মিষ্টি রোদের হাতছানি পর্ব-৬৪+৬৫

0
1283

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_64

গুধুলী বেলায় জনবহুল পরিবেশে বসে কাগজের গুটি গুটি লেখায় চোখ বুলাচ্ছে নাহিদ।একটা সমাবেশে যোগদান করেছে সে।সামনে আছে অসংখ্য মানুষের ঢল।নাহিদ সেদিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসলো।এইযে তাকে নিয়ে মানুষের উৎকণ্ঠা,উৎসাহ,আগ্রহ তাকে প্রশান্তি দেয়।নিজেকে ধাতস্থ করতে পারে সে সঠিক পথেই আগাচ্ছে।মানুষের সেবা করতে পারছে।এই মানুষগুলো তাকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালবাসে।সেই ভালোবাসার প্রতিদান দিতে এক বিন্দু ছার দেবেনা সে।সমাবেশ শেষে বেরিয়ে আসে নাহিদ।গাড়িতে উঠেই চমকে যায়।গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে বসে আছে আরজু।পরনে ব্ল্যাক জিন্স প্যান্ট আর উপরে গ্রে শার্ট।নাহিদকে দেখেই মিষ্টি করে হেসে বললো

-” সারপ্রাইজ!!!”

নাহিদ বুকের বা পাশে হাত দিয়ে জোরে নিঃশ্বাস টেনে বললো

-” এটা সারপ্রাইজ নাকি শক?তুমি এখানে?”

আরজু হেসে কুটিকুটি হলো।বললো
-” বারে!!! আমার বরের সমাবেশে আমি আসবো না?”

নাহিদ খানিকটা রেগে বললো
-” একদম না।তুমি জানো এসব সমাবেশে যে কোনো সময় দাঙ্গা,ফ্যাসাদ শুরু হয়।একদম ঠিক করনি আরজু।তাছাড়া তোমাকে কেউ দেখে নিলে?”

নাহিদ সামনে ড্রাইভিং সিটে বসা আসিফকে উদ্দেশ্য করে রেগে বললো

-” আসিফ এসব বিষয় তোমার খেয়াল রাখা প্রয়োজন ছিল।”

আসিফ কাচুমাচু হয়ে বললো
-” সরি স্যার।আমি ম্যামকে নিষেধ করেছিলাম।কিন্তু”

আরজু এবার বিরক্ত হয়ে রেগে বললো
-” আসিফ ভাইয়াকে কেনো ধমকাচ্ছেন।আমি নিজ ইচ্ছায় এসেছি।সব জায়গায় বাহাদুরি দেখবেন না।অসভ্য লোক।”

আরজুকে রাগতে দেখে নাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করলো।এই মেয়েটাকে কি করে বুঝাবে কত বিপদ সাথে নিয়ে চলতে হয় তাকে।নিজেকে নিয়ে তার কোনো ভয় নেই।ভয় নিজ প্রিয়তমাকে নিয়ে।নাহিদ শান্ত সুরে বললো

-” আরজু আর এমনটি করোনা।আমার চারপাশে শত্রুরা ঘুরে বেড়ায়।আমি চাইনা তারা তোমাকে টার্গেট করে কোনো ক্ষতি করুক।”

নাহিদ দ্রুত আসিফকে সেই জায়গা ছাড়তে বললো।নাহিদ দেখলো আরজু মন খারাপ করে বসে আছে।আহা !! এই গোমড়া মুখেই তার বউটাকে সাংঘাতিক সুন্দর লাগছে।তাই নাহিদ আরজুকে হালকা জড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বললো

-” মুখ এমন গোমড়া করে রাখলে কিন্তু গাড়িতেই চুমু খাবো।পড়ে আসিফ এই শর্ট ফ্লিম দেখে অক্সিডেন্ট করলে আমি দায়ী না।”

আরজু বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে রইলো নাহিদের দিকে।আর বললো

-” আপনার পার্টির লোকেরা জানে আপনি এমন অসভ্য?”

নাহিদ বিষদ হেসে বললো
-“পুরুষদের এতো সভ্য হতে নেই।নাহলে পরবর্তী প্রজন্ম আসার সুযোগ পাবে না।”

আরজু অভিমানী মুখ করে জানালার পাশে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।একটা রেস্টুরেন্টে বসে দুজন কিছু সময় কাটলো।সচরাচর এমন সুযোগ হয়না তাদের।আজকের বিকেলটা বেশ এনজয় করলো দুজন মিলে।আজ নাহিদের দুটো মিটিং ছিলো।কিন্তু সে দুটোই ক্যানসেল করেছে।মাঝে মাঝে কাজ ফাঁকি দিয়ে বউ নিয়ে প্রেম করতে হয়।এমনি সুন্দরী বউ তার।আবার অভিমানী ও বটে। একটু যত্নশীল না হলে বউয়ের হাতে না আবার মার খেতে হয়।সম্ভাব্য এমপি প্রার্থী হয়ে বউয়ের হাতে মার খেলে মান সম্মান কিছু থাকবে না।

__________________

নাঈম মাহমুদ আর আরজু বসে আছে বাগানের ছোট টেবিলে।কিছুক্ষণ আগেই এসেছেন ছেলের বউয়ের সাথে দেখা করতে।শশুরকে দেখে আরজুর মুখে হাসি ফুটে উঠলো।মানুষটার ব্যাক্তিত্ব তাকে মুগ্ধ করে।হয়তো তার নেতা সাহেবের সাথে শ্বশুরের আচরনে অনেক মিল তাই।নাঈম মাহমুদ আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বললেন

-” এই বাড়িটা আব্বা সখ করে নাহিদের জন্য বানিয়েছেন।এই বাগানের বড়ো বড়ো গাছ গুলো দেখছ,সেগুলো তিনি নিজ হাতেই লাগিয়েছিলেন।ভীষণ সৌখিন মানুষ ছিলেন তিনি।”

আরজু মুচকি হাসলো।শ্বশুরের সাথে গল্প করতে ভালো লাগছে।নাঈম মাহমুদ আরজুর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বললেন

-” সানজিদার ব্যাবহারের জন্য আমি ভীষণ লজ্জিত মা।সে এমন করবে জানলে তাকে আগেই সাবধান করে দিতাম।ওর পক্ষ থেকে আমি ক্ষমা চাইছি।”

আরজু চমকে গেলো।সেদিন কথা সে আর নেতা সাহেব ছাড়া কেউ জানেনা।তবে বাবার কানে গেলো কি করে? তার মানে নেতা সাহেব!! নিশ্চই এই নিয়ে বাবাকে কথা শুনিয়েছে?আরজু শান্ত সুরে বললো

-” বাবা আপনি ক্ষমা চেয়ে আমাকে লজ্জা দিবেন না।সেসব আমি কবেই ভুলে গেছি।”

নাঈম মাহমুদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো
-” সানজিদার এরূপ ব্যাবহারে জন্যই নাহিদ তাকে কখনোই পছন্দ করেনি। এতো বছরেও সানজিদা নিজের স্বভাব বদলাতে পারেনি।”

আরজু কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করলো
-“বাবা কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করতে পারি?”

-” অবশ্যই মা।”

-” নেতা সাহেব আর আপনার মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক নেই কেনো?”

নাঈম মাহমুদ শান্ত দৃষ্টিতে আরজুর দিকে তাকিয়ে রইলেন।এই মেয়েটাকে তার ভীষণ আপন মনে হয়।তার ছেলের একমাত্র সুখকে তার আপন মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক।এই মেয়েটি পারবে নাহিদকে সামলাতে।আজ বহুদিন পর মন খুলে কথা বলার মতো মানুষ পেলেন তিনি।দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে লাগলেন

-“আমি আর নিশি ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম।দুই পরিবারের সম্মতিতে ধুমধাম করে ঘরে তুলেছিলাম তাকে।আমাদের জীবনে ভালোবাসার কোনো কমতি ছিলনা।নিশি ছিলো তোমার মতো মায়াবতী।ওর মায়ার ঘোরেই আমার দিন পাড় হতো। শাড়ি পড়ে যখন সারা বাড়ি বিচরণ করতো তখন আমার মনে হতো কোনো পবিত্র পদ্ম ভেসে বেড়াচ্ছে।ভীষণ মিষ্টি করে হাসতো সে।আমাদের সুখকে দ্বিগুণ করে আমাদের ঘর আলো করে নাহিদের জন্ম হলো।ছেলেটা হয়েছে একদম মায়ের মত।পরিবারের সকলের চোখের মনি ছিলো নাহিদ।বিশেষ করে আমার আব্বা নাহিদকে চোখে হারাতো।ছেলেটা গুটি গুটি পায়ে যখন সারা ঘর ঘুরে বেড়াতো তখন কি যে প্রশান্তি অনুভব করতাম।বাসায় ফিরে ছেলের মুখ না দেখলে শান্তি পেতাম না।ধীরে ধীরে নাহিদ বড়ো হতে থাকলো।বাল্যকালে কি যে সুন্দর দেখতে ছিলো আমার নয়নের মনি।মায়া মায়া মুখে বাবা বাবা বলে কোলে এসে পড়তো।আর সেই মায়ায় আমরা বিভোর থাকতাম।
কিন্তু আমাদের সুখ বেশিদিন স্থায়ী ছিল না।ধীরে ধীরে খেয়াল করলাম নিশি প্রায়শ অসুস্থ থাকে।শরীরটাও কেমন ভেঙে এসেছে।একদিন জোর করে ডক্টরের কাছে নিয়ে গেলাম।টেস্ট করে জানতে পারলাম নিশির ফুসফুসে ক্যান্সার।আমার পৃথিবী যেনো থমকে গেলো সেদিন। প্রিয়তমা কঠিন অসুখ আমার হৃদয়কে ক্ষত বিক্ষত করে তুলেছিল।সেদিন নিশিকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদেছিলাম।বাড়ির সকলেই ভেঙে পড়েছিল।নাহিদ তখন ছোট ছিলো।তাই মায়ের রোগের বিষয়টা তাকে জানানো হলো না।কিন্তু নাহিদ বুঝতে যে কিছু একটা হয়েছে যার ফলে সবার মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেছে।আমার ছেলেটা সেই ছোট বয়স থেকেই বেশ বুদ্ধিমান ছিলো।

ধীরে ধীরে নিশির অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকে।ডক্টর এক বছরের আল্টিমেট দিয়ে দিলো।আমি তখন ভীষণ ভাবে ভেঙে পড়েছিলাম।নিশির মলিন মুখের দিকে তাকালেই বুকে মোচড় দিয়ে উঠতো।নাহিদ বুঝতে পারছিল তার মা বেশিদিন আমাদের সাথে থাকবে না।তাই সারাক্ষণ মায়ের কাছে পড়ে থাকত।মাকে জড়িয়ে কাদত।তখন নিশি আমাকে আবার বিয়ে করার জন্য প্রেসার দিতে থাকলো।এতে আমার বুকে আরো যন্ত্রণা শুরু হলো।প্রিয়তমার জায়গা অন্য কাউকে কি করে দেই?সেই যন্ত্রণা কমাতে মাঝে মাঝে মদ্যপান করতাম।একদিন মদ্যপান করে নেশার ঘোরে জীবনের চরম অপরাধ করে বসলাম।সানজিদা ছিলো আমার অফিসের সাধারণ কর্মচারী।কিন্তু নিশির অসুস্থতার খবর পাওয়ার পর থেকেই সে আমার দিকে ঘেঁষতে থাকে।আমি পাত্তা দিতাম না।কিন্তু সেদিন আমি সজ্ঞানে ছিলাম না।আমি জানি সানজিদা সেটার পুরোপুরি ফায়দা নিয়েছে।তারপর থেকেই অপরাধবোধ আমাকে ভেতরে ভেতরে শেষ করে দিচ্ছিল।আমি নিশির মুখোমুখি হতে পারছিলাম না।জীবনটা কেমন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছিল।”

নাঈম মাহমুদের দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।সেই তিক্ত অতীত মনে করে বুকের যন্ত্রণা শুরু হলো।আরজু তাকে সান্তনা দিলো না।মাঝে মাঝে মনের চাপা কষ্ট এই ভাবেই বের করা প্রয়োজন।এতে মন হালকা হয়।নাঈম মাহমুদ আবার বলতে লাগলেন

-“একদিন জানতে পারি সানজিদা প্রেগনেন্ট।আমি তখন চোখে মুখে অন্ধকার দেখছিলাম।কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।নিশির কানে খবরটা যেতেই সে আমাকে সানজিদাকে বিয়ে করার জন্য প্রেসার দিতে লাগলো।আমি জানি নিশির বুকে তখন কেমন যন্ত্রণা হচ্ছিল।কিন্তু সে আমাকে সামলানো জন্য নাহিদের জন্য কাউকে রেখে যেতে চাইছে।কিন্তু আমার পক্ষে সম্ভব ছিলনা নিশির জায়গা অন্য কাউকে দিতে। নিশির জীবদ্দশায় অন্য কাউকে স্ত্রী রূপে গ্রহণ করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।তবে নিশি নাছোড় বান্দা।তাই বাধ্য হয়ে তাকে প্রমিজ করেছিলাম তার কিছু হলে তবে সানজিদাকে বিয়ে করবো।

নিশির মৃত্যুর পর নাহিদ ভীষণ ভেঙে পড়েছিলো।তাকে সামলানোর মত পরিস্থিতি আমার ছিলো না।কারণ আমি তখন নিজেকে ঘরবন্দী করে ফেলেছিলাম।অনেকদিন অব্দি কারো সাথে কথা বলিনি।স্ত্রী শোক,অপরাধবোধ সব মিলিয়ে আমি স্বাভাবিক ছিলাম না।পরবর্তীতে নিজেকে গুছিয়ে নিশির দেওয়া কথা রাখতে পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা সানজিদাকে বিয়ে করে নিয়ে আসলাম।

এসবের বিরূপ প্রভাব পড়েছিলো নাহিদের উপর।মা হারানো বারো বছরের ছেলেটা মায়ের মৃত্যুর কিছুদিন পরই বাবাকে অন্তঃসত্ত্বা নতুন মা নিয়ে আসতে দেখে মানতে পারেনি।আমার দুরন্ত ছেলেটা ধীরে ধীরে শান্ত আর জেদি হতে থাকে।আমাকে সে প্রচন্ড ঘৃনা করতে শুরু করে।আমি কাছে টেনে নিল জেদ করে চলে যেতো।সানজিদাকে সে একদম সহ্য করতে পারতো না।আমি বুঝতে পারি সানজিদা ও কখনোই নাহিদকে আপন করে নেওয়ার চেষ্টা করেনি।ছেলেটা আমার কাছথেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো।

জাহিদের জন্মের পর থেকেই সে বাচ্চাটাকে ঘৃনা করতো।সে ভাবত এই বাচ্চা জন্যই তার মা শেষে সময়ে মনোকষ্ট নিয়ে মারা গেছে।আমি ভেবেছিলাম সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে।নাহিদের রাগ,জেদ,ঘৃনা কমে যাবে।কিন্তু আমি ভুল ছিলাম।আমার যে ছেলেটা বাবা বলতে পাগল ছিল সে আমার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকে।জেরিনের জন্মের পর নাহিদ জেরিনকে দূরে ঠেলে দেয়নি।বরং ছোট বোনকে ভীষণ ভালোবাসা দিয়েছে।কিন্তু জাহিদকে সে আজও মেনে নিতে পারেনি।আমার জাহিদটাও বেশ বুজদার ছেলে।ভাইয়ের ভালোবাসা পাবার জন্য কত কিছুই করতো কিন্তু কিছুতেই নাহিদের মন গলাতে পারেনি।অথচ জাহিদ আজও জানেনা কেনো তার ভাই তাকে এতো অপছন্দ করে।আমি জাহিদকে এসব বলার সাহস পায়নি।ছেলেটা আমাকে ভীষণ সম্মান করে।কিন্তু যখন জানবে তার বাবা কতবড় অপরাধী তখন যদি সেও আমাকে নাহিদের মত দূরে ঠেলে দেয় আমি মানতে পারবো না।”

বলেই নাঈম মাহমুদ অশ্রু ঝরালে।আরজুর ও চোখ ভিজে উঠলো।তার নেতা সাহেবের জীবনটা কখনোই মসৃণ ছিলো না। ইন্ট্রোভার্ট নাহিদ কখনই নিজের যন্ত্রণা কাউকে বলতে পারেনি।সেই বাল্যকালে এসব পরিস্থিতি একটা বাচ্চার মনে কিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে ভেবেই আরজুর বুক ধক করে উঠল।নাঈম মাহমুদের দিকে তাকিয়ে তার হাতে হাত রেখে সান্তনা দিয়ে বললো

-” বাবা আপনি ভেঙে পড়বেন না।আর নিজেকে অপরাধীও ভাববেন না।আপনি পরিস্থিতির শিকার।তবে আমি আপনাকে ছুঁয়ে প্রমিজ করছি,আপনার আর নেতা সাহেবের মধ্যকার দূরত্ব কমানোর চেষ্টা করবো।একজন বাবার বুকে তার সন্তানকে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।”

নাঈম মাহমুদ মুচকি হেসে আরজুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।বললেন
-” আমার বিশ্বাস তুমি পারবে।”
_______________
কিছুদিন পরের কথা,আজ আরজুকে নাহিদ ভার্সিটিতে ড্রপ করতে আসলো।কিন্তু আরজুকে ভার্সিটির গেটে না থেমে একটু আগেই নামিয়ে দিল।কারণ আরজুর বিয়ের বিষয়ে বন্ধুমহল ছাড়া আর কেউ জানেনা।নাহিদ এই মুহূর্তে কাউকেই এই বিষয়ে জানতে নিষেধ করেছে।আরজু স্বাচ্ছন্দে সবটাই মেনে নিয়েছে।আরজু আপন মনে হেঁটে ভার্সিটির গেটে ঢুকতেই তাদের ক্লাসের রিম্পি নামের একটি মেয়ে আরজুকে শুনিয়ে টিটকিরি করে বললো

-” বুঝলি রাইমা, আজকাল সুন্দরী হলে বড় বড় গাড়িতে চড়ার সুযোগ হয়।বড়ো বড়ো নেতারাও আগেপিছে ঘুরে।আজ সুন্দরী না বলে কোনো বড়লোক নেতা পটিয়ে ফেলতে পারলামনা।নাহলে বিত্তশালী কোনো লোকের বিছানা গরম করে সাননেন্দে এসির হাওয়া খেতে খেতে ভার্সিটিতে আসতে পারতাম।”

রাইমা নামের মেয়েটিও গা জ্বালানো হাসিতে ফেটে পরলো।রিম্পী মেয়েটি বন্ধুমহলের কাউকেই তেমন পছন্দ করেনা।বিশেষ করে আরজুকে।আরজুর প্রতি ছেলেদের বিশেষ আগ্রহ দেখে তার গা জ্বলে ওঠে। ঈর্ষা পরায়ণ মনোভাব প্রকাশ পায়।অনেকদিন যাবত আরজুকে সে লক্ষ করছিলো।আগে শুভর বাইকে করে আসলেও আজকাল বড়ো বড়ো গাড়ি থেকে বের হয় আরজু।একদিন নিবরাস নাহিদের সাথেও রেস্টুরেন্টে দেখেছে।নাহিদ নামক লোকটির সাথে আরজুর সখ্যতা রিম্পির মনে হিংসার জন্ম দিয়েছে।বন্ধুমহলের দাপট পুরো ক্যাম্পাসেই রয়েছে।তাই কখনো আরজুকে কিছু বলার সুযোগ হয়নি।কিন্তু আজও নাহিদের গাড়ি থেকে আরজুকে নামতে দেখে মেয়েটা আরজুকে খোঁচানোর সাহস পেয়ে গেলো।

আরজু কপাল কুঁচকে মেয়ে দুটির সামনে এসে দাড়ালো।কাধের ব্যাগ শক্ত করে চেপে ধরে রেগে বললো
-” মাইন্ড ইউর ল্যাঙ্গুয়েজ।”

রিম্পি ফিচেল হেসে বললো
-” তোমরা করলে দোষ নেই আর আমরা বললেই দোষ। লোকে ঠিক বলে সুন্দরী মেয়েদের চরিত্রে সমস্যা।এদের পয়সাওয়ালা লোক দেখলেই গায়ে ঢলে পড়তে মন চায়।”

আরজু প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে রিম্পিকে শাসিয়ে বললো
-“একদম বাজে কথা বলবেনা। কারো সম্পর্কে না জেনে তার ক্যারেকটার নিয়ে কথা বলার কোনো রাইট তোমার নেই।”

রিম্পী বাঁকা হেসে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো
-” তোমার ক্যারেকটার নিয়ে আমার আগেই সন্দেহ ছিলো।সেই ভাবে শুভর সাথে চিপকে থাকো।কিন্তু মেয়র নাহিদের ও যে মেয়েদের নেশা আছে জানতাম না।ভালই ভেবেছিলাম তাকে।আসলে নেতা মানেই ক্যারেকটার লেস।এদের প্রতি রাতে নতুন নতুন মেয়ে লাগে।আর তোমাদের মতো মেয়েরা নির্দ্বিধায় তাদের বিছানায় চলে যাও।আর বিনিময়ে বিলাসবহুল জীবনযাপনের সুযোগ পাও।”

এতক্ষণ সবটা হজম করলেও নাহিদকে নিয়ে বলা বাজে কথা আরজু সহ্য করতে পারলো না।প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে কষিয়ে একটা থাপ্পর বসিয়ে দিলো। এতেও খান্ত হলো না, মেয়েটার পেছনের চুলের মুঠি ধরে বলতে লাগলো

-“আমার নেতা সাহেবের চরিত্র নিয়ে বলার তুই কে?তাকে ক্যারেকটার লেস বলিস কোন মুখে? ইউ ব্লাডি বিচ।কয়দিন আগে যে সিনিয়রের সাথে অডিটোরিয়ামে প্রেম লীলা করতে যেয়ে সবার সামনে ধরা পড়লি তখন কি তোর চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র ছিলো?ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের হিল্লোলের সাথে যে তোর কি লটর পটর চলে জানিনা ভেবেছিস? Whatsapp গ্রুপে তোদের চুমু খাওয়ার ছবি বহুদিন ভাইরাল ছিল।যার নিজের চরিত্রের ঠিক নেই সে আমার আর নেতা সাহেবের দিকে অংগুল তুলে? আজ তোর পবিত্র চরিত্রই টেনে খুলে সেটা ধুয়ে পানি খাব।”

রাইমা মেয়েটি আরজুকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই পারছেনা।আরজু প্রচন্ড চটে গেছে। শুভ মাত্রই ভার্সিটির গেট দিয়ে ঢুকেছে।কিন্তু সামনের দৃশ্য চোখে পড়তেই হা হয়ে গেলো।কয়েক মুহূর্ত লাগলো বিষয়টা বুঝতে।আরজুর কাণ্ড দেখে এক দৌড়ে আরজুর কাছে এসে আরজুকে টেনে সরিয়ে নিতে নিতে বললো

-” কি করছিস আরজু? বিহেভ ইউর সেলফ।ছার বলছি।”

আরজু ক্ষেপা বাঘিনীর মতো আবারও মেয়েটার দিকে হাত পা ছুড়তে ছুড়তে বললো

-“এই বিচ এর সব চুল আমি ছিঁড়ে ছাড়বো।আমার নেতা সাহেবকে ক্যারেকটার লেস বলে কোন সাহসে?ওর মুখ থেতলিয়ে দিবো।ওর চরিত্রও থেতলিয়ে জুস বানাবো।”

শুভ আরজুকে জোর করে ধরে সরিয়ে এনে বললো
-” থামতে বলেছি আরজু।নাহলে মার খাবি।শান্ত হো।দিবো কিন্তু একটা কানের নিচে।”

ক্যান্টিনে বসে রাগে গজগজ করছে আরজু।তার সামনে একটা ঠান্ডা কোল্ড ড্রিংকস এনে দিলো রামিম। বললো

-“কোক খেয়ে মাথা ঠান্ডা কর।চোখ মুখ কেমন লাল হয়ে আছে।”

ফুয়াদ বলে উঠলো
-” ওহ মাই গুডনেস!! তুই এতো ভালো চুলোচুলি করতে পারিস আরজু জানতামই না।ইসস!! মনে করে ভিডিও করলে তোর বরের কাছে পাঠিয়ে দিতাম।নেতা দেখতো কি সাংঘাতিক বউ পাইছে।”

সাবিহা ফুয়াদের পিঠে চাপড় মেরে বললো
-“ধ্যত, ফাজলামি করিস না তো।”

জারা রেগে বললো
-” একদম ঠিক করেছিস আরজু। ওই ব্লাডি বিচকে তো শুকনো নিমের ডাল দিয়ে পিটানো উচিৎ। ওর স্ক্যান্ডাল এর কথা সবাই জানে।আবার আসছে সাধু সাজতে। লুচ্চা মাইয়া।”

শুভ আরজুর ঘামর্ত মুখ টিস্যু দিয়ে মুছে দিল। পাশে বসা রিমি সেদিকে নির্বিকারে তাকিয়ে আছে।যেই মেয়েটা ওর হৃদয় ভেঙেচুরে দিয়েছে সেই মেয়েটাকে এখনো কতো অবলীলায় যত্ন করছে শুভ।রিমির আফসোস হলো,শুভর ভালোবাসা না পাক অন্তত এই নিখাদ বন্ধুত্ব টুকু পেলেও তার জীবন সার্থক হয়ে যেতো।শুভ আর আরজুর এই সুন্দর বন্ধুত্ব আর কয়জনের ভাগ্যে আছে?

আরজু নিজেকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না।তার ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে একটা বাজে শব্দ আরজু সহ্য করতে পারেনা।আরজুর চোখ পড়লো শুভর হাতের দিকে।তখন আরজুকে টেনে আনার সময় আরজুর নখের আঁচড় লেগেছে।আরজু দ্রুত শুভর হাত ধরে অস্থির হয়ে বললো

-” কে বলেছে আমাকে ধরতে।দেখলি কেমন আঘাত পেলি।কি যে করিস তুই?”

শুভ মৃদু হেসে মনে মনে বললো
-” এই সামান্য আঘাত দেখে অস্থির হয়ে পড়লি আরজু? তবে আমার ভঙ্গুর হৃদয় দেখলে তুই সহ্য করতে পারবি না।”

কিন্তু মুখে বললো
-” আরে কিছু হবে না।ঠিক আছি।তুই শান্ত হো।”

আরজু বললো
-” ফুয়াদ স্যাভলন ক্রিম এনে দে।এক্ষুনি।”

শুভ আরজুকে শান্ত হতে বললো কিন্তু আরজু তো আরজু।তাকে থামানোর সাধ্য কারো নেই।ক্রিম এনে নিজে যত্ন করে শুভর হাতে লাগিয়ে দিলো।বাসায় ফেরার সময় শুভ নিজেই আরজুকে বাসায় ড্রপ করে দিয়ে গেলো।সে জানে আরজুর বুকে দাবানল জ্বলছে।করো কটু কথা এই মেয়ে মনতেই পারেনা।তাই বললো

-“সব বিষয়ে এমন রিয়েক্ট করতে হয়না আরজু।আমি জানি রিম্পীর ভুল ছিলো।কুকুর কামড়ালে তুই ও নিশ্চই কুকুরকে কামড়াবি না।একজন সুনামধন্য নেতার বউ তুই।একটু রেস্পন্সিবল হতে হবে তোকে। আমি জানি তোর মাথায় এখন কি চলছে।তবে নাহিদ ভাইকে যতটুকু বুজেছি তিনি নিশ্চই কোনো কারণে বিয়ের বিষয়টা গোপন রাখতে বলেছে।তুই আর রিয়েক্ট করিসনা।”

আরজু সেসব কথায় পাত্তা না দিয়ে শুভকে জোর করে বাসায় এনে তার হাতে বানানো বিদঘুটে কফি খাইয়ে তবেই যেতে দিয়েছে।কিন্তু ক্ষোভ আরজুর ভেতরে দাবানলের মতো ফুটছে।আজকের এই পরিস্থিতির জন্য নেতা সাহেব দায়ী। তাদের মধ্যে তো সবকিছুই ঠিক চলছে তবে এই সম্পর্ক নিয়ে কেনো এই লুকোচুরি?আরজু চায় সবাই জানুক সে নিবরাস নাহিদের অর্ধাঙ্গিনী।আরজু চায় অবাধে জনসম্মুখে নেতা সাহেবের হাতে হাত রেখে চলতে।আজ জবাব চাই তার।এই নেতার খবর করে ছাড়বে।

আজ অনেক রাত করেই বাসায় ফিরেছে নাহিদ।রুমে ঢুকেই দেখলো আরজু পুলের পাশে দাড়িয়ে আছে।আরজুর উজ্জ্বল মুখটায় রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে।নাহিদ বুঝতে পাড়ছে কোনো বিপদ সীমার মধ্যে আছে ।তাই আরজু কাছে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে উন্মুক্ত উদরে হাত গলিয়ে দিল।প্রিয়তমার চুলের ভাঁজে চুমু খেলো।আরজু চোখ গরম করে পেছন ফিরে তাকিয়ে প্রচন্ড রেগে বললো

-” কোনো ভদ্র বাড়ির ছেলে এতো রাত করে বাসায় ফেরে?”

নাহিদ বুজলো বউ সাংঘাতিক রেগে আছে।তাই মৃদু হেসে বললো
-” আমি মোটেও ভদ্র নই। নেতাদের ভদ্রতা দেখাতে হয় মুখে আর মনে রাখতে হয় তীব্র অভদ্রতা।”

নাহিদের হেঁয়ালি কথায় আরজু প্রচন্ড রেগে গেলো।নাহিদের পাঞ্জাবীর কলার চেপে বললো

-” আপনি আসলেই অভদ্র আর সুবিধাবাদী।নিজের সুবিধা ছাড়া কিছুই দেখেননা।আপনার কাছে পলিটিক্সই বড়ো, আমি কিছু না।আপনার লাইফে আমার কোনো গুরুত্বই নেই।”

নাহিদ মৃদু হেসে আরজুর ঠোঁটে টুপ করে চুমু খেয়ে নিল।আর বললো

-” পলিটিক্স আমার প্রথম ভালবাসা আর তুমি শেষ ভালোবাসা।প্রথম ভালোবাসা যেকেউ হতে পারে কিন্তু শেষ ভালোবাসা একজনই হয়। এবার তুমি বিবেচনা করো তুমি কতটা গুরত্বপূর্ন।”

আরজু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার পুলের দিকে তাকিয়ে দাড়ালো।গম্ভীর মুখে বললো

-“আমাদের সম্পর্ক নিয়ে এত লুকোচুরি কেনো খেলছেন?সবার সামনে আমাকে স্বীকৃতি কেনো দিচ্ছেনা?”

নাহিদ আবার আরজুকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আরজুর কাধে থুতনি রাখলো।শান্ত সুরে বললো

-” কে বলেছে তোমাকে স্বীকৃতি দেইনি? তোমার কথা আমার পরিবারের সকলেই জানে।পার্টির সকলেই জানে আমি সিঙ্গেল থেকে মিঙ্গেল হয়ে গেছি।এমনকি আমাদের পার্টির সবচাইতে ডিসগাস্টিং লোকটাকে অব্দি আমাদের বিয়ের কথা জানানো হয়েছে।”

-” আমিই আপনার স্ত্রী সেটা কেনো জানাচ্ছেন না?”

নাহিদ আরজুকে ছেড়ে সাইডে রাখা চেয়ারে আরাম করে বসে পড়লো।আরজু কপাল কুঁচকে নাহিদের দিকে তাকিয়ে রইলো।সমস্যা কি লোকটার?নাহিদ আরজুর দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।আচমকা হাত বাড়িয়ে আরজুর হাতে টান দিয়ে নিজের কোলে বসিয়ে দিলো।আরজু অবাক হয়ে গেলো।কিছু বলার আগেই নাহিদ আরজুকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো

-“আমাদের সম্পর্ক পাবলিক্যাল হওয়ার পর সবার আগে যেটা হারাবে সেটা হলো ব্যাক্তি স্বাধীনতা।এইযে অবাধে শহরের আনাচে কানাচে বন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়াতে পারছ, সেটা আর পারবেনা।মন চাইলে রাস্তায় দাড়িয়ে বন্ধুদের নিয়ে ফুচকা ,আইসক্রীম খেতে পারবে না।খাঁচায় বন্দি পাখির মতো বাঁচতে হবে। মানুষ তোমাকে তোমার পরিচয়ে না, জানবে আমার পরিচয়ে।মিডিয়া সারাক্ষণ তোমার পিছু নিবে।মানুষ তোমাকে নিয়ে সমালোচনা করবে।তোমার তো সাইফুলকে সাথে নিয়েই চলতেই অনিচ্ছা তখন আরো টাইট সিকিউরিটি নিয়ে চলতে হবে তোমাকে।আমার শত্রুপক্ষরা তোমাকে টার্গেট করে আমাকে দুর্বল করতে চাইবে।যখন তখন তোমার উপর হামলা ও হয়ে পারে।ভার্সিটিতেও সর্বক্ষণ তোমার সাথে সিকিউরিটি থাকবে।খালামণি বাসায় গেলে, সেই পুরো এলাকা সিকিউরিটি ঘেরাও করা থাকবে।রেস্টুরেন্ট থেকে শুরু করে মল সব জায়গাতেই টাইট সিকিউরিটির মধ্যে থাকতে হবে।তোমার চলাফেরা হয়ে যাবে সীমাবদ্ধ।চাইলেও স্বাভাবিক লাইফ লিড করতে পারবে না। তোমার লাইফ হয়ে উঠবে রেস্ট্রিক্টেড।এসব কি মানতে পারবে আরজু?”

আরজু হতবম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল।নাহিদ বাঁকা হেসে বললো

-” আমার লাইফ যতোটা সহজ ভেবেছো সেটা ততটা সহজ নয় আরজু।নিজের জীবন হাতে নিয়ে চলতে হয়।ব্যাক্তিগত জীবন বলতে কিছুই থাকেনা। নাইন টু ফাইব জব করা ব্যক্তিদের মতো সময় মতো বাসায় ফেরাও হয় না।রাতের পর রাত জেগে পার্টির কাজ করতে হয়।একজন নেতার সহধর্মিণী কে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয় আরজু।বিয়ের আগে তোমাকে ওয়ার্ন করেছিলাম।আমি জানতাম তোমার মত চঞ্চল,উল্লাসিত,স্বাধীনচেতা মেয়ের জন্য এসব রেস্টিকশন মেনে নেওয়া কষ্টকর।আমি চাইনি তোমার এই চঞ্চলতায় কোনো বাধা পরুক।আমি চেয়েছি আমার সুখ পাখিটা খোলা আকাশে ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়াক।কোনো বিপদ আমার পাখিটাকে ছুতে না পারুক।তাইতো শত্রুদের চোখ থেকে আমার প্রিয়তমাকে বাঁচিয়ে রাখার এতো চেষ্টা।”

আরজু অশ্রুসিক্ত নয়নে নাহিদের দিকে তাকিয়ে আছে।নাহিদ আরজুর অশ্রুকণা মুছে কপালে চুমু খেয়ে বললো

-“জীবনে অনেক বাধা আসবে আরজু।কিন্তু সব কিছুকে শক্ত হাতে মোকাবেলা করতে হবে।নাহিদের স্ত্রী হিসেবে তোমাকে হতে হবে আরো মজবুত,আরো তেজি।কোনো সমালোচনা যেনো তোমার জীবনে প্রভাব না ফেলতে পারে।আমি চাই আমার কিছু হলেও তুমি মাথা উচু করে বাঁচো।চলার পথে মুখ থুবড়ে পড়লেও মনে রাখবে তুমি নিবরাস নাহিদের অর্ধাঙ্গিনী।যে কখনও হারতে শেখেনি। আবার উঠে দরাবে আর নিজের লক্ষে এগিয়ে যাবে।কখনো হেরে যাবেনা।”

আরজু অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে নাহিদের গলা জড়িয়ে ধরলো।যেই মানুষটা তাকে এতো গভীর ভাবে ভালবাসে সেই মানুষটাকে সে ভুল বুজলো?আরজু তো কখনোই এতো গভীর ভাবে ভেবে দেখেনি।এই মানুষটা তাকে এতো কিছু থেকে বাঁচাতে চাইছে আর সে সেই মানুষটির সাথেই অভিমান করে বসে ছিল?আরজু তো জানতো নেতা সাহেবের বউ হওয়া সহজ বিষয় হবে না।তবে কেনো অন্যের কথায় এতো রিয়েক্ট করলো?

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_65

আজ অবনির লাস্ট পরীক্ষা।এতো দিনের পড়ার প্রেসার থেকে মুক্তি পাবে ভেবেই স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসলো।পরীক্ষা যেই লোক আবিষ্কার করেছে তাকে পেলে অবনি মরা সাজনা গাছের ডাল দিয়ে পিটাতো।এই ছোট্ট ব্রেনে এতো মোটা মোটা বই কি করে ফিট হবে?এটা কি আদো সম্ভব?এই কয়দিন মায়ের প্রেসারে বইয়ে মুখ গুজে বসেছিলো।আজ আর তাকে পায় কে?সুরভীকে পটিয়ে একটা ট্যুর দিবে।তবেই মনটা শান্ত হবে।

গেট থেকে বেরিয়ে তার চোখ পড়ল রাস্তার অপর পাশে বাইকে হেলান দিয়ে দাড়ানো মানুষটির দিকে।দুজনের দৃষ্টি মিলিত হতেই ব্যাক্তিটি অপ্রস্তুত হয়ে আসে পাশে তাকালো।অবনির অধরে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল।আর মনে উড়ছে রংবেরংয়ের প্রজাপতি।অবনি ব্যাক্তিটি দিকে এগিয়ে এসে বললো

-” আপনি এখানে কি করেন?”

নিশান অবাক হওয়ার বৃথা চেষ্টা করে বললো
-” আরে তুমি?এই হলে পরীক্ষা তোমার?”

অবনি মৃদু হাসলো।মনে মনে বললো ভীষণ বাজে অভিনয় করেন আপনি।অবনির দুষ্ট হাসিতে নিশান আরো অপ্রস্তুত হয়ে বললো

-” আমি এক ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে এসেছি।”

-“এই কলেজে পড়া স্টুডেন্ট আপনার ফ্রেন্ড?”

নিশান ঘাবড়ে বললো
-” না না।এই কলেজের প্রফেসর আমার ফ্রেন্ড।”

-” ও!!! তা আপনার ফ্রেন্ডের সাথে আপনার প্রতিদিন কাজ থাকে?”

নিশান হতবম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো।সে প্রতিদিন আসে এটা এই পিচ্ছি ধরে ফেললো? এতো মহা চালাক।শেষে কিনা এই অতি চালাক মেয়ের পাল্লায় পড়লো?অবনি হেসে উঠলো।আর নিশানের দিকে এগিয়ে নিচু স্বরে বললো

-” কি মিস্টার!!প্রেমে পরে গেলেন নাকি?”

নিশান শুকনো ঢোক গিললো।মুখটা এমন করলো যেমনটা চোর ধরা পরার পর করে।নিতান্তই বাচ্চার সামনে এমন ঘাবড়ানোর কোনো মানে হয়না।তাই বিরক্ত ভাব নিয়ে বললো

-” হোয়াট রাবিশ।আমি তোমার মতো বাচ্চার প্রেমে পড়তে যাবো কেনো?”

অবনি মৃদু হাসলো।বললো
-” আমি কিন্তু বলিনি আমার প্রেমে পড়েছেন।অবশ্য পড়াটাই স্বাভাবিক।সুন্দরী মেয়েদের প্রেমে সব ছেলেরাই পড়ে।”

নিশান ডান ভ্রু উচু করে বললো
-” তুমি সুন্দরী?”

অবনি হেসে বললো
-” তাতে কোনো সন্দেহ আছে?বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন আপনি আমার প্রেমে পড়েননি?”

নিশান থতমত খেয়ে গেল। সাংঘাতিক মেয়ে। এর সামনে আর এক মিনিট দাড়ালে মনের সব অনুভূতি টেনে হিঁচড়ে বের করবে।না আর এক মিনিটও না।নিশান দ্রুত বাইকে উঠে বললো

-” তোমার মাথায় সমস্যা আছে।অকালেই পেকে গেছো তুমি।তোমার প্যারেন্টস এর সাথে কথা বলতে হবে।”

অবনি ঝটপট নিশানের বাইকের পিছনে বসে পড়লো।নিশান চমকে গেলো।অবনি তাড়া দিয়ে বললো

-“বিয়ের এতো তারা আপনার?বুজেছি বিয়ের বয়স হয়েছে তো,কতো দিন আর কোলবালিশ নিয়ে লটরপটর করবেন?কোনো সমস্যা নেই।আম্মু বাসায় আছে।এক্ষনি চলুন।একটু পর আর আম্মুকে বাসায় পাবেন না।”

নিশানের মনে হচ্ছে, এই পিচ্চিকে এক পলক দেখার জন্য কলেজের সামনে এসে দাড়ানো তার জীবনের সবচাইতে বড়ো ভুল ছিল।কেনো দাড়ালো?এই মেয়ে তাকে বিপাকে ফেলতে সর্বদা প্রস্তুত।এই মেয়েকে বিয়ে করলে তার আর্মি অফিসার বাবা নির্ঘাত হার্ট অ্যাটাকে হসপিটালাইজড হবে।নিশান দ্রুত বললো

-” বাইকে কেনো উঠলে? আর আমি কখন বলেছি তোমার মতো বাচ্চাকে বিয়ে করবো?আমি তোমার মায়ের কাছে কমপ্লেইন করার কথা বলেছি বিয়ের জন্য না।”

অবনি পেছন থেকে নিশান কে জড়িয়ে ধরলো।তার পিঠে মাথা রেখে শান্ত সুরে বললো

-” আমাকে বাসায় ড্রপ করে দিন।নাহলে কলেজের সামনেই চুমু খাবো।তখন বিয়ে ছাড়া আর উপায় থাকবে না।”

অবনির কাজে নিশানের হৃদস্পন্দন থমকে গেলো।অবনির স্পর্শ তার পুরুষ মনকে অশান্ত করে তুলছে।অন্যদিকে অবনির শান্ত হুমকি তাকে বেসামাল করে তুলছে।এতো সব অনুভূতি এই বাচ্চা মেয়েটার জন্য জাগ্রত হওয়া কি আদো সঠিক?

_________________

মিষ্টি রোদের সোনালী আলোয় ঘুম ভেঙেছে আরজুর।প্রতিদিনের মতো আজও নেতা সাহেব পাশে নেই।হয়তো ঘুম থেকে উঠে অফিসে চলে গেছেন।কেনো একবার ডেকে তুললে কি হতো?আরজুর আর এই জীবনে নেতা সাহেবের আগে ঘুম থেকে উঠা হবেনা।লোকটা মনেহয় ভোর পাঁচটায় উঠে।আরজুর তো অতো সকালে চোখই খুলবে না।
বিছানা থেকে নেমে এলোমেলো চুল হাত খোঁপা করতে করতে ফ্রেস হতে গেলো।ফ্রেস হয়ে বেরিয়ে মুখ মুছতে মুছতে চোখ পড়ল বাগানের দিকে বাস্কেট বল কোটে।আরজু অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলো।ভুল দেখছে নাতো? নেতা সাহেব বাস্কেট বল খেলছে? এই সময়ে তো এই বান্দা কখনোই বাসায় থাকেনা।তবে আজ কি হলো? আরজু দ্রুত নিচে নেমে আসলো।বাগানে এসেই থমকে গেলো।নাহিদের পরনে গ্রে স্পোর্টস জার্সি।যা ঘামে ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। এক ফালি চুল ঘামে ভিজে কপালে পড়ে আছে।গলা আর কানের পাশদিয়ে ঘমার্ত নোনা পানি গড়িয়ে পড়ছে চুয়ে চুয়ে।আরজু বিমোহিত হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলো।সর্বদা শুভ্রও পাঞ্জাবী গায়ে জড়ানো মানুষটির এই রূপ আগে কখনোই দেখা হয়নি।আরজু পিটপিট চোখে তাকিয়ে মৃদু হাসলো।আজকের সকালটা আসলেই চমৎকার।নাহিদ একা একাই বলটা নিয়ে খেলছে।বলটা রিংয়ের ভেতরে ফেলেই পেছনে ফিরে তাকালো।আরজুকে দেখে কপালের লেপ্টে যাওয়া চুলকে পেছনে ঠেলে দিয়ে বললো

-” গুড মর্নিং মাই সুইটহার্ট।”

আরজু লজ্জা পেলো।আজকাল এমন কতো শত আদুরে নামে ডাকে এই ভদ্রলোক।আরজু সামনে এগিয়ে বুকে হাত গুজে বললো

-” নেতা সাহেব তাহলে বাস্কেট বল ও খেলতে জানে?”

নাহিদ মৃদু হেসে আরজুর কাছাকাছি দাড়ালো।আরজুর চিবুকে আলতো ছুঁয়ে আরজুর অধরে টুপ করে চুমু খেয়ে নিলো।আরজু প্রচন্ড লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলেছে।এই নেতা দিন দিন ভীষণ অসভ্য হয়ে যাচ্ছে।যখন তখন তার উপর হামলা করে বসে।নাহিদ বললো

-“খেলতে না জানলে নিশ্চই এই কোট সাজানোর জন্য রাখিনি।সময়ের অভাবে খেলার সুযোগ হয়না।”

আরজু নিচে পরা বলটা তুলে নিলো।বললো
-” আপনার আর কি কি গুন আছে আগে ভাগেই বলে দিন।প্রতি দিন একটা একটা করে আবিষ্কার করা ধৈর্যের ব্যাপার।আর আমার এতো ধৈর্য নেই।”

-” আমার আর কোনো গুন নেই।আমি পলিটিক্সের মানুষ।সব বিষয়ে একটি একটু ধারণা রাখার প্রয়োজন পরে।”

-“আপনি চাইলে একটা ম্যাচ হয়ে যাক?”

নাহিদ হাসলো।নাহিদ জানে আরজু বাস্কেট বল খেলেছে।অভিজ্ঞতা আছে।কলেজে পড়ুয়া আরজু যখন শুভর সাথে উৎসাহ নিয়ে মাঠে খেলত নাহিদ দুর থেকেই দেখে তৃপ্তির হাসি হাসতো।কিন্তু তার বোকা রাণীটা জানে না নাহিদ বাস্কেট বল খেলায় চ্যাম্পিয়ন ছিলো।বরাবর নাহিদের স্পোর্টসে বেশ আগ্রহ ছিল।তাই দাদাজান নাহিদের জন্য খেলার কোর্ট বাগানের পাশে করে দিয়েছেন।নাহিদ এগিয়ে এসে বললো

-” কেনো না।অবশ্যই ম্যাম।”

প্রথম বারে আরজু রিংয়ে বল ফেলতে পারলো না।কিন্তু নাহিদ ঠিকই ফেলে দিলো।এতে যেনো আরজুর মুখটা আরো মলিন হয়ে গেলো।আরজু দুবার জিতলেও নাহিদ পর পর কয়বার জিতে গেলো।আরজুর যেনো কান্না করার জোগাড়।তাই নাহিদ আর নিজে জেতার চেষ্টা করলো না।বউয়ের সাথে কম্পিটিশন করে লাভ নেই।এতে নিজের লস।আরজু জিততে পেরে খুশিতে আত্নহারা হয়ে গেলো।নাহিদের গলা জড়িয়ে ধরে বললো

-” আপনি হেরে গেছেন নেতা সাহেব।”

নাহিদ আরজুর ঘামে ভেজা কপালে লেপ্টে থাকা চুল কানে গুজে দিতে দিতে বললো

-” আমি তো সেই কবেই হেরেছি তোমাতে।শুধু তোমার বুঝতে দেরী হয়ে গেলো বউ।”

রুমে ফিরে দুজনই বেশ কিছুক্ষন পুলে সাঁতার কাটলো।কত শত খুনসুটি আর ভালোবাসার বিনিময় হলো।আরজুর মনে ভয় হয়।এতো সুখ,ভালোবাসা তার সইবে তো?কারণ তার আপন মানুষ গুলো একটা সময় দূরে চলে যায়।
নাহিদ আরজুর ভেজা চুল মুছে দিচ্ছে।আরজু আড়চোখে তাকিয়ে বললো

-“প্রতিদিন সকালে যে জনসেবার উদ্দেশে বাসা থেকে উধাও হয়ে যায় আজ হঠাৎ সে বাসায়,ঘটনা কি নেতা সাহেব?”

-“ঘটনা কিছুই না।ভেবেছি আজ সারা দিন বউয়ের সাথে কাটাবো।বউকে সময় না দিলে শশুর বাড়ির লোক আমাকে ভোট দিবে না।এতো গুলো ভোট ভেস্তে দেওয়া ঠিক হবে না।”

আরজু রেগে পেছন ফিরে বললো
-” ভোট পাওয়ার লোভে আমাকে সময় দিচ্ছেন? এতো খারাপ আপনি?”

-” খারাপের কি হলো? ঘরের লক্ষী যদি ভোট না দেয় তবে বাকিদের কাছ থেকে আশা করবো কি করে?”

আরজু নাহিদের পেটে গুতো দিয়ে বললো
-” পেটে পেটে এতো শয়তানি আপনার?”

নাহিদ আরজুর দিকে ঝুঁকে বললো
-” নেতাদের শিরায় শিরায় শয়তানি বুদ্ধি দৌড়ায়।আমার মতো তুখোড় নেতার সাথে তুমি পারবে না বউ।”

বলেই আরজুকে সুড়সুড়ি দিতে লাগলো।অন্যদিকে আরজুর হাসতে হাসতে ছুটোছুটি করছে।এক সময় বিছানায় শুয়ে হয়রান হয়ে আরজু জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো।নাহিদ আরজুর লাবণ্যময়ী রূপে মুগ্ধ হচ্ছে বার বার।বক্ষস্থলের অস্বাভাবিক উঠানামা দৃশ্য নাহিদের মস্তিষ্ককে বেকাকবু করে তুলছে।সন্তর্পনে সে আরজু উপরে নিজের বিশাল দেহখানা গলিয়ে দিয়ে বক্ষ বিভাজনে মুখ ডুবালো।তীব্র অনুভূতির ঝড়ের কবলে আরজুর নিজেকে মাতাল মনে হচ্ছে।নাহিদ মাথা তুলে আরজুর কপালে চুমু খেয়ে সম্মোহন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো

-“আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো প্রাপ্তি তুমি আরজু।তুমি আমার জীবনের সেই অমূল্য সম্পদ যাকে পাওয়ার আকাঙ্খা করাটাও দুঃসাধ্য।”

_____________________

তীব্র ক্রোধ নিয়ে লামিয়া দাড়িয়ে আছে সামনের ব্যাক্তির দিকে।লামিয়ার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছোট বোন লামিসার বেহাল দসা।বির বির করে সামনের ব্যাক্তিটি দিকে তাকিয়ে বললো

-” ভাইয়া এই চকলেট নিলে আপু রাগ করবে।”

ব্যাক্তিটি শান্ত দৃষ্টিতে লামিয়ার দিকে তাকালো।মৃদু হেসে বললো
-” কিছু বলবে না তুমি খাও।”

লামিয়া রাগে মুখ ফিরিয়ে নিলো।চিবিয়ে চিবিয়ে বললো
-” কয়দিন পর পর কেনো আসেন আপনি?আমাদের বাসা ভাড়া, লামিসার স্কুল ফি,আমার সেশন ফি চাচুর হাত দিয়ে পাঠিয়ে কি প্রমাণ করতে চান আপনি খুব ভালো মানুষ?”

ব্যাক্তিটি শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো
-” আমি তো নিজেকে কখনো ভালো মানুষ বলে দাবি করিনি।”

-“চাচীর অত্যাচার থেকে বাঁচানোর জন্য আপনি চাচাকে প্রেসার দিয়ে আমাদের এই বাসায় আপনার এলাকায় আনিয়েছেন।চাচার কাছ থেকে বাবার জমি উদ্ধার করেছেন।আমার স্বার্থপর চাচা যেদিন থেকে আমাদের টাকা দিতে আর আমাদের খোঁজখবর নিতে আসে তখন থেকেই বুঝতে পেরেছি এসবের পেছনে আপনি আছেন।”

-” হয়তো তোমার চাচা নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে।”

-“কখনোই না।ওই মানুষটা কখনোই বদলাবে না।চাচার হাতে পাঠানো টাকা ফিরিয়ে নিজে বাড়ি ভাড়া দিতে গেলে বাড়িওয়ালা ভাড়া নেয়না।এলাকার কোনো লাফাঙ্গা ছেলে ভুলেও আমার দিকে তাকিয়ে বাজে কথা বলার সাহস পায়না।এসব কেনো করছেন? দয়া দেখাচ্ছেন?”

-” এক বোনকে নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টা করছি।দায়িত্ববোধ থেকেই করছি।”

লামিয়া মেকি হেসে বললো
-” আমাদের উপর থেকে সবচাইতে বড়ো নিরাপত্তার ছায়া কেরে নিয়ে আপনি নিরাপত্তা দিতে এসেছে?দায়িত্ব পালন করছেন?হাস্যকর।”

ব্যাক্তিটি এবার লামিয়ার সামনে এসে দাড়িয়ে করুন কণ্ঠে বললো

-” অনুতাপের চাইতে বড়ো শাস্তি এই পৃথিবীতে আর কিছু নেই।অপরাধবোধ আমাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে।জীবনে সব সুখ পেয়েও হৃদয়ের গভীরে তীব্র ভয় আর অপরাধ বোধ নিয়ে বেঁচে আছি।এই ভাইটাকে কি মাফ করা যায়না।তোমার এই ঘৃণ্য দৃষ্টি দেখলে নিজেকে নর্দমার কিট মনে হয়। এবার অন্তত এই ভাইটাকে মাফ করে দাও।”

লামিয়ার চোখ ভিজে উঠলো।তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে।এই মানুষটা আড়ালে থেকে তাকে সর্বক্ষণ নিরাপত্তা দিচ্ছে।তাদের প্রতি খেয়াল রাখছে।অথচ একটা সময় এই মানুষটির জন্যই সে জীবনে সব হারিয়েছে।চাইলেও কি মাফ করা যায়।লামিয়া গম্ভীর সুরে বললো

-” আপনার মতো এতো বড়ো নেতার আমার মত ক্ষুদ্র মানুষের ক্ষমার প্রয়োজন কেনো?আপনি চাইলেই এসব পিছুটান ছেড়ে দিতে পারেন।”

অশ্রুসিক্ত চোখে তাকালো ব্যাক্তিটি।কাপা গলায় বললো
-” কিছু মানুষের অশ্রুর কারণ হয়ে স্বস্তিতে বাঁচা যায়না।আমার দ্বারা হওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ভুলের জন্য যাদের জীবনে বিপর্যয় নেমে এসেছে তাদের ধিক্কার নিয়ে বেঁচে থাকা বড্ডো যন্ত্রণার।”
_______________

আসিফ গাড়ি চালাচ্ছে আর বার বার নাহিদের রক্তিম আভায় ছেয়ে যাওয়া মুখটা দেখছে।এই মানুষটাকে সে বহু রূপে দেখেছে।কখনো কঠিন পাথরের ন্যায়,কখনো শান্ত কোমল গোলাপের ন্যায়।আজ নাহিদের অবস্থা ঠিক ধরতে পারছে না।মানুষটা অন্যায় দেখলে সর্বস্ব দিয়ে রুখে দাড়ায়।
ইদানিং নাহিদের রাজনৈতিক নেতাদের সাথে মতবিরোধ হচ্ছে।দলের সাথে তাল মিলিয়ে চলার দুষ্কর হয়ে পড়ছে।চারদিকে দুর্নীতি।এসব দেখলে মেজাজ খারাপ হয়ে যায় নাহিদের।শরিফুল হক তার চাটুকার কয়জন নেতাদের নিয়ে নাহিদকে নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার হুমকি দিয়েছে।আজ বিকেলেই তারা নাহিদের মুখমুখি বসে ছিল।এসব নিয়ে কথা কাটাকাটি করে ক্ষিপ্ত মেজাজে বাসায় ফিরেছে নাহিদ।
বাসায় পৌঁছাতেই নাহিদ দ্রুত রুমে চলে গেলো।অন্য দিনের মতো হাসি মুখে বিদায় নিলো না।আসিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজ গন্তব্যে চলে গেলো।

আরজু নাহিদের ক্লান্ত মুখটা দেখে এক গ্লাস লেমোনেট নিয়ে আসলো।নাহিদ সেটা খেয়েই ফ্রেস হয়ে আসলো।আরজু বুঝতে পাড়ছে কোনো কারণে তার নেতা সাহেবের স্ট্রেসের মধ্যে আছে।আরজু তো ভেবেছে নেতা হওয়া খুব সহজ।কিন্তু নাহিদকে কাছ থেকে দেখে উপলব্ধি করতে পারছে এটা মোটেও সহজ নয়।বরং অনেক বেশি পরিশ্রমের।মানুষটা খাওয়ার সময় অব্দি পায়না। নাহিদ এসেই সোজা আরজুর কোলে শুয়ে পড়লো। মাথার রগ গুলো ধপধপ করছে।মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে।নাহিদের ক্লান্ত মুখখানা দেখে আরজুর কষ্ট হচ্ছে।নাহিদ ক্লান্ত সুরে বললো

-” মাথাটা ভীষণ ধরেছে আরজু।মনে হচ্ছে ছিঁড়ে পড়ে যাবে।মাথায় হাত বুলিয়ে দাও।”

আরজু বিনা বাক্য অপচয় করে নাহিদের চুলে হাত বুলাতে লাগলো।আর বললো

-“এতো প্রেশার নিয়ে কাজ না করলে হয়না?অসুস্থ হয়ে পড়বেন তো?”

-” তুমি আছো না আমার অসুখ দুর করতে।আমার সব রোগের মেডিসিন।”

আরজু মৃদু হেসে বললো
-” সেই মেডিসিন যদি কোনোদিন সাংঘাতিক রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়?”

নাহিদ পিট পিট চোখে তাকালো।আরজুর হাতের তালুতে অধর ছুঁয়ে বললো
-” তুমি নামক সাংঘাতিক রোগকেও আমি হাসি মুখে আমার অস্তিত্বে মিশিয়ে নিবো।”

আরজু মৃদু হেসে নাহিদের কপালে চুমু খেয়ে বললো
-” কবে থেকে আমায় এতো ভালোবাসতে শুরু করলেন?”

-“যখন থেকে তুমি আমার জীবনে এসেছো।”
__________________

জীবন যেনো আলোর গতিতে ছুটে চলে অবিরত।সুখের সময় গুলো কেনো দীর্ঘ হয়না?জীবনের ভালো সময় হয় সবচাইতে সংক্ষিপ্ত।এটাই জীবনের ধর্ম। দুঃখ আছে বলেই হয়তো সুখকে মানুষ এতো ভালোবাসে।প্রতিটা মানুষের জীবনেই কঠিন মুহূর্ত আসে।হয়তো রামিম সেই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।

আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে যখন দেখলো তার মা তখনো উঠেনি রামিমের কাছে বিষয়টা অদ্ভুদ লাগে।কারণ মা খুব ভোরে উঠেই নামাজ পড়ে রান্না শেষ করেন।তার পর স্কুলের উদ্দেশে বের হয়।কিন্তু আজ আটটা বেজে গেল কিন্তু মা ঘুমাচ্ছে?আবার কি মায়ের শরীর খারাপ করলো? কেনো যে ডক্টরের কাছে যেতে চায়না?রামিম মায়ের বিছানার পাশে বসে মায়ের চুলে হাত বুলাতে যেয়ে চমকে উঠলো।কেমন বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে আছে।রামিম প্রচন্ড ভয়ে মাকে বার বার ডাকতে লাগলো।সারা শরীর বরফ শীতল হয়ে আছে।রামিম ডাকলো কিন্তু আঞ্জুমান আরা কোনো সাড়া দিলেন না। রামিমের সারা শরীর কেঁপে উঠলো। চোখে জমলো অশ্রু।অসহায় রামিম কাপা হাতে মাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে ছুটলো হসপিটালে।শেষ অবলম্বন টুকু হারালে রামিম নিজেই শেষ হয়ে যাবে।হসপিটালে পৌঁছেই ডক্টর পরীক্ষা করে যা জানালেন তার জন্য রামিম মোটেও প্রস্তুত ছিলো না।রামিম স্তব্ধ হয়ে সেখানেই বসে পড়লো। শ্যাম বর্ণের সুন্দর মুখটা রক্তিম হয়ে উঠলো।পুরো ধরণী যেনো স্তব্ধ হয়ে গেছে।রামিম যেনো হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে গেছে।অনেকক্ষণ যাবত রামিমের ফোন বেজে চলছে।কিন্তু রামিমের সেদিকে কোনো হুস নেই।ফোন বেজে বেজে ক্লান্ত হয়ে আবার কেটে যাচ্ছে।একসময় রামিম পকেট থেকে ফোন বের করে না দেখেই রিসিভ করে।ওপর পাশে মিষ্টি কণ্ঠ ভেসে আসে।

-” রামিম কোথায় তুই? কখন থেকে কল করে যাচ্ছি।”

রামিম শান্ত কণ্ঠে বললো
-“হসপিটালে।”

সাবিহা অস্থির হয়ে বললো
-” হসপিটালে? কি হয়েছে? তুই ঠিক আছিস? আন্টি ঠিক আছে?”

রামিম কাপা কাপা গলায় বললো
-” সাবিহা এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে আমি একা হয়ে গেলাম রে।আমার যে আর কেউ রইলো না।আমি বাঁচবো কি করে?”

বলেই হুহু করে কেঁদে উঠলো।অন্যদিকে সাবিহা স্তব্ধ হয়ে গেলো।সেই হাস্যোজ্জ্বল মানুষটা নেই ভাবতেই বুকে তীব্র পীড়া অনুভব করলো।তার ভালোবাসার মানুষটির একমাত্র অবলম্বন সৃষ্টিকর্তা কেনো কেড়ে নিলো?সৃষ্টিকর্তা এতটা নিষ্ঠুরতা এই মানুষটার সাথেই কেন দেখালো?