মিষ্টি রোদের হাতছানি পর্ব-৫৪+৫৫+৫৬

0
1407

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_54

বিকেলের শেষ ভাগে জারা মেকআপ রুমে বসে ফেস ক্লিন করছে।আজ তার একটা রাম্প শো ছিলো।এই কাজ সে প্রফেশন হিসেবে করে না। বরং এটা তার প্যাশন।গত সপ্তাহে একটা টেলিফিল্মের অফার পেয়েছে।কিন্তু জারা তাতে আগ্রহ দেখায় নি।মূলত গল্পটা তার তেমন পছন্দ হয়নি।কিন্তু ভালো স্ক্রিপ্ট পেলে অবশ্যই সে কাজ করবে।তার পরিবার থেকে ফুল সাপোর্ট আছে।বাবা মায়ের এক মাত্র আদরের মেয়ে সে।পরিবার তাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে নিজের জীবন নিজের মত গড়ার।জারার মনে হয় তার বাবা মায়ের মত এতো ব্রড মাইন্ডেড প্যারেন্টস আর একটাও এই গ্রহে নেই।বহুবছর আগে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন এই অদ্ভুত দুই প্রাণী।বিয়ের কয়েক বছর পরই জারার আগমন।তাদের ছোট্ট পরিবারটা যেনো পরিপূর্ন হয়ে উঠলো।জারার মতে মোস্ট রোমান্টিক কাপল তারা।প্রতি বছর তারা হানিমুনে যায়।যেমন এই বছর তাদের টার্গেট থাইল্যান্ড।জারা মুচকি হাসলো। সেও ঠিক এমন একজন মানুষকে জীবনে চায় যে তাকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভীষণ স্পেশাল ফিল করাবে।

এইসব ভাবনার মাঝেই জারার ফোন বেজে উঠলো।আরজু কল করেছে।গত কয়দিন যাবত মেয়েটার মন ভীষণ খারাপ।জারার মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় শুভর কান কেটে হাতে সরিয়ে দিতে।এই ফুলের মতো কোমল মেয়েটাকে এই ভাবে কষ্ট কেনো দিচ্ছে? এদের নাকি সেই বাল্যকালের বন্ধুত্ব।অথচ দুটোই বলদ।অকারণে মান অভিমান করে বসে আছে।আরে আমাদের আরজু রানী যেই অসাধ্য সাধন করেছে তাতে তো আরজুর হাতে বীরত্বের মেডেল ধরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন।আমাদের আরজু এক ক্ষমতাধর ধাম্ভিক নেতা পটিয়ে ফেলছে।যেনো তেনো কথা?জারার তো ভেবেই মন আনন্দে নেচে উঠে।

জারা কল ধরতেই আরজু বললো
-” ওই ঢঙ্গি কোথায় তুই?”

জারার হাসি মাখা মুখ মলিন হয়ে গেলো।রেগে বললো
-” আরেকবার টঙ্গী বললে কল কেটে দেবো।”

-” নাটক কম কর।আমার বাসায় আসতে পারবি?”

-” না পারবো না।আমি ভীষণ ব্যাস্ত।”

-“খবরদার আমাকে ব্যস্ততা দেখাবি না।”

জারা লিপস্টিক মুছতে মুছতে বললো
-” তোর নেতা সাহেবের বাসায়?”

-” হুম।”
________________________
জারা আরজুর বাসায় এসেছে।সোফায় বসে আশেপাশে চোখ বুলালো।এই বিশাল বাড়িটা সে অনেকবার দুর থেকে দেখেছে।কিন্তু আজ প্রথম এই বাড়িতে আসার সুযোগ হলো।জারা যখন এসেছে তখন আরজু বেরিয়ে এসেছিলো।জারা মনে হয়েছে কোনো রাজ্যের রানী এগিয়ে আসছে।রূপে গুনে অনন্য সেই নারী।আর তার নেতা সাহেব সেই রাজ্যের ধাম্বিক রাজা।যে যখন তখন তার গর্দান নেবে।

আরজু জারাকে সুমির সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো।জারা এসেই বুঝতে পাড়লো আধ পাগল আরজু মন ভালো করার জন্য বাইরে শপিংয়ে যাবে।আর শপিং মানেই এই দুই বান্ধবী এক সাথে।আরজু রেডি হতে চলে গেলো।আর সুমি গেলো জারার জন্য চা নাস্তার বেবস্থা করতে।

হঠাৎ ডোর বেল বাজাতেই জারা আশেপাশে তাকালো।না কাউকে দেখা যাচ্ছে না।জারা নিজেই গেলো দরজা খুলতে।কিন্তু দরজা খুলে সামনের মানুষটিকে দেখে অবাক হয়ে গেলো।জারার হতবম্ব মুখ দেখে সামনের ব্যাক্তিটি মুচকি হাসছে।জারা চেঁচিয়ে বলে উঠলো

-” তুমি এখানে? আমার পিছু নিতে নিতে এখানেও চলে এসেছো?এটা কার বাড়ি জানো?ভেতরে আসলে কি করে?সিকিউরিটি গার্ড গুলো কি করে?এতো বাজে সিকিউরিটি দিচ্ছে লোক গুলো?আরজুর লাইফ তো পুরোই রিস্কে আছে।”

জাহিদ মুচকি হেসে বললো
-“আমি তো দেয়াল টপকে এসেছি।”

জারার ভয়ে হাত পা কাপতে লাগলো।কি ডেঞ্জারাস কথা!জারা রেগে বললো
-” স্টুপিড ছেলে!! তুমি জানো এটা কার বাসা? এটা মেয়রের বাসা। নিবরাস নাহিদকে নিশ্চই চেনো?গর্দভ একটা!!গার্ডরা যদি টের পায় গুলি করে বুক ঝাঁজরা করে দিবে।”

জাহিদ কয়েক কদম এগিয়ে এসে জারার কাছাকাছি দাড়িয়ে বললো
-“আপনার জন্য এই বুক ঝাঁঝরা করতে দ্বিধা নেই।”

জারা শুকনো ঢোক গিললো।এই ছেলে নির্ঘাত পাগল হয়ে গেছে। হে আল্লাহ তুমি রক্ষা করো।জারা এবার রেগে বললো
-” মজনু হয়ে গেছো।ঠাটিয়ে এক চর মারবো।যাও এখান থেকে।যেই দেয়াল টপকে এসেছো ভদ্র ছেলের মতো সেখান দিয়েই ভাগো।”

ঠিক তখনই আরজু নিচে নেমে আসলো।আর বললো
-” কাকে বেরিয়ে যেতে বলছিস?”

আরজু এগিয়ে এসে দেখলো জাহিদ।আরজু হেসে কিছু বলার আগেই জারা আরজুর বাহু চেপে ভীতু ভীতু সরে বললো

-” দোস্ত এই পাগল ছেলে আমার পিছু পিছু চলে এসেছে।তুই একটু তোর বাসার গার্ডদের সামলে নে।আবার সুট না করে দেয়।বাচ্চা ছেলে বুঝতে পাড়েনি।দেয়াল টপকে চলে এসেছে।সব দোষ তোদের সিকিউরিটির।এমন বাজে সিকিউরিটি দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তোদের কাছ থেকে।বাচ্চা ছেলেটাকে অব্দি দেখতে পারলো না।”

আরজুর পেট ফেটে হাসি আসছে।পেছন থেকে জাহিদ ইশারায় হাসতে মানা করলো।আরজুর মনে দুষ্টু বুদ্ধি চাপলো।গম্ভীর স্বরে বললো

-” আমার কিছু করার নেই দোস্ত।নেতা সাহেবের রুলস এটা।অপরিচিত কেউ দেয়াল টপকে বাসায় আসলেই ধুম করে মেরে দেয়!!নিশ্চই এতক্ষনে গার্ডরা টের পেয়ে গেছে। এক্ষনি এসে বাচ্চাটাকে ধরে নিয়ে যাবে।তার পর কয়টা গুলি করবে আমি ধারণা করতে পারছি না।”

জারা ভীষণ ভয় পেয়ে গেলো।মুহূর্তেই বুকের মাঝে তীব্র উত্তেজনা অনুভব করলো।জাহিদকে এক টানে নিজের পেছনে লুকিয়ে নিয়ে বললো
-” আমি ওকে কিছু হতে দিবো না।”

আরজু গাম্ভীর্যতা বজায় রেখে জারার কানে কানে বললো
-” দোস্ত এই ছেলে তোকে দিন রাত ডিস্টার্ব করে।এটাই সুযোগ টপকে দেই।”

জারা পিঠ দিয়ে জাহিদকে দরজার সাথে আরো চেপে ধরলো।আর রেগে বললো
-” একদম ফালতু কথা বলবি না আরজু।তোর ওই নেতার সাথে থেকে হৃদয়টা পাথরের মতো শক্ত বানিয়ে ফেলেছিস।মনে কোনো দয়া মায়া নেই। ওকে কিছু করলে তোর নেতাকে আমি টপকে দিবো।”

জাহিদ জারাকে এতটা কাছে পেয়ে আবেগে হারিয়ে যাচ্ছে।মেয়েটা তার জন্য কয়টা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে।ইসস!! জাহিদ যেনো আবারও জারার প্রেমে পড়ে গেলো।জাহিদ জোরে শ্বাস নিলো।জারার চুল থেকে মাতাল করা সুবাস ভেসে আসছে।জাহিদ আলতো হাতে জারার চুল পিঠ থেকে সরিয়ে কাধে তুলে দিলো।জারা এসব কিছুই বুঝতে পারলো না।সে জাহিদকে আড়াল করে রেখেছে।জাহিদ ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে জারার কাধে আলতো চুমু খেলো।আরজু এসব দেখতে পারলো না।কিন্তু মুহূর্তেই জারার সারা শরীর জুড়ে অদ্ভুদ শিহরণ বয়ে গেলো।মেরুদন্ড বেয়ে শীতল রক্তের স্রোত বয়ে গেলো।জারা ভাবছে এই ছেলে একটা মানুষিক রোগী।এমন ক্রিটিকাল মোমেন্ট এই ছেলের রোমাঞ্চ জাগছে কি করে?জারাকে হঠাৎ থমকে যেতে দেখে আরজু হেসে ফেললো।বললো

-” আমার দেবরের প্রতি এতো মায়া তোর?আগে জানতাম না তো?”

আরজুর কথায় জারা যেনো বোকা বণে গেলো।থতমত খেয়ে আরজুর দিকে তাকিয়ে রইলো।পেছন থেকে জাহিদ হেসে বললো

-” মায়া তো অনেক আছে।কিন্তু আপনার বান্ধবী সেটা স্বীকার করবে না ভাবি।”

জারার দ্রুত জাহিদের সামনে থেকে সরে দাঁড়ালো।দুজনের দিকেই হা করে তাকিয়ে রইল।এই মুহূর্তে তার সাথে ঠিক কি প্রাঙ্ক হলো সেটা বুঝতে চেষ্টা করলো।

জারাকে মুখ ফুলিয়ে বসে থাকতে দেখে আরজু বললো
-” এমন বেলুনের মতো ফুলিয়ে আছিস কেনো?”

জারা রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে বললো
-” তুই আমার বন্ধু না। আমার সাথে এমন মজা করতে পারলি।আমার চাইতে এই দেবর বেশি হয়ে গেলো? নিজের দেবরকে আমার পিছনে এভাবে লাগিয়ে দিয়েছিস?”

-” এই আমি মোটেও এমন কিছু করিনি। জাহিদ নেতা সাহেবের ছোট ভাই সেটা আমি নিজেই জেনেছি মাত্র কয়দিন আগে।”

-“তাহলে আমাকে জানাস নি কেন?”

আরজু মুচকি হেসে বললো
-” তোর রিয়েকশন দেখার জন্য।”

জারা রেগে একটা কুশন আরজুর দিকে ছুঁড়ে মারল।কিন্তু আরজু সরে যাওয়ায় সেটা গিয়ে পড়লো জাহিদের উপর।জাহিদ কুশন হাতে নিয়ে বললো

-” বেয়াইন সাহেবা বালিশ ছুড়ে জানে মারার প্ল্যান করেছেন নাকি?”

জারা ভীষণ রেগে উঠে দাড়ালো।আর আরজুকে বললো
-” আমি তোর সাথে কোথাও যাচ্ছি না।আর এই বাঁদর তোর দেবর জানলে এই বাসায় জীবনেও আসতাম না।তোর সাথে আমার সব বন্ধুত্ব এখানেই শেষ।এতদিনের পুরনো বন্ধুত্বকে এই দুই দিনের দেবরের জন্য ভুলে গেলি।আমার সাথে এমন মজা করতে পারলি?”

পেছন থেকে জাহিদ হেসে বললো
-” বন্ধুত্ব শেষ হলে সমস্যা নেই।আপনাদের দুজনের তো নতুন সম্পর্ক শুরু হতে যাচ্ছে।”

জারা প্রচন্ড রেগে চলে গেলো।আরজু ডাকলেও শুনলো না।এদিকে জাহিদ হেসে কুটি কুটি হচ্ছে।আরজু মন খারাপ করে বললো

-” আমার বন্ধুবিকে এই ভাবে রাগিয়ে ঠিক করনি দেবরজী।”

জাহিদ হাসতে হাসতে বললো
-” আপনার ফ্রেন্ড সব সময় এমন রেগেই থাকে ভাবী।এটা আর নতুন কি?”
____________________
আজ সন্ধার দিকেই নাহিদ বাসায় ফিরে আসলো।সাথে এসেছে তার অ্যাসিস্টেন্ট আসিফ।বাসায় এসেই নাহিদের তোর জোর দেখে আরজু কিঞ্চিৎ চিন্তিত হলো।আর নাহিদকে প্রশ্ন করলো

-” আপনি কি কোথাও যাবেন নেতা সাহেব?”

নাহিদ একটা ব্যাগ বের করতে করতে বললো
-” হুম।আমাকে তিন দিনের জন্য সিলেট যেতে হবে।তুমি একা থাকতে পারবে না?”

আরজুর মুখটা মলিন হয়ে গেলো।মন খারাপ করে মনে মনে বললো
-” আপনাকে ছাড়া আমি এক দিনও থাকতে পারবো না।আপনার গম্ভীর মুখটা না দেখলে আমার বক্ষস্থলে তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়।”

কিন্তু আরজু এসব কিছু বলতে পারলো না।মন খারাপ করে বললো
-” যাওয়া কি জরুরী?”

নাহিদ আরজুর দিকে তাকালো।মেয়েটার মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে।নাহিদ ব্যাগ রেখে আরজুর সামনে দাড়ালো।আরজুর কোমল মুখখানা দুই হাতে স্পর্শ করে নিজের দিকে ফিরালো।আরজু অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে রইলো নাহিদের দিকে।নাহিদ মুচকি হেসে বললো

-” পার্টি অফিসের কাজ আছে।যেতেই হবে আরজু।কিন্তু আমার ঘরের চাঁদটা এমন মেঘে ঢেকে থাকলে আমার যেতে ভালো লাগবে না।”

আরজু চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রইলো।পায়ের তলা কেমন শিরশির করছে।খানিকটা লজ্জা লাগছে।মানুষটা আজ প্রথম এমন আবেগপ্রবণ,রোমাঞ্চকর কোনো কথা বললো।সব সময় এমন কেনো থাকে না?

নাহিদ আরজুর কপালে পরম আদরে নিজের ওষ্ঠজোড়া ছুঁয়ে দিলো।আরজু মুহূর্তেই কেপে উঠলো।নেতা সাহেবের সামান্য স্পর্শ আরজুর ভেতরে অনুভূতির ঝড় তুলে দেয়।নাহিদ আবার বললো

-” নিজের খেয়াল রাখবে।আমি দ্রুত আসার চেষ্টা করবো।আর ফিরে এসে তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।বাইরে যেতে হলে সাইফুলকে নিয়ে বের হবে।বুজলে?”

আরজু মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করলো।এই মুহূর্তে সারপ্রাইজ নিয়ে আরজুর মাথা ব্যাথা নেই।সে নেতা সাহেবের বিরহে কাতর।নাহিদ দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে আরজুকে আলতো জড়িয়ে ধরলো।তারপর আসিফকে নিয়ে বের হয়ে গেলো।যাবার আগে সুমিকে আরজুর খেয়াল রাখতে বলে গেলো।আরজু দরজায় দাড়িয়ে নেতা সাহেবের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।মন চাইছে দৌড়ে নেতা সাহেবকে আটকে দিতে।

নির্জন রাস্তায় গাড়ি ছুটে চলছে।নাহিদের কেমন অস্থির অনুভব হচ্ছে।বুকের ভেতর শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে।আগে বহুবার বাড়ির বাইরে অনেকদিন থাকলেও এইবার অসম্ভব খারাপ লাগছে।মনে হচ্ছে নিজের প্রাণটা পেছনে ফেলে এসেছে।বিয়ে করে আসলেই বউ পাগল হয়ে গেছে।আরজু ছাড়া সব কেমন শূন্য লাগে।আরজুর চোখে যখনই নাহিদ নিজের জন্য অজস্র ভালোবাসা দেখে তখন নিজের জীবনকে সার্থক মনে হয়।আরজুর চোখে সে ভালোবাসা,কাতরতা,আকাঙ্খা সবটাই দেখেছে।আরজু তার সান্নিধ্য কামনা করে।নাহিদ নিজেও চায় বউটাকে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখতে।আরজুর জন্য জমানো এত বছরের ভালোবাসা উজাড় করে দিতে।কিন্তু নাহিদের মনে ভয় কাজ করে।কোনোভাবে নিজের জীবনে আরজুকে জড়িয়ে ঠকাচ্ছে না তো?মেয়েটা কাছে অব্দি যেতে দ্বিধা কাজ করে তার।
_______
রামিম অনেক জোরাজুরি করেও মাকে হসপিটালে নিতে সক্ষম হলো না।আঞ্জুমান আরা ছেলেকে বললেন
-” স্কুলে বাচ্চাদের পরীক্ষা চলছে।তাই একটু স্ট্রেস যাচ্ছে।তুই এতো টেনশন কেনো করিস বাবা।”

রামিম মায়ের হাতে হাত রেখে বললো
-” মা তুমি জবটা ছেড়ে দাও।আমি তো টিউশনি করছি।দরকার পড়লে পার্ট টাইম জব খুঁজে নিবো।আর এটাই আমার লাস্ট ইয়ার।এক্সাম শেষ করে স্কলারশিপ এর জন্য বাইরের কোন কান্ট্রিতে ট্রাই করবো। তুমি আর এতো স্ট্রেস নিও না। এবার আমাকে সুযোগ দাও তোমার সেবা করার।”

আঞ্জুমান আরা তৃপ্তির হাসি হাসলেন।ছেলেটা আসলেই অনেক বড়ো হয়ে গেছে। এবার আর তার চিন্তা নেই।ছেলে একা নিজেকে ঠিক সামলে নিতে পারবে।তিনি হেসে বললেন
-” তোকে এসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।আগে লাস্ট ইয়ার শেষ কর।ভালো রেজাল্ট করতে হবে।তার পর সব হবে।তাছাড়া জব ছেড়ে বাসায় বসে থাকলে আমি সত্যি সত্যি অসুস্থ হয়ে পড়বো।তুই স্টাডি শেষ করে একটা বিয়ে করে বউ এনে দিলে, তখন আমি জব ছাড়বো।আর যদি তোর বউ আমাকে রাখতে না চায় তবে দূরে চলে যাবো।”

রামিম অন্য মনস্ক ভাবে জবাব দিলো
-” সাবিহা এমন না।ও কখন এমন করবে না।”

কথাটা বলে নিজেই চমকে গেলো।আঞ্জুমান আরা মুচকি হাসলেন।রামিম বেশ ইতস্তত বোধ করলো।দৃষ্টি এলোমেলো হলো।আঞ্জুমান আরা হেসে বললেন
-” সাবিহাকে অনেক ভালবাসিস?”

রামিম অস্থির হয়ে বললো
-” তেমন কিছু না।সারাদিন বন্ধুদের সাথে থাকি তাই ওদের নাম মুখ ফস্কে বের হয়ে গেছে।”

-” সবার না একজনের নাম।”

আঞ্জুমান আরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন
-“দোয়া করি দিন শেষে তোদের ভালোবাসা পূর্ণতা পাক। তোদের একটা সুন্দর সংসার হোক।”

রামিম আর কিছু বললো না।দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে আসলো।মা অবুঝের মতো কেনো কথা বলে।সাবিহাকে পাওয়া অসম্ভব।আবেগে হারিয়ে বাস্তবতাকে ভুলে যাওয়া নিতান্তই বোকামি।

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_55

সময় চলছে তার নিজ গতিতে।সময় যেমন থেমে থাকে না, তেমনি মানুষের জীবনও চলে নিজ গতিতে।শুভর জীবনের ক্ষেত্রেও তাই।আরজুকে ছাড়া তার জীবন চলছে ঠিক কিন্তু তাতে কোনো প্রাণ নেই।নেই কোনো উৎসাহ,উদ্দীপনা। আরজুকে সে এড়িয়ে চলছে প্রতিনিয়ত।মেয়েটা যখনই তার সামনে আসছে তখনই বক্ষস্থলের পীড়া আরো গাঢ় হয়ে যায়।শুভর বার বার মনে হয় কেনো এই মেয়েটা তার হলোনা।যেই মানুষটিকে প্রতিনিয়ত নিজের ভেবে এসেছে সে হুট করেই অন্যের হয়ে গেলো?এটা কি আসলেই মেনে নেওয়া সহজ?শুভর ক্ষেত্রে তো না।

শুভ নিজের রুমের বারান্দায় বসে আছে।পাশের টবের ক্যাকটাস গাছটায় তার নজর পড়লো।তার কোনো এক জন্মদিনে আরজু তাকে এটা বার্থডে গিফট হিসেবে দিয়েছিল।আর ঠোঁট টিপে হেসে বলেছিলো

-” তোর জীবন এই ক্যাকটাসের মত অমসৃণ আর কাটাযুক্ত হোক। শালা তোর এই কাটাময় জীবনকে যেই মেয়ে সাদরে গ্রহণ করবে তাকেই ঝাপটে ধরবি।কারণ সেই নারী তো মহান।তোর মতো বাঁদরের গলায় ঝুলে পরা তো সহজ কাজ না।তাই সেই নারীর প্রতি অগ্রিম সেলুট।”

শুভ আরজুর কান মলে বলেছিলো
-” সেই কাটায় আবার তোকে না আটকাতে হয়।দেখে শুনে উইশ করিস।”

আরজু বিরক্ত হয়ে কান ঘষতে লাগলো আর বললো
-” আমি কোনো কাটায় আটকাবো না,আমি তো স্কেলেটন ফ্লাওয়ারের মতো কারো জীবনে আটকাবো।এই ফুলের পাপড়ি যেমন বৃষ্টিসিক্ত হলে সাদা রং মুছে স্বচ্ছ কাচ বা বরফের ভাস্কর্য মতন দেখায়, এবং পাপড়ির শিরাউপশিরা দৃশ্যমান হয়ে কংকাল স্বাদৃশ্য হয় ।তেমন সেই মানুষটাও আমার ভালোবাসায় নিজের কঠোরতা ভুলে আমার সামনে কোমল, নমনীয় আর স্বচ্ছ হয়ে উঠবে।যার মনটা আমি খুব সহজেই পড়তে পারবো।”

শুভ আরজুর মাথায় এক চাপড় মেরে বলেছিলো
-” মোটেও না।তোর কপালে এক ভেজাল লোক থাকবে।যার মন পড়া দূরে থাক, তার নজর অব্দি পড়তে পারবি না।সবটাই থাকবে ধোঁয়াশা।”

অতীতের সেই কথা ভেবে শুভ নিজেই হাসলো।আসলেই কি তার সেই কথা সত্যি হয়ে গেলো? নিবরাস নাহিদকে কি আরজু আসলেই পড়তে পারছে?কারণ তার জানা মতে নিবরাস নাহিদ বেশ তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যাক্তি।আর বেশ প্রফেশনাল।রাজনীতি এতো সচ্ছ না যেটা উপর থেকে দেখা যায়।নাহিদ ও তার বিপরীত নয়।এই অস্বচ্ছ দুনিয়ায় আরজু নিজেকে না হারিয়ে ফেলে!!আরজুর মতো বোকা মেয়ে আসলেই কি সেই নেতার জীবনের সুস্থ ভাবে টিকে থাকতে পারবে?সঠিক আর ভুলের মাজের তফাৎ কি ধরতে পারবে?
শোভা এক কাপ কফি এনে শুভকে দিলো।আর পাশের ফাঁকা চেয়ারে বসলো। ভাইয়ের মলিন মুখশ্রী তাকে ভীষণ পীড়া দেয়।সব সময় হাসি খুশি থাকা মানুষটা আজ কতটা শান্ত হয়ে আছে। শোভার হঠাৎ সেদিনের কথা মনে পড়লো।

অনেকদিন শুভর সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে আরজু তাদের বাসায় এসেছিলো।তখন বাবা মা বাসায় ছিলো না। শোভা প্রথমে আরজুকে দেখে ভীষণ রেগে গেছিলো।মনের মাঝে আরজুকে নিয়ে বেশ ক্ষোভ জমা ছিলো।ভেবেছিল আরজুকে সে ঢুকতেই দিবে না।কিন্তু আরজু তাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই সোজা শুভর রুমের দরজার কাছে চলে এসেছিল। শোভার ভীষণ রাগ হয় তখন।যেই মেয়েটার কারণে আজ তার ভাই এতটা মানুষিক যন্ত্রণা মাঝে আছে সেই মেয়েটা কোন অধিকারে এই ভাবে বাসায় ঢুকে পড়ছে?কিসের এই অধিকারবোধ?পরক্ষনেই মনে পড়লো এটাতো নতুন না।এমন অধিকারবোধ তো আরজু আগে থেকেই দেখিয়ে এসেছে।

আরজু শুভর দরজায় অনেকক্ষণ করোঘাত করে।কিন্তু শুভ দরজা খুলেনি।কারণ শুভর মনে তখন চলছিল ঝড়।আরজুর মুখোমুখি সে হতে চায়নি।আরজু অনেকক্ষন ডেকে হয়রান হয়ে পড়লো।আরজু একটা সময় কান্নায় ভেংগে পরে।আর বলতে থাকলো

-” আমার সাথে এমন কেনো করছিস শুভ।আমি জানি তোর কাছে সবকিছু লুকানো ঠিক হয়নি।কিন্তু বিশ্বাস কর সবার আগে আমি তোকেই জানাতে চেয়েছিলাম।এই ভাবে আমার উপর অভিমান করে থাকিস না।তুই আমাকে না বুজলে কে বুজবে?আমি জীবনে সবচাইতে আপন মানুষগুলোকে হারিয়ে খালামণি ,খালুজান আর তোকে পেয়েছি।আজ যদি তুইও মাম্মা, পাপার মতো হারিয়ে যাস তবে আমি মানতে পারবো না।আমাদের এতো বছরের বন্ধুত্বে তোর এই কঠিন অভিমানকে জায়গা দিসনা।কারণ আমার জীবনে তোর জায়গাটা অনেক স্পেশাল।যেটা কাউকে দিতে পারবো না।এমনকি নেতা সাহেবকেও না।”

সেদিন আরজুর প্রতিটা কথায় শোভা ভালোবাসা দেখেছিল।কিন্তু সেটা সাধারণ ভালোবাসার উর্ধ্বে তীব্র বন্ধুত্বের ভালোবাসা ছিলো। শোভার মনে হয়েছিলো এমন গভীর বন্ধুত্ব কি তার জীবনে আছে? না!!একটাও নেই।এইভাবে মান ভাঙ্গার মতো একটা বন্ধুত্বও তার নেই।তার মানে তার ভাই আর আরজুর মধ্যোকার বন্ধুত্ব ভীষণ স্পেশাল। শোভার প্রথম মনে হলো যেই অধিকার বোধে আরজু ঘরে ঢুকেছিলো সেটা ছিল বন্ধুত্বের অধিকার।যা আরজু সেই বাল্যকাল থেকে ধীরে ধীরে অর্জন করেছে।সেদিন শোভা বুঝতে পেরেছিল আরজুর মনে শুভকে নিয়ে একটা বিশেষ অনুভূতি রয়েছে।সেটা প্রেমিক যুগলের প্রেমের অনুভূতির চাইতেও পবিত্র আর তীব্র কোনো অনুভূতির সম্পর্ক।যাকে সাধারণ প্রেম বলা ভুল হবে।সেদিন শোভার প্রথম মনে হয়েছে আরজু তার ভাইকে কখনো প্রেমিকের নজরে দেখেনি।

আগের কথা ভেবে শোভা ভাইয়ের দিকে তাকালো।শোভাকে এই ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে শুভ বিরক্ত হয়ে বললো

-” এই ভাবে কি দেখিস?”

শোভা ভনিতা ছাড়াই প্রশ্ন করলো
-“আচ্ছা ভাইয়া তোমার কাছে ভালোবাসা বড়ো নাকি বন্ধুত্ব।”

শোভার প্রশ্নে শুভ থমকালো। শোভার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রইলো কিছুক্ষণ।পরমুহুর্তে কফিতে এক চুমুক দিয়ে মেকি হেসে বললো
-” এতো কঠিন প্রশ্ন কেনো করছিস?”

-“জানা প্রয়োজন তাই।”

-” ভালোবাসা আর বন্ধুত্বে ছোট বড়ো বলে কিছুই নেই।দুটোই জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।ভালোবাসার সম্পর্ক প্রণয় অনুভূতি থেকে আসে।ভালোবাসার জন্য একটা মুহূর্তই যথেষ্ঠ।আর বন্ধুত্ব।সেটা আমরা ধীরে ধীরে অর্জন করি।একটা মানুষকে খুব কাছথেকে জেনে তার প্রতি ধীরে ধীরে একটা আস্থা তৈরি হয়।আর তা থেকে বন্ধুত্ব তৈরি হয়।
আমার জীবনে দুটোই এসেছে।আমার সবচাইতে ভালো বন্ধুত্ব একসময় আমার অজান্তেই ভালোবাসায় রূপ নিয়েছে।”

শোভা ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো
-“তার মানে ভালোবাসা তোমার অগোচরে হয়েছে।যাতে তোমার কোনো হাত ছিলো না।কিন্তু বন্ধুত্ব জন্মেছে আস্থা থেকে,অতি যত্নে নিজ হাতে তৈরি হয়েছে এই সম্পর্ক।যেটা দিন দিন আরো অটুট হয়েছে তোমাদের দুজনের মধ্যকার বিশ্বস্ততায়।একে অপরের প্রতি এতটাই বিশ্বাস ছিল যে, নিজেদের অতি গোপন কথা একে অপরকে খুব সহজে বলে দিতে পারতে।মনের কষ্টগুলো নির্দ্বিধায় অন্যকে প্রকাশ করতে পারতে।একজন পুরুষ হয়েও সেই মানুষটার সামনে অশ্রু বিসর্জন দিতে দ্বিধা বোধ করেনি।আরজু তোমার কাছে নিজেকে এতটাই নিরাপদ বোধ করতো যে গভীর রাতে তোমার বাইকে চরে দুর দূরান্তে চলে যেত দ্বিধাবোধ করতো না।আমার দৃঢ় বিশ্বাস আজ যে কোনো বিপদে আরজু তোমাকেই সর্ব প্রথম মনে করবে।তাইনা ভাইয়া?”

শুভ কোনো জবাব দিলো না।নিস্তব্দ হয়ে বসে রইলো।শোভা শুকনো ঢোক গিলে আবার বললো

-” সেই ছোটবেলা থেকে তিলে তিলে গড়া সুন্দর বন্ধুত্বে এই অগোচরে আসা ভালোবাসা কি করে ভারী পড়ে গেলো ভাইয়া?এতদিনের যত্নে গড়া বন্ধুত্বের সম্পর্ক কি এই অনাকাঙ্ক্ষিত ভালোবাসার অনুভূতির কাছে হেরে যাচ্ছে?যেই অনুভূতি ছিলো শুধুই একপাক্ষিক।”

শুভ থমথমে অবস্থায় বসে রইলো।মন মস্তিষ্ককে চলছে হাজারো যুদ্ধ।মনে হচ্ছে স্নায়ু কোষ স্থির হয়ে আসছে।শোভার প্রতিটা কথা তার মস্তিষ্ককে বিশৃংখলা সৃষ্টি করছে।শুভকে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে দেখে শোভা উঠে চলে গেলো।তার ভাই যথেষ্ট বুদ্ধিমান।ভালোবাসার অনুভূতির জন্য এত পুরনো বিশেষ মূল্যবান সম্পর্ককে কি ভাবে দেখা উচিৎ সেটা তার ভাই নিশ্চই জানে।।একতরফা ভালোবাসায় দগ্ধ হয়ে নিজেকে অন্ধকারে হারিয়ে ফেলুক সেটা শোভা চায়না।তার ভাই আরজুর প্রতি সৃষ্টি হাওয়া ভালোবাসাকে মনের গহীনে সম্মানের সাথে জমিয়ে সামনে এগিয়ে যাক।জীবনে চলার পথে নিশ্চই এমন কেউ আসবে যে ভাইয়ার এই একতরফা ভালোবাসার যথাযথ মূল্যায়ন করে তাকে উজাড় করে ভালোবাসবে।ভুলিয়ে দেবে এই না পাওয়ার যন্ত্রণাকে।
_____________
কাজ শেষ করে মাত্রই হোটেলে ফিরেছে নাহিদ।রুমে এসেই একরাশ ক্লান্তি এসে ভর করেছে তাকে।বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো।নাহিদ ফোন বের করে আরজুকে ভিডিও কল করলো।আরজু যেনো তার কলের অপেক্ষায় ছিল।দ্রুতই সে কল রিসিভ করলো।মুহূর্তেই নাহিদের ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠলো স্নিগ্ধ এক মুখশ্রী।নাহিদ আলতো হাসলো।এই মুখটা দেখেই সব ক্লান্তি নিমিষেই পালিয়েছে।নাহিদ ক্লান্ত স্বরে বললো

-” কেমন আছো আরজু।”

আরজু মুখটা মলিন করে বললো
-” একদম ভালো নেই।ভীষণ শূন্যতা অনুভব করছি।”

নাহিদ বাঁকা হেসে বললো
-” এই শূন্যতা কাটানোর জন্যই বুজি আমার পাঞ্জাবি পড়ে বসে আছো?”

আরজু ভীষণ লজ্জা পেলো।মাথা নিচু করে নিচের ঠোঁট কামড় ধরলো।এই অসভ্য লোকটা সব দিকেই নজর রাখে।নাহিদকে প্রচন্ড মিস করছিলো আরজু।তাই ক্লজেট থেকে নাহিদের একটা পাঞ্জাবি পড়বে বলে ভেবেছে।মানুষটাকে বুকে জড়াতে না পারলেও পাঞ্জাবি তো জড়ানো যাবে।কারণ তাতে নেতা সাহেবের কায়ার স্পর্শ,সুভাস মিশে আছে।কিন্তু ক্লজের খুলে দেখলো সব পাঞ্জাবী সাদা রঙের।আরজুর মেজাজ খারাপ হলো।এই দুনিয়াতে এতো রং থাকতে মানুষটাকে শুধু সাদাই কেনো পড়তে হবে?আরজু মনে মনে ভেবে নিলো নেতা সাহেবের জন্য সে নিজে শপিং করবে।আর রংবেরংয়ের পাঞ্জাবি কিনে আনবে।আরজু একটা পাঞ্জাবি নিয়ে পড়ে ফেললো।কিন্তু এই পাঞ্জাবি তার মতো শুকনো শরীরের কাছে জুব্বা মনে হচ্ছে।আরজুকে চুপ থাকতে দেখে নাহিদ বললো

-” লজ্জা পেলে? লজ্জা কিন্তু নারীর সৌন্দর্য আরো কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়।”

আরজু লাজুক হেসে বললো
-” তার মানে আপনার চোখে আমি সুন্দর।”

নাহিদ মুচকি হাসলো।আর বললো
-” আমার চোখে তুমি মায়াবী,স্নিগ্ধ,কোমল।”

আরজুর সারা দেহে শিহরণ বয়ে গেলো।এই মানুষটা যে তার বাহ্যিক সৌন্দর্য কে ছাপিয়ে অভ্যন্তরে সৌন্দর্যের খোঁজ করেছে সেটা আরজুর হৃদয় ছুঁয়ে গেলো।আরজু বুঝতে পাড়ছে নাহিদের গম্ভীর সত্তার শক্ত খোলসটা ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে।হয়তো নেতা সাহেবের মনের কোথাও না কোথাও তার জন্য প্রেমের পদ্ম ফুটে উঠছে।কিন্তু আরজু তো জানেই না তার নেতা সাহেব তার জন্য বুকে এক সমুদ্র ভালোবাসা জমিয়ে রেখেছে।

*********************

নিস্তব্দ রাস্তায় ছুটে চলছে নাহিদের গাড়ি।তিনদিন পর ফেরার কথা থাকলেও দুই দিনেই সে কাজ শেষ করে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিয়েছে।আরজু মেয়েটা আগে তার মাথা খারাপ করে রেখেছিল আর এখন তার সস্তি টুকু কেরে নিয়েছে।মেয়েটার কাছথেকে এতো বছর দূরে থেকেছে অথচ এখন এক দিনও বছরের মতো লাগছে।সারাক্ষণ অস্থিরতায় ঘিরে ধরে রেখেছে তাকে।এই অস্থিরতা আরজুকে না দেখা অব্দি কমবে না।একদিন আগেই বাসায় পৌঁছে আরজুকে একটু চমকে দিবে সে।আরজু নিশ্চই খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠবে।

এতসব ভাবনার মাঝেই নাহিদের ফোন বেজে উঠলো।কল রিসিভ করতেই অপর পাস থেকে এক পুরুষালি কণ্ঠ বলে উঠলো

-” নিবরাস নাহিদকে আজকাল পাওয়াই যায়না।আকাশের চাঁদ হয়ে গেছে,নাকি জীবনে চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে কোনটা?”

নাহিদের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো।মানুষটাকে সে খুব ভালো করেই চেনে।নাহিদ গম্ভীর সুরে বললো
-” চাঁদ হয়েছি নাকি চাঁদের দেখা পেয়েছি সেটা তোর দেখার বিষয় না।নিজের চরকায় ওফফ!! সরি লিয়াকত আলীর মাথায় তেল দে।”

অপর পাশের মানুষটি খানিক হেসে বললো
-” শুনলাম এবার এমপি হওয়ার সাধ জেগেছে।”

নাহিদ বাঁকা হেসে বললো
-” সেটা বহু আগে থেকেই জেগেছে।তোর চাইতে ভালো কে জানে।তোর লিডারকে বলে দিস এবার তার গদিতে চরার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যাবে।”

অপর পাশের মানুষটা এবার গম্ভীর স্বরে বললো
-” সেটা সময় বলে দিবে।রায়হান কে কোথায় রেখেছিস?”

নাহিদ বাঁকা হাসলো।জানালার বাইরে দূরের আকাশে চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললো
-” কোনো মেয়ের সম্মানে আঘাত হানলে আমরা তার জন্য কি শাস্তির বেবস্থা করতাম মনে আছে? আর তোর লিডারের বোনপো তো সম্মান হানির সাথে মেয়েটাকে মার্ডার করেছে।তাহলে তার শাস্তি কেমন হবে বুঝতেই পারছিস।”

-” লিয়াকত আলীকে চিনিস না।তার বোনপোর কিছু হলে তোর জীবনে কি ধ্বংসলীলা শুরু হবে জানিস তো?নিজের ভালো চাইলে ওকে ছেড়ে দে।”

নাহিদ খানিকটা রেগে বললো
-” তোর মত বিশ্বাসঘাতকের কাছে আমার ভালো আশা করা যায়না।”

-“ঠিক আছে।তবে নিজের পরিণতির জন্য অপেক্ষা কর।”

কথাটা বলেই লোকটি কল কেটে দিলো।রাগে নাহিদের শরীরের রক্তকণিকা ফুটতে শুরু করলো।এই মানুষটিকে নাহিদ প্রচন্ড ঘৃনা করে।এই মানুষটা তার জীবনের বিপর্যয়ের জন্য অনেকাংশে দায়ী।নাহিদ হয়তো কবেই এই মানুষটার চিন্হ পৃথিবী থেকে মুছে দিতো।কিন্তু সে এক ক্ষমতাধর এমপির ছত্রছায়ায় নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে।তাছাড়া নাহিদ অতীতের এক অদৃশ্য মায়ার জন্য মানুষটাকে শেষ করেদিতে পারেনা।মায়া বড্ডো খারাপ জিনিস।

নির্জন রাস্তায় নির্বিকারে ছুটে চলছে নাহিদের গাড়িটি।নাহিদ নিজের মেজাজ ভালো করতে ফোনে আরজুর ছবি দেখতে লাগলো।তার বুকে প্রশান্তি দেওয়ার এক মাত্র মাধ্যম আরজু।ছবিতে আরজু একটা সাদা কুর্তি আর লেগেন্স পরা।শপিং মলের সামনে দাড়িয়ে বিরক্ত চোখে সামনে তাকিয়ে আছে।তার পেছনেই জারা।এই ছবিটা আজ থেকে প্রায় তিন বছর আগের।নাহিদ কাজের প্রেসারে অস্থির হয়ে একটু প্রশান্তির খোঁজে আরজুর পেছনে ছুটেছিল।দুর থেকে এক পলক দেখে যেনো নাহিদের মন ভরে না।তাই জুম করে বেশ কয়েকটা ছবি তুলে নিয়েছিলো।

হঠাৎ গাড়ি ব্রেক করায় ভাবনা থেকে বেরিয়ে নাহিদ চমকে সামনে তাকালো।আসিফকে উদ্দেশ্য করে বললো
-” কি হয়েছে আসিফ?”

-” স্যার ঠিক বুঝতে পারছি না।হঠাৎ থেমে গেলো।আমি নেমে দেখছি।”

আসিফ একটু পরই জানালো টায়ার পাঞ্চার হয়ে গেছে।নাহিদ বেশ বিরক্ত হলো।গভীর রাতে নির্জন রাস্তায় গাড়ি থেকে নেমে দাড়ালো নাহিদ।বাইরে স্নিগ্ধ হাওয়া বইছে।নাহিদ দেখলো আসিফ টায়ার বদলাতে বেস্ত।হঠাৎ রাস্তায় পরে থাকা কিছুর দিকে নাহিদের নজর যায়।সে সেটা হাতে তুলে নিল।দেখলো খুব সূক্ষ্ম পিন জাতীয় কিছু।নাহিদ ভালো করে তাকিয়ে দেখলো আরো বেশ কিছু এমন পিন রাস্তায় পড়ে রয়েছে।মুহূর্তেই নাহিদের মস্তিষ্ক আসন্ন বিপদের জানান দিলো।নাহিদ বেশ চিন্তিত হয়ে আসেপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে দ্রুত আসিফকে উদ্দেশ্য করে বললো

-” আসিফ এটা একটা ফাঁদ।আশেপাশে কেউ আছে।দ্রুত গাড়িতে যাও।কুইক।”

বিচক্ষণ আসিফ মুহূর্তেই পরিস্থিতি বুঝতে পারলো। টায়ার ততক্ষণে লাগানো হয়ে গেছে।সে দ্রুত গাড়ির দিকে ছুটে গেলো।কারণ সে তার রিভলভার গাড়িতে রেখে এসেছে।কিন্তু ততক্ষণে একটা গুলি আসিফের কানের নিচ দিয়ে ছুটে গেলো। আসিফের মনে হচ্ছে বিকট শব্দে কিছু তার কানে বাজছে।কিন্তু নাহিদ ততক্ষনে গাড়ির ভেতরে পৌঁছে গেছে। সিটের নিচ থেকে দ্রুত নিজের রিভলভার বের করলো।সেটা জানালা দিয়ে দ্রুত আসিফের দিকে ছুঁড়ে মারলো।আসিফ দ্রুতই সেটা ক্যাচ করলো আর সামনের সিট থেকে আরেকটা রিভলভার নাহিদ নিজে নিলো।সামনে থেকে ধেয়ে আসছে গুলির বর্ষণ।নাহিদ দেখলো সামনের ঝোপের পাশে কিছু মানুষের অবয়ব।আর সেদিক থেকে সুট করা হচ্ছে।নাহিদ আর আসিফ পাল্টা গুলি ছুড়তে লাগলো।ততক্ষণে সামনের গ্লাসটি অনেকাংশে ভেঙে পড়েছে।নাহিদ তখন গাড়ির ভেতরে আর আসিফ গাড়ির বাইরে আড়ালে দাড়িয়ে গুলি ছুঁড়ছে।হঠাৎ একটা গুলি আসিফের বাম হাতে কব্জিতে এসে লাগলো।গুলিটা তার হাতের মাংস ভেদ করে বেরিয়ে গেছে।নিস্তব্দ রাস্তায় আসিফ জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলো।তীব্র যন্ত্রণায় গাড়ির পেছনে রাস্তায় বসে পড়লো।কিন্তু দমে গেলো না।অন্য হাতে অনবরত শত্রুপক্ষকে প্রতিহত করতে লাগলো।নাহিদ এই কঠিন পরিস্থিতিতে নিজেকে শান্ত রাখলো।নিচু হয়ে পেছনের সিট থেকে ড্রাইভিং সিটে চলে আসলো।আর আসিফকে বললো

-” আসিফ দ্রুত গাড়িতে উঠো।আমি ওদের দেখছি।”

আসিফ নাহিদের কথা মতো খুব সাবধানে গাড়ির পেছনের সিটে উঠে পড়লো।নাহিদ দ্রুত গাড়ি স্টার্ট দিলো। এ ছাড়া আর উপায় নেই।নাহিদের রিভলবারের আর গুলি অবশিষ্ট নেই।নাহিদ অস্থির চিত্তে আসিফ কে বললো
-” আসিফ হেট ডাউন।”

আসিফ দ্রুতই তা করলো।নাহিদ সামনের গুলি ওপেক্ষা করে গাড়ি সামনের দিকে আগালো।ফুল স্পীডে গাড়ি ছেড়ে দিলো।জঙ্গলের ভেতরে থাকা শত্রুপক্ষকে মুহূর্তেই পেছনে ফেলে নাহিদ সামনে আগাতে থাকলো।আসিফ ব্যাথায় কাতর হয়েও নাহিদকে দেখছে।যেখানে এই মানুষটাকে তার সিকিউরিটি দেওয়ার কথা সেখানে এই মানুষটাই তাকে নিরাপত্তা দিচ্ছে।আসিফ নাহিদকে প্রশ্ন করলো

-“ওরা আমাদের আসার খবর পেলো কি করে?নিশ্চই কেউ খবরটা লিক করেছে। স্যার আপনি ঠিক আছেন।”

নাহিদ মুখে কিছুই বললো না।দ্রুত স্পীডে ড্রাইভ করতে লাগলো।লুকিং গ্লাস নাহিদের চোখ জোড়া অসম্ভব লালছে দেখালো। সুন্দর মুখটায় বিষণ্ণতার ছাপ।আসিফের খানিকটা সন্দেহ হতে লাগলো।সে সামনের দিকে ঝুঁকে নাহিদকে দেখলো।নাহিদ এক হাতে ড্রাইভ করছে।আসিফের হঠাৎ চোখ পড়লো নাহিদের পেটের দিকে। দেখলো নাহিদের সাদা পাঞ্জাবি পেটের ডান পাশে রক্তে ভিজে লাল হয়ে আছে।সেখান থেকে চুয়ে চুয়ে রক্ত বের হচ্ছে।আর নাহিদ এক হাতে সেই জায়গাটায় চেপে ধরে আছে।মুহূর্তেই আসিফের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো।সে যেনো নিজের যন্ত্রণা ভুলেই গেলো।সে অস্থির হয়ে বললো

-” ওহ্ শিট!!!!স্যার আপনার গুলি লেগেছে? আপনি সরুন আমাকে ড্রাইভ করতে দিন।”

নাহিদ কাপা গলায় বললো
-“ড্রাইভ থামাতে পারবো না আসিফ।পেছনে দেখো।”

আসিফ অস্থির চিত্তে পেছনে ফিরে দেখলো একটা মালবাহী গাড়ি দ্রুত গতিতে তাদের দিকে ধেয়ে আসছে।নাহিদ বললো
-” আসিফ পেছনের সিটে আমার ফোন আছে।দ্রুত পুলিশকে কল করো।সামনেই চেকপোস্ট আছে।আমি সেদিকে যাওয়ার চেষ্টা করছি।দ্রুত করো।”

আসিফ আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নাহিদের ফোন দেখতে পেলো।ফোনের স্ক্রিনে আরজুর একটা ছবি ভাসছে।আসিফ বললো
-” স্যার পাসওয়ার্ড।”

নাহিদের বুকে মুহূর্তেই তীব্র যন্ত্রণা শুরু হলো।সে কাপা গলায় বললো
-“আরজু মাই লাইফলাইন।”

আসিফ কয়েক মুহূর্ত থমকাল। পরো মুহূর্তেই নিজের কাজ করলো।তীব্র যন্ত্রণায় নাহিদের চোখ বুজে আসছে।ক্ষত স্থান থেকে রক্তধারা গড়িয়ে গাড়িতে পড়ছে।নাহিদের নিজেকে ভীষণ দুর্বল লাগছে।মুহূর্তেই আরজুর হাসি মাখা মুখটা চোখের সামনে ভেসে আসতেই নাহিদ মাথা ঝাকিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো।আরজু তার অপেক্ষায় আছে।যে করেই হোক তাকে দুর্বল হলে চলবে না।এতকিছুর পরও ভালোবাসার মানুষটাকে পেয়ে এতো কম সময়ের মাঝেই তাকে ছেড়ে যেতে চায়না।আরজুকে নিয়ে সে বাঁচতে চায় বছরের পর বছর।কিন্তু চোখের সামনে সব যে ঝাপসা হয়ে আসছে।নাহিদের সারা শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে।

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_56

রাতের আধারে নির্জন শহর জুড়ে অদ্ভুদ মায়ার সঞ্চার হয়।সারাদিনের কোলাহলের পর এই শহর যেনো ক্লান্ত হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেয়।আর সেই ক্লান্তি, নিস্তব্দতার মাঝে আছে অপার সৌন্দর্য।দূরের ঝি ঝি পোকারা দলে দলে ছুটে বেড়াচ্ছে।আকাশের চাঁদটাও আজ মেঘে ঢাকা।আরজু ডিভানে বসে রাতের সেই সৌন্দর্য উপভোগ করছে।কিন্তু মন কিছুতেই তৃপ্তি পাচ্ছে না।পাবে কি করে,মনটা যে বড্ডো অস্থির হয়ে আছে।সেই বিকেলে নেতা সাহেবের সাথে কথা হয়েছে।আর এখন কল রিসিভ করছে না।মানুষটা দেশের প্রতি দায়িত্বশীল হলেও বউয়ের প্রতি একদমই না।কেমন খাপছাড়া।আরজুর অবুঝ মন ছোটবেলা থেকেই ভালোবাসার কাঙাল।হয়তো বাবা মায়ের অভাববোধ থেকে সৃষ্টি হয়েছে এই চাহিদা। চারপাশের মানুষগুলো তাকে চাওয়ার আগেই এতো ভালোবাসা দিয়েছে যে আরজু কারো সামান্য অবহেলা মেনে নিতে পারে না।যেমন আজকাল শুভর অদ্ভুদ ব্যাবহার তাকে ভীষণ আহত করে।

আর নেতা সাহেব হলো তার বিশেষ কাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তি।এই মানুষটির কাছে তার প্রত্যাশা অনেক বেশি।কবে, কখন, কিভাবে এই কঠোর,ধম্ভিক মানুষটাকে আরজু নিজের অস্তিত্বের সাথে মিশিয়ে নিয়েছে আরজুর জানা নেই।এক অদৃশ্য শক্তি আরজুকে মানুষটির দিকে টেনে নিয়ে গেছে।তাইতো জীবনে প্রথম এতো বেহায়া হয়ে মানুষটাকে নিজের করে পেতে চেয়েছে।আর প্রকৃতি যেনো তার পক্ষে ছিলো।তবে আরজুর বিশ্বাস নেতা সাহেবও তাকে ভালোবাসে।কারণ এই অদ্ভুদ ভাবে হওয়া বিয়েটাকে নেতা সাহেব খুব সহজেই মেনে নিয়েছে।আরজুকে কখনো অসম্মান করেনি।আরজুর প্রতি ভীষণ খেয়াল রেখেছে।

আরজু ফোনের লক স্ক্রিনে তাকালো।সেখানে তার নেতা সাহেবের বেশ সুন্দর একটা ছবি।এই ছবিটা আরজু অনেক আগে নেতা সাহেবের ফেসবুক পেজ থেকে নিয়েছে।আরজু বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে নাহিদের ছবিটা ছুঁয়ে দিলো।পাঞ্জাবীর হাতা গুটাতে ব্যাস্ত এমন ভাবে ছবিটা তুলেছে।নাহিদের এই কাজটা আরজুকে ভীষণ আকর্ষণ করে।এই সুদর্শন পুরুষ তার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে।একবার কথা না হওয়া অব্দি আরজু কিছুতেই স্বস্তি পাবে না।আরজু আবার নাহিদকে কল করার জন্য লক খুললো।স্ক্রিনে ভেসে আসলো তার আর শুভর হাস্যোজ্জ্বল ছবি।আরজু দীর্ঘশ্বাস ফেলে নাহিদের নাম্বারে আবার কল করলো।কল রিসিভ হলো না।আরজু এবার অধৈর্য হয়ে সারা রুমে পায়চারি করছে।দায়িত্বহীন পুরুষ একটা।কিছু একটা ভেবে সে আসিফকে কল করলো।বেশ কিছুক্ষন রিং হওয়ার পর কল রিসিভ হলো।আরজু অভিমানী সুরে বললো

-“আপনার স্যারকে বলে দিবেন ফোন ইউজ করা বন্ধ করে দিতে।কারণ ফোনের প্রপার ইউজ সম্পর্কে তিনি কিছুই জানে না।”

আসিফকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে আরজুর রাগ হলো।তাই বললো
-” আপনি আর আপনার স্যার দুজনেই আমার কাছ থেকে ক্লাস নিবেন।আপনারা প্রযুক্তির ব্যাবহার জানেন না।একজন ফোন ধরতে জানে না।আর অন্যজন কল রিসিভ করে মিউট হয়ে যান।”

আসিফ চোখ বুঁজে নিজেকে আগে শান্ত করলো।চঞ্চল এই মেয়েটাকে এমন দুঃসংবাদ দেওয়ার সাহস হচ্ছে না।আরজুকে তার খুব পছন্দ।এই মেয়েটার মধ্যে সৌন্দর্যের সাথে সাথে সরলতা আছে।একজন মেয়রের স্ত্রী হওয়ার কোনো ধাম্ভিকতা নেই।এটা তাকে খুব আশ্চর্য করেছে।আসিফকে দেখলেই হাসি মুখে কথা বলে।তার স্যারের মতো গুরুগম্ভীর ব্যাক্তি এই চঞ্চল মেয়েটার মাঝে কি করে আটকে গেলো?আসিফ কাপা কাপা গলায় বললো

-” ম্যাম আপনাকে কিছু বলবো।কিন্তু তার আগে বলুন আপনি নিজেকে শান্ত রাখবেন।।”

আরজুর বুকের মাঝে কেমন ধক করে উঠলো।তার মন বলছে খারাপ কিছু ঘটেছে।আরজু অস্থির হয়ে অস্পষ্ট স্বরে বললো
-” নে..নেতা সাহেব ঠিক আছেন?”

আরজু মনের ভয়কে সত্যি করে আসিফ তাকে যা বললো তাতে আরজু পুরো স্তব্ধ হয়ে গেলো।হাত থেকে ফোনটা গড়িয়ে পড়লো মেঝেতে।আরজুর যেনো নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। বক্ষস্থলে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে।দুর্বল আরজু ধপ করে পড়ে গেলো নিচে।সারা শরীর অসম্ভব কাপছে।দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু ধারা।বহুবছর আগে নিজের আপন মানুষ গুলোকে যে ভাবে হারিয়েছে নেতা সাহেবও কি সেই ভাবে হারিয়ে যাবে? না!! আরজু আর কিছুই ভাবতে পারছে না।ভেতরের কান্না দলা পাকিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে।আরজু যেনো নিজেকে আর সামলাতে পারলো না।বুকের ভেতরে তীব্র হাহাকার শুরু হলো।হুহু করে কেঁদে উঠলো আরজু।আর বিড়বিড় করতে লাগলো।তার সাথেই কেনো এমন হয়।তার একান্ত আপন মানুষগুলো কেনো তার কাছথেকে এক এক করে হারিয়ে যাচ্ছে।

কিছুক্ষনের মধ্যেই সুমি দৌড়ে আসলো।নিস্তব্দ রাতে কারো আর্তনাদ শুনে সুমির গভীর গুম ছুটে গেলো।সুমি ঘরে ঢুকে দেখলো মেঝেতে পড়ে থাকা বিধ্বস্ত আরজুকে।সুন্দর মুখটা কেমন লালচে হয়ে আছে।চুলগুলো এলোমেলো।আরজুকে মেঝেতে পড়ে কাদতে দেখে সুমি দৌড়ে আসলো আরজুর কাছে।আর অস্থির হয়ে বললো

-” ভাবী কি হয়েছে? আপনি কাদছেন কেনো?”

আরজু কাঁদতে কাঁদতে কাপা সরে বললো
-” নেতা সাহেব…”

আরজু আর বলতে পারলো না।হুহু করে কেঁদে উঠলো।সুমি আরজুকে উদ্দেশ্য করে বললো
-” ভাইজানের কি হয়েছে ভাবী?”

আরজু সুমিকে ঝাপটে ধরলো।আর বললো
-” আমার নেতা সাহেব হসপিটালে সুমি।তার নাকি এক্সিডেন্ট হয়েছে।”

সুমির যেনো বুক কেপে উঠলো।ভাইজান কে সে প্রচন্ড শ্রদ্ধা করে।এই মানুষটা তাকে বড়ো ভাইয়ার মতো স্নেহ করে।আর সেই মানুষটার এমন খবর শুনে সুমি নিজেই কেঁদে উঠলো।আরজু অস্থির হয়ে উঠে দাড়ালো।সুমি বললো
-” ভাবী কোথায় যাচ্ছেন?”

আরজু অস্থির হয়ে বললো
-” নেতা সাহেবের কাছে।”

সুমি দ্রুত আরজুকে আটকে বললো
-” ভাবী এই গভীর রাতে আপনি একা কি করে যাবেন।সাইফুল ভাই তো বাসায় চলে গেছে।এই রাতে একা গেলে যেকোনো বিপদ হতে পারে।ভাইজান আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে আপনার খেয়াল রাখতে।আপনাকে এই গভীর রাতে একা কিছুতেই যেতে দেবো না।”

আরজু যেনো কিছুই ভাবতে পারছে না।খালুজান শহরের বাইরে গেছে দুইদিন হলো।বাসার গ্যারেজে গাড়ি থাকলেও আরজু নিজে ড্রাইভ করতে জানে না।কি করবে কিছুই ভাবতে পারছেনা।আরজু দুহাতে নিজের চুল খামচে ধরলো।হঠাৎ আরজু অস্থির হয়ে ফোন খুঁজতে লাগলো।এই পরিস্থিতে আরজুর একজনকেই মনে পড়ছে।একমাত্র এই মানুষটাই তাকে সাহায্য করতে পারবে।

————————-
গভীর রাতে বারান্দায় বসে সিগারেট টানছে শুভ।মেঘে ঢাকা চাঁদের ন্যায় তার জীবনটাও কেমন আধারে ছেয়ে গেছে।জীবনের চলা উত্থান পতনের মাঝে নিজের লেখাপড়া থেকে অনেকটাই সরে গেছে।রিমির প্রেসারে একটা নোট রেডি করতে করতে অনেক রাত হয়েছে।মাথা পুরো জ্যাম হয়ে আছে।তাই এই নিকোটিনের বিকল্প নেই।

হঠাৎ তার ফোন বাজতে লাগলো।শুভ খানিকটা বিরক্ত হলো।এই রাতে কে কল করেছে?ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে শুভ চমকালো।আরজুর নাম্বার থেকে কল করা হচ্ছে।শুভ সেদিনই আরজুর নাম্বার আনব্লক করেছে।শুভ ঘড়িতে সময় দেখে কপাল কুঁচকে ফেললো।এতো রাতে আরজু তাকে কেনো কল করেছে?আগে এই গভীর রাতে আরজুর কল স্বাভাবিক বিষয় হলেও বর্তমানে খানিকটা অস্বাভাবিক।কারণ তাদের মাঝে একটা অদৃশ্য দেয়াল দাড়িয়ে আছে।যে দেয়াল শুভ নিজে দার করিয়েছে।সব দ্বিধা দ্বন্দ ভুলে শুভ কল রিসিভ করলো। অপর পাশ থেকে আরজুর কান্নারত কণ্ঠস্বর শুনে শুভর বক্ষস্থল কেঁপে উঠলো।শুভ স্পষ্ট বিপদের অভ্যাস পেলো।আরজু ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে চলছে।মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না।হয়তো চেষ্টা করেও পারছে না।আরজুর বাবা মা মারা যাওয়ার পর থেকে আরজুকে কখনোই এই ভাবে কাদতে দেখেনি শুভ।শুভ অস্থির হয়ে প্রশ্ন করলো

-” কি হয়েছে আরজু? কাদছিস কেনো?”

আরজু তখনও কাদার ফলে কিছুই বলতে পারছেনা।শুভ আদুরে স্বরে বললো
-” আরজু সোনা প্লিজ কান্না করিসনা।কি হয়েছে বল।আমি সব ঠিক করে দিবো?কে আমার গালফুলিকে এই ভাবে কাঁদালো?”

আরজু কেঁদে বললো
-” শুভ আমাকে নেতা সাহেবের কাছে নিয়ে যা।”

শুভকে আর কিছুই বলতে হলো না।শুভ অনেকটা আন্দাজ করতে পারলো কি ঘটেছে।শুভ আরজুকে আশ্বাস দিয়ে বললো

-” আমি আসছি।তুই প্লিজ কান্না থামা।”

_________________________
শুভর মায়ের ঘুম ভেঙে গেলো টুক টুক শব্দে।এই গভীর রাতে এই শব্দ কোন জায়গা থেকে আসছে দেখতে বিছানা ছেড়ে উঠে গেলেন।সোফার রুমে আসতেই দেখলেন শুভ হন্তদন্ত করে অস্থির হয়ে জ্যাকেট গায়ে জড়াতে জড়াতে বেরিয়ে আসছে।চোখে মুখে তার বিষণ্ণতা,অস্থিরতা।শুভর মা চিন্তিত হয়ে বললেন

-“বাবা এতো রাতে কোথায় যাচ্ছিস?”

শুভ জুতা পড়তে পড়তে বললো
-” বাইরে।”

শুভর মা আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন।ছেলের মাথা নির্ঘাত খারাপ হয়ে গেছে।এই গভীর রাতে হন্তদন্ত হয়ে বাইরে ছুটছে।তিনি অস্থির হয়ে বললেন

-“এই রাতে বাইরে কি? এই তুই গাজা, হিরোইন খাসনা তো? ইয়াহ আল্লাহ!!! আমার ছেলে হয়ে এইসব ড্রাগে জড়িয়ে পড়েছিস?এই শিক্ষা দিয়েছিলাম তোকে?”

এসব বলেই শুভর মা বিলাপ শুরু করলেন।শুভ এতে প্রচন্ড বিরক্ত হলো। শোভা মায়ের বিলাপ শুনে উঠে আসলো।শুভ রেগে বললো

-” ফালতু কথা বলোনা আম্মু।আমি আরজুর কাছে যাচ্ছিস।”

এই কথা যেনো শুভর মায়ের কাছে আরো ভয়ানক শুনালো।ছেলে গাজার নেশা করলে হয়তো একটু কম কষ্ট পেতেন।কিন্তু ছেলে পড়েছে প্রেমের নেশায়।এই নেশা যে বড়ো ভয়ানক।তিনি আতঙ্কিত হয়ে শুভর কাছে এসে বললেন

-” পাগল হয়ে গেছিস? যেই মেয়ে তোকে ছেড়ে প্রভাবশালী এক লোককে টাকার জন্য বিয়ে করেছে সেই মেয়ের কাছে ছুটে যাচ্ছিস?”

শুভ পাশের বাকেট থেকে বাইকের চাবি নিয়ে বললো
-“বাজে কথা বলোনা।আরজু বিপদে পড়েছে আম্মু।আমাকে যেতেই হবে।”

শুভর মা রেগে বললেন
-” স্বার্থপর মেয়ে একটা।আমার ছেলেকে এতো কষ্ট দিয়েছে।আর এখন বিপদে পরে আমার ছেলেকে ডাকে।জীবনে ভালো হবেনা এই মেয়ের। জাদু করেছে আমার ছেলেকে।আমার ছেলের জীবনে কালো ছায়া হয়ে ঘুরছে।”

শুভ কঠিন দৃষ্টি ফেলে বললো
-” আরজু কখনো আমাকে কোনো কমিটমেন্ট করেনি আম্মু।আমরা কোনো লাভ রিলেশনেও ছিলাম না।আমি আরজুকে ভালোবাসি তার মনে এটা না আরজুর ও আমাকে ভালবাসতে হবে।তাছাড়া তোমার ছেলেকে এই শিক্ষা দাওনি যে, কারো বিপদে হাতপা গুটিয়ে বসে থাকবে।আর সেটা যদি আরজু হয়ে তবে তোমার ছেলে দুই মিনিটও ভাববে না তার কাছে ছুটে যেতে।ভুলে যেওনা আরজু তোমার ছেলের ভালবাসা হওয়ার আগে ভালো বন্ধু।সেই বন্ধুত্বের মূল্য আমার কাছে অনেক।”

শুভর মা হতবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন।শুভ দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়ের কাছে এসে কপালে চুমু একে বললো
-” আই অ্যাম সরি আম্মু।কিন্তু আমাকে যেতে হবে।তুমি ঘুমিয়ে পরো।”

শুভ শোভাকে ইশারাতে বুজালো মাকে সামলাতে।আর শুভ দ্রুত চলে গেলো। শুভর মা কিছুক্ষন বিলাপ করে কাদলেন।আরজুকে নানান গালিগালাজ করলেন।একসময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন।
___________________________
প্রায় চল্লিশ মিনিট পর শুভ আরজুর বাসায় পৌঁছালো।বাসায় দ্রুত ঢুকে দেখলো আরজু সোফায় বসে কান্না করছে।শুভ একটু আগাতেই দেখলো আরজুর বিধ্বস্ত অবস্থা।শুভর বুক মুচড়ে উঠলো।যেই মুখে সারাক্ষণ হাসি লেগে থাকে সেই মুখে আজ অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ছে।শুভকে দেখে আরজু আর নিজেকে সামলাতে পারলো না।দৌড়ে এসে শুভর বুকে মুখ লুকিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো। শুভর বুকে যেনো রক্তক্ষরণ হচ্ছে।সে দ্রুত পরম আদরে আরজুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো

-” কাদিস না।সব ঠিক হয়ে যাবে।”

আরজু ভাঙ্গা গলায় বললো
-” আমাকে নিয়ে চল শুভ।আমি নেতা সাহেবের কাছে যাবো।তার কিছু হলে আমি শেষ হয়ে যাবো।আমার কাছের মানুষেরা আমাকে ফেলে কেনো চলে যায়?আমি কি এতটাই খারাপ?”

শুভর দুচোখ ভিজে উঠলো।আরজুর চুলে আলতো চুমু খেয়ে বললো
-” আরে পাগলী এসব কি কথা? কেউ তোকে ফেলে যায়নি।সবটাই তোর ভ্রান্ত ধারণা।সবাই তোর কাছেই আছে।তোর নেতা সাহেব ঠিক হয়ে যাবে।দেখিস।”

শুভ আরজুর চোখের অশ্রু মুছে দিয়ে দ্রুত হসপিটালের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লো।সুমি এতক্ষণ অবাক হয়ে এই দুজনকে দেখছিলো। কারো বন্ধুত্ব বুঝি এতো গভীর হয়?কত সহজেই ভাবীকে সামলে নিলো তার বন্ধু।এমন বন্ধুত্ব তো ভাইজান আর আসফি ভাইয়ার মধ্যেও দেখেনি সে।
___________________
হসপিটালে পৌঁছেই শুভ আর আরজু ছুটে গেলো রিসেপশনে।সেখান থেকে জানতে পারলো নাহিদকে OT তে ঢুকানো হয়েছে।আরজুর দমবন্ধ হবার জোগাড় হয় তখন,যখন জানতে পারে নাহিদকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আনা হয়েছে।আরজুর মাথা চক্কর দিয়ে উঠে।আরজু পড়ে যেতে নিলে শুভ ধরে ফেলে।আরজুর মুখে কোনমতে পানি ছিটিয়ে OT সামনে আসে।অপারেশন থিয়েটারের সামনে এসে শুভ চমকে গেলো l।পুরো ফ্লোর পুলিশের আন্ডারে।সেখানে কাউকেই ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।সিটির মেয়রের উপর হামলা হওয়ায় পুলিশ বেশ ইসট্রিক সিকিউরিটি দিয়ে রেখেছে।এমনকি আরজু আর শুভকে যেতে দেওয়া হলো না।শুভ রেগে আরজুর উদ্দেশে বললো

-” এসব কি কথা।মেয়রের ওয়াইফ তুই।তোকে কেনো যেতে দিবে না?আমি এক্ষনি বলছি তুই কে।”

আরজু ভেজা চোখে সামনে তাকালো।তারপর কান্নারত অবস্থায় বললো
-“না শুভ।নেতা সাহেব আমাদের বিয়েটা আপাদত গোপন রেখেছে।তুই এই ভাবে কিছু বলতে গেলে হাঙ্গামা সৃষ্টি হবে।”

-” আচ্ছা আশেপাশে তাকিয়ে দেখ কাউকে চিনিস কিনা?”

আরজু ঝাপসা দৃষ্টিতে আশেপাশে চোখ বুলালো।কিন্তু কাউকেই পরিচিত বলে মনে হলো না।দুর্বল আরজু আর দাড়িয়ে থাকতে পারছে না।শুভ পাশের চেয়ারে আরজুকে বসিয়ে দিলো।শুভ নাহিদের অ্যাসিস্টেন্ট আসিফ কে কল করলো।কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না।

হঠাৎ কয়েকজনকে হন্তদন্ত হয়ে আসতে দেখেলো শুভ।তাদের খুব সহজেই ভেতরে যেতে দিলো পুলিশ।শুভ কপাল কুচকে বললো

-” আরজু ওরা মনে হয় নাহিদ ভাইয়ার ফ্যামিলি পারসন।”

আরজু মাথা তুলে তাকিয়ে দেখলো সামনের ব্যাক্তিদের মুখগুলো পরিচিত মনে হলো।আরজু তাদের ছবিতে দেখেছে।সামনের বয়োজ্যেষ্ঠ নারীটি নাহিদের দাদী।তাকে আরজুর মনে আছে।বাকি কাউকেই তেমন মনে করতে পারলো না।ঠিক তখনই তাদের সামনে দিয়ে ছুটে আসলো একজন ব্যাক্তি।আরজু ভেজা চোখে মানুষটাকে দেখে হুহু করে কেঁদে উঠলো। আসফি লিফট থেকে বেরিয়েই আরজুকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখলো।সে ছুটে আসল আরজুর সামনে।আরজু তাকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ল। আসফি আরজুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো

-” নিজেকে সামলাও আরজু।তোমার স্বামী একজন দুঃসাহসী পলিটিশিয়ান।তার স্ত্রী হয়ে তোমাকে এত দুর্বল হলে চলবে না।তোমাকে এইভাবে দেখলে আমার বন্ধুর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসবে।তাই নিজেকে স্ট্রং করো।”

আরজু ভাঙ্গা সরে বললো
-” এসব কেনো হলো ভাইয়া?আমার নেতা সাহেব তো কারো কোনো ক্ষতি করেনি।তবে কেউ কেনো গুলি করলো তাকে?”

আসফি কি করে বুজাবে আরজুকে যে, তার নেতা সাহেবের চারদিকে শত্রুপক্ষের অভাব নেই।নাহিদ যেই পথে চলে সেই পথে পদে পদে শত্রু তৈরি হয়।

আসফি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।আরজু আর শুভকে ভেতরে নিয়ে গেলো।সেখানে পৌঁছেই দেখলো নাহিদের দাদী কান্না করছেন।আরো বাকি সবাই বেশ উদ্বিগ্ন। আসফি সেখানে থাকা একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আর্মি অফিসারে সাথে হাত মিলালো।সে অফিসারটি বেশ গম্ভীর স্বরে বললো

-“কার কাজ এটা।আমার ভাতিজার গায়ে আঘাত করার সাহস পায় কি করে?”

আসফি কপাল চুলকে বললো
-” সঠিক বলতে পারছি না আংকেল।তবে আমরা যা ধারণা করছি সেটা হতে পারে।”

নকীব মাহমুদ চোয়াল শক্ত করে বললো
-” ওই রাস্কেল এবার কি করে নমিনেশন পায় আমি দেখে নেবো।এই সময়টায় নাহিদকে সিকিউরিটি ছাড়া বের হতে মানা করেছিলাম।ছেলেটার জীবনের ভয় নেই।”

কথা শেষ করে নকীব মাহমুদের নজর যায় পেছনে দাড়ানো আরজুর দিকে। চোখে মুখে গাম্ভীর্যের আভাস রেখে তিনি বললেন

-” চিন্তা করোনা মা।তোমার স্বামীর কিছুই হবেনা।আমাদের ছেলে ভীষণ স্ট্রং।এতো অল্পতে নেতিয়ে পড়বে না।”

আরজু হতবম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো।আরজু ভাবছে এই ব্যাক্তিটি কে? আর তাকে চেনে কি করে?আরজুর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে নকীব মাহমুদ বললেন
-” আমি নাহিদের চাচু।”

আরজু অবাক হলো।নেতা সাহেব বলেছেন বিয়ের বিষয়ে কাউকেই জানায়নি।কিন্তু এই মানুষটা নিজের ঘনিষ্ঠ ব্যাক্তিদের ঠিক সবটা জানিয়েছেন।

আরজু পাশের চেয়ারে বসে অশ্রু ঝরাচ্ছে।তার নেতা সাহেব ঠিক আছে তো?মানুষটার নিশ্চই অনেক কষ্ট হচ্ছে।আরজু আর ভাবতে পারছে না।আরজু সৃষ্টিকর্তার কাছে তার নেতা সাহেবের জীবন ভিক্ষা চাইতে লাগলো।এই মানুষটাকে নিয়ে আরো বহু পথ হাঁটতে চায় আরজু।

ঠিক তখনই OT র ভেতর থেকে ডক্টরের জায়গায় নিজের শশুরকে বেরিয়ে আসতে দেখে আরজু চমকে গেলো।মানুষটার গায়ের শার্ট রক্তে ভেজা।একদম তরতাজা রক্ত।আরজু ছলছল চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলো।এই রক্ত কি তার নেতা সাহেবের? আরজুর ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো।অতীতের স্মৃতি তার মস্তিষ্ককে কামড়ে ধরেছে।ঠিক এমন রক্তে ভেজা শরীরে বাবা মায়ের মুখটা দেখেছিল বহু বছর আগে।আরজু থর থর করে কাঁপতে লাগলো।শুভ আরজুর কাধ চেপে ধরলো।আরজুকে শান্ত করতে চাইলো।নাঈম মাহমুদ দুর থেকেই আরজুকে দেখতে পেলেন।তিনি সামনে দাড়ানো নিজের মা,স্ত্রী সকলকে পাস কাটিয়ে চলে গেলেন সোজা আরজুর দিকে।নূরজাহান,সানজিদা মাহমুদ অবাক হয়ে তাকালো নাঈম মাহমুদের দিকে।নাঈম মাহমুদ আরজুর সামনের হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়লেন।আরজু চিৎকার করে কাদছে।নাঈম মাহমুদ তার রক্তে ভেজা হাতে আরজুর মাথায় পরম স্নেহে হাত বুলিয়ে বললেন

-“ছেলেটাকে কতটা ভালোবাসি সেটা কোনোদিন প্রকাশ করতে পারিনি।আমার ছেলেটা আমার উপর ভীষণ অভিমান করে আছে। বাবা হয়ে নিজ সন্তানের রক্তাক্ত দেহ বহন করা কিযে যন্ত্রণার বলে বুঝাতে পারবো না।ঠিক এই ভয়েই আমি নাহিদকে পলিটিক্স ছাড়তে বলি।আর ছেলেটা আমাকে নিজের স্বপ্নের বাধা মনে করে।বৌমা আমার ছেলেটা জ্ঞান হারানোর আগে একটা কথাই বলেছে।তার অমূল্য সম্পদের হেফাজত করতে।আর আমার ছেলের একমাত্র অমূল্য সম্পদ তুমি মা।”

আরজু নাঈম মাহমুদের কথায় সারা শরীর কাপিয়ে কেঁদে চললো।তার নেতা সাহেব তার কাছে আবার ফিরে আসবে তো?আরজুর কান্না সেই ফ্লোরের সকলেই শুনতে লাগলো।আর নাহিদের দাদী আর সানজিদা মাহমুদ অবাক হয়ে আরজুকে দেখছেন।কারণ এই মুহূর্তে তারা অচেনা মেয়েটার এই আর্তনাদের কারণ বুঝতে পাড়লো না।