মিষ্টি রোদের হাতছানি পর্ব-৬০+৬১

0
1113

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_60

নিস্তব্দ রাতে সারা আকাশ জুড়ে রয়েছে তারার মেলা। মিটি মিটি জ্বলছে হাজারো নক্ষত্র।বাতাসে রয়েছে মিষ্টি সুভাস।জারা জোড়ে নিঃশ্বাস নিয়ে সেই সুভাস অনুভব করলো।আজকের দিনটা তার অদ্ভুদ কেটেছে।ভীষণ অদ্ভুদ।সারা দিন বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে বিকেলে বাসায় ফিরে আসার সময় তার গাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল জাহিদ।জারা খানিকটা অবাক হলো।আজ সারাদিন এই বান্ধার কোনো খবর ছিলো না।কিন্তু হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হয়ে হয়েছে?সেই অবাধ্য ছেলেটা বললো

-” আপনার কি একটু সময় হবে?”

যারা বিস্ময় নিয়ে বললো
-” কেনো?”

-” সব কিছুতে কেনো হয়না।আপনি কি আপনার জীবনের মূল্যবান একটু সময় আমাকে দিতে পারবেন?”

জাহিদের নিরলস বাক্যে কি ছিল জারার জানা নেই।জাহিদকে ভীষণ সিরিয়াস মনে হলো।সে বেরিয়ে আসলো গাড়ি থেকে।জাহিদ মুচকি হেসে বললো

-” বাইকে উঠুন।”

জারা নিজেও জানেনা কেনো সে ছেলেটাকে মানা করতে পারলো না।জাহিদের বাইকে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে বসলো।জাহিদ মুচকি হেসে বাইকে নিয়ে এগিয়ে গেলো।কি আশ্চর্য বিষয়, একটা ছেলের কথায় সে এই ভাবে চলে আসলো।মানা কেনো করতে পাড়লো না?

ভাবনার মাঝেই বাইক থামলো একটা অট্টালিকার সামনে।জারা বুজলো এটা একটা রেস্টুরেন্ট।জাহিদ তাকে নিয়ে পৌঁছালো রুফটপে।কিন্তু রূফটপে পৌঁছে জারা অবাক হলো।সারা ফ্লোর খুব সুন্দর ভাবে সাজানো।তবে অবাক করা বিষয় হলো পুরো ফ্লোর খালি।জারা আড়চোখে জাহিদের দিকে তাকালো।সাদা পাঞ্জাবিতে ছেলেটাকে মারাত্মক লাগছে।কোথাও যেনো নাহিদ ভাইয়ার ছাপ পাওয়া যায়।কিন্তু ব্যাক্তিত্বের বিস্তর ফারাক।

জাহিদ জারাকে একটা টেবিলে বসার আহ্বান জানালো।জারা বুঝতে পারছে এই ছেলেটা সব আগেই প্ল্যান করে রেখেছে।কিন্তু জারা আজ আসবে এটা নিশ্চিত ছিলো কি করে?জারা চেয়ারে বসলো।জারার অবচেতন মন কিছু একটা আন্দাজ করতে পারছে।জারা সামনে তাকিয়ে দেখলো জাহিদের সারা মুখে মুগ্ধতা ছড়িয়ে আছে।এমন করে কেনো তাকায় ছেলেটা।একদম বুকে যেয়ে ধাক্কা লাগে।
কেনো যেনো সামনের নারীটির প্রতি জাহিদ তীব্র আকর্ষণ বোধ করে।এই বাসন্তী শাড়িতে কি মারাত্বক লাগছে এই মেয়েটা কি জানে? এই রমণী যে জাহিদের সুখ,শান্তি কেরে নিয়েছে।কিন্তু এই মেয়ে বুজলে তো?রাগ যেনো নাকের ডগায় ঘুরে।কিছুক্ষণ নিরবতা পর জারা বললো

-“কিছু বলবে?”

জাহিদ মনে মনে সাহস সঞ্চয় করে মুচকি হেসে বললো
-“অনেক কিছুই তো বলতে চাই।”

-” হুম আমি শুনছি।”

জাহিদ কোনো ভনিতা না করে সোজা বললো
-” আমি আপনাকে ভালোবাসি।”

জারা জাহিদের কথায় চোখ কুচকে ফেললো।আর বললো
-” আর ইউ ম্যাড?মাথা ঠিক আছে তোমার?”

জাহিদ মৃদু হেসে বললো
-” না আমি একদম ঠিক নেই।একদম পাগল হয়ে যাচ্ছি।”

জারা রেগে বললো
-” ইউ নিড সাইক্রিয়েট্রিস।”

জাহিদ জারার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো
-” নো, আই নিড ইউ।”

জারা কঠিন স্বরে বললো
-” তোমার আমার বয়সের গ্যাপ জানো?আমার মিনিমাম তিন বছরের ছোট তুমি।নিতান্তই বাচ্চা একটা।”

জাহিদ টেবিলে রাখা জারার ফর্সা কোমল হাতে নিজের হাত ছুঁয়ে বললো

-” বয়স কোনো ম্যাটার করে না।ভালোবাসা এতো কিছু পরিমাপ করে হয় না।আর আমি বাচ্চা নাকি বড়ো সেটা নাহয় সময় আসলেই প্রমাণ দিবো।”

জারা নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো।ভীষণ অসস্তি হচ্ছে তার।এই ছেলেটাকে কি করে বুঝাবে সে।নিজের চাইতে ছোট একটা ছেলের সাথে সম্পর্ক ভীষণ বেমানান।তাছাড়া জারা আবেগ দিয়ে বিবেচনা করতে চায়না।জারা বিজ্ঞদের মতো করে বললো

-” মাত্র উনিশ বছর বয়স তোমার।এই বয়সটা আবেগের।এই বয়সটাই মারাত্মক ভুল করার।এই বয়সে সব কিছু সুন্দর মনে হয়।কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই আবেগ মুছে যাবে।এইযে তোমার মনে হচ্ছে আমাকে ভালোবাসো এটাও আবেগ।একটা সময় সব ভুলে যাবে।তখন এসব অতীত মনে করে হাসবে।”

জাহিদ আকুতি ভরা কণ্ঠে বললো
-” আপনি আমার আবেগ না।আপনি আমার অনুভূতি।যা আমি তীব্র ভাবে অনুভব করি।”

-” দেখো জাহিদ তুমি আবেগে ভাসছ।বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছো। এই বয়সে ভালোবাসা অনেকটা বন্যার জলের মতো। প্লাবনের তোড়ে সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। জল নেমে গেলেই একসা ধূসর কাদায় বসিয়ে রাখে।”

জারা থেমে আবার বললো
-“এই বয়সে তুমি ভুল করতে পারো কিন্তু আমি একজন ম্যাচিওর মেয়ে হয়ে এই ভুল করতে পারি না।আমি যথেষ্ঠ বাস্তবধর্মী।আমাকে আরজুর মতো ইমোশনাল ভাবলে ভুল করবে।তোমার ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা থেকে আমার বন্ধুবি যেই কঠিন সিদ্বান্ত নিয়েছে সেটা আমি পারবো না।”

জাহিদ ছল ছল চোখে তাকিয়ে রইলো।বুকের ভেতর তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করতে লাগলো।এই মেয়েটাকে না পেলে তার জীবনটাই যে বৃথা হয়ে যাবে।জাহিদ কাপা কাপা স্বরে বললো

-” আমার ভালোবাসাকে আবেগ ভেবে তুচ্ছ করছেন আপনি।আমার ভালোবাসা আজ যেমন আছে,সামনের সময়ে ঠিক তেমনি থাকবে।একটা বার সুযোগ দিয়ে দেখুন।”

জারা নিজেও ভীষণ অস্থির অনুভব করছে।সব সময় দুষ্টুমিতে মেতে উঠা ছেলেটা আজ কেমন সিরিয়াস হয়ে আছে।তার সামনে ভেজা চোখে তাকিয়ে আছে।জারা অনুভব করলো এই ছেলেটার মলিন মুখটা সে সহ্য করতে পারছে না।কিন্তু এই সম্পর্কের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। সময়ের সাথে সাথে যদি এই ছেলেটা বদলে যায়।তখন কি হবে? জারা আশেপাশে দৃষ্টি মেলালো।নিজেকে সামলে কঠিন স্বরে বললো

-” তুমি উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে।জীবনে যা চেয়েছ তা মুহূর্তেই পেয়েছ।আর এবার তুমি আমার প্রতি আকর্ষণ বোধ করছ।আমাকে পাওয়ার জেদ চেপেছে তোমার মাঝে।আমার না তুমি মেনে নিতে পারছ না।”

জাহিদের গাল বেয়ে এক বিন্দু অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।এই মেয়েটা তার ভালোবাসাকে জেদ বলছে?তার হৃদয়ের নিংড়ানো ভালবাসা কি একটুও চোখে পড়ছে না?জাহিদ নিজের অশ্রু মুছে বললো

-” আমার ভালোবাসা প্রমাণ করতে কি করা লাগবে বলুন।সব পরীক্ষা দিতে আমি প্রাস্তুত।তবুও আমার ভালোবাসাকে অপমান করবেন না।শুধু একটা সুযোগ চাইছি জারা।”

জারা কি করবে? নিজেকে ভীষণ দুর্বল লাগছে।এই ছেলেটাকে এই ভাবে বললে সে কিছুতেই মানবে না।ভীষণ জেদি জাহিদ।মেয়রের ভাই বলে কথা।জারা নিজেও জাহিদের অনুভূতি নিয়ে দ্বিধায় পড়ে আছে।জারা নিজে জাহিদকে অপছন্দ করে তেমন না।বরং আশ্চর্য বিষয় হলো এতো ডিস্টার্ব করার পরও এই ছেলেটাকে সে কখনো ঘৃনা করতে পারেনি।অদ্ভুত টান অনুভব করেছে।জারা কয়েক মুহুর্ত সময় নিয়ে বললো

-“তিন বছর পর তোমার বিবিএ কমপ্লিট হবে।ততদিন অব্দি আমার সাথে কোনো যোগাযোগ করবে না তুমি।একই ভার্সিটিতে যেহেতু পড়ছি তাই মুখুমুখি হওয়াটা স্বাভাবিক।এই তিন বছর আমরা একদম অচেনা দের মত থাকবো।আমাকে রাস্তা ঘাটে ডিস্টার্ব করা যাবে না।দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।যদি তিন বছর পরও তোমার মধ্যে এই আবেগ বেচেঁ থাকে,আমাকে ঠিক এইভাবেই ফিল করো তখন আর তোমাকে ফিরিয়ে দিবো না।রাজি?”

জাহিদ মলিন দৃষ্টিতে জারার দিকে তাকিয়ে রইল।যেই মেয়েটাকে এক দিন না দেখলে,ডিস্টার্ব না করলে তার দিনটাই বৃথা যায়, তার কাছথেকে তিন বছর কি করে দূরে থাকবে?বেশ কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে তাকে।জাহিদ চেয়ার ছেড়ে জারার পায়ের কাছে হাঁটু ভেঙে বসে পড়লো।জারার হাত দুটি ধরে বললো

-” আজ থেকে তিন বছর পর আমার বউ হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকুন জারা।আপনার এই পরীক্ষায় আমি উত্তীর্ণ হবোই।”

বলেই জারার হাতের উল্টো পিঠে চুমু খেল।জারার সারা শরীরে কম্পন সৃষ্টি হলো।কি কনফিডেন্সের সাথে বলছে ছেলেটা।আদো এটা সম্ভব।তিন বছরে এই আবেগ কি আসলেই ফিকে হবে না? না এটা অসম্ভব।কয়দিন পরই সব ভুলে যাবে।তখন এই ভালোবাসার ভূত মাথা থেকে নেমে যাবে।

রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে জারা এইসবই ভাবতে লাগলো।ছেলেটা এমন অদ্ভুত কেনো?দুই ভাই একদম বিপরীত মুখী।একজন রূপের রানী পেয়েও ফিরে তাকাচ্ছে না,অন্যজন সিনিওর কাউকে এক্ষনি বিয়ের স্বপ্ন দেখছে।আচ্ছা জারা কি ঠিক করছে?ছেলেটাকে এমন একটা শর্ত দেওয়া আদো ঠিক হয়েছে? যদি জাহিদ তিন বছর পর এমন আকুতি নিয়ে তার সামনে দাড়ায় তবে সে কি করবে? ফিরিয়ে দিবে,নাকি….??
না জারা আর ভাবতে পারছে না।
________________

চাঁদনী এই রাতে দুর আকাশে কালো মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। এমন স্নিগ্ধ সময়ে ছাদে দাঁড়িয়ে একের পর এক সিগারেট টানছে নাহিদ।জ্বলন্ত সিগারেট অগ্নিশিখা যেনো তার হৃদয়কেও জ্বালিয়ে দিচ্ছে।বুকের ভেতরে চলছে তীব্র ঝড়।নিজেকে কেমন এলোমেলো লাগছে।মনের মাঝে কতটা দ্বিধা দ্বন্দ চললে একজন পুরুষ সেই উন্মাদনার মুহূর্তে নিজের প্রিয়সী কে অবজ্ঞা করে চলে আসতে পারে?নিজেকে কিছুতেই মাফ করতে পারছে না নাহিদ।না পূর্বের অন্যায়ের জন্য আর না আজকের পরিস্থিতির জন্য।তার জীবনটা এমন কেনো হলো?নিজের প্রিয়তমাকে কাছে পেয়েও কেনো নির্দ্বিধায় স্পর্শ করতে পারছে না?কেনো পারছেনা প্রিয়তমকে নিয়ে স্বর্গীয় সুখে ভাসতে?অপরাধবোধ তার ভেতরটাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।ভাগ্য কি আদো তাকে সহায় করেছে নাকি আত্মগ্লানির পাল্লা ভারী করছে?কিছুই বুঝতে পারছে না সে।যাকে কাছে পাওয়ার লোভে অন্য কোনো মেয়ের দিকে সেভাবে তাকানোই হয়নি আজ তাকে সে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। এর চাইতে যন্ত্রণার আর কি হতে পারে?
তীব্র যন্ত্রণায় নাহিদ জোরে নিঃশ্বাস ছাড়তে লাগলো। দুচোখে জমা হলো নোনা জল।নাহিদ এক হতে নিজের চুল খামচে ধরলো।উফফ!! এমন যন্ত্রণা কেনো হচ্ছে?কি করবে সে? সব ভুলে কি আরজুকে আপন করে নিবে নাকি দূরে সরিয়ে দিবে?

নাহিদ হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে আসফি কে কল করলো। আসফি তখন নুসাইবার সাথে কথা বলছিলো।নাহিদের কল পেয়ে কল রিসিভ করে বললো

-” আরে ব্যাটা এই রাতে আমাকে কল করে ডিস্টার্ব করছিস কেনো? বউটার সাথে প্রেমালাপ করছিলাম সেটাও দিচ্ছিস না।”

নাহিদ শুকনো ঢোক গিললো।মুখ দিকে কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে পারছে না। শুধু জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো। আসফি নাহিদের নীরবতয় চিন্তিত হয়ে পড়লো।আর বললো

-” তুই ঠিক আছিস নাহিদ? কিছু হয়েছে?”

নাহিদ নিরবতা ভেঙে কাপা কাপা স্বরে বললো
-“আমি ঠিক নেই দোস্ত।একদম ঠিক নেই।”

আসফি চিন্তিত হয়ে বললো
-” আরজুর সাথে কিছু হয়েছে?”

-” আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে আসফি।আরজুকে পেয়েও আমি নিজের করে নিতে পারছি না।প্রতিনিয়ত মনে হয়ে ওকে আমি ঠকাচ্ছি।আরজুর ভালোবাসার আহ্বানে আমি সাড়া দিতে ভয় পাচ্ছি।ভীষণ ভয় পাচ্ছি।মেয়েটা ভীষণ কষ্ট পেয়েছে আসফি।”

আসফি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো
-” এসব তোর ভুল ধারণা।আরজুকে তুই মোটেও ঠকাচ্ছিস না।অতীত ভুলে এবার তোর সামনে আগাতে হবে নাহিদ।আর পিছু ফিরে দেখতে যাসনা।আরজু তোকে ভালোবাসে নাহিদ।এটা কত বড়ো মিরাকেল সেটা বুঝতে পারছিস? যেই মেয়েকে পাওয়ার তীব্র বাসনা তুই করেছিলি সেই মেয়ে নিজে তোর কাছে এক আকাশ ভালোবাসা নিয়ে ধরা দিয়েছে।সেটা এই ভাবে পায়ে ফেলে দিস না।সুন্দর সম্পর্কটাকে তিক্ততায় ভরিয়ে তুলিস না।”

নাহিদ পাঞ্জাবীর বুকের পাশের বোতাম খুলে নিলো।ভীষণ হাসফাস লাগছে।নাহিদ আকাশের মেঘের দিকে তাকিয়ে আবার বললো

-” আমি ভীষণ দ্বিধা দ্বন্দ্বে আটকে আছি রে।ওকে স্পর্শ করতেও ভীষণ ভয় হয়।আমার এই নোংরা স্পর্শে যদি আরজুর পবিত্রতা নষ্ট হয়।আরজু যদি আমাকে ভুল বুঝে।যদি আমাকে ফেলে চলে যায়।আমি বাঁচতে পারবো না আসফি ওকে ছাড়া।এতো কাল ও দূরে ছিলো।ওকে পাওয়ার কোনো আশা আমার ছিলো না।কিন্তু আজ সে আমার এতো কাছে।এতো গভির ভাবে তাকে আমি উপলব্ধি করতে পারছি। এতো কাছে আসার পর কোনো দূরত্ব আমি মানতে পারবো না।কিছুতেই না।”

নাহিদ না চাইতেও চোখের পানি অঝোরে ঝড়ে যাচ্ছে।আসফি হতবাক হয়ে বললো

-“তুই কাদছিস! নিবরাস নাহিদের মতো কঠোর ব্যাক্তিত্বের মানুষটা আজ এক নারীর জন্য কাদছে। এর চাইতে বড়ো পাওয়ার আর কি হতে পারে আরজুর জন্য।আরজু আসলেই ভাগ্যবতী যে আমার বন্ধুর শুদ্ধ ভালোবাসা পেয়েছে।দেখ সব সময় পরিস্থিতি এক থাকে না।বর্তমান পরিস্থিতি তোর অনুকূলে।আরজুকে আপন করে নে নাহিদ।ভালোবাসা তোকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।সেটা ফিরিয়ে দেওয়া অন্যায় হবে। ভবিষ্যতের কথা ভেবে বর্তমান নষ্ট করার মানেই হয়না।আরজুকে নিজের প্রণয় জালে আটকে রাখ।নারী যদি বড্ডো কোমল।তাদের একটু ভালোবাসা দিলে একদম বুকের সাথে লেপ্টে থাকবে।আরজু ও কোমলমতি মেয়ে।দেখবি তোকে ছাড়া এক মুহুর্ত নিশ্বাস ও নিতে পারবে না।এটাই ভালোবাসার জাদু।”

নাহিদ বহু কষ্টে নিজেকে সংযত করলো।সময় কখনও ফিরে আসে না।আর না পূর্বের সময় ফিরিয়ে আনা সম্ভব।তবে কেনো সে তার বর্তমান নষ্ট করছে? আজ আরজু তার কাছে।চলার পথে কখন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় কে জানে?এই ছোট্ট জীবনে নিজের সুখের কথা ভাবলে কি সে বড়ো স্বার্থপর হয়ে যাবে? হোক স্বার্থপর।আজ সে চরম স্বার্থপর হবে।সব কিছুর উর্ধ্বে আজ শুধু মনের কথা শুনবে।আরজুকে আর নিজের কাছথেকে দূরে রাখবে না।একটু সুখ পাওয়ার অধিকার তারও আছে।আর নাহিদের একমাত্র সুখ আরজু।
_________________

আরজু বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে তখন থেকে ফুপাচ্ছে।রাগে,দুঃখে তার দুই চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।চোখের কাজল লেপ্টে গেছে।জীবনে প্রথম বার তার হৃদয় কারো জন্য তীব্র অনুভূতি অনুভব করেছে।মনের সকল দ্বিধা কাটিয়ে সেই মানুষটার কাছে ছুটে এসেছে।অথচ তাকে ফিরতে হলো অপমানিত হয়ে।তার প্রথম আবেগকে এই ভাবে তুচ্ছ করতে পারলো নেতা সাহেব।সে শাড়ি পড়লো,চোখে কাজল দিলো,ঠোঁটে লিপস্টিক লাগালো।নিজেকে সাধ্যমত সাজিয়ে হাজির হলো নেতা সাহেবের সামনে।লোকটা কি ভাবে পারলো তাকে উপেক্ষা করতে?আরজুর গাল ভিজে গেলো অশ্রুতে।এই মানুষটা তাকে মোটেও ভালোবাসতে পারেনি।নিতান্তই তার পাগলামিতে এই সম্পর্কে আটকে পড়েছে।আর আরজু সেটা ভালবাসা ভেবে বসে আছে?কতটা বোকা সে।আসলেই সে ইমোশনাল ফুল।বিবেক দিয়ে না আবেগ দিয়ে ভেবেছে সব।এই ঘর,এই সংসার,এই ঘরের মালিক কিছুই তার না।সবটাই তার ভ্রম।সেই মানুষটাই তো তাকে প্রত্যাখ্যান করলো।

আরজু উঠে দাড়ালো।যেখানে মানুষটাই তার না সেখানে তার এই সংসারে হস্তক্ষেপ মোটেও গ্রহণযোগ্য না।আরজু চোখ মুছে এলোমেলো ভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো।নিচে এসে সোজা সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসলো।দারোয়ান তাকে দেখে আটকাতে চাইলে আরজু কিছুই বললো না।সোজা বেরিয়ে আসলো।এলোমেলো পা ফেলে হেঁটে চললো রাতের আধারে।

কিছুক্ষণ পরই নাহিদ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলো রুমের দিকে।মেয়েটা নিশ্চই কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে।এই ভাবে বউকে কষ্ট দেওয়া ঠিক হয়নি।আরজুর ভালোবাসা উপেক্ষা করার সাহস তার নেই।এই মেয়েটাকে আকড়ে ধরে বাঁচতে চায় নাহিদ।

কিন্তু রুমে ঢুকে নাহিদ আরজুকে কোথাও খুঁজে পেলো না।নাহিদের বুক চিপ দিয়ে উঠলো।আরজু এই গভীর রাতে কোথায় যেতে পারে? নাহিদ সিড়ির কাছে আসতেই সদর দরজা খোলা দেখলো।মুহূর্তেই নাহিদের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল।আরজু কি সত্যি তাকে ফেলে চলে গেছে? নাহিদ যেনো আর কিছুই ভাবতে পারলো না।এক দৌড়ে বাইরে চলে আসলো।দারোয়ানের কাছ জানতে পারলো আরজু একটু আগেই বেরিয়ে পড়েছে।নাহিদ আর ভাবার সময় নিলো না।ছুটে গেলো রাস্তায়।কয়েক মিনিট দৌড়েই দেখলো তার বউ এলোমেলো ভাবে হাঁটছে।আরজুর শাড়ির আঁচলটা রাস্তার ধুলোয় গড়াচ্ছে।নাহিদ জোরে দম নিয়ে আরজুর দিকে ছুটে গেলো।আরজুর সামনে দাড়িয়ে খানিকটা হাপাতে লাগলো।খোলা চুলে মেয়েটার মুখ ঢেকে আছে।শরীর ঈষৎ কাপছে।চোখের জলে সাজের বেহাল দশা দেখে নাহিদের হৃদস্পন্দন থমকে গেলো।

হঠাৎ কেউ রাস্তা আটকে দাড়ানোর ফলে আরজু ভয় পেয়ে গেলো।চোখ তুলে নাহিদকে দেখে খানিকটা চমকে গেলো।নাহিদ আরজুর সামনে দাড়িয়ে হাপাতে হাপাতে বললো

-“নারী জাতির এক দোষ,কিছু হলেই বাসা থেকে বেরিয়ে পড়বে।এতো অভিমান রাখো কোথায়?”

নাহিদের কথায় আরজুর রাগ,অভিমান যেনো বহুগুণ বৃদ্ধি পেলো।তাকে কষ্ট দিয়ে ফাজলামো হচ্ছে?সে কিছু না বলে নাহিদকে এড়িয়ে চলে যেতে আগালো।কিন্তু পেছন থেকে নাহিদ তার হাত ধরে আটকালো।অশ্রুসিক্ত নয়নে আরজু নাহিদের দিকে ফিরলো।হাত ছাড়াতে চেষ্টা করতে করতে বললো

-” হাত ছাড়ুন।”

-” ছাড়বো না।”

আরজুর অভিমানেরা পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগলো।আরজু ক্ষিপ্ত হয়ে বললো

-” ছাড়ুন বলছি।কেনো আটকাচ্ছেন আমাকে? আমিতো আপনাকে এই সম্পর্কের বেড়া জাল থেকে মুক্তি দিচ্ছি।আমার জেদের কারণে এই সম্পর্কে আটকে আছেন।যেই সম্পর্কে ভালোবাসা নেই,সেই সম্পর্ক বয়ে বেড়ানোর কোনো মানেই হয়না।যেতে দিন আমাকে।”

নাহিদ আরজুকে এক টানে নিজের বুকে মিশিয়ে ফেললো।সযত্নে আগলে ধরলো নিজের সাথে।আরজুর চিবুকে হাত গলিয়ে ফিচেল সরে বললো

-” ভালোবাসা কি শুধু মুখে বলেই প্রকাশ করতে হয় আরজু?উপলব্ধি করা যায় না?”

আরজু হুহু করে কেঁদে উঠলো।নিজেকে নাহিদের কাছথেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো।আর বললো

-” আমি কিছু উপলব্ধি করতে চাইনা। কারো জীবনে অযাচিত হস্তক্ষেপ করতে চাইনা।ছাড়ুন আমাকে।”

নাহিদ আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বললো
-” বাসায় চলো আরজু।রাস্তায় সিনক্রিয়েট করছো কেনো?”

আরজু রেগে বললো
-” আমি রাস্তার মেয়ে তাই।একারণেই আমাকে ছুড়ে ফেলে চলে গিয়েছিলেন তাই না? এখন কেনো এসেছেন?এতিম বলে দয়া দেখাচ্ছেন?আমি কখনোই কারো দয়ায় বাঁচতে চায়না।ছাড়ুন বলছি।”

নাহিদের প্রচন্ড রাগ হলো।এসব কথার মানে কি?মেয়েটা কি বুঝেনা তার চোখের ভাষা।শান্ত নাহিদ হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে আরজুর চুল খামচে ধরে আরজুর ঠোঁট কামড়ে ধরলো।আকস্মিক হামলায় অবাক হলো আরজু।নেতা সাহেব এমন করবে ভাবতে পারেনি।আরজু তীব্র যন্ত্রণায় চোখ বুজে ফেললো।এমন সুখকর যন্ত্রণায় আরজুর দুচোখ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ল।

একটু পরেই আরজুর ঠোঁট ছেড়ে দিলো নাহিদ।গোলাপী আভার অধর ততক্ষনে টকটকে লাল হয়ে গেছে।

নাহিদ অপলক দেখলো তার মিষ্টি বউ এর অভিমান।কি মিষ্টি লাগছে লেপটানো কাজলে,লাল ঠোঁটে।নাহিদ বাঁকা হেসে বললো

-” এই আক্রমণের জন্য তুমি দায়ী।আমি কোনো সুপুরুষ নই আরজু।লাস্যময়ী রূপের নিজ রমণীকে দেখে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা নিশ্চই করবো না। আমার প্রণয় উত্তাপ তোমাকে জ্বালিয়ে ছারখার করে দিবে।তাই নিজেকে আমার কাছ থেকে বাঁচিয়ে রাখাই তোমার জন্য মঙ্গলজনক।কারণ আমি নাহিদ তোমার মাঝে মিশে গেলে তোমার ফিরে যাওয়ার পথ বন্ধ।তখন আমার সকল ভুল,অন্যায়কে মেনে নিতে হবে।কারণ এই নাহিদ নিজ অস্তিত্বে তোমাকে ধারণ করলে তোমার এই খারাপ মানুষটাকে নিয়েই বাঁচতে হবে।জীবনের কঠিন মুহূর্তেও এই হাত শক্ত করে ধরতে হবে। তোমার ভালোর জন্য নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলাম।কিন্তু তুমি আমাকে উন্মাদ করেছো।এখন তোমার যাওয়ার পথ বন্ধ।এই নাহিদকে উন্মাদ করে পালানো এতো সহজ না সুন্দরী।”

আরজু তখনও কাদঁছে।নাহিদের বুকে ব্যাথা শুরু হলো।এই সুন্দর মুখটায় কান্না একদম মানায় না।নাহিদ শান্ত হলো।আরজুর অশ্রু বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে মুছে দিলো।আর নরম সুরে বললো

-“এভাবে কাদেনা বউ। আই অ্যাম সরি।আমি ভীষণ সরি।তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি।সরি,সরি।”

আরজু নাহিদের মুখে বউ ডাক শুনে আর নাহিদের আদর পেয়ে আরো আহ্লাদী হয়ে উঠলো।নাহিদের বুকে ইচ্ছে মত কিল ঘুষি বসাতে লাগলো।মনের সব ক্ষোভ নাহিদের দিকে ঢেলে দিচ্ছে।কিন্তু এতেও তার মন ভরলো না।সে এগিয়ে এসে নাহিদের বুকের বা পাশে কামড়ে ধরলো।আর নাহিদ চোখ বুজে প্রিয়তমার দেওয়া যন্ত্রণা অনুভব করলো।আরজুর চুল খামচে ধরে বললো

-“ব্যাথা পাচ্ছি তো বউ।রক্ত চুষে খাবে নাকি?রিভেঞ্জ নিচ্ছো? কামড়ের বদলে কামড়।কিন্তু আমি তো দিলাম ঠোঁটে আর তুমি দিচ্ছ বুকে।”

আরজু নাহিদের বুক থেকে সরে আসলো।সেদিকে তাকিয়ে দেখলো নাহিদের ফর্সা বুকে তার দাতের ছাপ বসে গেছে।এক সাইড কেটে সেখান থেকে সামান্য রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে।আরজু জিব্বায় নোনতা স্বাদ পেয়ে হাতের উল্টো পিঠে ঠোঁট মুছলো।সেখানেও খানিকটা রক্ত লেগে গেছে।নাহিদ বুকে হাত ঘষে বললো

-” তোমার দাত ভীষণ ধারালো।এক বসায় আস্ত গরু চিবিয়ে খেতে পারবে।এক দাপুটে নেতাকে কামড়ে রক্তাক্ত করে দিলে?”

আরজু ক্ষিপ্ত চোখে নাহিদের দিকে তাকালো।এই লোক তাকে আবার অপমান করছে।পেয়েছে কি? আরজুর কি কোনো সেলফ রেসপেক্ট নেই? যতো ইগো এই লোক দেখাবে?আরজু রেগে আবার হাটা ধরলে নাহিদ এগিয়ে এসে আরজুকে কোলে তুলে নিলো।আর বললো

-” তুমি আবার নিজেকে হারিয়ে ফেলেছো বউ।তাই তোমার হাত না বরং তোমাকে তুলেই দুর্গম পথ পাড়ি দিবো।চলবে?”

আরজু এবার শব্দ করে কেঁদে উঠলো।আর নাহিদের পাঞ্জাবীর কলার খামচে ধরলো।ফলে আরজুর ধারালো লোক নাহিদের গলায় ধেবে যাচ্ছে।আরজু বললো
-” আপনি আমাকে ইচ্ছে করে কাদিয়েছন।আমাকে অপমান করেছেন।থাকবো না আমি আপনার সাথে।”

নাহিদ আরজুকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে হাঁটতে লাগলো আর বললো

-” বিয়ের দিন কি বলেছিলাম মনে আছে? আমার জীবনে এসেছো নিজ ইচ্ছায়,কিন্তু বের হবে আমার ইচ্ছায়।আর এমন ইচ্ছে আমার কোনোদিন হবে না।তাই তুমি বন্দী।আমার জগতে তুমি চিরদিনের জন্য বন্ধী।যেই বুকে বার বার আঘাত করে ক্ষত বিক্ষত করছো সেই বুকেই মুখ লুকাতে হবে চিরকাল।”

আরজু কিছুক্ষণ ছটফট করে থেমে গেলো।আরজু ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।নাহিদ আরজুকে কোলে করেই ঘরে প্রবেশ করলো।আরজুকে বিছানায় বসিয়ে দিলো।তীব্র অভিমানে আরজু মুখ ফিরিয়ে নিলো।নাহিদ আরজুর কোলে মাথা রেখে ফ্লোরে বসে পড়লো।এতে আরজু খানিকটা চমকালো।নাহিদ আরজুর কোমর ঝাপটে ধরে সেখানে মুখ গুঁজে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বললো

-” তোমাকে আমি অপমান করিনি আরজু।আর না তোমার ভালোবাসাকে।শুধু একটু ঘাবড়ে গেছিলাম।জীবনে কাঙ্ক্ষিত সব কিছু হুট করে পেয়ে গেলে মানুষ যেমন ঘাবড়ে যায়,ঠিক তেমন ঘাবড়ে গেছিলাম।অতীতের কিছু স্মৃতি আমাকে তারা করে বেড়ায় আরজু।তখন নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগে।তোমার কাছে আসলেই ভয় হয় যদি তোমাকে হারিয়ে ফেলি।আমার জীবন ততটা মসৃণ নয় আরজু।বিষাক্ত কিছু স্মৃতি আমার মন মস্তিষ্ককে কাবু করে রেখেছে।আমাকে কখনো একা করে ফেলে যেওনা আরজু।তুমি আমার কি সেটা বলে বুঝাতে পারবো না।”

আরজু বুজলো নাহিদের গলা কাপছে।আরজু নাহিদের চিবুকে হাত রেখে মুখ তুলে তাকালো।নাহিদের চোখ জোড়া লাল হয়ে আছে।মুখে ফুটে উঠেছে অসহায়ত্ব।আরজু অবাক হলো।সেই কঠিন,ধম্ভিক,গুরুগম্ভীর,সুদর্শন ব্যাক্তিটির চোখে মুখে কেমন অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে।আদো এটা সম্ভব?আরজুর কোমল হৃদয় ব্যাথিত হলো।এই পুরুষটিকে সে কখনোই দুর্বল হতে দেখেনি।আর আজ,,।সে নিজের অভিমান ভুলে নাহিদের কপালে অধর ছুয়ে দিলো।আবেশে নাহিদ চোখ বুজে নিলো।আরজু ভেজা গলায় বললো

-” আমি কোথাও যাচ্ছিনা নেতা সাহেব।এইতো আপনার পাশেই আছি।শেষ নিঃশ্বাস অব্দি থাকবো।”

নাহিদ মৃদু হেসে আরজুর হাতে চুমু খেলো।আরজুর দিকে ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বললো

-” তোমায় প্রথম দেখে আমার রবি ঠাকুরের একটা উক্তি বার বার মনে পড়েছিল আরজু।”

আরজু প্রস্নসুচক তাকিয়ে রইলো।নাহিদ হেসে বললো
-” প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।”

আরজু লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিলো। নেতা সাহেব আর কাব্যিক উক্তি, ভাব যায়?নাহিদ আবার আরজু আরো কাছাকাছি এসে বললো

-“রবি ঠাকুর আরো বলেছেন-পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দূরত্ব কোনটি জানো ? নাহ্ জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত , উত্তরটা সঠিক নয় । সবচেয়ে বড় দূরত্ব হলো যখন আমি তোমার সামনে থাকি , কিন্তু তুমি জানো না যে আমি তোমাকে কতটা ভালবাসি ।”

আরজু ছলছল চোখে নাহিদের দিকে তাকালো।এই কাংখিত শব্দটি নেতা সাহেবের মুখ থেকে শোনার জন্য আরজু মুখিয়ে ছিলো।আজ সেই কাঙ্খিত শব্দ শোনার ভাগ্য হলো তার।তার নেতা সাহেব তাকে ভালোবাসে। এর চাইতে মধুর বাক্য আর কি হতে পারে?আরজুর শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেলো।নাহিদ তাদের মাঝের দূরত্ব আরো কমিয়ে আনলো।দুজন দুজনের শাস প্রশ্বাস উপলব্ধি করতে পারছে।উষ্ণ নিশ্বাস দুজনের মাঝে তীব্র উন্মাদনার সৃষ্টি করছে।নাহিদ আর নিজেকে আটকে রাখতে চায়না।এই উন্মাদনায় ভাসাতে চায়।আরজু নামক অনুভূতি উপলব্ধি করতে চায়।নাহিদ ফিসফিস করে বলল

-” আই অ্যাম গেটিং অ্যাডিক্টেড আরজু।হেল্প মী গেট ব্যাক। আই অ্যাম গেটিং লস্ট।”

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#Part_61

সকালের মিষ্টি রোদে সতেজ হয়ে উঠেছে ধরণী।নিয়ম মাফিক সকল আঁধারকে ছাপিয়ে নতুন দিনের সূচনা ঘটেছে।সূর্যরশ্মির আগমনে বাগানে সতেজ ফুলের মেলা বসেছে।আরজু আশেপাশে চোখ বুলালো।বাগানে এসেই তার হৃদয় স্নিগ্ধতায় ভরে গেলো।প্রতিদিন ভোরে কেনো ঘুম থেকে উঠেনা সে?আজ সকালে উঠে বাগানে না আসলে এই ওপার সৌন্দর্য,সজীবতা মিস করতো।যদিও ফুলকে গাছেই বেশি মানায় তবুও আরজু একটা লাল টকটকে জবা ছিঁড়ে আধ ভেজা কেশে কানের পাশে গুজে দিলো।একটা লাল গোলাপ ছিঁড়ে তার সুভাস নিলো।আজ প্রকৃতি এতো মোহনীয় কেনো?নাকি রোজই এমন,কিন্তু তার চোখে পড়েনি।এই স্নিগ্ধতা কি পরিবেশে বিরাজ করছে নাকি তার মনে?

-“বাহ্!!। আজকের সকালটা আমার বাগানের সবচাইতে মোহনীয় পুষ্পের সুবাসে মৌ মৌ করছে। প্রতিদিন এই সাধারণ পুষ্পের সুভাস নিয়ে মন ভরাতে হতো।কিন্তু আজ এই বিশেষ পুষ্প সুভাস ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে।দারুন তো ব্যাপারটা। ”

বাক্যটি কর্ণগোচর হতেই আরজুর ঘাড়ে উত্তপ্ত নিঃশ্বাস আঁচড়ে পড়লো।আরজুর হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো বহুগুণ।বেসামাল আরজুর পিঠ যেয়ে ঠেকলো পেছনের ব্যাক্তিটির বুকে।নাহিদ আরজুর ভেজা চুলে মুখ ডুবিয়ে দিলো।আহা!!কি মিষ্টি সুভাস।নাহিদ আরজুর দিকে ঝুঁকে ফিচেল স্বরে বললো

-“আমার এই পুষ্পর কাছে তোমার হাতের এই লাল পুষ্প মূল্যহীন আরজু।আমার পুষ্প যে বড্ডো কোমল,স্পর্শকাতর।যাকে স্পর্শ করলেই কেমন বুকের কাছে নুয়ে পড়ে।আর তার ধারালো কাটা আমার বুকে বিধিয়ে তবেই খান্ত হয়।”

লাজুক আরজু পেছন ফিরে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না।এই অসভ্য ব্যাক্তিটি গতকাল থেকে লাগামহীন সব কথা বলে তাকে লজ্জায় ফেলছে।আরজু কেনো যে নির্লজ্জের মতো লোকটার কাছে ধরা দিয়েছে?সভ্য,শান্ত মানুষটির এই অসভ্য,অশান্ত রূপটি দেখে আরজু লতার মতন নুইয়ে পড়ছে।

আরজু শিউরে উঠলো নাহিদের অবাধ্য স্পর্শে।নাহিদ পেছন থেকে আকড়ে ধরেছে আরজুর উন্মুক্ত উদরে।আরজুর দেহের মৃদু কম্পন নাহিদও অনুভব করতে পারলো।স্নিগ্ধ সকালে প্রীয়সির উদরে জড়ানো ফিনফিনে অর্ধ ভেজা শাড়ি নাহিদের পুরুষ সত্তাকে বেসামাল করে তুলছে।নাহিদ বাঁকা হেসে বললো

-” আমার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছো? কোনো লাভ নেই।এই নাহিদের প্রণয় জালে বন্দি হয়ে গেছো বউ।তোমার আর মুক্তি নেই।”

আরজু বুজলো এই লোকটি তাকে অসস্তিতে ফেলতে চাইছে।নাহলে এমন শুরু করতো না।আরজু নাহিদের দিকে ফিরে কড়া চোখে তাকিয়ে বললো

-” দেশের নেতাই যদি এমন অসভ্য,নির্লজ্জ হয় তবে সাধারণ জনগণের কি হবে?দেশটা এবার রসাতলে গেলো।”

নাহিদ মৃদু হাসলো।আরজুর দিকে ঝুঁকে বললো
-” সামনে এমন মোহনীয় নারী উপস্থিত থাকলে যে কেউ নির্লজ্জ হবে।এই নেতার আর দোষ কই?”

লজ্জাবতী আরজু নাহিদের বুকে হালকা চাপড় মারলো।নাহিদ ডান ভ্রু উচু করে বললো

-” প্রথম দর্শন থেকেই এই বুকে আঘাত করে চলছো।এটা কি ঠিক?দিন শেষে এই বুকেই লুকাতে হবে।”

বলেই নাহিদ তার পরনের টিশার্ট খানিকটা নিচে নামিয়ে নিলো।আরজু সেদিকে এক নজর তাকিয়েই সাথে সাথে তার নখের দিকে চোখ বুলালো।পরক্ষনেই নিচের ঠোঁট কামড়ে অপরাধীর মতো নাহিদের দিকে তাকালো।তার তীক্ষ্ণ ধারালো নখ যে নেতা সাহেবকে ক্ষতবিক্ষত করে ছেড়েছে।নাহিদ আরজুর হাতের দিকে তাকিয়ে বললো

-“বাহ্!!! দারুন অস্ত্র তোমার। আমার প্রোটেকশনের জন্য আসিফকে রিভলবারের জায়গায় এমন ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করতে বলবো।এক আঘাতেই শত্রু পক্ষ কাত।”

আরজু কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো
-” আপনি চরম অসভ্য লোক।ইচ্ছে করে সকাল থেকে আমার পিছু লেগেছেন।তাই না?”

-” মোটেও না।বরং তুমি আমার সামনে সামনে চলছো।আমি পিছু কোথায় লাগলাম?”

আরজু বিরক্ত হয়ে বাগান থেকে বেরিয়ে যেতে লাগলো।নাহিদ ট্রাউজারের দুই পকেটে হাত রেখে মৃদু হেসে বললো

-” এক কাপ কফি হবে ম্যাডাম?আপনার হাতের অমৃত কফি মুখে না উঠলে আমার দিন শুরু হয়না। খেয়ে আমাকে বের হতে হবে।”

আরজু পেছন ফিরে মুখ ভেঞ্চালো।অসহ্য লোক একটা।দূরে গেলেও আরজুকে জ্বালায় আর কাছে থাকলেও।
____________________

লামিয়ার কাল থেকে এইচ এস সি পরীক্ষা শুরু।পরীক্ষার প্রস্তুতি ভালো থাকলেও কেমন নার্ভাস লাগছে।লামিসা এসে লামিয়ার পাশে বসলো।একগ্লাস দুধ লামিয়ার সামনে রাখলো।লামিয়া তখন গাইড বইয়ে মুখ গুজে পড়ায় ব্যাস্ত। লামিসার দিকে তাকিয়ে বললো

-“সেই কখন গ্লাসে দুধ দিয়ে এলাম।না খেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস কেনো?”

লামিসা মৃদু হেসে বললো
-” অর্ধেক খেয়েছি তো আপু।এই দেখো।আর পারছি না।তুমি খেয়ে নাও।”

লামিয়া শীতল দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকালো।ছোট্ট বোনটা বড়ো হয়ে যাচ্ছে।তার খেয়াল রাখা শিখে গেছে।বুকে প্রশান্তি বয়ে গেলো তার।বোনটা ছাড়া তার আপন বলতে তেমন কেউ নেই।আজ বাবার কথা ভীষণ মনে পড়ছে লামিয়ার।ছোটবেলায় স্কুলে পরীক্ষার সময় বাবা নিজে বসে তাকে পড়াতো।লামিয়া বরাবর ভীষণ ভালো স্টুডেন্ট ছিলো।ক্লাসে সব সময় ফাস্ট হতো।বাবা তার রেজাল্টের দিন ফেরার সময় তার পছন্দের নাড়ু নিয়ে ফিরতো। আজ বাবা নেই।তাই তার পছন্দ দেখার মানুষও নেই।কিন্তু আজকাল লামিসা তার খেয়াল রাখছে।হয়তো সময় সাথে সাথে বুঝতে পারছে তার বোনের যত্ন নেয়ার কেউ নেই।

হঠাৎ ডোরবেল বাজাতেই লামিসা লাফাতে লাফাতে দরজা খুলতে গেলো।কিন্তু অপর পাশে ফুয়াদকে দেখে অবাক হয়ে বললো

-“আপনি?”

ফুয়াদ মৃদু হেসে বললো
-” হে আমি। জ্বিনের বাদশা।”

লামিসা কপাল কুঁচকে বললো
-” আপনি জ্বিনের বাদশা হলে আমি পরীদের রাণী।”

ফুয়াদ হেসে বললো
-” সেটা তোমাকে দেখেই বুঝা যায় কিউটিপাই।”

লামিয়া এসে ফুয়াদকে দরজায় দেখে অবাক হয়ে বললো
-” আরে আপনি এখানে?”

-” পরীদের রানীকে দেখতে এলাম। পরীর খেয়াল রাখছ কিনা জানতে হবে না?তাই না কিউট পরী?”

বলেই ফুয়াদ ভ্রু নাচিয়ে লামিসার দিকে তাকালো।লামিসা হেসে ফেললো।এই ছেলেটাকে তার ভীষণ ভালো লাগে।
লামিয়ার টেবিলে এক ব্যাগ ভর্তি স্টেশনারি জিনিসপত্র রাখলো ফুয়াদ।মোটামুটি লামিয়ার পরীক্ষার জন্য যা যা প্রয়োজন সব।লামিয়া অবাক হয়ে বললো

-” এসব কেনো এনেছেন? কোনো প্রয়োজন ছিলো না।”

-” প্রয়োজন আছে।আর এসব আমাদের ছোট্ট পরীর খেয়াল রাখার জন্য সামান্য উপহার দিলাম।বুজলে?”

লামিসা হেসে আবার চকলেট মুখ ডুবালো।ফুয়াদ আসার পরই তার হাতে এত্তোগুলো চকলেট ধরিয়ে দিয়েছে।সেটাই খেতে বেস্ট সে।ফুয়াদ এবার বললো

-” পরীক্ষার প্রস্তুতি কেমন?”

-” জি ভালো।”

-” হুম গুড। কাল পরীক্ষার আগে আমি এসে তোমাকে হলে নিয়ে যাবো।”

লাসিয়া তাৎক্ষণিক ভাবে বললো
-” না না তার প্রয়োজন নেই।আমি চলে যেতে পারবো।”

ফুয়াদ চেয়ারে টান টান হয়ে বসে বললো
-” আরে মেয়ে অতো ভিড়ে সিট খুঁজে পাবে না।তখন পরীক্ষা ছেড়ে সিট খুঁজে বেড়াতে হবে।গার্জিয়ান থাকলে সুবিধা হয়।”

লামিয়া চমকে তাকালো।ফুয়াদের উদ্দেশে বললো
-” কিন্তু আমার তো কোনো গার্জিয়ান নেই।তাহলে?”

ফুয়াদ অনায়াসেই বলে উঠলো
-“কেনো আমি আছি না?”

ফুয়াদের কথায় লামিয়ার বুক ধক করে উঠলো।”আমি আছি না?” বাক্যটা ঠিক কতটা বিশ্বস্ততায় পরিপূর্ণ ছিলো বলে বুঝানো সম্ভব না।মুহূর্তেই লামিয়ার চোখ ভিজে উঠলো।সে কাপা স্বরে বললো

-” আমার জন্য এতো কেনো করছেন?”

ফুয়াদ মৃদু হেসে তার খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললো
-” আমার এক বন্ধু বলেছে,কোনো এক মায়ায় পড়ে আমার বাজে সভ্যাব বদলে যাচ্ছে।সেটা তুমি কিনা বুঝার চেষ্টা করছি।”

লামিয়া ফুয়াদের এই কঠিন উক্তির মানে বুজলো না।কিন্তু এটা বুজলো এই মানুষটার তার প্রতি মায়া কাজ করে।হয়তো সে অনাথ বলে।

পরদিন সত্যি সত্যি ফুয়াদ সকাল বেলায় চলে আসলো লামিয়ার বাড়িতে।লামিয়াকে কলেজে নামিয়ে সিট খুঁজে দিলো।লামিয়ার তখন নার্ভাসনেস এর কারনে হাত পা কাপছে।ফুয়াদ বেরিয়ে আসার আগে লামিয়ার মাথায় অতি স্নেহে হাত বুলিয়ে বললো

-” আমার দেখা সবচাইতে চমৎকার মেয়ে তুমি।এতো স্ট্রং পার্সোনালিটির মেয়ে আমি কোনোদিন দেখিনি।সব পরিস্থিতি কি সুন্দর করে সামলে নিতে জানো।সেই দুর্দান্ত মেয়েটি সামান্য পরীক্ষায় কেনো দুর্বল হয়ে পড়ছে?আমার বিশ্বাস তুমি চমৎকার পরীক্ষা দিবে। অল দ্যা বেস্ট।”

লামিয়া ভীষণ ভরসা পেলো।ফুয়াদের যাবার দিকে ভেজা চোখে দিকে তাকিয়ে রইলো।অনেকদিন পর তার জীবনে ভরসা যোগ্য কাউকে পেয়েছে।এই মানুষটা তার জীবনে আসার পর থেকেই লামিয়া ভীষণ প্রশান্তি অনুভব করে।মানুষটার দৃঢ় চাহনি তাকে আশ্বস্ত করে।
______________
নাহিদ নিস্তব্ধে চায়ের কাপটা টেবিলে রাখলো।সামনের বয়স্ক ব্যাক্তিটির দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো।ব্যাক্তিটি কালচে হওয়া দাতের হাসি বজায় রেখে নাহিদের দিকে তাকিয়ে চায়ে চুমুক দিচ্ছে।নাহিদকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন

-” বুজলে তোমার দাদার সাথে আমার বেশ ভালো সম্পর্ক ছিলো। স্যার আমাকে ভীষণ স্নেহ করতেন।তোমার ভীষণ প্রশংসা করতেন।”

নাহিদ নীরব হাসলো।অতি পান চিবানোর ফলে দাতের এই বাজে হাল।লোকটি কালচে দাতে ফিক করে হেসে আবার বললো

-” বুজলে নাহিদ আমার মেয়ে এবার লতে পড়াশোনা করছে।তোমার ভীষণ প্রশংসা করে।তুমি বলতে পাগল। স্যাররে সাথে একবার ওর দেখা হয়েছিল।মেয়েটাকে অনেক পছন্দ করেছিলেন।তোমার সাথে দেখাও করাতে চেয়েছিলেন।”

নাহিদ বাঁকা হাসলো।লোকটির নাম শরিফুল হক।তাদের পার্টির একজন ক্ষমতাধর নেতা।বেশ ধূর্ত লোক।নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছুই বুঝে না।তাদের পার্টির সবচাইতে করাপ্টেড লোকের লিস্ট করলে লোকটিকে অনায়াসে প্রথম স্থান দেওয়া যায়।যার ফলে লোকটির পার্টিতে রেপুটেশন অনেকটাই ডাউন হয়ে আছে।লোকটা অনেক দিন যাবত নাহিদকে ইনিয়ে বিনিয়ে তার রূপবতী ল স্টুডেন্ট মেয়েকে নাহিদের সাথে দেখা করাতে চাইছে।নাহিদ লোকটার উদ্দেশ্য বেশ ভালো করেই জানে।তাই মৃদু হেসে বললো

-“জি আপনার কথা দাদাজান আমাকে অনেক বার বলেছে।কি করে গদিতে টিকে থাকতে হয় আপনার চাইতে ভালো কে জানে বলুন?নাহলে এতো বার দুদককে চকমা দেওয়া সহজ বিষয় না।”

নাহিদের কথায় লোকটির প্রসারিত হাসি খানিকটা কমে আসলো।তীব্র অপমান গায়ে না মেখে মেকি হেসে বললেন

-” আরে পলিটিক্সে একটু চতুর না হলে হয়না।দেশের সেবা করবো আর বিনিময়ে নিজের পকেটে কিছু ঢুকবে না এটা তো হয়না।”

নাহিদের ইচ্ছে করলো লোকটির মুখে চায়ের কাপটি ছুড়ে মারতে।এদের মতো কিছু করাপ্টেড নেতাদের জন্য তাদের পার্টির বদনাম হয়।নাহিদ নিজেকে শান্ত করলো।পার্টির সিনিয়র একজন নেতা তাই নূন্যতম সম্মান দেখলো।নাহিদ মেকি হেসে বললো

-” আপনার মেয়ে একদম রাইট প্রফেশন ক্লিক করেছে।কারণ বলাতো যায়না খুব জলদি আপনার একজন ভালো লয়েরের প্রয়োজন পড়তে পারে।পরিবারের বিশ্বস্ত কেউ হলে বেশ ভালই হবে।”

লোকটি নাহিদের সকল খোচাকে অগ্রাহ্য করে বললো
-” আরে এসব কথা রাখ।আর কতো সিঙ্গেল থাকবে?তো বিয়ে শাদী কবে করবে?তোমার পেছনে তো মেয়েদের লাইন লেগে আছে।ইয়াং জেনারসেনে মধ্যে তোমার যা ক্রেজ।আমার মেয়েটাও তুমি বলতে পাগল।”

নাহিদ বাঁকা হাসলো।সে জানে এই লোকটার আসল উদ্দেশ্য।মূলত নাহিদ এবার এমপি পদে দারাবে।আর এতে নাহিদের পার্টির অন্য নেতাদের পরিপূর্ণ সমর্থন আছে।এই শরিফুল হক চাইছে নাহিদ এই এমপি পদে নমিনেশন না নিক।কারণ তিনি কয়ছর যাবত এই পদে আছেন।আর নাহিদ নির্বাচনে দাড়ালে তার আর এই পদে পুনরায় বসা হবেনা।তার দুর্নীতির অভিযোগে পার্টির সকলেই বিরক্ত।তাই তার জায়গায় নাহিদকে দার করাচ্ছে।যেটা এই ব্যাক্তিটির মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে।তাই কোনো ভাবে তার লয়ার মেয়েকে নাহিদের সাথে সেট করতে চাইছে।যদি গদি ছাড়া হয়ও তবে নাহিদকে হাত করা যাবে।নাহিদ পাঞ্জাবীর হাতা গুটাতে গুটাতে মৃদু হেসে বললো

-“আমাকে সিঙ্গেল কেনো মনে হলো আপনার?আমার মত হ্যান্ডসাম নেতার কি সিঙ্গেল থাকা মানায় বলুন?”

শরিফুল হক যেনো হতবম্ব হয়ে পড়লো।তার সাজানো সুন্দর পরিকল্পনায় যেনো কেউ এক বালতি জল ঢেলে দিল।তিনি বেশ অবাক হয়ে বললেন

-” মানে তোমার গার্লফ্রেন্ড আছে?”

নাহিদ নীরব হাসলো।বললো
-“আমার ব্যাক্তিগত জীবনে আমি কখনোই কারো হস্তক্ষেপ পছন্দ করিনা।আমার ব্যাক্তিগত জীবন নিয়ে মিডিয়াতে রসালো নিউজ হোক সেটাও চাইনা।আমার ঘরণীকে একান্ত আমার করে রাখতে চাই।আসলে সুন্দরী ঘরণী থাকলে যা হয় আরকি, পুরুষ মানুষ ইনসিকিউর হয়ে যায়?”

শরিফুল হক যেনো আকাশ থেকে পড়লেন।নাহিদ কি বিয়ে করে নিয়েছে?এটা কি করে সম্ভব?এমন কিছু হলে মিডিয়াতে বিষয়টা চলে যেতো।নাকি ভদ্রভাবে তার মেয়েকে রিজেক্ট করছে?অন্তত কথায় তো তেমনি মনে হচ্ছে।লোকটি যেনো এবার নিজের আসল রূপে ফিরে এলো।আঁটসাঁট হয়ে বসে নাহিদের দিকে সৃষ্টি ফেলে বললো

-” তোমার পরিবারকে আমি খুব ভালো করে চিনি।বিশেষ করে তোমার দাদাজানকে।বেশ সুপরিচিত এমপি ছিলেন।পলিটিক্সে তোমার ফিউচারও বেশ ভালো।মেয়র পদে বেশ ভালো করেছো তুমি।পার্টি বেশ খুশি তোমার উন্নতি দেখে।কিন্তু সত্যি বলতে মেয়র পদ আর এমপি পদে বিস্তর ফারাক।এতে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়।যা অল্প দিনে পাওয়া যায়না।তোমার বয়স অল্প।আরো অভিজ্ঞতার প্রয়োজন।”

নাহিদ শান্ত ভঙ্গিতে সবটা শুনছে।লোকটি নাহিদের শান্ত কিন্তু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এক নজর তাকিয়ে খানিকটা নড়ে চড়ে বসলেন।আর মেকি হেসে বললেন

-” আমি তোমার ভালো চাই।আমাদের পার্টির ভবিষ্যত তুমি। দেখো নাহিদ তুমি এবার নির্বাচনে এমপি পদ থেকে সরে দাঁড়াও।এবছর মেয়র পদে পুনরায় দাড়াও।পরবর্তী নির্বাচনে পরিপূর্ণ অভিজ্ঞ্যতা নিয়ে এমপি পদে দাড়াতে পারবে।আমি নিজে তোমাকে সাহায্য করবো।”

নাহিদ সবটাই শুনলো।ফিক করে হেসে বললো
-” আপনিও ভীষণ মজা করতে জানেন।পলিটিক্সে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে বছরের পর বছর প্রয়োজন হয় নাকি? এবার অন্তত একটা রেভ্যুলেশনের প্রয়োজন।আচ্ছা আপনার কি আমাকে এমপি পদে অযোগ্য মনে হচ্ছে?”

নাহিদের শান্ত দৃষ্টি লোকটির মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করলো।মৃদু হেসে বললো

-” আরে না।কি যে বলো?তোমার প্রশংসায় পার্টির সকলেই পঞ্চমুখ।তবে আমার মনে হয় তোমার বয়সের তুলনায় দায়িত্বের ভার বেশি হয়ে যাবে।আমি কি তোমার খারাপ চাইতে পারি?”

-” আমার যোগ্যতার প্রমাণ অতি শিঘ্রই দিবো।আপনাকে চিন্তা করতে হবে না।আপনি বরং নিজের গদি কি করে সামলাবেন সেটা ভাবুন।”

লোকটি এবার খানিকটা শক্ত কণ্ঠে বললেন
-” আমাকে কিন্তু তুমি আন্ডারএস্টিমেট করছ নাহিদ।ভুলে যেওনা এতো বছর আমি এই পদেই ছিলাম।সোজা আর বাঁকা দুই প্রক্রিয়াই আমার জানা আছে?তোমার ভালো চাই বলে সাবধান করতে আসলাম।কিন্তু তুমি নিজের জেদ ছাড়ছ না।”

নাহিদ বাঁকা হেসে বললো
-“আমাকে এতো কাচা খেলোয়াড় ভাববেন না শরিফুল সাহেব।আপনি যে কোনো রাস্তা এপ্লাই করতে পারেন।আপনার রাজ কীর্তি সবটাই আমার জানা।কোন কোন সিন্ডিকেটে আপনি জড়িত সবটাই আমার জানা আছে।নিতান্তই আপনার নামের সাথে পার্টির নাম জড়িত।নাহলে কবেই জেলার ঘানি টানতে হতো।আপনার রূপবতী লয়ার মেয়েও কিছু করতে পারত না।”

লোকটি বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো। আঙ্গুল তুলে বললো

-” তোমাকে আমি দেখে নিবো নাহিদ।আমাকে টপকে আমার গদিতে কি করে বসো সেটাই দেখছি।”

-” অবশ্যই দেখবেন।খুব জলদি দেখবেন।গদিতে অলস বসে বসে জং ধরিয়ে ফেলেছেন। এখন সেটা একটু ঝালাই করতে হবে।”

শরিফুল হক যতোটা খুশি মনে নাহিদের অফিসে ঢুকেছে ঠিক ততটাই ক্রোধ নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।