#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_66
বাইরে রোদের তেজ বাড়ছে।বাতাসের উষ্ণ হাওয়ার স্পর্শে সেটা বেশ উপলব্ধি করা যাচ্ছে।পুরনো ধাঁচের বাড়িটির দ্বিতীয় তলায় বইছে অতৃপ্ত নিস্তব্দতা।আরজু শুভর কাধে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে উঠছে।শুভ স্তব্ধ হয়ে বসে সামনের মানুষটিকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে।নিস্তব্দ,নিষ্প্রাণ,নির্বাক হয়ে বিছানার সামনে ফ্লোরে বসে আছে রামিম।তার ঠিক পাশেই তৃষ্ণার্ত চাতকের মতো বসে রামিমের পানে দৃষ্টি ফেলে অশ্রু জড়াচ্ছে সাবিহা।শুভর চোখ ভিজে উঠলো।সামনের এই ছেলেটিকে সে কখনোই ভেঙে পড়তে দেখেনি।বরং সবচাইতে দায়িত্বশীল ভাবে তাদের বন্ধুমহলের সকলকে সামলিয়েছে।নিজের একাকীত্ব,কঠিন বাস্তবতা আর আর্থিক সমস্যা কখনোই কারো সামনে প্রকাশ করেনি।সবসময় সব পরিস্থিতি হাসি মুখে,যুক্তি দিয়ে সামলিয়েছে।হাসি খুশি থাকা সেই দায়িত্বশীল ছেলেটির একমাত্র অনুপ্রেরণা ছিলো তার মা।যাকে নিয়ে সুন্দর ভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখছে।কিন্তু ভাগ্য যেনো এই ছেলেটির সহায় ছিলো না।সৃষ্টিকর্তার কি নির্মম বিচার!!
সাবিহা অসহায় দৃষ্টিতে রামিমকে দেখছে। রামিমের অশ্রুসিক্ত ক্লান্ত আঁখিতে অসহায়ত্বের ছাপ।প্রতি মুহূর্তে মুহূর্তে সাবিহার বুক ধুকপুক করে উঠছে। সর্বদা যেই চোখে তেজ থাকতো সেই চোখে যেনো আজ ভীষণ শান্ত,নির্জীব।এই ছেলেটা নিজেকে সামলাবে কি করে?সাবিহা ঠোঁটে দাত চেপে নিজের কান্না রোধ করলো।আজ যদি সে নিজেই ভেঙে পড়ে তবে তার ভালোবাসার মানুষটিকে কি করে সামলাবে?এই মানুষটিকে যে সান্তনা দেবার মতো কেউ নেই।ভালোবেসে মাথায় হাত বুলানোর মতো আর কেউ রইলো না।আঞ্জুমান আরার হাস্যজ্জল মুখখানা ভেসে উঠলো।কি মিষ্টি করে হেসে তাকে আদর করে মা বলে ডাকতেন।সাবিহার মনে পড়লো সেদিনের কথা, যেদিন আঞ্জুমান আরা তারা হাত ছুঁয়ে বলেছিলেন সবসময় রামিমের পাশে থাকতে।
রামিমের আত্মীয় বলতে তেমন কেউ নেই।নানাবাড়ির কারো সাথেই তাদের তেমন যোগাযোগ নেই।কিন্তু বোনের মৃত্যুর খবর শুনে হয়তো দায়িত্ববোধ থেকেই জানাজায় শরিক হতে এসেছেন।জানাজা শেষে করেই যেনো তাদের যাবার তাড়া বেড়ে গেলো।রামিম কারো সাথেই কোনো বাক্য বিনিময় করেনি। যারা তাদের দুঃসময় পাশে এসে দারায়নি তাদের এই কঠিন মুহূর্তেও পাশে চায়না সে।ফুয়াদ আর জারা তাদেরকেই বিদায় দিয়ে বাসায় ফিরে আসলো।যেই বাসায় একসময় আসলে তারা সকলেই হইহুল্লোরে মেতে উঠতো,আজ সেই বাসা জুড়ে আছে বিষাদের ছায়া।জারার মতো কঠিন মেয়েও যেনো আজ বার বার কেপে কেপে উঠছে।
বেশ কিছুদিন আগেই আঞ্জুমান আরার হার্টে ব্লক ধরা পড়েছিল।ডক্টর তাকে দ্রুত ওপেন হার্ট সার্জারি পরামর্শ দিয়েছেন।এতে অনেক অর্থের প্রয়োজন।আঞ্জুমান আরা তিলে তিলে কিছু অর্থ জমা করেছেন ছেলের ভবিষ্যতের জন্য।কোনো বিপদের সময় সামান্য সাহায্য করার মতো কেউ নেই তাদের।তাই সেই জমা অর্থ নিজের চিকিৎসায় খরচ করে ফেলার ইচ্ছা তার ছিলো না।মেডিসিনের মাধ্যেমে তিনি সবটা ধামাচাপা দিয়েছেন।তার অসুস্থতায় রামিম হসপিটালে নিয়ে যেতে চাইলে তিনি রাজি হতেন না।কারণ তিনি জানতেন ছেলে নিজের শরীরের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে হলেও মায়ের চিকিৎসায় নেমে পড়বে।পার্থিব জীবনে একদিন তো সবাইকেই যেতে হবে।তাই ছেলেকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে যেতে চাননি।
তপ্ত রোদ নিজের তেজ কমিয়ে পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে অনেক আগেই।বন্ধুমহলের সকলেই নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে।রিমি আর শুভ সবার জন্য হালকা পাতলা খাবারে ব্যাবস্থা করলো।সাবিহা বেশ কয়েকবার রামিমকে কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করেছে।কিন্তু সফল হলো না।কেমন নিস্তব্দ,শান্ত হয় আছে ছেলেটা।না কাদঁছে আর না কিছু বলছে।সকল নিস্তব্দতা কাটিয়ে রামিম বললো
-” তোরা বাসায় চলে যা।অনেক রাত হয়ে গেছে।”
আরজু বললো
-” আমাদের সমস্যা নেই।তুই ঠিক আছিস রামিম?”
-” আমি ঠিক আছি।তোরা বাসায় যা।”
সাবিহা প্রতিবাদ করে বললো
-” তোকে এই অবস্থায় রেখে কিছুতেই যাবো না।আমি এখানেই থাকবো।”
রামিম শুভর দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বললো
-” এই পাগলটাকে নিয়ে যা তো।আমি বলছি তো ঠিক আছি।”
সাবিহা কেঁদে উঠলো।রামিম সাবিহার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো
-” আমাকে এতো দুর্বল ভাবিস না।নিজেকে সামলাতে জানি আমি।”
সাবিহা রামিমকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো।বিড়বিড় করে বললো
-” জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে আমাকে পাশে পাবি।আন্টিকে ছুঁয়ে প্রমিজ করেছি সব সময় তোর পাশে থাকবো।”
রামিম উগলে আসা কান্নাকে সামলে নিয়ে শুভকে বললো
-” ওদের সবাইকে বাসায় পৌঁছে দে।এতো রাতে কাউকে একা ছাড়িস না।”
ফুয়াদ বললো
-” শুভ তুই ওদের দিয়ে আস।আমি আছি।”
জারা নিজের গাড়িতে করেই আরজু আর সাবিহাকে নিয়ে ফিরে গেলো।আরজুকে তার খালামনির বাসায় নামিয়ে দিবে।সারা রাস্তা সাবিহা ফুপিয়ে কাঁদলো।আজ বৈধ অধিকার থাকলে রামিমের কাছ থেকে কেউ ওকে সরাতে পারতো না।ঠায় বসে থাকতো।আরজু সাবিহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।আপন জনের এই অনাকাঙ্ক্ষিত যাওয়া কতটা যন্ত্রণাদায়ক সেটা আরজু জানে।বেশ ভালো করেই জানে।কিন্তু তার তো খালামণি, খালুজান ছিলো।অথচ রামিমেকে সামলানোর জন্য আপন কেউ নেই।এটা ভেবেই আরজুর চোখ ভিজে উঠলো।
রিমির বাসা অনেকটা দূরে তাই শুভ নিজেই তাকে নিয়ে বের হলো।রিমির বাসার সামনে থামলে রিমি নেমে পড়লো।শুভ দেখলো চশমার আড়ালে লাল হওয়া ফোলা দুটি চোখ এখনো ভিজে আছে।শুভ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।রিমি দাত চেপে কান্না আটকে বললো
-“উপর ওয়ালা এতো নিষ্ঠুরতা কেনো দেখাচ্ছে রামিমের সাথে? বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন কেন কেড়ে নিল সৃষ্টিকর্তা?”
শুভ সামনের অন্ধকার রাস্তার পানে দৃষ্টি ফেলে বললো
-” সৃষ্টিকর্তা প্রায়শী আমাদের পরীক্ষা নেয়।ধৈর্যের পরীক্ষা। আমাদের কাছের মানুষদের মুহূর্তেই দূরে সরিয়ে নেয়। চাইলেও তাদের নিজের কাছে বেঁধে রাখা যায় না।”
রিমি শান্ত ভেজা চোখে তাকিয়ে বললো
-” আরজু তো জানতেই পারলনা কতটা শুদ্ধ ভালোবাসা নিয়ে একজন পুরুষ তার অপেক্ষায় ছিলো।”
শুভ চমকে তাকালো রিমির পানে।কয়েকমুহূর্ত চুপ থেকে বললো
-“আরজু কিন্তু কোনো এক পুরুষের পরিশুদ্ধ ভালোবাসার আবেসেই ঘিরে আছে।নাহিদ ভাই আমাদের আরজুকে চোখে হারায়।দেখিস না আরজুর ঠোঁটের তৃপ্তির হাসি!! সেই হাসিতেই কেমন সুখ সুখ অনুভূতি আছে। আমি চাইনা আরজু আর আমার বন্ধুত্বে অসস্তি ভাবটা আসুক।আমি চাইনা আরজু কখনোই জানুক আমার সুপ্ত অনুভূতি।দিন শেষে মেয়েটা ভালো থাকুক।”
_____________
আরজু বিছানায় চোখ বুজে বসে আছে।ভীষণ মাথা ধরেছে।একটু কাঁদলেই তার মাথা ব্যাথা শুরু হয়।সাবা খানম আরজুর মাথায় তেল মেখে দিচ্ছে।মেয়েটার উস্কোখুস্কো চুলের অবস্থা দেখে আর একটু আরাম দিতে তিনি ম্যাসাজ করে দিচ্ছেন।আঞ্জুমান আরার হঠাৎ এই ভাবে চলে যাওয়াটা আরজুর মনে পুরনো হারানোর কষ্ট মনে করিয়ে দিচ্ছে।সাবা খানম জানে মেয়েটা আবেগপ্রবণ। রামিমের কথা ভেবে সাবা খানমের প্রচন্ড খারাপ লাগছে।
নাহিদ গত দুইদিন যাবত শহরের বাইরে আছে।ব্যাস্ততার জন্য আরজুকে তেমন একটা কল দিতে পারছে না।আজ একটু সময় করেই আরজুকে কল করলো।আরজুর মলিন গলার স্বর নাহিদকে পীড়া দিচ্ছে।আরজু ফুপিয়ে কাঁদলো।আর বললো
-” নেতা সাহেব আমার ভীষণ খারাপ লাগছে।আপনার বুকে মাথা রেখে একটু ঘুমাতে চাই।কবে আসবেন?”
নাহিদের গলা শুকিয়ে আসলো।এই মেয়েটার সামান্য অশ্রু তার হৃদয়কে দ্বিখণ্ডিত করে দেয়।নাহিদ শান্ত সুরে বললো
-” এই ভাবে কাদেনা বউ।তোমার এখন একজন প্রকৃত বন্ধু মতো রামিমের পাশে থাকা প্রয়োজন।ছেলেটাকে মানুষিক সাপোর্ট দেওয়া প্রয়োজন।”
-” আর আমার আপনাকে প্রয়োজন।অপেক্ষার প্রহর যে শেষ হচ্ছে না।”
নাহিদ মৃদু হাসলো।আরজুকে এই মুহূর্তেই বুকের মাঝে ঝাপটে ধরতে ইচ্ছে হচ্ছে।মায়া পরীর মায়ায় বাজে ভাবে ফেঁসে গেছে।
_______________________
আজ দুদিন যাবত রামিম বাসার বাইরে বের হয়নি।কেমন শান্ত হয়ে আছে।সবাইকে দেখাচ্ছে সে ভীষণ শক্ত।কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে ভীষণ ভাবে ভেঙে পড়েছে।এই বাড়ির আনাচে কানাচে মায়ের ছোঁয়া লেগে আছে। কতো শতস্মৃতির মেলা চারদিকে।এতদিন ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে মায়ের আদুরে মুখশ্রী তার সব ক্লান্তি মুছে দিতো।কিন্তু এখন দিন শেষে এই শূন্য ঘরে কি করে থাকবে সে?মায়ের শূন্যতা যে কোনো কিছু দিয়েই পূরণ করা সম্ভব না।আর কেউ তার জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষা করবে না।দেরিতে বাসায় ফিরলে দুশ্চিন্তা করবে না।কেউ তার ক্লান্ত মুখে হাত বুলিয়ে দিবে না।এতো পরীক্ষা কেনো নিচ্ছে সৃষ্টিকর্তা?আর কি কেরে নিবে তার কাছথেকে। সেতো আজ একেবারেই নিঃস্ব।
শুভ আর ফুয়াদ এই দুইদিন রামিমের সাথেই ছিলো।ছেলেটাকে এই পরিস্থিতিতে একা ছাড়া ঠিক হবেনা।বাকি সবাই প্রতিদিন রামিমকে দেখে গেছে।সাবিহা নিজে রান্না করে এনে রামিমকে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছে।সবাই নিজেদের কাজ রেখে এই ভাবে তার পেছনে পড়ে থাকুক সেটা রামিম চায়না।তাই সবাইকেই এক প্রকার জোর করে যার যার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে।সবাই চলে যেতেই রামিম মায়ের বিছানার ওপর গুটি সুটি মেরে শুয়ে পড়লো। রামিমের মনে হচ্ছে তার মা পাশেই আছে।তার মাথায় পরম আদরে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে।রামিম দুচোখ বুজে সেই স্পর্শ অনুভব করছে। চোখের কোণ থেকে কয়েক বিন্দু অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।ক্লান্ত চোখ দুটি একসময় ঢলে পড়লো গভীর নিদ্রায়।
_______________
নাহিদ শহরে ফিরে সোজা চলে আসলো সাবা খানমের বাড়িতে।অবনি দরজা খুলেই মিষ্টি হেসে বললো
-” মাই সুপার হিরো জিজু।আপনার তো দেখাই পাওয়া যায়না।একটা মাত্র শালী আপনার।কই তার সাথে একটু টাইম স্পেন্ড করবেন,তার জন্য একটা গোমড়ামুখো ছেলে ধরে আনবেন। তা না, জনসেবায় হারিয়ে গেছেন।আচ্ছা আপনার যেই জনসাধারণের মধ্যে কি আমি পারিনা?আমার কি একটু সেবার প্রয়োজন নেই?”
নাহিদ মিষ্টি হাসলো।পাঞ্জাবীর হাতা গুটাতে গুটাতে বললো
-” মাই ডিয়ার শালী।আপনি সাধারণ কেনো হতে যাবেন।আপনি তো অসাধারণ।আপনার সেবায় আমি টুয়েন্টি ফোর আওয়ার নিয়োজিত।আর রইলো গোমড়ামুখো ছেলের কথা।সেটা আপনি একটু বড়ো হলেই ধরে আনবো।”
বলেই নাহিদ ভেতরে প্রবেশ করলো।ভেতরে যেতে যেতে অবনির কানের কাছে ফিসফিস করে বললো
-“বাই দা ওয়ে, তোমার বুকে যেই নিশান ছেপে গেছে সেটা যদি আরো কয়েক বছর এই ভাবেই বহাল থাকে, তবে তোমার নামের পাশে সেই নিশান ছাপতে এই জিজু যথা সাধ্য চেষ্টা করবো।বুজলে শ্যালিকা।”
নাহিদ কথাটা বলেই চমৎকার ভাবে চোখে ব্লিঙ্ক করে চলে গেলো।অবনি সেখানেই হতবাক হয়ে দাড়িয়ে রইলো।তার জিজু যে গভীর জলের মাছ সেটা বুঝতে সময় লাগলো না।নিশান সম্পর্কে সুরভী ছাড়া সে কাউকেই জানায়নি।তবে তার এই সুদর্শন জিজু সবটা জানলো কি করে?স্পাই লাগিয়েছে নাকি?
নাহিদকে হঠাৎ নিজের রুমের দরজার সামনে দেখেই আরজুর চমকে গেলো। বুকে প্রশান্তি খেলে গেলো।মানুষটাকে একদিন না দেখলেও তার অস্থিরতা বেড়ে যায়।আরজু এক দৌড়ে এসে নাহিদের বুকে মুখ গুঁজে দিলো। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরই মাথা তুলে অস্থির হয়ে নাহিদের পাঞ্জাবীর বোতাম খুলতে লাগলো।নাহিদ খানিকটা লজ্জা পেয়ে গেলো।এই পাগলীটা রুমের বাইরে দাড়িয়েই পাগলামি শুরু করেছে। শ্বশুর বাড়ির কেউ দেখে নিলে চরম লজ্জায় পড়তে হবে।ততক্ষণে আরজু নাহিদের বুকের কাছের বোতাম খুলে নিয়েছে।নাহিদের উন্মুক্ত লোমশ বুকে নেসাত্ব দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সেখানে মুখ গুঁজে দিলো। হে এবার আরজুর ভালো লাগছে।ভীষণ ভালো লাগছে।
নাহিদ আড়চোখে একবার আশেপাশে তাকালো।না কেউ নেই।খালামণির সামনে পড়লে অসস্তিতে পড়ে যাবে।নাহিদ সেই অবস্থায় আরজুর কোমর জড়িয়ে শূন্যে তুলে রুমে ঢুকে পড়ল।দরজা বন্ধ করেই আরজুকে কোলে তুলেই বিছানায় শুয়ে পড়লো।আরজু তখনও নাহিদের বুকে মুখ লুকিয়ে ফুপিয়ে যাচ্ছে।নাহিদ আরজুর চিবুক ধরে মুখ তুলে চোখের অশ্রু মুছে দিলো।কপালে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিলো।তার পর সারা মুখে চুমু খেতে লাগলো।স্বামীর আদর,ভালবাসা পেয়েই মেয়েটা শান্ত হলো।নাহিদ আরজুকে বুকে নিয়েই তার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো
-” জানো আরজু ছোটবেলায় মা আমাকে এই ভাবে বুকে নিয়ে ঘুমাতো।আমি মায়ের শরীরের সুবাস না পেলে ঘুমাতেই পারতাম না।বাবা মা আর পরিবার নিয়ে আমি ভীষণ ভালো ছিলাম।জীবনে কোনো অপূর্ণতা ছিলো না।দাদাজান আমাকে কাধে চরে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াতো।সে কি সুখের মুহূর্ত ছিলো!!সময় যেতে লাগলো আর আমি বুঝতে পারলাম মা কেমন অসুস্থ হয়ে পড়ছে।মায়ের লাবণ্যময়ী রূপ কেমন ফ্যাকাসে হয়ে আসছে।মায়ের কঠিন অসুখ সবাই আমার কাছ থেকে লুকালেও আমি বুঝতে পারছিলাম মা হয়তো আমাদের সাথে আর বেশি দিন নেই।মা গভীর রাতে আমাকে বুকে নিয়ে কাঁদতো।আমার সারা মুখে চুমু খেতো।আমার ছোট মস্তিষ্ক ধরতে পেরেছিলো এই আদর হয়তো আর পাবো না।মা সবার সামনে নিজেকে সামলে নিয়ে চলতো।সবাইকে স্ট্রং থাকতে বলতো।কিন্তু আমি দেখেছি আমার মায়ের চোখে ছিলো বেঁচে থাকার আকাঙ্খা।
যেদিন মা আমাকে ছেড়ে চলে গেলো আমি না কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না।আমার জীবনে সব ছিলো।কিন্তু সবচাইতে বড়ো সম্পদ ছিলো না।আমি তবুও নিজেকে সংযত করে নিয়েছিলাম।কেমন শান্ত আর গম্ভীর হয়ে গেছিলাম।কিন্তু যেদিন বাবা সেই মহিলাকে বিয়ে করে বাসায় নিয়ে আসলো, বিশ্বাস করো আমার দুনিয়া সেখানেই থেমে গেছিলো।বাবা এমন করবে আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।মায়ের মৃত্যুর কিছুদিনের মাথায় বাবা বিয়ে করে নিলেন।আমার মায়ের জায়গায় আমি কাউকেই মানতে পারিনি।আর যখন বুঝতে পারলাম আমার মায়ের শেষ সময়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নার আসল কারণ বাবা আর এই মহিলা ছিলো আমি একদম সহ্য করতে পারিনি।আমার মায়ের অশ্রু মাখা লালচে মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতো।বাবার জন্য আমার মনে তীব্র ঘৃনা জন্মাতে শুরু করলো।তিনি কতো সহজেই আমার মাকে ভুলে অন্য নারীকে বিয়ে করে ফেললো।আমার মায়ের জীবদ্দশায় তিনি অন্য নারীর সান্নিধ্যে কি করে যেতে পাড়লো? এতটাই ঠুনকো ছিলো তার ভালোবাসা?আমার অসুস্থ মাকে ফেলে তিনি অন্য নারীতে মেতে ছিলেন।সন্তান হয়ে কি করে মেনে নিতাম?সেই মহিলার সন্তানকেও আমি মানতে পারিনি।কারণ জাহিদ তাদের পাপের ফল।সেই পাপ যা আমার মাকে স্বস্তিতে মরতে দেয়নি।জীবনের চরম কঠিন মুহূর্তে মায়ের হৃদয় ভেঙেছে।আমি কি করে সেই ছেলেকে ভাইয়ের মত ভালবাসতাম? তবে জেরিনের প্রতি আমার কোনো ক্ষোভ ছিল না।তাকে আমি বড়ো ভাইয়ের স্নেহ, ভালোবাসা দিয়েছি।কারণ সে আমার মায়ের কষ্টের কারণ ছিলো না।মেয়েটার মায়াবী মুখটা দেখে আমার প্রশান্তি কাজ করে।
দাদাজানের মৃত্যুর পর আর আমি সেই বাসায় থাকিনি।সানজিদা মাহমুদ কখনই আমাকে স্নেহের চোখে দেখে নি।আর না আমি তাকে মা ভাবতে পেরেছিল।বাবাকে আমি কখনোই ক্ষমা করতে পারিনি।শূন্যতা আর একাকিত্ব আমার জীবনকে অন্ধকার করে রেখেছিল।এতো বছরে আমার জীবনে সুখকর যেটা ছিলো সেটা ছিলে তুমি।এক বসন্তে আমার জীবনকে রাঙিয়ে দিতে তোমার আগমন ঘটে ছিলো।সৃষ্টিকর্তা আমাকে যেমন আধারে ঠেলে দিয়েছিল ঠিক তেমন করেই আমার একমাত্র সুখের রানীকে আমার জীবনে রুদ্রজ্জ করে পাঠিয়ে দিলো।”
আরজু মুগ্ধ হয়ে নাহিদকে শুনছিল। মানুষটা কতো গুছিয়ে কথা বলে।তবে নেতা সাহেব বাবাকে নিয়ে মনে অনেক ভুল ধারণা পুষে রেখেছেন।এটা তার ভাঙতেই হবে।
সাবা খানম যতই নাহিদকে অপছন্দ করুক জামাই আদরে কোনো ত্রুটি রাখেননি।নানান পদের খাবার দিয়ে টেবিল ভরে ফেলেছেন।আরজুর মুখে যেই সুখ সুখ আভা ভেসে বেড়ায় এতে সাবা খানম বেশ সন্তুষ্ট।মেয়ের সুখের জন্য তিনি বিষকেও হজম করে নিতে পারবেন।
তারা বেশ আয়েস করে রান্নায় সাহায্য করছে।নাহিদকে তার বেশ পছন্দ।আগে বহুবার পোস্টার আর টিভির ইন্টারভিউ প্রোগ্রামে নাহিদকে দেখেছে।কি যে সুন্দর আর মায়াবী মুখ।সামনে থেকে দেখতে আরো সুদর্শন।যাকে বলে সুপুরুষ।তারার প্রিয় মানুষ আরজুর পাশে নাহিদকে দেখেই মনটা তৃপ্তি পায়।খাপেখাপ জোড়া এদের।দেখেই শান্তি লাগে।
নাহিদ টেবিলে খেতে বসে ভীষণ লজ্জা আর অসস্তিতে পড়ে গেলো।এতো খাবার কে খাবে?অসহায় মুখে আরজুর দিকে তাকালো।আরজু মিটি মিটি হাসছে নাহিদের অবস্থা দেখে।অবনি মৃদু হেসে বললো
-” জিজু ঝটপট লেগে পরো।সব খবর তোমার জন্য আম্মু স্পেশালি বানিয়েছে।সব শেষ করতে হবে কিন্তু?”
নাহিদের ফ্যাকাসে মুখ দেখে জুবায়ের আহমেদ হেসে নাহিদের বলিষ্ঠ কাঁধে হাত রেখে বললেন
-” ডোন্ট ওয়ারি ইয়াং ম্যান। যতো টুকু ভালো লাগে স্বাচ্ছন্দে খেতে পারো।কোনো প্রেসার নেই।”
সাবা খানম গম্ভীর মুখেই নাহিদের প্লেটে খাবার তুলে দিলো।নাহিদ মৃদু হেসে অনুরোধ করে বললো
-” ম্যাম আপনিও বসুন।”
অবনি ফিক করে হেসে বললো
-” ম্যাম? সিরিয়াসলি? জিজু আপনার শাশুড়ি হয়।অন্তত খালামণি বলতে পারেন।”
জুবায়ের আহমেদ হেসে বললো
-” অবনি ঠিক বলেছে। স্যার ম্যাম এসব চলবে না।খালামণি আর খালুজান বলতে পারো।”
নাহিদ আড়চোখে সাবা খানমকে দেখলো।তিনি কি চায় সেটাই নাহিদ জানতে চায়।সাবা খানম গলা খাকানি দিয়ে নিজের গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন
-” যেহেতু তুমি আরজুর হাসবেন্ড তাই আরজু যা ডাকবে তাই ডাকতে পারো।”
নাহিদ ভীষণ খুশি হলো।এই মানুষটা উপরে যতটাই কঠিন ভাব দেখাক না কেনো আরজু বিষয় আসলে তিনি মোমের মতো গলে যান।আরজু খুশিতে আত্মহারা হয়ে খালামনির গালে চুমু খেলো।সাবা খানম মুচকি হাসলেন।খাওয়া দাওয়া শেষে বিকেলের দিকে আরজু নাহিদকে নিয়ে রিক্সায় ঘুরতে বেরিয়ে পড়লো। বউয়ের এই ছোট্ট আবদার নাহিদ মানা করতে পারলো না।।নাহিদ প্রথমে নিষেধ করলেও আরজুর মিষ্টি আবেদন নাখচ করতে পারলো না।মুখে একটা মাস্ক পড়ে নেমে পড়লো বউয়ের আবদার পূরণ করতে।নাহিদ ভয়ে আছে।এই এলাকার সকলেই তাকে চিনে।যদি আরজুর সাথে তাকে দেখে ফেলে তবে আরজুর জন্য সমস্যা।কিন্তু এই পাগলীটা বুজলে তো?তাছাড়া সিকিউরিটি ছাড়া এইভাবে বের হওয়াটা ঠিক হবে না।তাই মেসেজে তাদের পেছনে গার্ডদের আসতে বললো।আরজুকে এই বিষয়ে কিছুই জানালো না।এতে মেয়েটার উৎফুল্লতা,স্বাচ্ছন্দ্য বোধে বাধা পড়তে পারে।নাহিদ মুখে মাস্ক পড়ে চোখে সানগ্লাস পরে নিলো।আরজু প্রথমে গেলো ফুচকার দোকানে।তারপর আরো কয়েক জায়গায় ঘুরল।
সন্ধার আগ মুহূর্তেই আরজু রিক্সা নিয়ে একটা বাড়ির সামনে থামলো।নাহিদ এক পলক বাড়িটা দেখে নিল।সাততলা বাড়িটা সে খুব ভালো করে চেনে।নাহিদের বুকে তীব্র অসস্তি শুরু হলো।এটা যে আরজুর ইমোশনের জায়গা।আরজু নাহিদের হাত ধরে চতুর্থ তলায় আসলো।তালাবদ্ধ দরজায় দাড়িয়ে আরজু জোরে নিঃশ্বাস ফেললো।দরজার সামনে কাঠের বোর্ডে খোদাই করে লেখা একটি নাম।”ড্রিম হোম”।আরজু ব্যাগ থেকে চাবি বের করে দরজা খুলে অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরটিতে ঢুকে পড়ল। নাহিদ প্রথমে ভেতরে যেতে অসস্তি বোধ করছিলো।কিন্তু আরজুর নাহিদের হাত ধরে টেনে ভেতরে প্রবেশ করলো।পাশের দেয়ালের সুইচ বোর্ডে চাপ দিতেই অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরটি আলোয় ঝলমল করে উঠলো।নাহিদ আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন একটা ফ্ল্যাট।না ফ্ল্যাট বললে ভুল হবে। এটি ঘড়,স্বপ্নের ঘর।দেখেই বুজা যায় নিয়মিত ঘরটি পরিষ্কার করা হয়।নাহিদের চোখ পড়লো এই ঘরের সবচাইতে সুন্দর দৃশ্যে।সামনের দেয়ালে টানলো একটা হাস্যোজ্জ্বল ছবি।যেখানে একজোড়া দম্পতি বসে আছে।তাদের পেছনেই এক অতি রূপবতী,আদুরে কিশোরী তাদের কাধ ধরে দাড়িয়ে আছে।প্রত্যেকের মুখেই লেগে আছে তৃপ্তির হাসি।এক সুখী পরিবারের ছবি দেখে নাহিদ শুকনো ঢোক গিললো।চোখ ঘুরিয়ে দেখলো আরজু অশ্রুসিক্ত চোখে সেই ছবিটাই দেখছে।আরজু নাক টেনে বললো
-” এটা আমার সুখের নীড় নেতা সাহেব।এই নীরেই আমার একটা ছোট্ট সুখী পরিবার ছিলো।যেখানে আমি ছিলাম মধ্যমনি।আমার শৈশব, কৈশোর সবটাই কেটেছে এই ঘরটাতে।একটা সময় এই ঘরের আনাচে কানাচে আমার কলরবে মুখরিত হয়ে উঠেতো।মাম্মা,পাপা,আমি।আমাদের একটা ছোট্ট সুখী পরিবার ছিলো।কিন্তু আজ এই ঘরের দেয়ালে দেয়ালে নিস্তব্দতা।পাপা মাম্মাকে বিয়ে করে এই ঘটাতেই তুলে ছিলেন।কত শত খুনসুটি, দুঃখ, স্বপ্ন, ভালোবাসার সাক্ষী এই ঘরটা।কি ছিলো না এই ঘরে?এই ঘরটায় যেমন আমি হেসে খেলে বেড়িয়েছি ঠিক এই ঘরটায় মাম্মা, পাপার নিথর দেহকে পড়ে থাকতে দেখেছি।আমার সুখের নীড় এক নিমিষেই ধ্বংস হয়ে গেছিলো।সবার ভালোবাসায় ঘেরা কিশোরী চোখের পলকেই এতিম হয়ে পড়েছিল।সে কি বিবৎস পরিস্থিতি ছিলো বলে বুঝাতে পারবনা।”
আরজু নিজের অশ্রু মুছে নাহিদের দিকে তাকালো।নাহিদ থমথমে দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।তার মায়াবী চোখ জোড়া অসম্ভব লালচে হয়ে আছে।নিশ্বাসের গত বৃদ্ধি পাচ্ছে।আরজু মৃদু হাসলো।মানুষটা তার অশ্রু সহ্য করতে পারেনা।এতো গুরুগম্ভীর,দাম্ভিক মানুষটা তার সামনে একদম দুর্বল হয়ে পড়ে। এর চাইতে সুখের কি হতে পারে?আরজু সুখী।ভীষণ সুখী।আরজু নাহিদের কাছে এসে বাহুতে একহাত পেঁচিয়ে কাধে মাথা রেখে বললো
-“লাইফ ইজ ভেরি আনসারটেন।কখন কোন মুহূর্তে জীবন আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে কেউ বলতে পারেনা।আপন মানুষ গুলোকে হারানোর পরই আমরা তাদের মূল্য বুঝতে পারি।বাবা মায়ের চাইতে আপন আর কেউ হয়না নেতা সাহেব।তারা কোনোদিন সন্তানের অমঙ্গল চায়না।আমার মনে হয় ওই মানুষটাই সবচাইতে বেশি একা, যে নিজেকে প্রকাশ করার মতো কাউকে খুঁজে পায়না।আপনি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন সেসব মানুষ থেকে যারা আপনাকে অসম্ভব ভালোবাসে।আপনি বাবাকে কখনোই বুঝতে চেষ্টা করেননি।তিনি মাকে অসম্ভম ভালোবাসেন।অসুস্থ স্ত্রীকে রেখে তিনি পরো নারীতে আসক্ত হননি।তিনি ছিলেন পরিস্থিতির শিকার।সেটা আপনিও জানেন।কিন্তু আপনার জেদ,ইগো,মায়ের প্রতি অগাধ ভালোবাসা এই সত্যটা মেনে নেয়নি।সানজিদা মাহমুদকে আপনি খুব ভালো করে চেনেন।তিনি নিজের স্বার্থের জন্য কতটা নিচে নামতে পারে সেটাও আপনার জানা।বাবা খুব বাজে ফেঁসে গেছিলো।কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গেছেন তিনি।তিনি আপনাকে অসম্ভব ভালোবাসে নেতা সাহেব।আপনার রাগ,জেদ, ঘৃণা মানুষটাকে ভেতরে ভেতরে ঝাঁজরা করে দিচ্ছে।সন্তানের ঘৃনা একজন বাবার জন্য অভিশাপের মতো।আজ যেই বাবাকে অবহেলা করছেন হয়তো একদিন চোখের দেখাও দেখতে পারবেন না।তখন ভীষণ আফসোস হবে।দাত থাকতে দাঁতের মর্যাদা দিতে হয়।আমি আর রামিম তো এতিম হয়ে পড়েছি।আমরা জানি মাথার উপর বাবা মায়ের ছায়া কতটা গুরুত্তপূর্ণ। কাছে সবাই আছে।সময় থাকতে এই ছায়ার গুরুত্ব দিন।”
আরজু থামলো।নাহিদের দিকে তাকিয়ে দেখলো মানুষটার চোখের কোণের অশ্রু টইটুম্বুর করছে।হয়তো যে কোনো মুহূর্তেই গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়বে।আরজু নাহিদের চিবুকে আলতো স্পর্শ করে চোখে চোখ রাখলো।মৃদু হেসে বললো
-” আমি চাইনা আপনি এই একাকীত্বের জীবন কাটান।আমি সর্বদা আছি আপনার সাথে।একবার নিজের আপনজনদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিন, দেখবেন তারা আপনাকে নিমিষেই বুকে জড়িয়ে নিবে।রক্তের সম্পর্ক গুলোতে অলৌকিক শক্তি থাকে।এই সম্পর্ক চাইলেও ছিন্ন করা যায়না।জাহিদকে একবার ভালোবেসে ভরসার হাত তার কাঁধে রেখে দেখুন,কতটা শান্তি পাবেন।ছেলেটা আপনার একটু স্নেহ,ভালোবাসা পাবার জন্য মুখিয়ে থাকে।আদো এই ছেলেটার কোনো দোষ ছিলো?সে তো এতো বিষাক্ত সত্যিটা জানেনা পর্যন্ত।যদি জানতে পারে তাহলে কতটা ভেঙে পড়বে ভেবে দেখেছেন।যেই মাকে এতো ভালবাসে তার সেই ঘৃণিত রূপ মেনে নিতে পারবে?আমি চাই আমার নেতা সাহেব সবার ভালোবাসায় সিক্ত হোক।সম্পর্ককে মূল্যায়ন করুক।এতে অদ্ভুত মানুষিক প্রশান্তি মেলে।যে অন্যকে ক্ষমা করতে জানে সে নিজে কখনোই ঠকে যায়না।ক্ষমার চাইতে বড়ো মনুষ্যত্ব বোধ আর কিছুই হতে পারেনা।”
নাহিদ নির্বাক হয়ে আরজুর দিকে তাকিয়ে রইলো।তার বুকে যে কতো শত প্রলয় চলছে তা আরজুকে কি করে বুঝাবে?ক্ষমা কি চাইলেই পাওয়া যায়? ক্ষমা যদি এতো সহজ হতো তবে তার চাইতে খুশি আর কেউ হতো না।কিন্তু নাহিদ জানে ক্ষমা করা অনেক কঠিন।
#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_67
সকালের মিষ্টি রোদ এসে রামিমের গভীর নিদ্রা়য় ব্যাঘাত ঘটালো।প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে চোখ কচলে আধ খোলা চোখে ফোনের স্ক্রিনে সময় দেখে নিল। সারে আটটা বাজে।রামিম তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো।এতো বেলা হয়ে গেলো সে এখনো ঘুমাচ্ছে? রামিম তপ্ত শ্বাস ফেললো। আগের মতো মাথায় হাত বুলিয়ে ডেকে দেওয়ার মতো কেউ নেই তার জীবনে।শূন্য ঘরে একবার চোখ বুলালো রামিম।আগে এই ঘরে কাজ শেষে ফিরে আসার কতো তাড়া ছিলো তার।কিন্তু আজকাল এই ঘরে দম বন্ধ হয়ে আসে।বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করেনা।কেউ তো আর তার জন্য অপেক্ষারত নেই।রামিম ফ্রেস হয়ে বাইরে চলে গেলো নাস্তা করতে।ঘরে নাস্তা বানিয়ে খাওয়ার মতো এনার্জি নেই তার।বাইরের হোটেলে নাস্তা শেষে দিক শূন্য হয়ে কিছুক্ষণ রাস্তায় হাঁটলো।জীবনের সব আনন্দ যেনো ছুমন্তর হয়ে হারিয়ে গেছে।মায়ের কবরে এসে কিছু সময় বসে রইলো।ছেলেদের নাকি কাদতে নেই।কিন্তু রামিমের যে ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছে করছে। হৃদয়ে দাবানো যন্ত্রণায় কেমন বুকে ব্যাথা শুরু করেছে। রামিমের ইচ্ছে করছে মায়ের পাশে চুপটি করে শুয়ে পড়তে।তিনি নিশ্চই আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিবেন।
প্রায় দুপুরের দিকে বাসায় ফিরে আসলো রামিম।কিন্তু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চমকে গেলো।সে তো দরজা বাইরে থেকে লক করে গেছিলো। কিন্তু এখন ভেতর থেকে লক করা।খালি বাসায় কোনো চোর ঢুকে পড়লো নাকি? চিন্তিত হয়ে ডোরবেল বাজলো।একমিনিটের মধ্যেই দরজা খুলে গেলো।দরজার সামনে সাবিহা দাড়িয়ে। রামিমকে দেখে বিরক্তি প্রকাশ করে বললো
-” এতক্ষনে তোর আসার সময় হলো?সারাদিন বাইরে কি? দিন দিন একদম বখে যাচ্ছিস।কেউ শাসন করবে না ভেবেছিস?”
রামিম স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলো।সাবিহার শাসন দেখে মনে হলো তার অনেক দিনের পুরনো বিয়ে করা বউ তাকে শাশাচ্ছে।ফর্সা কোমল মুখে শিশির বিন্দুর ন্যায় ঘাম জমা হয়ে আছে।ভীষণ আদুরে লাগছে।সাবিহা দরজা ছেড়ে ভেতরে চলে গেল।রামিম ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ করে দেখলো সাবিহা রান্নাঘরে কাজে ব্যাস্ত।এই অদ্ভুদ সুন্দর দৃশ্যপট রামিমের হৃদয়ে ছেপে গেলো।এতো দিনের তীব্র যন্ত্রণায় জর্জরিত বুকে যেনো একপশলা সুখের বৃষ্টি ঝড়ে পড়লো।ঠিক এমনি একটা দৃশ্য সে প্রায়শ স্বপ্নে দেখে।শুধু পার্থক্য সেখানে তার মা উপস্থিত নেই।রামিম সেদিকে এগিয়ে গেলো আর প্রশ্ন করলো
-” আমি তো দরজা লক করে গেছিলাম।ভেতরে ঢুকলি কি করে?”
সাবিহা চুলায় বসানো পাতিলে নাড়াচাড়া করতে করতে বললো
-” দরজা ভেঙে।”
-” ফাজলামি না করে বলতো?”
সাবিহা মৃদু হেসে বললো
-” এই বাসার চাবি আমার কাছে অনেক আগে থেকেই ছিল।আন্টি দিয়েছে।”
রামিম হতবম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকল।এই দরজার জন্য মা তিনটি স্পেয়ার চাবি বানিয়েছিল।দুটো তার আর মায়ের কাছে ছিলো।অন্য চাবির কথা রামিম জিজ্ঞেস করলে মা হেসে বলেছিলো
-” অন্যটা আমার ছেলের বউয়ের জন্য বানিয়ে রাখলাম।তার ও তো প্রয়োজন পড়বে।তাইনা?”
-” আমি সেই কবে না কবে বিয়ে করবো তার জন্য তুমি এখনি চাবি বানিয়ে রেখেছো?আশ্চর্য!!”
-” তো রাখবো না?আমার ছেলের বউকে তো আমি আমার এই ছোট্ট রাজ্যের রানী করে রাখবো।”
অতীতের কথা মনে পড়তেই রামিমের বুক ভার হয়ে আসলো।মা কেনো সাবিহাকে চাবি দিয়েছে রামিম ভালো করেই জানে।সাবিহাকে যে মা মনে মনে তার ছেলের বউ হিসেবেই ভেবে রেখেছিল।বাস্তবতা জানার পরও তিনি মনে প্রাণে দোয়া করে গেছেন ছেলের প্রণয়ের সফলতার জন্য।রামিম সাবিহার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো
-” রান্না ঘরে কি করছিস?”
সাবিহা ব্যঙ্গ করে বললো
-” নাচছি,দেখছিস না?”
-” তোকে এসব কে করতে বলেছে?”
-” স্বপ্নে একটা জ্বীন এসে বললো এই বেকুবকে একটু ভালো মন্দ রেধে খাওয়াতে।”
রামিম রেগে বললো
-” এক্ষনি বেরিয়ে আয়।এসব আমার মোটেও পছন্দ না।আমি বলেছি তোকে আমার জন্য রান্না করতে?”
-” বলিস নি বলে কি রাধতে পারবো না?”
-” না পারবি না।তোকে আমি বলেছি এসব করতে? তুই কি আমার বউ?”
সাবিহা মৃদু হেসে বললো
-” বানিয়ে নে বউ তাহলেই তো সমস্যা খতম।”
রামিম শুকনো ঢোক গিললো।কথাটা একদমই বলতে চায়নি।মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেছে।রামিম অপ্রস্তুত হয়ে বললো
-” আমার কোনো ইচ্ছা নেই তোকে বউ বানানোর।বেরিয়ে আয়।তোর এসবে অভ্যস্ততা নেই।যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।”
-” কিছুই হবে না।তুই ফ্রেস হয়ে আস।আমার রান্না প্রায় শেষ।কি হলো যা!!”
রামিম আর কিছু বলতে পারলো না।ফ্রেস হয়ে আসলো।সাবিহা নিজে খাবার প্লেটে তুলে দিলো।রামিম সাবিহাকেও বসতে বললো।খাবার মুখে তুলে রামিম চমকে বললো
-“এই ভাবে মুড়িঘন্ট রান্না কি করে শিখলি? মা এই ভাবেই করতো।”
সাবিহা মৃদু হেসে বললো
-” এই রেসিপি আমি আন্টির কাছথেকে শিখেছি।তার ছেলের পছন্দের সব খাবারই আমাকে রান্না শিখিয়েছেন।”
রামিম তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো
-“এসব পাগলামি কেনো করিস তুই?”
সাবিহা সম্মোহন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো
-” আপন মানুষগুলো জন্য একটু পাগলামি করাই যায়।”
রামিম আর কিছু বললো না।সে চায়না সাবিহা নিজের মনে অনুভূতি মুখে প্রকাশ করুক।তাহলে রামিমের জন্য পরিস্থিতি বেশ কঠিন হয়ে পড়বে।যেটা মোটেও কাম্য না।
_____________
সময়টা ভালো মন্দ মিলিয়েই চলছে আরজুর।যতক্ষণ নেতা সাহেব পাশে থাকে ততক্ষণ সময়টা হয় বসন্তের শীতল সকালের মতো স্নিগ্ধ,মনোমুগ্ধকর,রোমাঞ্চিত।কিন্তু মানুষটা দূরে গেলেই যেনো আরজুর বুকে শ্রাবণের ঘন কালো মেঘ জমা হয়।কি যে মিষ্টি যন্ত্রণা বলে বোঝানো কঠিন।ভার্সিটিতে জারার সাথেই ক্যান্টিনে বসে ছিল আরজু।ঠিক তখনই জাহিদের আগমনে খানিকটা অবাক হয়েছে।সচরাচর ভার্সিটিতে জাহিদ তার সম্মুখে তেমন একটা আসে না।একদম সিনিয়রের মতোই ট্রিট করে।এই বিষয়টা আরজুর বেশ লাগে।জাহিদ দুটো বার্গার আর কোল্ড ড্রিংস এনে মিষ্টি হেসে বললো
-“আমার পক্ষ থেকে ছোট্ট একটা ট্রিট ভাবী।গ্রহণ করলে ভীষণ খুশি হবো।”
বলেই আড়চোখে জারার দিকে তাকালো।জারা নিজেও খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পরলো।আরজু হেসে বললো
-” কি ব্যাপার দেবর জি।এতো খুশি খুশি দেখাচ্ছে কেনো?”
-” আজকে আমার সকালটা ভীষণ অন্যরকম কেটেছে তাই।”
আরজু প্রশ্ন করলো
-” কি রকম?”
জাহিদ আবেগপ্রবণ হয়ে মৃদু হেসে বললো
-” আজ সকালে ভাইয়া আমাকে প্রথম কল করেছে ভাবী।আমার লেখাপড়া কেমন চলছে জানতে চেয়েছে।আমি প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারিনি।তবে আমি জানি এসবের পেছনে আপনি ছিলেন।ধন্যবাদ ভাবী।”
আরজু বেশ অবাক হলো।সত্যি এমনটা হয়েছে? মানুষটা কি সত্যি তার কথাকে এতটা গুরুত্ব দিয়ে নিজের ইগো,অভিমানকে ভাঙতে শুরু করেছে।আরজুর খুশিতে চোখ ভিজে উঠলো।এই পরিবারটি আবার জোড়া লাগলে আরজুর চাইতে বেশি খুশি আর কেউ হবে না।
___________
লামিয়ার পরীক্ষা শেষ হতেই সে আবার কাজে লেগে পড়েছে।ফুয়াদ রান্নাঘরের দরজার পাশে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আপেলে কামড় বসাচ্ছে আর লামিয়ার দিকে তীক্ষ্ণ নজর ফেলছে।ফুয়াদের এই অদ্ভুদ দৃষ্টিতে লামিয়া খানিকটা অসস্তিতে পড়ে গেলো। আড় চোখে তাকিয়ে বললো
-” আপনার কিছু লাগবে?”
-” হুম।”
-” কি লাগবে?”
ফুয়াদ ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিল
-” তোমাকে।”
লামিয়া চমকে উঠলো।বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে রইলো।ফুয়াদ ফিক করে হেসে উঠলো।বললো
-“ভয় পেয়ে গেলে নাকি? আমি তো বলেছি তোমাকে লাগবে গল্প করার জন্য।”
লামিয়া জোরপূর্বক হাসলো।ফুয়াদ আপেলে চিবুতে চিবুতে বললো
-” আমার লাইফে একটা মজার ঘটনা ঘটেছে।আগে প্রতি দুই মাস অন্তর অন্তর আমার গার্লফ্রেন্ড চেঞ্জ হতো। আসলে আমার জন্য দুই মাসের বেশি সময় সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা রীতিমতো টর্চার ছিল।প্রেম অনেক করলেও কাউকেই ভালোবাসতে পারিনি।ওইসব নেকা মেয়েদের আমি আবার বেশিক্ষণ টলারেট করতে পারিনা।তারাও আমার মতো টাইম পাস করতো।সিরিয়াস রিলেশনে কখনই জড়াইনি।তবে বিগত কয়েক মাস যাবত আমার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই।কেউ প্রপোজ করলেও কোনো উৎসাহ পাইনা।অন্য কোনো মেয়েকে মনেই ধরে না।অন্য মেয়েদের দেখে কোনো অনুভূতি আসে না।এমনটা কেনো হচ্ছে বলতে পারবে?”
লামিয়া স্তব্ধ হয়ে ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে রইলো।ঠিক কি বলবে বুঝতে পারছে না।মানুষটার আজকাল বেশ অদ্ভুদ আচরণ করে।তবে ফুয়াদের কথায় বক্ষ স্থলের কোন এক কোণে সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভব করছে।সে মাথা নিচু করে শান্ত স্বরে বললো
-” আমার মনে আপনি কারো গভীর প্রেমে পড়েছেন।যেটা ভালোবাসায় রূপ নিচ্ছে।তাইতো অন্য নারীর প্রতি আগ্রহ হারিয়েছেন।”
ফুয়াদ নীচের ওষ্ঠে দাঁত চেপে মৃদু হাসলো।মেয়েটার এই সরলতা ফুয়াদকে চুম্বকের মতো টানে।মেয়েটা হয়তো নিজেও জানেনা সে ফুয়াদের জন্য কতটা স্পেশাল।
সিড়ির পাশে দাড়িয়ে ফুয়াদের বাবা ফুয়াদকে লামিয়ার সাথে এতো সহজে মিশতে দেখে ক্রোধে ফুঁসতে লাগলেন।কোথাও না কোথাও তার অহমিকার তীব্র আঘাত লাগলো।ছেলে তো তাদের সাথে কখনোই এতটা স্বাচ্ছন্দে কথা বলেনা অথচ একজন সামান্য রাধুনীর সাথে কথা বলছে।বিষয়টা তার মোটেও পছন্দ হলোনা।আজই ফুয়াদের মায়ের সাথে কথা বলে এই মেয়েটার একটা ব্যাবস্থা করতে হবে।কারণ তিনি যেই আভাস পাচ্ছে সেটা কিছুতেই মেনে নেয়া সম্ভব।ছেলের এই অধঃপতন কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না।
_______________________
আজকাল আরজু খুব সকালে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস করে নিয়েছে।সকাল সকাল নিজে বসে থেকে নেতা সাহেবকে ব্রেকফাস্ট খাইয়ে তবেই বাইরে যেতে দেয়।আজও আরজু দ্রুত ঘুম থেকে উঠার হালকা পাতলা ব্রেকফাস্ট তৈরি করে নিলো। শেফ তাকে অনেকটাই হেল্প করলো।খাবার তৈরি করে রুমে প্রবেশ করে দেখলো তার একান্ত ব্যাক্তিগত নেতা সাহেব মিররের সামনে দাড়িয়ে দ্রুততার সাথে হাতঘড়ি পড়ে নিচ্ছে।আরজু কপাল কুঁচকে বললো
-” এতো হড়বড় করে কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”
-” উফফ!! আরজু সকাল সকাল কোথায় চলে যাও? ঘুম থেকে উঠে বউয়ের মুখ না দেখলে আমার দিনটাই খারাপ যায়।”
আরজু হেসে উঠলো।এগিয়ে এসে দুহাতে নাহিদের গলা জড়িয়ে ধরে বললো
-” তাই নাকি?আপনি চাইলে আপনার দিনটা একদম ভেলকি দেওয়া ঝলমলে রোদের মতো উজ্জ্বল করে তুলতে পারি।”
নাহিদ সন্তর্পনে আরজুর উন্মুক্ত কটি দেশে নিজের শক্ত,রুক্ষ হাত গলিয়ে আরজুকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো।ফিচেল স্বরে বললো
-” আমার জীবনকে রৌদ্রোজ্জ্বল করতে তোমার উপস্থিতিই যথেষ্ট আরজু।”
-“হুম বুজলাম।এক্ষনি বের হবেন?”
-” হুম,একদম সময় নেই।আজ একটা জরুরী মিটিং আছে।”
-“খালি মুখে কোথাও যাওয়া চলবে না।আমি ব্রেকফাস্ট তৈরি করেছি।খেয়ে তবেই যাবেন।মাম্মা বলতো সকালে খালিমুখে কখনই কাজে বের হতে নেই।”
নাহিদ পাঞ্জাবীর কলার ঠিক করতে করতে বললো
-” একদম সময় নেই।অফিসে করে নিবো।”
আরজু ধমকে বললো
-” একদম না।চলুন বলছি।”
নাহিদ গোবেচারা চেহারা করে বললো
-” একজন প্রভাবশালী নেতাকে তুমি এই ভাবে হুমকি ধামকি দিচ্ছ? জাতি সইবে না তাদের নেতার অত্যাচার।”
আরজু মুখ ভেংচি কেটে নিচে নেমে আসলো।নাহিদ হেসে উঠলো।দ্রুত ডাইনিংয়ে এসে বসে পড়লো।নাহিদ নিজেও খেল আর আরজুকে ও খাইয়ে দিল।নাহিদের এই যত্ন টুকু আরজুর হৃদয়ে প্রশান্তি নিয়ে আসে।তারপর নাহিদ বেরিয়ে পড়লে আরজুও দ্রুত তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লো।একটা ক্যাফেতে গাড়ি থামাতে বললো সাইফুলকে।সাইফুলকে তার পিছু পিছু আসতে দেখে আরজু কড়া চোখে তাকিয়ে বললো
-” আমি একটা ফ্রেন্ডের সাথে মিট করতে এসেছি। এখানেও তোমার সুপারগ্লু আঠার মতো লেগে থাকতে হবে?একদম আমার পিছু পিছু আসবে না।তুমি আর তোমার স্যার এমন ভাব করো যেনো লোকে আমাকে মারার জন্য বন্ধুক নিয়ে ক্যাফেতে বসে আছে।অসহ্য।তুমি চলে যাও।আমার ভার্সিটি সামনেই ,সো আমি নিজেই চলে যেতে পারবো।”
সাইফুল কিছুক্ষণ কাচুমাচু করলো।সে জানে ম্যাম তার উপর প্রচন্ড বিরক্ত।এই সিকিউরিটি নিয়ে চলা তিনি মোটেও পছন্দ করেনা।কিন্তু সাইফুলকে তো তার ডিউটি করতেই হবে।সাইফুল সম্মতি প্রকাশ করলেও আরজু ভেতরে প্রবেশের পর সে আশেপাশেই রইলো।নাহিদের কড়া নির্দেশ আছে আরজুকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখার।কিন্তু ম্যাম ভীষণ রেগে যায় তার উপর।তাই আপাতত ভেতরে যাওয়ার চিন্তা বাত দিয়ে বাইরেই দাড়ালো।
আরজু কফিতে চুমুক দিয়ে মৃদু হেসে বললো
-” কি ব্যাপার সাদমান সাহেব? এতো জরুরী তলব। একমিনিট!!! আমার সুন্দরী ফ্রেন্ডের প্রেমে ট্রেমে পড়েছেন নাকি?তাহলে বলবো ভুলে যান।আমার দেবর অলরেডী তাকে বুক করে ফেলেছে।”
সাদমান মেকি হেসে বললো
-” নাহিদ যেমন তার ভাইও দেখি তেমন।সব সুন্দরীদের উপর এই দুই ভাইদেরই নজর পড়ে থাকে।”
আরজুর কেনো যেনো কথাটা পছন্দ হলো না।সে হেসে বললো
-” আপনি ভুল জানেন।নেতা সাহেবের আমার উপর না বরং আমার নজর নেতা সাহেবের উপর পড়েছে।তাইতো একপ্রকার হুমকি ধামকি দিয়ে সোজা বিয়ে করে নিলাম তাকে।”
আরজুর কথায় সাদমান দম ফাটা হাসিতে ফেটে পরলো।আরজু কিছুটা অবাক হয়ে সাদমান কে দেখছে।মানুষটা এমন করে হাসছে যেনো আরজু কোনো মজার কৌতুক বলেছে।আরজুকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে সাদমান নিজের হাসি থামিয়ে নিলো।কিছুক্ষণ সময় নিয়ে স্বাভাবিক হয়ে বললো
-“নাহিদকে আপনি কতটুকু চেনেন?”
আরজু হতবম্ব হয়ে গেল প্রশ্ন শুনে।কপাল কুঁচকে বললো
-” যতটুকু একজন অর্ধাঙ্গিনীর জানা প্রয়োজন।”
সাদমান আবার হাসলো।বললো
-” ওহ্ কাম অন আরজু!! আপনার কি মনে হয়,নাহিদের মতো এতো তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন,ক্ষমতধর তেজী নেতা আপনার সামান্য হুমকিতে ভয় পেয়ে যাবে?আপনি বড্ডো বোকা আরজু।নাহিদ আপনাকে তার জীবনের অর্ধেকও জানায়নি।”
আরজু বিস্মিত হয়ে বললো
-” আপনি নেতা সাহেবকে ব্যাক্তিগত ভাবে চেনেন?”
-” নাহিদকে আমার চাইতে বেশি আর কেউ চেনেনা।আরজু আপনি পলিটিক্সের মারপ্যাঁচ কিছুই জানেন না।আজ নাহিদ যেই অবস্থানে পৌঁছেছে সেটা কি এতো সহজেই।কতো শত মানুষের রক্তের দাগ লেগে আছে জানেন?”
আরজুর অবিশ্বাস্য ভাবে তাকিয়ে রইলো। সাদমানের এসব কথা তার মোটেও বোধগম্য হচ্ছে না।আরজু বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে বললো
-” আপনি তাকে কি করে চেনেন? আর আমার হাসব্যান্ড সম্পর্কে কোনো বাজে কথা আমি মোটেও সহ্য করবো না।”
-” আমি নাহিদকে সেই ভার্সিটি লাইফ থেকেই চিনি।একসময় ভালো বন্ধুত্ব ছিল আমাদের।কিন্তু সেই বন্ধুত্বের মর্যাদা সে কখনই রাখেনি।আর আপনার হাজব্যান্ড সম্পর্কে বানিয়ে কিছু বলার ইচ্ছে আমার নেই। আসলে আপনাকে আমি আগেই সব বলতে চেয়েছিলাম।কারণ আমি চাইনা আপনি নাহিদের নোংরা খেলায় ফেঁসে যান।কিন্তু বলতে পারিনি।তার আগেই আপনি নাহিদের জালে আটকে পড়েছেন।”
আরজু রাগে গজগজ করতে করতে শক্ত গলায় বললো
-” দেখুন পলিটিক্স নিয়ে আমি কিছুই বলতে চাইনা।কেউ অন্যায় করলে কিংবা নেতা সাহেবের ক্ষতি করতে চাইলে তিনি নিশ্চই বসে থাকবেন না।আর আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি।তাই আপনার এসব বাজে কথা বন্ধ করুন।”
সাদমান দূর্বুধ হাসলো।আরজুর ফর্সা কোমল মুখশ্রীর লালাভ আভায় স্পষ্ট নাহিদের ধ্বংস দেখতে পাচ্ছে।বাঁকা হেসে বললো
-” নাহিদ কতটা গভীর জলের মাছ সেটা আপনি আজও বুঝতে পারেননি আরজু।অন্য সবার কথা বাত দিলাম।আচ্ছা!!আপনার বাবা মা তো এক্সিডেন্টে মারা গেছেন তাইনা?আমি যদি বলি তাদের মৃত্যুর জন্য নাহিদ দায়ী সেটাও কি অবিশ্বাস করবেন?”
হঠাৎ শিরশিরে কাঁপন ধরলো আরজুর সর্বাঙ্গে।আরজুর বুকের ভিতর উলটপালট হচ্ছে, ভাঙচুর হচ্ছে, সর্বনাশা এক প্রলয় ঘটছে।সামনে বসা সাদমান কে এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচাইতে নিকৃষ্ট প্রাণী মনে হচ্ছে।আরজুর দুচোখে অশ্রু জমা হলো।সে অশ্রুসিক্ত চোখে কাপা গলায় বললো
-” আ…আপনি মিথ্যা বলছেন।আমার নেতা সাহেব কখনই এমন করতে পাড়ে না।কখনোই না।”
সাদমান আরজুর মলিন মুখটা দেখে যেনো আরো উৎসাহ পেলো।শান্ত স্বরে বললো
-” ছোট বেলা থেকেই নাহিদ তেজী,বেপরোয়া,একরোখা আর জেদি।জীবনে যা চেয়েছে নিমিষেই তা পেয়েছে।বড়োলোকের বিগড়ে যাওয়া নবাবজাদা সে।সেদিন বেপরোয়া ভাবেই হাইওয়ে তে গাড়ি চালাচ্ছিল নাহিদ।আর তখনই এই দুর্ঘটনা ঘটায়।তার তো কিছুই হয়না কিন্তু আপনার বাবা মা প্রাণ হারায়।নাহিদের একটু ভুলের মাসুল দিতে হয়েছে আপনার বাবা মাকে জীবন দিয়ে।আর আপনাকে হতে হয়েছে এতিম।আপনার জীবনের প্রতিটা একাকিত্ব,অশ্রু কারণ এক মাত্র নাহিদ।বিশ্বাস না হলে আপনার খালামণিকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।তিনি তো সবটাই জানেন।”
আরজু হতবম্ব হয়ে পড়ল।অস্থির চিত্তে আশেপাশে চোখ বুলালো।আরজুর মনে হচ্ছে তার সাজানো গুছানো দুনিয়াতে কেউ তীব্র মাত্রায় ভূমিকম্প ঘটাচ্ছে।আরজু অস্থির ভঙ্গিতে দুই পাশে মাথা নেড়ে বললো
-” সব মিথ্যা।আপনি সব বানিয়ে বলছেন।আমার নেতা সাহেব সম্পর্কে ভুলভাল বলে আমাদের সম্পর্কে ফাটল ধরাতে চাইছেন।কেনো করছেন এমন? কি শত্রুতা আপনার আমাদের সাথে?”
সাদমান আরজুর দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বললো
-” শান্ত হয়ে পানি খেয়ে নিন আরজু।কারণ সত্যি অনেক তেতো হয়।আর সেটা আপনাকে হজম করতেই হবে।আপনার খালামণি ওর অপরাধের যথাযথ শাস্তি দিতে চেয়েছেন কিন্তু নাহিদের পরিবার নিজের ক্ষমতার অপ ব্যাবহার করে নাহিদকে বাঁচিয়ে নিয়েছে।নাহিদ আইনের হাত থেকে রেহাই পেয়ে গেছে।আপনার বাবা মায়ের হত্যাকারী কোনো শান্তি ছাড়া অবাধে ঘুরে বেরিয়েছে।নাহিদ শুধু এখানেই থেমে থাকেনি।অবাধ্য নাহিদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আপনার উপর পড়ে গেছিলো।হসপিটালে সে আপনাকে দেখে আপনার রূপের মোহে পরে গেছে।ধনী পরিবারের উচ্চবিলাসী নাহিদের তখন আপনাকে চাই।আপনাকে পাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল।নাহিদের দাদাজান নাতির সখ পূরণের জন্য সব করতে পারেন।আপনার খালামনির কাছে প্রস্তাব অব্দি রেখেছেন।কিন্তু আপনার খালামণি সরাসরি মানা করে দিয়েছেন।একজন খুনীর হাতে নিশ্চই মেয়েকে তুলে দিতেন না।তারপর নাহিদ অনেকটা দমে গেছিলো।কেনো সেটা জানিনা।আমি ভেবেছি হয়তো এতো বছরে তার মাথা থেকে আপনার ভূত নেমে গেছে।কিন্তু আপনি তো ছিলেন নাহিদের জেদ।যেটা নাহিদ হাসিল না করা অব্দি থেমে থাকবে না।তাই কৌশলে সে আপনার মাধ্যেমেই নিজের জেদ পূরণ করেছে।আর আপনি বোকার মতো সেটা ভালবাসা ভেবে সুখের সাগরে ভাসছেন।”
আরজুর দুনিয়া যেনো সেখানেই থমকে গেলেন।কেউ যেনো তার বুকে ছুরি চালিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলছে।এমন অসহনীয় ব্যাথা কেনো হচ্ছে?আরজু জানতো তার বাবা মায়ের গাড়ি অন্য একটা গাড়ির সাথে সংঘর্ষ হয়েছে ফলে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।কিন্তু এর সাথে নাহিদ জড়িত এটা আরজু কিছুতেই বিশ্বাস করবে না।কখনোই না।সব ভুল।সব মিথ্যা।
সাদমান আড়চোখে আরজুকে দেখে নিল।আরজুর মধ্যে কি চলছে সবটাই অনুধাবন করতে পারছে।সে শান্ত স্বরে বললো
-” দেখুন আরজু আমি জানি এই কঠিন সত্যিটা মানতে কষ্ট হবে।তবে আমি চাইনা আপনি কোনো ভুলের মধ্যে থাকুন।আমার কথা আপনার বিশ্বাস না হলে নাহিদকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।আপনার স্বামী হয়তো এবার আপনাকে সত্যিই বলতে পারে।তাছাড়া আপনার পরিবারও আপনার কাছে সব লুকিয়েছে।আমি চাইনা আপনি সারা জীবন একটা মিথ্যার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে থাকুন।বাকিটা আপনি ভালো জানেন।”
সাদমান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো। চোখে সানগ্লাস পড়ে আরজুর দিকে তাকিয়ে বললো
-“যে কোনো প্রয়োজনে আপনি আমাকে স্মরণ করতে পারেন।আমি কিন্তু আপনাকে মন থেকেই বন্ধু ভেবেছি।তাই নির্দ্বিধায় আমাকে কল করতে পারেন।আসি আরজু।ভালো থাকবেন।আর অবশ্যই জীবনে সঠিক সিদ্বান্ত নিবেন।”
আরজু মূর্তির ন্যায় সেখানেই বসে রইলো।যেনো তার হিতাহিত জ্ঞান লোভ পেয়েছে।গাল বেয়ে চিবুক স্পর্শ করলো নেত্রজল।বিমূঢ় চোখে চেয়ে রইলো স্থির দৃষ্টিতে।মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।ঠিক কতটা সময় আরজু সেখানে বসে ছিল জানা নেই।
শুভ আর রিমি ভার্সিটির বৃদ্ধ বিশাল বট গাছের নিচে দাড়িয়ে কথা বলছে।আজকাল শুভর সাথে রিমির অনেকটাই ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে।রিমির অদ্ভুদ সব কথায় শত যন্ত্রণার মাঝেও শুভ মন খুলে হেসে ওঠে।রিমি ও মুগ্ধ হয়ে সেই হাসি দেখে পুলকিত হয়। হঠাৎ রিমির চোখ পড়ল গেটের দিকে।কপাল কুঁচকে বললো
-” আরজুর আবার কি হয়েছে?”
শুভর তড়িৎ গতিতে সেদিকে তাকালো।আর সাথে সাথেই বুকটা কেমন ধক করে উঠল।সবসময় পরিপাটি থাকা মেয়েটা কেমন বিশ্বস্ত অবস্থা।এলোমেলো চুল,ঘামে ভেজা মুখে লেগে আছে রাজ্যের ক্লান্তি।এলোমেলো পা ফেলে এগিয়ে আসছে আরজু।দুচোখ অসম্ভব লাল হয়ে ফুলে আছে।আরজুর যেনো কোনো হুস নেই।
আরজু নিভু নিভু চোখে সামনে তাকাচ্ছে।সব কেমন ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে।আরজু যেনো শরীরে কোনো শক্তি পাচ্ছে না।সব শক্তি যেনো কেউ চুষে নিচ্ছে।আরজুর ভীষণ দুর্বল লাগছে।আরজু যেনো সামনে আর কিছুই দেখতে পারছে না।হঠাৎ করেই সব অন্ধকার হয়ে আসলো।আরজু মুহূর্তেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
হঠাৎ আরজুকে মাটিতে পড়ে যেতে দেখে শুভ চমকে গেলো।হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে দৌড় লাগালো আরজুর দিকে।আরজুর কাছে এসে দেখলো আরজু সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে।হঠাৎ পড়ে যাওয়ায় মাথায় সামান্য আঘাত পেয়েছে।ফলে সেখান থেকে রক্ত বের হচ্ছে। হাতে ও পায়ে কয়েক জায়গায় ছিলে গেছে। রিমিও ততক্ষণে চলে আসলো।শুভ আরজুর মাথা কোলে নিয়ে অস্থির হয়ে আরজুকে কয়েকবার ডাকলো।কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না।শুভ অস্থির হয়ে রিমিকে পানি আনতে বললো।পানির ছিটা দিয়েও আরজুর জ্ঞান ফিরলো না।শুভ আর দেরি করলো না।দ্রুত আরজুকে কোলে তুলে হসপিটালের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লো।রিমিও শুভর পিছু পিছু যেতে লাগলো।হঠাৎ আরজুর কি হলো শুভ বা রিমি কেউ কিছু বুঝতে পাড়লো না।