মিষ্টি রোদের হাতছানি পর্ব-৫০+৫১

0
1002

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_50

দিনের শুরু হতেই সকলের কর্মব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়।ঠিক তেমনটি ঘটে নুর ম্যানশনে।সকাল সকাল রেডি হয়ে নাস্তার টেবিলে বসলেন নাঈম মাহমুদ।টেবিলে তখন অলরেডি তার মা নূরজাহান বেগম বসে আছেন।বেশ বিরক্তি নিয়ে খাবার খাচ্ছেন।এটা তার নিত্য দিনের কাজ।মেজাজ তার বরাবর চটে থাকে।সানজিদা মাহমুদ টেবিলে বসতেই নূর জাহানের বিরক্তির মাত্রা আরো বাড়লো।নাঈম মাহমুদ গম্ভীর স্বরে মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন

-” আম্মা গতকাল আপনার ডক্টরের কাছে এপয়েন্টমেন্ট ছিল,সানজিদা বললো আপনি যাননি। কেনো?”

নূর জাহান সানজিদা মাহমুদের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বললেন
-” তোর বউকে কান পরা কম দিতে বলবি।আমি একদম ঠিক আছি।ডক্টরের কোনো প্রয়োজন নেই।”

-” আহা আম্মা!! আমি সেদিনও দেখলাম আপনার শরীরটা খারাপ যাচ্ছে।নিজের সাস্থ্য নিয়ে অবহেলা করা ঠিক না।”

নূর জাহান বেগম খানিকটা ক্ষিপ্ত হয়ে বললো
-” আমাকে দেখার কে আছে? তোরা সবাই তো নিজেদের নিয়ে ব্যাস্ত। তুই বিজনেস নিয়ে।ছোট ছেলেটা আর্মি অফিসার হয়ে নানান শহরে পোস্টিং নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।ছোট ছেলের বউটাও ডক্টর হয়ে ঝালা হয়েছে।দিন রাত হসপিটালে পড়ে থাকে।আর নাহিদের কথা কি বলব? ছেলেটা তো পুরো পরিবার থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।”

কথাটা বলেই সানজিদা মাহমুদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন।সানজিদা মাহমুদ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে নাস্তা করতে লাগলেন।নুর জাহান বেগম আবার বললেন

-” নাহিদকে এই বাসায় ফিরে আসতে বল নাঈম।ছেলেটা একা একা থেকে আরো নিশ্চুপ হয়ে যাবে।এতো রাগ ভালো না।”

নাঈম মাহমুদ গম্ভীর স্বরে বললেন
-” চেষ্টা তো অনেক করেছি।কিন্তু আপনি তো জানেন নাহিদ কতটা একরোখা।তাছাড়া আমার উপর ভীষণ ক্ষিপ্ত।আব্বা মারা যাওয়ার পর ছেলেটা বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো।আব্বা থাকলে ঠিক সামলে নিতো ওকে।”

নূর জাহানের মুখটা চুপসে গেলো। খানিকটা ভেবে বললেন
-” অন্তত ছেলেটাকে বিয়ের জন্য রাজি করা।বউ আসলে যদি পরিবর্তন হয়। ঘরের ছেলে যদি ঘরে ফেরে।এই ভাবে কাজের মধ্যে ডুবে থাকলে ছেলেটা একসময় অসুস্থ হয়ে পড়বে।”

নাঈম মাহমুদ মনে মনে হাসলেন।বউ তো আসে পড়েছে।তাও ছেলের পছন্দের বউ। এতদিন ছেলেটার পিছুটান ছিলো না।কিন্তু এখন আছে।এখন অন্তত রাজনীতির ময়দান থেকে পিছিয়ে আসলেই হয়।নাহিদ যেহেতু কাউকে বিয়ের বিষয়ে জানাতে চাইছে না তাই এই বিষয়টা কাউকে না জানানোই ভালো।তাছাড়া সানজিদা নানান কিটি পার্টি নিয়ে ব্যাস্ত থাকে।মুখ ফস্কে কিছু বলে ফেললে নিউজে হেডলাইন হয়ে যাবে।ওকে নিয়ে কোনো বিশ্বাস নেই।

নাঈম মাহমুদকে এতটা নিশ্চিন্ত থাকতে দেখে সানজিদা মাহমুদের মনে খটকা লাগলো।বড়ো ছেলের বিষয় আসলেই যেই মানুষটা ভীষণ অস্থির আর চিন্তিত হয়ে পড়ে সেখানে আজ তিনি কতটা স্থির।কিছু কি লুকাচ্ছে তিনি?
______________
সকালের নাস্তা রেডি করে শুভর মা গেলো শুভকে ডাকতে।আজকাল ছেলেটা বেশ অনিয়ম করে চলে।ঠিক মতো খায়না, ঘুমায়না। বাসায়ও অনেক রাত করে ফেরে।আগে সকালে উঠেই দ্রুত নাস্তা করে আরজুর বাসার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়তো।কিন্তু এখন অনেক বেলা অব্দি পড়ে পড়ে ঘুমায়।ঠিক মতো ভার্সিটিতে যায়না।

শুভর রুমে ঢুকে ঘুটঘুটে অন্ধকার আর বিচ্ছিরি গন্ধে তার দম আটকে আসবার জোগাড়।দ্রুত রুমের আলো জ্বালিয়ে জানালা খুলে দিলেন।পড়ার টেবিলের পাশে বেশ কিছু সিগারেটের অবশিষ্ট অংশ পড়ে আছে।আর শুভ বিছানায় এলোমেলো হয়ে ঘুমাচ্ছে।ছেলের শুকনো মুখখানা দেখে নিজের বুকে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করলেন।বড়ো আদরের ছেলে তার।কিন্তু আজ কেমন নাজেহাল অবস্থা।আরজুর প্রতি তার ঘৃনা তীব্র আকার ধারণ করেছে।এই মেয়েটা তার ছেলের জীবনে না আসলে আজ তার ছেলের জীবনটা এতটা এলোমেলো হতো না।সেই ছোট থেকেই ছেলেটা আরজুর জন্য পাগল ছিলো।প্রতি দিন আরজুকে না দেখলে ছেলেটার দিন কাটতো না।আর আজ তার ছেলে আরজুকে ছাড়া বেচেঁ তো আছে, কিন্তু এটাকে সুস্থ ভাবে বাঁচা বলে না।

বালিশের কাছে শুভর ফোনটা দেখে তিনি সেটা হতে তুলে নিলেন।শুভর ফোনের পাসওয়ার্ড তার জানা।”আরজু রানী”।ফোন আনলক করে দ্রুত ব্লক নাম্বার লিস্ট চেক করলেন।সেখানে আরজুর নাম্বার দেখে খানিকটা নিশ্চিন্ত হলেন।আরজুর নম্বরটা তিনি নিজেই শুভর ফোন থেকে ব্লক করেছেন।শুভ হয়তো জনেও না।আরজু শুভর জীবন থেকে যত দূরে থাকবে ততই ভালো।আরজু তো ঠিকই এক বিত্তশালী দেখে বিয়ে করে নিয়েছে।আল্লাহর কাছে দিন রাত একটাই দোয়া করে যাচ্ছেন যেনো ছেলেটা স্বাভাবিক হতে পারে।আর তার ছেলের জীবনে যেনো এমন কেউ আসে যে তার ছেলেকে মন থেকে ভালোবাসবে।আরজুর নামটা যেনো শুভর মন থেকে মুছে ফেলতে পারে।

——————————
অন্যান্য দিনের মতো আজও আরজু ঘুম থেকে উঠে নাহিদকে দেখতে পেলো না।গতকাল রাতে কখন বাসায় এসেছে আরজু জানেও না।এই গভীর ঘুম আজ তার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।এই লোকটা কখন আসে কখন যায় টেরও পায়না আরজু।নাহিদের এই হেয়ালিপনায় আরজু বেশ রেগে গেলো।একটা বার তাকে ডেকে গেলে কি হতো? বাসায়ও ফিরে অনেক রাত করে। এতো কি কাজ তার? নতুন বিয়ে করেও লোকটার মধ্যে তেমন কোনো অনুভূতি নেই। কোথায় বাসায় ফিরে বউকে জড়িয়ে ধরে চট পট চুমু খেয়ে জড়িয়ে ধরবে।না পালিয়ে বেড়ায়। বিয়ের আগেও যেমন তাকে এড়িয়ে চলতো বিয়ের পরও তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি।আরজুর মতো রূপবতী মেয়েকে অব্দি এই অসভ্য লোক মূল্য দিচ্ছে না? তবে কি এই লোকের হুর প্রয়োজন ছিল?আরে মরে গেলে এমনি চল্লিশটা পাবি।বর্তমানে আমাকে পেয়েছিস সেটাই কম কি?আমার ইনস্টাগ্রামে কতো মেইল ফলোয়ার আছে এই লোকের ধারণা আছে?স্টুপিড,বদ, অভ্যাস লোক একটা।

না!!!এই মানুষটাকে এই অনিয়মের মধ্যে চলতে দেওয়া যাবে না।ফ্যামিলি অ্যান্ড কাজ দুটোর মধ্যে ব্যালেন্স করা শেখাতে হবে।মেজাজ ঠান্ডা করে আরজু দ্রুত রেডি হয়ে নাস্তার টেবিলে আসলো।আরজুকে টপস আর জিন্সের সুমি আজ প্রথম দেখলো।কিযে সুন্দর লাগছে।সুমির মনে হচ্ছে আরজুর মতো সুন্দরী আদো সে কখনো দেখেছে কিনা?না!!এতো সৌন্দর্যে ঘেরা নারী আগে কখনো দেখেনি সুমি।তার ভাইজান আসলেই ভীষণ ভাগ্যবান ব্যাক্তি।নাহলে এই রূপের রানী কি করে পেলো?আরজুকে তৈরি হয়ে আসতে দেখে সুমি বললো

-” ভাবী কোথাও যাবেন?”

আরজু মুখে খাবার পুড়ে বললো
-” হুমম!! আজ থেকে ক্লাস কন্টিনিউ করবো সুমি।বিয়ে করে তো স্টাডি লাটে উঠে গেছে।তোমার ভাইজান তো বিয়ের জন্য নিজের কাজের কোনো পরিবর্তন করেননি।তবে আমার এইভাবে বসে থেকে কাজ কি?”

আরজুর কথা শুনে সুমি হেসে ফেললো।আরজু স্নিগ্ধ চোখে সুমির নিষ্পাপ মুখখানা দেখলো।মেয়েটা একদম সহজ সরল।আরজু হঠাৎ প্রশ্ন করলো
-” সুমি তোমার বাবাকে মনে পরে না?”

সুমি হাসি থামিয়ে মলিন মুখে বললো
-” হুমম মনে পড়ে।বাবা আমাকে অনেক ভালোবাসে।মা তো অনেক আগেই মারা গেছে।বাবা চেষ্টা করেছে আমাকে আগলে রাখতে।কিন্তু বাবার এই আদর সৎ মায়ের সহ্য হতো না।আমাকে অনেক অত্যাচার করতো।বাবার কাছে বিচার দিলেন অত্যাচার আরো বেড়ে যেতো।আমার বাবা আগে নূর ম্যনশন বাসায় কাজ করত।কিন্তু অসুস্থতার জন্য আর পারেনা।তাই ভাইজান বাবাকে কাজ করতে মানা করছে।উনি নিজেই আমাদের সংসারের দায়িত্ব নিয়েছে।ভাইজান তখন আমাকে নুর ম্যনশন নিয়ে যায়।সেখানে থেকেই আমি লেখাপড়া করেছি। পরে দাদীজান আমাকে ভাইজানের এই বাসায় পাঠায় দিছে।তার দেখাশুনার জন্য।ভাইজান আমাকে এইখানে কলেজ ভর্তি করিয়ে দিয়েছে।কিন্তু আমার পড়াশুনা তেমন ভালো লাগে না।তাই এইচ এস সি পরীক্ষা দিয়ে আর ভার্সিটিতে ভর্তি হয়নি।ভাইজান অনেক বলেছে কিন্তু আমার একদম ইচ্ছে ছিলো না। ”

আরজু মুচকি হেসে বললো
-“ওই বাসার মানুষজনের সাথে তোমার ভাইজানের সম্পর্ক কেমন?”

সুমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো
-” আপনি তো এখন এই পরিবারে মানুষ।আপনাকে বলতে সমস্যা নাই।ভাইজানের তাদের সাথে সম্পর্ক তেমন ভালো না।বড়ো স্যারের সাথে ভাইজানের ছত্রিশ আখড়ার ঝামেলা চলে। এর আসল কারণ আমি জানিনা।এই বাসায় আসার পর থেকেই এমন দেখি।জেরিন আপা আর দাদীর সাথে একটু ভালো।আর ভাইজানের চাচার সাথেও বেশ ভালো।চাচাজান খুব ভালোবাসে ভাইজানরে।ভাইজান ও চাচাকে অনেক মানে।”

আরজু গভীর চিন্তায় বিভোর হয়ে পড়লো।নেতা সাহেব সম্পর্কে আরও অনেক কিছুই তার অজানা।এই মানুষটার মন বুঝতে গেলে এই মানুষটাকে পুরোপুরি জানতে হবে।মানুষটা সব সম্পর্ক থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে কেনো?নেতা সাহেব তাকে যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করলেও তার কাছথেকে অনেকটা দুরত্ব বজায় রাখে।আরজুর জীবনের সবচাইতে প্রিয় মানুষটি তাকে খানিকটা এড়িয়ে চলে এটা আরজুর মানতে কষ্ট হয়।নেতা সাহেব কি আজও বিয়েটা মানতে পারেনি?নাকি অন্য কিছু?মাঝে মাঝে নেতা সাহেবের আচরণে মনে হয় তিনি হয়তো তার প্রতি দূর্বল।কিন্তু পরক্ষণে মনে হয় আরজুর কোনো অস্তিত্ব এই মানুষটার জীবনে নেই।না!!! আরজু এতো সহজে হাড় মানবে না।নেতা সাহেবকে জয় করে নিবে।নিজের ভালোবাসার বাঁধনে আটকে রাখবে নেতা সাহেবকে।তার জন্য যা করা প্রয়োজন তাই করবে।

আরজু দ্রুত নাস্তা শেষ করে বাসার সদর দরজা থেকে বের হওয়ার সময় দেখলো একজন লোক গাড়ির পাশে দাড়িয়ে আছে।বেশ লম্বা চওড়া লোকটার হাতের পেশী গুলো অনেকটা ফুলে ফেঁপে আছে।আরজুকে দেখেই লোকটি সালাম দিলো।আর আরজুর উদ্দেশ্য বললো

-” আসুন ম্যাম। কোথায় যাবেন?”

আরজু ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে অচেনা লোকটির উদ্দেশে বললো
-” আপনি কে?”

লোকটি মুচকি হেসে বললো
-” আমি সাইফুল আপনার বডিগার্ড।”

আরজু যেনো আকাশ থেকে পড়ল।বডিগার্ড!! সিরিয়াসলি!! তার কেনো বডিগার্ডের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়না।আরজু বেশ বিরক্ত হয়ে বললো
-” আমার কোনো বডিগার্ডের প্রয়োজন নেই।”

লোকটি জবাব দিলো
-” সরি ম্যাম।কিন্তু স্যার আমাকে আপনার জন্য হায়ার করেছে।সর্বক্ষণ আপনাকে নিরাপত্তা দেয়া আমার দায়িত্ব।”

আরজুর নাহিদের উপর বেশ রাগ হচ্ছে।আরে নিজে এক গাদা গার্ড নিয়ে চলে বলে তারও এই গার্ড নিয়ে চলতে হবে? ইম্পসিবল।আরজু এমন কোনো সেলিব্রেটি না যে তার বডিগার্ডের প্রয়োজন পড়বে।আরজু দ্রুত নাহিদের নম্বরে ডায়াল করলো।নাহিদ কল রিসিভ করতেই আরজু উত্তেজিত হয়ে বললো

-“আপনি আমার জন্য বডিগার্ড হায়ার করেছেন?আমি কি কোনো সেলিব্রেটি? হোয়াট ইজ দিস?”

নাহিদ মুচকি হেসে বললো
-” কুল ডাউন আরজু।এতো হাইপার হচ্ছো কেনো? তাছাড়া তুমি তো এখন একজন সেলিব্রেটি চাইতে বেশি কিছু।”

-” একদম আমার সাথে মজা করবেন না।আমার এসবের কোনো প্রয়োজন নেই।”

নাহিদ বুঝতে পাড়লো তার বউ কোনো কারণে ক্ষিপ্ত।নাহলে আরজু কখনোই এতো রেগে যায়না।তাই নাহিদ শান্ত হয়ে বললো
-“প্লিজ আরজু ট্রাই তো আন্ডারস্ট্যান্ড। সাইফুল তোমাকে ভার্সিটির গেট অব্দি পৌঁছে দিবে জাস্ট।”

আরজু জেদি গলায় বললো
-” একদম না।এইসব নমুনা নিয়ে আমি ঘুরে অভ্যস্ত না।তাছাড়া আমাদের বিয়ে সম্পর্কে কেউ জানে না।সো এসবের কোনো প্রয়োজন আমার নেই।”

নাহিদ বুজলো আরজু অনেকটা ক্ষেপে আছে তার উপর।তাই বুজিয়ে বলার চেষ্টা করলো।
-” লিসেন আরজু ,বর্তমানে তুমি নিবরাস নাহিদের সহধর্মিণী।তাই তোমার নিরাপত্তার ঝুঁকি রয়েছে।সকলেই এই নাহিদকে দুর্বল করে ভেঙে ফেলে নিজেদের রাস্তা ক্লিয়ার করতে চায়।তাই সবাই আমার দুর্বলতা খুঁজে বেড়ায়।তোমার আমার সম্পর্কের বিষয়টা বের করা বিপক্ষ দলের জন্য খুব একটা কঠিন বিষয় না।
যে কেউ এসে এই নাহিদের কলিজায় আঘাত করে চলে যাবে এমন কোনো সুযোগ আমি কখনোই কাউকে দিবো না।কোনো রকম বিরোধিতা না করে চুপচাপ সাইফুলের সাথে যাও।অ্যান্ড ইটস মাই অর্ডার।সাইফুল আমার বিশ্বস্ত লোক।”

শেষে কথাগুলো বেশ কঠিন সুরে বললো নাহিদ।নাহিদের কঠিন সুরে আরজু খানিকটা দমে গেলো।তাই আর কিছু না বলে চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলো।

ভার্সিটির গেটে পৌঁছে আরজু সবার আগে ফুয়াদকে দেখতে পেলো।ফুয়াদ নিজের বাইক পার্ক করছে।আরজু ফুয়াদের দিকে এগিয়ে গেলো।পেছনে ফিরে হঠাৎ আরজুকে দেখে খানিকটা চমকে গেলো ফুয়াদ।গলার শার্ট তুলে বুকে ফু দিয়ে বললো

-” ও গড।এই ভাবে ভূতের মতো পেছনে দাড়িয়ে আছিস কেনো?একটুর জন্য হার্ট এ্যাটাক করলাম না।”

আরজু একদৃষ্টিতে ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে রইলো।ফুয়াদ খানিকটা অপ্রাস্তুত বোধ করলো।নিজেকে সামলে বললো
-” সর ক্লাসে যাবো।”

আরজু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো
-” আমার উপর রেগে আছিস?”

ফুয়াদ আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বললো
-” না। রাগবো কেনো?”

আরজু অশ্রুসিক্ত নয়নে বললো
-” মিথ্যে কথা বলছিস।তুই আর শুভ আমার উপর ভীষণ রেগে আছিস।এই কয়দিনে আমি শুভকে বহুবার কল করেছি।ওর ফোনে কল যাচ্ছে না।তোকেও কল করেছি তুই রিসিভ করিসনি।আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক কি এতটাই ঠুনকো ছিলো ফুয়াদ,যে আমাকে এই ভাবে এড়িয়ে চলছিস?কাউকে ভালোবাসা কি অন্যায়? নেতা সাহেবকে আমি পছন্দ করি এই বিষয়টা আমি কখনোই তোদের কাছ থেকে লুকাইনি।তোরা সবাই জানতি আমি এই একটা মানুষের প্রতি প্রচন্ড দুর্বল।শুভ নিজেও বিষয়টা জানে।তোরা এই বিষয়টা নিয়ে ফান করতি বলেই আমি তোদের সামনে আমার অনুভূতির গভীরতা ব্যক্ত করিনি।অথচ আজ তোরা সবাই আমাকে অপরাধীর মতো কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রেখেছিস।ঠিক আছে আমি আর আসবেনা তোদের পেছনে।থাক তোরা তোদের মতো করে।”

ফুয়াদ আরজুর অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে নিজেকে অপরাধী ভাবতে লাগলো।আসলেই তারা সবাই জানতো আরজু মেয়র নাহিদকে পছন্দ করে।কিন্তু সেই পছন্দের তীব্রতা সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা ছিল না।বরং সেটা নিয়ে আরজুর লেগপুল করেছে।আর শুভ আরজুর উপর রাগ দেখিয়েছে।তারা ভেবেছে আরজু হয়তো অন্য সব মেয়েদের মতো দূর থেকে দেখে ক্রাশ খেয়েছে।কিন্তু আরজু আসলেই সেই মানুষটিকে মনে প্রাণে ভালোবেসে ফেলেছে এটা তাদের ধারণার বাইরে ছিলো।সেদিন আরজুকে ভুলবুজে যোগাযোগ বন্ধ করে ফেলা ঠিক হয়নি।শুভ যেমন তার বন্ধু আরজু ঠিক তেমনি।সেদিন শুভর অনুভূতি বুঝতে পারলেও আরজুর দিকটা বিবেচনা করে দেখেনি।মেয়েটাকে মনে মনে দোষারোপ করেছে।আদো আরজুর কোনো দোষ ছিলো? ফুয়াদ বহুবার শুভকে বলেছে নিজের মনের কথা আরজুর সামনে বক্ত করতে কিন্তু শুভ নিজেই সেই সাহস দেখতে পারেনি।আজকের পরিস্থিতির জন্য কোনো না কোনোভাবে শুভ নিজেও দায়ী।

আরজু চোখের শীতল জল হাতের উল্টো পিঠে মুছে ক্লাসের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো।ফুয়াদ বাইকের চাবি দ্রুত পকেটে গুজে দৌড়ে আরজুর পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো।আরজু ফুয়াদকে দেখেও না দেখার ভান করে হাঁটছে।ফুয়াদ আরজুকে উদ্দেশ্য করে বললো
-“লোক ঠিক বলে সুন্দরীদের তেজ বেশি থাকে।দেখ তোর তেজে আমি ঝলসে যাচ্ছি।”

বলেই নিজের হাত বাড়িয়ে দিলো।আরজু না দেখেই হাঁটতে লাগলো।ভীষণ অভিমান জমেছে তার মনে।ফুয়াদ মুচকি হেসে বললো
-“আচ্ছা তোর নেতা সাহেবের সাথে ঝগড়া করে এসেছিস নাকি?আমার উপর রাগ দেখাচ্ছি কেনো?ওই ব্যাটা আবার তোকে ধরে পিটায় নাতো?”

আরজু হঠাৎ থেমে ফুয়াদের দিকে প্রচন্ড রেগে তাকালো।আর চিবিয়ে চিবিয়ে বললো
-” খবরদার আমার জামাইকে নিজে এসব ফালতু কথা বলবি না।ওই মানুষটাকে তোরা চিনতে ভুল করেছিস।সে আমাকে যথেষ্ট সম্মান করে।আমার খেয়াল রাখে।নেতা সাহেব সম্পর্কে তোদের ধারণা ভুল।মানুষটাকে উপর থেকে কঠিন মনে হলেও সে ভীষণ নরম মনের মানুষ।তাকে নিয়ে কোনো বাজে কথা বলবি না।”

ফুয়াদ দুষ্ট হেসে বললো
-” ওহো!!! কি প্রেম?তুইতো প্রেমের সাগরে পুরো পুরি ডুবে মরে ভূত হয়ে গেছিস।ভালো!! তুই তো দেখা যায় খুব জলদি আমাদের মামা ডাক শুনাবি বলে মনে হয়।”

আরজু রেগে ফুয়াদের পিঠে কিল বসিয়ে দিলো।ফুয়াদ উঃ আঃ করে উঠল।আর বললো
-” ও মা!! এটা হাত না লোহা? শুভ তোর এই নরম হাতের শক্ত মাইর সহ্য করে কেমন করে?”

আরজুর মুখটা আবার মলিন হয়ে গেলো।গত দুই দিনে আরজু বহুবার শুভকে কল করেছে।কিন্তু কিছুতেই যাচ্ছে না।শুভর সাথে প্রতিদিন দেখা করা, কথা বলা, ঝগড়া করা আরজুর নিত্য দিনের কাজ ছিলো।আরজুর ভালো খারাপ সবটা সময় শুভ পাশে ছিলো।কিন্তু হঠাৎ করে শুভ তার উপর এতো অভিমান করলো কেনো?আরজু জানে সে শুভ বা পরিবারকে না জানিয়ে বিয়ে করে ভুল করেছে।কিন্তু সে ভুল মানুষকে বিয়ে করেনি।নিজের মনের মানুষটাকেই ভালোবেসে বিয়ে করেছে।কিন্তু হঠাৎ শুভ তার সাথে সকল যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে।আরজুর ভেতরে কতটা সংঘর্ষ চলছে সেটা আরজু কাউকে বলে বুঝাতে পারবে না।এক দিকে খালামণি তার উপর নারাজ।অন্য দিকে শুভ যোগাযোগ বন্ধ করে রেখেছে।তার উপর নাহিদের সাথে তার এই নতুন সম্পর্কটাকে এখনো গুছিয়ে উঠতে পারেনি।সম্পর্কের এই টানা পোড়েনে আরজু অনেকটা হাপিয়ে উঠেছে।

ফুয়াদ বিষয়টা হয়তো বুঝতে পেরেছে তাই আরজুকে আশ্বস্ত করে বললো
-” চিন্তা করিসনা আমি শুভর সাথে কথা বলবো।ওকে একটু সময় দে।সেই ছোট থেকে এক সাথে ছিলি তোরা।নিজেদের মধ্যে এতো ভালো আন্ডারস্ট্যান্ডিং তোদের।হঠাৎ করে তোর জীবনের এতো বড়ো সিদ্বান্ত শুভর মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে।তুই হঠাৎ দূরে চলে গেছিস ভেবেই ছেলেটা ভীষণ কষ্ট পেয়েছে।সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে।”

আরজু নিজেকে শান্ত করলো।ফুয়াদ মনে মনে ভাবলো
-” শুভর জন্য এটা মেনে নেয়া ভীষণ কষ্টের আরজু।ছেলেটা তোকে পাগলের মতো ভালোবাসে।কিন্তু শুভকে এই কঠিন বাস্তবতা মেনে নিতেই হবে।আমি কথা বলবো শুভর সাথে।শুভর ভালোবাসার কথা তুই জানিস না।আমি চাই ভবিষ্যৎ ও তুই এই বিষয়ে কিছুই না জানতে পারিস।তবে অযথাই নিজেকে অপরাধী ভাববি।আর আমি চাইনা তুই নতুন জীবন কোনো অপরাধবোধ নিয়ে শুরু কর।”

ক্লাসে এসে আজ আরজুর মন খারাপ হয়ে গেলো।শুভ আজ আসেনি।আরজুকে কয়দিন পর দেখে সবাই বেশ এক্সাইয়েড হয়ে পড়লো।বিশেষ করে জারা।আরজুকে টেনে নিয়ে দুষ্ট হেসে কানে কানে ফিসফিসিয়ে বললো
-” কীরে তোর আর নেতা সাহেবের রোমান্স কেমন চলে?যা হ্যান্ডসাম জামাই তোর।”

আরজু মুখটা মলিন করে হতাশার সুরে বললো
-” আমার জীবনে রোমান্স নাই রে।এই নেতা একটা নিরামিষ গাধা।এই লোককে দিয়ে রোমান্স সম্ভব না।”

জারা বেশ অবাক হয়ে বললো
-” বলিস কি? তোর মতো খাসা মাল দেখেও মেয়রের মনে রোমান্স জাগেনা?”

আরজু চোখ মুখ শক্ত করে কঠিন দৃষ্টিতে তাকালো।আর রেগে বললো
-” ওই মাল কি? মুখ ঠিক কর?”

-” ওকে কুল!!কিন্তু তোর মতো রূপের রাণীকে দেখেও এই লোকের রোমেঞ্চ জাগেনা কেমনে?আমি তো ভেবেছিলাম এতো দিনে তোদের কয়েক দফায় হানিমুন শেষ।”

-” ফাজলামি করিস না।আমি সিরিয়াস।”

-” ওকে বুজলাম।আচ্ছা উনার কোনো সমস্যা নাইতো? মানে গে নাতো?তাহলে তোর কপাল পুড়েছে রে আরজু।”

আরজু জারার কাদে একটা চাপড় মেরে ধমকে উঠলো।জারা আরজুকে শান্ত করে বললো
-” আরে চেতিস কেনো?দেখ তোর মতো খাসা মালকে সামনে রেখে যেই লোকের মনে কোনো অনুভূতি জাগেনা তার মানে তো এটাই হয়।আরে মিডিয়াতে আমার সাথে মডেলিং করে, এমন হ্যান্ডসাম ডেশিং ছেলেরা দেখি গে।তাই বললাম।”

আরজু খানিকটা চিন্তিত হয়ে পড়লো।কিছু একটা ভেবে জারাকে সেদিন রিসোর্টে ঘটনা খুলে বললো।জারা তো আরজুর কথা শুনে অবাক।অনেকটা উত্তেজিত হয়ে বললো

-” ওই মেয়র তোকে রিসোর্টে কিস করেছে? সিরিয়াসলি!! তোর জামাই তো পাক্কা খেলোয়াড়।তাহলে এতদিন তোকে এতো ইগনোর করার মানে কি?”

আরজু ঠোঁট ফুলিয়ে বললো
-” জানি না।”

আরজুকে মন খারাপ করতে দেখে জারা বললো
-” আরে পাগলী মন খারাপ করিস না। আই থিঙ্ক তোর নেতা সাহেব পলিটিক্সে দৌড়াতে দৌড়াতে মনের মধ্যে যং ধরে গেছে।তোকে একটু ঝালাই করে ওই পাষাণ বুকে ভালোবাসার বীজ বপন করতে হবে।উনি হয়তো নিজের শক্ত খোলস খুলে তোর সামনে আসতে পারছে না।তাহলে প্রথম স্টেপ তুই নে।”

আরজু চোখ মুখ কুঁচকে বললো
-” কি আমি? ইম্পসিবল।”

-” ফালতু কথা কম বল।নাহলে সারা জীবন তোরা জামাই বউ ভার্জিন মরবি।”

আরজু আমতা আমতা করে বললো
-” আমি কি ভাবে?”

-“আরে আমি আছি না।সব শিখিয়ে দিবো।”

পেছন থেকে ফুয়াদ এসে বললো
-” তোর শয়তান মাথা থেকে কি বুদ্ধি শিখাতে চাইছিস আরজুকে।”

জারা মুখ ভেংচে বললো
-” তুই বুজবি না।এটা গার্লস টক। ইউ ক্যান গো নাও।”

ফুয়াদ জারার মাথায় চাপড় মেরে চলে গেলো।আর জারা মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ফুয়াদের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করতে লাগলো।

আরজু আর জারা কিছু শপিং করে একটা কফি হাউসে বসলো।দুই বান্ধবী মিলে অনেক ক্ষন গল্পঃ করলো।হঠাৎ কারো ডাকে তাদের গল্পে বাধা পড়লো।আরজু দেখলো একটা পরিচিত মুখ তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।আরজু লোকটিকে দেখে মুচকি হেসে বললো

-” আরে মিস্টার সাদমান?”

সাদমান হেসে বললো
-” ইয়েস।কেমন আছেন আরজু?”

-” জী ভালো।আপনি?”

-“আলহামদুলি্লাহ ভালো।”

জারা অবাক হয়ে দুজনের কথা শুনছিল।আরজুকে খোঁচা মেরে ইশারা করলো লোকটি কে?”
আরজু সেদিন শপিং মলে ফোন ভাঙ্গার ঘটনা সংক্ষিপ্ত করে বললো।আরজু সাদমানকে তাদের সাথে কফি খাওয়ার অফার করলো।সাদমান খুশি মনে তাদের সাথে জয়েন করলো।সাদমান হেসে বললো
-“সুন্দরী রমণীদের ফ্রেন্ডরা ও সুন্দরী হবে এমন কোনো রুলাস আছে নাকি?”

আরজু হো হো করে হেসে উঠলো।জারা খানিকটা বিব্রত হলো বললো
-“ফ্লার্ট তো ভালই জানেন।”

সাদমান হেসে বললো
-” ওই একটু আকটু।সুন্দরী নারীদের সংস্পর্শে আসলে এমনটা হয় আরকি।”

জারা চেয়ারে হেলান দিয়ে বললো
-” সে ক্ষেত্রে আপনার প্রথম ট্রাই তো আরজুকে করার কথা।অতি সুন্দরী নারী তো সামনেই ছিলো।”

-” সেটার সুযোগ পায়নি।আপনার ফ্রেন্ড আগেই তার ভিআইপি মানুষটার কথা আমাকে জানিয়েছে।সো কোনো চান্স নেই।”

জারা হেসে খানিকটা ঝুঁকে বললো
-” আমার পেছনে একজন লিটল ভিআইপি পড়ে আছে। রীতিমতো আঠার নেয় লেগে আছে। আপনার সাথে দেখলেও সেই লিটেল ভিআইপির জ্বলে যাবে।আপনার নাক ফাটাতে ও ভাববে না।”

সাদমান হেসে বললো
-” ইন্টারেস্টিং!! আপনদের দুই ফ্রেন্ডের পেছনেই ভিআইপি। ভেরি গুড।আফসোস হচ্ছে আমি কেনো ভিআইপি হলাম না।”

সাদমানের কথায় আরজু জারা দুজয়েই হাসলো।
আরজুর হঠাৎ মনে পড়লো জারাকে তো জাহিদের বিষয়ে বলাই হয়নি।জারা পেছনে পড়ে থাকা মানুষটা আর কেউ না তার দেবর।দুই ভাই একদম বিপরীত।একজন সিনিয়র কেও প্রপোজ করে বসে আছে।রোমাঞ্চ যেনো শিরায় শিরায় দৌড়ায়।অন্যজন নিজের বিয়ে করা বউকে কিছু বলতেই পারে না।নিরামিষ একটা।তবে তেজ যেনো দুই ভাইয়ের এক।তবে আরজু ভেবে রেখেছে জারাকে এখন কিছু বলবে না।একটা চমক দিবে।জারার মুখটা দেখার মতো হবে।

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_51

পড়ন্ত বিকেলের দিকে অবনি কোচিং শেষ করে বাসায় আসছিলো।বাড়ির সামনে আসতেই দেখলো একটা বড়ো গাড়ি সবে দাড়িয়েছে।অবনি কৌতহল বসতো সামনের এগিয়ে গেলো।কিন্তু গাড়ির কাছাকাছি আসতেই আরজুকে দেখে চমকে গেলো।এতদিন পর বোনকে দেখে অবনির খুশি যেনো বাঁধ মানে না।সে দৌড়ে আরজুর কাছে যেতে চাইলে এক দীর্ঘদেহী মানব তার সামনে বাধা হয়ে দাড়ালো।অবনির আকাশ সমান উত্তেজনা মুহূর্তেই উড়ে গেলো।লোকটি গম্ভীর সুরে অবনীকে প্রশ্ন করলো

-” কে আপনি? এইভাবে ম্যাম এর দিকে ধেয়ে আসছে কেনো?”

আরজু তখন গাড়ি থেকে শপিং ব্যাগ ড্রাইভারকে বুজিয়ে দিতে ব্যাস্ত।সাইফুলের ভারী কণ্ঠ শুনে আরজু ফিরে তাকালো।অবনীকে দেখে দ্রুত এসে জড়িয়ে ধরলো।আজ কতগুলো দিন পর নিজের আপন মানুষগুলোকে দেখছে।অবনীকে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকে প্রশান্তি অনুভব করলো আরজু।সমাজ মেয়েদের জন্য এই কঠিন নিয়ম কেনো তৈরি করলো?জীবনের অর্ধেকটা সময় যেই মানুষগুলার কাছে থেকেছে তাদের ছেড়ে অচেনা মানুষদের আপন করে নিতে হয়।যাদের হাত ধরে চির চেনা আঙিনায় বড়ো হয়েছে সেই অঙ্গিনাকে ছেড়ে নতুন নীড়ে‌ বাসা বাঁধতে হয়।আরজুর হাতে ক্ষমতা থাকলে এই কঠিন নিয়মকে ভেঙে গুড়িয়ে দিতো।
আরজুকে এই ভাবে মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরতে দেখে সাইফুল খানিকটা অপ্রস্তুত বোধ করলো।বুঝতে পারলো ভুল জায়গায় ইন্টারাপ করেছে।মেয়েটা নিঃসন্দেহে ম্যামের পরিচিত।পরিচিত বললে ভুল হবে।ঘনিষ্ট কেউ।অবনি তখন সাইফুলকে কঠিন দৃষ্টি ফেলে ভৎস করতে ব্যাস্ত।সাইফুল নিজের দৃষ্টি তখন আশেপাশে ফেলতে ব্যাস্ত।

অবণী ইশারায় আরজুকে বললো
-“আপু এই নমুনা কোথা থেকে ধরে এনেছো?”

আরজু অবনীকে চোখ রাঙিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে মৃদু স্বরে বললো
-” নেতা সাহেব আমার পেছনে লাগিয়ে দিয়েছে।আমার বডিগার্ড।অসহ্য।”

অবণী মৃদু হেসে বললো
-” দারুন ব্যাপার তো।এই ব্যাটা কি তোমাদের বেডরুমে ঢুকেও তোমাকে নিরাপত্তা দেয়?”

আরজু অবনির কান টেনে বললো
-” বেশি পক পক করছিস।চল বাসায় চল তোর খবর আছে।”
__________________
শহরের ব্যাস্ত রাস্তায় এগিয়ে চলছে তিন চাকার রিকশা।বিকেলের স্নিগ্ধ হাওয়ায় এক মাতোয়ারা আবেশ মিশে থাকে।সেটা একমাত্র খোলা আকাশের নিচেই উপলব্ধি করা যায়।আশেপাশে চোখ বুলাচ্ছে সাবিহা।রাস্তার দুই ধারে যা দেখছে সবটাই ভালো লাগছে। এবার সাবিহা দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো তার পাশে বসা শুদ্ধ পুরুষটির দিকে।যে বিরক্তি নিয়ে একবার হাতের ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে তো আবার আশেপাশে চোখ বুলাচ্ছে।সাবিহা ঠোঁট টিপে হাসলো।এই মানুষটার সব কিছুই তার ভালো লাগে। এমনকি মাঝে মাঝে শুকনো ঢোক গেলার সময় অ্যাডামস অ্যাপেল এর উঠা নামা দেখেও সাবিহার নিঃশ্বাস বন্ধ হবার জোগাড় হয়।অতি ক্ষুদ্র বিষয়গুলো তাকে ভীষণ ভাবে টানে।পাশে বসা মানুষটা তাকে অপ্রকাশিত ভাবে বহুবার প্রত্যাখ্যান করলেও সাবিহা এই মানুষটার মায়াজাল থেকে কিছুতেই বের হতে পাড়ে না।বার বার বেহায়ার মতো ছুটে আসে।

রামিম একবার আড়চোখে সাবিহার দিকে তাকালো।মেয়েটা এইভাবে ঘায়েল করা দৃষ্টিতে কেনো তাকিয়ে আছে?শত হোক সে একজন পুরুষ।বার বার ভালোবাসার মানুষটিকে চাইলেও এড়িয়ে চলা যায়না।সাবিহার মধ্যে একটা অদ্ভুদ মায়া আছে।নাহলে রামিমের মতো শক্ত ব্যাক্তিত্ব কেনো গলে যেতে চায়?আজ সে কিছুতেই সাবিহার সাথে এক রিক্সায় আসতে চায়নি।কিন্তু মেয়েটা যখন ডাগর ডাগর চোখে তাকিয়ে তাকে বললো

-” চল না রামিম।আমার বাসার সামনে দিয়েই তো টিউশনে যাবি।আমাকে নামিয়ে দিয়ে চলে যাস।”

রামিম আর মানা করতে পারলো না।মনের ভেতরে কোথাও না কোথাও সাবিহার সান্নিধ্য সে আশা করে।সাবিহার বাসার সামনে আসতেই সাবিহা নেমে দাড়ালো। রামিমকে উদ্দেশ্য করে বললো

-” কাল আমি আন্টিকে দেখতে গেছিলাম।উনি মনেহয় বেশ অসুস্থ।কিন্তু বুঝতে দিতে চাইছে না।”

সাবিহা ব্যাগ থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে রমিমের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো
-” এই ডক্টরের কাছে আন্টিকে একবার নিয়ে যাস।উনি আমার পরিচিত আংকেল।বেশ ভালো ডক্টর।”

রামিম কার্ডের দিকে এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়েই বললো
-” আমার অগোচরে বাসার যাওয়ার প্রয়োজন নেই।চাইলে আমার উপস্থিতিতেই যেতে পড়িস।”

সাবিহা অভিমানী সুরে বললো
-” যেচে অপমানিত হওয়ার জন্য?”

রামিম মলিন চোখে সাবিহার দিকে তাকালো।শান্ত সুরে বললো
-“সেদিনের বলা কথার জন্য অভিমান করেছিস?”

সাবিহা মেকি হেসে বললো
-“আমার অভিমানে তোর কি আসে যায়?”

রামিম মস্তক অবনত করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। না!! সাবিহাকে সে আর কোনো উত্তর দিবে না।নাহলে মনের কথা মুখে আসতে এক মুহুর্ত সময় নিবে না।সাবিহা রামিমের দিকে তাকালো।সাবিহা কাপা গলায় বললো

-” শুভর জন্য ভীষণ খারাপ লাগে।ছেলেটা কেমন যেনো হয়ে গেছে।তবুও ছেলেটা নিজেকে সামলে নিয়েছে।ওর পরিস্থিতে কখনো আমি পড়লে নিজেকে সামলাতে পারবো না রামিম।হয়তো নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাবো।”

রামিম চট করে সাবিহার দিকে তাকালো।চোখ পড়ল প্রিয়সীর অশ্রুসিক্ত নয়নে।মুহূর্তেই রামিমের বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো।আসলেই কি সাবিহা নিজেকে সামলাতে পারবে না? কিন্তু সে কি করে সাবিহাকে নিজের এই অনিশ্চিত জীবনে জড়াবে?

সাবিহা আর অপেক্ষা করলো না।বাসার গেট পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো।রামিম ভারাক্রান্ত মন নিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো। এতক্ষণ যাবত বারান্দায় দাড়িয়ে সাবিহার বাবা সবটাই দেখলো।তাদের মধ্যে কি কথা হয়েছে সেটা শুনতে না পারলেও দুজন যুবক যুবতীর মুখভঙ্গি দেখে সবটাই বুঝা যায়।বয়সতো আর কম হলোনা।আর মেয়েকে তিনি বেশ ভালো করেই চেনে।ভীষণ ইমোশনাল।বাস্তবতা থেকে মেয়েটা বহু দূরে অবস্থান করছে।নাহলে এমন চাল চুলোহীন কোনো ছেলের প্রতি দূর্বল হতো না।তিনি মনে মনে অনেক কিছুই মিলাতে বসেছেন।এই ভাবে মেয়েকে আবেগে গা ভাসাতে দিবেননা কখনো।পরিস্থিতি হাতের বাইরে যাবার আগে দ্রুতই কোনো পদক্ষেপ নিতে হবে।

___________________
জনসমাগম পূর্ণ স্থানে বসে আছে নাহিদ।একটা সমাবেশে যোগদান করেছে।চারদিকে মানুষের আনাগোনা।অন্য সব নেতারা একে একে ভাষণ দিচ্ছে।একটু পর নাহিদকে ও বক্তব্য দিতে ডাকা হবে।কিন্তু নাহিদের মন এই মুহূর্তে পড়ে আছে আরজু কাছে।আজ মেয়েটা তার উপর ভীষণ ক্ষেপে আছে।কারণটা কি? শুধু মাত্র বডিগার্ড হায়ার করার জন্য নিশ্চই না?ক্ষেপা আরজুকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে।ক্ষেপে গেলে আরজুর নাক আর কান লাল হয়ে যা।এটা নাহিদ অনেক বছর আগেই নোটিশ করেছে।আরজু সম্পর্কে এমন কি নেই যা সে জানে না?এতো বছরে আরজুকে সম্পূর্ণ জানা হয়েছে তার।কিন্তু অবাক করা বিষয় বউ তার সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না।নাহিদ চায়না আরজু নাহিদকে সম্পূর্ণ জানুক।থাকুক না কিছু বিষয় আড়ালে।

নাহিদ ফোনে আরজুর স্কুল ড্রেস পরা একটা ছবি বের করলো।সেখানে আরজু মাথায় হাত দিয়ে বিস্ময় নিয়ে সামনের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে।ছেলেটাকে নাহিদ খুব ভালো করেই চেনে।সেটা শুভ।আরজুর স্কুল লাইফ থেকে শুরু করে ভার্সিটি লাইফ অব্দি যত বন্ধু বান্ধব আছে সবার সম্পর্কেই নাহিদ ডিটেলস জানে।বোকা মেয়েটা জীবনে বন্ধু নির্বাচনে কোনো ভুল করেনি।অথচ নাহিদ এতো তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হয়েও বন্ধু চিনতে ভুল করেছে।নাহিদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।ঠিক তখনই তার ডাক পড়লো।নাহিদ উঠে মাইকের সামনে দাড়ালো।মানুষের মাঝে তখন তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছে।হয়তো তরুণ এই নেতাকে দেখে বাকি তরুণদের তারুণ্যের জয়গান বেজে উঠে।মানুষ নাহিদের ব্যাক্তিত্বের প্রশংসা বরাবর করে এসেছে।কিন্তু ভুল ত্রুটি নিয়েই জীবন।একজন পলিটিশিয়ান হয়ে চাইলেও নাহিদ নোংরা কাদা থেকে দূরে থাকতে পারেনি।কারণ যারা নোংরা তাদের সেই পদ্ধতিতেই প্রতিহত করতে হয়।ক্ষমতা পাওয়া সহজ কিন্তু সেই ক্ষমতা ধরে রাখা বেশ কঠিন।
নাহিদের ফোনে একটা মেসেজ আসতেই সেটা বক্তিতার মাঝেই কৌশলে ওপেন করলো।কারণ এসএমএস সাইফুল করেছে।আর সাইফুল তাকে একমাত্র আরজুর বিষয়ে জানাতে নক করবে।ম্যাসেজ চেক করে জানতে পারলো আরজু তার খালামনির বাসায় গেছে।নাহিদ সাইফুলকে বলে দিলো আরজুর বাসার আশেপাশেই থাকতে।

____________
আরজুকে দেখে তারা খুশিতে লাফিয়ে উঠলো।আরজুর পছন্দের খাবার রান্না করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো।আরজু আসার মিনিট পাঁচেক পরে বাসায় আসলেন জুবায়ের আহমেদ।আরজুকে হঠাৎ দেখে বেশ সারপ্রাইজ হয়ে গেলেন।পরম যত্নে আরজুকে বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন
-” আমার সুইটি পরীটা কেমন আছে?”

-” আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তোমরা সবাই কেমন আছো?”

-” হুম বেশি ভালো না।আমাদের বাড়ির উজ্জ্বল নক্ষত্র আমাদের আধারে ফেলে এখন অন্যত্র আলো ছড়াচ্ছে।”

খালুজান কথায় আরজুর মুখটা মলিন হয়ে পড়ল জুবায়ের আহমেদ মৃদু হেসে বলে উঠলো
-“এটাই তো নিয়ম মা।আমি ও তো তোর নানাভাইয়ের বুক খালি করে তোর রাফ অ্যান্ড টাফ খালামণিকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছি।”

জুবায়ের আহমেদের কথায় আরজু মুচকি হাসলো।জুবায়ের আহমেদ সাবা খানমকে ম্যাসেজ করে আরজুর বিষয়ে অবগত করে দিলেন।সাবা খানম রিপ্লাই দিলেন তিনি ব্যাস্ত।খালামণি যে এখনো তার উপর রেগে আছে সেটা আরজু স্পষ্ট বুঝতে পারলো।জুবায়ের আহমেদ আরজুর মন ভালো করার কাজে লেগে পড়লেন।

জুবায়ের আহমেদের ম্যাসেজ পেয়েই সাবা খানম অস্থির হয়ে উঠলেন।বেশ কয়দিন ধরেই আরজুকে দেখেন না।আগেও অফিসের কাজে বাসা থেকে দূরে থেকেছে।ফলে সবার সাথে অনেক দিন দেখা হতো না।কিন্তু এবার বিষয়টা ভিন্ন।মেয়েটা আজ পরের ঘরে চলে গেছে।চাইলেই আরজুকে দেখতে পারেনা।তাছাড়া নিজের উপরের শক্ত খোলসটা দেখাতে গিয়ে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন।তিনি দ্রুত তার অ্যাসিস্ট্যান্টকে ডেকে পরবর্তী মিটিংগুলো ক্যানসেল করে দিলেন।দ্রুত ব্যাগ নিয়ে বাসার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লেন।রাস্তায় আরজুর ফেবারেট আইসক্রীম নিতে ভুল করলেন না।
বাসায় পৌঁছেই দেখলেন আরজু সবার সাথে বসে টিভি দেখছে আর গল্পঃ করছে।আরজু খালামণিকে দেখে দৌড়ে এসে ঝাপটে ধরলো।এই মানুষটার মাঝে আরজু মাকে খুঁজে পায়।সাবা খানমের দুচোখে অশ্রু জমা হলো।কিন্তু অতি গোপনে সেই অশ্রু মুছে নিলেন।আরজু খালামণিকে পেয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো।সাবা খানম গম্ভীর স্বরে বললেন

-” এই ভাবে কাদছিস কেনো? ওই স্টুপিড তোকে কষ্ট দিয়েছে?দেখ আরজু আমার কাছে কিছু লুকাবি না।কোনো খারাপ ব্যাবহার করলে বল।ওকে চৌদ্দ শিকের ভাত খাইয়ে ছাড়বো।”

আরজু সাবা খানমের গালে উষ্ণ স্পর্শ দিয়ে বললো
-” নেতা সাহেব আমাকে মোটেও কষ্ট দেয়নি খালামণি।সে আমাকে অনেক ভালো রেখেছে।তুমি তার উপর এতো রেগে থাকো কেনো?সে রাজনীতিবিদ বলে? ট্রাস্ট মি খালামণি মানুষটা অন্য সবার চাইতে আলাদা।”

সাবা খানম মোটেও নাহিদকে নিয়ে কথা বলতে আগ্রহী না।তাই প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললেন
-” এমন শুকিয়ে যাচ্ছিস কেনো? ওই নেতার বাড়িতে তোকে ঠিক মতো খেতে দেয়না নাকি?”

আরজু হেসে বললো
-” উফফ!! খালামণি!! এমন ট্রিপিক্যাল শাশুড়িদের মতো কথা বলছে কেন? তোমাকে মোটেও শুট করছে না। আমার মর্ডান খালামনিকে মডার্ন শাশুড়ি রূপে জোস লাগবে।”

সাবা খানমের হাসি পেলেও সেটা চেপে গেলেন।জুবায়ের আহমেদ নিজের স্ত্রীকে খোঁচা মেরে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন
-” তুমি না ভীষণ ব্যস্ত।তাহলে এত জলদি বাসায় আসলে কি করে?”

সাবা খানম কঠিন দৃষ্টিতে জুবায়ের আহমেদের দিকে তাকালো।তারপর বললো
-” মিটিং ক্যানসেল হয়ে গেছে তাই।”

অবণী মৃদু হেসে বললো
-“হোয়াট আ কোনসিডেন্স।আপু বাসায় আসলো আর মাম্মার সব মিটিং একসাথে ক্যান্সেল হয়ে গেল।”

সাবা খানম রেগে সোফার কুশন অবনীর দিকে ছুড়ে মারলো। আর বাকি সবাই হেসে উঠলো।সারা বিকেল কাটিয়ে আরজু সন্ধার দিকে বাসায় ফিরে আসলো।

আজ নাহিদ রাত সাড়ে এগারোটার মধ্যেই বাসায় ফিরে আসলো।আরজু তো অনেকটা অবাক হলো।কারণ আরজু এই বাসায় আসার পর থেকে নাহিদকে রাত একটার আগে কখনোই আসতে দেখেনি।তার মানে মানুষটার মধ্যে পরিবর্তন আসছে।আরজুর ছোট্ট দেহের ছোট্ট হৃদয়টা খুশিতে নেচে উঠলো।নাহিদ ওয়াসরুমে ঢুকতেই আরজু দ্রুত নিচে নেমে কিচেনে ঢুকে পড়ল। সুমি ও আরজুর পেছনে পেছনে কিচেনে আসলো।আরজুকে কিচেনের চারদিকে ঘুরতে দেখে সুমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো
-” কিছু খুঁজছেন ভাবী?”

-” হুম!! তোমার ভাইয়ার জন্য চা বানাবো।উনি তো এসেই দেখি চা খায়।ভাবলাম আজ আমি তাকে চা করে খাওয়াবো।কিন্তু কোথায় কি আছে খুঁজে পাচ্ছি না।”

সুমি হেসে আরজুকে চায়ের সব ইংগ্রেডিয়েন্ট বের করে দিল। আরজু সুমিকে কিচেন থেকে বের করে দিয়ে বললো
-” আমি নিজে বানাবো।তোমার কোনো হেল্প ছাড়া বুজলে সুমি?”

কিন্তু সুমি নাছোড় বান্দা।দরজার আড়ালে দাড়িয়ে দেখতে লাগলো আরজুর চা বানানো।আরজুকে এক কাপ চায়ে ছয় চা চামচ চা পাতা দিতে দেখে সুমি বুজে গেলো এই রূপের রানী আজ প্রথম চা বানাচ্ছে।সুমি একবার ভাবলো আরজুকে থামবে।কিন্তু পরে ভাবলো থাকনা ভাবী এতো খুশি মনে বানাচ্ছে তাকে বাধা দিয়ে মন খারাপ করার মানে হয়না।তবে ভাইজান কি করে এই চা হজম করবে সেটাই ভাবার বিষয়।

নাহিদ ওয়াসরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো আরজু চা হাতে দাড়িয়ে আছে।কিন্তু খানিকটা খেয়াল করতেই দেখলো আরজুর হাতের কাপটা কেমন থর থর করে কাপছে।
নেতা সাহেবের উন্মুক্ত বুকে তাকিয়ে আরজু খেই হারিয়ে ফেললো।গ্রে কালারের টাউজার পরা মাস্কুলার বডি দেখে আরজুর বুকে ঝড় শুরু হলো।কোনো নেতার বুজি এমন অ্যাট্রাক্টিভ বডি থাকে? সে তো সারা জীবন ভুঁড়িওয়ালা নেতা দেখে অভ্যস্ত। এই নেতা কোন গ্রহ থেকে টপকে পড়েছিল তার জীবনে?

নাহিদ আরজুর কাছে এসে দাড়ালো।সদ্য স্নান করায় নাহিদের কায়া জুড়ে বডি সোপের সুগ্রান ভেসে আসছে।আরজু জোরে নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে চোখ বুজে ফেললো।মনে মনে নিজেকে বেহায়া বলে আখ্যায়িত করলো।নাহিদ আরজুর অবস্থা বুঝে মুচকি হাসলো।ভীষণ ইচ্ছে করলো আরজুর কাপা অধরে ঝাঁপিয়ে পড়তে।কিন্তু নিজের মনকে শান্ত করে আরজুর হাত থেকে কাপটা নিয়ে মৃদু স্বরে বললো

-” কোথাও ভূমিকম্প হচ্ছে নাকি?তোমার হাতের কাপটা যেভাবে কাপছে মনে হচ্ছে এক্ষুনি আমার মাথায় এসে পড়বে।”

আরজু শিউরে উঠলো।মনে মনে বললো
-” ভূমিকম্প তো আমার বুকে উঠেছে নেতা সাহেব।”

আরজু নিজেকে সামলে বললো
-” চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”

নাহিদ মুচকি হাসলো।আর বললো
-” চা কি তুমি বানিয়েছো?”

আরজু মাথা ঝাকিয়ে সম্মতি প্রকাশ করলো।নাহিদ চায়ে এক চুমুক দিয়েই বুজলো পৃথিবীর সবচাইতে মিষ্টি মেয়েটা পৃথিবীর সবচাইতে তেতো চা বানিয়েছে।কিন্তু মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে রেখে ধীরে ধীরে চা শেষ করলো।আরজু তখনও নাহিদের দিকে অধীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে।নাহিদ হেসে বললো

-“বেশ ভালো চা বানাতে পারো দেখা যায়।এই চা কন্টিনিউ করলে আমার কোনোদিন ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভবনা নেই। ভেরি গুড।”

আরজু খানিকটা কনফিউজড হয়ে পড়ল। চা টা কি আসলে ভালো হলো না খারাপ হলো সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না। এই নেতা সাহেব নিজের মতো কমপ্লিমেন্টও পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে দেয়।

দুজনেই এক সাথে রাতে ডিনার শেষ করলো।আরজু ভার্সিটির পরা শেষ করে নিলো।কারণ নেতা সাহেব কনফারেন্সে একটা মিটিং করছিলো।আরজু বুজলো মানুষটা তাকে সময় দেওয়ার জন্যই এই মিটিং কলের মাধ্যম রেখেছে।নাহলে হয়তো আজও অনেক রাত করে বাসায় আসতে হতো।নাহিদ মিটিং শেষ করে রুমে এসে আরজুর উদ্দেশে বললো

-” আরজু জলদি রেডি হয়ে নাও।”

আরজু অবাক হয়ে বললো
-” কেনো? কোথায় যাচ্ছি আমরা?”

নাহিদ ক্লোজেট থেকে কাপড় নামাতে নামাতে বললো
-” বাইক রাইডিং কেমন লাগে তোমার?”

আরজু বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে বললো
-” এত রাতে? বাইক রাইডিং?”

নাহিদ মুচকি হাসলো।আরজু ভীষণ খুশি হয়ে এক দৌড়ে নাহিদকে ঝাপটে ধরলো।রাতে বাইক রাইডিং তার ভীষণ পছন্দ।শুভর সাথে বহুবার এমন বের হয়েছে।আজ অনেক দিন পর রাইডিং করবে ভেবে আরজু খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে নাহিদকে ঝাপটে ধরলো।নাহিদ আরজুর এই কাজে প্রথমে অবাক হলো।পড়ে হেসে উঠলো। এতে আরজু ভীষণ লজ্জার মুখে পড়লো।ইসস!! আরজু আসলেই ভীষণ বেহায়া।