মিষ্টি রোদের হাতছানি পর্ব-৪১+৪২

0
1079

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_41

গুড়ুম গুড়ুম করে আকাশ ডেকে উঠলো।বৃষ্টির সাথে একঝাঁক দমকা হাওয়া ঢুকে পড়ল নীরব রুমে।প্রাকৃতিক বিদ্যুৎ খানিকক্ষণ পর পর অন্ধকার ধরণীতে আলোর সঞ্চার করছে।তীব্র ধ্বনিতে আরজুর শরীরটা বার বার কেপে উটছে।বিষণ্ণ মনে আকাশের দিকে তাকালো আরজু।বুকটা তীব্র যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।এমনটা আগে কখনোই অনুভব করেনি সে।ছোটবেলার কিছু স্মৃতি মনে পড়ছে।

আরজু তখন ক্লাস ফাইভে পড়তো।বাবা মা তখন বেচেঁ ছিলেন।বাবা মায়ের ভীষণ আদরে তার দিন কাটছিলো।তখন তাদের ক্লাসে একটা নতুন মেয়ে ভর্তি হয়েছিলো।শুভ সেই মেয়েটার সাথে খুব সহজেই মিশে গেছিলো।তারা একসাথে বসে সারা ক্লাস গল্পঃ করতে শুরু করলো।একসাথে ক্যান্টিনে যাওয়া,আড্ডা দেওয়া শুরু করলো।আরজুকে তেমন সময় দিচ্ছিলো না।আরজু শুভর এই পরিবর্তন কিছুতেই মানতে পারছিলো না।আরজুর কোমল হৃদয় তখন ভীষণ আহত হয়।

একদিন ছুটির পর আরজু শুভর জন্য অপেক্ষা করছিলো।কিন্তু শুভ আসার নাম গন্ধ নেই।আরজুর নিজের উপর আক্ষেপ হতে লাগলো।ছুটির সময় কেনো ওয়াসরুমে যেতে হলো তার?শুভ কি তাকে ফেলেই চলে গেছে?কিছুসময় অপেক্ষার পর আরজু মন খারাপ করে বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দিলো।সামনে আগাতেই দেখতে পেলো শুভ সেই মেয়েটার সাথে দাড়িয়ে কথা বলছে আর হাওয়াই মিঠাই খাচ্ছে।তাদের হাসিতে চারপাশ গমগম করছে।শুভ তাকে ছাড়া অন্য কারো সাথে এতটা সহজ ভাবে মিশত না।এই ভাবে প্রাণঢালা হাসি শুধু আরজুর সাথেই হাসতো।কিশোরী আরজু চোখ মুখ খিচে নিজের কান্না বহু কষ্টে আটকায়।এই বয়সটাই এমন যে নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডকে অন্য কারো সাথে বেশি কথা বলতে দেখলেই কষ্ট হয়।নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডকে অন্য করো বেস্ট ফ্রেন্ড হতে দেখার কষ্টটা কিশোর-কিশোরী সকলেই অনুধাবন করতে পারবে।এটা একদমই মেনে নেয়া যায় না।নিজেকে তখন ভীষণ অসহায় লাগে।

আরজু দাতে দাত চেপে রইলো।আরজু ভীষণ রেগে শুভর হাতের হাওয়াই মিঠাই কেড়ে নিয়ে মাটিতে ছুড়ে ফেললো। এতেও যেন তার মন ভরলো না।পা দিয়ে পিষে মাটির সাথে মিশিয়ে ফেললো।আরজুর কান্ড দেখে পাশের দুজন স্তব্ধ হয়ে গেলো।আরজু ক্ষিপ্ত চোখে তাকিয়ে মেয়েটির সামনে দাড়িয়ে বললো

-” শুভর সাথে একদম কথা বলতে আসবি না।তাহলে মাথার সব চুল ছিঁড়ে হাতে ধরিয়ে দিবো।”

নুসাইবা আরজুর কথায় অবাক হয়ে বললো
-‘ শুভ কি তোমার একার ফ্রেন্ড নাকি?”

-” হে আমার একার ফ্রেন্ড।ওর তোর মতো চিপকু ফ্রেন্ড দরকার নেই।”

-” সেটা তুমি বলার কে?”

-“আমিই সব।আমি ওর বেস্ট ফ্রেন্ড।”

শুভ স্তব্ধ হয়ে দুজনের তর্ক শুনছিল।বেচারার কপাল বেয়ে ঘাম ছুটে গেছে।একসময় কিশোরী আরজু আর নুসাইবা কঠিন ঝগড়ায় লিপ্ত হলো।শুভর মুখে হাত চলে গেলো তখন,যখন আরজু রেগে নুসাইবার চুল মুঠোয় নিয়ে টানতে লাগলো।শুভ একপ্রকার টেনে হিচরে আরজুকে সেখান থেকে নিয়ে এসেছিলো।রাস্তায় আরজু শুভর সাথে কোনো কথাই বলেনি।অর্ধেক রাস্তায় আসতেই ঝুম ঝুম করে বৃষ্টি শুরু হলো।আরজু রেগে বৃষ্টিতে ভিজেই বাসার উদ্দেশে রওনা দিলে শুভ জোর করে ধরে একটা দোকানের পাশে দার করলো।আরজু তখনও রাগে ফুসছে।শুভ মুচকি হেসে আরজুর দিকে তাকিয়ে বললো

-” তুই এই লেভেলের চুলাচুলি করতে পারিস আগে জানতামনা তো?দারুন ছিলো কিন্তু ব্যাপারটা।”

কিশোরী আরজু প্রচন্ড রেগে শুভর দুই গালে কষিয়ে থাপ্পর বসিয়ে দিলো।শুভ দুই গালে হাত বুলিয়ে মুচকি হেসে বললো
-” কি থাপ্পর মারলি? তোর এই থাপ্পড়ে একটা মশা ও মরবে না।হাতে কি তুলা লাগিয়ে ঘুরিস? দেখি দেখি!!”

আরজু প্রচন্ড রেগে সেখান থেকে বেরিয়ে আসলো।শুভ হো হো করে হাসতে হাসতে আরজুর পেছন পেছন ছুটলো।

আসলে শুভর বন্ধুত্বের জায়গাটা কেউ কোনোদিন পূরণ করতে পারবে না।হয়তো নেতা সাহেবও না।
আজ ভার্সিটি থেকে আরজু সোজা শুভ দের বাসায় চলে গেছিলো।কিন্তু শুভর সাথে দেখা হয়নি।শুভ ফুয়াদের সাথে বাইরে গেছে।আরজু খেয়াল করলো শুভর মা তার দিকে তাকায়নি পর্যন্ত।আর শোভাও কেমন অদ্ভুদ আচরণ করছিলো।সবাই তাকে আসামির নজরে দেখছিলো।কিন্তু আরজু কি করেছে? শুভর সাথে বিয়ের মতো সম্পর্কের চিন্তা আরজু কখনোই করেনি।নিশ্চই শুভও করেনি।সবাই নিজেদের মতো সবটা ভেবে এখন তাকেই ভুল বুঁজছে।

শুভর রাগের কারণ আরজু জানে।শুভকে না জানিয়ে বিয়ের বিষয়ে সিদ্বান্ত নেয়ায় শুভ তার উপর প্রচন্ড ক্ষিপ্ত।জীবনের সকল ছোট বড়ো বিষয় শুভকে জানায় আরজু।কিন্তু এতবড় সিদ্বান্ত শুভকে না জানিয়ে নেয়ায় শুভ ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়েছে।তাইতো শুভকে সবটা বুজিয়ে বলার জন্য গেছিলো।
আরজুর হাজারো ভাবনার মাঝে হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো।আরজু ফোনের স্ক্রিনে দেখলো সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটির কল।আরজুর নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসলো।সারা শরীর কাপছে।শুকনো ঢোক গিলে আরজু দ্রুত কল রিসিভ করলো। অপর পাশ থেকে শ্রুতি মধুর ধ্বনি ভেসে আসলো।

-” কেমন আছো আরজু?”

আরজুর অক্ষিপল্লব চক চক করে উঠলো।নিচের ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে মেয়েটা।চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে
-” আমি ভালো নেই নেতা সাহেব।একদম ভালো নেই।ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার।আমাকে একবার ঝাপটে ধরুন না।আপনার বক্ষে মাথা রেখে ভীষণ কাদতে ইচ্ছে করছে।”
কিন্তু আরজু কিছুই বলতে পারছে না।নিজেকে সংযত করে গলা পরিষ্কার করে বললো
-” জি ভালো।”

-” তুমি কি কাঁদছিলে?”

আরজু চোখ বুজে ফেললো।আরজুর ফর্সা মুখশ্রী বেয়ে অশ্রুধারা ঝড়ে পড়লো। নাহিদ মুচকি হেসে বললো
-“তুমি কি জানো, বিশাল আকাশ চিরে ঝরা বিন্দু কনার চাইতে রূপবতী রমণীদের গাল বেয়ে ঝড়া অশ্রুকণা বেশী মোহনীয়,আকৃষ্ট হয়।”

হাজারো কষ্টের মাঝেও আরজুর সারা শরীরে অদ্ভুদ শিহরণ বয়ে গেলো।খানিকটা লজ্জা পেলো।নাহিদের সামান্য কথাও আরজুর কাছে টনিকের মতো কাজ করে।ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটে উঠল আরজুর।আবার মুখটা মলিন করে আরজু বললো

-” আপনি কোথায় হারিয়ে যান বার বার।আমি আপনাকে খুজেই পাইনা।”

নাহিদের বুকে বিষাদের ছায়া নেমে আসলো। সেতো চাইলেই আরজুর সাথে সময় কাটাতে পারে না।চাইলেই আরজুকে একটু ছুঁয়ে দিতে পারে না।সময় বা পরিস্থিতি কোনোটাই তার অনুকূলে নেই।কিন্তু সবকিছুর উর্ধ্বে যেয়ে নাহিদ একটা সিদ্বান্ত নিয়েছে। এখন শুধু আরজুর সম্মতি প্রয়োজন।নাহিদ শান্ত সুরে বললো

-“তুমি সাধারণ কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে চুজ করনি আরজু।হাজারো দায়িত্বের স্রোতে ভাসা একটা মানুষকে জীবনে জড়িয়েছো।সে চাইলেই তোমাকে নিয়ে একটা বিকেল হাত ধরে ব্যাস্ত রাস্তায় হাঁটতে পারেনা।চাইলেই ফুচকার দোকানে বসে ঝাল ঝাল ফুচকা খেতে পারেনা।চাইলেই তোমার এক ডাকে ছুটে আসতে পারেনা।হাজারো মানুষের আশা,ভরসা,নিরাপত্তার দায়িত্ব আমার কাধে।অথচ আমার নিজের জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই।”

আরজু খানিকটা ঘাবড়ে গেল নাহিদের কথায়।নাহিদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।বুঝতে পারলো আরজুর চিন্তার কারণ।কিন্তু আরজুকে এখন এই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি করতে চায়না।মেয়েটা এমনি এই সামান্য ঝড়ে ভেঙে পড়েছে।তবে সামনের ঝড় গুলো কোমলমতি মেয়েটা কি করে সামলাবে কে জানে?তাই কথা ঘুরিয়ে বলতে লাগলো

-“বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ ডিসিশন তোমার ইচ্ছায় নিয়েছো।তবে এর পরের ডিসিশন গুলো আমি নিবো।আমার যে কোনো ডিসিশনে তুমি কি সহমত পোষণ করবে আরজু? আমার উপর যেই আস্থা আছে তোমার?”

আরজুর কাছে আজ নাহিদকে একটু অন্যরকম লাগছে।তাদের সম্পর্কের ব্যাপারে বেশ সিরিয়াস মনে হচ্ছে।যেমনটা আগে কখনই দেখেনি।নাহিদ কি ডিসিশন নিতে চাইছে আরজুর জানা নেই।কিন্তু নাহিদের প্রতি অদৃশ্য ভাবেই তীব্র আস্থা আরজুর আছে।কবে সেটার জন্ম হয়েছে আরজু নিজেও জানে না।তাই বললো

-“একজন নারী জীবনে সবচাইতে বিশ্বস্ত পুরুষ তিনজন।বাবা,ভাই আর স্বামী।আমার জীবনে বাবার জায়গাটা খালুজানের।কারণ তিনি আমাকে ঠিক বাবার মতোই ভালোবেসেছেন।বাবার অভাব পূরণ করেছে।ভায়ের জায়গাটায় বরাবর শুভর ছিলো।একজন ভাই যেমন তার বোনকে আগলে রাখে,নিরাপত্তা দেয় শুভ ঠিক সেই ভাবেই আমাকে আগলে রেখেছে।আমার পাশে ছায়ার মত থেকেছে।আর যেদিন থেকে আপনার নামে কবুল বলেছি, ঠিক সেদিন থেকেই নিজেকে আপনার নামে উইল করে দিয়েছি।সারাটা জীবন এক সাথে পথ চলার প্রতিজ্ঞা করেছি।তাই আপনার নেয়া প্রতিটি সিদ্ধান্তকে আমি সর্বোচ্চ সম্মান করবো।”

নাহিদ চেয়ারে মাথা হেলিয়ে দিলো। বাম হাত অটোমেটিক্যালি হৃদযন্ত্রের উপর চলে গেলো।কেমন অস্বাভাবিক ভাবে লাফাচ্ছে। ইসস!!! বউটা তাকে একদম দুর্বল করেই দম নিবে।আরজুর কথায় নাহিদ অনেকটা স্বস্তি পেলো।ভাবতেই অবাক লাগে সেই কিশোরী মেয়েটা আজ তার বউ। শুধু বউ না। বহু প্রতীক্ষার বউ।
___________________
নিশান দ্রুত অফিসের জন্য তৈরি হয়ে নাস্তার টেবিলে আসলো।সামনেই তার বাবা মনোযোগ দিয়ে পেপার পড়ছে আর চা খাচ্ছে।নিশানকে দেখে তিনি গলা খাকানি দিয়ে বললেন

-” দিন দিন তোমার বোন ইনডিসিপ্লিন হয়ে পড়ছে। ভার্সিটিতে উঠে একগাদা বন্ধু-বান্ধব বানিয়েছে। চেহারার সুরত সবগুলোর সুন্দর হলেও ডিসিপ্লিন কারো মধ্যেই নেই। তাদের সাথে মিশে তোমার বোনটাও দিন দিন গোল্লায় যাচ্ছে। সামনে ফাইনাল ইয়ারে রেজাল্ট খারাপ করলে সোজা ধরে বিয়ে দিয়ে দিব। এই কথাটা বলে দিও তাকে।”

নিশান কপাল কুঁচকে বাবার সব কথাই শুনলো।অফিসের চাপে একটা জিনিষ খেয়াল করেনি।দুই দিন ধরে রিমি একবারের জন্যও তার রুমে যেয়ে উকি দেয়নি। সবসময় নিশান বাসায় ফিরলে রিমি একবার হলেও তার ঘরে উকি দেয়।নিশান নাস্তা না করেই রিমির ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো।রুমের লাইট বন্ধ।নিশান লাইট অন করে দেখলো রিমি বেঘোরে গুমাচ্ছে।নিশানের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল।রিমি কখনোই এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমায় না। ভোরে উঠে নামাজ পরে পড়ার টেবিলে বসে যায়। মাঝে মাঝে ঘুমালেও ঘুম অনেক পাতলা থাকে।এমন বেঘোরে রিমি কখনোই ঘুমায় না।

নিশান ধীর গতিতে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো।রিমির ঘুমন্ত মুখখানা দেখে অনেকটা অবাক হলো।মুখটা কেমন মলিন হয়ে আছে।চোখের নিচে কালশিটে হয়ে গেছে।নিশান বেশ অবাক হলো পাশের টেবিলে ঘুমের ট্যাবলেট দেখে।একটা পাতার দুইটা ট্যাবলেট ফাঁকা।নিশান শুকনো ঢোক গিললো।বুকটাও কেমন কামড়ে ধরলো।রিমির কি কিছু হয়েছে? তার ছোট্ট বোনটা কোনো সমস্যায় পড়েছে?যেই মেয়ে বিছানায় শোয়া মাত্র ঘুমে তলিয়ে যায় তার হঠাৎ ঘুমের ঔষধ কেনো প্রয়োজন পড়ছে? এমন নানান প্রশ্ন নিশানের মাথায় আসলো।নিশান পরম যত্নে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।রিমিকে সে ভীষণ ভালোবাসে।কিন্তু নিজের গম্ভীর ব্যাক্তিত্বের খোলস থেকে বেরিয়ে সেই ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারেনি।রিমি নিজেও বেশ চাপা সভাবের।সহজে নিজের মনে কথা কাউকে বুঝতে দেয়না।

রিমির বন্ধু মহল নিয়ে নিশান প্রথম প্রথম বেশ চিন্তায় ছিলো।জীবনে প্রথম তার বোন এত গুলো বন্ধুবান্ধবদের সাথে মিশছে।ছেলেমেয়ে গুলো কেমন কে জানে? বিশেষ করে ছেলে গুলো কেমন? তার বোন এদের সাথে নিরাপদ কিনা এমন নানান চিন্তা ভর করতো।কিন্তু নিশানের সব চিন্তা ধীরে ধীরে নেমে আসে তখন যখন দেখলো তার নীরব,শান্ত বোনটা অনেকটা চঞ্চল হয়ে ওঠেছে।মন খুলে হাসছে।বাবার স্ট্রিক রুলস নিমিষেই গুড়িয়ে দিচ্ছে।নিশান যেই ধরাবাধা জীবন থেকে বের হতে পারেনি কিন্তু রিমি পারছে।জীবনকে নিজের মতো উপভোগ করছে।

মনে মনে ভীষণ খুশি হয় রিমির বন্ধুমহলের প্রতি।তাহলে এমন কি হলো যে মেয়েটার এই করুন দশা?
নিশানের ডাকে রিমি চোখ খুলে তাকালো। চোখের পাতা কেমন ভারী হয়ে আছে।সামনে ভাইকে দেখে রিমি লাফ দিয়ে উঠে বসলো। চোখ কচলে মেকি হেসে বললো

-” ভাইয়া তুমি এখানে?”

রিমি ঘড়ির দিকে চোখ বুলিয়ে বললো
-” ওহহ শিট!!! এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমোচ্ছিলাম? সরি ভাইয়া।পাপা নিশ্চই রেগে আছে।আমি এক্ষনি ফ্রেস হয়ে আসছি।”

রিমি দ্রুতই ওয়াসরুমে যেতে উদ্যত হলে নিশান বললো
-” এ্যানিথিং রং রিমি?তুই ঠিক আছিস?”

রিমি নিজের ওষ্ঠ জোড়া দাত দিয়ে চেপে ধরলো।যা ভয় পেয়েছে তাই হলো।ভাইয়ার তাকে দেখলেই নানা প্রশ্ন করবে বলেই দ্রুত তার চোখের আড়াল হতে চেয়েছিল, কিন্তু পারলো কই? রিমি নিজেকে সংযত করে পেছন ফিরে হালকা হেসে বললো

-” আমার কি হবে? আমি ঠিক আছি ভাইয়া।”

বলেই দ্রুত ওয়াসরুমে চলে গেলো।নিশান চোখ কুচকে রিমির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।রিমি দ্রুত ওয়াসরুমে ঢুকে দেয়ালে পিঠ ঠেকে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়লো।মুহূর্তেই তার চোখের কোনা বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।রিমি ঘন ঘন শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।কিন্তু বেহায়া মন কিছুতেই মানছে না।জীবনে প্রথম যেই ছেলেটাকে দেখে তার নিঃশ্বাস থমকে গেছিলো,যাকে প্রথম দেখেই তার বখস্থলের গভীরে সূক্ষ প্রেমের বীজ বপন করেছিলো সেই মানুষটা অন্য কাউকে ভালোবাসে।মানুষটা যদি তার নাই হয় তবে সৃষ্টিকর্তা তার প্রতি এই গভীর দুর্বলতা কেনো তৈরি করলো।ভালোবাসার মতো নিষ্ঠুর কিছু এই পৃথিবীতে আর কিছুই নেই।
_________________
অবনি সোফার রুমে বসে আপেলে খেতে খেতে টিভি দেখছে আর সামনের দুটো ঘরের দরজার দিকে তাকাচ্ছে।এক ঘরে আরজু আপু ঘাপটি মেরে বসে আছে।অন্য রুমে তার মা এক বালতি অভিমান নিয়ে।বাসার পরিস্থিতি কেমন গুমোট হয়ে আছে।আম্মু আরজু আপুর সাথে কোনো কথাই বলছে না।গতরাতে আরজু আপু কথা বলতে গেলে তার মা সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে অবাধ্য কারো সাথে কথা বলবে না।আরজু আপুও কেঁদে কেটে নাকের পানি চোখের পানি এক করে ফেলেছে।অবনির মায়ের প্রতি রাগ লাগছে।এমন হ্যান্ডসাম, কিউট, ডেসিং জিজুকে নিয়ে কিসের এতো সমস্যা? ওমন ছেলে লন্ঠন নিয়েও খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।সেখানে মা বাবার এই বিরোধী আচরণ তার ছোট্ট মাথায় কিছুতেই আসছে না।

হঠাৎ ডোরবেলের শব্দে অবনীর ধ্যান ভাঙ্গে। এই সময় কে আসলো? উঠেছে দরজা খুলতে ভীষণ আলসেমি লাগছে। তারা আপু মনে হয় ওয়াশরুমে। তাই বাধ্য হয়ে আপেলে কামড় বসাতে বসতে দরজা খুলে দিলো।কিন্তু সামনের মানুষটিকে দেখে অবনি থমকে গেলো।তার চোখ জোড়া ছানাবড়া অবস্থা হয়ে গেলো।হাতের আপেল হাত থেকে খসে পড়লো।অবনি বড়ো বড়ো চোখ করে লোকটির দিকে তাকিয়ে রইলো।সামনের ব্যাক্তিটি মুচকি হেসে বললো

-” কি অবস্থা শালীকা? আমাকে দেখে চমকে গেলে নাকি? আই লাইক ইওর ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন।”

অবনি চোখ পিট পিট করে তাকিয়ে নিজের হাতে চিমটি কাটলো।নিশ্চই কোনো ভুলভাল সপ্ন দেখছে।কিন্তু না এটা কোনো সপ্ন না।এটা একদম সত্য।

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_42

ব্যাস্ততম দিনের শুরুতেই লামিয়ার ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে।এক চুলায় সবজি বসিয়েছে।আর অন্য চুলায় রুটি ভাজছে।রুটি উল্টে পাল্টে সামনের দিকে নজর দিলো।ফুয়াদ নরম সোফায় হেলান দিয়ে টিভি দেখছে।কিন্তু টিভি দেখায় তার মনোযোগ নেই।অন্যমনস্ক হয়ে দাত দিয়ে নখ কেটে চলছে।লামিয়ার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো।সব সময় হাসি খুশি থাকা মানুষটা আজ এমন শান্ত হয়ে বসে আছে কেনো? লামিয়ার মধ্যে কৌতহল জাগ্রত হলো।তাই হাতের কাজ দ্রুত সেরে ফুয়াদের পাশে দাড়িয়ে গলা খাকানি দিয়ে বললো

-” কোনো কারণে আপনার মন খারাপ?”

ফুয়াদ চমকে লামিয়ার দিকে তাকালো।এতক্ষণ সে গভীর চিন্তায় বিভোর ছিলো।ফুয়াদ পাশে তাকিয়ে দেখলো সবুজ রঙের সালোয়ার কামিজ পড়া মায়াবী একজোড়া কোমল,শান্ত দৃষ্টি তার দিকে তাকিয়ে আছে।মায়াবী মুখখানা দেখে হাজারো চিন্তার মাঝে সামান্য শীতলতা অনুভব করলো ফুয়াদ।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো

-” না।”

লামিয়া ওষ্ঠ জোড়া চেপে ধরে আবার বললো
-” আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে কিছু নিয়ে ভীষণ চিন্তিত।”

ফুয়াদ পাশের সোফায় ইশারা করে লামিয়াকে বসতে বললো।লামিয়া অসস্তিতে পড়ে গেলো।এইভাবে পাশে বসাটা কি ঠিক হবে?অন্য কেউ দেখে ম্যাম এর কানে লাগিয়ে দিলে অনেক কথা শুনতে হবে।ফুয়াদ আবার ইশারা করতেই লামিয়া খানিকটা দূরে কাচুমাচু হয়ে বসে পড়লো।ফুয়াদ দৃষ্টি টেলিভিশনে রেখে বললো

-” তোমার কোনো বন্ধু বান্ধব আছে?”

লামিয়া অবাক হয়ে গেলো ফুয়াদের প্রশ্নে।হঠাৎ তার বন্ধুর খবর কেনো নিচ্ছে?লামিয়া নিচু সরে বললো
-” হ্যাঁ আছে। প্রীতি আমার একমাত্র বান্ধুবি।”

ফুয়াদ টিভির স্ক্রিনে নজর রেখে বললো
-” আমার একটা বন্ধুবান্ধবদের গ্রুপ আছে।এই গ্রুপের একটা সুন্দর নাম দেওয়া হয়েছে।”বন্ধুমহল।” সুন্দর না নামটা?”

লামিয়া মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করলো।ফুয়াদ আবার বলতে শুরু করলো
-” বন্ধুমহলের প্রত্যেকটাই এক একটা নমুনা।সবাই এক সাথে হলেই হৈ হুল্লোর,ঝগড়া, মারামারি পর্যন্ত হয়।ওদের সাথে থাকলে নিজের জীবনের শূন্যতা,কষ্ট সবটাই ভুলে যাই।প্রত্যেকেই প্রত্যেকের বিপদে নিঃস্বার্থ ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ি।অসম্ভব প্রশান্তি ছেয়ে যায় সবাই এক সাথে থাকলে।আমরা সবাই মিলে একটা পরিবারের মতো।”

লামিয়া বিমোহিত হয়ে শুনছিল ফুয়াদের প্রত্যেকটি উক্তি।সত্যি এমন বন্ধুবান্ধব পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।তার জীবনে এক প্রীতি ছাড়া আর কোনো ভালো বন্ধু নেই।লামিয়া বললো

-“আপনি ভীষণ ভাগ্যবান।নাহলে বর্তমানে স্বার্থ ছাড়া কেউ কথা পর্যন্ত বলে না।বন্ধুত্ব দূরের কথা।”

ফুয়াদ মুখটা মলিন করে বললো
-” কিন্তু আমার মনে হচ্ছে খুব জলদি আমরা এই মধুর সম্পর্ক গুলো হারিয়ে ফেলবো।আর তার শুরুটা হয়তো হয়ে গেছে।”

লামিয়া চমকে তাকালো ফুয়াদের দিকে।এতো সুন্দর সম্পর্ক গুলো নষ্ট হয়ে যাবে কেনো?তাই বললো
-“এমন কেনো হবে? আপনি সব ঠিক করে দিন।সম্পর্ক গুলো একত্রে জড়িয়ে রাখুন।”

লামিয়াকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাতে দেখে ফুয়াদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো
-” আমার হাতে কিছুই নেই।আমি চাইলেও সবাইকে এক সুতায় গেথে রাখতে পারছি না। কারো মনকে বেধে রাখার শক্তি আমার কেনো, কারোরই নেই।”

ফুয়াদের এই জটিল কথার মর্ম লামিয়া কিছুই বুঝতে পারলো না।শুধু বুঝতে পারলো বন্ধুমহলে প্রবল ঝড়ের উৎপত্তি হয়েছে। এখন এই ঝড় কতটা তাণ্ডব চালায় সেটাই দেখার পালা।
___________________
দুরু দুরু বুকে দরজার পেছনে দাড়িয়ে আছে আরজু।পাশের ঘরে কি কথা হচ্ছে সেটা শুনার চেষ্টা করছে।কিছুক্ষণ আগে অবনি হন্তদন্ত হয়ে ওর ঘরে ঢুকে বললো

-” আপু এলাহী কান্ড ঘটে গেছে।”

আরজুর এমনি মন ভীষণ খারাপ তার উপর অবনির এই হেয়ালি কথা তার ভীষণ বিরক্ত লাগছে।তাই আরজু ধমকের সুরে বললো

-” অবনি আমার সামনে থেকে যা।তোর আলতু ফালতু কথা শুনার মুড নেই।”

অবনি দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বললো
-‘ আপু জিজু এসে পড়েছে।”

আরজু অবনির কথা কিছুই বুঝতে না পেরে বললো
-‘ কিসের জিজু?”

-” আপু তোমার নেতা সাহেব এসেছে।”

আরজু চমকে অবনির দিকে তাকালো।অবনি অভয় দিয়ে বললো
-” এক্সাক্টলি তুমি যেটা শুনেছো, আমি সেটাই বলেছি। নাহিদ জিজু বসার ঘরে আছে।”

আরজুর সারা শরীর থর থর করে কাঁপতে লাগলো।কি ভয়ঙ্কর কথা।নেতা সাহেব তার বাসায়? খালামণি জানতে পারলে কি হবে?আজ নির্ঘাত সংঘর্ষ হতে চলছে।
এইসব ভেবে আরজু দ্রুত বসার রুমের দরজার আড়ালে দাড়ালো।অমনি চোখ পড়লো সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত সুদর্শন পুরুষটির দিকে।চোখে জ্বালা ধরানো সুন্দর অ্যান্ড হ্যান্ডসাম লাগছে।আরজু যেনো ঘোরের মাঝে চলে গেলো।পাশেই অবনি এসে ফিসফিসিয়ে বললো

-” জিজু বাস্তবে এমন ড্যাম হ্যান্ডসাম, কিউট হবে ভাবতেই পারিনি।পুরাই চকলেট বয়।”

আরজু ঘোরের মধ্যেই বলে উঠলো
-” হুম!!পুরোই চকলেট।”

কিন্তু পাশেই খালামণিকে শক্ত হয়ে বসে থাকতে দেখে আরজু বাস্তবে আছড়ে পড়লো।পাশেই খালুজান চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছে।আরজু প্রচন্ড ভাবে ভয় পেয়ে রুমে দৌড়ে চলে গেলো।বিছানায় বসে ঘন ঘন শ্বাস টেনে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করলো।নেতা সাহেব কি করতে চাইছে কিছুই বুঝতে পড়ছে না।

_____________
সাবা খানম কঠিন দৃষ্টিতে একবার নাহিদের দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার পাশের টেবিলে থাকা ডালা গুলোর দিকে।নাহিদ বাসায় ঢোকার পর পরই দুজন লোক একের পর এক ডালা দিয়ে টেবিল ভর্তি করে ফেলেছে।

জুবায়ের আহমেদ নাহিদকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে।নাহিদ মূলত কি উদ্দেশে এসেছে সেটাই বুঝার চেষ্টা করছে।রাজনৈতিক ভাবে সফল এই পুরুষ তাদের কাছে কেনো হাজির হলো?সে যেটা ভাবছে তেমন কিছু নয় তো?
সকল নীরবতাকে বিচ্ছিন্ন করে সাবা খানম কঠিন গলায় বললো

-” আমার বাসায় কেনো এসেছো? আর এই সবের মানে কি?”

টেবিলের প্যাকেট গুলো দেখিয়ে বললেন সাবা খানম।নাহিদ কি ভাবে কথা শুরু করবে বুঝতে পারছে না।জীবনে কখনো কারো সামনে কথা বলতে নাহিদ থমকায়নি।কিন্তু সাবা খানমের কঠিন দৃষ্টি তাকে খানিকটা ভাবতে বাধ্য করছে। কারণ মানুষটার সাথে আরজু সম্পৃক্ত।নাহিদ শান্ত সুরে বলতে লাগলো

-“এই ভাবে হুট করে চলে আসার জন্য আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।আর বিয়ের পর শশুর বাড়িতে খালি হাতে আসা অসামঞ্জস্য দেখায়।তাই আপনাদের জন্য সামান্য কিছু উপহার।”

নাহিদের কথায় সাবা খানমের গা জ্বালা করছে।কষিয়ে আরো দুটো থাপ্পর মারতে পারলে মন শান্ত হতো।টাকার গরম দেখাচ্ছে।তাই খানিকটা রেগে বললো

-” আমাদের জীবনে ঝড় তুলে আবার কি কারণে এসেছো?”

নাহিদ কেশে গলা পরিষ্কার করে বললো
-” আমি জানি ম্যাম আপনারা আমার উপর ভীষণ অসন্তুষ্ট।বিশেষ করে আমার আর আরজুর বিয়ে নিয়ে।কিন্তু আরজুকে এই ভাবে বিয়ে করার কোনো মনোভাব আমার কখনোই ছিলনা।আমি মোটেও এমনটা চায়নি।”

সাবা খানম দাতে দাঁত চেপে বললেন
-” বেশ কয়েক বছর আগে “নিজামুল হক” তোমার দাদা যখন একটা কঠিন পরিস্থিতিতে আরজুর জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে তখনই তাকে আমি আমার মতামত সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছি।তিনি বেশ কয়বার আমার অফিসেও এসেছেন।আমি তাকে জানিয়ে দিয়েছি তার বখে যাওয়া নাতির সাথে আমরা আরজুর কোনোদিন বিয়ে দিবো না।তার পর আর তিনি এমন প্রস্তাব রাখেননি।ভেবেছি তোমাদের মধ্যে নূন্যতম মনুষ্যত্ব বোধ জাগ্রত আছে।কিন্তু আজ এতদিন পর আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো।তোমার মতো ছেলের কাছে আসলে কিছুই আসা করা যায়না।সেই রিজেকশন তোমার ইগো কে হার্ট করেছে।তাই আরজুকে এই ভাবে গোপনে বিয়ে করে নিজের ইগোকে সেটিসফাইড করেছ।”

নাহিদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো
-” আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন ম্যাম। আরজুকে আমি মন থেকেই চেয়েছি।কিন্তু নিজের করে পাওয়ার আশা কখনোই করিনি।আরজুকে আমার প্রতি আকৃষ্ট করার প্রচেষ্টা করিনি।আমি জানি আমার অতীত কি? আমার প্রফেশন সম্পর্কেও জানি।আমার যদি ইগো সেটিসফাইড করার ইচ্ছা থাকতো তবে কয়েক বছর আগেই আমি আরজুকে তুলে নিয়ে বিয়ে করতে পারতাম।আমাকে থামাতে অব্দি পারতেন না আপনারা।সেটা নিশ্চই জানেন?কিন্তু আমার এমন ইন্টেনশন কখনই ছিলো না।আমি আরজুর কাছে থেকে নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছি।আমি জানি সেদিন আরজুর পাগলামীতে সায় দেওয়া আমার ভুল ছিল।কিন্তু ম্যাম দিন শেষে আরজুর প্রতি আমি দুর্বল ছিলাম।সে আমার বউ।এটা অস্বীকার করার উপায় নেই।”

সাবা খানম ভীষণ রেগে তার দিকে তাকিয়ে আছে।নাকের পাটা বার বার ফুলে উঠছে।নাহিদ জুবায়ের আহমেদের দিকে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন

-“স্যার আমি জানিনা ভবিষ্যতে আমাদের জন্য কি লেখা আছে।তবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই সম্পর্ক ধরে রাখতে চাই।আরজুকে নিয়ে জীবন শুরু করতে চাই। আরজুও নিশ্চই এমনটাই চায়।আমি আজ আরজুকে আপনাদের সম্মতি ক্রমে আমার সাথে নিয়ে যেতে এসেছি।রাজনৈতিক নানান জটিলতার কারণে আমার এই বিয়ে সম্পর্কে গোপন রাখতে হচ্ছে।তাছাড়া এতে আরজুর নিরাপত্তার বিষয় অন্তর্ভুক্ত।তাই আমাকে একটা সুযোগ দিন।”

সাবা খানম রেগে বললেন
-” তুমি কি ভেবেছো আরজু তোমার মুখোশের আড়ালের নিকৃষ্ট চেহারা দেখার পরও তোমার কাছে আসবে? কখনোই না।”

নাহিদ শান্ত দৃষ্টিতে বললো
-” আরজুর মুখের মিষ্টি হাসির কারণ কোথাও না কোথাও আমার মাঝে নিহিত।সেটা আপনিও জানেন।আপনি নিশ্চই আরজুর মুখের সেই হাসি কেড়ে নিতে চাইবেন না।”

নাহিদের কথায় সাবা খানম খানিকটা ভরখে গেলো।নিজেকে সামলে বললো
-” আরজু তোমার সাথে কোথাও যাবে না।”

নাহিদ গম্ভীর মুখে বললো
-” এই কথাটা আমি আরজুর মুখ থেকে শুনতে চাই।”

_____________
আরজু নিস্তব্দ দর্শক হয়ে সবার সম্মুখে দাড়িয়ে আছে।বুকের ভেতর ধক ধক করছে।মনে হচ্ছে এক্ষুনি মাটিতে লুটিয়ে পড়বে।ফ্লোরে পা খামচে দাড়িয়ে আছে।
নাহিদ আরজুকে আড়চোখে দেখতে লাগলো।হোয়াইট টিশার্ট আর ব্ল্যাক প্লাজোতে এলোমেলো আরজুকে কি যে মায়াবী লাগছে।একবার গোলাপী গাল জোড়া ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।

নাহিদ উঠে আরজুর মুখোমুখি দাড়ালো।আরজু চোখ পিট পিট করে নাহিদের দিকে তাকিয়ে আছে।নাহিদ প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে সহজ ভঙ্গিতে দাড়ালো।অবনি বড়ো বড়ো চোখ করে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।নাহিদ জিজু পট করে সবার সামনে চুমু খেয়ে বসবে নাতো?ইসস! কি কিউট লাগছে দুজনকে।একদম মেড ফর ইচ আদার।
নাহিদ কোনো ভনিতা ছাড়াই আরজু কে জিজ্ঞেস করলো

-” তোমাকে আমি আমার রাজ্যে নিয়ে যেতে এসেছি আরজু।তুমি কি যাবে আমার সাথে?”

আরজু হতবম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল নাহিদের সহজ বক্তব্যে।মুখটা তার হা হয়ে গেছে।তার মানে নেতা সাহেব এই ডিসিশনের কথাই বলেছিলেন।আরজু কি বলবে বুঝতে পারছেনা। ঘাড় ঘুরিয়ে সোফায় শক্ত হয়ে বসা খালামনির দিকে তাকালো।মুহূর্তেই মনটা কেঁদে উঠলো।খালামনির সম্মতি ছাড়া সে আর কিছুই করতে চায় না।মানুষটাকে ভীষণ কষ্ট দিয়ে ফেলেছে।অন্যদিকে নেতা সাহেবকে ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য তার নেই।

জুবায়ের আহমেদের এই ছেলেটার উপর ভীষণ বিশ্বাস করতে মন চাইছে।ছেলেটার চোখে মুখে রয়েছে অনুতাপের গ্লানি।তবে কি নাহিদ সত্যি আরজুকে ভালোবাসে?নাকি আরজু তার জেদ।কিছুই বুঝতে পারছেনা তিনি।তবে মন বলছে একটাবার ছেলেটাকে সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন।অন্তত আরজুর মনে জাগ্রত হওয়া গভীর ভালোবাসার জন্য।আরজু যে ছেলেটাকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছে।আদো আরজুকে আটকে রাখা ঠিক হবে?
_____________________
সাবা খানম তার বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে।তার পাশেই জুবায়ের আহমেদ।সারা ঘর জুড়ে নিস্তব্দতা ভর করেছে।সাবা খানম নিজের মনে রাখা ক্ষোভ উগ্রে বললেন

-” ওই নাহিদকে মিথ্যা আশ্বাস দেওয়ার মানে কি?”

জুবায়ের আহমেদ অনেকক্ষণ যাবত এমন প্রশ্নের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন।তাই ঠিকঠাক মতো বসে বললেন
-” মিথ্যা আশ্বাস কেন হবে?”

সাবা খানম তিরিক্ষ মেজাজ দেখিয়ে বললেন
-” তুমি কি ওই ছেলের হাতে আরজুকে তুলে দিতে চাইছো?এমনটা আমি কখনোই হতে দেবো না।”

জুবায়ের আহমেদ সাবা খানমের হাত জোড়ায় হাত বুলিয়ে বললেন
-” শান্ত হও সাবা।এই বিষয়টা আমাদের শান্ত হয়ে ভাবতে হবে।নাহিদ কিন্তু আগের মতো নেই।ছেলেটা নিজেকে অনেকটা বদলে নিয়েছে।সময় ধীরে ধীরে পরিস্থিতির পরিবর্তন করে।অশান্ত,বদ রাগী ছেলেটা আজ কতটা শান্ত হয়ে গেছে।জনসাধারণের জন্য কতটা করছে সেটা তুমি নিজেও দেখেছো।রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নাহিদ সবসময় দেশের কল্যাণের কথা ভেবেছে।তবে আগে ছাত্র রাজনীতি করার সময় তার বয়সটা নিতান্তই কম ছিলো।যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে শান্ত ভাবে সমাধান না করে ভায়লেন্স ক্রিয়েট করতো।যার ফলে আমারা তার নেগেটিভ দিকটাই বেশি দেখেছি।কিন্তু নাহিদ এখন সব কেস কতটা নিখুঁত ভাবে হ্যান্ডেল করে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।”

সাবা খানম চোখ মুখ কুঁচকে তাকিয়ে বললো
-” তুমি আমার সামনে ওই ছেলের গুন গান কেনো গাইছ?এই ছেলেটা আমাদের কতটা ক্ষতি করেছে সেটা ভুলে গেছো?”

-” আমি কিছুই ভুলিনি সাবা।সব কিছু মূলত কেনো, কি ভাবে হয়েছে সেই ব্যাখ্যাটাও আমাদের জানা।কিন্তু আমাদের এই মুহূর্তে সব কিছুর উর্ধ্বে আরজুর কথা ভাবতে হবে।নাহিদের জীবনের সাথে আরজু গভীর ভাবে জড়িয়ে পড়েছে।আরজুর চোখে আমি নাহিদের জন্য গভীর ভালোবাসা দেখেছি।যেই ভালোবাসা আমরা চাইলেই আরজুর মন থেকে ছুড়ে ফেলতে পারবো না।তাছাড়া আরজু নাহিদের প্রতি অনেক বেশি আসক্ত,সেটা আমরা আগেও দেখেছি।বর্তমানে তারা একটা পবিত্র সম্পর্ককে আবদ্ধ। আমরা চাইলেই সেটা অস্বীকার করতে পারিনা।নাহিদ চাইলেই আরজুকে সেই সম্পর্কের জোরে আমাদের সামনে থেকে হাত ধরে নিয়ে যেতে পারে।যেখানে আরজুর সম্মতি আছে সেখানে আমরা তাকে আটকাতেও পারবো না।নাহিদ পলিটিক্যালি কতটা পাওয়ারফুল সেটা নিশ্চই জানো।তবুও ছেলেটা কোনো ক্ষমতার জোর না দেখিয়ে আমাদের সম্মতি চাইছে।ছেলেমেয়ে গুলো যদি একে অপরের সঙ্গে ভালো থাকে তবে আমাদের বাধা দেওয়া ঠিক হবে না।”

সাবা খানমের চোখ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ল।তিনি কান্নায় ভেংগে পড়লেন।আর বললেন

-” আরজু এতো বড়ো ভুল কি করে করলো? ভবিষ্যতে মেয়েটা ভীষণ পস্তাবে। আমি এত চেষ্টা করেও ওকে কেন ফেরাতে পারলাম না। ওই ছেলেটার কাছ থেকে ওকে দূরে রাখার জন্য ওকে আমি কত শাসন করেছি। তবুও কেনো মেয়েটা ওই ছেলের প্রতি ঝুঁকে পড়লো?আরজুকে নিয়ে আমি এই ভয়টাই পেতাম।আবেগ প্রবন এই মেয়েটা কখন কোন ভুল করে ফেলে।আমার ভয় সঠিক হয়ে গেলো।আরজু কখনোই নাহিদের লাইফস্টাইল এর সাথে খাপ খাওয়াতে পারবে না।আরজুর মতো আবেগ প্রবন মেয়ে নাহিদের মতো কঠিন মানুষের সাথে কি করে থাকবে?”

-” সাবা ওরা এক সাথে যদি সুখে থাকতে পারে তবে আমাদের উচিৎ তাদের সুযোগ করে দেওয়া।আরজুকে আটকে রাখার চেষ্টা করলে মেয়েটা কখনোই সুখী হবে না।আমরা জানি আরজু কতটা সেনসিটিভ।মেয়েটা চাইলেই আজ নাহিদের সাথে চলে যেতে পারতো।কিন্তু মেয়েটা তোমার সম্মতি চাইছে।তুমি বুদ্ধিমতি।তাই জানো তোমার কি ডিসিশন নেওয়া উচিৎ।”

ঠিক তখনই তাদের রুমে নক করার শব্দ হলো।জুবায়ের আহমেদ দেখলেন আরজু এসেছে।আরজু ধীরো পায়ে এসে বিছানা ঘেঁসে ফ্লোরে বসে পড়লো। সাবা খানমের কোলে মাথা রেখে চুপ করে রইলো।আরজুর দু চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।সাবা খানম অন্য দিনের মতো আজ তার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে না।আরজু নাক টেনে বললো

-” বাবা মা মারা যাওয়ার পর আমার একমাত্র আপনজন ছিলে তুমি খালামণি।আমি কখনো স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবো ভাবতেই পারিনি।বাবা মাকে হারিয়ে আমি যখন ভেঙে পড়েছিলাম তখন তুমি আর শুভ না থাকলে আজ আমি বাঁচতে পারতাম না।তুমি আমার মা হয়ে উঠলে।আর খালুজান আমার বাবা।তুমি কোনোদিন আমাকে কোনো কিছুর অভাব অনুভব করতে দাওনি।আমাকে জীবনের সকল স্বাধীনতা দিয়েছো।কোনো কিছুতে বাধা দাওনি।আমাকে এতো ভালোবাসা দিয়েছো। কিন্তু আমি তোমার সেই ভালোবাসার সঠিক মর্যাদা দিতে পারিনি।তোমার অবাধ্য হয়েছি।

কিন্তু আমি আমার মনে সাথে যুদ্ধ করতে পারিনি।জীবনে প্রথম আমি কোনো পুরুষকে দেখে অদ্ভুত কিছু অনুভব করেছি।ওই মানুষটির উপস্থিতি আমাকে অজানা ঘোরের মাঝে রাখে।আমি তার কাছথেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারিনি।এক অজানা আকর্ষন আমাকে তার প্রতি ঝুঁকিয়ে দিয়েছে।ধীরে ধীরে আমার মনে মানুষটার জন্য তীব্র অনুভূতির সৃষ্টি হয়।আমি না চাইতেও মানুষটাকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি।তুমি বলতে না, খাঁটি ভালোবাসা সবচাইতে পবিত্রতা আর স্নিগ্ধতায় ভরপুর থাকে।এই মানুষটাকে ভালোবেসে আমি ঠিক এমনটাই অনুভব করেছি।
আমি জানি এই ভাবে বিয়ে করে আমি তোমাকে ভীষণ কষ্ট দিয়েছি।যার কোনো ক্ষমা হয়না।আমি নিজেও জানিনা সেদিন কেনো আমি এতটা ডেসপারেট হয়ে পড়েছিলাম।মানুষটার কোনো দোষ ছিলনা খালামণি।আমি তাকে এমনটা করতে ফোর্স করেছিলাম।ওই মানুষটিকে ছাড়া আমি কখনোই সুখী হতে পারবো না।কিন্তু আমি আর তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না খালামণি।তুমি যা বলবে আমি তাই করবো।তবে আমার জীবনে নেতা সাহেবের জায়গা অন্য কাউকে দিতে পারবো না।কখনোই না।”