মিষ্টি রোদের হাতছানি পর্ব-৬২+৬৩

0
1184

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_62

গুধুলি বেলায় দুরু দুরু বুকে শুভর রুমে প্রবেশ করলো রিমি।মিনিট দশেক আগেই এসেছে সে।শুভর মা রিমিকে দেখে ভীষণ খুশি হলেন।হাত ধরে সোফায় বসিয়ে কুশলাদি বিনিময় করলেন।কথার এক পর্যায় ছেলের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আফসোস করলেন,চোখের জল বিসর্জন দিলেন।আর আরজুর উপর ক্ষোভ ঝাড়লেন।রিমি নীরবে সবটাই শুনেছে।শুভর মাকে আরজুর বিষয়ে কিছুই বলতে ইচ্ছে করলো না তার।কারণ তিনি একজন মা।নিজের সন্তানের কষ্ট কোনো মাই সহ্য করতে পারে না।সেক্ষেত্রে তিনিও ব্যতিক্রম না।রিমি শুভর কথা জিজ্ঞেস করলে বললেন শুভ ঘুমাচ্ছে।রিমি সেদিকেই এগিয়ে গেলো।

শুভর ঘরে আজ অব্দি যতবার সে এসেছে ততবার কেমন সুখ সুখ অনুভব হয়েছে।এই ঘর আর ঘরের মানুষটিকে নিয়ে হাজারো স্বপ্ন বুনেছে রিমি।রিমির অবুঝ মন কোনো না কোনো ভাবে আরজুর প্রতি কৃতজ্ঞ।কিন্তু রিমি নিজের ভালোবাসাকে শুভর উপর চাপিয়ে দিতে চায়না।শুভ আবার আগের মত স্বাভাবিক,প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠুক সেটাই চায়।
রিমির চোখ পড়লো বিছানায়।উপুড় হয়ে ঘুমোচ্ছে শুভ।রিমির বেহায়া চোখ আটকে গেলো শুভর উন্মুক্ত পিঠে।পিট পিট করে তাকালো সে।ভীষণ লোভ হচ্ছে এই শুভ্র পিঠে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরতে।রিমি মাথা ঝাকিয়ে নিজের নজর সরালো।আজকাল তার নজর ভীষণ বেহায়া হয়ে গেছে।আরজুর রোগে ধরলো নাকি?ঘামে চোখের চশমাটা কেমন ঘোলাটে হয়ে পড়েছে।রিমি সন্তর্পনে চোখের চশমা খুলে গলার স্কার্ফ দিয়ে পরিষ্কার করে নিলো।

দৃঢ় পায়ে এগিয়ে এসে শুভর পাশে দাড়িয়ে শুভকে ডাকলো।শুভর কোনো হেলদোল নেই।রিমির দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো ছোট্ট টেবিলের পাশে কাঠের একটা বস্কে,যেখানে অনেক গুলো সিগারেটের অবশিষ্ট অংশ পড়ে আছে।রিমি কপাল কুচকে সেদিকে কয়েক মুহূর্ত তাকালো।ভীষণ রাগ হচ্ছে তার।দাতে দাত চেপে টেবিলে থাকা এক গ্লাস পানি শুভর মুখে ছুড়ে মারলো।তাৎক্ষণিক শুভ দরফর করে উঠে বসে বলতে লাগলো

-” আরজু খুব খারাপ হবে বলে দিলাম।তোকে তো আজ..”

আর বলতে পারলো না।সামনে রিমিকে দেখে থেমে গেলো।মুখের পানি মুছে বিরক্তি নিয়ে বললো
-” পানি মারলি কেনো?”

রিমি বুকে সূক্ষ ব্যাথা শুরু হলো।আরজু শুভর জীবনে আজও ততটাই ঘিরে আছে যতোটা আগে ছিলো।শুভ সবার সামনে শুধুমাত্র স্বাভাবিক থাকার নাটক করছে।আসলে সে আরজুকে মন থেকেই চায়।রিমি অভিমানী সুরে বললো

-” বেশ করেছি।তোর জন্য ক্যাফে তে বসে অপেক্ষা করতে করতে আমি হয়রান।আর তুই নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিস?স্টুপিড একটা।”

শুভর মনে পড়লো আজ রিমির সাথে বসে কিছু ম্যাথ ডিসকাস করার কথা ছিল। কিন্তু সে সেই কথা ভুলে বসে আছে।এক হাতে নিজের চুল খামছে বললো

-” ওহ্ শিট!! ভুলে গেছিলাম।”

রিমি ভাবলো আজ আমার জায়গায় আরজু থাকলে তুই কখনোই ভুলে যেতি না।আরজুর মতো করে তোর হৃদয়ে হয়তো কখনোই আমি বিচরণ করতে পারবো না।রিমিকে মন খারাপ করতে দেখে শুভ বললো

-” একটু অপেক্ষা কর। জাস্ট ফ্রেস হয়ে আমার টেবিলেই বসে যাবো।ওকে?”

রিমি মাথা ঝাঁকালো।শুভ ফ্রেস হয়ে আসতেই তারা টেবিলে বসে পড়লো। শোভা আড়চোখে শুভর রুমে উকি দিয়ে দেখলো।রিমি শুভর মাথায় একটা চাপড় মেরে বলছে

-“গাধা এটা এই ভাবে না।দে দেখিয়ে দিচ্ছি।”

শুভ মাথা চুলকে সেই ম্যাথ বুঝার চেষ্টা করছে।শোভা মুচকি হাসলো।মনে মনে রিমির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো। শোভার মনে হচ্ছে তার ভাইকে যদি কেউ সামলাতে পারে তবে সেটা একমাত্র রিমি আপু।আরজু আপুকে হয়তো তার ভাই কোনোদিন ভুলতে পারবে না।কিন্তু রিমি আপু নিজের জন্য আলাদা একটা জায়গা করে নিতে পারবে।

_____________
একটা সেমিনার থেকে মাত্রই অফিসে ফিরলো নাহিদ।চেয়ারে হেলিয়ে দিলো ক্লান্ত দেহখানি।চোখ বুজে জোরে নিঃশ্বাস নিলো।ক্ষমতা বড়ো খারাপ জিনিস।এটা আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু কেরে নেয়।অদৃশ্য শত্রুর আগমন ঘটায়।এতদিন বিরোধী দলের লোক তার পেছনে পড়ে ছিলো,কিন্তু এখন নিজেদের পার্টির নেতারাই তার বিরোধীতা করছে।নবীনদের অগ্রগতি প্রবীণ নেতাদের মধ্যে ঈর্ষার সঞ্চার করেছে।নিজেদের অবস্থান নতুনদের দিতে তাদের বড্ডো জ্বলছে।অথচ এটাই প্রকৃতির নিয়ম।

হঠাৎ মোবাইলের রিং শুনে নাহিদ চোখ খুলে তাকালো।স্ক্রিনে নামটা দেখে নাহিদের চোয়াল শক্ত হয়ে আসলো।না চাইতেও ফোন রিসিভ করলো সে। অপর পাশ থেকে গম্ভীর স্বরে একজন বললো

-“বলতে হয়, কই মাছের প্রাণ তোর।এতো বড়ো অক্সিডেন্টের পরও দিব্যি সুস্থভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছি।গুড ফর ইউ।”

-” তোরা তো চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখিসনি।কিন্তু উপরওয়ালা সহায় থাকলে তোদের মত পুটি মাছের টোপে এই নাহিদের কিছুই হবে না।তবে তোদের কারণে জনসাধারণের সাপোর্ট আর সিম্পেথি দুটোই পাওয়া সহজ হয়ে গেলো।”

লোকটি ফিক করে হেসে উঠলো।আর বললো
-” তোর মনে হয় আমি অক্সিডেন্ট করিয়েছি?তোর জেনারেল চাচাও আমাকে হুমকি ধামকি দিলো।আরে আমি কি তোর কোনো ক্ষতি করতে পারি? আফটারোল আমরা বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলাম ইয়ার।”

নাহিদ দাতে দাত চেপে বললো
-” আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আফসোস এই একটাই।তোর মতো বাস্টা*র্ড কে নিজের জীবনে জড়িয়েছিলাম।যে পেছন থেকে বিশ্বাস ঘাতকতা করে।তুই কখনোই কারো বন্ধু হতে পারিস নি।”

-“বিশ্বাস?? হাসালি।তুই কি ভেবেছিস আমি সারা জীবন তোর আগে পিছে ঘুরে বেড়াবো?বিরোধী দলে আমি নিজের একটা শক্ত অবস্থান তৈরি করেছি।তোর সাথে থাকলে কখনোই সম্ভব ছিলো না।”

নাহিদ নিচের অধর কামড়ে বললো
-” তোর এই দ্বিমুখী রূপটাই তোকে সবার কাছ থেকে দুর করেছে।তোর জন্য আমার জীবনের যে ক্ষতি হয়েছে সেটা কখনোই পূরণ সম্ভব না।তোর মত মানুষকে পার্টি থেকে বের করে দেওয়াটা পার্টির জন্য বেশ ভালো সিদ্বান্ত ছিলো এটা।নাহলে তোর মতো বিশ্বাসঘাতক পার্টির নাম ডুবিয়ে রাখতো।তোর মত জানোয়ার কারো আপন হয়না।”

লোকটি বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে বললো
-” নিজেকে কি মনে করিস তুই?এবার তোর এমপি হওয়ার স্বপ্ন কখনোই পূরণ হবে না।লিয়াকত আলীর পাওয়ার সম্পর্কে তোর ধারনা নেই।তার পেছনে লাগাটা তোর ঠিক হয়নি।তার একাধিক ব্যাবসায়ে তুই নাক গলিয়েছিস।তার উপর তার বোনপো কে গুম করে রেখেছিস।সে এখন হিংস্র বাঘ হয়ে আছে।তোকে এতো সহজে ছাড়বে না।নিজের জীবন বাঁচাতে চাইলে এমপি পদ থেকে সরে দারা।”

নাহিদ বাঁকা হেসে বললো
-“এবার আসল কথায় এসেছিস।আমি এমপি পার্থী হওয়ায় তোর নেতার গদি সামলানো দায় হয়ে পড়েছে।বেচারা ভয় পেয়ে তার চেলাকে দিয়ে আমায় হুমকি দিচ্ছে।আমাদের পার্টির সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করে লিয়াকত আলীর চাটুকার হয়ে ঘুরছিস।লিয়াকত তোকে পালতু কুত্তা বানিয়ে রেখেছে।একদম তোর লেভেলে যেয়ে পৌঁছেছিস।অল দ্যা বেস্ট।”

ছেলেটি ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো।কিন্তু নিজেকে শান্ত করে মেকি হেসে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো

-” বেশি উড়ছিস নাহিদ।তোর পাখা কাটতে আমার এক মিনিটও লাগবে না।যাকে সবার কাছথেকে আড়াল করে রেখেছিস তাকে তোর জীবন থেকে ছুড়ে ফেলতে আমার এক মিনিটও লাগবে না।তুই কি ভেবেছিস আমি এতটাই বোকা? সবাইকে ধোঁকা দিতে পারলেও আমাকে পারবি না।তোর রগ রগ আমার চেনা আছে।তোর সবচাইতে দুর্বল জায়গাটা আমার বেশ ভালো করে জানা আছে নাহিদ।”

বলেই ছেলেটি কল কেটে দিলো।নাহিদ দাতে দাত চেপে চোখ বুজে রইলো।মুহূর্তেই রক্তিম চোখ জোড়া খুলে অস্থির হয়ে আসফিকে কল করলো।

আধা ঘন্টার মধ্যেই আসফি নাহিদের অফিসে হাজির হলো।শান্ত হয়ে বসে নাহিদকে পর্যবেক্ষণ করলো।নাহিদ বার বার পায়চারি করছে। আসফি চায়ে চুমুক দিয়ে বললো

-” এমন ঘুড়ির মতো ঘুড়ছিস কেনো? কি সমস্যা?এতো চিন্তিত কেনো তুই?”

নাহিদ ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো।এক হাতে সামনের চুলে হাত বুলিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো

-“আমার মনে হয় ও আরজু সম্পর্কে সবটা জেনে গেছে।”

আসফি কপাল কুঁচকে বললো
-” কে?”

প্রশ্ন করেই আসফি চোখ বড়ো করে অবাক হয়ে বললো
-” সিড?”

নাহিদ মলিন চোখে তাকালো। আসফি আবার বললো
-” বিষয়টা তো গোপন ছিলো।এটা ইম্পসিবল।”

নাহিদ দুহাতে মুখ ঘষে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।বললো
-“ঠিক জানিনা।তবে ও কিছু একটা ধরতে পেরেছে।আরজু সম্পর্কে ও খুব ভালো করেই জানে।আরজুকে নিয়ে আমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। সিড আরজুর যে কোনো ক্ষতি করতে পারে।আর সবচাইতে বড়ো বিষয় আরজুকে আমার বিরুদ্ধে ব্যাবহার করতে পারে।এতদিন আমি যেই ভয়ে আরজুর কাছ থেকে দূরে ছিলাম সেটাই হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।”

-” তুই চিন্তা করিস না।সাইফুল সবসময় আছে আরজুর সাথে।আরজুর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।আরজু অব্দি পৌঁছানোর সাহস পাবে না।”

-” জীবনে প্রথম আমরা মানুষ চিনতে ভুল করেছিলাম।ওর মতো রাস্কেলকে নিজের বন্ধু বানিয়েছিলাম।ওর কোনো বিশ্বাস নেই।ওর দ্বারা সব সম্ভব।”

-” এতে তো আমাদের দোষ নেই।ওর মতো নিমকহারামরা নিজেদের আসল রূপ লুকিয়ে রাখে।লোভ,হিংসা,অহংকার ওর মনুষ্যত্বকে নষ্ট করে দিয়েছে।তোর আর আরজুর মধ্যে দেয়াল সেই ক্রিয়েট করেছিলো।তবে ও আমাদের পাস্ট সম্পর্কে সবটাই জানে।আর সেটাকেই হাতিয়ার বানিয়ে বিরোধী দলে নিজের জায়গা বানিয়েছে।”

-” আমার ভয় ঠিক সেই জায়গায়।আমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ও জানে।”

নাহিদ কপাল চেপে ধরলো।ভীষণ মাথা ধরেছে। আসফি চা শেষ করে বললো

-” একটু রেস্ট নে নাহিদ।এতো স্ট্রেস নিসনা।তোর আর আরজুর ভালোবাসা ভীষণ মজবুত আর পবিত্র।এতো সহজে সেটা নষ্ট হবে না।আরজুকে একটু সময় দে।মেয়েটা তোর প্রতি আসক্ত।তুই একবিন্দু ভালোবাসা দিলে মেয়েটা তোকে এক সাগর ভালোবাসায় ডুবিয়ে রাখবে।”

নাহিদ অস্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো
-” আমার ভয়টা ঠিক কোথায় তুই ভালো করে জানিস।আরজু যতোটা কোমল,ঠিক ততটাই অভিমানী।ওর কঠিন অভিমান ভাঙ্গার সাহস আমার নেই।”

_______________
সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষে বেশ রাত করে বাসায় ফিরলো নাহিদ।শরীর আর মন বেশ ক্লান্ত।মাথা ব্যাথায় টনটন করছে।এলোমেলো ভাবে রুমে এসে দেখলো আরজু বিছানায় হেলান দিয়ে বসে বই পড়ছে।নাহিদকে দেখেই আরজু সোজা হয়ে বসে বললো

-” আপনি যদি রোজ রোজ এমন লেট করে বাসায় ফেরেন তবে খুব খারাপ হবে বলে দিলাম।”

নাহিদ জানে আরজু ভীষণ রেগে আছে।আজ সারাদিন বহুবার আরজু কল করেছে কিন্তু নাহিদ ব্যাস্ততার জন্য রিসিভ করেনি।নাহিদ হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে বললো

-” ইসস!! আজকের দিনটাই হুমকি ধামকি তে পাড় হচ্ছে। তা কি খারাপ হবে শুনি ম্যাডাম।”

আরজু উঠে দাড়ালো।অভিমানী মনের কাদতে ইচ্ছে করছে।এই মানুষটা বড্ডো খারাপ।আরজু একবার এই সুপুরুষের গলার আওয়াজ শুনতে কতবার কল করলো।কিন্তু এই পুরুষ একবারও রিসিভ করেননি।এতো কি ব্যাস্ততার তার?
নাহিদ পরনের ঘামার্ত পাঞ্জাবি নিয়েই আরজুর দিকে এগিয়ে আসলো।অভিমানী আরজুকে বিছানায় বসিয়ে কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।আরজুর কোমরে ঝাপটে ধরে উন্মুক্ত উদরে মুখ ডুবালো।কয়েকটা চুমুও খেলো।আরজু শিউরে উঠলো নাহিদের উষ্ণ ছোঁয়ায়।নাহিদ বললো

-“যন্ত্রণায় মাথা ফেটে যাচ্ছে। একটু চুলে হাত বুলিয়ে দাও।”

নাহিদের নিঃসংকোচ আবদারে আরজু থ হয়ে গেলো।পরক্ষণে নাহিদের ক্লান্ত মুখ দেখে ভীষণ মায়া হলো।নেতা হওয়া আসলেই সহজ বিষয় না।সারাদিন কত দৌড়ের উপর থাকতে হয়।ক্ষমতা বাড়ার সাথে সাথে দায়িত্ব বেড়ে যায় বহুগুণ।আরজু তার নরম,কোমল আঙ্গুল গুলো নাহিদের চুলে গলিয়ে দিলো।পরম আদরে চুলে হাত বুলাতে লাগলো।নাহিদ ফিসফিসিয়ে বললো

-” রোজ রোজ শাড়ি পরে আমাকে মেরে ফেলার প্ল্যান করেছো?আমাকে অনুভূতির জালে ফাঁসাতে গেলে নিজেই ফেঁসে যাবে।তখন হাজার মানাও এই নাহিদ শুনবে না।তোমাকে প্রণয় দহনে জ্বালিয়ে ছাড়বে।”

আরজু ঠোঁট কামড়ে লজ্জা ঢাকার চেষ্টা করলো।এই লোকটা তাকে লজ্জা দিতে এক বিন্দু ছার দেয়না।এই নাহিদ এক ভিন্ন কেউ।নাহিদের এই সত্তা আগে দেখেনি আরজু।
আরজু দেখলো কিছু সময়ের মধ্যেই নাহিদ ঘুমে তলিয়ে গেছে।নাহিদের ঘামে ভেজা ক্লান্ত দেহখানি আরজুর জন্য এক অনুভূতির ভান্ডার।ঘুমের মাঝে নাহিদের মুখখানা দেখে আরজুর বুকে দুরু দুরু শব্দ হতে লাগলো।আরজু নিচু হয়ে নাহিদের কপালে চুমু খেলো।এই মানুষটার সাথে চাইলেও অভিমান নিয়ে থাকা যায়না।মানুষটার চারপাশে যেনো মায়ার জাল বিছানো।যাতে আরজু বার বার আটকে যায়।

________________
নূরজাহান বেগম সামনের মায়াবতী মেয়েটির মুখটা গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।আকাশী রঙের জামদানি পরিহিত মেয়েটিকে তার কোনো হুর পরী মনে হচ্ছে।তিনি আরজুর সারা মুখে হাত বুলিয়ে সেই হতে চুমু খেলেন।আর বললেন

-” মাশাআল্লাহ।আমার নাহিদের পছন্দ আছে বলতে হবে।সেদিন হসপিটালে ভালো করে দেখতে পারিনি।আমার নাতবৌয়ের রূপের কাছে সবই মাটি।”

বলেই তিনি সামনের সোফায় বসা সানজিদার দিকে আড়চোখে তাকালেন।সানজিদা বিরক্ত হয়ে চোখ মুখ কুচকে ফেললো।

একটু আগেই নাহিদ আরজুকে নিয়ে নূর ম্যানশনে এসেছে।নূরজাহান বেগম স্পেশালি তাদের জন্য ডিনারের ব্যাবস্থা করেছেন।আরজু এখানে এসে খানিকটা গুটিয়ে গেছে।ভীষণ লজ্জা লাগছে।সবার উৎসুক দৃষ্টি আরজুকে আরো অসস্তিতে ফেলে দিচ্ছে।আরজু নূরজাহান বেগমকে আড়চোখে দেখলো।ভদ্র মহিলা এই বয়সেও যথেষ্ট লাবণ্যময়ী।তার মানে যুবতী বয়সে নিশ্চই আগুন ঝরা সুন্দরী ছিলেন। বেশ সুশীল,মার্জিত তার ব্যবহার।কথার মাঝেই ক্লাসি একটা ভাব ফুটে আসে। আরজু মুগ্ধ হলো।নুর জাহান বেগম একটা ডায়মন্ডের সেট বের করে বললেন

-” এটা নাহিদের দাদাজান আমাকে গিফট করেছিলেন।আমি সামলে রেখে দিয়েছি।ভেবেছি যোগ্য কাউকে এটা দিবো।কিন্তু এতদিন সেই যোগ্য কাউকে পায়নি।কিন্তু আজ পেয়ে গেছি।”

বলেই তিনি আরজুকে সেটা পরিয়ে দিলেন।সানজিদা মাহমুদ রাগে ফুঁসছেন।শাশুড়ির খোঁচা মূলক কথাগুলো তার রাগ বাড়িয়ে দিচ্ছে।

আরজু আড়চোখে সানজিদা মাহমুদকে দেখলো।বুঝতে পারলো এই মহিলাটি নাহিদের সৎ মা। যার সাথে নাহিদের খুব একটা ভালো সম্পর্ক নেই।আরজু আশেপাশে তাকিয়ে নাহিদকে খুঁজলো।লোকটি তাকে বসিয়ে রেখে কোথায় গেল?

বন্ধুদের আড্ডা ছেড়ে নীতি দ্রুত বাসায় ফিরেছে আজ।নাহিদ ভাই বিয়ে করেছে শুনে সে বেশ অবাক হয়েছিল।তাই নাহিদের বউ দেখার ইচ্ছা থাকলেও আগ্রহ জাগেনি।বাসায় এসেই সোফায় বসা মেয়েটির দিকে চোখ পড়তেই নীতি চমকে গেলো।বড়ো চাচীর কাছে শুনেছে নাহিদের বউ মিডেল ক্লাস ফ্যামিলির মেয়ে।সেটা শুনে নীতিও নাক ছিটকিয়েছে। নাহিদের টেস্ট এতো নিচে কি করে নেমেছে ভেবে পায়নি।কিন্তু সামনের মেয়েটিকে দেখে তার সকল চিন্তা ভাবনা উল্টে গেলো।অতি সুশ্রী,সুদর্শনা এক রমণী তার সামনে।আরজু চোখ তুলে নীতির দিকে তাকালো।মিষ্টি সুরে হেসে বললো

-” কেমন আছো নীতি?”

নীতি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।কি মিষ্টি কণ্ঠ!!! নীতির এই মুহূর্তে নিজের সৌন্দর্যকে ফিকে মনে হচ্ছে।তার নাহিদ ভাই এই মেয়েতে এমনি মজেনি।কেমন চোখ ঝলসে দেওয়ার মত রূপ এই মেয়ের।

জেরিন এতক্ষণ আরজুকে ফ্যামিলি অ্যালবামে সবার ছবি দেখাচ্ছিল।তাই নীতিকে দেখেই সে চিনে ফেললো।
জেরিন নীতিকে টেনে সোফায় বসিয়ে বললো

-” কি নীতি আপু দেখে তব্ধা খেয়ে গেলে? বলেছিলাম না আমার ভাবীকে দেখে চোখ ফেরাতে পারবে না।”

নীতি এই মুহূর্তে আরজুর প্রতি হিংসে হচ্ছে।এতদিন এই পরিবারের সকলে তার রূপের প্রশংসা করতো।তাকে নানা ভাবে পেম্পার করতো।কিন্তু আজ সবার মুখে এই মেয়েটির নাম।আরজু বুঝতে পাড়লো এই মেয়েটি তাকে খুব একটা সহজ ভাবে নিতে পারেনি।তাই আর কথা বাড়ালো না।
নাহিদ তার চাচার রুমে শান্ত হয়ে বসে আছে।নকীব মাহমুদ এই বাসায় খুব একটা থাকে না।তার পোষ্টিং চিটাগাং।তাই সেখানেই থাকতে হয়।নকীব মাহমুদ শান্ত সুরে বললেন

-“নাহিদ তোকে আরো সাবধানে চলতে হবে।বিরোধী দলের নেতারা তোর উপরে বেশ চড়াও হয়ে আছে।ওই বাস্টার সিড না থাকলে আমার এতো চিন্তা হতো না।ও আমাদের পরিবার সম্পর্কে সবটাই অবগত।”

নাহিদ চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো

-“আরজুকে আমার জীবনে জড়িয়ে কি ভুল করলাম?আমার অনিশ্চিত জীবনে ওকে জরানো একদম ঠিক হয়নি।”

নকীব মাহমুদ নাহিদের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন

-” নেতাদের কি ব্যাক্তিগত জীবন নেই?তাদের কি পরিবার থাকে না? শোন, জীবনে নিশ্চয়তা তো কারোরই নেই।তাই এসব ভুলভাল চিন্তা ভুলে যা।মেয়েটা ভারী মিষ্টি।অনেক ছোট বয়সে দেখেছিলাম।তোর চাচী আজ মেডিকেলে একটা OT তে ফেঁসে গেছে।ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই বাসায় পৌঁছে যাবে।সে তোর বউ দেখার জন্য উৎসুক হয়ে আছে।”

নাহিদ মুচকি হাসলো।কিন্তু মনকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না।

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_63

পড়ন্ত বিকেলে মেঘে ঢাকা আকাশ দেখতে দেখতে সাবা খানম সোফায় বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন।শান্ত দৃষ্টিতে সামনে তাকালেন।আরজু উচ্ছ্বাসিত হয়ে খালামণিকে নুর ম্যানশনের গল্প বলছে।কিন্তু সাবা খানম বিষণ্ণ মনে সেই গল্প শুনছেন।এই গল্পে তার একদম ইন্টারেস্ট নেই।জুবায়ের আহমেদ সাবা খানমকে চোখের ইশারায় শান্ত থাকতে বলছেন।মেয়েটার উৎফুল্লতায় কোনো বাধা দিতে চায়না তিনি।ওই পরিবারের কাউকেই সাবা পছন্দ করে না।কিন্তু আরজুর খুশির জন্য সবটাই মেনে নিতে হচ্ছে। এবার সাবা খানম গলা পরিষ্কার করে বললেন

-” ওই বাড়ির কেউ কি তোর সাথে কোনো খারাপ ব্যাবহার করেছে?”

আরজু খানিকটা থমকলো।মনে পড়লো সেদিনের কথা।
আরজু নুর ম্যানশনে নাহিদের ঘর ঘুরে ঘুরে দেখছে।এই ঘরেই তার নেতা সাহেব জীবনের দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন।এই ঘরের প্রতিটি কোনায় নেতা সাহেবের ছোটবেলার স্মৃতি জড়িয়ে আছে।এই ঘরেই হয়তো তার মায়ের কোলে শুয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছেন।আরজু ভাবছে এমন সুন্দর পরিবার থাকতে মানুষটি এমন একাকীত্বের জীবন কেনো বেছে নিলো?সব আছে তার।তবে কেনো এই দূরত্ব? আরজুর ভাবনার মাঝেই সানজিদা মাহমুদ ঘরে ঢুকলেন।আরজু চমকে তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো।এই মানুষটির সাথে তার আগে তেমন কোনো কথা হয়নি।সানজিদা বাঁকা হেসে বললেন

-” নুর ম্যানশন কেমন লাগছে তোমার?”

আরজু মিষ্টি হেসে বললো
-” ভীষণ ভালো আন্টি।”

সানজিদা বেগম হেঁয়ালি করে হেসে বললেন
-” হুম ভালো তো লাগবেই।এমন আভিজাত্য,বিলাসবহুল লাইফ নিশ্চই আগে দেখার সুযোগ হয়নি তোমার।তোমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারে তো এসব এফোর্ড করা অসম্ভব।তবে বলতে হয়, তোমার রূপ,লাবণ্য কেমন করে তোমার পুরো লাইফ সেট করে দিলো।নাহিদের মতো এমন কঠোর পার্সোনালিটির ছেলেও তোমার সৌন্দর্যে ফেঁসে গেছে।সৌন্দর্যের সাথে সাথে বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়েছো। আই এপ্রিশিয়েট ইউ।”

আরজুর মুখটা কেমন থমথমে হয়ে গেলো।তার জীবনে বাবা মা,কিংবা খালামণি, খালুজান তাকে উচ্চবিত্ত,মধ্যবিত্তের মধ্যে পার্থক্য তো কখনোই শেখায়নি!আরজু শিখেছে সবাই মানুষ।সবার নিজের জীবনকে উপভোগ করার অধিকার আছে।উচ্চশিক্ষিত পরিবারে স্বাধীনচেতা মনোভাবে বড়ো হয়েছে সে।সে স্বচ্ছল,স্বাচ্ছন্দে সবসময় লাইফ লিড করেছে।তার কোনো চাওয়া তো কখনোই অপূর্ণ ছিলো না।এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে কারো মনোভাব এমন হতে পারে আরজু জানতোই না।তার পৃথিবী অনেক ছোট।সেখানে পরিবার আর বন্ধুবান্ধব ছাড়া আর তেমন কেউ নেই।আর তারা কখনই তাকে মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য আলাদা ভাবে দেখেনি।

সানজিদা মাহমুদ আরজুর মলিন মুখশ্রী দেখে আবার বললেন

-“তোমার তো মা বাবা নেই তাইনা?হুমম!! প্যারেন্টস ছাড়া বড়ো হয়েছ তাই শাসন করার কেউ ছিলো না।নাহলে মাটিতে দাড়িয়ে চাঁদ ধরার সাহস পেতে না।তবে এটা সত্যি তোমার রূপ দেখে যে কোনো পুরুষই পিছলে পড়বে।যেমনটা নাহিদ পড়েছে।”

আরজুর দুচোখ ভরে ওঠলো।এতো কঠোর কথা আজ অব্দি কেউ তাকে বলেনি।আরজু বুঝতে পাড়ছে এই মহিলাটি তাকে পছন্দ করেনা।তাই বলে এমন বিচ্ছিরি ভাষা ব্যাবহার করবে?আজ নেতা সাহেবের এই মহিলাটিকে অপছন্দ করার কারণটাও স্পষ্ট।অথচ তার ছেলে মেয়ে দুটি মোটেও তার মতো না।আরজু কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিলো।আরজু কোনো নাইন্টিস এর নিরীহ বধূ না।সে বর্তমান যুগের শিক্ষিত,স্মার্ট মেয়ে।কি করে ইটের জবাব পাথর দিয়ে দিতে হয় ভালো করেই জানে।আরজু মুচকি হেসে বললো

-“আপনি বোধয় বাহ্যিক সৌন্দর্য আর আর্থিক অবস্থা দিয়ে মানুষকে বিবেচনা করেন। বাট সরি টু ছে, আপনি ভীষণ পুরনো চিন্তাধারায় বিচরণ করছেন।পোশাকের সাথে সাথে আপনার চিন্তা ধারাকেও আরেকটু ডেভলপ করা প্রয়োজন।আপনাকে আরেকটু স্মার্টলি ভাবতেও হবে।যুগের সাথে না চলতে পাড়লে ভীষণ পিছিয়ে পড়তে পারেন।আমার খালামণিকে দেখলে আপনি বিমোহিত হয়ে পড়বেন।বাহ্যিক সৌন্দর্যের সাথে সাথে কি করে ব্যাক্তিত্বের সৌন্দর্য বর্ধন করা যায় সেটা সে খুব ভালো করেই জানে।আমার খালামনির কাছ থেকে আপনার কাউন্সিলিং করা প্রয়োজন।কি করে ব্রড মাইন্ডের হওয়া যায়,কি করে নিজেকে স্মার্টলি প্রেজেন্ট করা যায়,সবটাই সে আপনাকে এক ঘণ্টায় শিখিয়ে দিবে।।টাকা দিয়ে দামী পোশাক কিনতে পারলেও সুশীল ব্যাক্তিত্ব আর আভিজাত্য অর্জন করা যায়না।আপনার মেন্টালিটি আমার কাছে কোনো যেনো অশিক্ষিত, অরুচিশীল পরিবারের মনে হচ্ছে? ইজ ইট ট্রু?”

আরজুর এহেন কথায় দরজার বাইরে দাড়ানো নাহিদ ফিক করে হেসে উঠলো।একদম!! এই বাঘিনীর প্রেমেই তো সে পড়েছিলো।এক আঙুলে কপাল চুলকে মিটি মিটি হেসে ভেতরে প্রবেশ করলো নাহিদ।

এমনি সানজিদা মাহমুদের মুখ তীব্র অপমানে রক্তিম আকার ধারণ করেছে,তার উপর নাহিদের গা জ্বালানো হাসি তাতে ঘি ঢেলে দিলো।আরজুকে সে শান্ত,নিরীহ টাইপ মেয়ে ভেবেছে।যাকে চাইলেই দমিয়ে রাখা যাবে।কিন্তু এই মেয়ে পুরো বারুদ।

নাহিদ হেলেদুলে এসে আরজুর পাশে দাড়িয়ে আরজুর কপালে চুমু খেয়ে বললো

-“ইউ আর আবসুলেটলি রাইট আরজু।তোমার উপস্থিত বুদ্ধি দেখে আমি মুগ্ধ।এই নাহলে আমার বউ?এই মহিলার ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে তুমি চুটকিতে ধরে ফেললে? আই অ্যাম প্রাউড ওফ ইউ।”

আরজু শান্ত দৃষ্টিতে নাহিদের দিকে তাকালো।নাহিদ সানজিদা মাহমুদের দিকে তাকিয়ে বললো

-” আজ কাল আমার পার্সোনাল ব্যাপারগুলা নিয়ে আপনি বেশি মাথা ঘামাচ্ছেন মিসেস মাহমুদ।এসব বন্ধ করুন।আর একটা কথা,রূপের জালে কি করে ফাঁসাতে হয় আপনার চাইতে বেশি ভালো কে জানে বলুন?আমার বউয়ের কাউকে রূপের জালে ফাঁসানোর প্রয়োজন পড়ে না।তার সরলতা,ব্যক্তিত্বই যথেষ্ট কাউকে মুগ্ধ করতে।আপনার মত মহিলা সেটা বুঝেনা।যার মন কুৎসিত তার বাহ্যিক সৌন্দর্য নর্দমায় ফুটে উঠা কচুরিপানার মতো।যা দুর থেকে দেখতে সুন্দর হলেও কারো হাতে শোভা পায়না।আমার বাবা কচুরিপানাকে পদ্ম ভেবে ভুল করলেও আমি এই ভুল মোটেও করিনি।আমি সদ্য ফোটা পবিত্র গোলাপটাকেই বেছে নিয়েছি।”

প্রচন্ড ক্রোধ নিয়ে সানজিদা মাহমুদ বেরিয়ে গেলেন নাহিদের রুম থেকে।নাহিদকে তার একদম সহ্য হয়না।প্রচন্ড বেয়াদব এই ছেলে।আর বিয়েও করেছে আরেক বেয়াদবকে।নাঈমকে বলেও কোনো কাজ হবেনা।সে তো ছেলের বিষয়ে কিছুই শুনতে নারাজ।নাহিদের মুখের উপর কিছু বলার সেই সাহসও তার নেই।তাইতো নাহিদের বউকে জব্ধ করতে চেয়েছিল।কিন্তু ওই মেয়ে বাঘা তেতুঁল।

________________

আরজু থমথমে মুখ করে বসে আছে।সানজিদা মাহমুদের প্রতিটা কথা তাকে ভীষণ পীড়া দিচ্ছে।জীবনকে সে কখনোই ওই ভাবে ভাবেনি।

নাহিদ আরজুর পাশে বসে ঘাড় কাত করে আরজুর লাল হওয়া মুখ পর্যবেক্ষণ করছে।আরজুর এলোমেলো চুল কানের পিঠে গুজে দিয়ে আরজুর শুভ্র কোমল হাতের মাঝে নিজের হাত গলিয়ে দিলো।আরজু তখনও স্থির। নাহিদ আরেকটু আরজুর কাছাকাছি এসে আরজুর চুলের ভাঁজে চুমু খেলো।কাধে হাত রেখে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বললো

-“অযাচিত কারো বক্তব্যকে নিজের জীবনে জায়গা দেওয়ার কোনো মানে হয়না আরজু।তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে।তাই এসব উটকো ঝামেলাকে জীবনে প্রশ্রয় দিবে না।কারণ জীবনটা তোমার।তুমি কি ভাবে বাঁচতে চাও সেটা অন্য কেউ নির্ধারণ করে দেওয়ার সুযোগ যেনো না পায়।”

আরজু থমথমে মুখে ফ্লোরে স্থির দৃষ্টি রেখে বললো
-” আমি কখনোই আপনার প্রতিপত্তি দেখে ভালোবাসিনি নেতা সাহেব।প্রথম যেদিন দেখেছি সেদিনই আপনার প্রতি দূর্বল হয়ে পরেছি।সেই দুর্বলতা একসময় ভালোবাসায় রূপ নিয়েছে।তখনও আমি জানতামনা আপনি কে,কোন ফ্যামিলি বিলং করেন।যখন জেনেছি তখন আমার অনুভূতি অনেক দুর অব্দি পৌঁছে গেছে।আমি চেয়েও নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি।আমার কখনোই মনে হয়নি আমাদের মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে।”

নাহিদ আরজুর কাধে রাখা হাতের বাঁধন আরো শক্ত করে ধরে জড়িয়ে ধরলো।আরজুর মুখটা নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো

-“আমি জানি বউ।আমার জন্য এসব মেটার করেনা।যেই মানুষটার মাঝে আমার শান্তি মেলে আমি তাকেই বেছে নিয়েছি।যেখানে মনের মিলন ঘটে সেখানে এসবের কোনো জায়গা নেই।ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে বাঁচতে পারার সুযোগটাই অনেক।সেটাও বা কয়জন পায় বলো?
-“আমি মোটেও পারফেক্ট ওয়াইফ না।”

-“কে বলেছে ওয়াইফ কে পারফেক্ট হতে হবে।ওয়াইফ পারফেক্ট হতে নেই।তারা ভুল করবে,ঝামেলা করবে আর হাজবেন্ড সেই ঝামেলা মেটাবে,তার বাচ্চামো সহ্য করবে।তবেই না সংসার জমবে।নাহলে লাইফ বোরিং হয়ে উঠবে।”

নাহিদের কথায় আরজু মুচকি হাসলো।মানুষটা তাকে এতো স্পেশাল কেনো ফিল করায়?আরজুর উজ্জ্বল মুখটায় লাজুক হাসি নাহিদের বুকে প্রশান্তি দিলো।নাহিদ হঠাৎ আরজুর কোমর জড়িয়ে একদম নিজের কাছে নিয়ে আসলো।আরজুর অধরে উষ্ণ স্পর্শে ভরিয়ে দিলো।আরজু নাহিদের চুলে খামচে ধরে সেই অনুভূতির অত্যাচার সহ্য করছে।আজকাল এমন অত্যাচার তার উপর প্রায়শ হয়ে থাকে।আবেশে আরজুর চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে আসলো আরজুর।ভালোবাসায় সিক্ত দুজন মানুষের ভারী নিঃশ্বাস ছড়িয়ে পড়লো নিস্তব্দ ঘরে।খানিক বাদে অধর ছেড়ে নাহিদ মৃদু হেসে আরজুর কাপা অধরে তাকালো।এই লালচে অধরের তৃষ্ণায় কাতর ছিলো তার শুষ্ক হৃদয়।আরজু লজ্জায় কেমন তার বুকে মিশে আছে।নাহিদ মনে মনে হেসে বললো

-“এই রমণীর মিষ্টি হাসি একদিন নিবরাস নাহিদের চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল।এই ঘরটায় বসেই এই রমণীকে নিয়ে প্রথম স্বপ্ন বুনেছিলো।পাওয়া না পাওয়ার দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলো কত রাত।আর আজ সেই রমণীকে বুকে জড়িয়ে দীর্ঘশ্বাসের জায়গায় ভারী নিঃশ্বাস ফেলার পথটা মোটেও সহজ ছিল না আরজু।যেদিন তোমাকে জীবনসঙ্গী করে পেয়েছিলাম খুশিতে মরে যেতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু প্রকাশ করতে পারিনি।এতো সাধনার বউকে কেউ সামান্য কষ্ট দিবে সেটা নাহিদ মোটেও মেনে নিবে না।একদম না।”

ঠিক সেই সময়েই কেউ নাহিদের রুমের দরজায় নক করলো।জেরিন এসেছে।জেরিন হেসে বললো

-” তোমাদের কি ডিস্টার্ব করলাম ভাইয়া? ডিস্টার্ব হলেও কিছু করার নেই।আজ আর ভাবীকে তুমি পাবে না।ভাবী তোমাকে এই বাড়ির সবচাইতে সুন্দর জায়গা দেখানো হয়নি।ছোট চাচীর বাগান দেখলে চোখ জুড়িয়ে যাবে।জলদি চলো।”

নাহিদ জেরিনের কান মলে দিয়ে বললো
-” বেশি পেকে গেছিস।”

-” মোটেও না।”

জেরিন নাহিদকে ভেংচি কেটে আরজুকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।নাহিদ মুচকি হেসে পকেটে হাত গুজে সারা রুমে চোখ বুলালো।জীবনের দীর্ঘ সময় এই রুমটাতে কেটেছে তার।কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এখানে।

জেরিন আরজুকে ঘুরে ঘুরে বাগান দেখাচ্ছে।আরজু মনোযোগ দিয়ে সবটাই পর্যবেক্ষণ করছে।বাগানের এক পাশে জাহিদ দাড়িয়ে ছিলো।আরজু তাকে দেখে সেদিকে এগিয়ে গেলো।মৃদু হেসে বললো

-” কি ব্যাপার দেবর জি।আপনাকে তো আজকাজ পাওয়াই যায়না।আমার বান্ধবীর প্রেমে ডুবে অতল সাগরে হারিয়ে গেলে নাকি?”

জাহিদ হেসে বললো
-“আপনার বান্ধুবি ডুবতে দিলে তো?সবার কপাল আমার ভায়ের মতো না।”

-” তাই নাকি?তবে আমার বান্ধুবী কিন্তু নরম মনের মানুষ।উপরে শক্ত কিন্তু ভেতরে সুপার সফট।”

-” কই সেই সফটনেস এর ছিটে ফোটাও দেখলাম না?”

আরজু হেসে উঠলো।জাহিদ মন খারাপ করে সেই হাসি দেখলো।তার দুঃখে ভাবী হাসছে?আরজু হাসি বন্ধ করে এবার একটু সিরিয়াস হয়ে বললো

-” আমার বরের সাথে তোমার কোনো দ্বন্দ চলছে? মানে জেরিনের সাথে যতোটা সহজে তিনি মিশছে তোমার সাথে তেমন না।কেনো?”

-” সেটা আপনার বরকে জিজ্ঞেস করুন।”

-” বাহ! এতো অভিমান আমার বরের প্রতি?”

-” অভিমান নেই ভাবী।ভাইয়াকে আমি ভীষণ সম্মান করি।”

-” ওই নেতা আমাকে কিছুই বলে না।তার এতো সময় কই? ব্যাটা বিয়ে করেই খালাস।”

জাহিদ ফিক করে হেসে দিলো।বললো
-” আমার ভাইকে নিয়ে বিচিং করা হচ্ছে?আমি কিন্তু মোটেও টলারেট করবো না।”

আরজু বাগানের বকুল গাছটার নিচে দাড়িয়ে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বললো

-” তোমাদের পরিবার বা নেতা সাহেব সম্পর্কে তেমন কিছুই জানিনা আমি জাহিদ।নেতা সাহেব কখনই আমার সাথে স্বাচ্ছন্দ্যে এই বিষয়ে কথা বলেনি।আমি বুঝতে পারছি তার সবার সাথে কোনো মেজর ঝামেলা আছে।কিন্তু সেটা কি জানিনা।তাকে প্রেসার দিয়ে আমি জানতেও চাইনা।”

জাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো
-“ভাইয়া আমাকে তেমন পছন্দ করেনা ভাবী।ছোট বেলা থেকেই সে আমাকে ইগনোর করে এসেছে।অন্যসব বড়ো ভাইদের মত আদর করে কাছে ডাকেনি।আমি সবসময় তার অ্যাটেনশন পাবার চেষ্টা করতাম।সবার বড়ো ভায়েরা তাদের ছোট ভাইকে নিয়ে মাঠে খেলাধুলা করতো। সেটা দেখে আমিও একবার নতুন ব্যাট বল কিনে ভাইয়ার কাছে ছুটে গেছিলাম।তার সাথে খেলার বায়না করলাম।কিন্তু সে মানা করে দিলো।আমি জেদ করলে আমার গালে থাপ্পর বসিয়ে দিয়েছিল।সেদিনের পর থেকে তার সাথে কোনো কিছু নিয়ে জেদ করিনি।তারপর ধীরে ধীরে তার সাথে আমার দূরত্ব বাড়তে থাকে।সেই দূরত্ব কমানোর চেষ্টা আমি করলেও ভাইয়া কোনোদিন সেই দূরত্ব কমানোর চেষ্টা করেনি।তাই আমাদের মধ্যে কোনো সক্ষত্যা গড়ে ওঠনি।”

আরজু অবাক হয়ে সবটা শুনলো।নেতা সাহেব সবার সাথে এমন ঝামেলা কেনো বাঁধিয়ে রেখেছে?জাহিদের কি দোষ ছিল? সে তো জাস্ট একটা বাচ্চা ছেলে ছিলো। সৎ ভাই বলে নিশ্চই এমন করেনি।তাহলে জেরিনের ক্ষেত্রেও এমন হতো।কিন্তু সে জেরিনকে ঠিক স্নেহ করেন।আরজু জাহিদের দিকে তাকিয়ে বললো

-” খুব ভালোবাসো আমার নেতা সাহেবকে?”

জাহিদ চুলে হাত বুলিয়ে মুচকি হেসে বললো
-“আপনার চাইতে কম ভাবী।”

আরজু হেসে উঠলো।জাহিদ ও হাসলো।হঠাৎ আরজুর চোখ পড়লো বাড়ির বিশাল গেটের দিকে।একটা কালো গাড়ি এসে থেমেছে সেখানে।গাড়ি থেকে বাদামি রঙের শাড়ি পরা এক সুন্দরী নারী বেরিয়ে আসলো।আরজু বিমোহিত হয়ে সে দিকে তাকিয়ে রইলো।জাহিদ সেদিকে তাকিয়ে আরজুকে উদ্দেশ্য করে বললো

-” সামনের মানুষটিকে দেখছেন ভাবী?আমাদের ছোট চাচী। ইনি আমাদের সবার মেন্টর।জীবনে যে কোনো সমস্যায় এই মানুষটি আপনাকে এক চুটকিতে সমাধান বের করে দিবে।”

নীবিতা মাহমুদ বাগানে জাহিদের পাশে সুন্দরী রমণীকে দেখেই বুঝে গেলেন এটা আরজু।তিনি মুখ ভর্তি হাসি ফুটিয়ে এদিকে এগিয়ে আসলেন।আরজুর চিবুকে ছুঁয়ে বললেন

-” আমাদের নাহিদের আরজু রাইট!”

আরজুর হৃদয়ে প্রশান্তি বয়ে গেলো।ইসস!!নাহিদের আরজু কথাটা কতটা মধুর শুনালো।আসলেইতো সে নাহিদের আরজু।আরজু লাজুক হেসে মাথা ঝাঁকালো।জাহিদ হেসে বললো

-” চাচী ইউ আর লেট।”

-” আই নো।একটা OT তে ফেঁসে গেছিলাম।আরজু কেমন আছো?”

আরজু হেসে বললো
-” আলহামদুলিল্লাহ ভালো।আপনি?”

-” আমার আর ভালো!নেতা আর ডাক্টার দের কোনো পার্সোনাল লাইফ নেই। টুয়েন্টি ফোর আওয়ার জনসেবায় নিয়োজিত থাকতে হয়।”

আরজুর এই মানুষটিকে ভীষণ ভালো লাগলো।কেমন সাবলীল ভাবে কথা বলছে।কোনো অহংকার নেই তার মাঝে।অনায়াসে মানুষটিকে মনের কথা বলে ফেলা যায়।

জাহিদ হেসে বললো
-” দাদাজান থেকে শুরু করে ভাইয়া পর্যন্ত সকলেই এক একটা হুর পরীদের এনে মেলা বসিয়েছে।ইসস!!! আমার পরীটাকে যে কবে আনবো?”

নীবিত মাহমুদ জাহিদের কান চেপে ধরে বললো

-” বাচ্চা ছেলের শখ কত এই বয়সে বিয়ে করার।”

-” একদম বাচ্চা বলবেনা চাচী।এই শব্দটা আমার ভীষণ অপছন্দ।আমি তো তিন বছর পরই বিয়ে করে বউ ঘরে তুলবো।”

জাহিদের কথায় আরজু আর নীবিতা মাহমুদ হেসে উঠলেন।
______________
সাবা খানম আরজুর হাসি খুশি মুখটা দেখে শান্তি পেলেন। গল্পের মাঝেই প্রশ্ন করলেন

-” তুই সুখে আছিস তো আরজু?”

আরজু এক মুহুর্ত থেমে মুচকি হেসে সাবা খানমের গলা জড়িয়ে বললো

-“সুখ কাকে বলে আমি জানিনা খালামণি। কিন্তু মানুষটা যতক্ষণ অব্দি বাসায় ফিরে না আসে আমি অস্থির হয়ে থাকি।তার ক্লান্ত মুখটা দেখলে সারাদিনের বিষণ্ণতা ভুলে যাই।মানুষটা বাসায় প্রবেশ করেই সবার আগে আমাকে খুঁজে।আমাকে দেখেই সেই মানুষটার ক্লান্ত চোখে মুখে চঞ্চতা বেড়ে যায়।আর তার উজ্জ্বল হাসি আমার বুকে তীব্র প্রশান্তি দেয়।এই অনুভূতিকে যদি সুখ বলে তবে আমি ভীষণ সুখী খালামণি।মানুষটা আমাকে ভীষণ ভালোবাসে।সে ঠিক তোমাদের মত আমাকে আগলে রাখে।মানুষটিকে তুমি যতোটা কঠোর ভাবো সে আসলে তেমন না।তার মধ্যে একটা অন্য সত্তা আছে।যা আমার সামনে আসলেই ফুটে উঠে।নেতা সাহেব জীবনে না আসলে ভালোবাসার আসল মানেটাই বুঝতাম না আমি।”

সাবা খানম সস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন।আরজু সুখে থাকলে তার চাইতে শান্তি আর কেউ পাবে না।এই মেয়েটা যে তার প্রাণ।সাবা খানম আরজুর কপালে চুমু খেয়ে বললেন

-” খুব সুখী হো।জীবনের সব সুখ আমার আরজুর ঝুলিতে জমা হোক।”

আরজু হেসে সাবা খানমের বুকে মাথা রেখে শুয়ে রইলো।আহা!!! এতো প্রশান্তি কেনো মায়েদের বুকে?
অবণী পরীক্ষা শেষ করে বাসায় ফিরে আরজুকে সাবা খানমের বুকে দেখে বললো

-” বাহ!! বাহ!! আসতে না আসতেই আম্মুর বুকে ঢুকে পড়েছ?আর আম্মু কই আমাকে তো এই ভাবে বুকে নাওনা?”

আরজু ভেংচি কেটে বললো
-” আসছে জেলাসি বান্দর।এতো দিন একা সব আদর নিয়েও মন ভরেনি?আমাকে আদর করতে দেখেই তোর পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে?”

-” নাও নাও আরো আদর নাও।আমাকে তো কেউ ভালোবাসা না।বিয়ে করে শ্বশুর বাড়ি চলে গেলে তখন বুজবে।”

সাবা খানম মুচকি হেসে অবণীকে কাছে ডাকলেন। অবণী গোমড়া মুখে এগিয়ে আসলো।সাবা খানম দুজনকেই কোলে শুয়ে দিলেন।এতদিন পর মেয়ে দুটিকে পেয়ে ভীষণ খুশি তিনি।আজ সারাদিন আর কোনো কাজেই হাত দিবেনা।সবটুকু সময় মেয়েদের দিবেন।জুবায়ের আহমেদ দ্রুত মুহূর্তটাকে ফোনের ক্যামেরায় ধারণ করে নিলেন।
______________

সারাদিনের ক্লান্তি শেষে নাহিদ বাসায় ফিরে মন খারাপ করে বসে রইল।আরজুকে ছাড়া ঘরটা কেমন শূন্যতায় ঘিরে আছে।বউদের দুদিন পর পর বাপের বাড়ি কেনো যেতে হবে?ভীষণ ফালতু একটা নিয়ম।সে এমপি হয়ে সবার আগে নতুন আইন পাস করাবে।বিয়ের পর এক রাত ও স্বামী ছাড়া কাটানো দণ্ডনীয় অপরাধ।সুমি এসে তাকে খেতে বলে গেলো।কিন্তু নাহিদ জানালো সে খাবে না।বউ ছাড়া তার মুখে খাবার রুচবে না।তখনই ফোন করলো আসফি।নাহিদের মলিন কণ্ঠ শুনে বললো

-“কিরে এমন ভেদা মাছের মতো চেপ্টা হয়ে আছিস কেনো?”

নাহিদ রেগে বললো
-” সালা বউ নাই।তাই মাথাও ঠিক নাই।সারাদিন পর বউকে না দেখলে কলিজা ঠান্ডা হয়না।”

আসফি বিরক্ত হয়ে বললো
-” আরে বাবা!! একদিন বউকে না পেয়েই এই অবস্থা।তাহলে আমার দিকটা ভাব।বউ সেই সাত সাগর তেরো নদীর ওপারে অন্য দেশে পড়ে আছে।তুই তো চাইলেই বউকে বিছানায় নিয়ে আদর করতে পারিস কিন্তু আমি?আমার যৌবন তো এমনি খসে পড়ছে।কিন্তু ওই ফাজিল মেয়ে বুজলে তো?বাইরে পড়াশুনা করে দেশকে উদ্দার করে ফেলছে।”

নাহিদ পেছনের চুলে হাত বুলিয়ে বললো
-” আগে বুঝতাম না ইয়ার এখন বুজি বউ দূরে থাকলে কি যন্ত্রণা।”

-” ধেত মনটাই খারাপ করে দিলি।এক্ষনি নুসাইবা কে কল করে প্রেমালাপ করে মন শান্ত করতে হবে।আমি তো চাইলেই বউকে কৌশলে আনতে পারি না।তাই ফোনেই প্রেম শেষ করতে হবে।”

কল কেটে নাহিদ বাঁকা হাসলো।
অস্থির মন নিয়ে আরজুকে কল করলো সে। অপর পাশের রমণী মিষ্টি কণ্ঠে বললো

-” নেতা সাহেবের মন খারাপ?”

নাহিদ হি হি করে হেসে বললো
-” না মোটেও না। বরং আজ মনটা বেশ ফুরফুরে।”

আরজু কপাল কুঁচকে বললো
-” কেনো?”

-“আমাদের পার্টিতে একটা মেয়ে নেত্রী নিয়োগ দেয়া হয়েছে।বেশ চঞ্চল মেয়েটা।কি সুস্পষ্ট ভাষায় কথা বলে? শুনতেই মন চায়।ভেবেছি তাকে ডিনারে ইনভাইট করবো।কিন্তু বাসায় এসে দেখি তুমি নেই।যায় হোক সমস্যা নেই।তুমি এমনিতেও আমাদের ডিনারের রাজনৈতিক আলোচনায় বিরক্ত হতে।তুমি বরং সেখানেই ইনজয় করো।আচ্ছা রাখছি আরজু।”

বলেই নাহিদ কল কেটে দিলো।সুমিকে ডেকে বললো
-“স্পেশাল ডিনারের ব্যাবস্থা কর সুমি।আমার স্পেশাল গেস্ট আসছে।”

নাহিদ পুল সাইডে টেবিল সাজিয়ে স্পেশাল গেস্টের অপেক্ষা করছে।টেবিলে সুন্দর ভাবে ক্যান্ডেল দিয়ে সাজানো।বাড়ির গেটে গাড়ি থামতেই নাহিদ বাঁকা হাসলো।কয়েক মিনিটের মধ্যেই একজন নাহিদের রুমে প্রবেশ করলো।দৌড়ে পুল সাইডে গেলো।সামনের মানুষটির এলোমেলো দৃষ্টি দেখে নাহিদ মুচকি হাসলো। আরজু ঠিক যতোটা ক্রোধ নিয়ে এসেছিল নাহিদকে কমলা রঙের পাঞ্জাবিতে দেখে মুহূর্তেই সেই রাগ শান্ত হয়ে গেলো। কমলা রঙের পাঞ্জাবীতে নাহিদকে দেখে থমকে গেলো সে।বলিষ্ঠ শরীরে কমলা রঙের পাঞ্জাবিতে অসম্ভব আকর্ষণীয় লাগছে নাহিদকে।সে নেতা সাহেবকে দেখতে চেয়েছিলো এই রূপে।অনেক আগে চিঠিতেও নেতা সাহেবকে সেই কথা জানিয়েছিল।মানুষটা সেই কথা মনে রেখেছে?আরজুর শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেলো।

তবে নাহিদের দুষ্ট হাসি দেখেই বুজলো নেতা সাহেব তাকে চরম বোকা বানিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে।কি চতুর এই নেতা?আরজু এই লোকটার চালাকি ধরতেই পারলো না?অথচ আরজু কতো কষ্টে খালামণিকে ম্যানেজ করে তবেই এসেছে।নাহিদের সাথে অভিমান করতে যেয়েও পাড়লো না।নাহিদের নেশালো দৃষ্টি আরজুকে অস্থির করে তুললো।নাহিদ দুহাত তুলে তাকে কাছে আসতে ইশারা করলো।তীব্র আবেগে দিক বেদিক ভুলে এক দৌড়ে নাহিদের বুকে ঝাপিয়ে পড়লো আরজু।নাহিদও জাপটে ধরেছে তাকে।আরজুকে শূন্যে তুলে নিলো নাহিদ। কোলে তুলে পেছনের দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো।দুজনের নিঃশ্বাসের গতি তীব্র পর্যায়ে আছে।দুজনে মাঝে নেই কোনো দূরত্ব।নাহিদের মাঝে তীব্র আকাঙ্খা এসে ভর করলো।বউকে কাছে পাবার আকাঙ্খা।বউকে গভীর ভাবে স্পর্শ করার আকাঙ্খা।নাহিদ বাঁকা হেসে ফিসফিসিয়ে বললো

-” বলেছিলাম না আমার জালে বন্দী হয়ে গেছো।চাইলেই এই জাল ভেদ করতে পারবে না।”

আরজু ঘন ঘন শ্বাস নিয়ে বললো
-” আপনি একটা মিথ্যুক। মিথ্যা বলে নিয়ে এসেছেন আমাকে।আর এই ভাবে কেনো তাকিয়ে আছেন?আমার কিন্তু ভীষণ লজ্জা লাগছে।”

নাহিদ হেসে বললো
-” তাই!! মিথ্যা নয় জেলাসের কারণে এসেছেন আপনি ম্যাডাম।আর একটু আগে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে এই লজ্জা কোথায় ছিলো?”

আরজু নাহিদের বুকে মুখ লুকালো।নাহিদ বাঁকা হেসে বললো

-“শোনো বউ, কামুকতার দৃষ্টি শুধু মাত্র বউয়ের দিকেই ফেলা উচিৎ।বউ তো সাজিয়ে রাখার জিনিস না।বউ আদর করার জিনিস।ভালোবাসার জিনিস।আমি ব্যাস্ত মানুষ,তাই যখনই সময় পাবো বউকে আদর করবো।অ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেটের মতো দুই বেলা সময় করে চুমু খাবো।বউ যদি বাবার বাড়ি যেয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকে তবে জুনিয়র নাহিদ কি করে আসবে?পুরুষ মানুষ সারাদিনের ক্লান্তি পর বাসায় এসে বউ না পেলে মাথা খারাপ হয়ে যায়।বুজলে?”

আরজু হতবম্ব হয়ে নাহিদের দিকে তাকিয়ে রইলো।এটা নেতা সাহেব তো? এ কোন রূপ তার?কেমন বেফাঁস কথা বলে তাকে লজ্জায় ফেলছে।আরজু শুকনো ঢোক গিলতে লাগলো।এই নেতার নিয়ত খুব খারাপ।তার উপর যে কোনো সময় হামলা হওয়ার সম্ভবনা আছে।আরজুর ভয়কে সত্যি করে নাহিদ আরজুর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে আরজুর অধরে হামলে পড়লো।আরজু মুহূর্তেই নাহিদের গলা খামচে ধরলো।একে অপরের ওষ্ঠে উষ্ণ স্পর্শে টালমাটাল হতে লাগলো। এ যেনো সর্গী ও সুখ ।তীব্র উত্তেজনায় আরজু নাহিদের ঘাড়ে অসংখ্য নখের আঁচড় কাটতে লাগলো।নাহিদ ও প্রতিশোধ নিতে পিছুপা হলো না। আরজুর বক্ষস্থলে মুখ ডুবিয়ে অনুভূতির অত্যাচার শুরু করলো।আরজুর সারা শরীর বার বার কেঁপে উঠলো।বুকের ধুকপুক শব্দ বেড়েই চললো।আজ যেনো কোনো প্রতিযোগিতা চলছে।কে কাকে বেশি আদরের অত্যাচার করতে পাড়ে।স্বামী স্ত্রীর এক পবিত্র ভালোবাসায় সিক্ত হলো দুটি শরীর আর হৃদয়।যেই ভালোবাসায় এক বিন্দু দূরত্ব মেনে নেওয়া যায়না।শুধু হারিয়ে যেতে হয় তীব্র অনুভূতিতে।