মিষ্টি রোদের হাতছানি পর্ব-৫৭+৫৮+৫৯

0
1099

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_57

সকল আঁধারকে ছাপিয়ে পূর্ব আকাশে সূর্যের তীক্ষ্ণ রশ্মি ছড়িয়ে পড়ছে এই ধরণীতে।পরিবেশে ছড়িয়ে আছে স্নিগ্ধতা।দিনের প্রথম প্রহরে শহর জুড়ে বিচরণ করে নিস্তব্দতা।তবে ধীরে ধীরে সময়ের গতির সাথে বাড়ছে জনমানবের আনাগোনা।

হসপিটালের করিডোরে সকলেই নিস্তব্দ হয়ে বসে আছে।একটু আগেই নাহিদকে OT থেকে বের করা হয়েছে।নাহিদের পেটের বাম পাশে গুলি লেগেছিল।সেটা সফল ভাবে বের করা হয়েছে।বর্তমানে নাহিদকে আইসিইউ তে রাখা হয়েছে।অনেকটাই বিপদমুক্ত সে।ক্লান্ত চোখে সামনের বেঞ্চে বসা রূপবতী মেয়েটার দিকে তাকালেন নূরজাহান বেগম।এতক্ষণ এই বিপর্যয় পরিস্থিতে মেয়েটাকে ভালো করে দেখা হয়নি।বিষয়টা এখন অব্দি বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার।তার সবচাইতে আদরের নাতি কাউকে না জানিয়ে এতো বড়ো সিদ্বান্ত নিয়ে নিবে ভাবতে পারেনি।অথচ এতদিন বিয়ে কর! বিয়ে কর! বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছে।মনে মনে নাতির প্রতি প্রচন্ড অভিযোগ জমা হলেও এই রূপবতী মেয়েটাকে দেখে তার অভিযোগ খানিকটা কমে গেলো।এতো সুন্দরী মেয়েতো সে নিজেও কোনো দিন দেখেনি।কি রূপ এই রমণীর।!!!মলিন মুখেও যেনো সৌন্দর্য্যের কোনো কমতি নেই।কান্নার ফলে নাকের ডগা কেমন লালচে হয়ে আছে।নূরজাহান বেগম মনে মনে হাসলেন।তিনি নিজেও নাতির জন্য কোনোদিন এমন রূপসী খুঁজে পেতেন কিনা সন্দেহ।
আরজু নামটা তার বহুবার শুনা হলেও এই রূপবতীকে কখনো দেখা হয়নি।তিনি আজ বুঝতে পারছেন কয়েক বছর আগে তার গুরুগম্ভীর নাতি এই রমণীর জন্য কেনো উতলা হয়ে পড়েছিল।তিনি জানতেন তার নাহিদ কোনো সাধারণ মেয়ের জন্য পাগল হয়নি।নিশ্চই সে মেয়ের মধ্যে অসাধারণ কিছু আছে।আর আজ আরজুকে দেখে সেটা উপলব্ধি করতে পেরেছেন।

আরজু আড়চোখে নূরজাহানের দিকে তাকালো।এই বয়সেও বৃদ্ধা ভদ্রমহিলাটি বেশ মার্জিত,রুচিশীল। দাদীর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার ফলে আরজুর অসস্তি হতে লাগলো।আরজুর কে ছটফট করতে দেখে শুভ বললো

-” তুই ঠিক আছিস?পানি খাবি?”

আরজু মাথা নেরে সায় দিলো।আসলেই তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে।শুভ চলে গেলো পানি আনতে। একটু পরই আরজু দেখতে পেলো আসিফ আসছে।তার হাত প্লাস্টার করা।আরজু দ্রুত তার কাছে এগিয়ে গেলো।আর বললো

-” আপনি ঠিক আছেন?”

আসিফ হেসে বললো
-” জি ম্যাম। স্যাররে কি অবস্থা?”

-” জি মোটামুটি ভালো। এখনো জ্ঞান ফিরেনি।”

আসিফ এবার চলে গেলো আসফির কাছে।তাকে সব বিষয়ে ডিটেলস জানাতে।নাঈম মাহমুদ মাত্রই পৌঁছলেন হসপিটালে।নাহিদের OT শেষ হওয়ার পর উনি বাসায় ফিরে গেছেন।কারণ তার সারা গায়ে নাহিদের রক্ত লেগে ভিজে উঠেছিলো।ছেলের সুস্থতার খবর শুনেই ফ্রেস হতে বাসায় গেছেন।গতকাল অফিসের মিটিং শেষ করে বাসার উদ্দেশে বেরিয়েই আসিফের কল পেয়ে স্পটে ছুটে গেছেন।সেখানে তখন মাত্র অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছেছে।তার ছেলেটা রক্তাত্ব অবস্থায় অ্যাম্বুলেন্স স্ট্রেচারে শুয়ে কাতরাচ্ছে।নাঈম মাহমুদ ত্বরিত গতিতে ছেলের কাছে চলে গেলেন।ভয়ে,আতঙ্কে তার সারা শরীরে কম্পন সৃষ্টি হয়েছিলো।তিনি পরম আদরে সন্তানকে বুকে টেনে নিলেন। দুচোখে তখন অশ্রু জমা হয়েছিল।তার তিন সন্তানের মধ্যে নাহিদের প্রতি টানটা একটু অন্যরকম।কিন্তু মন খুলে কখনো সন্তানের কাছে সেই অনুভূতি,ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারেনি।তিনি নিজে যেমন ব্যাক্তিত্বের ছেলেটাও ঠিক তেমন।তাইতো দুই কঠোর ব্যাক্তিত্বের মানুষ নিজেদের ধম্ভিকতা ভুলে এগিয়ে আসতে পারেনি।নাহিদ ঝাপসা চোখে নিজের বাবাকে দেখে বিষণ্ণ হাসলো।আর কাপা সরে বললো

-“আপনার চোখে আমার জন্য অশ্রু জমা হয়েছে দেখে অবাক হলাম।”

নাঈম মাহমুদ হুহু করে কেঁদে উঠলেন।ছেলেটা এমন কেনো?বাবার স্নেহ কি বুজে না?তিনি বললেন

-” আমার সন্তানের জন্য সর্বদাই আমার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়।কিন্তু সেটা তুমি কোনো দিন উপলব্ধি করনি।”

নাহিদ তখন ভীষণ যন্ত্রণায় কাতর।সব কিছু কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে।ক্ষত স্থানে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে।কিছুতেই চোখ খুলে রাখতে পারছেনা।অনেক কষ্টে বাবার উদ্দেশে বললো

-“আপনার কাছে একটা অনুরোধ করতে চাই।আমার কিছু হয়ে গেলে আমার মূল্যবান সম্পদের হেফাজত করবেন।মনে রাখবেন আপনার ছেলে এই সম্পদের বিন্দুপরিমান ক্ষতি সহ্য করতে পারবে না।”

নাঈম মাহমুদ তখন আহত সন্তানকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন।কিন্তু তার আগেই নাহিদ জ্ঞান হারায়।

নাঈম মাহমুদ এসে আরজুর পাশে দাঁড়ালেন।আরজুর উদ্দেশে বলেন
-” কিছু খেয়েছো মা?”

আরজু বিষণ্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো
-” আমার খিদে নেই আংকেল।”

নাঈম মাহমুদ মুচকি হেসে বললেন
-“না খেলে তো চলবে না।আর আমাকে নাহিদ আগে বাবা বলে ডাকতো।অনেকদিন হয় সেই ডাকটা শুনিনা।”

আরজু ভীষণ লজ্জা পেলো।সে জানেনা নেতা সাহেব আর তার বাবার মাঝে কি সমস্যা আছে।কিন্তু আরজু জানে বাবার মূল্য কতো।আজ পাশে আছে বলে মানুষটা বুঝতে পারছেনা।হারিয়ে গেলে ঠিক আফসোস করবে।পৃথিবীতে কোনো বাবাই খারাপ হয়না।আর তার সামনের মানুষটা তো নেতা সাহেবের প্রতিচ্ছবি।সেই মানুষটা কখনোই খারাপ হতে পারে না।তাই আরজু কাচুমাচু হয়ে বললো

-“আপনি চিন্তা করবেননা বাবা।খুব শীঘ্রই নেতা সাহেবের কাছ থেকে বাবা শুনতে পারবেন।ইনশাআল্লাহ।”

নাঈম মাহমুদের মনটা খুশিতে ভরে গেলো।তার বিশ্বাস আরজু পারবে তার আর নাহিদের মাঝের এই দূরত্ব মুছে দিতে।আরজু হাত কচলাতে কচলাতে বললো

-” বাবা আমি কি উনাকে একবার দেখতে পারি?”

নাঈম মাহমুদ আরজুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন
-” একটু ধৈর্য ধরতে হবে মা।নাহিদের ক্ষততে ইনফেকশন হবার ভয় আছে।তাই কাউকেই ভেতরে যাওয়ার পারমিশন দিবে না। আগে ওর জ্ঞান ফিরুক তারপর দেখা করতে পারবে।”

আরজু মাথা ঝাকিয়ে সম্মতি প্রকাশ করলো।কারণ এই মুহূর্তে নেতা সাহেবের সুস্থতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।তখনই শুভ আসলো পানি আর কিছু খাবার নিয়ে।আরজুকে খেতে বললে আরজু খেতে চাইলো না।শুভ রেগে বললো

-” না খেয়ে অসুস্থ হয়ে জামাইয়ের পাশের সিটে আসন গাড়তে চাস?থাপ্রিয়ে গাল লাল করে দিবো।”

নাঈম মাহমুদ হেসে বলে উঠলেন
-” খেয়ে নাও মা।তোমার বন্ধু ঠিক বলেছে।অসুস্থ হলে আমার পাগল ছেলেটাকে সামলাবে কি করে?”

আরজু সামান্য একটু খাবার মুখে দিলো।কিন্তু কিছুতেই গিলতে পারছে না।অসহায় দৃষ্টিতে শুভর দিকে তাকালো।শুভ চোখ রাঙিয়ে তাকালো।আরজু বাধ্য হয়ে পানি দিয়ে কোনো মতে খাবার গিলে ফেললো।আরজুর কষ্ট হচ্ছে দেখে শুভ আর জোর করলো না।পড়ে দেখা যাবে বমি করে ভাসিয়ে ফেলেছে।আরজুর এইসব বাজে সভাব সম্পর্কে সে ভালো করেই জানে।

সানজিদা মাহমুদ নাঈম মাহমুদের পাশে দাড়ালেন।আড়চোখে আরজুর দিকে তাকিয়ে বললেন

-” আপনার ছেলে কাউকে না জানিয়ে বিয়ের মতো এমন একটা ডিসিশন নিয়ে নিল।আর আপনি মেনে নিলেন? মেয়েটা দেখতে ভালো, স্মার্ট, রুচিশীলও বটে।দেখে কিন্তু বোঝাই যায়না মেয়েটা মিডল ক্লাস।তাইনা?”

সানজিদা মাহমুদ আফসোসের স্বরে আবার বললেন
-“নাহিদ আবার শুধু মাত্র রূপের মোহে পড়ে মেয়েটাকে বিয়ে করেনি তো?কারণ নাহিদের মত উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলের সাথে মেয়েটাকে একদম যায়না।নাহিদের স্ট্যাটাস মেইনটেন করা প্রয়োজন ছিলো।”

সানজিদার কথায় নাঈম মাহমুদের রাগ হলো।কিন্তু হসপিটালে সেটা প্রকাশ করা শোভনীয় হবে না।চারপাশে পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা রয়েছেন।আর মিডিয়াও উঠপেতে আছে নিউজ জানতে।এমন পরিস্থিতির কোনো সিনক্রিয়েট হোক তিনি চায়না।তাই নিজেকে শান্ত করে বিরক্ত হয়ে বললো

-“একুশ শতাব্দীতে এসে তোমার এমন মনোভাব কিছুতেই শোভা পায় না।তাছাড়া আরজু যথেষ্ঠ স্মার্ট,ইন্টিলিজেন্স অ্যান্ড ইনোসেন্ট একটা মেয়ে।সবচাইতে বড়ো কথা মেয়েটা আমার ছেলের পছন্দের। আরজু একটা শিক্ষিত,সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে।ওর বাবা মা দুজনই ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার।ওর খালামণি একজন সুনামধন্য এডভোকেট।আর ওর আংকেল একজন ইনিকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার।সো স্ট্যাটাসের কোনো সমস্যাই নেই।সকলেই ওয়ে স্টাবলিস।আমার মতে স্ট্যাটাস মানুষের রুচিশীলতা,মার্জিত ব্যাবহার আর যোগ্যতার মাধ্যেমে নির্ধারিত হয়।অর্থের মাধ্যেমে না।তাছাড়া তুমি আরজুর দিকে আঙুল তোলার আগে নিজের অতীত মনে করে নিও।”

সানজিদা মাহমুদ ভীষণ অপমান বোধ করলেন।মনে মনে আরজুর প্রতি ক্রোধ জন্মালো।দুই দিনের আসা মেয়েটার জন্য আজ তাকে এইসব কঠিন কথা শুনতে হলো?এটা মেনে নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার।

প্রায় ঘন্টা খানেক পরই হসপিটালে পৌঁছালো জাহিদ আর জেরিন।তারা দুজন ভাইয়ের অ্যাক্সিডেন্টের খবরটা পেয়েছে ভোরের দিকে।দুজনই ছিলো ঢাকার বাইরে নানুর বাড়ি।জেরিন এইচ এস সি পরীক্ষা শুরুর আগে তাদের দোয়া নিতে গেছে দুইদিন আগে।জেরিন আরজুকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ অশ্রু বিসর্জন দিলো।জাহিদের চোখ কেমন লাল হয়ে আছে।নাঈম মাহমুদ ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন

-” ডোন্ট ওয়ারি মাই সন্।হি ইজ অলরাইট।”
________________

প্রায় দুপুরের দিকে নাহিদের জ্ঞান ফিরলো।আর সবার আগে নাহিদের কাছে পৌঁছালো কমিশনার।কারণ বিষয়টা নিয়ে মিডিয়াতে নানান রকম নিউজ হচ্ছে।যে দেশে একজন মেয়রের নিরাপত্তা নেই সেই দেশে জনসাধারণের কি হবে?হসপিটালের আশেপাশে জার্নালিস্টস দের ভিড় জমে আছে।পুরো হসপিটালে পুলিশ দিয়ে ঘেরাও করা।বিষয়টা ইনভেস্টিগেশন করে দেখার জন্য উপর মহল থেকে প্রেসার আসছে।পুলিশের উপর সকলেই আঙ্গুল তুলতে দ্বিধাবোধ করছে না।তাই নাহিদের কাছথেকে স্টেটমেন্ট নেওয়া ভীষণ প্রয়োজন।পুলিশের সাথে আসফি উপস্থিত ছিলেন।কারণ সে নাহিদের লয়ার।পুলিশ চলে গেলে নাহিদ আসফির দিকে তাকালো। আসফি মুচকি হেসে বললো

-” শালা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি।সিকিউরিটি ছাড়া কেনো বের হয়েছিলি?জানিস ওরা ওত পেতে থাকে তোর ক্ষতি করার জন্য। আর তুই নিজে প্লেটের সাজিয়ে ওদের সেই সুযোগ দিয়েছিস।”

নাহিদ চোয়াল শক্ত করে নিচু স্বরে বললো
-“জানিস তো পেছন থেকে কারা আঘাত করে।কাপুরুষেরা।ও নিজেকে আরো আগেই কাপুরুষ প্রমাণ করেছে।আমার ভাবতে অবাক লাগে এক সময় এই মানুষটাকে কতটা বিশ্বাস করেছিলাম।”

আসফি মলিন হেসে বললো
-” বিশ্বাস ঘাতকেরা দেখতে একদম মানুষের মতোই হয়।তাইতো তাদের চিহ্নিত করা কঠিন।”

নাহিদ সারা শরীরে ব্যথা অনুভব করছে। শরীর সামান্য নাড়াতে পারছে না।ব্যাথার যন্ত্রণাকে ভুলে নাহিদ আসফির উদ্দেশে বললো

-” ও এসেছে?”

আসফি জানে নাহিদ কার কথা বলছে।কিন্তু দুষ্টুমি করে না জানার ভান করে বললো
-” কার কথা বলছিস?”

নাহিদ জানে আসফি ইচ্ছে করেই এমন করছে।তাই বললো
-” আমার বউ কই ব্যাটা?”

আসফি শব্দ করে হেসে উঠলো।আর বললো
-” একজেক্টলি এমন প্রেমিক নাহিদকেই তো দেখার ইচ্ছে ছিলো।যে নিজের প্রেমিকার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে।কিন্তু এতো বছর এক নিরামিষ নাহিদকে সহ্য করতে হয়েছে।ফাইনালি ব্যাটা বিয়ে করে লাইনে এসেছিস।”

নাহিদ বিরক্ত হয়ে বললো
-” আরজু ঠিক আছে।বেশি রিয়েক্ট করেছে?”

আসফি হেসে বললো
-” শালা বউকে হসপিটালাইজড করার বেবস্থা করে ফেলেছিস।স্বামীর বিরহে বেচারীর অবস্থা নাজেহাল। বউ তো তোর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে ব্যাটা।”

নাহিদ মুচকি হাসলো।হৃদয়ের কোথাও না কোথাও প্রশান্তি অনুভব হচ্ছে।আবার ভয় কাজ করছে।আজ তার কিছু হলে আরজু কি নিজেকে সামলে নিতে পারতো?নাকি ভেঙে পড়তো?

নাহিদের ভাবনার মাঝেই রুমে প্রবেশ করলো নূরজাহান বেগম।নাহিদকে দেখেই হুহু করে কেঁদে দিলেন ভদ্রমহিলা।নাহিদকে শয্যাশী অবস্থায় দেখে ভীষণ কষ্ট পেলেন।নাহিদ দেখলো পেছনেই পরিবারের সকলে সাথে বাবাও এসেছেন।নাহিদ দাদীর দিকে তাকিয়ে বললো

-” ডোন্ট ক্রাই বিউটিফুল লেডি। কাদলে তোমাকে ভীষণ বাজে লাগে।আমার বউকে কান্না করতে দেখে নিশ্চই বুঝেছ কত কিউট লাগে।তুমি কি তার সাথে কম্পিটিশন দিতে চাচ্ছো?”

নূরজাহান বেগম গাল ফুলিয়ে বললেন
-” আমার রূপের কাছে সবাই ফিকে।যৌবন কালে এমনি এমনি এমপি সাহেব আমার পেছন পেছন ঘুরেছে নাকি?”

নাহিদ মুচকি হেসে বললো
-” তোমার জামাই কিন্তু আমার বউকে দেখে ফিট খেয়ে গেছিলো।তোমার রূপ ভুলে বসেছিলো।”

নূরজাহান নাহিদের গালে হালকা চাপর মেরে বললেন
-” আমার বয়স হয়েছে।এমন করে ভয় পাইয়ে দিলে হার্ট এ্যাটাক করে উপরে চলে যেতে হবে।সিকিউরিটি ছাড়া কেনো বেড়িয়েছিস।জীবনের মায়া নেই তোর?”

-“যেদিন চলে যাবার ডাক আসবে সেদিন এমনি চলে যাবো।”

-” এসব বলতে নেই। বর্তমানে তুই একা না।নিজে নিজে তো ঠিক বিয়ে করে নিয়েছিস।এই বুড়িকে জানানো জরুরী মনে করিস নি।”

-” তুমি তো জানতেই আমি বিয়ে করলে এই একজনকেই করতাম দাদিজান।তবে কেনো বার বার আমাকে বিয়ের প্রেসার দিতে?”

নূরজাহান বেগম নাহিদের কপালের চুমু একে বলে
-” যেহেতু তাকে নিজের করে পেয়েই গেছিস, তাই তার কথা ভেবে নিজেকে এই বিপদের সম্মুখীন হতে দূরে রাখতে পারিসনা?”

নাহিদ আর কিছুই বললো না।জানে কথায় কথা বারে।নাহিদ একনজর বাবার দিকে তাকালো।এই মানুষটার চোখে সে গতকাল অদ্ভুত কিছু দেখেছিল।তবে কি বাবা সম্পর্কে বুঝতে কোথাও কোনো ভুল হচ্ছে?কিন্তু নাহিদ এই মানুষটাকে কখনোই সেই সম্মান দিবে না যা তার প্রাপ্য।এটা নাহিদের জেদ বা গোঁড়ামি যাই বলুক তাতে নাহিদের কিছুই আসে যায় না।

সবাই নাহিদের সাথে দেখা করে বেরিয়ে আসলে নাহিদ বিচলিত হয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো। আসফি মুচকি হাসলো নাহিদের ব্যাকুলতা দেখে।এই ছেলেটাকে এমন রূপে দেখার বড়ো স্বাদ ছিলো।ফাইনালি সেটা পূরণ হচ্ছে। আসফি হেসে বললো

-“এতো অস্থির হতে হবে না।যাকে খুঁজছিস সে দরজার পাশেই দাড়িয়ে আছে। পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

আরজু দুরু দুরু বুকে নাহিদের কেবিনে প্রবেশ করলো।তার চোখ জোড়া যেনো ব্যাকুল হয়ে আছে নেতা সাহেবকে এক নজর দেখার জন্য।আরজু দৃষ্টি সামনে ফেলতেই দেখলো বেডে দুর্বল,নিস্তেজ একটা শরীর পড়ে আছে।নাহিদের চোখে মুখে আছে বিষণ্ণতা।আরজুর বখোস্থলে সূক্ষ যন্ত্রণা শুরু হলো।আরজুকে নিস্তব্দ হয়ে ছল ছল চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে নাহিদ তাকে ডাকলো।

-” আরজু কাম হেয়ার।”

আরজু নিস্তব্ধে নাহিদের পাশের টুলে বসলো।নাহিদ মুচকি হেসে বললো
-” সুন্দরী বউ রেখে বেড়িয়েছিলাম।কিন্তু ফিরে এসে দেখি এক বিধ্বস্ত পেত্নী সামনে বসে আছে।ঘটনা কি?”

প্রচন্ড অভিমানে আরজু দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো।এমন মুহূর্তে এমন মজা করার কোনো মানেই হয়না।নাহিদ আবার বললো
-” অভিমান করেছো নাকি?স্বামী বিছানায় পরে আছে আর স্ত্রী অভিমান নিয়ে বসে আছে।গুড।চলে গেলেই ভালো হতো।”

আরজু ঠোঁট উল্টিয়ে কেঁদে উঠলো।নাহিদের প্রতিটা কথা তাকে কষ্ট দিচ্ছে।নাহিদ কয়েক মুহূর্ত সেই কান্না উপভোজ করলো।ইসস!! কতটা ভাগ্যবান হলে প্রীয়সীর চোখে নিজের জন্য অশ্রু বিসর্জন দেখার সৌভাগ্য হয়।নাহিদ যে আসলেই বড়ো ভাগ্যবান পুরুষ।নাহলে নিয়তি তার পক্ষে চলছে কেনো?নাহিদ থমথমে গলায় বললো

-“কাম ক্লোজার আরজু।”

আরজু ছল ছল চোখে নাহিদের দিকে তাকালো।আর মাথা ঝাকিয়ে না জানালো।মেয়েটা বার বার ফুঁপিয়ে উঠছে।
নাহিদ আবার বললো

-” কাছে এসো না প্লিজ।”

আরজু এবার আর চুপ করে বসে থাকতে পাড়লো না।এতো আকুলতার ডাক নাখোচ করা কঠিন।তাই নাহিদের কাছাকাছি এগিয়ে আসলো।নাহিদ আরজুর চোয়াল দুই হাতে আবদ্ধ করে নিল।আর আরজুর ললাটে অধর ছুয়ে দিলো।পরম আবেশে আরজুর চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে আসলো।স্বামীর স্পর্শ বুঝি এতটাই প্রশান্তির হওয়ায়? এই পবিত্র স্পর্শ আরজুর সারা কায়া জুড়ে শিহরণ খেলে গেল।আরজু ভাবলো জীবন তার কাছথেকে যা কেরে নিয়েছে তার চাইতে অনেক বেশি ফিরিয়ে দিয়েছে।

_____________
সাবা খানম আর জুবায়ের আহমেদ বসে আছে নূরজাহান বেগমের মুখোমুখি। নাহিদকে ভীষণ অপছন্দ হলেও এমন একটা মুহূর্তে তিনি না এসে পারলেন না। কারণ নাহিদ নামক মানুষটির সাথে তার মেয়েটার জীবন গভীরভাবে জড়িয়ে আছে।সাবা খানমকে দেখে নূরজাহান বেগম বললেন

-“বর্তমানে যেহেতু দুই পরিবারের মধ্যে একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তাই পূর্বের তিক্ততা ভুলে সবার সামনে এগিয়ে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে।বাচ্চারা যাতে সুন্দর ভাবে নিজেদের জীবন সাজাতে পারে সেই দোয়া করবেন।”

সাবা খানম তেমন কিছু বললেন না।জুবায়ের আহমেদ মুচকি হেসে সায় দিলো।শুভর ফোনে বার বার কল আসছে।তার মা কল করছে।শুভ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।পাশে ফিরে আরজুর দিকে তাকালো।আরজু শুভর কাধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে।মেয়েটাকে ভীষণ ক্লান্ত লাগছে।শুভর হঠাৎ মনের পড়লো অনেক আগের কথা।শুভকে যখন সেদিন সেই ছেলেরা পিটিয়েছিল সেদিন আরজু কিছু ছেলেদের মাধ্যেমে তাকে হসপিটালে নিয়ে আসে।শুভ বেশ আহত হয়েছিল।আর আরজু শুভর পাশে বসে ফোঁস ফোঁস করে কেঁদেছিলো।নাকের পানি চোখের পানি ফেলে একাকার অবস্থা। ছি!! কিযে বিচ্ছিরি অবস্থা।সবাই এতো বলেও তাকে বাসায় পাঠাতে পারেনি।শুভর পাশেই ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল।আরজুকে বাসায় পাঠাতে শুভ দুর্বল গলায় আরজুকে ধমকে বলেছিলো

-” ইয়াক!!! কি নোংরা কাজ এসব?যা আমার চোখে সামনে থেকে যা।আমার বমি পাচ্ছে।বাসায় যেয়ে সোজা গোছলে ঢুকবি।”

আরজু অভিমান করে শুভর আহত গালে একটা ঠাস করে থাপ্পর বসিয়ে বাসায় ফিরে এসেছিলো।শুভ মুচকি হেসে সেই ব্যাথা গিলে নিয়েছিলো।এতো অভিমান কোথায় লুকিয়ে রাখে?

শুভ ঘুমন্ত আরজুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।তাদের এতো সুন্দর একটা সম্পর্কের মাঝে ভালোবাসার কোনো কমতি নেই।শুভ আজ বুঝতে পারছে সে আরজুর কাছে যেই ভালোবাসা প্রত্যাশা করেছে তার চাইতেও সুন্দর ভালোবাসা ময় সম্পর্ক তাদের মধ্যে অনেক আগে থেকেই ছিল।তবে শুভর মনে জন্মানো অনুভূতি কখনোই ভুলে থাকার নয়।সে আরজুকে সারা জীবন ঠিক এই ভাবেই অনুভব করবে।কিন্তু এই অবুঝ মেয়েটা হয়তো কোনদিন সেটা বুঝতেই পারবে না।আরজুকে যতবার দেখবে ঠিক ততবার হৃদয়ের ক্ষত তাজা হবে।তাই নিজেদের ভালোর জন্যই তার আরজুর কাছথেকে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।নাহলে তার হৃদয়ের হাল আরজু ঠিক বুঝে যাবে।যা আরজুর নতুন জীবনে বাজে ভাবে প্রভাব ফেলবে।

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_58

আজ প্রায় তিন দিন হতে চললো নাহিদকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে।নূরজাহান বেগম নাহিদকে নুর ম্যানশন নিয়ে যাওয়ার অনেক চেষ্টা করেছিলেন।কিন্তু নাহিদ কিছুতেই সম্মতি দেয়নি।এতে তিনি খানিকটা মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছেন।তবে এতে নাহিদের কোনো হেলদোল নেই।সে নিজের সিদ্ধান্তে অটল।আরজু এই বিষয়ে তেমন কিছুই বলে নি।কারণ নাহিদের পরিবারের সাথে নাহিদের মূল সমস্যা কি সেটা আরজু জানে না।আর কিছু না জেনে কোনো মতামত প্রকাশ করা বোকামি হবে।

বাসায় আসার পর থেকেই আরজু নাহিদের সেবায় নিজেকে ব্যাস্ত করে রেখেছে।এই মানুষটাকে এতটা সময় নিজের কাছে পেয়ে আরজু এক দিকে ভীষণ খুশি।নাহলে এই অসভ্য লোক কাজ ছাড়া কিছুই বুঝে না।সকালে ঘুম থেকে উঠেই এই মানুষটার ঘুমন্ত মুখটায় কতটা মায়া ঝরে পড়ে সেটা আরজু প্রথম দেখছে।নাহলে এই অসভ্য লোক তার ঘুম ভাঙ্গার আগেই লাপাতা হয়ে যায়।

অন্যদিকে নাহিদ বিছানায় শুয়ে বসে থাকতে থাকতে ভীষণ বিরক্ত।সর্বক্ষণ কাজের মাঝে ডুবে থাকা মানুষগুলো হয়তো এমন পরিস্থিতিতে প্রচন্ড অস্থির হয়ে পড়ে।তবে নাহিদ বিরক্ত হলেও অস্থির হলো না।কারণ এই প্রথম সে আরজুর সাথে অতটা সময় কাটাতে পারছে।বিষয়টা মন্দ লাগছে না।
নাহিদ বিছানায় আধ শোয়া হয়ে বসে বসে ফোন স্ক্রল করছে।পার্টির সকল নেতারা কল করে তার খোঁজ খবর নিচ্ছে।ফাইনালি এতো বছর পর নাহিদের স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে।এবারের নির্বাচনে নাহিদ এমপি পদে দাড়াতে যাচ্ছে।এটা তার অনেক দিনের সপ্ন। এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোতে চলবে মনোনয়ন ফরম কেনাবেচার উৎসব।মনোনয়ন অনেক পেলেও জিতবে একজনই।বিরোধী দলের নেতারা যেনো গদিতে চরার জন্য যে কোনো পদক্ষেপ নিতে পিছপা হবে না।সেই ছোট থেকেই রাজনৈতিক পরিবারের হওয়ার দরুন রাজনীতির এই নোংরা সাইড তার অনেক দেখা হয়েছে।তবে নাহিদ নিজেকে প্রস্তুত রেখেছে।ক্ষমতা কিছুতেই সেসব দুর্নীতিবাজ নেতাদের হাতে যেতে দিবে না।নাহিদ জানে সামনের পরিস্থিতি আরো কঠিন হতে পারে।কিন্তু কাপুরুষের মতো পালিয়ে যাবার মতো পুরুষ নাহিদ না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে নিজের জীবন দিতে প্রস্তুত।যেমনটা তার দাদাজান করেছে।দুনিয়ার সকলে তার দাদাজানের মৃত্যু স্বাভাবিক ভাবেই হয়েছে বলে জানলেও, নাহিদ জানে সেটা স্বাভাবিক মৃত্যু ছিলো না।সবটাই নাহিদ মনে রেখেছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।যখন শত্রুদের ধরবে তখন একদম
ছাই দিয়ে ধরবে।বেরিয়ে যাওয়ার কোনো পথ পাবে না।

-” শার্ট খুলুন।”

নাহিদ ভাবনা থেকে ফিরে আসে আরজুর বিস্ফোরক বক্তব্যে।রুমে ঢুকেই আরজু নাহিদের উদ্দেশে বলা এমন কথায় বিস্মিত হয়ে পড়লো।আরজু আবার বললো

-“কি হলো শার্ট খুলুন।”

নাহিদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো
-” আর ইউ সিরিয়াস?”

আরজু বিরক্ত হয়ে বললো
-” ইয়েস আই অ্যাম।”

নাহিদ দুষ্টু হেসে বললো
-” এই অসুস্থতায় আমার উপর টর্চার না করলে হয়না?দুনিয়ার এটাই নিয়ম দুর্বলের উপর জুলুম হয়।”

আরজু হতবম্ব হয়ে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো নাহিদের দিকে।নাহিদের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে রেগে একটা বালিশ নিয়ে নাহিদকে মারতে লাগলো।নাহিদ আরজুকে হঠাৎ করেই দুহাতে ঝাপটে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো।আকস্মিক ঘটনায় আরজুর হাত থেকে বালিশ পড়ে গেলো।আরজুর সারা কায়া শিউরে উঠলো।সে পিট পিট চোখে নাহিদের দিকে তাকালো।নাহিদ আরজুর দিকে শীতল দৃষ্টি স্থির করে বললো

-“তোমার তো অনেক সাহস। নিবরাস নাহিদকে মারছো। জানো ভবিষ্যৎ এমপিকে আঘাত করার অপরাধে পুলিশ তোমার কি হাল করবে?”

আরজু নিজেকে শান্ত করে নাহিদের দিকে এগিয়ে গেলো।নাহিদকে অপ্রস্তুত করতে নাহিদের সামনের একফালি চুল গুছিয়ে দিতে দিতে বললো

-” ভবিষ্যৎ এই এমপির গায়ে সহস্র আঘাত করার অধিকার নিয়ে আমি জন্মেছি।তাই আপনার পুলিশ, র‍্যাব,আর্মি আমার চুলটাও বাঁকা করতে পারবে না।”

নাহিদ মৃদু হাসলো।বললো
-“বাহহ!! তুমিতো সেই পাওয়ারফুল পারসন।তবে এই নাহিদকে দুর্বল ভেবো না।কারণ আমি আঘাত করলে কাউকে সেটা না দেখতে পারবে আর না বুঝাতে পারবে।অনুভূতির ঝড় বড্ডো খারাপ জিনিস।তোমাকে কখন গভীরে ডুবিয়ে ফেলবে বুঝতেই পারবে না।তখন বাঁচার জন্য ছটপট করেও লাভ হবে না।কারণ ততক্ষণে প্রেমের বানে আটকে পড়ে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়বে।”

আরজু নাহিদ কথায় ভীষণ লজ্জা পেলো।বখস্থলে ছড়িয়ে পড়লো শীতলতা।অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো আরজু।আর বললো

-” আপনি একটা অসভ্য লোক।শার্ট খুলে আপনার গা মুছে দিতে হবে।তাই খুলতে বলেছি।জলদি করুন।”

নাহিদ আরজুর লালাভ মুখ দেখে আর কিছুই বললো না।ভীষণ লজ্জা পেয়েছে মেয়েটা।চুপ চাপ শার্ট খুলে দিলো।আরজুর অসস্তি তো কমলোই না বরং আরো বাড়লো।শার্ট লেস নাহিদের শরীর যেনো তার চোখকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করছে।যেনো দমবন্ধ হবার জোগাড়।আরজু কাপা কাপা হাতে নাহিদের গা মুছে দিতে লাগলো।আরজু দেখলো নাহিদের পিঠ আর পেটে পুরনো কিছু ক্ষত।আরজু এটা আরো আগে লক্ষ করেছে।তাই আজ প্রশ্ন করলো

-” আপনার কি আগেও কোনো অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল?এতো ক্ষতর চিন্হ কেনো?”

নাহিদ যেনো মুহূর্তেই নিভে গেল।আর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো
-” এসব অনেকদিনের পুরনো ক্ষত।ছাত্র জীবনে আন্দোলনের সময় লাঠিচার্জের ফলে কিছু হয়েছে।কিছু বিরোধী দলের সাথে সংঘর্ষের ঘটনায়।এছাড়াও আরো অনেক ভাবেই।”

আরজু তার কোমল ছোট্ট হাত দিয়ে সেই ক্ষততে ছুঁয়ে দিলো।আরজুর কোমল হৃদয় নিদারুণ যন্ত্রণা অনুভব করলো।ভালোবাসার মানুষের গায়ে সামান্য আঘাত হৃদয়ে কেমন অসহ্য যন্ত্রণার সৃষ্টি করে। আরজু বললো

-” এমন ঝুঁকিপূর্ণ প্রফেশন কেনো চুজ করেছেন?যাতে লাইফ রিস্ক আছে।”

নাহিদ মৃদু হাসলো।আর বললো

-” ঝুঁকি ছাড়া তো কোনো কাজই সম্ভব না।তাছাড়া ঝুঁকির কথা চিন্তা করে তুমি কখনোই সমাজের সেবা করতে পারবে না।সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে,সমাজে পরিবর্তন আনতে গেলে কাউকে না কাউকে রিস্ক নিতে হবে।ভয় পেয়ে ঘরের কোনে লুকিয়ে মন্তব্য করলে চলবে না।মাঠে নেমে সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে হবে।পলিটিক্স আমার প্যাশন।সেই ছোট থেকেই এই স্বপ্ন আমার মনের মধ্যে একটু একটু করে বেড়ে উঠেছে।আজ এই অবস্থানে আসার জন্য আমাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে।অনেকেই ভাবে আমি দাদাজানের বদৌলোতে সবটাই খুব সহজে মুঠোয় পেয়ে গেছি।কিন্তু আমার পরিশ্রমের জায়গাটা সবাই জানে না। আট দশজনের মতোই আমাকে শুরু থেকে শুরু করতে হয়েছে।সমাজের সেবায় নামলে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেই নামতে হয়।কবে কার গুলিতে আমার জীবন শেষ হবে জানা নেই।কিন্তু সেই ভয়ে হাত গুটিয়ে রাখলে চলবে না।”

আরজ আঁতকে উঠল।পেছন থেকেই নাহিদের উন্মুক্ত পৃষ্ঠে মাথা রাখলো।আর বললো

-“দয়া করে এসব বাজে কথা বলবেন না।আমি জীবনে অনেক হারিয়ে কিছু মানুষদের পেয়েছি।যাদের আমি কখনোই হারাতে চাইনা।”

নাহিদ তার পৃষ্ঠে তরল কিছু অনুভব করে পেছন ফিরে তাকালো।আরজুর ডাগর ডাগর আখি পল্লব জুড়ে অশ্রুকণা জমা হয়েছে।নাহিদ আরজুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো

-” এতো অল্পতে ভেঙে পড়লে চলবে আরজু?ইউ হ্যাভ টু বি স্ট্রং।একজন পুরুষের স্ট্রেন্থ কিন্তু একজন নারীর।সেই নারী পুরুষের মনোবল বাড়ায়।আমি চাই তুমি আমার স্ট্রেন্থ হও।কারণ যেই মানুষটা একজন পুরুষের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।ঠিক সেই মানুষটি পারে সেই পুরুষের স্ট্রেন্থ হতে।”

আরজু নিজেকে শান্ত করলো।নেতা সাহেব ঠিক বলেছে।তাকে ভীষণ স্ট্রং হতে হবে। আরজু বুঝতে পারলো পলিটিক্স নাহিদের জন্য সাধারণ কোনো প্রফেশন না।এই মানুষটা পলিটিক্স নিজের সত্তায় ধারণ করে রেখেছে। জনসাধারণের সেবায় নিজের জীবন দিতে একবারও ভাববে না মানুষটি।নাহিদের প্রতি আরজুর শ্রদ্ধাবোধ আরো কয়েক গুণ বেড়ে গেলো।মনে মনে নিজেকে ভীষণ ভাগ্যবতী মনে হলো।এমন অদ্ভুদ মানুষটাকে জীবনে পেয়ে আরজুর জীবন যেনো সার্থক হলো।

____________
অবণী ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে সামনে সোফায় বসা নাহিদের দিকে।নাহিদ হেসে বললো

-” কি ব্যাপার শালী সাহেব?এই ভাবে কি দেখো?”

অবণী বিস্ময় প্রকাশ করে বললো
-” আমি ভেবেছি কাউকে গুলি করা এসব সিনেমাতেই হয়।বাস্তবে এসব কিছুই হয়না।কিন্তু আমার হিরোর মতো দুলাভাইকে কোন মহিষ গুলি করলো?তাকে পেলে আমি জুসারে ভরে তার জুস বের করে দিতাম।”

নাহিদ মুচকি হেসে বললো
-“এক্সাক্টলি। আমার সব শত্রুর পক্ষকে জানিয়ে দিতে হবে আমার একজন সুপারউইম্যান শালী আছে।সো ভুলেও আমার দিকে গুলি বারুদ ছুরা যাবেনা।”

-” ভাইয়া আপনি কি শুট করতে পারেন? মানে আপনার কাছে রাইফেল আছে।”

-” আরে না।এসব কি বলো।রাইফেল দেখলেই আমার ভয় লাগে।আর গুলি করা অনেক দূরের বিষয়।”

অবণী বিজ্ঞদের মতো মাথা দোলালো।ফুয়াদ হেসে বললো
-” অবণী তুমি চাইলে পুলিশে জয়েন করে তোমার দুলাভাইকে প্রোটেক্ট করতে পারো।”

অবণী মাথা নেড়ে বললো
-” অসম্ভব।আমি মোটেও পুলিশে জয়েন করবো না।আমিতো এক সিনিয়র ব্যাটা ধরে বিয়ে করে নিবো।তারপর চুটিয়ে প্রেম করবো।কারণ সিনিয়র ব্যাটারা বিয়ের আগে প্রেম করতে চায় না।”

নাহিদ কপাল কুঁচকে বললো
-” কি ব্যাপার শালী সাহেবা,প্রেম প্রেম গন্ধ পাচ্ছি!!”

অবণী নাহিদের দিকে ঝুঁকে বললো
-” প্রেমে কি শুধু আরজু আপুই পড়বে নাকি? আমি পারি না?”

-” একদম পারো।তোমাদের দুই বোনের জন্মই সিনিয়রদের প্রেমে পড়ার জন্য।”

-” আপু তো আপনাকে পটিয়ে ফেলেছে এবার আমার পালা।আমিও ঠিক ওই ব্যাটাকে পটিয়ে ফেলবো।”

শুভ আড়চোখে তাকিয়ে বললো
-” আন্টিকে বলবো তোর সিনিয়রের গল্প?”

অবণী মেকি হেসে বললো
-” আমার মাকে কোমায় পাঠাতে চাইলে বলতে পারো।এমনি আরজু আপুর দেয়া শক থেকে বের হতে পারেনি বেচারি।”

অবনীর কথায় সবাই হেসে উঠলো।আজ বন্ধু মহলের সকলেই এসেছে নাহিদকে দেখতে।নাহিদ সবাইকেই ভালো মতো গ্রিট করেছে।নাহিদ সবার সাথে এতো সহজ আর সাবলীল ভাবে কথা বললো যেনো বহু বছর ধরে তাদের চেনে।অন্তত রামিমের কাছে তাই মনে হলো।শুভ নাহিদের উদ্দেশ্য বললো

-” স্যার আপনার শরীর ঠিক আছে?”

নাহিদ হেসে বললো
-“মাচ বেটার।আর তোমরা আমাকে ভাইয়া ডাকতে পারো।একে আমি তোমাদের ভার্সিটির সিনিয়র ছিলাম তার উপর তোমাদের ফ্রেন্ডের হাসবেন্ড।তাই ভাইয়া ডাকটা বেশি অপ্রপিয়েট হবে।”

জারা,রিমি আর সাবিহাকে আরজু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সারা বাড়ি দেখাচ্ছে।জারা বললো
-“নাহিদ ভাইয়ার চয়েস বেশ ক্লাসি। আই লাইক ইট।”

আরজু হেসে বললো
-” আমার দেবরের চয়েজ ও কিন্তু ক্লাসি।”

জারা রেগে আরজুর দিকে তাকালো।আরজু মুখ ভেংচে সামনে এগিয়ে গেলো।দুপুরে সবাই এক সাথে লাঞ্চ করলো।লাঞ্চ শেষে বিকেলের দিকে আরজু সবার জন্য কফি নিয়ে আসলো।আর হাসি মুখে বললো

-” আমি নিজে তোদের জন্য কফি বানিয়েছি।লাইফে থার্ড টাইম।”

বলেই আরজু শুভর আর নাহিদের দিকে তাকালো।রিমি চশমা ঠিক করে বললো

-” থার্ড টাইম?তবে ফার্স্ট আর সেকেন্ড টাইম কাকে বানিয়ে দিয়েছিস?”

আরজু হেসে বললো
-” যখন কলেজে পড়তাম তখন একবার শুভকে খাইয়েছিলাম।এই শুভ মনে আছে তোর? আর সেকেন্ড টাইম উনাকে।”

বলেই আরজু লাজুক হাসলো।নাহিদ আড়চোখে শুভর দিকে তাকালো।শুভ নিজেও অসহায় মুখ করে নাহিদকে দেখছে।কলেজ লাইফে একদিন আরজু আর শুভ আরজুদের বাসায় আড্ডা দিচ্ছিল।তারা তখন বাজারে ছিলো।তাই আরজু নিজেই সাহস করে প্রথম শুভর জন্য কফি বানিয়েছিল।আর শুভ সেই কফি মুখে দিয়েই বুঝেছে এর চাইতে জঘন্য কফি এই দুনিয়ার কেউ বানাতে পারবে না।শুভ বলেছিল

-” এই ইউনিক কফির রেসিপি কোথা থেকে পেয়েছিস?”

-” ইউটিউব থেকে।দারুন দারুন রেসিপি শেয়ার করে ওই আপুটা।”

শুভ বুজলো ওই আপুই এই জঘন্য কফির উদ্ভাবক।আরজু তেমন একটা কফি পছন্দ করেনা।তাই সে নিজের বানানো কফি কোনোদিন ট্রাই করেনি।করলে নিশ্চই আর জীবনে বানাতো না।

শুভ বিশ্বাস করতে পারছে না নাহিদের মত এমন গুরুগম্ভীর লোক আরজুর বানানো জঘন্য কফি হজম করে নিয়েছে।আরজুর বানানো কফি মুখে দিয়ে সবাই মুখ বিকৃত করে নিলো।কিন্তু শুভ আর নাহিদ বেশ আয়েশ করেই সেই কফি মুখে পুরে নিচ্ছে।ফুয়াদ মনে মনে বললো

-” আহা প্রেম!! এই প্রেম মানুষকে হাসি মুখে বিষ পান করাতে সক্ষম।সামনের দুজন মানুষকে দেখে তেমনটাই মনে হচ্ছে।”

কেউ আর আরজুর মন ভেঙে তার কফির জঘন্য স্বাদের কথা জানালো না।বরং খুব সাবধানে কফি ফেলে দিলো।জারা মেকি হেসে বললো

-” তোর এই ইউনিক কফির জন্য নোবেল ছুড়ে মারা হোক।”

রিমি হেসে বললো
-” তুই চাইলে ক্যাফে খুলে নিতে পারিস।”

আরজু আগ্রহ নিয়ে বললো
-” আসলেই এতো ভালো হয়েছে? আমিতো নিজেই ট্রাই করিনি।”

নাহিদ মৃদু হেসে বললো
-” নিজের বানানো স্পেশাল খাবারের স্বাদ নিতে নেই।এতে স্বাদ কমে যেতে পারে।”

আরজু কপাল কুঁচকে বললো
-” এটা আবার কেমন লজিক?”

ফুয়াদ বললো
-” এই লজিকের কথা আমিও শুনেছি।”

আরজুর এদের কথা বিশ্বাস হলো না।তাই এই নিয়ে আর কথা বাড়ালো না।আজ অনেকদিন পর সবাইকে এক সাথে পেয়ে আরজু অনেক বেশি খুশি হলো।কিন্তু আরজু বুঝতে পারছে শুভ তার কাছথেকে দূরত্ব বজায় রাখছে।শুভর এতো অভিমানের কারণ আরজুর আজও অজানা।এতো সুন্দর মুহূর্তের মাঝেও আরজুর মনটা কিছুতেই স্বস্তি পেলো না।বাকি সবাই বাগানে ঘুরতে গেলো। কিন্তু শুভ গেলো না।বরং সোফায় বসে ফোন নিয়ে পড়ে রইলো।বাকি সবাই শুভর মনে অবস্থা সম্পর্কে জানে বলে তেমন জোর করলো না।আজ সে এই বাসায় মোটেও আসতে চায়নি।কিন্তু আরজু কষ্ট পাবে ভেবেই এসেছে।কিন্তু আরজুর কাছথেকে অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখেছে। নাহিদ শুভর দিকে তাকিয়ে বললো

-“তোমাদের এই বন্ধুমহল দেখলে মনে কেমন প্রশান্তি বয়ে যায়।আমার সেই ভার্সিটির দিন মনে পড়ে যায়।আমাদেরও বন্ডিং এমন ছিলো।তবে কেউ কেউ সত্যিকারের বন্ধুত্ব ডিজার্ভ করেনা।তবে তোমার আর আরজুর মতো এমন বন্ধুত্ব আমি একটাও দেখিনি।এই সম্পর্ক গুলো ভীষণ মূল্যবান।আমি সবসময় এমন নিঃস্বার্থ সম্পর্ককে সম্মান করি।আরজুর মনে বিশ্বাস,আস্থার ওই জায়গাতে আমি আজও পৌঁছাতে পারিনি যেটা তুমি দখল করে আছো।বিষয়টা আমাকে বেশ প্রভাবিত করে।আরজুর জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ন অংশ তুমি।এমন বন্ধুত্ব বর্তমানে সত্যিই বিরল।”

নাহিদ এবার খানিকটা নড়েচড়ে বসলো।পাঞ্জাবীর হাতা গুটাতে গুটাতে বললো

-“আমি জানি তোমাদের মধ্যে কিছু মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং চলছে।যেটা তোমার আর আরজুর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করছে।আর এই বিষয়টা আরজুকে ভীষণ পীড়া দিচ্ছে।আমি জানি আরজুর চোখের অশ্রু তুমি নিজেও সহ্য করতে পারো না।তবে কেনো এতো অভিমান করে আছো?তুমি আজ যে ভালোবাসা, বন্ধুত্ব পেয়েও অবহেলা করছো অনেকেই এমন ভালোবাসা আর বন্ধুত্বের জন্য হাজারো তপস্যা করে।ভালোবাসা কখনো পাওয়া না পাওয়ার হিসেব করে হয়না।কারণ দুর থেকেই ভালোবাসার মানুষকে হাসি মুখে দেখা তৃপ্তি বক্ষস্থলে প্রশান্তি দেয়।ভালোবাসা মানুষকে নতুন বাঁচতে শেখায়।মানুষ যতো সহজে অভিমান প্রকাশ করতে পারে ভালোবাসা কেনো পারে না?যদি পারতো তবে জীবনটা অনেক সহজ হয়ে যেতো।এই ক্ষেত্রে আরজু ভিন্ন।সে নিজের অভিমান আর ভালোবাসা দুটোই প্রকাশ করতে জানে।তাইতো সে জীবনে সবকিছু পাওয়া ডিজার্ভ করে।বন্ধুত্ব,ভালোবাসা সবকিছুই।”

শুভ হতবম্ব হয়ে নাহিদের দিকে তাকিয়ে রইলো।এই মানুষটা তার মনের গভীরে লুকানো অনুভূতি কেমন করে বুঝতে পারলো?যেটা আজ অব্দি আরজু বুঝতে পারেনি।এই মানুষটা আসলেই তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যাক্তি।এতো ক্ষমতাবান হয়েও এই ব্যাক্তির মধ্যে কোনো অহংকার নেই।কত সাবলীল ভাবে শুভকে জটিল বিষয়টা বুঝিয়ে দিলো।এই মানুষটা উপর থেকে গম্ভীর,ধাম্ভিক মনে হলেও ভেতরের মানুষটা একদম বিপরীত।একজন নেতা সম্পর্কে শুভর ধারণার অনেকটা পরিবর্তন হলো আজ।শুভ ভেজা চোখে তাকিয়ে রইলো নাহিদের দিকে।নাহিদ মৃদু হেসে শুভর সামনে এসে শুভর মাথায় স্নেহের হাত রেখে বললো

-” আমার কিছু হয়ে গেলেও আরজুর জন্য তেমন দুশ্চিন্তা হয়না।কারণ আমি জানি আরজুর জন্য এমন কেউ আছে যে নিঃস্বার্থ ভাবে তাকে সারা জীবন আগলে রাখবে।তাকে ঠিক সামলে নিবে।তোমার অনুভূতির প্রতি আমার তীব্র সম্মান শুভ।তোমাদের এই মূল্যবান সম্পর্ক বেচেঁ থাকুন চিরকাল।সেটাকে নষ্ট হতে দিও না।”

কথাটা বলেই নাহিদ সেখান থেকে চলে গেলো।আর শুভর গাল বেয়ে ঝড় পড়লো বিন্দু বিন্দু অশ্রু।শুভ মনে মনে বললো

-” তুই সঠিক মানুষ চিনতে ভুল করিসনি আরজু।তোর পবিত্র হৃদয় আজ পর্যন্ত কোনোদিন মানুষ চিনতে ভুল করেনি।এক দারুণ মানুষকে পেয়েছিস তুই।যেই মানুষটা নিজের স্ত্রীর প্রতি অন্য পুরুষের অনুভূতিকে সম্মান করতে জানে সে সাধারণ পুরুষ না।”

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_59

শহর জুড়ে নেমেছে বসন্তের ছোঁয়া।ফাল্গুন এবং চৈত্র মাস মিলে হয় বসন্ত ঋতু। বসন্ত ঋতুর আগমন ঘটে শীত চলে যাবার পর এবং গ্রীষ্ম আসার আগে। গ্রীষ্মমন্ডলীয় এলাকায় তাপমাত্রা বাড়তে থাকে কারণ পৃথিবী সূর্যের দিকে হেলে থাকে। পৃথিবীর অনেক প্রান্তে এই ঋতুতে ফুল ফুটে, নতুন গাছের পাতা গজায়, নতুন গাছের জন্ম হয়। এর ফলে গাছপালা বেড়ে উঠে, ফুল ও ফলের পরবর্তী বেড়ে ওঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

এই বসন্তে অশোক, আকআড়কাঁটা, হিমঝুরি, ইউক্যালিপটাস, রক্তকাঞ্চন, কুরচি, কুসুম, গাব, গামারি, গ্লিরিসিডিয়া, ঘোড়ানিম, জংলীবাদাম, জ্যাকারান্ডা, দেবদারু, নাগেশ্বর, পলকজুঁই , পলাশ, পাখিফুল , পালাম, বুদ্ধনারিকেল, মণিমালা, মহুয়া, মাদার, মুচকুন্দ, রুদ্রপলাশ, শাল, শিমুল, স্বর্ণশিমূল, ক্যামেলিয়া ইত্যাদি ফুল ফুটে।চারদিকে চলে রঙের মেলা।

এই বসন্ত আর ভালোবাসা মিলে মিশে একাকার হয়ে আছে।আরজু ভার্সিটিতে পৌঁছালো বসন্তকে স্বাগতম জানিয়ে।বন্ধুমহলের সকলেই আজ বাসন্তী রঙকে গায়ে জড়িয়েছে।সবাই আজ আগের মতো মাঠে বসে গল্পের আসর জমিয়েছে।পাশেই ছোট একটা ছেলে কিছু ফুল নিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসলো। রামিমের ছেলেটাকে দেখে ভীষণ মায়া হলো। যেই বয়সে খেলনা নিয়ে খেলার কথা,কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলের যাবার কথা,সেই বয়সে জীবিকার তাগিদে ফুল বিক্রি করতে হচ্ছে।রামিম সবার জন্য একটা করে হলুদ গোলাপ নিলো।কিন্তু একটা শর্ট পড়েছে।তাই ছেলেটা একটা লাল গোলাপ তার হাতে ধরিয়ে দিলো।রামিম আর মানা করতে পারলো না।

আরজু আর জারা রামিমের হাত থেকে একটা করে হলুদ গোলাপ নিয়ে বললো

-” আমাদের হলুদ ফুলটা দে।শাড়ির সাথে দারুন ম্যাচ হবে।খোঁপায় গুজে সেলফি তুলবো।”

বলেই দুজন খোঁপায় গুজে নিলো।রিমি আর সাবিহা তখন ওয়াশ রুমে ছিলো।তারা আসতেই দেখলো রামিম একটা লাল গোলাপ আর একটা হলুদ গোলাপ নিয়ে বসে আছে।রিমি চশমা নাকের সাথে এটে দিয়ে মন খারাপ করে বললো

-” এই লালটা আমার শাড়ির সাথে একদম যাবে না।”

রামিম রিমির দিকে হলুদ গোলাপ এগিয়ে দিয়ে বললো
-” তাহলে হলুদ ফুলটা নে।”

রিমি গোলাপ নিলো ঠিক কিন্তু কিছুতেই খোঁপায় গুঁজে দিতে পারছেনা।সাজ গোজে তার তেমন আগ্রহ নেই।নিতান্তই আরজু আর জারার খপ্পরে পড়ে সাজতে হয়েছে। এসবে সে ততো পটু না।রিমি আসে পাশে আরজু আর রিমিকে খুঁজলো।দুই বাদর সেই দূরের কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে দাড়িয়ে পাউট দিয়ে ছবি তুলছে।সাবিহার দিকে এগিয়ে যেতে গেলে শুভ বললো

-” আমাকে দে,আমি গুজে দিচ্ছি।ওদের একটু একা থাকতে দে।এই দিনে যদি হাদারাম গুলো নিজেদের মনের অনুভূতি প্রকাশ করতে না পারে,তবে এই জীবনে পারবে না।আমাকে দেখেও শিক্ষা হয়নি।যেদিন সব হারাবে সেদিন আফসোস ছাড়া কিছুই থাকবে না জীবনে।”

রিমি মলিন মুখে বললো
-” দ্বিতীয়বার কি ভালোবাসা যায় না?”

শুভ থমকে তাকালো রিমির দিকে।তারপর দৃষ্টি দূরে আরজুর দিকে নিবদ্ধ করে বললো
-” জানিনা।তবে আমি মনে হয় পারবো না।”

রিমি শুকনো ঢোক গিলে বললো
-” মানুষ পারেনা এমন কিছু নেই।যদি এমন কেউ আসে যে তোকে নিজের অস্তিত্বের সাথে মিশিয়ে নিতে চায় তাকে কি ফিরিয়ে দিবি?”

শুভ মলিন হেসে বললো
-“জেনে শুনে কেউ ভাঙ্গা হৃদয়ের অংশীদার হতে চাইবে না।কারণ সেই মানুষটাকে হয়তো সেই ভাবে ভালোবাসতে পারবো কিনা আমি নিজেই জানিনা।”

রিমি কথা বাড়ালো না।শুভর মন মস্তিষ্ককে বর্তমানের আরজুর বিচরণ।কিন্তু শুভর এই ভাঙ্গা হৃদয়ের অংশীদার সে হতে চায়।সেই সুযোগ কি আদো দিবে শুভ?

শুভ বেশ যত্ন নিয়ে রিমির খোঁপায় গোলাপ গুঁজে দিতে লাগলো।রিমি নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো।অদ্ভুদ শিহরণ জাগানো অনুভূতি হচ্ছে।শুভর প্রতিটা কেয়ার রিমির বুকে ভালোবাসার ঢেউ তুলে। এই মানুষটা সম্পর্কের যত্ন নিতে জানে।আচ্ছা শুভ কি কোনোদিন আরজুর মতো তাকে ভালোবাসতে পারবে?

শুভ রিমির খোঁপায় গোলাপ ফুল গুঁজে আড়চোখে দূরে দাড়ানো আরজুর দিকে তাকালো।ইসস!! কি মায়াবী লাগছে পাগলীটাকে।আরজু এমন এক নারী যার দিকে কোনো পুরুষ একবার তাকালে চোখ ধাঁধিয়ে যাবে।শুভ চোখ নামিয়ে নিলো।আরজু আর তার নেই।এই আরজু অন্য কারো সম্পদ।এই রূপসীকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখার অধিকার শুধু সেই মানুষটার।

রিমি খেয়াল করলো শুভ আরজুর দিকে তাকিয়ে আছে।রিমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।শুভর মনে আরজু যেই জায়গা দখল করে আছে শুভর জন্য সবটা ভুলে যাওয়া অসম্ভব।
রামিম হাতের লাল গোলাপ নিয়ে বেশ দ্বিধা দ্বন্দ্বে পড়ে গেলো।সাবিহাকে কি ভাবে এই লাল গোলাপ দিবে?যদি অন্য কিছু ভাবে।যদি মনে কোনো প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়।সাবিহা হয়তো রামিমের অবস্থা বুঝতে পারলো।তাই রামিমের সামনে পেছন ফিরে বসে বললো

-” আমার শাড়ীর সাথে লাল গোলাপ দারুন লাগবে।শাড়ির পাড়ে লাল আছে।জলদি খোঁপায় পরিয়ে দে।”

রামিম খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো।আর বললো
-” আমি এসব পারিনা।তুই নিজে পর।”

সাবিহার মেজাজ খারাপ হলো।আজ এই ভালোবাসার দিনে অন্তত এই ছেলেটা নিজের মনের কথা বলতে পড়তো।কিন্তু না এই ভেরা জীবনেও বলবে না।বরং আজ আরো দূরে দূরে পালাবে।সাবিহা অভিমানী সুরে বললো

-” ঠিক আছে লাগবে না পড়ানো।এসব পারবি কেনো?কাজের কাজ কখনোই পারিস না তুই।”

সাবিহা উঠে যেতে চাইলে রামিম শাড়ির আঁচল টেনে ধরলো।সাবিহা চমকে রামিমের দিকে তাকালো।রামিম আঁচল ছেড়ে বললো

-” সরি।এতো রাগের কি আছে।বস আমি ফুল পরিয়ে দিচ্ছি।”

সাবিহা মুচকি হাসলো।অভিমান না ছাই।সাবিহা জানে রামিম তাকে আটকাবে।এই ছেলে সহজ ভাবে কিছু করে পারেনা।রামিম সাবিহার খোঁপায় ফুল গুঁজতে গুঁজতে সাবিহার দিকে ঝুঁকে জোরে নিঃশ্বাস টেনে নিল।মিষ্টি সুভাস ভেসে আসছে সাবিহার লম্বা কেশ থেকে।কেমন মাতাল করা সুভাস।
ফুয়াদ সেই সুন্দর মুহূর্তের বেশ কিছু ছবি ক্লিক করে রাখলো।আর আফসোস করে বললো

-” আজ একটা গফ নাই বলে।কেমন এতিম এতিম লাগতেছে।”

শুভ বললো
-” তোর পিছে তো মেয়েদের লাইন পড়ে আছে।একটাকে ধরলেই পারিস।”

ফুয়াদ দুই পকেটে হাত গুজে সামনের একটা কংক্রিটে হালকা লাথি দিয়া বললো

-” ইন্টারেস্ট পাইনা।ওইসব নেকা গফ জাস্ট অসহ্য লাগে।”

শুভ ভাবুক সরে বললো
-” তুই ইন্টারেস্ট পাসনা!! স্ট্রেঞ্জ।আগেতো মাসে মাসে গফ চেঞ্জ করতি।নাকি কোনো একজনের মায়ায় পড়ে গেছিস।যেই কারণে অন্য মেয়েদের প্রতি আকর্ষণ বোধ করছিস না।”

ফুয়াদ খানিকটা অবাক হলো।কই এমন কিছুতো তার মানে হচ্ছে না।কোনো মেয়ের মায়ায় তো ও পড়েনি।আজ কাল বন্ধুমহলের বাইরে লামিয়া ছাড়া অন্য কোনো মেয়ের সাথে কথাই হয়না।তবে সে কি করে কারো মায়ায় পড়লো?
___________________
ভার্সিটির থেকে বাসায় পৌছে আরজু ফ্রেস হয়ে নিজের মন মত রুমটা সাজিয়েছে।নেতা সাহেবকে এই ভালোবাসার দিনে একটু চমকে দিল কেমন হয়!!আরজু আজ নেতা সাহেবকে নিজের মনের অনুভূতি প্রকাশ করবে বলে ভেবেছে।নেতা সাহেব তার অস্তিত্ব জুড়ে কতটা মিশে আছে সবটা জানাবে।তার নেতা সাহেব হয়তো কখনোই নিজের মনের কথা প্রকাশ করতে পারবে না।তাই প্রথম উদ্যোগটা তাকেই নিতে হবে।এই আনরোমান্টিক বরকে একটু রোমাঞ্চ শেখাতে হবে।তানাহলে এই লোক চিরকাল ব্রহ্মচারী রয়ে যাবে।আরজুর ছোট্ট নেতা সাহেবের স্বপ্ন কখনোই পূরণ হবে না।তাছাড়া ভালোবাসার প্রকাশ শুধু পুরুষদের কেনো করতে হবে? একজন নারী যদি কোনো পুরুষকে ভালোবেসে পাগলপ্রায় হয়ে পড়ে শুধু মাত্র লোকলজ্জা এর সমাজের ভয়ে কেনো গুটিয়ে থাকবে।নিজের ইচ্ছা,অনুভূতি সবটা প্রকাশ করার অধিকার নারীর আছে।

আরজু নাহিদের ফোনে কল করলো।কল রিসিভ করলো আসিফ।আরজু গম্ভীর সুরে বললো

-“আপনার স্যারকে বলে দিবেন আজ যদি দেরী করে বাসায় ফেরার প্ল্যান থাকে তবে সেটা ভুলে যেতে।আজ দেরী করে ফিরলে তাকে ক্রস ফায়ার করে বুক ঝাঁজরা করে দিবো।”

আসিফ খানিকটা ভরকে গেলো।আর চিন্তিত হয়ে বললো
-” ম্যাম স্যার একটা মিটিংয়ে।এই মিটিং কয়টায় শেষ হবে বলতে পারছি না।”

-“মিটিং ফিটিং বুঝতে চাইনা।তাকে বলে দিবেন”যেই লোক বউ সামলাতে জানে না ,সে দেশ কি করে সামলাবে?”

আসিফ পড়লো বড়ো ঝামেলায়।এই মিটিং বেশ গুরুত্বপূর্ণ।নাহিদ স্যার কাজের সময় ডিস্টার্ব মোটেও পছন্দ করে না।।কিন্তু এই খবর স্যারের কাছে পৌঁছাবে কি করে।না পৌঁছালে আরজু তার গলা চিপে ধরবে।দুই স্বামী স্ত্রীর মাঝে পরে তার স্যান্ডউইচ এর মতো অবস্থা।দুজন দুই জাতের পাগল।

আসিফ খুব সাবধানে নাহিদের কান অব্দি এই কথা পৌঁছালো।নাহিদ কয়েক সেকেন্ড হতবম্ব হয়ে আসিফের দিকে তাকিয়ে ছিলো।পরক্ষণে নিজেকে সামলে বললো

-“আপনার ম্যামের মাথা আজ গরম মনে হচ্ছে।”

আসিফ মনে মনে ভাবলো
-” যার আপনার মতো রসকষ হীন বস থাকে তার জীবনে রোমান্স থাকেনা।আজ না আপনি নিজের বউকে সময় দিয়েছেন আর না আমাকে আমার হবু বৌয়ের কাছে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছেন।”

কিন্তু আসিফ মুখে বললো
-“আজ তো ভালোবাসা দিবস তাই হয়তো ম্যাম আপনার কাছে সময় চাইছে।”

নাহিদ মুচকি হাসলো।আর বললো
-“ভালোবাসার জন্য কোনো নির্দিষ্ট দিনের প্রয়োজন হয় নাকি। কারো প্রতি হৃদয়ের গভীরে ভালোবাসা থাকলে প্রতিটা দিনই ভালোবাসার দিন।তবে একটা দিন স্পেশাল হবে কেনো?”

আসিফ এই কঠিন যুক্তির পিছে কিছুই বলতে পাড়লো না।তাই বললো
-” জানিনা স্যার।”

নাহিদ পাঞ্জাবীর হাতা কনুই অব্দি তুলতে তুলতে বললো
-” গাড়ি বের করতে বলুন।আগে বউ সামলে আসি।পড়ে নাহয় দেশ সামলাবো।”

আসিফ নাহিদ কথায় খানিকটা লজ্জা পেলো।তবে বুঝতে পারছে তার পাথরের ন্যায় কঠিন স্যার ধীরে ধীরে নরম হচ্ছে।আসলেই প্রণয় অনুভূতি মানুষকে কতটা বদলে দিতে পারে।

নাহিদ বাসায় পৌঁছালো প্রায় বারোটার দিকে। আজও দেরী হয়ে গেলো।মনে মনে ভাবছে আজ তার বউ রেগে আছে কেনো?তার জানামতে সকালে সেজেগুজে রূপসী বেরিয়েছিল।বন্ধুদের সাথে সারাদিন টই টই করে ঘুরে বেরিয়েছে।তাহলে এমন হুমকি দেওয়ার কারণ কি? বউ মানেই জটিল অঙ্ক।যা সমাধান করা অসম্ভব।আর আরজুর মতো আধ পাগলী বউ হলে কথাই নেই।

নাহিদ দরজায় দাড়িয়ে এক মুহূর্ত চিন্তায় পড়ে গেলো।পড়ে কপাল চুলকে ভেতরে প্রবেশ করলো।আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নাহিদ অবাক হয়ে গেলো।নিয়ন আলোয় সারা ঘর জুড়ে ফুলের সুবাস ভেসে আসছে।নাহিদ খেয়াল করে দেখলো ড্রেসিং টেবিলের সামনে ফ্লাওয়ার ভাসে হাসনাহেনা ফুল রাখা।তার সুভাস সারা ঘরে মৌ মৌ করছে।বিছানার সাইডে হার্ট সেপের অসংখ্য লাল বেলুন।বিছানায় হার্ট সেপের একটা কার্ড রাখা।নাহিদ ধীরে ধীরে সেদিকে এগিয়ে গেলো।বুকের ভেতর কেমন ধুক পুক করছে।কার্ডটি হাতে নিয়ে খুলতেই তাতে গুটি গুটি অক্ষরে কিছু শব্দ দেখতে পেলো।

-“প্রথম দর্শনে কখনোই কারো প্রেমে পড়া হয়নি আমার।এটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতো।কিন্তু সেদিন সেই সন্ধায় রক্তাক্ত ছেলেটাকে নিয়ে হসপিটালে যাবার পর আমার সামনে দাড়ানো মানুষটাকে দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম।যেই মানুষটা কোনো প্রশ্ন ছাড়া আমাকে সাহায্য করেছিল।সেই ধাম্ভিম মানুষটার চোখে আমি অদ্ভুত মায়া দেখেছি।এক অচেনা অনুভূতি আমার মন মস্তিষ্ককে গ্রাস করে রেখেছিল।তারপরের দিন গুলি ছিলো আমার জন্য ভীষণ এলোমেলো।সেই অচেনা ব্যাক্তিটি কে আমি কিছুতেই ভুলতে পারছিলাম না।তারপর অদ্ভুদ ভাবেই সেই মানুষটা অনেক বার আমার সামনে চলে এসেছিল।আমি যেনো নিজেকে হারিয়ে ফেলছিলাম তার মাঝে।অচেনা মানুষটা আমার দিবা স্বপ্ন হয়ে দাড়ালো।আর যখন জানতে পারলাম সেই মানুষটা বেশ বিত্তশালী পরিবারে ক্ষমতাধর নেতা।আমার অনুভূতিতে কোনো ভাটা পড়েনি।কারণ আমার জন্য প্রতিপত্তি কোনো মেটার করেনা।সে হতে পাড়ে পাওয়ারফুল নেতা।কিন্তু আমার জন্য সে আস্ত একটা অনুভূতি।

দুর্লভ সেই মানুষটাকে যেদিন আমি নিজের করে পেলাম।নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।নিজের পছন্দের মানুষটিকে জীবনসঙ্গী করে পাবার মত ভাগ্য কয়জনের ভাগ্যে জুটে বলুন?কিন্তু তাকে মুখ ফুটে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করতে দ্বিধা হচ্ছিলো।তবে আমি নিজেকে মেলে ধরতে কখনো ভয় পাইনা।তবে এই মানুষটার সামনে আমি বরাবর দুর্বল হয়ে পরি।প্রণয়ের কথা মুখে বলতে কেমন জড়তা কাজ করে।কিন্তু দমে যাওয়ার মেয়ে আমি নই।তাই এই পন্থা অবলম্বন করেছি।নেতা সাহেব আমি আপনাকে ভালোবেসে সেই কবেই নিজেকে হারিয়েছি।আপনি কি আমাকে খুঁজতে সাহায্য করবেন?আমি হাত বাড়িয়ে দাড়িয়ে আছি।আপনি কি আমার হাতে হাত রেখে দুর্গম পথ পাড়ি দিবেন?”

কিছুর শব্দ পেয়ে নাহিদ পেছন ফিরে তাকালো।হালকা স্নিগ্ধ আলোয় এক অপ্সরী তার সামনে দাড়িয়ে আছে।লাল রঙের ফিনফিনে সিল্কের শাড়িতে আরজুকে লাস্যময়ী লাগছে।নাহিদ কয়েক মুহূর্তের জন্য ব্লাঙ্ক হয়ে গেলো।তার মনে হচ্ছে আশেপাশে সব কিছু থেমে গেছে।শুধু সামনের এই মায়াবতীর কেশ এলোমেলো ভাবে উড়ে চলছে।এমন রূপসীর দেখা নাহিদ আগে কখনোই পায়নি।নাহিদ তার অবাধ্য দৃষ্টি জোড়া আরজুর সারা দেহে বুলালো।কিন্তু নাহিদের হৃদস্পনদ থেমে গেলো ফিনফিনে শাড়ির নিচে ভাসমান বৃত্তাকার বেলিবাটনে দৃষ্টি পড়তেই।নাহিদের সবকিছু এলোমেলো হতে শুরু করলো।চারদিকে কেমন উষ্ণতা অনুভব করলো।কপাল জুড়ে বিন্দু বিন্দু নোনতা স্বেদবারি জমা হলো।নাহিদ ভীষণ অস্থির অনুভব করলো।নিজের এতদিনের যত্নে গড়া কঠিন খোলসটা কেমন ফাটল ধরতে শুরু করেছে।এই রূপে আরজুকে কখনোই দেখা হয়নি।এই মেয়েটা নির্ঘাত তার হার্ট এ্যাটাক করানোর ফন্দি এটেছে।নাহিদ আনমনেই বুকের বা পাশে হাত বুলালো।হৃদাপন্দন অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে চলছে।

আরজু এতক্ষণ অনেক কিছু প্ল্যান করলেও এখন তার ভীষণ লজ্জা লাগছে।নিজেবে চূড়ান্ত বেহায়া মনে হচ্ছে।নাহিদের সেই অস্বাভাবিক দৃষ্টি আরজুর বকের ধুক পুক বাড়িয়ে দিলো কয়েক গুন।এই মানুষটার এমন দৃষ্টির সম্মুখীন আগে হয়নি আরজু।

নাহিদ হিতাহিত জ্ঞান শুন্য হয়ে এগিয়ে গেলো আরজুর দিকে।আরজু মাথা নিচু করে আছে।নাহিদ আরজুর কাছাকাছি চলে আসলো।এতটা কাছাকাছি যে আরজুর দম বন্ধ হবার জোগাড়।এতক্ষনের দুঃসাহস মুহূর্তেই ফুস হয়ে গেলো।আরজু খেয়াল করলো তার পা কাপছে।না আসলে তার পুরো শরীর কাপছে।নাহিদ আরজুর কপোলে তার শক্ত রুক্ষ হাত দিয়ে আজলে ধরে বললো

-” আমি এই মুহূর্তে হার্ট এ্যাটাক করে মরে গেলে তুমি দায়ী থাকবে।”

আরজু লাজুক হাসলো।নাহিদ সেই লাজুক হাসিতে ঘোরের মাঝে হারিয়ে গেলো।আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ল।আরজুর কম্পনরত অধরে দৃষ্টি পড়তেই দিকবেদিক ভুলে গেলো সে।আরজুর উন্মুক্ত উদরে হাত গলিয়ে দিলো।আরজু শিউরে উঠলো।আরজুকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো সে।নিমিষেই কোমল অধরে নিজের অধর মিশিয়ে নিলো নাহিদ।আবেশে আরজু চোখ বুজে ফেললো।অনুভূতির তন্তব চলছে দুটি মানব হৃদয়ের। কতো সময় কাটলো কেউ ঠাহর করতে পারলো না।

একসময় আরজু নাহিদের বুকে দুহাতে ধাক্কা দিলো।কিন্তু নাহিদকে এক বিন্দু সরাতে পারলো না।আরজুর মনে হচ্ছে নিঃশ্বাসের অভাবে আজ সে মারা যাবে।আরজু নিজের ধারালো নখ দিয়ে নাহিদের গলায় আঁচড় কেটে দিলো।এতে কিছুটা কাজ হলো।ধীরে ধীরে নাহিদের হাত আলগা হয়ে আসলো।

আরজু জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলো।নাহিদ তখনও নেশায় ডুবে আছে।আরজুর নেশায়।জোরে নিঃশ্বাস নেওয়ার ফলে আরজুর বখোস্থল উঠানামা করছে।সেই দৃশ্য নাহিদের মস্তিষ্ককে নিউরনকে বিচলিত করে তুলছে।আরজু আড়চোখে নাহিদের দিকে তাকালো।নাহিদের প্রগাঢ় দৃষ্টি আরজুর অন্তর কাপিয়ে দিলো। এ কোন নেতা সাহেবকে দেখছে।উন্মাদ প্রেমিকের ন্যায় নাহিদের অস্থিরতা দেখে আরজু ঝাঁপিয়ে পড়লো নাহিদের বুকে।নাহিদ তাল সামলাতে না পেরে আরজুকে নিয়ে বিছানায় পড়ে গেলো।নাহিদ মৃদু হেসে পরম আবেশে আরজুকে দু হাতে ঝাপটে ধরলো।আরজু নাহিদের বুকের খোলা বোতামের ফাঁকে মুখ গুঁজে অনবরত চুমুর বর্ষণ ঘটালো।আরজু যেনো আজ উন্মাদ।নেতা সাহেবের প্রেমে উন্মাদ।অদ্ভুদ মাদকতায় ঘিরে রইলো ঘর জুড়ে।নাহিদ আজুকে ঘুরিয়ে নীচে ফেলে নিজে উপুড় হয়ে রইলো।দুজনের নিঃশ্বাসের গতি তীব্র আকার ধারণ করেছে।নাহিদ আরজুর এলো মেলো চুল মুখ থেকে সরিয়ে নিলো।আরজু চোখ বুজে নিজের ভালোবাসার মানুষটির প্রতিটি স্পর্শ উপভোগ করছে।উত্তেজনায় উন্মাদ নাহিদ কাপা হাতে আরজুর শাড়ির আঁচল সরিয়ে ফেললো।আরজুর নিঃশ্বাসের গতি তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছে।বক্ষস্থলের উত্তাল ঢেউ নাহিদের পুরুষ চিত্তকে তৃষ্ণার্ত করে তুললো।নাহিদ আরজুর বক্ষস্থলে মুখ ডুবিয়ে দিল।তীব্র উত্তেজনায় আরজু থর থর করে কাঁপছে।নিচের ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলাতে চাইলো মেয়েটা।কিন্তু তার ভেতরে যে অনুভূতির ঝড় বইছে তা থামবার নয়। নতুন অনুভূতির সাথে পরিচিত হচ্ছে সে।

ঠিক এমন তীব্র উত্তেজনার মাঝেই হঠাৎ নাহিদ অনুভূতির জোয়ারে ভাটা ফেলে আরজুর উপর থেকে সরে গেলো।কি হলো কিছুই বুঝা গেলো না।কিন্তু নাহিদকে ভীষণ অস্থির দেখালো।সে অনবরত কপালের ঘাম মুছলো।হাত অসম্ভব কাপছে তার।আরজু পিট পিট চোখে নাহিদের দিকে তাকালো।আরজুকে উত্তেজনার চরম শিখরে পৌঁছে এমন করে ধপ করে ফেলে দেওয়ার মানে বুঝতে পারলো না।নাহিদ এক হাতে মাথার চুল গুলো এলোমেলো করতে লাগলো।তারপর একপ্রকার দৌড়ে সেই রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো।

আরজু হতবম্ব হয়ে পড়ে রইলো।নেতা সাহেব কেনো এমনটা করলেন কিছুই ঠাহর করতে পারলো না আরজু।সে কি কোনো ভুল করেছে? নেতা সাহেব কি তবে এই সম্পর্কে মনের বিরুদ্ধে বাঁধা পড়ে আছে?তিনি কি এই সম্পর্কের পরিণতি চায়না?তানাহলে নেতা সাহেব তাকে এই ভাবে অগ্রাহ্য কেনো করলো?তীব্র অপমানে আরজু বালিশে মুখ গুজে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।চরম বেহায়া হয়ে সে নিজের স্বামীর কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছিলো।কিন্তু বিনিময়ে এই অগ্রাহ্য আরজু কিছুতেই মানতে পারলো না।কেনো নেতা সাহেব তাকে দূরে ঠেলে দিলো? কেনো?তার ভালোবাসার এমন অপমান কেনো করলো মানুষটা?তার এই সৌন্দর্যের কি মূল্য যদি স্বামীকেই বাঁধতে না পারে?