মিষ্টি রোদের হাতছানি পর্ব-৭৩+৭৪+৭৫

0
1001

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_73

টুট টুট শব্দে নাহিদের ঘুম ভেংগে গেল।পিট পিট চোখে তাকানোর চেষ্টা করলো।কিন্তু চোখের পাতা ভীষণ ভারী মনে হচ্ছে।যেনো কেউ পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে।নাহিদ বেশ কষ্ট করেই চোখ মেলে তাকালো।উপরের ধব ধবে সাদা সিলিং। ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকিয়ে দেখলো তার বিছানার পাশেই তার বাবা মাথা হেলিয়ে ঘুমিয়ে আছে।বাবার চোখের পাতা কেমন ফুলে আছে।লোকটি কি কেঁদেছে? নাহিদ আশেপাশে তাকিয়ে বুজলো সে হসপিটালের বিছানায় শুয়ে আছে।সামনেই দেয়ালের ঘড়ির দিকে চোখ পড়ল। ভোর পাঁচটা বাজে।এতটা সময় সে সেন্সলেস ছিলো? নাহিদের হঠাৎ দাদাজানের কথা মনে পড়লো।তিনি ঠিক আছে তো? নাহিদ অস্থির হয়ে বিছানা থেকে উঠতে চাইলে নাঈম মাহমুদের ঘুম ছুটে যায়।তিনি অস্থির হয়ে বলেন

-” তুমি ঠিক আছো? শরীর খারাপ লাগছে?”

-” দাদাজান কোথায়?উনি ঠিক আছেন?”

নাঈম মাহমুদ ছেলেকে শান্ত করতে বললেন
-” আব্বা ঠিক আছেন।আইসিইউ তাকে রাখা হয়েছে।বর্তমানে সেন্সলেস অবস্থায় আছেন।তবে ডক্টর বলেছে হি ইস আউট অফ ডেঞ্জার।”

-” আমি এক্ষনি তাকে দেখতে চাই।”

-” এখন না নাহিদ।তুমি বেশ আহত হয়েছ।আগে সুস্থ হও।”

নাহিদ বাবার কথায় তেমন পাত্তা না দিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করলো।নাঈম মাহমুদ বার বার না করলেও নাহিদ শুনছিল না।নাঈম মাহমুদ ছেলের জেদ দেখে রেগে ধমক দিয়ে বললেন

-” কি শুরু করেছ? তুমি ইনজুর। ইউ নিড প্রপার রেস্ট।”

নাহিদ ভেজা চোখে রেগে বললো
-” আমার জন্য দুজন সাধারণ মানুষ আজ মৃত্যুর পথযাত্রী হয়েছে।কি করে রেস্ট করবো আমি?দাদাজানের কি অবস্থা কে জানে? সব আমার জন্য হয়েছে।”

নাঈম মাহমুদ ছেলের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।বললেন

-” শান্ত হও বাবা। এসবে তোমার কোনো হাত নেই।যে এই কাজ করেছে তার যোগ্য শাস্তির ব্যবস্থা আমি করব।”

নাহিদ কিছুক্ষণ জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়লো।চোখ মুখ লাল হয়ে এসেছে।বুকের ভেতর তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে।সেই বিভৎস দৃশ্য বার বার চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে।নাহিদকে অস্থির হতে দেখে নাঈম মাহমুদ নাহিদকে ধরে ধরে দাদাজানের কেবিনের বাইরে নিয়ে আসলেন।নিজামুল হকের মুখে অক্সিজেন মাস্ক।শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যান্ডেজ। দুর থেকেই দাদাজানের অবস্থা দেখে নাহিদ ভেঙে পড়লো।মানুষটা এই বয়সে এতো বড়ো ধাক্কা কি করে সামলাবে?ঠিক তখনই নাহিদের কাধে হাত রাখলো আসফি।পাশেই সাদমান ও আছে।নাহিদ প্রচন্ড আবেগে দুই বন্ধুকে জড়িয়ে ফুপিয়ে উঠলো।তারা দুজনেই নাহিদকে শান্ত করলো।নাহিদ চোখ মুছে বললো

-” অন্য গাড়ির মানুষ গুলোর কি অবস্থা?দুজনের অবস্হা খুব বাজে ছিলো।”

সবাই চুপ হয়ে গেলো।নাহিদ নিজেও আন্দাজ করেছে কি হতে পারে।সবার নিশ্চুপ থাকা দেখে সেটা কনফার্ম হয়ে গেলো।নাহিদ তাদের এক নজর দেখার জন্য ডক্টরের কাছে অনুরোধ করলো।নাহিদের বাবা আর বাকি সবাই নাহিদকে মানা করলেও সে শুনলো না।প্রথমে লাবিবকে দেখতে গেলো নাহিদ।লোকটি ড্রাইভিং সিটে ছিলো।একটি হিম শীতল রুমে প্রবেশ করে নাহিদের শরীর শির শির করে উঠলো।সাদা কাপড়ে মোড়ানো লাশটা দুর থেকে দেখেই নাহিদের গলা শুকিয়ে আসলো।খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কাছে এসে কাপড়টা সরিয়ে নিজের চোখ বুজে নিলো।মাথাটা একদম থেতলে গেছে।কেমন বিভৎস দেখাচ্ছে লাশটাকে।নাহিদের শরীর থর থর করে কাঁপতে লাগলো।সাদমান আর আসফি দুজনেই নাহিদের দুবাহু ধরে রেখেছে।নাহিদ ঠিক ভাবে দাড়িয়ে থাকতে পারছে না।নাহিদের চোখ ভিজে উঠলো। বহু কষ্টে নিজেকে শক্ত রেখে পড়ে সাবরিনা খানমের লাশের কাছে গেল।সাবরিনা কে দেখে নাহিদের কেনো যেনো পরিচিত মনে হলো।করো সাথে যেনো খুব মিলে যায়।কিন্তু নাহিদ পরিষ্কার বুঝতে পারছে না।তবে সাবরিনাকে দেখে মনে হলো ভদ্র মহিলা অতি রূপবতী।সেই রূপবতী নারীর সারা মুখেই বিভিন্ন ক্ষত।এতো সুন্দর মুখে এই ক্ষত যেনো ভীষণ বেমানান।মুখটা কেমন নীলচে হয়ে আছে।শরীর থেকে নিশ্চই অনেক রক্ত ঝরে পড়েছে তাই।পেটের কাছে একটা কাচ বিধে পেটের খাদ্যনালী ফুটো হয়ে গেছে। হাতটাও থেতলে গেছে।নাহিদের মতো শক্ত মানুষটিও থর থর করে কাঁপতে লাগলো।মহিলাটির দিকে তাকিয়ে নাহিদ অদ্ভুদ টান অনুভব করলো।কিন্তু ডক্টরের একটা কথায় নাহিদের অপরাধবোধ যেনো আকাশ ছুয়ে গেলো।ভদ্রমহিলা চার মাসের প্রেগনেন্ট ছিলেন।নাহিদের যেনো বুকে কেউ ছুরি আঘাত করছে।তার জন্য তিন তিনটা প্রাণ হারিয়ে গেলো।নাহিদ দুহাতে মুখ গুজে কেঁদে উঠলো।এতো বিভৎস মৃত্যু যেনো কোনো শত্রুর না হয়।আজ তাদের জায়গায় এই মানুষগুলোর প্রাণ গেলো।নাহিদকে বাচ্চাদে মতো কাদতে দেখে সকলেই হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।এতো সুশীল কঠিন ব্যাক্তিত্বের ছেলেটা এভাবে কাদতে পারে জানা ছিল না।সবাই মিলে নাহিদকে সামলানোর চেষ্টা করলো।কিন্তু নাহিদ আজ বাচ্চাদের মতো কেঁদেছে। সাদাত হাসান তখনও বেচেঁ আছেন।তবে তার অবস্থা খুব একটা সূচনীয় নয়।অপারেশন থয়েটারের আছেন তিনি।নাহিদ দুর্বল শরীর নিয়ে দাদাজানের কেবিনের বাইরের চেয়ারে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো।নিজেকে এতটা তুচ্ছ আগে কখনোই লাগেনি।সবাই তাকে বেডে শুয়ে রেস্ট নিতে বললেও শুনলো না।নকিব মাহমুদ প্রিয় ভাতিজার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন

-“নিজেকে সামলাও নাহিদ।একজন নেতা হতে চাইলে মনকে অনেক শক্ত করতে হবে।আব্বা তোমাকে নিয়ে অনেক বড়ো স্বপ্ন দেখেছে।তুমি একদিন এমপি হবে।আজ যদি ভেঙে পরো তবে সামনে আগাবে কি করে? তোমার ফিল্ডে এমন রক্তের বন্যা আরো বহুবার দেখতে হতে পারে।মনে কোনো গিলটি রেখোনা। এসবে তোমার কোনো দোষ নেই নাহিদ।সবটাই নিয়তি।কেউ প্ল্যান করে করেছে বুঝাই যাচ্ছে।আল্লাহর রহমতে তুমি আর আব্বা সুস্থ আর জীবিত আছো। এটাই আমাদের জন্য অনেক।আর যারা মারা গেছেন তাদের পরিবারকে খবর দেওয়া হয়েছে।খুব জলদি তারা পৌঁছে যাবে।তুমি রেস্ট করো বাকি দিকটা আমরা সামলে নিবো।”

নাহিদ ভাঙ্গা গলায় বললো
-” ওই মানুষ গুলোকে আমি ফেস করবো কি করে?তারা আমাকে ঘৃনা করবে।তাদের আপনজন হারানোর দায় আমাকে দিবে।এই অপরাধবোধ নিয়ে আমি বাঁচবো কি করে চাচু?”

-” না এসব ভেবোনা।তুমি ইচ্ছাকৃত ভাবে কিছুই করনি নাহিদ।নিজেকে শক্ত করো।এমন চাইল্ডিশ বিহেভ করোনা।”
নাহিদ সেখানেই চুপটি করে বসে রইল।কিছুক্ষণ পর সেখানে একজন মধ্যবয়সী মহিলা দুই কন্যা সন্তান নিয়ে হাজির হলেন।একটা মেয়ে কোলে আর অন্য মেয়েটা মায়ের হাত ধরে ভয়ে চুপসে আছে।লাবিবের লাশের পসেই মহিলাটি ধপ করে বসে পড়লেন।দুচোখে তার অশ্রু ধারা। সেই রমণী চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন।সেই গগন বিদারী চিৎকার নাহিদের মস্তিষ্ককে বিষের নেয় আঘাত করলো।মহিলাটি স্বামীর ক্ষত বিক্ষত লাশটি বুকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলেন।হঠাৎ মহিলাটি পাগলের মতো ছুটে আসলো নাহিদের সামনে।নাহিদের গেঞ্জির কলার ধরে চিৎকার করে বলতে লাগলো

-” কি দোষ ছিল তার? কেনো মেরেছিস তাকে? আমার বাচ্চা গুলোকে কেনো এতিম করে দিলি?তোকে আমি মেরেই ফেলবো।”

বলেই নাহিদের গালে কয়েকটা থাপ্পর বসিয়ে দিলো।সবাই এসে দ্রুত মহিলাটিকে নাহিদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিলো।নাহিদ অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইলো। চোখের কার্নিশ বেয়ে টপ টপ করে অশ্রু ঝড় পড়লো। দশ এগারো বছর বয়সী লামিয়া নাহিদের সামনে এসে দাড়ালো।মিষ্টি মেয়েটার চোখে মুখে তীব্র রাগ।নাহিদের দিকে ঘৃণার দৃষ্টি ফেলে বললো

-” তুমি আমার বাবাকে মেরেছ?আমার বাবার মাথা মেরে ফাটিয়ে দিয়েছ?এখন আমাকে কে আদর করবে? কে আমাকে অনেক অনেক খেলনা কিনে দিবে?আমি কতো ডাকলাম বাবা উঠলো না।আম্মুও সেই কখন থেকে চিৎকার করে কাদঁছে।সব তোমার জন্য হয়েছে।তুমি খুব খারাপ লোক।”

নাহিদ দপ করে লামিয়ার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো। দুই হাত জরো করে কেঁদে উঠলো।আর বললো

-” আমাকে মাফ করে দিও বোন।আমার জন্যই আজ তুমি বাবা হারা হয়েছ।তোমার ঐ ছোট্ট চোখের মোটা মোটা অশ্রু বিন্দু আমার অপরাধবোধে যে বহু গুনে বাড়িয়ে দিচ্ছে।আমি কি করে ক্ষমা চাইবো তোমার কাছে নিজেই জানিনা।”
আসফি এসে নাহিদের পাশে বসলো।লামিয়া কাদতে কাদতে আবার বাবার লাশের পাশে দাড়িয়ে রইলো।নাহিদের বুকে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করতে লাগলো।এতটা বিষাদময় দিন তো মায়ের চলে যাওয়ার দিনটাও ছিল না। আজকের এই দিনটা নাহিদকে সারা জীবন তারা করে বেড়াবে।কিন্তু নাহিদের বিষাদ যেনো এখনেই শেষ ছিলো না।সবচাইতে বড় ধাক্কাটা তার জন্য সামনে অপেক্ষা করছিল।

প্রায় ঘন্টা খানেক পর হসপিটালে এক কিশোরীকে ঢুকতে দেখে নাহিদের কলিজা মোচড় দিয়ে উঠলো।কয়েক সেকেন্ডের জন্য নাহিদ যেনো থমকে গেছিলো। হৃদস্পন্দন যেন বন্ধ হয়ে আসছে।আরজুর এলোমেলো প্রতিটি কদম নাহিদের মনে ভয়ে সৃষ্টি করতে লাগলো।তীব্র ভয়।সাবরিনা খানম যে আরজুর মা সেটা বুঝতে নাহিদের জাস্ট এক মিনিট সময় লাগলো।জীবনে এর চাইতে বিভৎস কিছু আর কি হতে পারে? তার ভালোবাসার মানুষটির মায়ের মৃত্যুর দায় কি করে বহন করবে নাহিদ?সেই চঞ্চল হাসি খুশি মেয়েটির মুখটা কেমন লালচে হয়ে ছিলো।মায়ের লাশটা দেখে আরজু আকস্মিক দু কদম পিছিয়ে গেছিলো।এই পরিস্থিতি বিশ্বাস করা সেই কিশোরী আরজুর পক্ষে সম্ভব ছিল না।মায়ের সুন্দর মুখটায় এতো ক্ষত দেখে মেয়েটার শরীরের রক্ত হিম হয়ে আসছিল।মৃত মায়ের বুকে পড়ে আরজুর সেই চিৎকার নাহিদ হয়তো জীবনে কোনো দিন ভুলতে পারবে না।কোনোদিন না।

যেই মেয়েটিকে চিরদিন ভালোবেসে সুখে রাখতে চেয়েছিল আজ কিনা সেই মেয়েটির দুঃখের একমাত্র কারণ সে নিজে।নাহিদ যেনো এটা কিছুতেই মানতে পারছিল না।নাহিদ পড়ে যেতে নিলে সাদমান তাকে সামলে নিল। আসফি সাদমান দুজনের চোখে মুখেই আতঙ্ক আরজুকে দেখে।কেউ সপ্নেও ভাবতে পারেনি এই মানুষ গুলো আরজুর বাবা মা।নাহিদ বেশিক্ষণ আর দাড়িয়ে থাকতে পারেনি।অতি টেনশনে আর আতঙ্কে তার মস্তিষ্ককে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে মাইল্ড স্ট্রোক করে বসে। এতো কম বয়সেই এমনটা হবে কেউ ভাবতেই পারেনি।
____________

নাহিদের জ্ঞান ফিরলো একদিন পর। ছেলেটার দুর্বল শরীর দেখে নাঈম মাহমুদ বহুবার অশ্রু ঝরিয়েছেন।কিন্তু ছেলের সামনে নিজেকে স্বাভাবিক আর শক্ত রেখেছেন।ততক্ষণে আরজুর বাবাও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। জ্ঞান ফেরার পরও নাহিদকে এই খবরটি কেউ জানায়নি।যদি ছেলেটার কিছু হয়ে যায়।এই শোক ছেলেটা সহ্য করতে পারে কিনা কে জানে?জ্ঞান ফিরে সে সর্বপ্রথম বলেছিল

-” ভাগ্য এতটা নিষ্ঠুরতা কেনো দেখাচ্ছে আমার সাথে? আরজু আমাকে কোনোদিন ভালোবাসবে না।কোনো দিন না।আমি ওর চোখের দিকে কোনোদিন তাকাতে পারবো না।যেই চোখে ভালোবাসা দেখতে চেয়েছি সেই চোখে ঘৃণা সহ্য করা মরণ যন্ত্রণার সামিল।”

বাবা মাকে হারিয়ে আরজু তখন নিজের মধ্যে ছিলো না।তার আসে পাশে কি হচ্ছে কিছুই সে জানতো না।সাবা খানম বোন আর বোন জামাইকে হারিয়ে পাগল প্রায়।এতো সহজে হেরে যাওয়ার পাত্রী তিনি না।তিনি নাহিদের নামে মামলা করে বসেন।নিজামুল হক ততদিনে খানিকটা সুস্থ।তিনি নিজের ক্ষমতার সবটা লাগিয়ে দেন নাহিদের জন্য।নাহিদকে অ্যারেস্ট করলেও একটা দিন জেলে রাখতে পারেনি।এটা সাবা খানম মেনে নিতে পারেনি।প্রচন্ড ক্ষোভ জন্মে তার নাহিদ আর এই নেতাদের ক্ষমতার অপব্যবহারের উপর।
পরবর্তীতে সিসিটিভি ফুটেজ থেকে দেখা যায় নাহিদের সাথে গাড়ির প্রথম সংঘর্ষে সময় সকলেই শুধু মাত্র নানা ভাবে আহত হয়।কিন্তু পরবর্তীতে ট্রাকের চাপায় এই মানুষ গুলোর মৃত্যু হয়।সাবা সবটা জানলেন কিন্তু মানতে পারলেন না।কোথাও না কোথাও তার নাহিদকে দোষী মনে হয়েছে।সে রং সাইড দিয়ে না আসলে তার বোন,বোন জামাইয়ের গাড়ির সাথে কখনো সংঘর্ষ হতো না।আর না ট্রাক তাদের চাপা দিতে পারতো।তার ধারণা নাহিদ নিজেকে বাঁচানোর জন্য তার বোন,বোন জামাইকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে।

পরবর্তী সময়টা নাহিদের জন্য ছিলো বেদনা দায়ক।তাকে আইনের আওতায় শাস্তি দিতে না পারলেও বিবেকের আদালতে নাহিদ প্রতি মুহূর্তে শাস্তি ভোগ করছি।বেছে থাকাও যেনো দুর্বিষহ হয়ে পড়েছিল।আরজুর সেই চঞ্চলতায় ভাটা পড়তে দেখে নাহিদের হৃদয় পুড়েছে বহুবার।কিন্তু মাথা তুলে আরজুর সামনে দাঁড়ানোর সাহস বা শক্তি কোনোটাই ছিলো না।কতো রাত আরজুর বারান্দার পাশের রাস্তায় নাহিদ দাড়িয়ে রাত কাটিয়েছে।যদি এক ঝলক দেখা পাওয়া যায় প্রিয়তমার।মাঝে মাঝেই দেখতো আরজুকে মলিন, নিস্তব্দ হয়ে দাড়িয়ে আকাশের পানে তাকিয়ে অশ্রু ঝরাতে।নাহিদের তখন নিজেকেই শেষ করে ফেলতে ইচ্ছে করতো।
একটা সময় আরজু স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে।কিন্তু নাহিদ সেই ট্রমা থেকে কখনোই বের হতে পারে নি।নিজেকে সব কিছু থেকে গুটিয়ে কাজে ব্যাস্ত থাকতে শুরু করে।দিন রাত কাজে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতো।যেই আরজুকে নিয়ে হাজারো স্বপ সব মাটি চাপা দিতে লাগলো।আরজুকে পাওয়ার কোনো স্বপ্নই আর ছেলেটা দেখেনি।কিন্তু দুর থেকে সর্বদা আরজুর খেয়াল রেখেছে।এলাকায় কোনো ছেলে ভুল করেও আরজুর দিকে তাকানোর সাহস পায়নি।

নাহিদ দিন দিন আরো নিস্তেজ হয়ে পড়ছি।কাজ ছাড়া যেনো তার জীবনে আর কিছুই নেই।সবাই জানতো নাহিদ আরজুকে ভুলে জীবনে এগিয়ে গেছে।কিন্তু নিজামুল হক ঠিক বুঝতে পেরেছেন তার নাতি এক নারীতে আসক্ত।আরজুর আসক্তি নাহিদ কোনোদিনই কাটিয়ে উঠতে পারেনি।শুধু মাত্র মনে সাথে যুদ্ধ করেই চলছে নাহিদ।কিন্তু মন শুধু আরজুকে চাইছে।নাহিদের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে নিজামুল হক বড়ো সিদ্বান্ত নিয়ে নিলেন।নাহিদকে না জানিয়েই আরজুর ইন্টার পরীক্ষার পর নিজামুল হক একদিন সাবা খানমের কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যান।স্বাভাবিক ভাবেই সাবা খানম সেটা প্রত্যাখ্যান করে।নিজের বোন,বোন জামাইয়ের হত্যাকারীর হাতে মেয়েকে তিনি কখনোই তুলে দেবেন না।নিজামুল হক একাধিক বার সাবা খানম আর জুবায়ের আহমেদের কাছে প্রস্তাব রাখেন।কিন্তু আত্মমর্যাদা সম্পন্ন,তীক্ষ্ণ ব্যাক্তিত্বের সাবা খানম প্রতিবার তাকে অপমান করে প্রত্যাখ্যান করেন।বিষয়টা নাহিদ জানতে পারলে দাদাজানের সাথে বেশ বাকবিতণ্ডা হয়।নাহিদ ভীষণ রেগে বলেছিলো

-” ওর আশা আমি ছেড়ে দিয়েছি।তোমাকে যেচে অপমান হবার জন্য কে যেতে বলেছে?তোমার কি মনে হয় আরজু আমার জেদ? মোটেও না।আরজু আমার জেদ হলে কবেই তুলে এনে নিজের বউ করে ফেলতাম।কিন্তু সে আমার অনুভূতি,আবেগে,অস্তিত্ব।তাকে আমি কখনোই হাসিল করতে চাইনা।সে আমার অনুভূতিতে মিশে থাকবে চিরদিন।”
এসবের আভাস সাবা খানম আরজুকে হতে দেয়নি।কারণ মেয়েটা মা বাবার বিষয়ে অনেক বেশি সেনসিটিভ।যে কোনো ইস্যু তার কোমল হৃদয় কে পুনরায় আঘাত করতে পারে।বহু কষ্টে মেয়েটা স্বাভাবিক হয়েছে তাকে আবার সেই আধারে সাবা খানম ফেলতে চায়নি।
__________________

জুবায়ের আহমেদ কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে সাবা খানমকে পর্যবেক্ষণ করছেন।আরজুকে হঠাৎ নাহিদ নিয়ে গেছে জেনেও স্ত্রীর এই শান্ত ব্যাবহার তার ঠিক হজম হচ্ছে না।এতক্ষনে তুলকালাম কাণ্ড বাধানোর কথা ছিল।কিন্তু তার স্ত্রী ভীষণ শান্ত।তিনি গলা পরিষ্কার করে বললেন

-“তুমি ঠিক কি চাইছো বলোতো?”

সাবা খানম আড়চোখে স্বামীর দিকে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন

-” কোন বিষয়ে?”

-” নাহিদ আর আরজুর বিষয়ে।নাহিদের উপর তুমি অসন্তুষ্ট ছিলে।কিন্তু আজ নাহিদের কাজে তুমি এতো শান্ত কি করে?”

সাবা খানম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন

-” তুমি ঠিক বলেছো।নাহিদের প্রতি আমি অসন্তুষ্ট ছিলাম। কিন্তু এত দিনে ছেলেটার প্রতি আমার দৃষ্টি ভঙ্গি অনেকটাই পাল্টে গেছে।ছেলেটাকে আমি ধনী পরিবারের বিগড়ে যাওয়া সন্তান ভেবেছি।আসলে আপার মৃত্যুর পর নাহিদকে জেলের ভেতর দেখতে চেয়েছিলাম।কারণ সেই ঘটনার জন্য নাহিদের প্রতি আমার তীব্র ক্ষোভ জন্মেছিল।কিন্তু তার দাদার ক্ষমতার অপব্যাবহার দেখে আমি ভীষণ নিরাশ হয়েছিলাম।মনে মনে নাহিদের প্রতি রাগ বেড়েই চলেছে।কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে ছেলেটার ধৈর্য্যশীলতা,শান্ত ব্যাবহার আর মোস্ট ইম্পর্টেন্ট আরজুর প্রতি তীব্র ভালোবাসা দেখে আমি অবাক হয়েছি।আরজুকে আমি তার জেদ ভেবেছি।কিন্তু ছেলেটা কখনই আরজুর প্রতি সেই ডেসপারেট বিহেভ দেখায়নি।নাহিদের সাথে থাকা কালীন আরজুর চোখে মুখে আমি যেই সুখী ভাবটা দেখেছি সেটা কখনোই আরজুর মধ্যে আগে ছিল না।সবচাইতে বড় বিষয় ছেলেটাকে আরজু পাগলের মত ভালবাসে।ঠিক কতটা ভালোবাসলে বিয়ের মতো সিদ্বান্ত এমন করে নিতে পারে বুঝতে পারছো?পূর্বে যাই ঘটেছে সেটা বদলানো সম্ভব না।কিন্তু সেটার রেশ ধরে বর্তমান খারাপ করার কোনো মানেই হয়না।আমার মনে হয় আরজু একমাত্র নাহিদের সাথেই সবচাইতে সুখে থাকবে।আমাদের আরজুর এতো পাগলামি নাহিদের মত ধৈর্যশীল ছেলেই সামলাতে পারবে।আমি মনে প্রাণে চাইছি আরজু এবার নিজের আবেগ দিয়ে নয় বরং বিবেক বুদ্ধি দিয়ে সিচুয়েশন বুঝবে এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবে। মেয়েটা মন থেকে যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেটাই আমি মেনে নিব। কারণ দিনশেষে আমি আরজুকে সুখী দেখতে চাই।”

জুবায়ের আহমেদ মুচকি হাসলে।।আজ এতো বছর পর তার স্ত্রীর মন গলেছে ভেবে বেশ খুশি হলেন।নাহিদকে তিনি নিজেও বেশ পছন্দ করেন।আজ কালকের যুগে এতটা সচ্ছলতা সাথে রাজনীতিতে নিজের অবস্থান টিকিয়ে রাখা যায়না।যখনই তার কলিগরা রাজনীতির গল্প করে তখনই সবার মুখে নাহিদের প্রশংসা শুনে তার বুকটা গর্ভে ভরে উঠে।যদিও সবাই জানেনা নাহিদের নিয়ে সম্পর্কে।কিন্তু জন সাধারণের মুখে মুখে নাহিদের জয়গান চলে।এটা একজন বাবার জন্য ভীষণ প্রাপ্তির।

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_74

গভীর নিস্তব্দ রাত।সবাই দিনের ক্লান্তি শেষে গভীর নিদ্রায় মশগুল।কিন্তু রিসোর্টের আভিজাত্য পূর্ণ ঘরটায় দুটি প্রাণ যেনো নিদ্রাহীন কাটাচ্ছে।নরম বিছানায় এক কোণে হাঁটুতে মুখ গুজে ফুপাচ্ছে আরজু।বাবা মায়ের সেই বিভৎস মৃত্যুর বর্ণনা যেনো আরজুকে ভেতর থেকে ভেঙে চুরে দিচ্ছে।তার সাথেই কেনো এমন হলো?সব ঠিক থাকলে আজ তার ও পরিপূর্ণ পরিবার থাকতো।হয়তো তার একটা খেলার সাথী আসতো যাকে আরজু ভীষণ ভালোবাসতো।কিন্তু সব কিছুই অপূর্ণ।অন্য দিকে নাহিদ বারান্দায় বসে একের পর পর এক সিগারেট শেষ করছে।জীবনের এমন কিছু সময় থাকে যখন মানুষের কাছে সব কিছুই অন্ধকার মনে হয়।যেনো সামনে কোনো রাস্তা নেই।কোনো গোলক ধাঁধায় আটকে যায়।নাহিদের এই মুহূর্তে ঠিক তেমন অবস্থা।সে না পারছে আরজুকে ছাড়া বাঁচতে আর না পারছে আরজুকে অধিকারের দোহাই দিয়ে নিজের কাছে বেধে রাখতে।

আরজুর ফুপানোর শব্দ নাহিদের কানে এসে তীরের মতো বিধছে।নাহিদ শুষ্ক ওষ্ঠের ভাঁজে আবারও সিগারেট রাখলো।এই কালো ধোঁয়ার মতো জীবনের সব দুঃখ,যন্ত্রণা যদি উগ্রে বের করে দেওয়া যেতো তবে বেশ হতো।

অন্ধকার ঘরে চাঁদের আলোয় আলোকিত করে তুলেছে।আরজু মলিন দৃষ্টিতে সেই উজ্জ্বল ঝলমলে চাদেকে দেখে যাচ্ছে।জানালার ফাঁকে চাঁদটা দেখতে ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে।আরজু ভাবছে কিছুক্ষণ আগের কথা।নাহিদের মুখে সব শুনে আরজু স্তব্ধ হয়ে বসে ছিল।বাবা মায়ের সেই ক্ষতবিক্ষত মুখটা আবার ভেসে উটছে নিজের দৃশ্য পটে।আরজু হঠাৎই ফুপিয়ে উঠলো।নাহিদ আরজুর সামনে মাথা নত করে বসে ছিলো তখন।আরজুকে কান্নায় ভেংগে পড়তে দেখে নাহিদের অপরাধ বোধ আরো বেরে দ্বিগুণ হয়ে গেলো।নাহিদ আরজুর কোমল হাতে হাত রেখে বললো

-” আমি মোটেও তোমার সামনে নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণ করতে চাইছি না।আমি জানি আমি অপরাধী।সেদিন আমি উলটো পাশে গাড়ি ড্রাইভ না করলে হয়তো তাদের গাড়িটা অনায়াসেই বেরিয়ে যেতো।আমার গাড়ির সাথে প্রথম ধাক্কাটা না লাগলে হয়তো সেদিন তোমার বাবা মা সঠিক সময়ে তোমার কাছে পৌঁছে যেতো।আরজু সেই সময় আর পরিস্থিতি কোনোটাই আমার অনুকূলে ছিলো না।আমার জীবনে সবচাইতে বিভৎস দৃশ্য ছিল তাদের মৃত্যু।আরজু আমি ইচ্ছাকৃতভাবে কোন কিছু করিনি। এটা শুধুমাত্র একটি আকর্ষিক দুর্ঘটনা।যেটা আমার জীবনকে একেবারে বদলে দিয়েছে। সেদিন আমার আর দাদাজানের মৃত্যুর প্ল্যান করা হলেও তোমার বাবা মায়ের প্রাণ গিয়েছিল।আমি কখনই চায়নি আমার জন্য অন্য করো ক্ষতি হোক।আর সেটা যদি হয় তোমার আপনজন তবে তো আরো না।সেদিনের পর থেকে মনে হয়,তোমার বাবা মায়ের জায়গায় আমার প্রাণ গেলেই ভালো হতো।তাহলে এমন প্রতিনিয়ত ধুকে ধুকে মরতে হতো না।

এই অপরাধ বোধ থেকে আমি আজও বের হতে পারিনি।ঠিক এই কারণেই আমি তোমার কাছ থেকে দূরে থেকেছি। সবসময় তোমাকে ইগনোর করে এসেছি।কখনোই তোমার সামনে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করিনি।কিন্তু ভাগ্য হয়তো অন্য কিছু চেয়েছে।আমি বুঝতেই পারিনি তুমি আমার প্রতি কবে থেকে দুর্বল হতে শুরু করেছ।তোমার সেই আবেগ,অনুভূতি আমাকে স্থির থাকতে দেয়নি।আমি তোমাকে পাওয়ার আশা কখনোই করিনি আরজু।সেদিন হসপিটালে তোমাকে তোমার মায়ের বুকে মাথা রেখে কাদতে দেখে আমি বুজে গেছিলাম তোমাকে পাওয়া আমার ভাগ্যে নেই।তাই কোনো চেষ্টাই আমি করিনি।যেদিন তোমার আমার বিয়ে হলো সেদিনও আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।সবটাই স্বপ্ন মনে হচ্ছিল।সেদিন হুট করে বিয়ের সিদ্বান্ত নেয়ার পর থেকে আমার বুকের যন্ত্রণা যেনো আরো বেড়ে গেছিলো।তোমাকে ফেস করতে আমার ভয় হয়তো।তোমাকে একটু স্পর্শ করতে ভীষণ ইচ্ছা করলেও সেই অপরাধবোধ আমাকে বাধা দিয়েছে।কিন্তু দিন শেষে আমি মানুষ।নিজের আবেগ,অনুভূতি কতদিন লুকিয়ে রাখতাম?নিজের সহধর্মিণী আহ্বানে সাড়া না দিতে পারার কষ্ট তুমি কখনো বুজবে না আরজু।”

নাহিদ জোরে নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো।আরজু ভেজা ফোলা চোখে নাহিদকে দেখে যাচ্ছে।নাহিদের ভেজা চোখে যে অসীম মায়া আছে যেখানে আরজু সর্বদাই হারিয়ে যায়।আরজুর নিজেরও চোখ ভিজে উঠলো।নাহিদ আরজুর সেই ভেজা অক্ষিযুগলে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো

-” একটি মানুষ যার তার উপর অধিকার দেখায় না। ওই মানুষটার উপর অধিকার দেখায় যাকে সে ভালোবাসে, আপন মানুষ ভাবে।কারো উপর সর্বোচ্চ অধিকার থাকার পরও তাকে বেধে না রাখতে পারার যন্ত্রণা বেশ তীব্র হয় জানো আরজু।এইযে আমি চাইলেই তোমাকে নিজের সাথে বেধে রাখতে পারছিনা। জোর খাটিয়ে বলতে পারছি না যে,আমাকে ছেড়ে কোথাও যেও না।আমি নিঃস্ব হয়ে যাবো।আমি তোমাকে ঠিক যতোটা ভালোবেসেছি তার চাইতে অনেক বেশি আমি তোমাকে সম্মান দেখিয়েছি আরজু।আমার জীবনের সবচাইতে মূল্যবান ব্যাক্তি তুমি।নিজের সেই মূল্যবান মানুষটির কষ্টের কারণ হয়ে বেচেঁ থাকা খুব কষ্টের।আমাদের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কি আমার জানা নেই। আমি কোনোদিন তোমার উপর আমার কোনো সিদ্বান্ত চাপিয়ে দেইনি আর সামনেও দিবো না।আজ সব সত্যি তোমার সামনে।তুমি যেই সিদ্বান্ত নেবে আমি সেটা মাথা পেতে নেবো।যদি কোনোদিন মনে হয় আমার আত্মগ্লানির পরিসমাপ্তি ঘটাতে চাও তবে ফিরে এসো।আমি শেষ নিঃশ্বাস অব্দি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো।তোমার সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত আমার জন্য এতটাই স্পেশাল যে সেই স্মৃতি নিয়ে আমি সারা জীবন কাটিয়ে ফেলতে পারব।ক্ষমা চেয়ে তোমাকে ছোট করবো না।কারণ জানি আমার ভুলের কোনো ক্ষমা নেই।”

___________________

সাবিহা স্তব্ধ হয়ে বসে আছে পাত্রপক্ষের সামনে।বাবা হুট করেই এমন একটা সিদ্বান্ত নেবে সে জানতো না।সে জানতো বাবার কোনো কলিগের পরিবার আসছে বেড়াতে।সাবিহা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি তার বিয়ের প্ল্যান বাবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।যখনই সাবিহাকে তাদের সামনে এইভাবে বসানো হতো তখনই মেয়েটা বুজে গেলো বাবা মূলত কি চাইছেন।ভদ্র মহিলা বেশ হাসি মুখের সাবিহার সাথে কথা বললো।বেশ যত্নের সাথে অংগুলে একটি আংটি ও পরিয়ে দিলো।সাবিহা মলিন চোখে বাবার দিকে তাকালো।তিনি বেশ খুশি মনে সবার সাথে কথা বলছে।সাবিহা বাবার সম্মান রক্ষার্থে সেই মুহূর্তেই কিছুই বলেনি।কিন্তু তারা চলে যেতেই সাবিহা বাবার রুমে প্রবেশ করলো। কাউচে বসে চা পান করছেন তিনি।সাবিহাকে দেখে মুচকি হেসে বললেন

-” আরে সাবিহা!! আসো মা এদিকে আসো।”

সাবিহা সামনে এগিয়ে এসে বাবার সামনে দাড়ালো।কাচুমাচু করে বললো

-” বাবা আমি এখন বিয়ে করতে চাইনা।তুমি প্লিজ উনাদের মানা করে দাও।”

-” কি বলছো? ছেলেটা খুব ভালো।শিক্ষিত,স্মার্ট ছেলে।বিত্তশালী পরিবার আর তারা সকলেই খুব ভালো,মার্জিত তাদের ব্যাবহার। আর কি চাই একজন বাবার তার মেয়েকে তুলে দিতে?”

সাবিহা মাথা নিচু করে বললো
-“বাবা আমি স্টাডি শেষ করতে চাই।”

-” অবশ্যই করবে।তারা তোমার স্টাডিতে সব রকম হেল্প করবে।তোমার কোনো সমস্যাই হবে না।বিয়ের পর যত পড়তে চাও পড়তে পারবে কেউ বাধা দিবে না।”

সাবিহার চিৎকার করে কাদতে ইচ্ছে করছে।বাবাকে কি করে বুঝাবে? সাবিহার দুই চোখ ভিজে উঠলো। নাক টেনে মলিন সুরে বললো

-” বাবা প্লিজ।আমি এই মুহূর্তে বিয়ে করতে চাইনা।”

-” কারণ টা কি তোমার সেই বন্ধু?”

সাবিহা চমকে বাবার দিকে তাকালো।সাবিহার বাবা শান্ত দৃষ্টি ফেলে বললো
-” তুমি কি রামিম ছেলেটার জন্য বিয়েতে রাজী না?”

সাবিহা ভয়ে শুকনো ঢোক গিললো।বাবাকে সে যেমন ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে, ঠিক তেমন ভাবে ভয় ও পায়।সাবিহার বাবা চায়ের কাপ ছোট টেবিলে রেখে বললেন

-” আমি তোমার বাবা।তোমার জন্য সবচাইতে বেস্ট জিনিসটাই বাছাই করবো।একজন বাবা হয়ে নিশ্চই কোনো পরিবারহীন অসচ্ছল পরিবারের ছেলের হাতে মেয়েকে তুলে দিবো না।”

সাবিহা কাপা কাপা গলায় বললো
-” বাবা রামিম ভালো ফ্যামিলির ছেলে।ভালো প্রতিষ্ঠান থেকে লেখাপড়া করছে।ফিউচারে ভালো কিছু করার সুযোগ আছে।তাছাড়া আমি ওকে পছন্দ করি।”

-” সাবিহা বাস্তববাদী হও।তোমার মতো ম্যাচিউর একটা মেয়ের মুখে এ ধরনের কথা মানায় না।রামিম ফিউচারে কিছু করবে ভেবে মেয়েকে তো বানের জলে ভাসিয়ে দিতে পারিনা।তাছাড়া ছেলেটার সাথে আমাদের স্ট্যাটাস গ্যাপ আছে।সামান্য একটা স্কুল শিক্ষিকার ছেলের সাথে আমার মেয়েকে কিছুতেই যায়না।তাই এইসব ভূত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো।এই বয়সে এমন ভুল একটু আকটু হয়েই থাকে। মিরাজের সাথেই তোমার বিয়ে হবে।আর কিছু শুনতে চাইছি না।”

সাবিহা আর কিছুই বলতে পারলো না।নিঃশব্দে বাবার রুম থেকে বেরিয়ে আসলো।সাবিহার মা মেয়ের মলিন মুখটা খেয়াল করেছেন।তাই স্বামীকে বললেন

-“সাবিহাকে না জানিয়ে হুট করে এইভাবে আংটি পড়ানো ঠিক হয়েছে?মেয়েটার নিজস্ব মতামত থাকতে পাড়ে।”

সাবিহার বাবা ভারী কণ্ঠে বললেন
-” এসব নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না।মেয়ের জন্য কোনটা ভালো হবে আমাকে বুঝতে দাও।আমার মতামতই মেয়ের মতামত।”

সাবিহার মা চুপ হয়ে গেলেন।স্বামীর এই একরোখা সভাব তার ভীষণ অপছন্দ।
সাবিহা নিজের রুমে এসে বালিশে মুখ গুজে কেঁদে উঠলো।নিজের এই কষ্ট কাকে বলবে? যার জন্য এতো কিছু সেই মানুষটিই তো আজ অব্দি নিজের মনের কথা প্রকাশ করতে পাড়লো না। বরং সাবিহার অনুভূতিকে ও অগ্রাহ্য করে এসেছে।
__________________

খুব ভোরেই আরজুর ঘুম ভাঙলো।আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো বিছানার এক কোণে সে শুয়ে আছে।গায়ে একটা তুলতুলে চাদর জড়ানো।আরজুর দ্রুত উঠে বারান্দায় আসলো।সেখানে নাহিদ নেই। সিগারেটের এস্ট্রে তে বেশ কিছু সিগারেটের অবশিষ্ট অংশ পড়ে আছে।আরজু শুকনো ঢোক গিলে রুমে ফিরে আসলো।বিছানায় চুপ করে বসে রইল।এই মুহূর্তে তার কিছুই ভালো লাগছে না। মূলত আরজুর মন কিছুই স্থির করতে পারছে না।মনে হাজারো দ্বিধা দ্বন্দ চলছে।কয়েক মুহূর্ত পরই নাহিদ রুমে ফিরে আসলো।অনেক দিন পর আবার সেই শুভ্র পাঞ্জাবি আরজুর বুকে ধুকপুক বাড়িয়ে তুললো।আরজু এক দৃষ্টিতে নাহিদকে দেখতে লাগলো।নাহিদ আরজুর দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে বললো

-” ফ্রেস হয়ে এসো আরজু।আমরা নাস্তা করেই ফিরে যাবো।”

-” কোথায়?”

নাহিদ শান্ত সুরেই জবাব দিলো
-” নিজ নিজ গন্তব্যে।”

আরজু আর কিছুই বললো না।তারা কিছু সময়ের মধ্যেই বেরিয়ে পড়লো।রাস্তায় কেউ কোনো কথাই বললো না।আরজুর খালামণি বাসার সামনে গাড়ী থামিয়ে নাহিদ বললো

-” বাসায় যাও আরজু।”

আরজু কয়েক মুহূর্ত চুপ করে বসে রইল।নাহিদের মন বলছিল আরজু এক্ষনি বলবে” আমাকে এই বাসায় কেনো এনেছেন?আমাকে আমার বাসায় নিয়ে চলুন।”

কিন্তু আরজু তেমন কিছুই বললো না।আরজু নেমে যেতে উদ্যত হলে নাহিদ বললো

-” সিড,আই মিন সাদমানের সাথে আর কোনো প্রকার যোগাযোগ রেখো না।সে নিজের স্বার্থের জন্য যে কোন কিছু করতে পারে।সেদিন রাতে আমার আর দাদাজানের বাইরে যাওয়ার খবরটা সাদমান বিরোধী দলকে দিয়েছিল।বন্ধুত্বের আড়ালে আমার জীবনে সবচাইতে বেশি ক্ষতি সেই করেছে।আর যাই হোক ওকে বিশ্বাস করা যায়না।আমাকে ভেঙে চুরে দিতে তারা তোমাকে ব্যাবহার করতে চাইছে।সেটা আমি কিছুতেই হতে দিবো না।”

আরজু হতবম্ব হয়ে নাহিদকে দেখছে। সদমানকে সে প্রথমে ভালো মানুষ ভেবেছিল।কি সাচ্ছন্দে তার সাথে কথা বলত।কিন্তু সেদিনের পর থেকে আরজু নিজেও সাদমানের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করেছে।কারণ যেই লোকটা নেতা সাহেবের এক সময়ের বন্ধু দাবি করেছে আবার সেই বন্ধুর সবচাইতে দুর্বল জায়গায় আঘাত করেছে।আরজুকে সত্যের মুখোমুখি করে সাদমানের আসলে কি লাভ। এখানে যে রাজনৈতিক কোনো চাল চলছে সেটা আরজু আগেই বুঝতে পেরেছে।কিন্তু দিন শেষে সত্য তো সত্যিই হয়।সাদমানের উদ্দেশ্য খারাপ হলেও আরজুকে এক হৃদয় বিদারক সত্যের মুখোমুখি করেছে।

আরজুকে নীরব থাকতে দেখে নাহিদ শান্ত দৃষ্টিতে আরজুর দিকে তাকালো।নাহিদের ইচ্ছে করছে আরজুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে।কিন্তু আরজু ইচ্ছার বিরুদ্ধে সে কখনোই এমন কাজ করবে না।সে বললো

-” বাসায় যাও আরজু।ভালো থেকো।আর সাবধানে থেকো।”

আরজু একপলক নাহিদের দিকে তাকিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেলো।নাহিদ আর দেরী করলো না। দ্রুতই সেখান থেকে প্রস্থান করলো।
____________

সকাল সকাল বাসার ডোর র্বেল বাজতে দেখে লামিয়া বেশ বিরক্ত হলো।লামিসা বাসায় নেই।তাই হাতের কাজ ফেলে দরজা খুলে ফুয়াদকে দেখে চমকে গেলো। গ্রিন টিশার্ট পরা ছেলেটাকে আজ বেশ এলোমেলো লাগছে।সবসময় পরিপাটি থাকা ছেলেটার এমন অবস্থা দেখে লামিয়ার গলা শুকিয়ে আসলো।কাপা গলায় বললো

-” আপনি?”

-” কেনো অন্য কাউকে আশা করছিলে নাকি?”

লামিয়া কিছুই বললো না।ফুয়াদ লামিয়াকে পাস কাটিয়ে বাসার ভেতরে প্রবেশ করলো।লামিয়া চোখ বড়ো করে তাকিয়ে রইল।আর বললো

-” এতো সকালে এখানে কেনো আপনি?”

ফুয়াদ দ্বিধা দ্বন্দ ছাড়াই চেয়ারে বসলো।টিশার্টের কলার ঠিক করতে করতে বললো

-” নাস্তা করতে আসলাম।তুমি তো বাসায় যাওনি তাই আমি চলে এসেছি।”

লামিয়া কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।সেদিন ফুয়াদের মায়ের বলা প্রতিটি কথা তার বুকে তীরের মতো বিধে আছে।নিজেকে এতটা ছোট আর কখনোই মনে হয়নি।তার আত্মসম্মানে কেউ আঘাত করবে সেটা মানতে পারবে না। লামিয়া নিজেকে শক্ত করে জোর গলায় বললো

-” আমি আপনাদের বাসার কাজটা ছেড়ে দিয়েছি।আপনি প্লিজ এই ভাবে হুট করে আমার বাসায় আসবেন না।”

-“কেনো?”

-” দেখুন আমরা একটা সমাজে বাস করি।আমার ছোট বোনটাকে নিয়ে আমি এই সমাজে টিকে থাকার চেষ্টা করছি।আপনার মত একজন ব্যাচেলর ছেলের বাসায় আসা যাওয়া লোকে ভালো চোখে দেখবে না।”

-” লোক বা সমাজের আমি ধার ধারি না।কে কি বললো সেটা নিয়ে ভাবার সময় নেই।যা আমার সেটা একান্তই আমার। পাছে লোকে কি বলে ভেবে লাভ নেই।”

লামিয়া বুজলো ফুয়াদ কি বুঝাতে চাইছে।তাই কিছুটা রেগে বললো

-” দেখুন আমি চাইনা আপনি আমার সাথে কোনো প্রকার যোগাযোগ রাখুন।আপনার পরিবারও তেমনটা চায় না।”

-” তুমি কি আমার সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করতে চাইছো?”

-” আপনার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।আমি আপনার বাসায় রান্নার কাজ করতাম এর চাইতে বেশি কিছুই না।আমার মত মেয়ের সাথে আপনাদের মত বিত্তশালীদের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না।”

ফুয়াদ চেয়ার ছেড়ে লামিয়ার মূখমুখি দাড়ালো।এতটাই কাছাকছি দাড়িয়েছে যে লামিয়ার অস্থিরতা শুরু হলো।ফুয়াদ স্বাভাবিক ভাবেই বললো

-” তোমার সাথে আসলেই আমার কোনো সম্পর্ক নেই?”

লামিয়া কাপা স্বরে বললো
-” না।”

ফুয়াদ লামিয়ার কোমল চিবুকে আলতো ছুঁয়ে নিজের দিকে ফিরিয়ে ফিচেল স্বরে বললো

-” আমি তোমার জন্য কি অনুভব করি সেটা তুমি কখনোই বুঝতে পারনি সেটা আমি বিশ্বাস করবো না।তুমি যথেষ্ঠ বুদ্ধিমতী।তুমি খুব ভালো করেই জানো আমি তোমাকে ঠিক কি ভাবে চাই।”

লামিয়ার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল।মুহূর্তেই দুচোখে অশ্রুরা এসে ভিড় জমালো।জীবনে অনেক সময় সত্যি জেনেও না জানার ভান করাটাই শ্রেয়।পিট পিট করে ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে লামিয়া বললো

-” আমি কিছুই জানিনা।আপনি প্লিজ চলে যান।”

-” আমি চলে যেতে আসিনি লামিয়া।তোমাকে আমি নিজের করে চাই।”

লামিয়া ফুয়াদের হাত ছাড়িয়ে দূরে সরে আসলো।জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বললো

-” আপনার পরিবার আপনার ভালো চায়।আমার মত একটা মেয়ে আপনার সাথে কোনো ভাবেই যায়না।আমি আপনার যোগ্য নই।আপনি প্লিজ আমার পিছু ছেড়ে দিন।”

-” তোমার পিছু আমি এই জীবনে ছাড়ছি না।তুমি সেই মানুষটার কথায় আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছ যার কোনো গুরুত্ব আমার জীবনে নেই।”

-” আমি কখনই আপনার কাছের ছিলাম না।তাই দূরে যাওয়ার প্রশ্নই আসেনা।”

ফুয়াদ লামিয়ার কাছাকাছি দাড়িয়ে বললো
-” তুমি কি অস্বীকার করতে চাইছো যে আমাকে তুমি ভালোবাসো না?”

লামিয়া কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।এই মানুষটা আজ তাকে এ কোন বিপদে ফেলে দিল।মনের গভীরে যত্ন করে লুকানো অনুভূতিকে এই লোকটা কেনো টেনে হিচড়ে বের করতে চাইছে?অবান্তর অনুভূতির হৃদয়ের কোনেই পড়ে থাকতে হয়।ফুয়াদ মুচকি হাসলো।আর বললো

-” তোমার এই সভাবটাই আমাকে তোমার প্রতি দূর্বল করেছে।তুমি কখনোই মিথ্যা বলতে পারো না।”

লামিয়ার অশ্রু সিক্ত চোখে ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে রইলো।ফুয়াদ লামিয়ার হাতটা নিজের হাতের ভাঁজে রেখে বললো

-” আমার জীবনে দেখা শ্রেষ্ঠ নারী তুমি। তোমার মাঝে এমন কিছু আছে যা আমি সারা জীবন আমার মায়ের মাঝে খুঁজে বেড়িয়েছি।কিন্তু কখনোই পায়নি।নিজের পছন্দের মানুষটিকে মনের অনুভূতি প্রকাশ করতে কোনো প্রকার দেরী করে শুভর মতো ভুল করতে চাইনা।আমার জীবনে অনেক নারী আসলেও কেউ আমার হৃদয়ে আঁচড় কাটতে পারেনি।কিন্তু তুমি আর তোমার ব্যক্তিত্ব আমার হৃদয়ের গভীর আচার কেটেছে। সেই ক্ষত সারাতে আমার তোমাকে চাই লামিয়া।”

লামিয়া অশ্রুসিক্ত চোখে মাথা নাড়িয়ে না জানালো।খানিকটা দূরে সরে আসলো আর বললো

-” আপনাদের জন্য এমন আবেগ অনুভূতি খুব সাধারণ বিষয়।আমাদের মতো মেয়েরা চাইলেই পারেনা।আপনার হাত ধরে আপনার মায়ের প্রতিটি অপবাদকে আমি সত্যি করতে চাইনা।এতে আমার আত্মসম্মানে আঘাত করবে।”

ফুয়াদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।শান্ত দৃষ্টিতে লামিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো

-” ঠিক আছে।আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো।আমি নিজের পায়ে যখন দাড়াতে পারবো ঠিক তখন তোমার আত্মমর্যাদা কে সম্মান জানিয়ে তবেই তোমাকে আমার করবো।সেখানে আমার বিত্তশালী বাবা মায়ের কোনো অর্থ থাকবে না।থাকবে এই ফুয়াদের কষ্টে অর্জিত অর্থ।তখন নিশ্চই আর কোনো অভিযোগ থাকবে না তোমার।ততদিন তোমার পাশে ছায়ার মতো দাড়িয়ে থাকবো।তুমি চাইলেও না চাইলেও।”

বলেই ফুয়াদ বেরিয়ে গেলো।লামিয়া মুখে হাত চাপিয়ে ফুপিয়ে উঠলো।এসব কেনো হচ্ছে তার সাথে।তার মতো সামান্য একটা মেয়ের জন্য এই ছেলেটা এতো আত্মত্যাগ কেনো করতে চাইছে? আসলেই কি ফুয়াদ তাকে এতটা ভালোবাসে? কবে থেকে? কবে তার মনে এই কঠিন অনুভূতি জন্মালো?লামিয়ার যে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।একাধিক নারীর সংস্পর্শে থাকা ছেলেটা কি আসলেই এক নারীতে তীব্র ভাবে আসক্ত হতে পারে?

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_75

ভার্সিটির সেই চিরো চেনা ক্যান্টিনে বসে আছে আরজু।সাবিহা রিমির কাধে মাথা রেখে সেই কখন থেকে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে।বাবার হঠাৎ নেয়া সিদ্ধান্তের মেয়েটা বেশ কষ্ট পেয়েছে।জারা এসবে বেশ বিরক্ত।বাস্তববাদী এই মেয়েটার সম্পর্কের এতো জটিলতা মাথায় আসেনা।বেশ বিরক্তি নিয়ে জারা বললো

-“আংকেলের সমস্যা কি?এক্ষনি তোর বিয়ের ভূত তার মাথায় চাপলো কি করে।এমন বাচ্চা মেয়ে বিয়ে দিয়ে কি করবে?আমি ডেম শিওর তুই ইন্টিমিসির কিছুই জানিস না।আরজুর মতো আবাল নিশ্চই তুই না?”

আরজু ক্ষিপ্ত চোখে জারার দিকে তাকালো।জারা আরজুর সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি উপেক্ষা করে বললো

-” এইভাবে তাকাস কেনো? মিথ্যা বলেছি? অস্থির হয়ে সবাইকে না জানিয়ে বিয়ে করেছিস।আবার সেই বিয়ের মজাও কয়দিনের মধ্যেই শেষ।তোর সব কিছুতেই হুটহাট ডিসিশন না নিলে হয়না।এমন জোস মালকে পেয়েও আগের বিষয় নিয়ে পড়ে আছিস।আরে অতীত নিয়ে পড়ে থাকলে ভবিষ্যতে সামনে আগাবি কি করে?আর এই মালও হাত ছাড়া হয়ে যাবে।শকুনের মতো তোর মালের দিকে মেয়েদের তীক্ষ্ণ নজর।”

আরজু কটমট চোখে তাকিয়ে নিচু সরে জারার কানে কানে বললো

-” বেশি কথা বলবি তো হাটে হাঁড়ি ভাঙবো।আর মাল কি? ফিউচারে তোর ভাসুর হতে পারে।সম্মান দিয়ে কথা বল।”

জারা মুখ বাঁকিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বির বির করে জাহিদকে গালি দিতে লাগলো।এই ছেলের জন্য আজ তাকে চুপ থাকতে হচ্ছে।নাহলে তার মুখ বন্ধ করা এতো সহজ ছিল না।

ফুয়াদ চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো
-” রামিম জানে বিষয়টা?”

সাবিহা নাক টেনে মাথা দুই দিকে নেড়ে না জানালো।আর ভাঙ্গা গলায় বললো

-” ও জানলেই কি আর না জানলেই কি?তার কিছুই আসে যায় না।”

শুভ বেশ আফসোস নিয়ে বললো
-” এই রামিমটাকে নিয়ে আর পারা যায়না।সবকিছু থেকে এমন গা বাঁচিয়ে কেনো চলছে? কল দে শালাকে।”

ফুয়াদ কল করলো রামিম কে।কিন্তু কল রিসিভ হলোনা।সকলেই চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে রইলো।
________________

ভার্সিটির থেকে বেরিয়েই কিছুদূর এগিয়ে গেলো আরজু।সাবিহাকে নিয়ে শুভ গেছে রামিম এর বাসায়।রামিম এর সাথে দেখা করে সবটা জানানো প্রয়োজন।আরজু কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে হাঁটছে।বিকেলের শহরে স্নিগ্ধ হাওয়ায় হাঁটতে ভালই লাগছে।হঠাৎ খেয়াল করলো পেছন থেকে বেশ কয়েকটা গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে।আরজু পেছনে ফিরে তাকালো।বেশ কয়েকটা গাড়ির মাঝে বেশ পরিচিত গাড়িটা দেখে আরজুর হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল।আরজু এক দৃষ্টিতে সেদিকেই তাকিয়ে রইলো।গাড়িটা মুহূর্তেই তার সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেলো।আরজু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাধের ব্যাগ শক্ত করে চেপে ধরে সামনে এগিয়ে গেলো।সামনের দেয়ালে একটা বড়ো পোস্টারে চোখ পড়লো তার।সামনের একটা সুনামধন্য কলেজে বিশাল বড় সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে।যেখানে বিশেষ অতিথি নাহিদ।এই পোস্টারটা আরজু আরো কয়দিন আগেই দেখেছে।তাইতো তার অবচেতন মন সেই কলেজের দিকেই ছুটে চলছিল।আরজু ছোট ছোট পা ফেলে সেই সমাবেশের কাছাকাছি চলে গেলো।মাঠে সাধারণ মানুষের উপচে পড়া ভিড়।আরজু দুর থেকেই স্টেজের দিকে তাকালো।কয়জন গার্ড নাহিদকে স্টেজের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।অনেকদিন পর নাহিদকে দুর থেকে দেখে আরজুর যেনো মন ভরলো না।একটু সামনে এগিয়ে যেতে পারলে ভালো হতো।কিন্তু যা ভির সেটা সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না।আরজু ভিড়ের ধাক্কায় কয়েক কদম পেছাতেই পেছনে স্ক্রিনে নাহিদকে স্পষ্ট দেখতে পেল।সর্বদা পরিপাটি থাকা মানুষটাকে অনেকটাই এলোমেলো লাগছে। ট্রিম করা হয়না বোধয় অনেক দিন।খোঁচা খোঁচা দাড়ি গুলো অনেকটাই বড়ো হয়ে গেছে।আরজু ছোট স্ক্রিনে থাকা অন্যমনস্ক নাহিদের মুখে হাত বুলালো।আরজু যেনো দম ফাটা কান্না পাচ্ছে।নাহিদের সিগারেট পোড়া ওষ্ঠে গভীর স্পর্শ দিতে ইচ্ছে জাগছে।আরজু শুকনো ঢোক গিললো।এই আবেগ সে কেনো কন্ট্রোল করতে পারে না? আবেগে ভেসে এবার আর কোনো সিদ্বান্ত সে নেবে না।আরজু আবার স্টেজের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।সামনের মানুষটি কি আদো ভালো আছে?
_________________

রামিম মাত্রই চুলায় চায়ের পানি বসিয়েছে।সারাদিনের ক্লান্তির পর এক কাপ চা না হলেই নয়।আগে দিন শেষে মায়ের হাতের এক কাপ চা সব ক্লান্তি দূর করে দিতো।কিন্তু এখন নিজের কথা নিজেকেই ভাবতে হয়।এসব ভাবছি সে ঠিক তখনই ডোরবেল বেজে উঠলো।রামিম চুলার আঁচ কমিয়ে গেলো দরজা খুলতে।দরজার ওপাশে শুভ আর সাবিহাকে দেখে খানিক অবাক হলো।তারপর মুচকি হেসে বললো

-“এই অবেলায় তোরা?আয় ভেতরে আয়।মাত্রই চায়ের পানি বসিয়েছি।তোদের জন্য দুকাপ বাড়িয়ে বসিয়ে দেই।”

শুভর মন চাইলো রামিমের নরম গালে কষিয়ে থাপ্পর বসাতে।শুভ শক্ত গলায় বললো

-” আমরা চা খেতে আসিনি।তোর সাথে জরুরী কথা আছে।”

-” আরে বস।সব কথা হবে।”

বলেই সে রান্না ঘরে চলে গেল।সাবিহার রাগে দাত কটমট করছে।খানিকটা রেগেই শুভকে বললো

-” দেখেছিস এই ছাগলকে। এর মধ্যে কোনো সিরিয়াসনেস নেই।”

-” তুই শান্ত হো।আমি কথা বলছি।”

একটু পরই রামিম তিন কাপ চা নিয়ে হাজির।রামিম মৃদু হেসে বললো

-” মায়ের মত ভালো চা বানাতে পারিনা।তবে ট্রাই করে দেখ আরজুর মতো সাংঘাতিক চা হবে না।”

রামিমের কথায় শুভ মৃদু হাসলো।তারপর গম্ভীর সুরে বললো
-“তুই জানিস সাবিহার বিয়ের কথা চলছে?”

রামিম একবার আড়চোখে সাবিহার দিকে তাকালো।সাবিহা চুপ চাপ মাথা নিচু করে বসে আছে।রামিম বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বললো যে

-” হুম ভালো তো।”

রামিমের কথায় সাবিহা অভিমানী চোখে রামিমের দিকে তাকালো।রামিম কে দেখে মনে হচ্ছে এই খবরটা সে আগে থেকেই জানে।সাবিহা বেশ রেগে চায়ের কাপটা ফেলে দিলো।মুহূর্তেই সেটি ভেঙে ফ্লোরে গড়াগড়ি খেতে লাগলো।শুভ সাবিহার হাত ধরে শান্ত হতে বললো।রামিমের দিকে তাকিয়ে বললো

-” রামিম আমার মনে হয় তোদের শান্ত হয়ে কথা বলা প্রয়োজন।আমার মত ভুল করে চিরদিন পস্তাস না।টেক ইট সিরিয়াসলি।”

বলেই শুভ রামিম দের বারান্দায় গিয়ে বসলো।পকেটে থাকা সিগারেটে আগুন ধরিয়ে সুখটান দিলো।এতে আদো সুখ আছে কিনা তার জানা নেই।তবে আজকাল বন্ধু মহলের সকলের ছন্নছাড়া জীবন দেখে ভয়েস চিন্তা হয়।জীবন তাদের জন্য কি রেখেছে কে জানে?

রামিম ভাঙ্গা কাপটার দিকে তাকিয়ে শান্ত হয়ে বললো
-” রাগ দেখিয়ে জিনিস পত্র ভাঙ্ছিস কেনো?আমার তোর মত বিত্তশালী বাবা নেই।একটা মা ছিলো সেও স্বার্থপরের মতো চলে গেছে।”

সাবিহা রাগে দিশেহারা হয়ে বললো

-” যারা ধরে রাখতে জানেনা তাদের ঠিক এই ভাবেই সব হারিয়ে যায়।তোর মতো খাপছাড়া মানুষের জীবনে থাকতে চাইলেও সেটা সম্ভব না।অবহেলা সব সম্পর্কের রঙকে ফিকে করে দেয়।”

-” বিয়ে করছিস ভালো কথা,আমার সাথে রাগ দেখাচ্ছিস কেনো?”

-” আমি বিয়ে করলে তোর কিছু আসে যায় না?”

রামিম স্বাভাবিক ভাবেই জবাব দিলো
-” না।আমার কি?”

-” তুই বলতে চাইছিস কোনো দিন আমার জন্য কিছু অনুভব করিসনি?”

-” না।আরজু,রিমি আর জারা আমার জন্য যেমন তুইও ঠিক তেমন।”

সাবিহা এই কথায় বেশ ক্ষিপ্ত হলো। রামিমের কলার চেপে ধরে চেঁচিয়ে বললো

-” তাহলে ওদের কেও কি কিস করেছিস? বল?”

রামিম হতবম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো।শুকনো ঢোক গিলে বললো

-” ফালতু কথা বলছিস কেনো? ওরা আমার বন্ধু।ওদের কিস কেনো করবো?”

-” তাহলে আমাকে কেনো করেছিস?”

-” দেখ সাবিহা এটা জাস্ট একটা মোমেন্ট ছিলো।তাছাড়া তুই আমাকে সিডিউস করেছিস।”

সাবিহা চোখ মুখ কালো করে ফেললো।রেগে বললো
-“আমার আফসোস হচ্ছে তোর মত ভীতু, কাপুরুষ কাউকে ভালোবেসেছি।বাবার সাথে আমি কার জন্য ফাইট করবো যেখানে আমার ভালোবাসার ভিত্তিটাই অর্থহীন।”

সাবিহা চোখের অশ্রু ফেলতে ফেলতে বেরিয়ে পড়লো।আর রামিম সেখানেই স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইলো।কয়েক মুহূর্ত পর রামিমের দুচোখ বেয়ে শীতল স্রোত নেমে গেলো।নিচের ঠোঁট কামড় নিজেকে শান্ত করলো।তার মতো এতিমদের বিলাসিতা মানায় না।সাবিহা তো বিলাসিতার পর্যায় পড়ে।এমন সচ্ছল পরিবারের মেয়েটা তার খড়কুটোর ঘরে সংসারের স্বপ্ন দেখছে।এই সংসারের কঠিন বাস্তবতা মেয়েটা জানে না।

শুভ দেখলো সাবিহা কাদতে কাদতে বের হয়েছে।শুভ দ্রুত সাবিহার কাছে এসে বললো

-” কীরে কাদছিস কেনো?কথা বলেছিস?”

-” ওর মতো কাপুরুষের সাথে আমি কোনো কথা বলতে চাইনা।আমার লাশ উঠে গেলেও নিজের মনের কথা প্রকাশ করবে না।রাস্কেল।”

শুভ সাবিহার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো
-” শান্ত হো।দেখিস সব ঠিক হয়ে যাবে।আমি ওর সাথে কথা বলবো।”

সাবিহা বাচ্চাদের মত কেঁদে উঠলো।আর বললো
-” রামিম টা এমন কঠিন হৃদয়ের কেনো? আমাকে এইভাবে কষ্ট কেনো দিচ্ছে?বাবাকে আমি কোন ভরসায় রামিমের কথা বলবো?যেখানে সে নিজেই এই সম্পর্কের কোনো নাম দিচ্ছে না।”

-” পরিস্থিতি ওকে এমন শক্ত হতে বাধ্য করেছে।তবে তুই চিন্তা করিস না।আমি ওর সাথে কথা বলবো।”

শুভ সাবিহাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। রামিমের উপর শুভর বেশ রাগ হচ্ছিল।যেখানে সাবিহা সবটা ছাড়তে প্রস্তুত সেখানে রামিম কেনো পিছিয়ে যাচ্ছে?
___________

মাঝে বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেল।নাঈম মাহমুদ অফিসের কাজে দেশের বাইরে ছিলেন।কিন্তু দেশে ফিরেই তিনি খবর পেলেন নাহিদ আর আরজুর ব্যাপারে।এমন একটা পরিস্থিতির ভয়টা তিনি আগে থেকেই পেয়েছেন।তিনি দেরি না করে গভীর রাতেই এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি নাহিদের বাসার দিকে রওনা দিলেন।ছেলেটা যে ঠিক নেই সেটা তিনি জানেন।বাসায় পৌঁছাতেই সুমি জানালো নাহিদের অনিয়মের কথা।ঠিক মত খাওয়া দাওয়া করেনা,রাতে ঠিক মত বাসায় ফেরেন না।সারাক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে থাকে।মাঝে মাঝেই রুম থেকে জিনিসপত্র ভাঙ্গার শব্দ আসে।সুমি ভয়ে সেখানে যেতে পারেনা।নাঈম মাহমুদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছেলের রুমের দিকে ছুটলেন।দরজা খুলেই দেখলেন অন্ধকার রুমটি সম্পূর্ণ ফাঁকা।সামনে এগিয়ে দেখলেন সুইমিং পুলের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে সিগারেটের ধোওয়া উড়াচ্ছে তার ছেলে।ছেলের মনের অবস্থা ঠিক ধরতে পারছেন তিনি।আরজুকে যে ছেলেটা অসম্ভব ভালোবাসে।এতদিন পর ছেলের জীবনে অনাকাঙ্খিত ভাবে আরজুর প্রবেশ দেখে তিনি বেশ খুশি ছিলেন।ছেলের চোখে মুখে সুখ ফুটে উঠত।কিন্তু আবার সেই অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে।তিনি নীরবে ছেলের পাশে বসে পড়লেন।নাহিদ চমকে পাশে তাকিয়ে বাবাকে দেখে হতবম্ব হয়ে পড়ল।নাঈম মাহমুদ নাহিদকে আরো চমকে দিয়ে নাহিদের হাত থেকে সিগারেট নিয়ে নিজের ঠোটে রাখলেন।নিঃশ্বাস টেনে বেশ কিছু ধোওয়া ছাড়লেন।নাহিদ স্তব্ধ হয়ে সবটাই দেখলো।বাবার সাথে তার কখনোই বন্ধুত্ব পূর্ণ সম্পর্ক ছিল না।নাঈম মাহমুদ হালকা কেশে বললেন

-” ভালো ব্র্যান্ড বাট বেশ ঝাজালো। ইটস হার্ম ইউ।”

নাহিদ কিছুই বললো না।চাঁদের আলোয় ঝলমল করা পানিতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।নাঈম মাহমুদ আবার বললেন

-” মনের ভাব প্রকাশ করতে না পারা মানুষ গুলো ভেতরে ভেতরে এই সিগারেটের মতোই পুড়তে থাকে।তুমি পলিটিক্সে নামবে জেনে আমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছি।কারণ আমি নিজে দেখেছি এই পথে কত শত বাধা।জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই।তুমি অনেক অল্প বয়সেই পলিটিক্সে নেমেছ।আমি ভেবেছি অন্য সবার মত তুমি বিগড়ে যাবে।ক্ষমতার অপব্যবহার করবে। অসৎ পথে ধাবিত হবে।উশৃঙ্খল জীবন যাপন করবে।হয়তো একসময় নারী দেহে আসক্ত হয়ে পড়বে। তুমি বেশ রগচটা সভাবের।নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারতে না।তাই ভেবেছি সর্বদা রাগের মাথায় সব ডিসিশন নেবে যা তোমার আর দেশের জন্য ভালো হবে না।মানুষের ঘৃনা নিয়ে বাঁচবে।সমাজে হয়তো আমাকে মাথা নিচু করে চলতে হবে।কিন্তু প্রতিটি মুহূর্তে তুমি আমাকে ভুল প্রমাণ করেছ।পলিটিক্সে থেকেও কি ভাবে নিজের ব্যক্তিত্বকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা যায় সেটা তুমি দেখিয়েছো।আজ সবার মুখে আমার ছেলের প্রশংসা আর জয়গান শুনে আমার বুক গর্ভে ভরে উঠে।আমার ছেলে বিপথে যায়নি দেখে আমি মুগ্ধ হই।কিন্তু কখনোই তোমাকে সেটা মুখ ফুটে বলতে পারিনি।আমি তো বাবা।তাই ছেলের নিরাপত্তার চিন্তা আমার মাথায় সবার আগে আসে।আমি এখনো চাই তুমি এসব থেকে বেরিয়ে এসে সাধারণভাবে জীবন যাপন করো।”

নাঈম মাহমুদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার বললেন

-“নাহিদ তুমি ছোটবেলা থেকেই ইন্ট্রোভার্ট ছিলে।তোমার মা মারা যাবার পর আরো শান্ত হয়ে পড়েছ।কখনোই তুমি নিজের মনের কথা অন্য কাউকে বলতে না।সব দুঃখ,কষ্ট,অস্থিরতা সবটাই একা ফেস করেছ।কাউকেই তুমি নিজের মনের অবস্থা মুখ ফুটে বলতে না।সেই অভ্যাস এখনো বিদ্যমান আছে।আমার সাথে সেই ছোটবেলা থেকেই তুমি দূরত্ব বজায় রেখেছ।কেনো তুমি নিজেকে অন্যের সামনে মেলে ধরতে পারছ না?আমাকে নাহয় ঘৃনা করো তাই বলে অন্য সবার কাছ থেকে কেনো নিজেকে আড়াল করে রাখছো?অন্য সবাই বাত থাক।অন্তত নিজের ভালোবাসার মানুষটির সামনে তো নিজেকে মেলে ধরবে?”

নাহিদের বুকের ভেতরের ঝড় যেনো জলোচ্ছাস হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে।বহুদিন পর বাবার সামনে তার সেই বাচ্চামো বেরিয়ে আসছে।সে আচমকাই বাবাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মত কেঁদে উঠলো।নাঈম মাহমুদ থমকে গেলেন।এতো বছর পর তার ছেলে তাকে এইভাবে জড়িয়ে ধরেছে।নাহিদ কাপা সরে বলে উঠলো

-“বাবা আমার ভালোবাসার মানুষ গুলো আমার কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।প্রথমে মা তারপর দাদাজান।আমি জীবনে আর কিছুই চাইনা।শুধু আরজুকে চাই।প্লিজ আমাকে আরজু এনে দাও।ওকে ছাড়া আমি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি।এই ঘরে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।সব জায়গাতেই আমার আরজুর স্মৃতি।আমি কাউকেই আমার মনের অবস্থা বলতে পারছিনা।আমি তো আরজুকে আমার জীবনে চাইনি।এতো কিছুর পর ওকে চাওয়ার সাহস আমার হয়নি।কিন্তু এক ঝোড়ো হাওয়ার মত সে আর জীবনে এসেছিলো।আমাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়ে আবার হারিয়ে গেলো।ওকে ছাড়া তখন বাঁচতে পারলেও এখন আমার জন্য জীবন দূর্বিসহ হয়ে দাঁড়িয়েছে।আমি এতটাই অসহায় যে ওকে জোর খাটিয়ে আটকে রাখতে পারছি না।নিজের কাছে বেধে রাখতে পারছি না।না ওকে বলতে পারছি “আমার ওকে চাই।” আরজুকে ছাড়া আমার জন্য এক একটা দিন যেনো হাজার বছরের সমান।আমাকে কি একটাবার ক্ষমা করা যায়না? আজ এই অপরাধবোধে আটকে না থাকলে আমি আরজুকে কখনই আমার কাছথেকে আলাদা করতাম না।মাকে হারিয়ে আমি তোমাকেও হারিয়ে ফেলেছি।সেই একাকীত্বের জীবনে বসন্ত হয়ে আমার জীবনে আরজু এসেছে।ওকে হারানোর শোক আমি সইতে পারবো না।বেশ জোর গলায় ওকে বলে এসেছি শেষ নিঃশ্বাস অব্দি ওর জন্য অপেক্ষা করবো।কিন্তু ওকে ছাড়া যে আমি নিঃশ্বাস বন্ধ হয়েই মারা যাবো।ওকে এনে দাও।আমার বউটাকে এনে দাও।প্লিজ!!”

নাঈম মাহমুদের ছেলের বাচ্ছামো আবদার শুনে গলা শুকিয়ে আসলো।বুকে তীব্র যন্ত্রণা হলো নিজ সন্তানের হাহাকার শুনে।এতো বছর পর ছেলেটা তার কাছে এমন কিছু আবদার করছে যা চাইলেও খেলনার মত সামনে হাজির করা যায়না।ক্ষমতার জোরে আরজুকে হয়তো ধরে বেধে ছেলের সামনে দাড় করানো যাবে কিন্তু তাতে কি ছেলের মন শান্ত হবে? কখনোই না। এখন আবেগী হয়ে এমন আবদার করলেও তিনি তার ছেলের ব্যাক্তিত্বকে বেশ ভালো করেই চেনেন। জোর খাটিয়ে সে কিছুই হাসিল করার ছেলে না।আরজু মন থেকে তার কাছে ফিরে না আসলে ছেলেটা কখনোই আরজুকে বিরক্ত করতে যাবে না।

তিনি পরম আদরে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।তার ছেলেটা ভালোবেসে কখনোই অগ্রেসিভ আচরণ করেনি।কয়জন প্রেমিক পারে নিজের প্রিয়তমাকে এমন স্বাধীনতা দিতে?তিনি নিজেই হয়তো পারতেন না।সর্বোচ্চ ক্ষমতা থাকেলও প্রিয়তমার উপর নাহিদ বিন্দু মাত্রও ক্ষমতার প্রয়োগ করেনি। ইসস!! এতো বছর ছেলেটা তার বুক খালি করে অভিমান নিয়ে বসে ছিল।ছেলের বুকের ভেতর চলা উত্তাল ঢেউ তিনি বেশ বুঝতে পারছেন।নিজের ইগো ভুলে ছেলেকে যদি আগে বুকে জড়িয়ে নিতেন তবে হয়তো আরো আগেই তাদের দূরত্ব কমে যেতো।
_______________

সাবা খানম আরজুর রুমের দরজায় টোকা দিলেন।আরজু তখন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ার টেবিলে বসে ছিল।মাথায় চলছিল হাজারো ভাবনা।খালামণিকে দেখে মৃদু হেসে বললো
-” ভেতরে এসো খালামণি।”

-” তোর পরীক্ষা কবে থেকে?”

-” এইতো কয়দিন পর থেকেই।”

সাবা খানম কিছুক্ষণ হাসফাস করলেন।আরজু বইয়ে দৃষ্টি রেখেই বললো
-” কি বলবে বলে ফেলো।”

সাবা খানম শুকনো ঢোক গিলে বললেন

-” আপা মারা যাওয়ার পর থেকেই তোকে আমি নিজের মেয়ের মতো বড়ো করেছি।আমার একটাই উদ্দেশ্য ছিল তোকে জীবনে সুখী দেখা।আমি তোর ফিউচার নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিলাম।আর তোর জীবনে নাহিদকে দেখে আমার ভয়ের সীমা ছিলো না।তোর জীবনে নাহিদ আসার পর থেকেই তোকে আমি অন্য রকম দেখেছি।যেনো পৃথিবীর সবচাইতে সুখী মেয়েটি তুই।আমি আসলেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না নাহিদ তোকে এতটা সুখে রেখেছে। তোর আর নাহিদের মধ্যকার সম্পর্কের দূরত্ব যদি হয়ে থাকে অতীতের ঘটনা তবে আমি বলবো ভুল করছিস।অতীতের ভুলের জন্য বর্তমান আর ভবিষ্যৎকে এভাবে নষ্ট করার কোন মানেই হয় না।নাহিদকে আমি অনেক বছর ধরেই দেখছি।ছেলেটা আমার সকল ভুল ধারণা ভেঙে দিয়েছে।ছেলেটার ধৈর্য্যশীল আচরণ আমাকে অবাক করেছে।যেই ছেলে নিজের ভালোবাসার প্রতি এতটা ধৈর্য ধারণ করতে পারে সে নিঃসন্দেহে চমৎকার পুরুষ।আর সেই চমৎকার পুরুষটি একান্ত তোর নিজের।

তোকে আমি সবসময় স্বাধীনতা দিয়েছি।আর নাহিদ তোকে আমার চাইতেও বেশি স্বাধীনতা দিয়েছে।বিয়ের পর কয়টা মেয়ে পারে এমন স্বাধীন ভাবে চলতে?অন্তত একজন নেতার বউ কখনোই পারেনা।শুধুমাত্র তোর নিরাপত্তার কথা ভেবে সে একজন গার্ড নিয়োগ করেছে।কিন্তু সেই গার্ডকে তোর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে দেয়নি।আমি জানি তুই বুদ্ধিমতী মেয়ে।পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে তুই সঠিক সিদ্বান্ত নিতে পারবি।তোকে আমার পক্ষ থেকে কোনো প্রেসার দেওয়া হবে না।তুই যা ডিসাইড করবি সেটাই হবে। তবে আমি বলবো নাহিদের সাথে তুই ভীষণ সুখী হবি।কারণ ছেলেটা জানে তোর সুখ কিসে।তুই সময় নিয়ে সিদ্বান্ত নে।কোনো জলদি নেই।আমি মা হিসেবে তোকে শুধুমাত্র গায়েড করতে পারবো কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্বান্ত তোর।”

আরজু গাল বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে বইয়ের পাতা ভিজিয়ে দিলো।সাবা খানম আরজুর অশ্রু মুছে দিয়ে বললো

-” একদম কাদবি না।আমার মেয়ের চোখে কাজল মানায় অশ্রু না।আমি সেই আগের চটপটে আরজুকে দেখতে চাই।এমন মনমরা আরজু আমার একদম পছন্দ না।দেখতে ভীষণ বাজে দেখায়।”

আরজু অশ্রু সিক্ত চোখে হাসলো।অবনি দরজায় দাড়িয়ে সবটাই শুনছিল।আজকাল আরজু আপুর মলিন মুখ দেখে তারও অস্থির লাগে।বাসায় সে কতশত অদ্ভুদ কাণ্ড করে আরজু আপুকে হাসানোর জন্য।কিন্তু আপুর মুখের পার্মানেন্ট হাসি একজনই ফুটাতে পারবে।
_____________

দেখতে দেখতে আর্যুদের ফাইনাল ইয়ারে ফাইনাল এক্সাম চলে এসেছে।সাবিহার বাবা মেয়ের পরীক্ষার কথা ভেবে আপাদত বিয়ের বিষয়ে চুপ থাকলেও সাবিহা জানে পরীক্ষার পর বাবা কোমর বেধে বিয়ের জন্য নামবেন।অন্যদিকে রামিম আজকাল সাবিহার সাথে একদমই কথা বলে না।সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলে।

একদিন সন্ধায় নাঈম মাহমুদ আরজুর সাথে দেখা করে গেছেন।পূর্বের ঘটনার জন্য মাফ চেয়েছেন।কিন্তু ছেলের কাছে ফিরে যাবার কোনো অনুরোধ করেননি।সেটা সম্পূর্ণ আরজুর উপর ছেড়ে দিয়েছেন।সেই সাথে আরজুকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।তিনি বেশ ভালো করেই জানেন ছেলের মন তার প্রতি এতো নরম হওয়ার পেছনে আরজু ছিলো।আরজু এই মানুষ গুলোকে চাইলেও ঘৃনা করতে পারছে না।না নাহিদকে আর না তার পরিবারকে।এই মানুষ গুলো তাকে এতো ভালোবাসা আর সম্মান দিয়েছে যে চাইলেই এদের অগ্রাহ্য করা সম্ভব হয়না।

আরজু জানে প্রায় রাতেই নাহিদের গাড়ি তার জানালার সামনের রাস্তায় দাড়িয়ে থাকে।আগে আরজু কিশোরী ছিলো।তখন নাহিদের এই বিষয় গুলি ধরতে পারেনি।কিন্তু বর্তমান আরজু পূর্ণ নারী।সে বুজে তার স্বামীর উপস্থিতি। দমকা হাওয়ায় ভাসা মিষ্টি সুবাস নাহিদের উপস্থিতির জানান দেয়।আরজু মাঝে মাঝে বারান্দায় দাড়িয়ে সেই মানুষটিকে ধরা দেয়।আবার মাঝে মাঝে লুকিয়ে আড়াল থেকে কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে দেখে। এ যেনো কোনো লুকোচুরি খেলা চলছে।

অবনি আজ মন খারাপ নিয়ে নিশানকে কল করলো।সে এখনো নিশানকে পরিচয় লুকিয়ে মাঝে মাঝেই কল করে।লোকটার ভেবাচেকা খাওয়া মুখটা দেখতে পেলে ভালো হতো।নিশান কল ধরতেই অবনি বললো

-“আপনি আমাকে একদমই ভুলে গেছেন।”

-“বল কি?আমার কবুল না বলা বউ তুমি।ভুলবো কি করে?অন্তত তুমি কিছুদিন পর পর তো মনে করিয়ে দিতে একদমই ভুল করো না।”

-” মজা নিচ্ছেন?”

-” মোটেও না।আচ্ছা তোমার কী মন খারাপ পিচ্ছি?”

অবনি ঘাবড়ে গেল।তাকে পিচ্ছি বলছে? তার মানে নিশান তাকে আগেই চিনে ফেলেছে?অবনিকে চুপ থাকতে দেখে নিশান বললো

-” আজ পিচ্ছি বলার পরও চুপ হয়ে গেলে যে?আমিতো ভাবলাম নিশ্চই কোনো সাইক্লোন ধেয়ে আসবে আমার দিকে।”

-” হুম বুজলাম!! রোবট মানব বেশ চতুর।”

নিশান মুচকি হাসলো।ভাবতে অবাক লাগে এই পিচ্ছিটাকে তার ভালো লাগে।অসম্ভব ভালো লাগে।নিশান বললো

-” এডমিশন টেস্ট কবে তোমার?”

-” কয়দিন পর।আমি এখন ভার্সিটির স্টুডেন্ট তাই মোটেও আমাকে পিচ্ছি বলবেন না।”

-” আমার বয়সের তুলনায় তুমি পিচ্ছি থাকবে।”

-” আপনি যেহেতু এতই বুড়ো তাহলে বিয়ে করে নিচ্ছেন না কেনো?”

-“এতদিন কাউকে মনে ধরেনি তাই।তবে এখন মনে হচ্ছে আরো কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে।”

অবনি লাজুক হাসলো।আর বললো
-” কয়েক বছর পর কি কাউকে মনে ধরবে?”

-” হয়তো একজনকে মনে ধরেছে কিন্তু তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।”

অবনির সারা শরীর শিউরে উঠলো।নিচের ঠোঁট কামড়ে বললো
-“শুনেছি অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়।”

নিশান আজ প্রথম শব্দ করে হেসে উঠলো।এই পিচ্ছিটা তার নিরামিষ জীবনে হাজারো রং ঢেলে দিয়েছে।এমন পিচ্ছি সারা ঘরে তিড়িং বিড়িং করে ঘুরে বেড়ালে মন্দ হয়না।অন্যদিকে অবনি মনে মনে বির বির করলো

-“এইবার আমার মা নির্ঘাত একটা মিনি হার্ট অ্যাটাক করবে।তার মেয়েরাই যত দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ড করে বেড়ায়।”

তবে সেও আরজুর বোন।নিজের ভালোবাসাকে নিজের না করে দম নিবে না।তবে আরজু আপুর মতো এতো কঠিন হৃদয়ের সে হবে না।নাহিদের সাথে অবনির নিয়মিত যোগাযোগ হয়।আরজুর খোঁজ খবর সবটাই অবনি নাহিদকে দেয়।
________

দেখতে দেখতে আরজুদের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলো।আরজুদের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হতেই সাবিহার বাবা তার বিয়ের দিন ধার্য করে ফেললেন।সব কিছু এতই দ্রুত হচ্ছিল যে সাবিহা কি করবে বুজে উঠতে পারছিলো না।সাবিহা এই নিয়ে বিরোধিতা করলেও তিনি সেটা শুনতে নারাজ।আরজু আর বাকি সবাই সাবিহার বাবাকে বুজাতে চেষ্টা করলেও কোনো কাজ হয়নি।তিনি নিজ সিদ্বান্ত অনড়।তাছাড়া তারা রামিমের ব্যাপারেও জোর দিয়ে কিছু বলতে পারেনি।কারণ রামিম নিজেই এসব বিষয় নিয়ে একদম মাথা ঘামাচ্ছে না।কেমন গা ছাড়া ভাব।বন্ধু মহলের সকলের কাছ থেকেই সে দূরত্ব বজায় রেখেছে।রামিম না ঠিক মতো বাসায় ফিরে আর না বন্ধুদের সাথে কোনো যোগাযোগ করে।সাবিহার জীবনে যেনো এক দুর্বিষহ নেমে এসেছে।মেয়েটার মনে রামিমের জন্য ভীষণ অভিমান জমা হয়েছে।এমন কঠিন হৃদয়ের পুরুষটিকে মন দিয়ে আজ এতো কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে।শুভ আর ফুয়াদ এসবে রামিমের উপর ভীষণ ক্ষিপ্ত।সামনের সপ্তাহেই সাবিহার বিয়ে আর ছেলেটার কোনো হেলদোল নেই।রামিম একবার বললেই তারা সেই মুহূর্তেই দুজনকে এক করে দিতে প্রস্তুত।

একদিন রাতে তারা রামিমের বাসার সামনে অপেক্ষা করছিল।রামিম বাসায় ফিরলো বেশ রাত করে।শুভ আর ফুয়াদকে ক্ষিপ্ত মেজাজে দেখে বললো

-” এতো রাতে তোরা আমার বাসায় কি করছিস?আয় ভেতরে আয়।”

তারা বাসার ভেতরে ঢুকেই ফুয়াদ রামিমের গালে বেশ কয়েকটা চর মেরে বসলো।শুভ আর রামিম দুজনেই হতবাক।কারণ তাদের বন্ধুত্বে অনেক খুনসুটি হলেও কখনোই রেগে কেউ কারো গায়ে হাত তুলেনি।ফুয়াদ রামিমের কলার টেনে ধরলো।বেশ ক্ষিপ্ত মেজাজ নিয়েই বললো

-” শালা মজা নিচ্ছিস? সবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ রেখে কি বুজাতে চাইছিস?বাসায় থাকিস না,কল পিক করিসনা, পেয়েছিস কি?নাকি আমাদের তোর জীবনে কোনো প্রয়োজন নেই? কোথায় থাকিস কি করিস কিছুই বলছিস না।তোর জন্য মেয়েটা কেঁদে কেটে শেষ হয়ে যাচ্ছে।কাউকে ভালোবাসতে পারবি আর তাকে নিজের করার সাহস নেই? কাপুরুষ একটা।তোর জন্য যদি সাবিহা উল্টাপাল্টা কিছু করে বসে তবে আমার চাইতে খারাপ আর কেউ হবে না।তোর সাথে সব বন্ধুত্ব তখনই শেষ করে দিবো।”

শুভ ফুয়াদকে টেনে সরিয়ে আনলো।আর তাকে শান্ত হতে বললো।তারপর রামিমের দিকে তাকিয়ে শুভ গম্ভীর স্বরে বললো

-” আন্টি নেই বলে তুই যা খুশি করে বেরাবি সেটা মানবো না।তুই আমাদের দায়িত্ব।আজকাল কি করছিস কিছুই বুঝতে পারছি না।আন্টি সাবিহাকে পছন্দ করত।নিজের ছেলের বউ হিসেবেও দেখতে চেয়েছে।আজ যখন তোর ভালোবাসার মানুষটির তোকে প্রয়োজন তুই হাত গুটিয়ে কেনো বসে আছিস? আরজু নাহয় আমাকে কখনই একজন প্রেমিক রূপে ভালোবাসেনি কিন্তু সাবিহা!! আমরা সবাই জানি তোদের মধ্যোকার কি চলছে।মেয়েটা আজ চার বছর যাবত তোকে ভালোবাসে।তোর মুখ থেকে একটাবার ভালোবাসার কথা শোনার জন্য মেয়েটা ব্যাকুল হয়ে আছে।আর তুই কত সহজে মেয়েটার ভালোবাসা তুচ্ছ করে যাচ্ছিস।সময় থাকতে প্রিয়জনের মূল্য দিতে হয়।কারণ একবার হারিয়ে গেলে তাকে কখনোই ফিরে পাওয়া যায়না।”

ফুয়াদ খেয়াল করলো ফ্লোরে রামিমের কাধের ব্যাগটি পড়ে আছে।হয়তো তখন গায়ে হাত তোলার সময় পড়ে গেছে।কিন্তু ফুয়াদের চোখ আটকে আছে ব্যাগের ফাঁকে বের হাওয়া একটা জিনিসে।ফুয়াদ নিচু হয়ে সেটা তুলতেই চমকে গেলো।শুভকে ডেকে সেটা দেখলো।দুজনেই প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি নিয়ে রামিমের দিকে তাকিয়ে রইলো।