মিষ্টি রোদের হাতছানি পর্ব-৮২+৮৩

0
1067

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_82

আজ আরজুর সপ্নের নীরে উৎসবের আমেজ।আত্মীয় সজন,বন্ধুবান্ধব সবাই উপস্থিত।তাছাড়া বড়ো বড় নেতারা তো আছেই।সাংবাদিকরা একে একে ছবি ক্লিক করছে আর ব্রেকিং নিউজ বের করছে।এতো জমজমাট আয়োজন এর আগে শহরে হয়েছে বলে মনে হয়না।সেদিন হুট করেই বিয়ে করার পর আরজু ভাবতেই পারেনি এতো জমজমাট একটা আয়োজনে তার বিয়ে হবে।সে তো মনস্থির করেই নিয়েছিল হয়তো তাকে আড়ালেই থাকতে হবে নেতা সাহেবের বউ হয়ে।তাতেও আরজুর আপত্তি ছিলো না।

নাহিদ স্টেজে দাড়িয়ে আরজুর অপেক্ষা করছিল। সারাদিনে আরজুকে একবারও দেখতে পায়নি।নাহিদকে বিচলিত হতে দেখে আসফি বললো

-” শালা আমার পড়ে বিয়ে করে দুই দুইবার বাসর করে ফেলছিলস।আর আমার কপালে একটা বাসর ও নাই।আমার কপালটাই খারাপ।বউ বিরহের আগুনে ছুড়ে ফেলে বিদেশী মাটিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।”

নাহিদ মৃদু হেসে বললো
-” তুই এতটাও সুপুরুষ না।বিয়ে করে সেদিনই যে বাসর সেরে ফেলেছিস আমি জানিনা ভেবেছিস?”

আসফি মলিন মুখে বললো
-“সেটা তো বহুদিন আগের কথা বন্ধু।এক যুগ পার হয়ে গেলো।”

আসফির কথায় নাহিদ হেসে উঠলো।ঠিক তখনই সামনের গেট দিয়ে আরজু প্রবেশ করলো।সকলেই মুগ্ধ হয়ে ব্রাইড কে দেখছে।আরজুর দর্শন হতেই নাহিদের শরীর শিরশির করছে।মাথা কেমন ঝিমঝিম করছে।নাহিদ বুঝতে পড়ছে তার মতো শক্তপোক্ত মানুষটার বুক কাপছে।প্রিয় মানুষটিকে এই রূপে দেখলে প্রতিটি পুরুষেরই কি এমন বুক কাপে? হৃদস্পন্দনের ধুকপুকানি নাহিদ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে।লাস্যময়ী এই নারী তার স্বপ্নে বহুবার এই রূপে ধরা দিয়েছে।যখনই নাহিদ এই স্বপ্ন দেখেছে ততবার তার ঘুম ভেংগে গেছে।অস্থিরতায় গলা শুকিয়ে গেছে।তখন তো একবারও ভাবতে পারেনি সেই স্বপ্ন কয়েক বছর পর এমন সত্যি রূপে ধরা দেবে।

সবার দৃষ্টি আরজুর দিকে দেখে মেয়েটা লজ্জায় মূর্ছা যাচ্ছে।আরজু ভারী লেহেঙ্গা পড়ে স্টেজে উঠতে উঠতে আড়চোখে নেতা সাহেবকে দেখলো। আর সাথে সাথেই চোখ আটকে গেল সেই সুপুরুষের দিকে। সর্বদা শুভ্র পাঞ্জাবি পরা মানুষটিকে এস কালারের ব্লেজারে মারাত্মক লাগছে।শুধু মারাত্বক না মাথা নষ্ট করা মারাত্বক সুন্দর।আরজু তো এমনই নেতা সাহেবের জন্য উন্মাদ।এইবার বোধয় মানুষটাকে দেখে অজ্ঞান হওয়ার সম্ভবনা আছে। ছি! ছি!! এমন স্টেজে উঠে অজ্ঞান হলে মান সম্মান কিছুই থাকবে না।

নাহিদ এগিয়ে এসে আরজুর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। আরজু চোখ তুলে তাকালো নাহিদের দিকে।মুচকি হেসে প্রিয় মানুষটির হাতটি ধরলো।আরজুকে স্টেজে তুলেই নাহিদ কানের কাছে ফিসফিস করে বললো

-” আরজু তুমি কি আমাকে বেশি দিন বাঁচতে দিতে চাও না?”

আরজু চমকে তাকালো নাহিদের দিকে।নাহিদ মৃদু হেসে বললো

-” একটু পর নিউজ বের হবে,লাস্যময়ী এক নারী নব্য এমপির হার্ট ব্লক করে মেরে ফেলেছে।এমন সাজে সামনে আসলে হার্ট দুর্বল হয়ে যায়,নিঃশ্বাসের গতি বৃদ্ধি পায় আর শরীরের প্রতিটা লোমকূপে বিদ্যুৎ খেলে যায়।একটা স্বাভাবিক মানুষের শরীরে এতো কিছু ঘটলে মৃত্যু নিশ্চিত।”

আরজু পিটপিট করে তাকিয়ে থেকে বললো

-” সহজ ভাবে বললেই হয় আমাকে মারাত্বক সুন্দর লাগছে।নেতাদের সাভাবই কথা পেঁচানো।”

-“অত ভালো উপমা আমি দিতে জানি না।তাই মন,মস্তিষ্ককে যা চলছে তাই বক্ত করলাম।”

-” আপনার মন মস্তিষ্ক আমার সামনে আসলেই অসভ্য হয়ে যায়।বাকি সবার কাছেই আপনি অতি সভ্য পুরুষ।”

নাহিদ হেসে বললো

-” তুমি ধীরে ধীরে একদম ট্রিপিকাল ওয়াইফ হয়ে যাচ্ছ আরজু।তোমার সুন্দর মেজাজ খারাপ হওয়ার কারণ কিন্তু আমি জানি।”

আরজু হতবম্ব হয়ে নাহিদের দিকে তাকালো।আসলেই এই মানুষটা তার মন পড়তে জানে?আরজু আবার সামনে তাকিয়ে বললো

-” সামনের ওই মেয়েদের চোখ উপড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।”

-” তাহলে তো আমার বউয়ের দিকে মুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকানো আশেপাশের সব ছেলেদের চোখ, নাক, কান সব ফেলে দেওয়া উচিত।”

-” আপনি খুব খারাপ।”

-” আর তুমি খুব মিষ্টি।”
______________________

জারা দাড়িয়ে কোল্ড ড্রিঙ্কস খাচ্ছে আর স্টেজে বসা আরজু আর নাহিদের খুনসুটি দেখছে।প্রথম থেকেই জারা চাইতো আরজু আর নাহিদ এক হয়ে যাক।আরজুর নাহিদের প্রতি পাগলামি সবটাই জারা দেখেছে,অনুভব করেছে।ফাইনালি দুজন মানুষকে পাশাপাশি দেখে বুকে প্রশান্তি বয়ে যাচ্ছে।ভালোবাসা দেখতেও ভালো লাগে।তখনই সামনের দিয়ে কেউ চলে গেলো।জারা বিমোহিত হয়ে সেই মানুষটিকে দেখছে। ব্ল্যাক ব্লেজার পরা ছেলেটা যেনো জারার কঠিন হার্ট মেল্ট করে দিচ্ছে।জারা অপলক সেদিকেই তাকিয়ে রইলো।জাহিদ কারো সাথে কথা বলছে।কথা বলার মাঝে পেছনের চুলে হাত বুলাচ্ছে।জারা অনুভব করলো তার হৃদপিন্ড দ্রুত বেগে লাফাচ্ছে।একটা জুনিয়র ছেলেকে দেখে এমন অদ্ভুদ অনুভূতি হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।জারা বুঝতে পারছে সে দুই বছরের ছোট একটা ছেলের প্রতি ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছে।এই কারণে সবাই কি তাকে ছি! ছি! করবে?এসব ভাবনার মাঝে জাহিদ কখন তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতেই পারেনি।জাহিদ জারার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো

-” দে আর মেড ফির ইচ্ আদার্স,লাইক অ্যাস।”

জারা চমকে তাকালো জাহিদের দিকে। মুগ্ধতাকে পাস কাটিয়ে বিরকি মাখা গলায় বললো

-“মোটেও না।তোমার মতো ছেলে আমার জন্য হতেই পারেনা।এসব বাচ্চা কাচ্চা দিয়ে আমি কি করবো?”

জাহিদ আবার হেসে বললো

-” একবার অনুমতি দিয়ে দেখুন, আমি বাচ্চা নাকি বাচ্চার বাবা হওয়ার যোগ্য বুঝিয়ে দেব।”

জারা হতবম্ব হয়ে পড়ল।রেগে বললো

-” তুমি একটা চূড়ান্ত লেভেলের অসভ্য।নাহিদ ভাইয়া কতো সভ্য কিন্তু তার ভাই হয়ে তুমি!!!”

-” আমার ভাই কতটা সভ্য সেটা ভাবী বলতে পারবে।আমার মনে হয় আমার ভাই আমার চাইতে কয়েক গুন বেশি অসভ্য।কারণ তার সব গুণই আমার মধ্যে এসেছে।”

-“তুমি না প্রমিজ করেছ আমার পিছু পিছু আসবে না।”

-“হ্যাঁ বলেছি। কিন্তু আপনি যদি আমার সামনে চলে আসেন তাতে আমার কি দোষ?আচ্ছা জারা আমাদের ফিউচার বেবি কি আপনার মতো কিউট হবে।তাহলে আমি সারাদিন তাদের কোলে নিয়ে বসে থাকবো।আপনি চাইলে আপনাকেও নিয়ে বসে থাকতে রাজি আছি।”

জারা রেগে হাতের কোল্ড ড্রিঙ্কস জাহিদের মুখে ছুড়ে মারলো।বললো

-” তোমার কোলে বসে থাকার জন্য আমি বসে নেই।স্টুপিড।”

বলেই জারা চলে যাচ্ছিলো।পেছন থেকে জাহিদ হেসে বললো

-” তাহলে আমি আপনার কোলে বসতে রাজি আছি।বেবিরা আর আমি সবাই আপনার কোলে উঠে বসে থাকবো।”

জারা আর এসবে কান দিলো না।সামনে এগিয়ে গেলো।বেহায়া ছেলে একটা।আর সে কিনা এই ছেলেকে নিয়ে এতো ভাবছে? এই ফাজিল জীবনেও ঠিক হবে না।একটু সামনেই দেখা হলো নাঈম মাহমুদের দিকে।জারা ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেলো।আংকেল কি জাহিদের কথাটা শুনে ফেললো? নাঈম মাহমুদ ঘাড় কাত করে পেছনে দাড়ানো জাহিদের দিকে তাকালো।বাবাকে দেখে জাহিদ মেকি হাসার চেষ্টা করলো।আসলে তারও লজ্জা লাগছে।নাঈম মাহমুদ জারার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো

-” আচ্ছা আমার পাজি ছেলেটা কি তোমাকে বেশি ডিস্টার্ব করছে?করলে বলবে,তোমার বাবা মায়ের সাথে কথা বলে তোমাকে পার্মানেন্টলি বাসায় নিয়ে আসবো।তখন তুমি এই ফাজিলকে একদম সোজা করে দিও।আমি তোমার সাপোর্ট থাকবো।কি মা পারবে না?”

জারার মনে হচ্ছে জমিন ফাঁকা হয়ে যাক আর সে টুপ করে সেখানে ঢুকে পড়ুক।ফাজিলটার জন্য কি লজ্জায় পড়তে হচ্ছে।এই ছেলে নিজের প্রেম কাহিনী বাবকেও শুনিয়ে বসে আছে? সাংঘাতিক ছেলে।
_____________________

এই হাজারো মানুষের মাঝে শুভর দৃষ্টি শুধু মাত্র একজনাতেই নিবদ্ধ।দুর থেকে নিজের ভালোবাসাকে দেখছে।আরজুর মিষ্টি হাসি,নাহিদের সাথে খুনসুটি সবটাই যেনো শুভর হৃদয়ের দহন বাড়িয়ে দিচ্ছে।এতো যত্নের ভালোবাসা কেনো তার কাছে ধরা দিলো না।এই মিষ্টি মেয়েটা কেনো তার জন্য বউ সাজলো না।সবার সামনে নিজেকে সাভাবিক দেখালেও শুভ নিজে জানে কি তীব্র যন্ত্রণায় তার প্রতিটি রাত কাটে।এতো বছরের যত্নে গড়া ভালোবাসা,অনুভূতি সব কি এক নিমিষেই ভুলে যাওয়া সম্ভব? শুভ তো পারছেনা আরজুকে ভুলতে।শুভ ছল ছল চোখে তাকিয়ে দেখলো আরজু তার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে।দুজনের দৃষ্টি বিনিময় হতেই আরজু ইশারায় বুঝালো কি হয়েছে? শুভ মৃদু হেসে ইশারা করলো

“কিছু না।তোকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে।”

আরজু লাজুক হেসে নাহিদের দিকে ইশারা করে বুঝালো

-” আমাদের মানিয়েছে?”

শুভ আঙ্গুলের ইশারায় দেখলো

-” ফাটাফাটি মানিয়েছে।”

আরজু হেসে উঠলো।শুভ যেনো আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না।সেখান থেকে দ্রুত চলে আসলো।ফুয়াদ এতক্ষন সবটাই দেখছিলো।তাই শুভর পিছু পিছু আসলো।দেখলো শুভ বাগানের সাইড এসে দাড়িয়ে আছে।বার বার তার শরীর মৃদু কেপে কেপে উঠছে।ফুয়াদ জানে শুভর মনের অবস্থা।তাই পেছনে কাধে হাত রেখে সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করলো।শুভ আচমকাই ফুয়াদকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো।বললো

-” আমি আরজুকে ভুলতে কেনো পারছি না।ওকে সারাজীবন সুখী দেখতে চেয়েছি।আজ যখন ও সবচাইতে বেশি সুখী তবে আমার কেনো খারাপ লাগছে।তাহলে কি আমি ভীষণ স্বার্থপর?”

-” তুই স্বার্থপর না শুভ।তুই আরজুকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসেছি।মেয়েটা ভীষণ ভাগ্যবতী জানিস? দুজন পুরুষের শুদ্ধতম ভালোবাসা পেয়েছে। নিজেকে সামলে নে।একবার আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখ, হয়তো অন্য কেউ তোকে এমন প্রগাঢ় ভাবে ভালোবেসে কষ্ট পাচ্ছে।তোকে দুর থেকেই চাইছে, তোর জন্য অতল গহ্বরে মতো ভালোবাসা নিয়ে অপেক্ষা করছে।”

রিমি দূরে দাঁড়িয়ে সবটাই দেখছিলো।তার দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে।শুভ কখনোই আরজুকে ভুলবেনা রিমি জানে।কিন্তু তবুও সে মিথ্যে আশা নিয়ে বসে আছে।সব ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে এমন তো নয়।কিছু ভালোবাসার জন্মই হয় অপেক্ষার জন্য,প্রণয় দহনে পুড়ে ছাই হওয়ার জন্য।আর সেই প্রণয়ে মজেছে শুভ আর রিমি।দুজনই ভালোবেসে দগ্ধ হচ্ছে।
——————————————

জোছনা স্নাত রাত।চারদিকের উৎসব থেমেছে অনেকক্ষণ আগেই।একে একে কোলাহল থেমেছে।সেই চেনা পরিচিত ঘরটায় বসে আছে আরজু।তবে আজ ঘরটা একদম অন্যরকম।নানান ফুলের সুবাসে মৌ মৌ করছে চারপাশ।এই ফুলের মেলায় আভিজাত্যে ঘেরা ঘরটি যেনো দ্বিগুণ প্রানবন্ত হয়ে উঠেছে।আরজু সেই চিরো চেনা বিছানায় বসে প্রিয়তম মানুষটির অপেক্ষায়।আরজুর হঠাৎ হাসি পেলো।বিয়ের এতদিন পর বাসর।বাসর তো তাদের বহুবার হয়েছে।প্রিয় মানুষটাকে গভীর ভাবে বহুবার অনুভব করেছে।তবুও কেনো আরজুর আজ অদ্ভুদ অনুভূতি হচ্ছে?শরীর শিরশির করছে,অস্থিরতা বাড়ছে।সবচাইতে বড়ো কথা আরজুর লজ্জা লাগছে।

নাহিদ দরজা ঠেলে রুমের মধ্যে পার্পেল লেহেঙ্গা পরা একটা বউকে ঘোমটা পড়া বসে থাকতে দেখলো।নাহিদের হাসি পেলো আরজুর লাজুক অবস্থা দেখে।নাহিদ অনুভব করলো আজ তাদের অফিসিয়াল বিয়ে ছিলো।তাই এই চাঁদনী রাতটিও প্রথম এইভাবে তাদের জীবনে আসলো।নাহিদ এগিয়ে এসে আরজুর মুখোমুখি বসলো।ঘোমটা তুলে দেখলো মায়াবতী বউকে।আরজু যেনো লজ্জায় কোথায় লুকাবে খুঁজে পাচ্ছে না।যেই পুরুষের বুকে বহুবার নগ্ন দেহে লেপ্টে ছিল তার সামনে এমন লজ্জা পাওয়া কি অদ্ভুদ না? তাই আড়চোখে নাহিদের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললো

-” দে..দেখুন না জেরিন আমাকে এমন মূর্তির মতো বসিয়ে দিয়ে গেলো।আমি কি নতুন বউ নাকি?”

-” নতুন বউ তো অবশ্যই।নতুন বউ,নতুন বাসর।সবটাই নতুন করে হবে।”

আরজু লজ্জা পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।অসভ্য নেতা।নাহিদ আরজুর চিবুকে আলতো ছুঁয়ে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো

-” আমি তো প্রতিনিয়ত তোমাকে নতুন ভাবেই আবিষ্কার করি।তুমি পাশে থাকলে আমার প্রতিটি ভোরে নতুন সূর্য উঠে।”

আরজু মুচকি হাসলো।বললো

-” আমার কেমন যেনো লজ্জা লাগছে?ছোটবেলা থেকেই আমার বউ সাজার অনেক সখ ছিলো।খালামণি প্রায় আমাকে সাজিয়ে দিতো।আর নিজেই খুশিতে কাদতো।বলতো
-” আরজু তোকে বউ সাজলে মারাত্বক সুন্দর লাগবে।যেদিন তোর বিয়ে হবে আমি সারাক্ষন শুধু তোকেই দেখবো।কথাটা সত্যি হয়েছে।আমাকে দেখেই সে কেঁদে বুক ভাসিয়েছে।”

বলেই আরজু হাসলো।কিন্তু তার দুচোখ ভরে উঠলো।নাহিদ জানে মেয়েটা পাগলাটে আর ভীষণ আবেগপ্রবণ।তাই আরজুর কপালে উষ্ণ স্পর্শ দিয়ে বললো

-” খালামণি ঠিক বলেছে।তোমাকে বউ সাজে মারাত্বক না শুধু ভয়ঙ্কর সুন্দর লাগছে।”

আরজু লাজুক হাসলো।নাহিদ বিছানা ছেড়ে উঠে ক্লোজেট থেকে কিছু বের করলো।আরজুর মুখোমুখি বসে বললো

-” অফিসিয়ালি আমাদের কখনো বাসর হয়নি।তাই তোমাকে এই বিশেষ জিনিসটা গিফট করা হয়নি।আজ তোমাকে খুব স্পেশাল কিছু দিতে চাই।”

বলেই নাহিদ রূপার একজোড়া নূপুর বের করলো।শান্ত সুরে বললো

-” আমার মায়ের নূপুর।আমি ছোটবেলায় এই নূপুর গুলো খুব পছন্দ করতাম। মা সারা বাড়ি রিনঝিন শব্দ করে হাটতো।আর আমি মায়ের পিছু পিছু ছুটতাম।জানি খুব দামী কিছু না।কিন্তু আমার জন্য অতি মূল্যবান।তোমাকে বিশেষ কোনো দিনে এটি দেবো বলে ভেবেছিলাম।আজকের চাইতে বিশেষ দিন আর হতেই পারেনা।তুমিও মায়ের মতো এই নূপুর পড়ে সারা ঘিরে রিনিঝিনি ঝঙ্কার তুলবে আর আমি তোমার পিছু পিছু ছুটে বেড়াবো।তুমি কি পড়তে চাও আরজু?”

আরজু দ্রুত পা এগিয়ে দিল।বললো
-” নিজ হাতে না পড়ালে পরবো না।”

নাহিদ হাসলো।অতি যত্নে আরজুর শুভ্র পা জোড়ায় নূপুর পরিয়ে দিলো।আরজুর সারা শরীর কেঁপে উঠলো যখন নাহিদ আরজুর পায়ে উষ্ণ স্পর্শ একে দিলো।আরজু অস্থির হয়ে পা সরিয়ে নিলো।চমকে বললো

-” প্লিজ পায়ে চুমু খাবেন না।আমার অসস্তি হয়।”

নাহিদ হেসে আরজুর দিকে আগালো।দুষ্টু হেসে বললো
-” তাহলে কোথায় চুমু খাবো? কোনো জায়গা কি বাকি আছে?”

আরজু রেগে নাহিদের বুক কিল ঘুষি মারতে মারতে বললো

-” আপনি একটা অসভ্য।”

-” আমি নিজেকে কখনোই সভ্য দাবি করিনি।”

আরজু কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললো
-” আমিও আপনাকে আজ সারপ্রাইজ গিফট দিতে চাই।”

নাহিদ ব্রু কুচকে তাকালো।আরজু লজ্জায় নাহিদের দিকে তাকাতে পারছে না।মাথা নিচু করে নাহিদের রুক্ষ পুরুষালি হাত তার উন্মুক্ত উদরে স্পর্শ করিয়ে লাজুক হেসে বললো

-“আপনার গিফট।”

নাহিদ নেশাতুর দৃষ্টিতে প্রিয়তমার দিকে তাকিয়ে রইলো আর অদ্ভুদ হাসলো।আরজু যেনো ভাবনায় পড়ে গেলো।নেতা সাহেব সারপ্রাইজড কেনো হলো না?নিচের ঠোঁট কামড়ে কিছু ভাবলো।তারপর অবাক হয়ে নাহিদের দিকে তাকিয়ে বললো

-” আপনি আগে থেকেই জানতেন?”

নাহিদ আবার হাসলো।নিচু হয়ে আরজুর উদরে চুমু খেয়ে বললো
-” জি ম্যাডাম।”

-” কিভাবে?”

নাহিদ দুষ্টু হেসে বললো

-” আরজু তুমি আমার স্ত্রী।তোমার রেগুলার সাইকেল আমার মুখস্ত।তাছাড়া তুমি হসপিটালে যাবে আর আমি জানবো না হতেই পারেনা।”

আরজু মুখটা মলিন করে রেগে বললো

-” আপনি আমার সারপ্রাইজ নষ্ট করে দিয়েছেন।সব জেনেও কিছু বললেন না কেনো?সব কিছুই কেনো আপনার আগে জানতে হবে?আমার পেছনে লোক লাগিয়ে রেখেছে?”

নাহিদ হাসলো।রাগী আরজুর নাকটা একদম লালচে হয়ে আছে।সে আরজুর নাক টেনে বললো

-” এই সুখবর টা আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চেয়েছি।আমার দুষ্টু বউটা এই নিউজটা আমাকে দেওয়ার সময় যেই লাজুক হাসবে,সেটা দেখার অপেক্ষা করছিলাম।”

আরজু বিভোর হয়ে তার নেতা সাহেবকে দেখছিলো।এই মানুষটা অদ্ভুদ।নিমিষেই আরজুর বিচলিত মন শান্ত করে ফেলতে পারে।কথায় আছে মাধুর্য্যতা।যেনো আরজু সারাদিন নিরলস মানুষটির কথা শুনতে পারবে।কেমন টনিকের মতো কাজ করে তার প্রতিটি বুলি।আরজুর নিজেকে উন্মাদ লাগে।
নাহিদ আরজুর ওষ্ঠে গভীর স্পর্শ করে বললো

-” তুমি আমার জীবনে সুখ পাখি হয়ে এসেছ বউ।তোমার স্পর্শে আমার জীবনের সকল একাকিত্ব,ক্লান্তি,দুঃখ, কষ্ট সব নিমিষেই ভেনিস হয়ে গেছে। তুমি আমার জীবনে সেই সকল স্বপ্ন পূরণ করেছ আরজু, যার কল্পনাও আমি করতে পারিনি।এসবের প্রতিদানে আমি তোমাকে কিছুই দিতে পারিনি আরজু।”

আরজু নাহিদের বুকে মাথা রাখলো।গলা জড়িয়ে ধরে বললো

-” কে বলেছে কিছু দেননি? আপনি আমাকে সম্মান,মর্যাদা,ভালোবাসা,ভরসা সব দিয়েছেন নেতা সাহেব।আমি সর্বদা আপনার পাশে থাকতে চাই।”

-” প্রমিজ করো আরজু,যদি কোনোদিন আমি নাও থাকি তুমি আমাদের এই অনাগত সন্তানের জন্য বাবা মা উভয় হয়ে তাকে মানুষ করবে।আত্মনির্ভরশীল হবে।কখনো হেরে যাবেনা।”

আরজু চমকে উঠলো।নাহিদকে আরো শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরে বুকে মুখ লুকিয়ে ফুপিয়ে বললো

-” এসব বলবেন না নেতা সাহেব।আমার কষ্ট হয়।আপনাকে ছাড়া আমি নিঃস্ব।তাই এসব বাজে কথা আর বলবেন না।”

নাহিদ হাসলো।আরজুর চুলে হাত বুলিয়ে বললো

-” মাঝে মাঝে তুমি একদম বাচ্চা হয়ে যাও। আই লাইক ইট।এতদিন এক বাচ্চা সামলেছি ,কয়দিন পর দুই বাচ্চা সামলাবো।দারুন হবে।কয়দিন পর দুই বাচ্চা ঘরে দৌড়াবে।”

আরজু নাহিদের বুকে হালকা কামড় বসালো।আর বললো
-” আমাকে কোন দিক দিয়ে বাচ্চা মনে হয়?”

নাহিদ ভাববার ভঙ্গি করে বললো
-” দেখতে হবে।দাড়াও চেক করে দেখছি।”

আরজু থতমত খেয়ে গেল।আর লাফে কোল থেকে নেমে পড়লো।নাহিদ আজ ছাড় দেবার পাত্র না।তাই বললো

-” আরে যাচ্ছো কোথায়? আজ না আমাদের বাসর রাত।”

-” ইসস!! বাসর রাত!!! যেনো উনি আজ প্রথম বাসর করছে।অসভ্য লোক।”

নাহিদকে আসতে দেখে আরজু সারা রুম জুড়ে দৌড়াতে লাগলো।নাহিদ ও তার পিছু পিছু ছুটে যাচ্ছে আর বলছে

-” আরজু তিড়িং বিড়িং বন্ধ করো।এই সময় এই ভাবে দৌড়ানো ঠিক না।থামো বলছি।আমার ছোটো আরজুটা ব্যাথা পাবে।”

-“ইসস!! ছোট আরজুর জন্য উনার দরদ উৎলে পড়ছে।আর কে বলেছে আরজু আসছে? কিউট নেতা সাহেব আসবে।”

-” আমার মনে হয় লিটেল আরজু।”

-” না লিটল নেতা সাহেব।”

-” না আরজু”

-” না নেতা সাহেব।”

এইভাবেই চললো তাদের তর্ক বিতর্ক।কে জিতল বা কে হারলো জানা গেলো না।কারণ ততক্ষণে সারা ঘর জুড়ে গভীর নিঃশ্বাসের গতি বৃদ্ধি পেলো।এই স্নিগ্ধ রাত কারো জন্য মধুর তো কারো জন্য বিষাক্ত।

(চলবে…..)

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_83

পূর্ব আকাশে সাদা তুলোর মতো মেঘ জমেছে।মৃদু শীতল হাওয়া বইছে চারপাশে।পড়ন্ত বিকেলে ক্যাফেতে বসেছে বন্ধুমহল।কয়েক মুহূর্ত আগে আরজুর বলা কথায় সকলে কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্তব্ধ।জারা মুখ হা করে রইলো কিছুক্ষণ।তারপর বললো

-” কি? সত্যি? তুই কনসিভ করেছিস?”

রিমি বোকার মতো বললো
-” মাত্র না তোদের বিয়ে খেলাম? এতো জলদি কেমন করে সম্ভব?”

ফুয়াদ রিমির মাথায় চাপড় মেরে বললো
-“ডাফার একটা।মাত্র তো রিসেপশন খেলি।বিয়ে তো আগেই হয়েছে।”

রিমি মলিন মুখে মাথায় ঘষতে লাগলো।ব্যাথা ভালই পেয়েছে।জারা হেসে আরজুকে খোঁচা মেরে বললো

-” নেতা সাহেব আনরোমান্টিক,গম্ভীর হেন তেন কতো কিছু।তাহলে জুনিয়র কি আকাশ থেকে টপকালো?”

আরজু এতক্ষন লজ্জা পাচ্ছিল।কিন্তু জারার কথায় বিরক্ত হলো।সাবিহা বুঝতে পেরে বললো

-” ফালতু কথা কম বল। কনগ্রাচুলেশন আরজু। আই অ্যাম ভেরি হ্যাপি ফর ইউ।”

জারা আফসোসের সুরে বললো
-” আমরা এখন অব্দি বিয়ে করতে পারলাম না।আর এই মেয়ের বিয়ে,সংসার,বাচ্চা কাচ্চা সব হয়ে যাচ্ছে।”

ফুয়াদ কপাল কুঁচকে বললো
-” তুই ও করে ফেল।তোর জন্য সুবিধা আছে।বিয়ে করেই বাচ্চা পালবি।”

জারা চিন্তিত হয়ে বললো
-” কেনো?”

-” কেনো আবার? তুই তো বিয়েই একটা বাচ্চাকে করবি।”

জারা রাগে ফুসফুস করতে করতে বললো
-” ভালো হবেনা বলে দিলাম।”

-” দেখলাম তো আরজুর অনুষ্ঠানের দিন।তোর পিছে সুপার গ্লু মতো চিপকে ছিলো।বাচ্চা হলেও দারুন হ্যান্ডসাম আছে ছেলেটা, একদম নাহিদ ভাইয়ের মত।তাছাড়া আরজুর শশুর ও রাজি। এরা আসলেই জনসেবা করছে। দুই ভাই দুই পাগলকে বিয়ে করে দেশের যা উপকার করছে।সেলুট জানাই।”

এবার জারা আরজু দুজনেই রেগে গেলো।ফুয়াদের কফিতে এক বোতল পানি ঢেলে দিলো।বললো
-” বেশি করে খা।ছাগল।”

ফুয়াদ হেসে বললো
-” সমস্যা নাই।আরজু এই খুশিতে ট্রিট দে।আমি অর্ডার করছি।”

আরজু মুখ বাঁকিয়ে বললো
-“আমার বয়েয়েই গেছে তোকে ট্রিট দিতে।”

-“তুই তো দারুন কিপটা।নেতাদের বউরা বুঝি এমন কিপটা হয়?”

-” হয়।”

সবাই আরজুকে অভিনন্দন জানালো।রিমি আড়চোখে শুভর দিকে তাকালো।কেমন থমথমে অবস্থায় বসে আছে।দৃষ্টি জানলে কাচের বাইরের আকাশে দিকে।রিমি আলতো স্পর্শে শুভর হাত ধরলো।যেনো একটু আশ্বস্ত করার প্রয়াস করলো।শুভ শান্ত দৃষ্টিতে রিমির দিকে তাকালো।রিমি জানে এই শান্তি দৃষ্টির আড়ালে কতটা অশান্তি বিরাজ করছে।

আরজু সবার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে শুভর দিকে তাকালো।এই খবর শুনে সে যাকে সবচাইতে বেশি উচ্ছ্বাসিত হবে ভেবেছিল সেই কেমন নির্বাক।আরজুর বুঝতে পারে শুভর সাথে তার একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে।আজকাল শুভ আরজুর কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করে।আরজু ভেতরে ভেতরে ভীষণ কষ্ট পায়।কারণ পরিবারকে হারিয়ে সবচাইতে কাছে সে শুভকে পেয়েছে।আর সেই শুভ তাকে এড়িয়ে চলে।আরজু শুভর দিকে তাকিয়ে বললো

-” তুই খুশি হোসনি শুভ?”

শুভ মৃদু হাসার চেষ্টা করে বললো
-” আমি খুশি হবো না কেনো?আমাদের ছোট্ট আরজু আসবে আর আমি খুশি হবো না।তুই এতো বড়ো হলি কবে বুঝতেই পারলাম না।”

আরজু মলিন হাসলো।কিছুই বললো না।আড্ডা শেষে আরজু শুভর কাছে আবদার করলো আজ শুভর বাইকে করে বাসায় যাবে।শুভ বললো

-” এই অবস্থায় বাইকে উঠা ঠিক হবে?”

আরজু রাগ দেখিয়ে বললো
-” নিবিনা বললেই হয়।”

শুভ বুঝল আরজু অভিমান করেছে।তাই বললো
-” আচ্ছা চল।”

আরজু বললো
-” সামনের আইস ক্রিম পার্লার থেকে কিন্তু আইসক্রিম খাওয়াতে হবে।”

শুভ হাসলো।যেই মেয়ে নিজেই বাচ্চাদের মতো আবদার করে সে বাচ্চা সামলাবে কি করে?শুভ অনুভব করলো আরজুর বেবী আসবে শুনে তার কষ্ট হচ্ছে না।বরং এক অজানা উত্তেজনা কাজ করছে।একটা ছোট্ট আরজু যদি গুটি গুটি পায়ে হাটে সেটা দেখতে পৃথিবীর সবচাইতে মনোমুগ্ধকর দৃশ্য হবে নিশ্চই?আরজু বসে পড়লো শুভর বাইকে।শুভ পেছনে তাকিয়ে বললো

-” তোর ঘোড়ার পাল কি পিছু পিছু আসবে?”

আরজু হেসে পেছনের গাড়িতে বসা সাইফুলকে দেখে বললো

-” হুম!! উপর থেকে কড়া নির্দেশ আছে।”

শুভ বাইক স্টার্ট করল।আজ অনেকদিন পর এই ভাবে শুভর বাইকে বসে পুরনো দিনের কথা মনে পড়ছে আরজুর।আরজু শুভর দিকে তাকালো।বেশ মনোযোগ দিয়ে ড্রাইভ করছে।আগের তুলনায় স্পীড অনেক কম।আরজু জানে শুভর এই সাবধানতার কারণ।সে মুচকি হাসলো।এমন প্রকৃত বন্ধু কয়জনের আছে।সে আসলেই ভীষণ ভাগ্যবতী।তার চারপাশে থাকা প্রতিটি পুরুষ ভীষণ যত্নশীল।নাহলে এই সমাজে হিংস্র,নোংরা মন মানসিকতার লোকের অভাব নেই।
আইসক্রিম খেতে খেতে শুভ বললো

-” এটাই লাস্ট।এই সময় নাকি বেশি ঠান্ডা খাওয়া ঠিক না।”

আরজু বিরক্ত হয়ে বললো
-“নানী দাদিদের মতো এতো কিছু জানিস কি করে?”

-” এসব বেসিক নলেজ। তোর মতো নিন্ম মানের গাধা বুঝবে না।”

-” তুই আমাকে গাধা বলতে পারলি?আসলে তো তুই গাধা।রিমি যে তোকে পছন্দ করে জেনেও না জানার ভান করছিস কেনো?”

শুভ জিন্সের পকেটে হাত রেখে আরজুর দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো

-” তুই সবার মন পড়তে পারিস শুধু আমাকে ছাড়া।”

আরজু কপাল কুঁচকে বললো
-” তোর মন পরবো কী করে?তোর মন তো আমাকে খোঁচানোর ধান্দায় থাকে?”

শুভ মৃদু হাসলো।যেই হাসির মানে আরজু বুঝতে পারলো না।আজকাল শুভর সবকিছুই তার কাছে ধোঁয়াশা মনে হয়।ছেলেটা এমন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে কেনো?শুভ আরজুর মাথায় হয় রেখে বললো

-“তোর মুখের এই স্নিগ্ধ হাসি দেখার জন্যই তো তোর পেছনে লেগে থাকতাম।তোর এই বত্রিশ দাত বের করা হাসি দেখার জন্যই এতো আয়োজন।তোকে এতো সুখী দেখে আমি সত্যি প্রশান্তি পাই।নাহিদ ভাই মানুষটা অমায়িক।উনার চাইতে বেশি সুখে তোকে কেউ রাখতে পারবে না।নাহিদ ভাইয়ের মধ্যে মানুষকে ভালোবাসার,সম্মান করার অদম্য শক্তি আছে।মানুষটার কাছাকাছি থাকেলই কেমন স্নিগ্ধতা ছেয়ে থাকে।তুই ভাগ্য করে তাকে পেয়েছিস।”

আরজু শুভর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো।কিন্তু চোখ অশ্রুসিক্ত।বললো

-” আমি জীবনে এমন অনেককেই পেয়েছি যারা আমাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেছে।তাদের আমি কখনোই হারাতে চাইনা।এই মানুষগুলো আছে বলেই এই আরজু এতো প্রানবন্ত।শুভ আমি জানি তুই আমাদের মধ্যে একটা অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করে রেখেছিস।তুই যদি ভাবিস আমাদের বন্ধুত্বের জন্য আমার সংসার জীবনে কোনো সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে তবে তুই ভুল।নেতা সাহেব মানুষটা চমৎকার।সে কোনোদিন আমাকে আমাদের বন্ধুত্ব নিয়ে প্রশ্ন করেনি।কোনো অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেনি।আমি তোকে হারাতে চাইনা শুভ।সবার জীবনে এমন একজন মানুষ থাকে যাকে নির্দ্বিধায় নিজের মনের কথা বলে দেয়া যায়।নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করা যায়।কারণ সে জানে সামনের মানুষটি কখনোই তার দুর্বলতার সুযোগ নিবে না।তুই আমার জীবনের সেই মানুষটি।কখনোই ভাবিস না আমার জীবনে নেতা সাহেব এসেছেন বলে তোর গুরুত্ব কমে গেছে।তুই আমার জীবনে ততটাই গুরুত্বপূর্ণ যতোটা পূর্বে ছিলি।তুই আমার কাছ থেকে দূরে সরে গেল আমি মানুষিক প্রশান্তি হারাবো।”

আরজুর অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে শুভ বুকে তীব্র ব্যাথা অনুভব করলো।আজ ভীষণ আফসোস হলো,তাদের এই মিষ্টি সম্পর্কের মাঝে তার এই ভালোবাসার উৎপত্তি না হলেই ভালো হতো।তাহলে আর এতো লুকোচুরি, অস্থিরতা থাকতো না।আরজু তো তার বন্ধুত্ব বজায় রাখতে পেরেছে কিন্তু শুভ কেনো পারলনা।একটা ছেলে মেয়ের মধ্যে কি প্রেম ছাড়া অন্য কোনো সুন্দর সম্পর্ক হতে পারে না? অবশ্যই পারে।এইযে আরজুর মনে তাদের বন্ধুত্ব নিয়ে কতটা সম্মানবোধ,ভরসা,নির্ভরতা আছে।শুভর মনেও তাই আছে।কিন্তু আলাদা একটা অনুভুতি যুক্ত হয়ে বাকি সবকিছুর রং ফিকে করে দিয়েছে।
________________________

সাবা খানম আরজুর প্রেগনেন্সির খবর শুনে খুশিতে কিছুই বলতে পারলেন না।এতো স্ট্রং একজন নারী হয়েও আরজুকে বুকে জড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ কাদলেন।অবনি বিরক্ত হয়ে বললো
-” আম্মু তোমার এই ফ্যাচ ফ্যাচ করে কান্না করার কি হলো?
আরজু আপু তো বিয়ের আগে প্রেগনেন্ট হয়ে যায়নি।”

সাবা খানম রেগে বললেন
-” দিবো এক চর।এসব কি কথা?অবশ্য তোর বিশ্বাস নেই।তুই কোনদিন কোলে বাচ্চা নিয়ে বাসায় ফিরে বলে ফেলিস, আম্মু তোমার নাতনি।দেখতে আমার মতো হয়েছে না?”

অবনি বিড়বিড় করে বললো
-” রোবট মানব অতো মর্ডান না।এই ব্যাটা বিয়ে করেও বাসর শুরু করতে তিন চার মাস লাগিয়ে দিবে।সে কিনা বিয়ের আগে কোলে বাচ্চা দিবে? ইম্পসিবল!!!”

জুবায়ের আহমেদ আরজুকে বুকে জড়িয়ে অজস্র দোয়া করলেন।বললেন

-” আমার সুইটির ঝুলিতে অজস্র সুখ এসে জমা হোক।”

আরজু হেসে বললো
-” জমা হতে হতে আবার ব্লক না হয়ে যায়।”

নাহিদ মুচকি হাসলো। সাবা খানম এই প্রথম নাহিদের মাথায় হাত রাখলেন।বললেন

-” ধন্যবাদ আপনাকে ভুল প্রমাণ করার জন্য।আরজুকে এতো আগলে রাখার জন্য।আমি ভুল ছিলাম নাহিদ।আসলে আরজু তোমার শুধু নিয়তি ছিলো না। শুদ্ধতম ভালোবাস ছিলো।তাইতো পরিবেশ,পরিস্থিতি কোনো কিছুই তোমাদের স্পর্শ করতে পারেনি।”

নাহিদ চমৎকার হেসে বললো
-” ধৈর্য মানুষকে ঠকায় না।বরং সঠিক সময়ে সেরা উপহার দেয়।”

সাবা খানম তৃপ্তির হাসি হাসলেন।সত্যি ছেলেটার ধৈর্য শক্তির প্রশংসা করতেই হয়।বর্তমান যুগে কেউ কি একজন মানুষের জন্য এতটা সময় অপেক্ষা করতে পারে?তাও অনিশ্চিত অপেক্ষা?দুর থেকেও কাউকে এতো গভীর ভাবে ভালোবাসা,অনুভব করা সম্ভব এই ছেলেকে না দেখলে জানতে পারতেন না।
_____________

এর মধ্যেই বেশ কয়েক জায়গায় শুভ আর ফুয়াদ ইন্টারভিউ দিয়েছিলো।আর একই কোম্পানিতে দুজনেরই চাকরি কনফার্ম হয়ে যায়।শুভর মা বাবা ছেলেকে স্বাভাবিক লাইফে দেখে ভীষণ খুশি হলো।শোভা জানে তার ভাই সেই ট্রমা থেকে বের হয়নি।কিন্তু সে চেষ্টা করছে দেখে বেশ ভালো লাগছে।শোভা মৃদু হাসলো।কিন্তু তার চোখ চক চক করছে।তারা দুই ভাই বোন ভালোবাসার ক্ষেত্রে বেশ খারাপ ভাগ্য নিয়ে জন্মেছে।যেদিন শুভর কাছে শুনলো ফুয়াদের অন্য একটি মেয়ের প্রতি তীব্র আসক্তি,ভালোবাসার কথা সেদিন তার কোমল হৃদয়টি ভেঙে গুড়িয়ে গেছে।ফুয়াদকে সে ভীষণ পছন্দ করতো,কিন্তু ভাইয়ের মতো তারও ভাগ্যে প্রথম ভালোবাসা পাওয়ার লেখা নেই। শোভা নিজেকে সামলে নিয়েছে।তার ভাই এতো বছরের ভালোবাসাকে ভুলে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করতে পারলে সে কেনো অল্প দিনের ভালোলাগাকে ভুলতে পারবে না।জীবন তো থেমে থেকে না।সে তার নিজ গতিতেই চলতে থাকে।

ফুয়াদের চাকরির খবর শুনে তার বাবা মা দুজনেই রেগে গেলেন।তাদের নিজেদের কোম্পানি থাকতে ছেলে কেনো অন্যত্র চাকরি করবে?তাদের এই অর্থ,প্রতিপত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী হয়ে সাধারণ মানুষের মতো জব করবে সেটা যেনো তারা মানতেই পারছেন না।ফুয়াদ নিজের সিদ্বান্ত অনড়।সে বললো

-” তোমাদের এইসব কিছুতে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই।আমি নিজের ক্যারিয়ার নিজে গড়বো।”

ফুয়াদের মা রেগে বললেন
-” এতো পরিশ্রম আমরা কার জন্য করেছি? তোমার জন্য।তোমার বেটার ফিচারের জন্য।”

ফুয়াদ মেকি হাসলো।বললো

-” মম তোমরা কখনো বুঝতেই পারোনি আমার আসলে কি প্রয়োজন।আমার তোমাদের অঢেল অর্থের প্রয়োজন কখনোই ছিলো না। মম আমি ছোটবেলা থেকে অল্পতে সন্তুষ্ট থাকতাম।আমি শুধু চাইতাম তোমরা আমার পাশে থাকো। আয়াদের কাছে বড়ো হয়েছি আমি।অথচ তখন আমার মায়ের প্রয়োজন ছিল।ব্যাথা পেলে আমি মাকে খুঁজতাম,মায়ের হাতে খেতে চাইতাম।মায়ের একটু আদর খুঁজতাম।কিন্তু তোমরা ছিলে না।আমার ছেলেবেলা দুর্বিষহ করে তোমরা আমার জন্য কিছু করনি।করেছ নিজেদের স্ট্যাটাস রক্ষা করার জন্য।তাই তোমাদের সেই অর্থের প্রয়োজন আমার নেই।”

ফুয়াদের মা বাবা ছেলের সিদ্ধান্তে আহত হলেন। ফুয়াদ ছোটবেলা থেকেই ভীষণ জেদি।যা ভাবে তাই করে।ফুয়াদের মায়ের আজকাল আফসোস হয়। নিজেদের ক্যারিয়ারের পেছনে ছুটতে যেয়ে ছেলেটাকে কখনোই সময় দেয়া হয়নি।তারা ব্যাবসায় সফল হলেও আদর্শ বাবা মা হতে পারেনি।
ফুয়াদ লামিয়াকে এই সুখবর জানালো।মেয়েটা ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড খুশি হলেও বাহিরে তা প্রকাশ করেনি।ফুয়াদ লামিয়ার হাত ধরে বললো

-“আমি জীবনের শেষ অব্দি তোমার হাত ধরে রাখবো।এক মুহূর্তের জন্য ছাড়বো না।বাবার যোগ্যতায় নয় নিজ যোগ্যতায় তোমাকে নিজের করবো।আমাদের ছোট্ট একটা সংসার হবে।সেখানে শুধু তুমি,আমি আর লামিসা থাকব।আমি অনেক বেপরোয়া একটা ছেলে।প্লিজ আমাকে সামলে নিও।একটু ভালোবেসে কাছে টেনে নিও।আমি তোমাকে দায়িত্বশীল একজন পুরুষ হয়ে দেখাবো।মনে রেখো এই পৃথিবীতে তোমরা একা নও।তোমাদের জন্য আমি ঢাল হয়ে সারাজীবন থাকবো।”

মেয়েটা কিছু বলতে পারে না। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সামনের অদ্ভুত এই মানুষটির দিকে।এমন যত্ন করে কেউ তাকে ভালোবাসে নি।কিন্তু এই মানুষটা তাকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসেছে।সে চাইলেও এই ছেলেটাকে ইগনোর করতে পারেনা।এটা লামিয়ার সাধ্য নেই।
_____________

সময় গড়ালো আরো কয়েকটা দিন। এর মাঝেই পুলিশ লিয়াকত আলীকে গ্রেফতার করেছে।তার বিরুদ্ধে করা বিভিন্ন বেআইনি কাজ আর দুর্নীতির অভিযোগ পুলিশ খতিয়ে দেখছে। তার বিরুদ্ধে সকল এভিডেন্স পেয়েছে তারা। সাদমান কেও গ্রেফতার করা হলেও সে জামিনে বের হতে পেরেছে।কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে কেস বিজ্ঞ আদালতে উঠানো হবে। তার বিরুদ্ধে স্ট্রং কোনো এভিডেন্স না থাকলেও পুলিশ পিছিয়ে নেই।সাদমান ছিলো লিয়াকত আলীর সহযোগী।লিয়াকত আলীর সব বেআইনি কাজে সাদমানের হাত আছে।লিয়াকত আলী কে সরাসরি ধরতে পারলেও এই সাদমানের মতো চতুর ছেলের জন্য যোগ্য প্রমাণ দিতে হবে।তাই পুলিশ এক জোট হয়ে কাজ করছে।

এসব খবরে পলিটিকাল পারায় বেশ সমাগম তৈরি হয়েছে।এতো বড়ো নেতার দুর্নীতির শিকড় ধরে টান দিতেই ডালপালা মেলা নেতারা আতঙ্কে আছেন।কখন তাদের নাম চলে আসে।দুর্নীতিবাজ নেতাদের মধ্যে নাহিদকে নিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।এই শান্ত,গম্ভীর ছেলেটা কেমন এক থাবায় এতো বড়ো নেতার কালো দিকটা উন্মুক্ত করে দিলো।যা এতদিন অন্য কেউ পারেনি।

নাহিদ এসব নিয়েই ব্যাস্ত ছিল।এতো ব্যাস্ততার মাঝে নিজের প্রিয়তমকে সময় দেওয়ার তীব্র চেষ্টা করে যাচ্ছে।তাইতো আরজুকে করা প্রমিজ অনুযায়ী তাদের হানিমুনের প্ল্যান করে ফেলেছে।এই মুহূর্তে দেশের বাহিরে যাওয়া সম্ভব না হলেও দেশে ভেতরেই পাহাড়ের চূড়ায় হানিমুন মন্দ হবে না।আরজু শুনে লজ্জা পেলো।বললো

-” আমিই প্রথম যে প্রেগন্নেন্সিতে হানিমুনে যাচ্ছে।”

নাহিদ আরজুকে বুকে জড়িয়ে দুষ্টু হেসে বললো
-” আমি সর্বদা এগিয়ে চলি ম্যাডাম।হানিমুনের পড়ে যা ঘটতো তা আগেই ঘটিয়ে ফেলেছি।”

আরজু লজ্জা পেয়ে নাহিদের বুকে কিল বসিয়ে দিলো।নাহিদ আরজুর হাত আটকে ধরে বললো
-” মেরে ফেলবে নাকি? এমনি তোমার প্রেমে মরে পরে আছি।আর কি মারবে?”

-” আপনি সভ্য গোছের অসভ্য লোক।”

-” আমার মতো এতো পাক পবিত্র নেতাকে অসভ্য বলছো?এমন প্রেমিক নেতা দেখেছো জীবনে?”

আরজু নাহিদের নাকে কামড় বসিয়ে বললো
-” প্রেমিক নেতা না ছাই।”

পরদিন নাহিদ আর আরজু চলে গেলো সাজেকের উদ্দেশে।নাহিদের অ্যাসিস্টেন্ট আসিফ তাদের ড্রাইভ করে নিয়ে গেলো।আসিফ বেচারাকে একটু অস্থির দেখলো।তাই নাহিদ বললো

-“কি ব্যাপার আসিফ, তোমাকে এতো অস্থির দেখাচ্ছে কেনো?”

আসিফ একটু চমকে গেলো।আমতা আমতা করে বলল
-” আসলে স্যার আপনি তো জানেন নতুন বিয়ে করেছি। নতুন মেরিড লাইফে নানান সমস্যায় আক্রান্ত আমি।বউকে যা বলি সে বুঝে তার উল্টোটা। আমি দক্ষিণ মেরুর আর সে উত্তর মেরুর।”

বলেই সে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।নাহিদ হেসে বললো
-” বউ মানেই একটা জটিল অঙ্ক বুঝলেন?এদের সঠিক সূত্রে সলভ না করলে খালি গরমিল ঘটেই যাবে।জীবনে মিলাতে পারবেন না।”

আরজু রাগান্বিত স্বরে বললো
-” একদম ফালতু কথা।বউকে একটু ভালোবেসে তার মন বুঝার চেষ্টা করুন দেখবেন সবটাই সহজ।”

সাজেকের পাহাড়ের চূড়ায় একটা ভিলাতে উঠলো তারা।শহরের কোলাহল ছেড়ে এই স্নিগ্ধ ,মনোরম মেঘের রাজ্যে এসে আরজুর মনটাই ভালো হয়ে গেলো।অতীতে তাদের বন্ধুমহলের সাথে সেই ট্রিপ,আর সেখানে নাহিদের সাথে কাটানো মুহূর্ত সব স্মৃতিচারণ করলো আরজু।সবুজে ঘেরা উচু নিচু পাহাড় আর তাতে মেঘের খেলা দেখে মনের সকল ক্লান্তি নিমিষেই দুর হয়ে যায়।এতদিনের কর্মব্যস্ততার পর নাহিদের নিজেরও এই নিস্তব্দ পরিবেশে বেশ অসাধারণ লাগছে।একটু রিফ্রেশমেন্ট বড্ডো প্রয়োজন।সারাদিন সাজেকের নানান জায়গায় তারা ঘুরে বেড়ালো।সময়টা বেশ চমৎকার কাটছে।সন্ধ্যা নামতেই তারা সেখানকার ট্রেডিশনাল খাবার ট্রাই করল।

খোলা বারান্দায় একটা চেয়ারে নাহিদের কোলে বসে রাতের আকাশ দেখছে আরজু।রাত বাড়তেই চারপাশে উষ্ণ মাতাল করা হওয়া বইতে শুরু করে।খোলা বারান্দায় তর তর করে বাতাস বইছে।নাহিদ পাতলা একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে আরজুকে বুকের মাঝে জড়িয়ে রাখলো।আরজু গুনগুন করে গান গাইছে।

এতো রোদ্দুর তুই এনে দিলি তাই
তোর বৃষ্টি আমি একটু পেতে চাই।

এতো রোদ্দুর তুই এনে দিলি তাই,
তোর বৃষ্টি আমি একটু পেতে চাই।
মেঘলা হয়ে যাক
আরও পাঁচটা বারো মাস
কোনো বিকেল বেলাতে,
তুই আমার হয়ে যাস।

শুধু তুই, শুধু তুই
আর চাইছি না কিছুই
শুধু তুই – শুধু তুই
আর চাইছি না কিছুই।

নিকষ কালো রাত।পাহাড়ের চূড়ায় ছেয়ে আছে নিস্তব্দতা।দূরে কোথাও ঝি ঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে।মাঝে মাঝে খেক শেয়ালের আর্তনাদ ভেসে আসছে।শীতল, স্নিগ্ধ,পরিবেশে বেশ গভীর ঘুমে মগ্ন আরজু আর নাহিদ।হঠাৎ করেই নাহিদের ঘুম ছুটে গেলো।কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল।পাশে ফিরে তাকালো প্রিয়তমার দিকে।একদম বাচ্চাদের মতো ঘুমাচ্ছে।নাহিদ খুব ধীরে সুস্থে আরজুকে নিজের বুক থেকে নামিয়ে বালিশে শুইয়ে দিলো।চারপাশে সচেতন দৃষ্টিতে তাকালো।জানালার কাছে যেয়ে আশেপাশে চোখ বুলালো।বাইরে তীব্র আঁধার ছেয়ে আছে।বারান্দার ছোট্ট আলো সেই আঁধারকে কাটিয়ে উঠতে পারেনি।বাহিরে তেমন কিছুই তার নজরে পড়লো না।নাহিদের কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে।তার মস্তিষ্ক কেনো যেনো বিপদের আভাস পাচ্ছে।নাহিদ কয়েক মুহূর্ত পায়চারি করে দ্রুত আসিফকে কল করলো।আসিফ কল রিসিভ করছেনা।ছেলেটা কি গভীর ঘুমে? দুতলা ভিলার নিচ তলায় আছে আসিফ।নাহিদের চিন্তা বাড়তে লাগলো।আশেপাশে যথেষ্ট সিকিউরিটি আছে।তবুও নাহিদের অস্থিরতা কাটছে না।তাদের এইখানে আসার বিষয়ে কাছের মানুষজন ছাড়া আর কেউ জানেনা।নাহিদ একটু ভেবে দ্রুত কল করলো নিজের বন্ধু আসফি কে।দুইবার রিং হওয়ার পরই আসফি কল রিসিভ করলো।ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো

-” তুই একমাত্র পুরুষ যে হানিমুনে যেয়ে মাঝ রাতে বউ রেখে বন্ধুকে কল করে।”

নাহিদ চিন্তিত সুরে বললো
-” আসফি আই থিঙ্ক সাম থিং ইস ফিসি। আই নিড ব্যাকাপ।”

মুহূর্তেই আসফির ঘুম ছুটে গেলো।সে এক লাফে উঠে বসলো।অস্থির হয়ে বললো

-” লিভ দি’স প্লেস রাইট নাও।”

বলেই কল কেটে দ্রুতই কোথাও কল করলো।
অন্যদিকে নাহিদকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে।সে বিছানায় গভীর ঘুমে মগ্ন আরজুর দিকে তাকালো।কি নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে মেয়েটা।নাহিদ আরজুর পাশে বসে পড়লো।আরজুর উন্মুক্ত উদরে চুমু খেয়ে বিড়বিড় করে বললো

-” তোমাদের গায়ে একটা আঁচড় ও লাগতে দিবো না। পাপার প্রমিজ।”