আরজুর বিস্ফোরণ মূলক কথা শুনে জারা আর সাবিহার গলা শুকিয়ে গেলো।জারার মাথা ঘুরছে।এইসব কি করে সম্ভব।যেই মেয়ে মেয়রের সামনে দাড়িয়ে ঠিক মত কথা বলার সাহস পায়না সেই মেয়ে কিনা বিয়ে করে ফেলেছে? এই অসাধ্য কি করে সাধন হলো জানার জন্য মন অস্থির হয়ে উঠলো।কিন্তু সে সাথে এক আকাশ অভিমান জমা হলো।আরজু নাহিদের বিষয়ের ওর কাছে সব শেয়ার করে তবে এত ভয়ংকর সত্য কেনো গোপন করলো?

_________________________
নাহিদ প্রতিদিনের মতোই অফিসের কাজে ব্যাস্ত।সকাল থেকে দাদিজান কল করছেন।তার শরীরটা একটু খারাপ যাচ্ছে।তাই নাহিদকে দেখতে চায়।নাহিদ কখনোই ওই বাড়িতে যেয়ে চায়না।কিন্তু দাদী আর ছোটবোন জেরিনের জন্য যেতে হয়।নাহিদ যখন কাজে একদম ডুবে ছিলো তখনই তার অ্যাসিস্টেন্ট আসিফ হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকলো।নাহিদ বিরক্তি প্রকাশ করলো।আসিফ কাচুমাচু হয়ে বললো

-” স্যার দুজন লোক এসেছেন আপনার সাথে দেখা করতে।”

-” এপয়েন্টমেন্ট আছে?”

-“জি না স্যার।আসলে…”

নাহিদ গম্ভীর স্বরে বললো
-“কি বলবে ক্লিয়ার করে বলো আসিফ।”

এবার আসিফ থমথমে সরে বললো
-” স্যার এডভোকেট সাবা খানম এবং তার হাজবেন্ড জুবায়ের আহমেদ এসেছেন।”

নাহিদ অবাক হয়ে আসিফের দিকে তাকালো।আসিফ জানে সাবা খানমের সাথে তার স্যারের সম্পর্ক খুব একটা ভালো না।অফিসিয়াল কাজে কেসের ক্ষেত্রে দুই একবার তাদের সাথে আদালতে মুখোমুখি হয়েছে।আসিফ খেয়াল করেছেন ভদ্র মহিলা তার স্যারকে ভীষণ অপছন্দ করে।আর আজ উনি হঠাৎ অফিসে এসেছেন।

নাহিদ তাদের দ্রুতই ভেতরে নিয়ে আসতে বললো।নাহিদ বেশ চিন্তায় পড়ে গেলো।সাবা খানম কখনই তার অফিসে আসেনা।তবে আজ হঠাৎ এই আগমনে কারণ কি হতে পারে?আরজুকে নিয়ে কোনো সমস্যা হয়েছে?আরজুর সাথে তার প্রায় তিন চারদিন যাবত কোনো যোগাযোগ নেই।কোনো সমস্যা হলো কিনা কে জানে?

ঠিক তখনই হুড়মুড় করে সাবা খানম ও জুবায়ের আহমেদ ভেতরে প্রবেশ করলেন।নাহিদ তাৎক্ষণিক দাড়িয়ে সৌজন্যমূলক হেসে বললো
-“আসসালামু আলাইকুম ম্যাম।”

সাবা খানম বা জুবায়ের আহমেদ কেউই কোন জবাব দিলেন না। বরং নাহিদের দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছেন। নাহিদ খানিকটা চিন্তিত হয়ে পড়ল। পরিবেশ নরমাল করতে নাহিদ বলে উঠলো

-“আপনি হঠাৎ এখানে। হাউ ক্যান আই হেল্প ম্যাম।”

সাবা খানম ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে নাহিদের দিকে এগিয়ে গেল। আর সাথে সাথেই নাহিদের বাম গালে সজোরে চড় বসিয়ে দিল।সাবা খানমের কাজে নাহিদ আর জুবায়ের আহমেদ দুজনেই হতবম্ব হয়ে পড়ল। এমন কিছু হবে সেটা কেউ আশা করেনি।মুহূর্তেই নাহিদের চোখ মুখ লাল হয়ে আসলো। রাগে,অপমানে নাকি কষ্টে ঠিক ঠাহর করতে পারল না।জুবায়ের আহমেদ ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন।সাবা যখন ভীষণ রেগে বাসা থেকে বের হচ্ছিলেন তখনই তিনি বুজেছেন তার স্ত্রী এই জায়গায়ই আসবে। সাবার রাগ সম্পর্কে তার বেশ ধারণা আছে।তাই তিনি নিজে সাথে করে নিয়ে এসেছে।সারা রাস্তা বুজিয়ে এসেছেন স্বাভাবিক ভাবে তারা নাহিদের সাথে কথা বলবে।উত্তেজিত হবে না।কিন্তু সাবা এসেই যা কান্ড ঘটালো।

নাহিদ একজন প্রভাবশালী নেতা।তার গায়ে এই ভাবে হাত তোলা একদম ঠিক হয়নি।একে যুবকদের রক্ত গরম থাকে।নাহিদের পূর্বের রেকর্ড বলে নাহিদ ভীষণ জেদি,রাগী একটা ছেলে।তাছাড়া বর্তমানে ছেলেটার হাতে অনেক ক্ষমতা।যদি রেগে সাবা বা তার পরিবারের কোনো ক্ষতি করে বসে।আরজুর কোনো ক্ষতি করে?

তাই জুবায়ের আহমেদ দ্রুত সাবা খানমকে টেনে পিছনে টেনে আনলেন।কিন্তু সাবা খানম দমে যাওয়ার মানুষ নয়।তিনি প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে নাহিদের উদ্দেশে বললেন

-“তোমার সাহস কি করে হলো আমার আরজুর লাইফ নিয়ে খেলার। হাউ ডিয়ার ইউ?”

নাহিদ কিছুই বললো না।সাবা খানম আবার রেগে বললেন
-“আরজুর সরলতার সুযোগ নিয়েছো তাই না? আমার আরজুর কাছ থেকে তোমাকে দূরে থাকতে বলেছিলাম। আর তুমি কি করলে?”

জুবায়ের আহমেদ স্ত্রীকে থামানো চেষ্টা করে বললেন
-” সাবা প্লিজ শান্ত হও।”

-“কি করে শান্ত হবো আমি? এই মানুষটা আমাদের সবার জীবনে কালো ছায়া হয়ে জড়িয়ে আছে।”

তারপর নাহিদের দিকে এগিয়ে বললেন
-“তুমি কি ভেবেছো? আরজুকে বিয়ে করলেই তোমার হয়ে যাবে। তাহলে বলবো ভুল ধারণা করছো। কারণ তোমার সম্পর্কে জানলে মেয়েটা কখনোই তোমাকে নিজের লাইফে রাখবেন না।নিজের অতীতকে এতো সহজে ভুলে গেলে?তোমার মতো ছেলে আমার মেয়ের যোগ্য না।আরজুকে এখনো ভালো করে চিনতে পারোনি। মেয়েটার আবেগ দেখেছো কিন্তু কঠোরতা দেখনি। তোমার মতন মানুষের সাথে আমার মেয়েটা কখনোই থাকবে না।

কয়েক বছর আগে তোমার দাদাজান যখন বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন তখনই আমি মানা করে দিয়েছি।আমি ধারণা করেছি তোমাদের মধ্যে এতটুকু আত্মসম্মান বোধ আছে।কিন্তু আজ আমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত হলো।তোমাদের মত নেতারা সব জায়গায় ক্ষমতার জোর দেখায়।আর যেখানে ক্ষমতা চলেনা সেখানে কৌশল অবলম্বন করে।বড়োলোকের বিগড়ে যাওয়া সন্তানরা যখন যা আবদার করে তার পরিবার তাদের সামনে মুহূর্তেই তা হাজির করে দেয়।তোমার ক্ষেত্রেও তাই।যখন আমার মেয়েটাকে চেয়েও পেলে না তখন তোমার মনে আরজুকে পাওয়ার জেদ চেপে ধরেছে।তাইতো আমার মেয়েটার ইমোশনের সুযোগ নিয়ে নিজের উদ্দেশ্য সফল করলে।বাহ! এই ধরনের মানুষরাই আবার দেশের প্রতিনিধিত্ব করে বেড়ায়। রিডিকুলাস!!”

নাহিদের দু চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।সে তো চেয়েছে আরজুর কাছথেকে দূরত্ব বজায় রাখতে।নিজের মন মস্তিষ্ককে সাথে অনেক যুদ্ধ করেছে।কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেনি।

সাবা খানম রেগে চলে যেতে উদ্যত হলে নাহিদ বলে উঠলো
-” আরজু কখনোই আমার জেদ ছিলো না ম্যাম।সেই প্রথম দেখা থেকেই আরজু আমার ভালোবাসা ছিলো।”

সাবা খানম কঠিন চোখে নাহিদের দিকে তাকালেন।বললেন
-” তোমার মত মানুষের ভালোবাসা আরজুর জীবনে মূল্যহীন।”

কথাটা বলেই তিনি বেরিয়ে গেলেন। জুবায়ের আহমেদ একবার ভালো করে নাহিদের দিকে তাকালেন। অসম্ভব সুদর্শন ছেলেটার মুখে রয়েছে রাজ্যের মায়া। কিন্তু এই মায়া পড়া আরজুর জন্য ক্ষতিকারক। আরজু একটা স্বাভাবিক জীবন ডিজার্ভ করে। নাহিদের সাথে কখনো সে স্বাভাবিক জীবন লিড করতে পারবেনা। এর প্রথম কারণ নাহিদের লাইফ স্টাইল। আর দ্বিতীয়ত নাহিদের অতীতে করা কিছু কাজ।

নাহিদের দিকে একবার দেখে জুবায়ের আহমেদ বেরিয়ে পড়লেন।নাহিদ ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো। চোখের কোণাবে এক ফোঁটা নোনা জল গড়িয়ে পড়লো।তার জীবনটা এতো জটিলতার ঘেরা কেনো?তার কি সুখে থাকার কোন অধিকার নেই? ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে বাঁচার কি কোন সুযোগ নেই?

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_40

ক্যাম্পাসের মাঠে বসে আছে আরজু,জারা,সাবিহা আর রামিম।বরাবই এই বন্ধুমহল যে জায়গায় বসে সেই জায়গা উত্তপ্ত করে তুলে।আড্ডা,হাসাহাসি,মারামারি লেগেই থাকে।তাদের হাসির খিল খিল শব্দে মুখরিত হয়ে উঠে চারপাশ।কিন্তু আজ পরিবেশ বেশ ঠাণ্ডা।চারদিকে নিরবতা ছেয়ে আছে।এই গ্রুপের সবচাইতে চটপটে, অশান্ত মেয়েটি মুখ ঘুরিয়ে অভিমান নিয়ে বসে আছে।আরজু চুপচাপ বসে ঘাসে নখ খোঁচাচ্ছে আর জারার ফুলানো মুখশ্রী পর্যবেক্ষণ করছে।মেয়েটা তার সাথে ভীষণ অভিমান করেছে।এই বাচাল পক পক না করলে কারোরই ভালো লাগে না।আরজু জারাকে খোঁচাচ্ছে।জারা বিরক্ত হয়ে রামিমের উদ্দেশে বললো

-” রামিম এই ফালতু বেটিকে আমার সামনে থেকে দূরে নিয়ে যা।নাহলে সিরিয়াস লাত্থি খাবে।”

আরজু দাতে দাঁত চেপে বললো
-” থাক!! গাল ফুলিয়ে বসে থাক।শুভর মতো তুইও মুখটা বেলুনের মতো ফুলিয়ে রাখ।ওই কুত্তাটা রাত থেকে আমার কল রিসিভ করছে না।মাথা এমনি খারাপ হয়ে আছে।তার উপর তোর কাহিনী জাস্ট নিতে পারছি না আমি।”

বলেই আরজু মাথার চুল খামচে ধরলো।মাথাটা যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে।সারা রাত তার ঘুম হয়নি।আরজুর ভাঙ্গা গলা শুনে জারা আরজুর দিকে তাকালো।আরজুর টলমল চোখের দিকে তাকাতেই নিজের সব রাগ,অভিমান নিমিষেই হাওয়া হয়ে গেলো।সে আরজুর মনের অবস্থা অনুধাবন করতে পারলো।

তখনই সাবিহা আরজুর মাথা বুকে চেপে ধরলো।মাথায় পরম যত্নে হাত বুলিয়ে বললো

-“বোকা মেয়ে তুই কাদছিস কেনো?”

আরজু ফুপিয়ে উঠলো।মনটা তার বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে।রাত থেকে খালামণি তার সাথে একটা কথাও বলেনি।রুমের দরজা বন্ধ করে বসে আছে।মাঝে একবার হন্ত দন্ত হয়ে বাইরে বেরিয়েছিল।সেখান থেকে ফিরেই দরজা বন্ধ করে রেখেছে।খালুজান নিজেও আরজুর সাথে তেমন কথা বলেনি।শুধু সকালে জোর করে হতে তুলে নাস্তা খাইয়ে দিয়েছিলো।আরজু অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে দেখেছিল সব কিছু।তার এতো বড়ো অঘটন ঘটানোর পরও খালুজান ঠিক তার খেয়াল রাখছে।একদম তার বাবার মতো।

ছোটবেলায় আরজু কোনো কারণে ভুল করলে তার বাবাও কথা না বলে শুধু চুপ চাপ খাইয়ে দিতো।বাবার কথা না বলাই আরজুর জন্য পাহাড় সমান শাস্তি ছিলো।খালুজান ঠিক তেমন কথা বলছেন না।অবনি নিজেও তাকে তেমন কিছুই জিজ্ঞেস করেনি।রাতে একবার আরজুর রুমে এসে একটা চিরকুট আরজুর হাতে গুজে দিয়েই পালিয়েছে।আরজু ভেজা চোখে দেখলো গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ছিল

-” ইস্ট ওর ওয়েস্ট,নাহিদ জিজুই বেস্ট।
বাকি সব গোল্লায় ভাসুক,আমার জিজু জলদি আসুক।”

চিরকুট পড়ে আরজু হাবলার মতো তাকিয়ে ছিলো।তারা ঠিক বলে অবনির মাথার স্ক্রু তার চাইতেও বেশি ঢিলা।আরজু আধা পাগল হলে ওইটা পুরো পাগল।

রাতে আরজু নাহিদের নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করে।কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি।নম্বর বন্ধ বলছে।আরজু তখন ভীষণ ভাবে ভেঙে পরে।বুকের ভেতর হু হু করে উঠে।এই সময়টায় আরজু চোখ বন্ধ করে শুধু একটা নাম মনে করছিল।সেটা হলো শুভ।তার সকল খারাপ সময় এই মানুষটাই নিঃস্বার্থভাবে তার পাশে থাকে।কিন্তু আজ শুভ তার দিকে যেই অভিমানী দৃষ্টিতে তাকিয়েছে তাতে আরজুর বুকে তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়েছে।শুভ কি তার উপর অভিমান করে কথা বলা বন্ধ করে দিবে?কিন্তু আরজু তো নিরুপায় ছিলো।সবটা শুভকে বলতে চেয়েও পারেনি।শুভ তাকে ধরে দুইটা থাপ্পর মারুক তবুও এই ভাবে অভিমান করে না থাকুক।

সবার ভালোবাসায় সিক্ত থাকা মেয়েটা এতো এতো অভিমান টলারেট করতে পারছে না।এমন পরিস্থিতিতে বাসায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল।তাই ভার্সিটির চলে এসেছে।ভেবেছে শুভর সাথে দেখা হবে।কিন্তু শুভ আজ আসেই নি।বাকি সবাই তার সাথে অভিমান করে বসে আছে।কি করবে আরজু?
জারা আরজুর দিকে এগিয়ে এসে বসলো।বললো

-” আরজু কান্না থামা। আমারও কিন্তু কান্না আসছে।ওকে সরি।আর রাগ দেখাবো না।”

আরজু সাবিহার বুক থেকে মাথা তুলে জারার দিকে তাকালো।জারা দেখলো আরজুর দু চোখ লালচে হয়ে আছে।জারা আরজুর চোখের পানি নিজ দায়িত্বে মুছে দিল।

পাশেই রামিম এদের কাহিনী দেখে মুচকি হাসলো।বন্ধুত্বের এই সম্পর্ক গুলো এমন মজবুত থাকুক।কিন্তু ভেতরে ভেতরে অনেক চিন্তারাই ভর করেছে।বন্ধু মহলের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এই ঝড় সম্পর্কের ঠিক কতটুকু ক্ষতি সাধন করছে সেটা ঝড় থামার পর বুঝতে পারা যাবে।শুভ এই সব বিষয় কি করে হ্যান্ডেল করবে কে জানে?শুভ যে আরজুকে গভীর ভাবে ভালবাসে সেটা অনেক আগেই বুঝতে পেরেছে।রামিম আড়চোখে সাবিহার দিকে তাকালো।সাবিহা মলিন চোখে রামিমের দিকেই দৃষ্টিপাত করে আছে।রামিম দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।কারণ শুভর আরজুর প্রতি গভীর প্রণয় নিয়ে সাবিহাই রামিমকে প্রথম অবগত করেছে।রামিম প্রথমে অবাক হলেও পরে বিষয়টা একদম স্বাভাবিক মনে হয়েছে।আরজুর প্রতি শুভর এতো কেয়ার, পজেসিভনেস,অল্পতেই অস্থিরতা সবটাই শুভর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।যেটা আরজু ধরতে পারেনি।সাবিহা বিষয়টা অনেক আগেই বুঝতে পেরেছে।কিন্তু আরজুর দুরন্তপনার জন্য কখনোই কিছু বলেনি।ভেবেছে শুভই হয়তো ঘটা করে আরজুকে একদিন জানাবে।কিন্তু সেই দিনটা আসার আগেই সব লন্ডভন্ড হয়ে গেলো।
________________________
সকাল সকাল ফুয়াদ শুভদের বাসায় এসে পৌঁছালো।রাতে অনেকটা সময় শুভর সাথেই ছিলো।শুভ আরজু দের বাসা থেকে বেরিয়ে আর একটা কথাও বলেনি।ফুয়াদ অনেকক্ষন কথা বলার চেষ্টা করেছে।কিন্তু শুভ রোবটের নেয় বসে ছিলো।যেনো অনুভূতি শূন্য হয়ে পড়েছে।ফুয়াদ শুভকে নানা ভাবে বুঝানোর চেষ্টা করছিল।শুভ শুধু একটা কথাই বলেছে

-” আমাকে একটু একা থাকতে দে ফুয়াদ।”

ফুয়াদ প্রথমে মোটেও রাজি হয়নি।কিন্তু পরে ভাবলো হয়তো এই সময় একটু স্পেসের আসলেই ভীষণ প্রয়োজন।তাই রাতে বাসায় ফিরে গেছে।কিন্তু সারা রাত শুভর কথা ভেবেছে।হাজারো বাজে চিন্তা মাথায় এসেছে।যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে?তাই দ্রুত নাস্তা না করেই বেরিয়ে পড়েছে।লামিয়া অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে নাস্তা কেনো করবে না।শরীর অসুস্থ কিনা?কিন্তু ফুয়াদ তেমন কিছুই বলেনি।দ্রুত বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছে।
শুভর বাসায় আসতেই শোভা বললো

-” ভাইয়া রাত থেকে রুমের বাইরে বের হয়নি।আমি অনেক ডাকাডাকি করাতে এক ধমক দিলো।ভয়ে আর আমি যাইনি।আপনি একটু দেখুন না ভাইয়া।”

ফুয়াদ শোভাকে আশ্বস্ত করে ফুয়াদের রুমের দিকে এগুলো।শোভার কাছথেকে চাবি নিয়ে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো।অন্ধকারাচ্ছন্ন রুমটিতে কোথায় কি আছে ফুয়াদ ঠিক ঠাহর করতে পারলো না।আন্দাজ মতো সুইচ খুঁজে রুমটিতে কৃতিম আলো জ্বালালো।সারা রুম ধোয়াচ্ছন্ন হয়ে আছে। শুভ বিছানা ঘেঁসে ফ্লোরে দুপা ছড়িয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। গায়ে এখনো গত রাতের পাঞ্জাবি।যা দুমড়ে মুচড়ে আছে।আর ফ্লোরের চারপাশে সিগারেটে অর্ধাংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।ফুয়াদ কপাল কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে রইলো।শুভ,রামিম আর সে সকলেই মোটামুটি স্মোকিং করে থাকে।কিন্তু কখনোই তারা বাসায় স্মোকিং করেনা।বাইরে বিভিন্ন চায়ের দোকানে দাড়িয়ে চা খেতে খেতে মাঝে মাঝে সুখটান দেয়।কিন্তু শুভ আজ বাসায় বসেই এতগুলো সিগারেট টেনেছে ভাবতেই গা শিউরে উঠলো।অতিরিক্ত ধোঁয়ার কারণে অলরেডি ফুয়াদের কাসি উঠে গেলো।কয়েকবার কেশে হাত দিয়ে ধোয়া সরানোর বৃথা চেষ্টা করলো ফুয়াদ।দ্রুত রুমের ভারী পর্দা সরিয়ে জানালা মেলে দিলো।ফলে মুহূর্তেই রুমটিতে সূর্যের কিরণ এসে নিজের আলো ছড়িয়ে দিল সর্বত্র।
ফুয়াদ শুভর পাশে গা ঘেসে বসে পড়লো।আর কৌতুক সুরে বললো

-” আরো দুই একটা আছে নাকি? থাকলে আমাকেও দে।ঘরে বসে সুখটান দিতে কেমন লাগে এক্সপেরিয়েন্স করি।”

কিন্তু শুভর কাছথেকে তেমন কোনো রেসপন্স পেলো না।ফুয়াদ শুভর দিকে এবার ঝুঁকে বসলো।আর সাথে সাথে আঁতকে উঠল।মাথা ভর্তি সিল্কি চুল গুলো পাগলের ন্যায় এলোমেলো হয়ে আছে। শুভর ফর্সা মুখশ্রী রক্তিম আকার ধারণ করেছে। চোখ জোড়া অসম্ভব লাল।সারা রাত না ঘুমিয়ে স্মোকিং করার কারণে চোখের নিচে কালো হয়ে আছে।ফুয়াদ খেয়াল করলো শুভর ঠোঁট কয়েক জায়গায় কালচে হয়ে গেছে।তার মানে সিগারেট টানতে যেয়ে ঠোঁট পুড়িয়ে ফেলেছে।শুভর এই বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে ফুয়াদের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।সর্বদা হাস্যোজ্জল, চঞ্চল ছেলেটার এ কি বেহাল দশা।ফুয়াদের এই মুহূর্তে আরজুর উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে।আরজুকে ভীষণ স্বার্থপর মনে হচ্ছে।কি করে এই ছেলেটার কোমল হৃদয়কে ভেঙে চুরে দিলো।আরজুর জন্য এই ছেলেটা ঠিক কতটা ডেসপারেট সেটা আরজু কেনো বুঝতে পারলো না।সুন্দরী মেয়ে গুলোকে কেনো এমন মাথা মোটা হতে হবে?

ফুয়াদ শুভর ফ্লোরে পড়ে থাকা দুর্বল হাতে নিজের হাত ছুঁয়ে বললো

-“জানিস ভালোবাসার মতো পবিত্র আর নির্মল এই পৃথিবীতে আর কিছুই নেই।আমরা মানুষরা অন্য একজন বিশেষ মানুষকে গভীর ভাবে অনুভব করতে পারি।যেটা অন্য প্রজাতির প্রাণী পারেনা।মনের কাছে আমরা অনেকটা ধরা বাধা।তবে সব কিছুর উর্ধ্বে মহান সৃষ্টকর্তা।নাহলে এই পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের ভিড়ে নির্দিষ্ট কাউকে কেনো ভালোবেসে ফেলি?তাকে ছাড়া ভেঙে পড়ি?”

ফুয়াদ থেমে গেলো।কথাগুলো কেমন খাপছাড়া হয়ে গেছে।তার এই ধরনের কথায় শুভর যন্ত্রণা বাড়বে বৈকি কমবে না।সে ভুল ট্রেকে চলে যাচ্ছে। না!!এডভাইস দেওয়া তার পক্ষে আসলেই সম্ভব না!!আসলে শুভকে কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না।এতো গুলো রিলেশনে জড়িয়েও আজ মনে হচ্ছে প্রেম সম্পর্কে সে ভীষণ আনাড়ি।তাই নিজের দুর্বল জ্ঞান ভান্ডার ক্লোজ করে বললো

-” তুই ঠিক আছিস?”

শুভ নরম গলায় বললো
-” আমি ঠিক থাকতে পারছি না ফুয়াদ।আমার মনে হচ্ছে কেই আমার দেহ থেকে হৃদপিণ্ড টাকে টেনে হিচড়ে বের করে ফেলেছে।যেখানে অঝোর ধারায় রক্তস্রোত বয়ে যাচ্ছে।কিন্তু কিছুতেই থামছে না।আমি দুর্বল হয়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি।”
ফুয়াদ দাত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলালো।এতো কষ্টের মাজেও শুভর কথায় কোনো খাপছাড়া ভাব নেই।তবে কি ভালোবাসলে প্রতিটা কষ্ট এতটাই গভীর ভাবে অনুভব করা যায়? ফুয়াদ খানিকটা নিরব থেকে বললো

-” নিজেকে সামলে নে।আরজু হয়তো তোর ভাগ্যে কখনোই ছিলো না।নাহলে তোর এতো ভালোবাসা উপেক্ষা করে আরজু অন্য কারো জন্য এতটা উতলা কেনো হলো?”

শুভ ভাঙ্গা গলায় বললো
-” ভাগ্য কি পরিবর্তন করা যায় না ফুয়াদ।কোনো ভাবে আমার আরজুকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেয়া যায়না?ওকে ছাড়া আমি একটা দিনও কল্পনা করতে পারি না।জানিস আমি মেডিকেলে চান্স পেয়েও ভর্তি হইনি।শুধু মাত্র আমার আরজুর জন্য।আরজুকে একা ছাড়ার ভয়ে।এই কথা আমি আম্মু আর শোভা ছাড়া কাউকে জানাইনি।আব্বুকে পর্যন্ত না।আরজুর সাথে এই ভার্সিটিতে এক ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হয়েছি। শুধু মাত্র আমার প্রেয়সীর জন্য।তার পাশে ছায়ার মত থাকার জন্য।তাকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য।

জানিস স্কুল লাইফে আরজু স্বাধীন ভাবে এলাকায় চলতে পারতো না।ওর মতো রূপবতী মেয়ের পেছনে মাছির মতো ছেলেরা ঘুরত।অনেক সময় সিনিওর ভাইরা আরজুকে রাস্তা ঘাটে প্রপোজ করে বসত।আমার ভীতু আরজু তখন ভয়ে চুপসে যেতো।আশেপাশে চোখ বুলিয়ে আমাকে খুঁজতো।আর আমি ওকে কখনোই একা ছাড়তাম না।একবার এলাকার এক বড়ো ভাই আরজুকে বিরক্ত করা শুরু করে।আমি বাধা দেয়ায় আমাকে প্রায় চার পাঁচজন মিলে বেধম মারে।কিন্তু সেদিন সেই মার আমাকে যন্ত্রণা দেয়নি।দিয়েছে আরজুর চোখের জল।আমি যখন রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়েছিলাম তখন সেই ছেলেটা আরজুর কাধে বাজে ভাবে স্পর্শ করছিলো।আমার আরজু ভয়ে থর থর করে কাপছিলো।আর বার বার আমার দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকাচ্ছিলো।সেই তাকানোতে ছিলো অসহায়ত্ব।সেদিন নিজেকে ভীষণ দুর্বল মনে হয়েছে।সেদিন আরজুর কিছু হলে আমি হয়তো সেখানেই মরে যেতাম।নিজের ভালোবাসাকে রক্ষা করতে না পারার কষ্টে আমার আসলেই মরে যেতে ইচ্ছে করছিলো।তবে আমি সেদিন কিছু করতে না পারলেও এলাকার কিছু ছেলেপেলে এসে তাদের অনেকে মেরেছিল।এতটাই মেরেছিলো যে সেই ছেলেটার হাত চিরদিনের জন্য অকেজো হয়ে গেছে।আমি সবটাই আবছা দেখছিলাম।আর আরজু ভয়ে আমার রক্তাক্ত দেহের পাশে বসে আমার মাথা কোলে নিয়ে কাদছিলো।আরজুর কোলে মাথা রেখে সেদিন আমি সব ব্যাথা,যন্ত্রণা মুহূর্তেই ভুলে গেছিলাম।”

শুভর দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।কিন্তু ঠোঁটে কিঞ্চিত হেসে বললো

-“তবে মজার বিষয় এর পর থেকে কোনোদিন কোনো ছেলে আরজুর কাছে ভিড়তে পারেনি। আমিও ছায়ার মত ওর পাশে থাকতাম।ওকে আগলে রাখতাম।আরজুর মলিন মুখ আমার মনের আকাশে ঘন কালো মেঘ জমিয়ে দিতো।সেই মুখে হাসি না ফোঁটা পর্যন্ত বুকে তীব্র ঝড় বয়ে যায়।ওর এতো কাছে থাকার পরও ও কেনো আমার অনুভূতি বুঝতে পারলো না বলতে পারিস?কেনো আমার ভালোবাসা অনুভব করলো না?আমি ওকে ছাড়া কি করে বাঁচবো বলতে পারিস?আমার কেমন দম বন্ধ হয়ে আসছে।আমার একান্ত মানুষটা হঠাৎ করে অন্য কারো হয়ে গেলো।আর আমি বুঝতেই পারলাম না।

আরজু যখনই ওই নেতার কথা উৎসাহ নিয়ে বলতো আমার মনে হতো কেউ ধাড়ালো তলোয়ার আমার বুকে চালিয়ে দিয়েছে।কি অসহ্য যন্ত্রণা হতো।কিন্তু নিজেকে সামলে নিতাম এইটা ভেবে যে,এসব আরজুর অ্যাট্রাকশন মাত্র।
আরজু আমার বুকে ছুরি চালিয়ে দিলেও এতো কষ্ট হতো না।কিন্তু এই ভাবে তিলে তিলে নিঃশেষ হওয়ার জন্য কেনো ফেলে গেলো?আমি যে নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।”

বলেই শুভ ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিতে লাগলো।শুভর বুক অস্বাভাবিক ভাবে উঠানামা করছে।একটা সময় ফুয়াদকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কাদতে লাগলো।ফুয়াদ হতবম্ব হয়ে বসে রইলো।এই প্রথম শুভকে এই ভাবে বাচ্চাদের মতো কাদতে দেখছে।কি অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে ছেলেটার সেটা অনুধাবন করতে পারলো।
_____________________
কেঁদে আরজু দুই চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। এখনো হিচকি তুলছে।জারা পরিবেশ শান্ত করতে মজার ছলে বলে উঠলো

-” এই অসাধ্য সাধন করলি কিভাবে? নাহিদ স্যারের মতো দাম্ভিক, গম্ভীর লোককে এমন কুপোকাত করলি কেমন করে? তুই তো উনার সামনে দাড়িয়ে ঠিক মত কথা বলতে পারিস না।সেখানে সোজা বিয়ে!!! কেমন কি?”

আরজু তাদের দিকে তাকিয়ে দেখলো তিন জোড়া চোখ তার দিকে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।আরজু শুকনো ঢোক গিলে ঘটনার বর্ণনা শুরু করলো।
আরজু মুখ থেকে সবটা শুনে তাদের ছানাবড়া অবস্থা।এমন দুঃসাহসী কাজ আরজ করেছে বলে বিশ্বাসই করতে পারছে না।আরজুর দ্বারা এটাও সম্ভব?জারা অবাক হয়ে বললো

-” কি!!!!! তুই এই সিটির মেয়র “নিবরাস নাহিদকে” ব্লাকমেইল করে বিয়ে করে ফেলেছিস?লাইক সিরিয়াসলি?সাবিহা আমি ঠিক শুনছি তো?”

সাবিহা কি বলবে? সে নিজেই এই শকের মধ্যে থেকে বের হতে পারছেনা।
আরজু আমতা আমতা করে বললো

-” আমার তখন কি হয়েছিল আমি নিজেও জানিনা।ওই শাড়ি পড়া মেয়েটাকে তার পাশে দেখে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছিলো।তার পাশে অন্য কাউকে চিন্তা করেও আমার বুক কেপে উঠে।”

আরজু জোরে নিঃশ্বাস ছাড়লো।আবার বলতে লাগলো

-“উনি কখনোই আমাকে পাত্তা দেয়নি।আমার প্রতি ইন্টারেস্ট দেখায়নি।আমাকে কোনো পজিটিভ ইঙ্গিত ও দেয়নি।তবুও আমি ওই মানুষটার প্রতি খুব বাজে ভাবে ঝুঁকে পড়েছি। জীবনে প্রথম কোনো পুরুষকে দেখে আমি থমকে গেছিলাম।উনার ব্যাক্তিত্বে ঘায়েল হয়েছিলাম।আমার জীবনে পুরুষদের মধ্যে শুভ,ফুয়াদ ,রামিম আছে।এদের মাঝে আমি নিজেকে ভীষণ সেফ ফিল করি।ওদের পাশে থাকলে ভীষণ ভালো সময় কাটাই।নিজের মনের কথা সহজেই ব্যাক্ত করতে পারি।বিশেষ করে শুভ।শুভকে দেখা ছাড়া আমার একটা দিনও ভালো লাগে না।ওর সাথে ঝগড়া করা ছাড়া আমার ঘুমই আসেনা।

কিন্তু কোনোদিন ওদের দেখে আমার এমন ফিল হয়নি।যেমনটা নেতা সাহেবকে দেখে হয়েছে।এই মানুষটার সামনে আমি স্বাভাবিক থাকতে পারি না। ভীষণ জড়তায় মুখ দিয়ে শব্দ উচ্চারণ করতে পারি না।অদ্ভুদ অস্থিরতা কাজ করে।সেদিন মনে হয়েছে ওই মানুষটিকে আজ নিজের মনের কথা না বললে আর সুযোগ পাবনা।নিজের মধ্যে অনেক সাহজ যুগিয়ে আমি তার মুখোমুখি হয়েছি। কিন্তু তার সামনে যেতেই হাত পা কাঁপছিল।জানিস উনি যখন আমার ভালোবাসাকে ক্ষণস্থায়ী আবেগ বলেছিলো আমার ভেতরটা শেষ হয়ে যাচ্ছিল।মনে হচ্ছিল এই মানুষটাকে আমার পেতেই হবে।আমার ভালোবাসাকে বুজাতেই হবে।ব্লাকমেইল করার কোনো ইন্টেনশন আমার ছিলো না।সেটা জাস্ট ফ্লো তে হয়ে গেছে।কিন্তু এই ভাবে বিয়ে করার ইচ্ছে আমার কখনোই ছিলো না।কিন্তু নেতা সাহেবকে হারিয়ে ফেলার ভয় আমার মনে ঝেঁকে বসেছিল।আমি আমার জীবনসঙ্গী হিসেবে তার জায়গায় অন্য কাউকে ভাবতেই পারিনা।”

এতক্ষণ মনযোগ সহকারে সবাই আরজুর বক্তব্য শুনছিলো।
জারা অবাক হয়ে বোকার মতো বলে উঠলো

-” তোরা বাসর সেরে ফেলেছিস?”

জারার বেফাঁস কথায় আরজু ভীষণ লজ্জা পেলো।সাবিহা অবস্থিত হয়ে এদিক সেদিক তাকাচ্ছিল।রামিম জারার মাথায় এক চাটি মেরে ধমকে বললো

-” চুপ কর বেকুব।”

বিষয়টা বুঝতে পেরে জারা জিবে কামড় দিয়ে ফেললো।কি সব বলে ফেললো।রামিম আরজুর কথায় একটা জিনিস হজম করতে পারলো না। নিবরাস নাহিদের মতো এতো পাওয়ারফুল নেতা আরজুর সামান্য ব্লাকমেইলে ভীত হয়ে বিয়ে করে নিলো।এটা কি আদো সম্ভব?

চলবে।