মিষ্টি রোদের হাতছানি পর্ব-৭৮+৭৯

0
1033

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_78

সময়ের সাথে সাথে মানুষের মধ্যে নানান পরিবর্তন আসে।বিশেষ করে কিশোরী থেকে যৌবনে পদার্পণের সময়।এই সময়টায় জীবন ভীষণ রঙিন মনে হয়।চেনা জানা পৃথিবীটা যেনো স্বপ্ন পুরীতে পরিণত হয়।অবনির ক্ষেত্রেও অনেক পরিবর্তন এসেছে।সদ্য ভার্সিটিতে উঠা মেয়েটার মধ্যে যেনো চঞ্চলতার কোনো কমতি নেই। বাচ্চামো কমে আসলেও দুষ্টুমিতে সেই আগের মতোই।নতুন ভার্সিটিতে এক গাদা বন্ধু বান্ধব হয়েছে তার। নতুন বন্ধুমহল নিয়ে সে দারুন সময় পার করছে।

মায়ের কড়া চাপে পড়ে এইচ এস সি পরীক্ষায় বেশ ভালো রেজাল্ট করেছে অবনি।সেই ভালো রেজাল্টের জন্য নাহিদ তাকে বেশ বড়ো ট্রিট দিয়েছে।অবনি অবশ্য একজন বিশেষ মানুষের কাছ থেকেও ট্রিট পেয়েছে।

নিশানের সাথে তার নিয়মিত যোগাযোগ হয়না।মূলত নিশান অবনীকে খানিকটা এড়িয়ে চলে।একে মেয়েটা ছোট।এই বয়সের ছেলেমেয়েরা প্রচন্ড আবেগী হয়ে থাকে।নিশান চায়না মেয়েটা আবেগের বশে কোনো ডিসিশন নিক।তাদের মধ্যে কোনো প্রেমের সম্পর্ক না থাকলেও একটা অদৃশ্য প্রেম দুজনের মধ্যে বিরাজ করে।দুজন বুঝতে পাড়ে অপরজন তার প্রতি দূর্বল কিন্তু সেই দুর্বলতা কেউ প্রকাশ করে না।নিশান খেয়াল করেছে ইদানিং মেয়েটা তাকে খুব একটা কল করে ডিস্টার্ব করেনা।নিশান যদিও এমনটাই চাইতো।কারণ এই নতুন আবেগে হারিয়ে মেয়েটার স্টাডিতে কোনো ইফেক্ট পড়ুক সেটা সে চায় না। তাছাড়া অবনির এই আবেগ ক্ষণস্থায়ী কিনা সেটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন আছে।এই বয়সে এসে বাচ্চা মেয়ের জন্য দেবদাস হওয়ার কোনো মানে হয়না।তাই অবনির কল সে প্রায় ইগনোর করে।মেয়েটা প্রায় সময় কল করে ক্লান্ত হয়ে পড়ে।নিশান কখনো অফিসে আবার কখনো বাসায় নানান কাজে নিজেকে ব্যাস্ত রাখে।

কিন্তু আজ বাচ্চা মেয়েটাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে।তাই নিশান দ্রুত হাতের কাজ শেষ করে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়লো।অবনির ভার্সিটির গেটেই অপেক্ষা করতে লাগলো।প্রায় বেশ কিছু সময় পর অবনি বের হলো। বন্ধু বান্ধবের সাথে হাসি মুখে গল্প করতে করতে বের হচ্ছে।নিশানের মনে হচ্ছে সেই বাচ্চা মেয়েটা হঠাৎ করেই অনেকটা বড়ো হয়ে যাচ্ছে।অবনি নিশানের সামনে দিয়েই এগিয়ে গেলো।যেনো দেখেও না দেখার ভান করছে।নিশানের চোখ মুখ কুচকে গেলো।অবনি তাকে ইগনোর কেনো করছে? বেশি রাগ করেছে নাকি? নিশান চিন্তিত ভঙ্গিতে অবনীকে পেছন থেকে ডাকলো।নিশানের ডাক শুনে অবনি পেছন ফিরে তাকালো।আর অবাক হওয়ার ভান করে বললো

-“আরে আপনি?”

নিশান খানিকটা অপ্রস্তুত বোধ করলো। এখানে এসে তো পড়েছে কিন্তু কেন এসেছে অবনীকে কি বলবে? গলা পরিষ্কার করে বললো

-“এদিকে একটা কাজে এসেছিলাম হঠাৎ তোমাকে দেখতে পেলাম।”

-“তাই নাকি?”

তার বলা মিথ্যাটা অবনি একদম বিশ্বাস করেনি সেটা তার মুখ দেখেই বুঝা যায়।নিশান আবার বললো

-” তোমার সময় হবে পিচ্ছি? কোথাও বসে কফি খাই।”

অবনির পাশে দাড়ানো বন্ধুরা ফিসফিস করে বললো
-” এই হ্যান্ডসাম পাঠা কে রে?”

অবনি বাঁকা হেসে বললো
-” আমার ফিউচার পাঠা থুক্কু বাচ্চার অভিভাবক।”

-” মানে?একমিনিট এটাই তোর সেই রোবট মানব?”

-“হুম।”

-” ওয়াও জোস তো।এই পাঠাই আমাদের কিউট অবনীকে ইগনোর মারে?”

অবনি বাঁকা হেসে বললো
-” অনেক দিন হয় এই রোবট মানবকে জব্দ করিনা।”

কথাটা বলেই তারা সকলেই দুষ্টু হাসি হাসলো।অবনি হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো

-“কফি সম্ভব না।আমাদের ভীষণ খুদা লেগেছে।লাঞ্চ করবো।”

নিশান মুচকি হেসে বললো
-” আচ্ছা চলো তোমাদের লাঞ্চ করাবো।”

-” ভেবে বলছেন তো?”

-“হুম।”

রেস্টুরেন্টের সবচাইতে বড়ো টেবিলে চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছে নিশান।অবনি আর তার আট জন বন্ধুবান্ধব এক গাদা খাবার অর্ডার করেছে।সেটাই মনের আনন্দে ঠুসছে তারা।নিশান মনে মনে ভাবছে এই মেয়ে সাংঘাতিক।প্রথম এই মেয়েকে কফির অফার করেছিলো।কিন্তু একবারেই তার পুরো পকেট ফাঁকা করে ছাড়লো।আর জীবনেও সে অবনীকে কফির অফার করবে না।যথেষ্ঠ শিক্ষা হয়েছে তার।তার কষ্টে কমানো পয়সা এই মেয়ে বন্ধু বান্ধব নিয়ে খেয়ে উড়াচ্ছে।খাওয়া শেষে চরা বিল দেখে নিশানের চোখ খুলে আসার জোগাড়।মনে পাথর বেধে সে কার্ডের মাধ্যেমে বিল পে করলো।কারণ এতো ক্যাশ তার কাছে ছিলো না।একে একে অবনির সব বন্ধু বান্ধব বিদায় নিলো।অবনি ধন্যবাদ জানিয়ে উঠতে গেলে নিশান বললো

-” অবনি আমাকে কি ইগনোর করছ?আজকাল তেমন যোগাযোগ করছো না।”

অবনি কাধের ব্যাগ চেপে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো
-” আপনি তো এমনটাই চাইতেন।আমি বাচ্চামো করি,দুষ্টুমি করি এটা ঠিক।কিন্তু অন্যদিকে আমি ভীষণ বাস্তববাদীও বটে।আবেগে ভেসে পাগলামি করার মেয়ে আমি না।আপনি যেহেতু চাননা আমি আপনার সাথে যোগাযোগ রাখি তাহলে তাই হবে।”

নিশান ঘামতে লাগলো।মনে হচ্ছে তার সামনে একজন ম্যাচিওর নারী দাড়িয়ে আছে।নিশান বুঝতে পারলো এই কঠিন কথার আড়ালে অবনির অভিমান লুকিয়ে আছে। এই প্রথম নিশান অনুভব করল অবনি তার প্রতি প্রচণ্ড রকমের অধিকার বোধ দেখায়।আর যেটা নিশানের ভীষণ রকমের ভালো লাগে।সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো

-” আমি আসলে বুঝতে চাইছিলাম এসব তোমার আবেগ কিনা? তুমি এখনো অনেক ছোট অবনি।জীবনের নতুন একটা অধ্যায়ে পা রেখেছো। চলার পথে এমন অনেক মানুষের সাথে তোমার সাক্ষাৎ হবে।যাদের দেখে তুমি বিমোহিত হবে।যাদের প্রতি তুমি আকৃষ্ট হবে।তখন যেন তুমি আফসোস না করো যে অল্প বয়সে তুমি আবেগে ভেসে গেছো।আর আমি তোমার সেই আবেগের সুযোগ নিয়েছি।”

অবনির মুহূর্তেই ভীষণ রাগ হলো।সেই রাগের কারণে তার নাকের ডগা বার বার ফুলে উঠলো।নিশান ফিল করলো সামনের এই রমণীর রাগান্বিত মুখ তার বুকে ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে।এই প্রথম সে বুঝতে পারলো বয়স্ক লোকেরাও কেনো বাচ্চা বাচ্চা বউকে ভয় পায়।অবনি রেগে বললো
-” আপনার মনে হয় আমার আবেগ,অনুভূতি বসন্তের মতো।যা কিছুদিন থেকেই উধাও হয়ে যায়?আবার নতুন বসন্ত এলে অন্যত্র আকর্ষিত হয়?”

-” রিলেক্স পিচ্ছি।আমি তেমন ভাবে বলিনি।ওকে সরি আর কখনো তোমাকে ইগনোর করবো না।”

অবনি মুখ বাঁকিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো।প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তার।এই রোবট মানব তাকে নাকে চরকি দিয়ে ঘুরাবে সেটা মোটেই হতে পারে না। সেও আরজুর বোন।আপু যদি এক নেতাকে বেকায়দায় ফেলতে পারে তবে তার জন্য এই বেহুদা ইঞ্জিনিয়ার কি জিনিষ?নিশান পড়েছে বড়ো ঝামেলায়।কি করলে এই অভিমান ভাঙবে?সে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দুই হতে কান চেপে ধরে বললো

-” সরি।প্লিজ মাফ করুন ম্যাডাম।”

অবনির এবার ভীষণ হাসি পাচ্ছে।এই রোবট মানবকে এই অবস্থায় দেখে তার যেনো কলিজা ঠান্ডা হয়ে গেলো।তাকে এতদিন এড়িয়ে চলেছে কিন্তু এইবার তার পালা।এই লোককে আজীবন এই ভাবে জব্দ করবে সে।অবনি দ্রুত নিশানের সেই কানে ধরা অবস্থার ছবি তুলে নিলো।নিশান হতবম্ব হয়ে বললো

-” এটা কি হলো? ছবি কেনো তুললে?”

অবনি কপাল চুলকে নিশানের কাছাকাছি দাড়িয়ে মুচকি হেসে বললো

-” এবার থেকে বেশি তেরিবেরি করলে এই ছবি ভাইরাল করে দিবো।আমাকে ইগনোর করার মজা বুঝবেন।”
নিশান হা করে তাকিয়ে রইল। এ কি সাংঘাতিক মেয়েরে বাবা!! এই সাংঘাতিক মেয়েকে বাবার সামনে কি করে দার করাবে?এই মেয়েকে তাদের বাড়িতে নিয়ে গেলে এই সাংঘাতিক মেয়ের খপ্পরে পড়ার অপরাধে বাবা তাকে শুট করে দিবে।
____________

লামিয়া একটা পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে।এটা যেনো তার কাছে স্বপ্নের মতো। এতো ঝড় ঝাপটা মধ্যে দিয়ে সে পরীক্ষা দিয়েছে।তাই চান্স পাওয়াটা তার জন্য আশ্চর্য জনক।নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তা তার উপর সহায় ছিলেন।সেদিন ফুয়াদ হুট করেই মিষ্টি নিয়ে তার বাসায় হাজির হয়েছিল।লামিয়া চেয়েও মানুষটির সাথে রাগ দেখাতে পারেনি।এই ছেলেটার প্রতি সে দুর্বল।

পাবলিক ভার্সিটিতে পড়ার কারণে তার বেশ কিছু টিউশন পেতে বেগ পেতে হয়নি।মাত্রই টিউশন থেকে ফিরে এসে শাওয়ার নিয়ে নিলো। এখন ভীষণ ফ্রেস লাগছে।লামিসা তখন টিভি দেখতে ব্যস্ত। তখনই দরজায় কেউ নক করলো।লামিয়া গায়ে ওড়না জড়িয়ে দরজা খুলে দিল।কিন্তু অপর পাশের মানুষটিকে দেখে ঠিক চিনতে পারলো না।কোথাও যেনো দেখেছে ঠিক মনে করতে পারছে না।তবে সামনের মানুষটির দিকে সম্মোহন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সবুজ জামদানি শাড়িতে সামনের নারীটিকে মারাত্বক সুন্দর লাগছে।মেয়েটি মিষ্টি হেসে বললো

-“হাই!!তুমি লামিয়া তাইনা? দারুন মিষ্টি তো দেখতে!!”

লামিয়া ভরকে গেল।অতি রূপবতী কোনো নারী তাকে হুট করে মিষ্টি বলছে ব্যাপারটা কেমন অদ্ভুদ।লামিয়ার চিন্তিত মুখ দেখে বললো

-” ভেতরে আসতে পারি?”

লামিয়া ভাবছে এমন করে অপরিচিত কাউকে ভেতরে আসতে দেওয়া ঠিক না।কিন্তু মেয়েটিকে কোনো ভাবে বিপদজনক মনে হচ্ছে না।কি মায়াবী চেহারা।সে দ্বিধা নিয়ে বললো

-” জি আসুন।”

মেয়েটি ভেতরে এসে চটপট করে বললো
-” এর পর থেকে অপরিচিত কাওকে বাসায় আসতে দিবে না বুঝলে?”
লামিয়া কি বলবে বুঝতে পারলো না।আসলেই তার এমন করা ঠিক হয়নি।তাই প্রশ্ন করলো

-” আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না।”

মেয়েটি মুচকি হেসে বললো
-” আমি আরজু।তোমার সাথে আমার একটা কানেকশন আছে।”

আরজু নামটা লামিয়ার কাছে ভীষণ পরিচিত মনে হলো।কোথাও শুনেছে মনে হয়।লামিসা সোফা থেকে এই দিকে এসে দাড়ালো।আরজুকে দেখে সে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে রইলো।লামিসার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো
-” আপু এই আপুটা কে? কি সুন্দর দেখতে!!”

আরজু লমিসার এক গাল টেনে বললো

-” তুমি তো তোমার আপুর চাইতেও বেশি কিউট। মাশাআল্লাহ।”

দুই বোন এই চঞ্চল নারীর সামনে বোকার মতো দাড়িয়ে রইলো।আরজু আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বললো

-” আমরা কি বসতে পারি।এক গ্লাস পানি খাওয়াতে পারবে?”

সোফায় মুখোমুখী বসে আছে তারা।আরজু নিরবতা ভেঙে বললো

-” আমার বাবার নাম সাদাত হাসান।আর আমার মা সাবরিনা খানম।তারা যেই অফিসে জব করতেন তোমার বাবা সেই অফিসেরই ড্রাইভার ছিলেন।”

লামিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।আরজু আবার মলিন মুখে বললো

-” যেই এক্সিডেন্টে তোমার বাবা মারা গিয়েছিল, ঠিক সেই এক্সিডেন্টে আমি আমার বাবা-মা দুজন কেই হারিয়েছি। সেদিন সেই গাড়িতে তোমার বাবা ছাড়াও আমার মা আর বাবা উপস্থিত ছিলেন।আমার মা তো সেখানেই স্পট ডেথ ছিলেন। জানো আমার মা তখন ফোর মান্থ প্রেগনেন্ট ছিলেন।তিনি বেচেঁ থাকলে হয়তো তোমার মতো কোনো ছোট বোন বা ভাই আমার থাকতো।”

বলেই আরজু চোখের অশ্রু মুছে নিলো।এই স্মৃতি সর্বদাই আরজুকে তীব্র আঘাত করে।

আরজুর কথায় লামিয়া,লামিসা দুজনই অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে রইলো।তাদের মতো এই মেয়েটিও তাহলে এতিম।আরজু আবার বললো

-” তোমরা নিশ্চই ভাবছ এতো বছর পর কেনো তোমাদের খবর নিচ্ছি?আসলে বাবা মা দুজনকে হারিয়ে আমি ছন্নছাড়া হয়ে পড়েছিল।তখন আমার আশেপাশে কি ঘটছিল কিছুই জানতাম না।আমি তখন নিজের মধ্যে ছিলাম না।দীর্ঘদিন ডিপ্রেশনের ছিলাম।সেখান থেকে বের হতে আমার অনেক সময় লেগে গেছিলো।তোমাদের বিষয়ে আমি জানতাম না এতদিন।তাছাড়া আমি তখন অনেক ছোট ছিলাম।তোমাদের বিভৎস দিন গুলোতে সাহায্য করতে পারিনি।তাই ভীষণ দুঃখিত।”

লামিয়া অশ্রু মুছে নাক টেনে নিঃশ্বাস নিয়ে বললো

-” আপনি সরি কেনো বলছেন আপু? আপনার কোনো দোষ নেই।আপনার বয়সই বা কতো ছিলো? আপনি নিজেই তখন একটা ট্র্যাজেডির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন।”

আরজু এবার গলা পরিষ্কার করে আড়চোখে তাকিয়ে বললো

-” আমার আরো একটা পরিচয় আছে।আমি নিবরাস নাহিদের ওয়াইফ।”

কথাটা যেনো মুহূর্তেই লামিয়ার মস্তিষ্ককে আঘাত করলো।সে বিস্ফোরিত চোখে আরজুর দিকে তাকিয়ে রইলো।আরজু সেই দৃষ্টিতে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো

-“আমি জানি তুমি কি ভাবছো।নিজের বাবা মায়ের মৃত্যুর কারণ যেই ব্যাক্তি,তাকে কি করে বিয়ে করলাম?আসলে লামিয়া সময় আর পরিস্তিতি অনেক সময় আমাদের অনুকূলে থাকে না।সেদিন নাহিদের ক্ষেত্রেও তাই ছিলো।”

তারপর আরজু একে একে সেই রাতের বর্ণনা দিলো।যেটা শুনে লামিয়া আর লামিসা দুজনেই ফুপিয়ে কাদতে লাগলো।কি বিভৎস সেই রাত।আরজু দুজনের হাতে হাত রেখে বললো

-” আমিও তোমাদের মতোই ভেঙে পড়েছিলাম।বাবা মায়ের মৃত্যুর জন্য ওই মানুষটিকে প্রচন্ড ঘৃনা করতে শুরু করেছিলাম।এমনকি তার কাছ থেকে দূরে সরে এসেছিলাম।কিন্তু পরোক্ষ ভাবে সেই মানুষটি নিজেই সেদিন ভিকটিম ছিলো।নিজের আর দাদাজানের জীবন রক্ষা করার জন্য তিনি বেপরোয়া ভাবে ড্রাইভ করছিলেন।কাউকে ক্ষতি করার উদ্দেশ্য ছিল না।মানুষটি চেষ্টা করেছে আমাদের আপনজনদের রক্ষা করতে।কিন্তু পারেনি।আমি ওই মানুষটিকে পুরোপুরি দোষ দিতে পারিনা।মানুষটা আজও এই অপরাধবোধ নিয়ে বেঁচে আছে।তার চোখে মুখে আমি তীব্র অনুশোচনা, আফসোস দেখতে পাই।এই যন্ত্রণা মানুষটিকে স্বস্তিতে বাঁচতে দিচ্ছে না।মানুষটা এই অপরাধবোধের কারণে নিজের ভালোবাসার মানুষটির কাছ থেকে দূরে দূরে থেকেছে।সে তবুও তোমার সামনে এসে দাড়িয়ে অপরাধ স্বীকার করেছে।কিন্তু আমার সামনে অব্দি দাড়ানোর সাহস করতে পারেনি।আমার চোখে কোনোদিন চোখ রাখতে পারেনি।নিজের ভালোবাসা আমার সামনে প্রকাশ করেনি।কিন্তু নিয়তি দেখো।এতো ইগনোর করার পরও আমি এই মানুষটিকেই ভালোবেসে ফেলেছি।সে আমাকে বার বার ফিরিয়ে দিয়েছে কিন্তু আমার অবুঝ মন সেটা মানতে নারাজ। নিবরাস নাহিদের মতো গুরুগম্ভীর,কঠিন ব্যাক্তিত্বের মানুষটিকে আমি বাচ্চাদের মতো কাদতে দেখেছি।সে তোমাদের অপরাধী।সে আমার অপরাধী।তবুও আমি মানুষটিকে জীবন থেকে ছুড়ে ফেলতে পারিনি।কেনো জানি? সে সম্পর্কের গুরুত্ব বুঝে।সে মানুষকে সম্মান করতে জানে।সে নিজের ভুল স্বীকার করতে দ্বিধা বোধ করেনা।সে সজ্ঞানে কখনোই অন্যের খারাপ চায়না।আমি বিশ্বাস করি সেই মানুষটির চোখে তুমিও সেই অপরাধবোধ,অনুশোচনা দেখেছো।এতো ক্ষমতাবান নেতা হয়েও সে বার বার তোমার কাছে ছুটে আসে ক্ষমার আশায়।যেটা অন্য কেউ হয়তো করতো না।”

আরজু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার বললো

-“মানুষটাকে আর ভুল বুঝোনা।তার গাম্ভীর্যতা আর মুচকি হাসির পেছনের যেই যন্ত্রণা আছে সেটা কাউকেই বুঝতে দেয়না।এই মানুষ গুলোকে সবাই ভুল বুজে। এরা নিজের চাপা কষ্ট কাউকেই প্রকাশ করে না। মানুষটা এতো বছর মানুষিক ভাবে যেই শাস্তি পেয়েছে তার পর আর তাকে কি শাস্তি দিবো?মানুষটি আজও তোমার দরজায় দাড়িয়ে আছে।তাকে কি একটিবার ক্ষমা করা যায়না?অনেক তো শাস্তি পেলো। এবার নাহয় তাকে এই গিল্ট থেকে মুক্তি দাও। বড়ো ভাই মনে করে নাহয় একবার ভেবে দেখো?”

লামিসা আর লামিয়া দুজন নীরবে অশ্রু ঝরাচ্ছে।অনেক বছর ধরেই নাহিদ তার কাছে ক্ষমা চাইছে।নিজের অপরাধ স্বীকার করেছে।হাজার বার ক্ষমা চেয়েছে।কিন্তু এই মানুষটা তাদের যেই ক্ষতি করেছে সেটা পূরণ করা অসম্ভব।তবে এটা সত্যি এই মানুষটি এতো বছর ধরে তাদের মাথার উপর ছায়ার মতো ছিলো।এই কঠিন সমাজে দুজন মেয়ের একা বেচেঁ থাকা এতটা সহজ নয়।এই মানুষটি দুর থেকে তাদের সর্বদা নিরাপত্তা দিয়েছে।কোনোদিন রাস্তায় কোনো রকম অসস্তিকর অবস্থায় তাদের পড়তে হয়নি।একজন বড়ো ভাইয়ের মতো সর্বক্ষণ তাদের প্রোটেক্ট করে গেছেন।
আরজু লামিয়ার মাথায় স্নেহময় হাত বুলিয়ে বললো

-” মানুষটা আজ বড়ো আশা নিয়ে এসেছে।তাকে আর ফিরিয়ে দিও না।মানুষটা তোমাদের প্রচন্ড ভালোবাসে।আমি তার চোখে মুখে তোমাদের জন্য অসম্ভব স্নেহ,মমতা,ভালবাসা দেখেছি।”

লামিয়া ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো।আসলে কারো প্রতি তার কোনো ক্ষোভ নেই।সে মেনে নিয়েছে সবটাই তার ভাগ্যে ছিলো।তবুও নাহিদকে দেখলে তার বাবার বিভৎস মৃত্যুর দৃশ্য মনে পড়ে যায়।তাই তো নাহিদকে অপমান করত।লামিয়া দরজার দিকে এগিয়ে গেলো।আরজু ভেজা চোখে সেদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।দরজা খুলতেই দেখতে পেলো নাহিদ চিন্তিত ভঙ্গিতে দাড়িয়ে আছে।লামিয়াকে দেখে মলিন হাসলো।বললো

-” ভালো আছো লামিয়া?”

লামিয়ার ভীষণ কান্না পাচ্ছে।এই মানুষটাকে সে আজ এই মুহূর্তে কেনো যেনো ঘৃনা করতে পারছে না।নাহিদ এগিয়ে এসে মাথায় হাত রেখে বললো

-” আবার এসে তোমাকে কষ্ট দিয়ে ফেললাম?ট্রাস্ট মী আমার এমন কোনো ইনটেনশন ছিল না। তোমাকে হঠাৎ খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল তাই আসলাম।আরজু কিছু বললে মাইন্ড করো না।মেয়েটা একটু পাগলাটে।পাগলাটে না হলে আমার মতো খারাপ একটা মানুষকে ভালোবেসে ফেলতো?যেখানে আমার জন্য নিজের সব হারিয়েছে।আমি মোটেও এতো খুশি ডিজার্ভ করিনা।”

লামিয়া ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো।নাহিদ লামিয়ার মাথাটা তার বুকের সাথে মিশিয়ে বললো

-“মিষ্টি মেয়েদের কাদতে নেই।তোমাকে হাসলে কিন্তু দারুন লাগে।আর তুমি তো ভীষণ সাহসী একটা মেয়ে।একাই কেমন সবটা সামলে নিয়েছ।এতো অল্প বয়সে তোমাকে আমার জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে।তাই আমি ভীষণ লজ্জিত বোন।আমি সর্বদা বড়ো ভাইয়ের মতো তোমাদের দায়িত্ব নিতে চেয়েছি।কিন্তু তুমি আমার উপর ভীষণ রেগে ছিলে।তোমার রাগ করাটা খুব স্বাভাবিক।”

লামিয়া নাহিদকে আকড়ে ধরে ফুপিয়ে উঠলো।আর বললো

-” আমার কারো উপর কোনো ক্ষোভ নেই। আল্লাহ চেয়েছেন বলেই আমার বাবা সেদিন চলে গেলেন।হয়তো তিনি না গেলে আপনাকে যেতে হতো। কারো না কারো মৃত্যু অবধারিত ছিলো।আপনার জায়গা অন্য কেউ হলে আমাদের মতো এতিমের দিকে ফিরেও তাকাতো না।কিন্তু আপনি সর্বদা আমাদের খোঁজ রেখেছেন।আড়ালে আমাদের সমস্যার সমাধান করেছে।একজন বড়ো ভাইয়ের সকল দায়িত্ব পালন করেছেন।কিন্তু কখনোই আপনার সেই অনুশোচনা দেখতে পায়নি।আপনাকে ঘৃনা করে গেছি।মায়ের সেই আর্তনাদের আগে আমি আর কিছুই দেখতে পায়নি।আমি চাইনা কেউ আমার বাবার মৃত্যুর গিল্ট নিয়ে বেঁচে থাকুক।আপনি নিজেকে এই অপরাধবোধ থেকে মুক্তি দিন।আমি মনে কোনো দুঃখ রাখিনি।আপনি একজন ভালো মনের মানুষ।সেই রাতটা আপনার,আমার সকলের জীবনে একটা নির্মম দুর্ঘটনা।যা ভুলে যাওয়াই উত্তম।”

নাহিদের মনে হলো বিশাল এক পাহাড় যেনো তার বুক থেকে সরে পড়লো।এই মেয়েটার ঘৃণ্য দৃষ্টি তার বুকটাকে ফালাফালা করে ফেলতো।এই ছোট্ট মেয়েটার চোখের দিকে তাকাতেও কেমন হীনমন্যতায় ভুগতে হতো।আজ সেই মেয়েটার শান্ত,মায়াবী দৃষ্টি তার এতো বছরের অপরাধ বোধকে কমিয়ে দিচ্ছে।

এই সুন্দর মুহূর্তটি আরজু দ্রুত ফোনের ফ্রেমে বন্দী করে নিলো।নেতা সাহেবের এই স্নিগ্ধ,কোমল রূপটি আরজুর ভীষণ প্রিয়।
___________________

ভার্সিটির গেটের পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে দাড়িয়ে শুভর জন্য অপেক্ষা করছে রিমি।মাস্টার্সের ক্লাস শুরু হয়ে গেছে কিন্তু সব ফাঁকিবাজ গুলো ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে।শুভ বলেছে আজ ক্লাসে আসবে।তাই রিমি তার জন্য অপেক্ষা করছে।হঠাৎ কারো ডাকে পেছনে ফিরে তাকালো।দেখলো ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের রাফি দাড়িয়ে আছে।ছেলেটা অসম্ভব ব্রিলিয়ান্ট।ডিপার্টমেন্টে ফার্স্ট বয়।চোখের চশমাটা যেনো তার মেধাবী হওয়ার প্রমাণ দেয়।নিঃসন্দেহে এই ছেলে সুদর্শন।বিউটি উইথ ব্রেন কথাটা এই ছেলের সাথে খুব সহজেই মানায়।সচরাচর ছেলেটা অন্য সবার সাথে তেমন একটা মেশে না।নিজের পড়ার মাঝেই ডুবে থাকে।কিন্তু আজ হঠাৎ রিমিকে তার কি প্রয়োজন।রিমি চোখের চশমাটা নাকের ডগায় আঁটসাঁট করে চেপে বললো

-” কিছু বলবে?”

রাফি খানিকটা কাচুমাচু করে বললো

-” তোমাকে অনেক দিন ধরেই কিছু বলবো ভাবছিলাম।”

-” বলো।”

-“রিমি ভার্সিটির সেকেন্ড ইয়ারে তুমি আর আমি একবার একটা কুইজে অ্যাটেন্ড করে ফার্স্ট হয়েছিলাম মনে আছে?”

রিমি মনে করে বললো

-” হে মনে আছে।”

-” আসলে সেদিনের পর থেকেই আমার তোমাকে ভীষণ ভালো লাগে।এই কথাটা আমি এতদিন বলার চেষ্টা করেও পারিনি।তুমি সর্বদা বন্ধুদের মাঝে ঘিরে থাকো।তোমার বন্ধুমহলের সকলে কি ভাববে ভেবে বলার সাহস পায়নি।আসলে তাদের একটু ভয় পাই।সবাই যদি আমাকে নিয়ে মজা নেয় সেই ভেবে কিছু বলতে পারিনি।তুমি কি সর্বদা আমার পাশে থাকবে রিমি?”

রিমি বিস্ময় নিয়ে সবটাই শুনলো।কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।রিমি শান্ত সুরে বললো

-” রাফি আমারও তোমাকে ভীষণ ভালোলাগে।”

কথাটা শুনেই রাফি ভীষণ খুশি হয়ে গেলো।তবে রিমির পরের কথা শুনে মুখটা মলিন হয়ে পড়ল।রিমি বলতে লাগলো।

-” তবে সেটা একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে,আমার ইয়ারমেট বলে।রাফি তোমার অনুভূতিকে আমি সম্মান জানাই।কাউকে ভালো লাগা কোনো অপরাধ না।কিন্তু তুমি আমাকে যেই ভাবে নিজের পাশে চাইছো সেই ভাবে তোমার পাশে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না।আমি নিজেই অন্যের দুয়ারে আমার অনুভূতির ঝুলি নিয়ে দাড়িয়ে আছি।কিন্তু সেই দুয়ারে ঢোকা তো দূরে থাক সেখানে টোকা দিতে ও ভয় পাচ্ছি।আমি অধীর আগ্রহে সেই মানুষটির অপেক্ষায় আছি।তবে মজার বিষয় সেই মানুষটি এসবের কোনো খবরই জানে না। সেও অনুভূতির ক্ষতে জর্জরিত।সেই ক্ষতে নিজের অনুভূতি কি করে মাখি?তাই তার পাশে একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।”

রিমির অনেক কথাই রাফির মাথার উপর দিয়ে গেলো।তবে বুজলো রিমি কাউকে ভালোবাসে।সে বললো

-” আমি যদি তোমার জন্য অপেক্ষা করি।”

-” প্লিজ না।অপেক্ষা করো না।এটা খুব খারাপ জিনিস।আমি সেই মানুষটির জায়গায় অন্য কাউকে ভাবতেই পারবো না।আমাকে মাফ করে দিও।”

রিমির নিজেরও খারাপ লাগছে রাফির জন্য।তার কোমল হৃদয় কাউকেই আঘাত করতে চায় না।কিন্তু সে কি করবে?শুভকে যে অসম্ভব ভালোবাসে।

রাফি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে সেখান থেকে চলে গেলো।রিমি সামনে ঘুরে তাকাতেই দেখলো শুভ বুকে দুই হাত গুজে পেছনে দাড়িয়ে আছে।রিমি হঠাৎ তাকে দেখে ভয় পেয়ে গেলো।শুভ কি কিছু শুনে ফেলেছে?সে তো শুভর নাম নেয়নি।কিন্তু শুভ যা কৌতুহলী,পছন্দের মানুষটা কে সেটা জানার জন্য ঠিক রিমির পিছনে পড়ে যাবে।রিমি শুকনো ঢোক গিলে বললো

-” তুই কখন আসলি?”

শুভ রিমির দিকে অদ্ভুদ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো
-” একটু আগেই।আচ্ছা চল ক্লাসে চল।”

রিমি চিন্তিত হয়ে পড়লো।শুভ তাকে কিছু জিজ্ঞেস কেনো করলো না? তার মানে কি শুভ কিছুই শুনেনি? রিমি এবার সস্তি পেলো।শুভর পেছন পেছন ক্লাসে চলে গেলো।
ক্লাস শেষ করে দুজন একটা রেস্টুরেন্টে বসলো।শুভই তাকে নিয়ে এসেছে।শুভ একটু পর পর রিমির দিকে অদ্ভুদ ভাবে তাকাচ্ছে।যাতে রিমির গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে।দুজনেই কফির অর্ডার করলো।কফিতে এক সিপ দিয়েই শুভ ভাবলেশহীন ভাবে বললো

-“কারো মনের দুয়ারে অনুভূতির ঝুলি নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলে কি দুয়ারের মালিক টের পাবে না ভেবেছিস?”

শুভর কথায় রিমির চমকে গেলো।মুহূর্তেই তার ঠোঁট পুড়ে গেলো।কফিটা টেবিলে রেখে অবাক হয়ে শুভর দিকে তাকিয়ে রইলো।শুভ চোখ তুলে একবার রিমির দিকে তাকালো।তারপর আবার দূরের রাস্তায় দৃষ্টি ফেলে বললো

-” আরজুকে আমি ঠিক কবে থেকে ভালোবেসেছি আমি নিজেও জানিনা।আমাদের জীবনের অনেকটা পথ আমরা এক সাথে কাটিয়েছি।সুখ,দুঃখ এক সাথে উপভোগ করেছি।আমরা দুজন যে সম্পূর্ণ আলাদা দুটি মানুষ সেটা মনেই হতো না।আমি আরজুর আসক্তিতে আসক্ত থাকলেও অন্ধ কখনোই ছিলাম না।কেউ যে আমাকে সেই প্রথম দেখা থেকেই অদ্ভুদ সম্মোহন দৃষ্টিতে দেখে সেটা সেদিনই বুঝতে পেরে ছিলাম।সেটা নিছক আকর্ষণ ভেবে তেমন পাত্তা দেইনি।কিন্তু সেই আকর্ষণ যে আমার প্রতি দৃঢ় হচ্ছিল সেটা বুঝতে আমার সময় লেগে গেছে।কারণ তখন আমি আরজুকে ছাড়া আর কিছু ভাবতেই পারছিলাম না।সব দেখেও যেনো না দেখার ভান করছিলাম।”

রিমির দুই চোখ ভরে আসলো।তার মানে শুভ তার মনের খবর অনেক আগে থেকেই জানে?তবে কেনো এতদিন কিছু বলেনি? শুভ রিমির দিকে পূর্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো

-” আমার মতো একটা ছেলেকে কেনো ভালোবাসতে গেলি? ইউ ডিজার্ভ মাচ্ বেটার।আমি যে নিজেই কেমন বিচ্ছিন্ন হয়ে আছি।সবার সামনে স্বাভাবিক থাকলেও ভেতরে ভেতরে আমি ভীষণ বিধ্বস্ত।তোর অনুভূতিকে মূল্যায়ন করার মতো মনের জোর আমার নেই।আমার বিক্ষিপ্ত মনটা আমি কিছুতেই স্থির করতে পারছি না।তোর সাথে আমি অনেক বার এই বিষয়ে কথা বলতে চেয়েছি।কিন্তু কোনোভাবেই কমফোর্ট হচ্ছিলাম না।যদি আমাদের বন্ধুত্বের সেই স্বাভাবিকতা নষ্ট হয় সেটা ভেবে।রাফি ছেলেটা খুব ভালো।মেধাবী স্টুডেন্ট।ব্রাইট ফিউচার।একবার ভেবে দেখতে পারিস।”

রিমির চোখ বেয়ে টুপ করে কয়েক ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়লো।বুকটা কেমন ধুকপুক করছে।এতো দিনের জমানো ভালোবাসা কি ভুলে যাওয়া সম্ভব?রিমি ফোলা চোখে শুভর দিকে তাকিয়ে ভাঙ্গা গলায় বললো

-” তুই কি পেরেছিস আরজুকে ভুলতে? নিজের বুকে জমানো অনুভূতিকে ঝেড়ে ফেলতে?তাহলে আমি কি করে পারবো?আমি তোর আর আরজুর মাঝে কখনোই আসতে চায়নি।তাই নিজেকে সর্বদা পিছিয়ে নিয়েছি।আরজুকে হারিয়ে তুই যখন ভেঙে পড়েছিলি তখনও তোর পাশে ঢাল হয়ে দাড়িয়েছি।তোকে ইমোশনাল সাপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করেছি।তোকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে গেছি।কিন্তু কখনো নিজের ভালোবাসা নিয়ে দাড়াইনি।তোকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করে নিজের অনুভূতি জহির করিনি।আরজু হঠাৎ বিয়ে করাতে আমি একটা সুযোগ নিবো ভেবে কিন্তু মনে মনে খুশি হয়ে যাইনি।বরং তোর কষ্টের কথা ভেবে আমার আরজুর উপর রাগ হয়েছিল।বিশ্বাস কর যদি সম্ভব হতো আরজুকে ছিনিয়ে এনে তোর হাতে তুলে দিতাম।তোকে এই বিধ্বস্ত অবস্থায় আমি মোটেও সহ্য করতে পারছিলাম না। আমার অনুভূতি আমি যত্ন করে বুকে লুকিয়ে রেখেছি।তোর কাছে বন্ধুত্বের বেশি কিছুই চায়নি।আর চাইবও না।তাই রাফিকে নিয়ে আমাকে ভাবতে বলবি না।আমি আমার অনুভূতি নিয়েই থাকতে চাই।”

শুভ অবাক হয়ে সবটাই শুনছিল।বললো

-” নিজের জীবনটাকে কেনো জটিল করছিস?কাউকে একটাবার সুযোগ দিয়ে দেখ।”

রিমি মৃদু হেসে বললো

-” সেটা তো তুইও করতে পারিস!”

শুভ থমকে গেলো।রিমি মেয়েটা তার জীবনে অদ্ভুদ একটা জায়গায় অবস্থান করে।এই মেয়েটাকে সে ভালো না বাসলেও অত্যাধিক ভরসা,বিশ্বাসের জায়গায় মেয়েটা দখল করে আছে।তাকে সেই ট্রমা থেকে অনেকটাই বের করে এনেছে রিমি।সে কিছু বলার আগেই মেয়েটা সব বুঝে যায়।শুভ রিমির দিকে ভালো করে তাকালো।চশমার আড়ালে থাকা ফোলা ফোলা চোখের মায়ায় ভীষণ গভীরতা আছে।যেখানে তাকালে শুভ আজকাল হারিয়ে যায়।শুভ চোখ সরিয়ে নীল আকাশের পানে দৃষ্টিপাত করলো।

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_79

রাত তখন সাড়ে দশটা।নিশান বিছানায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছে। হঠাৎ তার দরজায় রিমিকে দেখতে পেলো।একপলক সেদিকে তাকিয়ে পুনরায় কাজে মনোযোগ দিয়ে বললো

-” কীরে দরজায় কি করিস? ভেতরে আয়।”

রিমি মৃদু হেসে ভেতরে আসলো।বিছানার অপর প্রান্তে বসে বড়ো ভাইয়ের দিকে তাকালো।এই মানুষটা ঠিক তার বাবার প্রতিচ্ছবি।অনেক বেশি ডিসিপ্লিন মেইন্টেইন করে চলে।সময়ের কাজ সময়ে শেষ করে থাকে। কারো সাথেই তেমন একটা মিশতে পারে না।কাজ ছাড়া যেনো কিছুই ভাবতে পারে না।একদম একটা যন্ত্রের মতো।রিমিও তেমন ছিলো।কিন্তু এক গুচ্ছ বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়ে জীবনকে নতুন করে চিনেছে।তার অতি শান্ত, গম্ভীর ভাইয়ের মাঝে অনেক দিন ধরেই সে কিছু পরিবর্তন দেখেছে।এতদিন সেই পরিবর্তনের কারণ না জানলেও আজ খুব ভালো করেই ধারণা করতে পারছে।

আজ রেস্টুরেন্টে শুভ যখন নীলাভ আকাশ দেখতে ব্যস্ত ছিলো রিমি তখন ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আসেপাশে চোখ বুলাচ্ছিল।এতদিন যেই মানুষটির সামনে তার অনুভূতি লুকানোর এতো প্রয়াস করেছে সেই মানুষটি আগেই সেটা উপলব্ধি করে ফেলেছে।ভাবতেই রিমির গা শিরশির করছে।একরাশ লজ্জা,অসস্তি ঘিরে ধরেছে।এসব ভাবনার মাঝেই হঠাৎ একটা টেবিলের দিকে তার চোখ আটকে গেলো।রিমি কপাল কুচকে চোখের চশমা ঠিক করে নিল।ভুল কিছু দেখছে নাতো?নিশান একটা মেয়ের সামনে কানে ধরে দাড়িয়ে আছে।রিমির চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল।এমন দৃশ্য তো তার কল্পনার বাইরে।সে বিস্ময় নিয়ে বললো

-” শুভ আমি কি ঠিক দেখছি?”

শুভ রিমির কথা শুনে তার দৃষ্টি বরাবর তাকালো।মুহূর্তেই কপাল কুঁচকে এলো।বিস্ময় নিয়ে বললো

-” এটা তোর ভাই না?কান ধরে দাড়িয়ে আছে কেনো?”

-” জানিনা।মেয়েটা কে বুঝতে পারছি না।পেছন থেকে ঠিক বুঝা যাচ্ছে না।”

-” গার্লফ্রেন্ড হবে নিশ্চই।তোর এই রোবোটিক ভাই প্রেমও করে? জানতাম না তো।”

শুভর দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে বললো
-” ফালতু কথা বলিস না।ভাইয়া আর প্রেম!! ইম্পসিবল।”

-” প্রেম না করলে একটা মেয়ের সামনে কান ধরে দাড়িয়ে আছে কেনো?”

-” আমিও সেটাই ভাবছি।”

হঠাৎ মেয়েটা সেখান থেকে বেরিয়ে গেলো।রিমি আর শুভ মেয়েটিকে দেখে হতবম্ব হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলো।রিমি আর শুভ একসাথে বলে উঠলো

-” অবনি!!!!”

রিমি জড়ানো কন্ঠে বললো

-“অ..অবনি!!! কেমনে কি?এই কাহিনী কবে থেকে চলছে? মানে অবনি আর ভাই,কিভাবে ঘটলো এই কানেকশন?”

শুভ মৃদু হেসে বললো

-“অসম্ভব কিছু না।আরজু যেই উদ্ভট কাজ করে বেড়ায় আর তার বোন তো তার চাইতেও তিন গুণ উদ্ভট কিছুই ঘটাবেই।”

রিমি নিচের ঠোঁট কামড়ে চিন্তিত হয়ে বললো

-” বান্ধবীর বোন এই বাচ্চা মেয়েটাকে শেষমেষ আমার ভাবী ডাকতে হবে?”

শুভ খিলখিল করে হেসে উঠলো।রিমি বিরক্ত হয়ে বললো
-” হাসি থামা।টেনশনে আমার শরীর কাপছে। আচ্ছা!! আরজু কি এই বিষয়ে কিছু জানে?”

-” আমার মনে হয়না।সাবা আন্টি জানলে নির্ঘাত হার্ট এ্যাটাক করবে।আরজু যা কাহিনী ঘটালো।আর অবনি এতো সিনিয়র একজনের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে।দুই মেয়েই তার তারছেরা।”

রিমি রেগে বললো
-” সিনিয়র বলতে কি বুঝাতে চাইছিস? আমার ভাই বুড়ো?”

শুভ হেসে উঠলো।বললো
-” বুড়ো না হলেও বয়স তো কম না।অবনির চাইতে কমছে কম দশ বছরের বড়ো হবে।তবে ওই পাকনি বুড়ি কম যায়না।তোর ওই গম্ভীর রোবট ভাইকে রীতি মতো চরকির মতো ঘুরাচ্ছে।এতো বড়ো ছেলেকেও কিনা কান ধরে দার করিয়ে রেখেছে।জোস!!!দুই বোন দারুন ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে।”

রিমি প্রচন্ড রেগে বললো
-” আমার ভাই মোটেও বুড়ো নয়।মাত্র সাতাশ বছর বয়স তার।আর কি হ্যান্ডসাম দেখেছিস?”

শুভ নিজের চুল পেছনে ঠেলে বললো
-” ঠিক আছে মানলাম তোর ভাই হ্যান্ডসাম।মাথা ঠাণ্ডা কর।রাগের কি আছে?”

রিমি রাগ দেখিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলো।শুভ সেখানে বসে মৃদু হাসলো।রিমিকে রাগাতে তার ভালই লাগে।
রিমিকে চিন্তত ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখে নিশান বললো

-” কিছু বলবি?এমন মূর্তির মতো বসে আছিস কেনো?”

রিমি শুকনো ঢোক গিললো।বড়ো ভাইকে তার প্রেমিকা সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করতে তার বেশ অসস্তি হচ্ছে।কি বলবে ভেবে পেলো না।তাই বললো

-” ভাইয়া তুমি বিয়ে করবে কবে?”

নিশান কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইলো।রিমির সাথে তার কখনোই বন্ধুত্ত্ব পূর্ণ সম্পর্ক ছিলো না।তাই এমন প্রশ্ন ভীষণ বেমানান লাগলো।তাই বললো

-” হঠাৎ এই প্রশ্ন? তোকে কি মা পাঠিয়েছে?”

-” না ভাইয়া এমনি জিজ্ঞেস করলাম।বয়স তো হয়েছেই তাই না?”

-” তোকে বিয়ে দিয়ে নেই, তার পর করবো।”

রিমি ঘাবড়ে গেল।সে অস্থির হয়ে বললো
-” অসম্ভব!! আমি বিয়ে করছি না।”

-” কেনো?”

-” তুমি তো জানো আমি লাইফে কিছু করতে চাই।স্টাডি শেষ করে নিজে প্রতিষ্ঠিত হতে চাই।”

নিশান মুচকি হেসে বললো
-” ডোন্ট ওয়ারি।তুই প্রতিষ্ঠিত হয়ে নে তার পর তোকে বিয়ে দিবো।”

-” তাহলে তুমি কবে করবে?”

-” আগে পিচ্ছিটা বড়……”

নিশান থেমে গেলো।মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেছে কথাটা।রিমির দিকে তাকিয়ে দেখলো সে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে।নিশান ঘাবড়ে গেল।গলা পরিষ্কার করে বললো

-” মানে আগে তুই বড়ো হয়ে নে। এখনো পিচ্ছি আছিস।তার পর আমার পালা।”

রিমি মৃদু হেসে সেখান থেকে বেরিয়ে আসলো।তার সারা শরীর ঘামছে।বুদ্ধিমতী রিমির ভাইয়ের অসমাপ্ত কথার অর্থ বুঝতে সময় লাগলো না।সামনে তাকাতেই দেখলো তার বাবা ইজি চেয়ারে বসে পেপার পড়ছে।বাবা ভীষণ শান্তি প্রিয় মানুষ।কিন্তু ভাইয়া যাকে পছন্দ করেছেন সে ভীষণ অশান্ত।চটপটে অবনীকে তার ভীষণ পছন্দ হলেও বাবার হবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ।
______________________

হানিমুনের প্ল্যান করলেও সেটা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি আরজু নাহিদের।একদিকে নাহিদ নির্বাচন নিয়ে ভীষণ ব্যাস্ত।আর সিকিউরিটির একটা বড়ো ইস্যু আছে।অন্য দিকে আরজুর মাস্টার্সের ক্লাস শুরু হয়ে গেছে।তাই তারা প্ল্যান করলো নাহিদের নির্বাচনের ঝামেলার পর রিলেক্সে দূরে কোথাও যাবে।

আরজু আর নাহিদ আজ এসেছে “নুর ম্যানসনে।”নাহিদের দাদী দুজনকে ডিনারে ইনভাইট করেছে।বাসায় এসেই আরজু দাদীর সাথে আড্ডা জমিয়ে দিলো।নূরজাহান বেগম আরজুর সাথে নিজের বিয়ের গল্প করছে।আরজু মনোযোগ দিয়ে সেসব শুনছে আর হাসিতে ফেটে পড়ছে।সাথে আছে নাহিদের চাচী নিবিতা।জেরিন আরজু পাশেই বসে আছে।তবে আরজু সানজিদা মাহমুদকে খানিকটা এড়িয়ে চললো।কারণ কিছু মানুষ কখনোই পরিবর্তন হয়না।তাদের পরিবর্তন করতে চাওয়া বোকামি।

নাহিদ জাহিদের রুমের সামনে এসে দরজায় নক করে বললো

-” আসতে পারি?”

জাহিদ চমকে নাহিদের দিকে তাকালো।নাহিদ কখনোই তার রুমে আসেনা।তাই সে অবাক হয়ে দাড়িয়ে বললো
-” ভাইয়া আসো।”

নাহিদ জাহিদের রুমে প্রবেশ করলো।আশেপাশে চোখ বুলালো।সারা ঘর জুড়েই বিভিন্ন পপ তারকাদের পোস্টার।পাশের কর্নারে একটা গিটার রাখা।নাহিদ ডিভানে বসে বললো

-“সিঙ্গিংয়ে ইন্টারেস্ট আছে?”

জাহিদ মাথা নিচু করে বললো
-” ওই একটু আকটু।”

নাহিদ বললো
-” দাড়িয়ে আছো কেনো বসো।”

জাহিদ শান্ত ভঙ্গিতে বসে পড়লো।নাহিদ জাহিদের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।দুই মায়ের গর্ভে জন্মালেও অদ্ভুত ভাবে এই ছেলেটার সাথে তার ভীষণ মিল আছে।নাহিদ কখনোই এই ছেলেটাকে ভাইয়ের নজরে দেখতে পাড়েনি।অথচ ছেলেটা ছোট বেলায় তার পেছনে পেছনে ঘুরতো।ভাইয়া ভাইয়া বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলতো।আজ নাহিদের ভীষণ আফসোস হচ্ছে।এই নিষ্পাপ ছেলেটাকে তার ইগনোর করা ঠিক হয়নি।এই ছেলেটার তো কোনো দোষ ছিলো না।নাহিদ শান্ত সুরে বললো

-” আমার প্রতি নিশ্চই তোমার অনেক অভিযোগ জমে আছে?”

জাহিদ চমকে তাকালো নাহিদের দিকে।নাহিদ আবার বললো

-” আমি কখনোই একজন ভালো ভাই হতে পারিনি।তোমার প্রতি সর্বদা বিরূপ আচরণ করেছি।যেখানে তোমাকে আমার আগলে রাখার কথা ছিলো সেখানে তোমাকে একা ছেড়ে দিয়েছি।ভালোবেসে কখনোই মাথায় হাত বুলিয়ে দেইনি।অথচ একটা সময় আমি মায়ের কাছে একটা ছোট ভাই বোনের আবদার করতাম।তোমাকে অপছন্দ করার মূল কারণ ছিলো তোমার মা।যাকে আমি কখনোই মেনে নিতে পারিনি।আর না তিনি কখনও আমার মা হওয়ার চেষ্টা করেছেন।বাবার সাথে আমার সম্পর্ক কেমন ছিল সেটা ভালো করেই জানো।আরজু আমার জীবনে না আসলে হয়ত আমি এমন এলোমেলো ভাবেই জীবন কাটাতাম।সব থেকেও আমি সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম।অথচ এই মেয়েটা আমার জীবনে এসে কেমন সব সমস্যার সমাধান করে দিচ্ছে।মেয়েটা আমাকে না বুঝালে হয়তো বুঝতেই পারতাম না আমি তোমার সাথে অন্যায় করছি।আমাদের মা আলাদা হলেও বাবা তো এক ছিলো।আমাদের রক্ত তো এক ছিলো।আমার দায়িত্ব ছিল তোমার প্রতি যেটা কখনোই পালন করিনি।”

নাহিদ ফ্লোরে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।মৃদু স্বরে বললো

-“আমি কখনোই দায়িত্ব এড়িয়ে চলতে পছন্দ করিনা।একজন ভালো ভাই হতে পারবো কিনা জানিনা।তবে এখন থেকে একজন বড়ো ভাইয়ের সব দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করবো।আমার পূর্বের ব্যাবহারের জন্য আমি ভীষণ লজ্জিত।তুমি আমাকে সর্বদাই সম্মান দেখিয়েছো।কিন্তু বড়ো হয়ে আমি তোমাকে স্নেহ,ভালোবাসা দিতে পারিনি।তোমার মায়ের সাথে হয়তো কখনোই আমার একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক হবে না।কিন্তু তুমি চাইলে আমরা একটা স্বাভাবিক সম্পর্কে আসতে পারি।”

জাহিদ এক দৃষ্টিতে নাহিদের দিকে তাকিয়ে রইলো।আজ কেনো যেনো তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে।মেয়ে হলে নিশ্চই কেঁদে বুক ভাসাতো।নাহিদকে সে প্রচন্ড রকমের ভালোবাসে।এই মানুষটি তার আদর্শ।মনে অভিমান জমা থাকলেও এই মানুষটিকে ভীষণ সম্মান করে।

নাহিদের ভীষণ অসস্তি লাগছে।চাইলেই হুট করে কাউকে ভালোবাসা দেখানো যায়না।নাহিদের ইচ্ছে করছে জাহিদকে একবার বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে।কিন্তু হুট করেই এমন করাটা বেমানান,অসস্তিকর।অতি রঞ্জিত।লোক দেখানো কাজ নাহিদ সচরাচর করেনা।আর কিছু কাজ করতে চাইলেও অভ্যাসগত কারণে করা হয়ে উঠে না।নাহিদ ডিভান থেকে উঠে দাড়ালো।রুম থেকে বের হয়ে যেতে নিয়ে বললো

-” জারার ব্যাপারে কি তুমি সিরিয়াস?”

জাহিদ অশ্রুসিক্ত নয়নে চমকে নাহিদের পানে তাকালো।নাহিদ আবার বললো

-” তোমার চয়েজ ভালো।মেয়েটা প্রচন্ড রকমের বাস্তববাদী আর স্মার্ট।তবে তুমি বেশ ইমোশনাল। এখনো তোমার মাঝে ম্যাচিউরিটির অভাব আছে। সম্পর্কের ক্ষেত্রে বয়স কোন মেটার করে না। তুমি যদি এই সম্পর্কে সিরিয়াস না হয়ে থাকো তাহলে বলবো মেয়েটার পিছু ছেড়ে দাও। কারো ইমোশন নিয়ে খেলার অধিকার তোমার নেই।আর যদি সিরিয়াস হয়ে থাকো তাহলে বলবো “ক্যারি অন।”

জাহিদ হতবম্ব হয়ে নাহিদের দিকে তাকালো।কে বলবে এই মানুষটা তার কেয়ার করে না।দুর থেকে ঠিকই তার খেয়াল রাখছে।নাহিদ মুচকি হেসে বেরিয়ে যেতে গেলে জাহিদ ভাঙ্গা গলায় বলে উঠলো

-” ভাইয়া”।

নাহিদ পেছন ফিরে তাকালো।জাহিদ ভেজা চোখে তাকিয়ে বললো

-” আমি কি তোমাকে একবার জড়িয়ে ধরতে পারি?”

নাহিদের বুকের মাঝে হঠাৎ করেই ধুকপুক শুরু হলো।জাহিদের এই অনুরোধ তার ভেতরটা নাড়িয়ে দিলো।নিজের অপরাধ বোধকে যেনো বাড়িয়ে দিলো বহু গুণ।জাহিদ নাহিদের জবাবের অপেক্ষা করলো না।দৌড়ে এসে নাহিদের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো।ছেলেটা তাকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে উঠলো।যেনো ভরসা যোগ্য মানুষের সন্ধান পেয়েছে।নাহিদের মনে হলো বুকের ভেতর যেনো প্রশান্তি বয়ে যাচ্ছে।এতদিন সে যেই প্রশান্তি খুঁজে বেড়াচ্ছিল সেটা তার আশেপাশেই ছিলো।যেই প্রশান্তি সে বাইরে খুঁজছিল সেটা তো তার আপনজনদের মাঝেই ছিলো।কিন্তু সে উপলব্ধি করতে পারেনি।

দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে নাঈম মাহমুদ দুই ছেলের মিলন মেলা দেখছেন।অজান্তেই তার চোখের কোটর বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।এমন একটা পরিবারই তো সে চেয়েছিলো।দুই ভাই একে অপরকে ভালোবাসবে সেটাই চেয়েছেন।পেছন থেকে আরজু উকি দিয়ে দুই ভাইকে দেখে মুচকি হেসে বললো

-” দেট’স নট ফেয়ার।দুই ছেলের এই ভালোবাসা দেখে আপনার হিংসে হচ্ছে?দারুন হিংসুটে বাবা তো আপনি।”

নাঈম মাহমুদ হেসে ফেললেন।আরজুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন

-” তুমি আমার ঘরের লক্ষী।তুমি আসার পর থেকে আমার এই ভাঙ্গা সম্পর্ক গুলো জোড়া লাগছে।নাহিদকে পরিবর্তন করতে তোমার একটুও সময় লাগেনি।তুমি না থাকলে হয়তো কখনোই একজন বাবা তার ছেলেকে ফিরে পেতো না,আর না এক ভাই অন্য ভাইকে পেতো।আমি জানতাম আমাদের এই বিচ্ছিন্ন সম্পর্ক গুলো এক মাত্র তুমি ঠিক করতে পারবে।তোমার বাবা মা বেচেঁ থাকলে ভীষণ প্রাউড ফিল করতেন।”

আরজুর চোখ ভিজে উঠলো।বাবা মাকে ভীষণ করে মনে পড়লো।নিজেকে সামলে মৃদু হেসে বললো
-“আমাদের জন্য দোয়া করবেন বাবা।”

-“অবশ্যই।”

রাতের ডিনার টেবিলে সকলেই বসেছে।নাঈম মাহমুদের বুকটা প্রশান্তিতে ভরে গেল।আজ তার পুরো পরিবার এক সাথে।সানজিদা মাহমুদ মলিন মুখে খাবার খাচ্ছেন।নাহিদ আর আরজুর প্রতি এতো আহ্লাদ তার পছন্দ হচ্ছে না।ছেলে মেয়েও ভাই বলতে অজ্ঞান।আর আজকাল আরজুর সাথেও বেশ ভাব।ছেলেকে কিছু বলেই রেগে যায়।মেয়েও একই অবস্থা।স্বামী সন্তান কেউ তার কথা শুনেনা।

নাহিদের চাচী নিবিতা আর নূরজাহান বেগম আরজুর প্লেটে এটা সেটা তুলে দিচ্ছে।আরজু অসহায় চোখে নাহিদের দিকে তাকালো।নাহিদ মিটিমিটি হাসছে।জেরিন বললো

-” খেয়ে নাও ভাবী।আমাদের কিন্তু দাদিজান এতো আদর করে কখনোই খাওয়ায়নি।তোমার তো রাজ কপাল।”

নূরজাহান বেগম বিরক্ত হয়ে বললেন
-” তোর মতো বাঁদরকে আমি আদর করে খাওয়াবো? সারা দিনই তো তোর মুখ চলে।”

-” দাদিজান তুমি কিন্তু আমাকে অপমান করছো।”

-” তোর মান থাকলে তো অপমান করবো?”

-” বিয়ে করে চলে গেলে বুঝবে।তখন ফোন করে মোটেও বলতে আসবে না “জেরিন তোকে না দেখলে ভালোলাগে না।”একদিনের জন্য পিকনিকে গেলেই তো অস্থির হয়ে যাও।”

আরজু মুচকি হাসছে।এতো সুন্দর একটা পরিবার সে পাবে ভাবতেই পারেনি।আরজুর ইচ্ছে করে সবার সাথে এই বাড়িতেই থাকতে।কিন্তু নেতা সাহেব কখনোই রাজি হবে না।সানজিদা মাহমুদের মুখোমুখি তিনি হতে ইচ্ছুক না।আরজু ও চায়না নেতা সাহেব কোনো টক্সিক মানুষের সান্নিধ্যে থাকুক।
_________________

সাবিহার সময়টা আজকাল বিষণ্ণতায় কাটছে।চাইলেই প্রিয়তম মানুষটিকে দেখতে পারে না, ছুঁতে পারে না।মানুষটি যে বহু দূরে।ভার্সিটিতেও তার তেমন মন বসে না।ভার্সিটির আনাচে কানাচে মানুষটির স্মৃতি জড়িয়ে আছে। রামিমের সাথে তার কোনো যোগাযোগ নেই।মূলত সাবিহা নিজেই রামিমের সাথে যোগাযোগ করছে না।ছেলেটা একের পর এক কল,মেসেজ করেই যায়।কিন্তু সাবিহা রেসপন্স করেনা।প্রচন্ড অভিমান জমা হয়েছে তার মনে।এই মানুষটা তাকে বার বার ফিরিয়ে দিয়েছে।তার অনুভূতির মূল্যায়ন করেনি।কারণ যাই হোক না কেনো রামিম কেনো তাকে অগ্রাহ্য করবে? এটা সাবিহা মানতেই পারেনি।এই ছেলেকে চরম শাস্তি দিয়ে তবেই সে খান্ত হবে।এসব ভাবার মাঝেই ফোন মেসেজ আসলো।রামিম মেসেজ করেছে

“এতো অভিমানী কেনো তুই।তোর অভিমান আমার ভেতরটা ঝাঁজরা করে দিচ্ছে।তোকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে। তোর গলার স্বর শুনতে মন চাইছে।আমি জানি তুই যোগাযোগ বন্ধ রেখে আমাকে শাস্তি দিচ্ছিস। তোর দেওয়া এই শাস্তিটা আমাকে ভীষণ পীড়া দিচ্ছে সাবিহা।আমি আসার পর তোর খবর আছে।সব সুদে আসলে পূরণ করব।তোর এই ব্যাবহারের বিপরীতে সাংঘাতিক কিছু ঘটাবো আমি। জাস্ট ওয়েট কর।”

সাবিহা মুচকি হাসলো।এমন হুমকি ধামকি মেসেজ রামিম প্রায়শ দিয়ে থাকে।ছেলেটাকে জ্বালিয়ে মনে একটু শান্তি মেলে সাবিহার।
_____________________

নির্বাচনের প্রচারণা শুরু হয়ে গেছে।নাহিদের পার্টি থেকে একাধিক লোক নমিনেশন পেয়েছে।শরিফুল হক বুঝতে পড়ছে নাহিদের জয় লাভের সম্ভবনা বেশি।তিনি পার্টির সকলকে বুঝিয়ে নাহিদকে রিপ্লেস করার অনেক প্রয়াস চালিয়েছে।কিন্তু সফল হয়নি।বর্তমানে নাহিদের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে।তাই নাহিদের প্রতি তিনি ভীষণ ক্ষিপ্ত।অন্যদিকে লিয়াকত আলী সাদমানের প্রতি প্রচণ্ড বিরক্ত।নাহিদকে কোনো ভাবেই দমাতে পারছে না।লিয়াকত আলী নিজেও প্রচারণার কাজে বিপুল অর্থ ব্যয় করছেন।এইবার ক্ষমতা হারালে আর সহজে ক্ষমতা হাতে আসবে না।লিয়াকত আলী বেশ রেগে সাদমানের উদ্দেশ্য বললেন

-” তোমাকে দিয়ে কোন কাজই হয়না।নাহিদকে ইমোশনালি দুর্বল করতে পারলে না।বরং আরো জোরালো ভাবে মাঠে নেমেছে।”

সাদমান শান্ত সরে বললো

-” নাহিদকে দমানো কঠিন।রাজনৈতিক পরিবারের ছেলে।রাজনীতির আগে গোড়া তার মুখস্ত।তবে আমার ভয় অন্য জায়গায়।ওকে ইমোশনালি আঘাত করার পরও সে কোনো রিঅ্যাকশন দেখায় নি।নাহিদ ছেড়ে দেওয়ার পাত্র না।ও নিশ্চই কোনো বড়ো কিছু প্ল্যান করছে।”

লিয়াকত আলী ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলেন।নাহিদ বেশ চতুর ছেলে।তার নিরবতা ঝড়ের পূর্বাভাস দিচ্ছে।