মুগ্ধতায় তুমি পর্ব-১৮

0
779

#মুগ্ধতায়_তুমি
#পর্বঃ১৮
#Saiyara_Hossain_Kayanat

রক্তাক্ত নিথর দেহটা ঘিরে ধীরে ধীরে মানুষের ভিড় জমে যাচ্ছে। নিজেকে কোনো মতে সামলিয়ে দৌড়ে গেলাম মানুষটার কাছে। পিটপিট করে চোখ মেলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে হাল্কা এক তৃপ্তিময় হাসি ফুটে উঠেছে। হাত দিয়ে পাশে পড়ে থাকা ডায়েরিটার দিকে ইশারা করলেন আহনাফ। সাথে সাথেই তার পাশেই স্তব্ধ হয়ে বসে পরলাম আমি। ডায়েরিটা এক হাতে নিয়ে আরেক হাত দিয়ে ওনার এক হাত ধরেই কান্না ভেঙে পরলাম। শুভ্র ভাই দৌড়ে এসে আহনাফকে করে কোলে তুলে ভীড় ঠেলে গাড়ির দিকে নিয়ে গেলেন।
গাড়ির পিছনের সিটে বসে আহনাফের মাথা নিজের কোলে রেখে ওড়না দিয়ে চেপে ধরে রক্ত পরা বন্ধ করার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আর অনবরত চোখেরজল ফেলছি। শুভ্র ভাইকে বার বার তাড়া দিচ্ছি গাড়ি দ্রুত চালানোর জন্য। শুভ্র ভাই দ্রুত গাড়ি চালিয়ে পাশের একটা হসপিটাকে নিয়ে আসলেন।

——————

আইসিইউর বাহিরে এক হাতে ডায়েরি নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে আছি। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি আইসিইউর দরজার দিকে। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে আহনাফকে ভিতরে নিয়ে গেছে। কিছুক্ষন আগেই আমার মাথায় ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে ডক্টর। শুভ্র ভাইয়ের ধমকেই ব্যান্ডেজ করতে বাধ্য হয়েছি। হাল্কা একটু কেটে গেছে কপালের পাশ দিয়ে তাই তেমন একটা খেয়াল ছিলো না আমার।
শুভ্র ভাই আমার পাশে বসেই আমাকে এক হাতে জরিয়ে ধরে আছে। শুভ্র ভাইও যেন নিশ্চুপ হয়ে গেছে আজ। কোনো কথা বলছে না হয়তো আমাকে স্বান্তনা দেওয়ার মতো কোনো ভাষা খুজে পাচ্ছে না। দেখে মনে হচ্ছে উনি নিজেও এমনটা আশা করেনি। আমার চোখের পানি শুকিয়ে গেছে এখন আর পরছে না। বসে বসে শুধু আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছে আহনাফের যেন কিছু না হয়। আমার জন্য ওনার এই অবস্থা হয়েছে তা আমি সহ্য করতে পারছি না। কি থেকে কি হয়ে গেল!! সব কিছুই তো ভালো চলছিলো তাহলে আজ কেন আহনাফের এমন অবস্থা হলো!! আমি তো ওনাকে অনেক আগেই মাফ করে দিয়েছি। আমি তো তাকে এমন পরিস্থিতিতে দেখতে চাইনি তা-ও আবার আমারই জন্য।

———————

একদিন পর আহনাফের জ্ঞান ফিরেছে তার বেডের পাশেই চেয়ার নিয়ে বসে আছি আমি। নীরবে চোখের পানি ফেলছি। ওনার হাতে পায়ে আর মাথায় পেচানো ব্যান্ডেজে লাগানো রক্ত গুলো শুকিয়ে আছে। দেখেই বার বার ভয়ে আঁতকে উঠছি। শুভ্র ভাই আমাকে এখানে একা রেখেই চলে গেলেন বাহিরে হয়তো আমাদেরকে একা কথা বলার সু্যোগ দিয়েছেন। আহনাফ হাল্কা নেড়েচেড়ে উঠলেন তারপর আস্তে-ধীরে কথা বলা শুরু করলেন। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে।

—”তুমি ঠিক আছো তো অনন্যা?? মাথায় বেশি ব্যথা পেয়েছো?”

আহনাফের কথা শুনে বেশ অবাক হলাম। উনি নিজেই তো মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে অথচ এখনো আমার কথা চিন্তা করছে!!!

আমি কান্না করতে করতেই বললাম-

—” আমি ঠিক আছি কিন্তু আপনি কেন এমন করলেন!! আমার জন্য আপনি নিজের জীবনের এতো বড় ক্ষতি কিভাবে করলেন আহনাফ?”

আহনাফ কিছুক্ষন চুপ থেকে আস্তে আস্তে বললেন-

—”আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবেসেছিলাম অনন্যা। আমার চোখের সামনে তোমার ক্ষতি হতে দেই কি করে বলো!!! হয়তো আর কখনো বলার সুযোগ না-ও পেতে পারি। তাই এখন বলছি তোমাকে আমি ধোকা দিতে চাইনি তোমাকে কষ্ট দিয়ে আমি ভালো ছিলাম না অনন্যা।”

কথা গুলো বলতে বলতে আহনাফ হাঁপিয়ে উঠছে। আমি কান্না করতে করতেই ওনার হাত ধরে অস্থির কন্ঠে বললাম-

—” আপনি সুস্থ হয়ে উঠবেন আমি জানি। আপনি এখন শান্ত হোন বেশি কথা বলতে হবে না এখন।”

আমার কথার মাঝেই শুভ্র ভাই এসে আমার পাশে দাঁড়ালেন। আহনাফ শুভ্র ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন-

—” আমি জানি অনন্যা আপনার কাছে ভালো থাকবে। তবুও একটা রিকুয়েষ্ট আমার মতো আপনি অনন্যাকে কখনো কষ্ট দিয়েন না।”

শুভ্র ভাই মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালেন। আমার দিকে তাকিয়ে আবার বললেন-

—” আরে পাগলি মেয়ে আমি মরে যাইনি এখনও এভাবে কান্না করছো কেন?”

আমি নিজেকে সামলিয়ে কিছুটা শক্ত গলায় বললাম-

—” বার বার এসব আজে বাজে কথা বলবেন না আহনাফ।”

আহনাফ কিছু বললেন না একটু মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলেন।

————————

আহনাফের ডায়েরিটা হাতে নিয়ে ভাবছি খুলবো কি না। এতো দিন এটা আহনাফের কাছেই ছিলো। এই লোকটা হসপিটালের মধ্যেও এই ডায়েরি দিয়ে কি করেছে আল্লাহ মালুম। আজ আহনাফকে হসপিটালকেই থেকে বাসায় সিফট করা হয়েছে। যাওয়ার সময়ই আমার হাতে এটা ধরিয়ে দিয়ে বলেছেন-

—” আজ থেকে এটা তোমার অনন্যা খুব যত্ন করে রেখো। আমি কিন্তু যে কোনো সময় জানতে চাইবো ডায়েরিটা ঠিক আছে কি না।”

আমি শুধু মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলেছিলাম। তারপর শুভ্র ভাইয়ের সাথে বেশ কিছুক্ষন কথা বলে আহনাফ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেছেন। এখনো ভালো করে হাটতে পারেন না কিছু কিছু জায়গার ক্ষত এখনও পুরো পুরি ভালো হয়নি। শুভ্র ভাই এই ক’দিন আহনাফের সকল খেয়াল রেখেছে। আর শুভ্র ভাইয়ের সাথে আহনাফের বেশ ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে এই কিছু দিনে।

বেশ কিছুক্ষন ভেবে চিন্তে অবশেষে ডায়েরি খুলে প্রথমেই বড় বড় করে ‘আহনাফের প্রেয়সী’ লেখাটা চোখে পরলো।

প্রথম পাতায় লেখা- “এতোদিন তোমাকে ধোকা দিচ্ছি এটা ভেবে অপরাধ বোধ কাজ করছিলো। কিন্তু এখন যখন আমি বুঝতে পারলাম আমি তোমার প্রতি দূর্বল হয়ে পরছি এখন তোমাকে হারানোর ভয় পাচ্ছি।”

আর কয়েক পৃষ্ঠা পরেই লেখা-” আমার ভয়টাই সত্যি হয়ে গেল প্রেয়সী। হারিয়ে ফেললাম তোমাকে আমি। এভাবে দূরে না ঠেলে আমার কাছে থেকেই আমাকে শাস্তি দিতে পারতে তুমি।”

ডায়েরির পাতা উলটে পালটে সব পড়তে লাগলাম বেশ মনোযোগ দিয়ে। ডায়েরির প্রতিটি পাতা শুধু আমাকে নিয়েই লেখা। ডায়েরিতে আমাকে উল্লেখ করেছে ‘আহনাফের প্রেয়সী’ লিখে। শেষের কিছু পাতায় দেখলাম লেখা গুলো বেশ অগোছালো আর আঁকাবাঁকা করে লেখা। প্রথম লাইন পরতেই বুঝলাম এগুলো হসপিটালে বসে বসে লিখেছে। মানুষটা কতো পাগল হসপিটালে ও আমাকে নিয়ে ডায়েরি লিখতে ভুলে যায়নি।

“জানো তো প্রেয়সী তোমাকে ওই মুহুর্তে গাড়ির সামনে দেখে খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম তাই কোনো কিছু না ভেবে তোমাকে ধাক্কা দিয়েছিলাম। যখন রাস্তায় পড়ে নিভু নিভু চোখে তোমার দিকে তাকিয়ে তোমাকে চোখেরজল ফেলতে দেখলাম তখন যেন মনে হয়েছিলো আমি স্বার্থক হয়েছি তোমায় বাঁচাতে। মাঝে মাঝে মনে হয় আমার বন্ধুরা আমাকে এই ডেয়ার দিয়ে খুব ভালো করেছিলো তাদের জন্যই তোমাকে পেয়েছিলাম। কিন্তু ওদের এই গেইমের জন্যই আবার তোমাকে হারিয়ে ফেললাম। তবে আমি জানি তোমার মনে একদিনের জন্য হলেও আমাকে নিয়ে অনুভূতি ছিলো।

আমি স্বার্থক আমার প্রেয়সীকে অল্প দিনের জন্য হলেও কাছে পেয়ে।
আমি স্বার্থক তোমার প্রথম অনুভূতি হতে পেরে।
আমি স্বার্থক তোমার জীবনের প্রথম প্রেমিক পুরুষ হতে পেরে।
আমি স্বার্থক প্রথম তোমার হাত ধরে রাস্তায় হাঁটার সুযোগ পেয়ে।
তবে অবশেষে,
আমি ব্যর্থ আমার প্রেয়সীকে কাছে পেয়েও হারিয়ে ফেলে।

আমি জানি শুভ্র তোমাকে খুব ভালো করেই আগলে রাখবে। আমি নিশ্চিন্তে আহনাফের প্রেয়সীকে শুভ্রের হাতে তুলে দিতে পারি। আমি না হয় আমার প্রেয়সীর স্মৃতি গুলো নিয়ে ভালো থাকবো। আর তোমার কথা মতো নিজেকে এগিয়ে নিতে চেষ্টা করবো।

ইতি
তোমার প্রথম প্রেমিক পুরুষ। ”

ডায়েরির শেষ পাতা গুলো পড়ে নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে নোনাজল গড়িয়ে পরছে। নিস্তব্ধ হয়ে আছি আমি কি থেকে কি হয়ে গেল!! মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে মানুষটা তার জীবনে আমাকে এতটা জায়গা দিয়ে ফেলেছে যে আমাকে রক্ষা করার জন্য নিজের জীবনটা পর্যন্ত বিলিয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করে নি!!! দুটো বছর ধরে আমাকে তার প্রেয়সী বানিয়ে ডায়েরিতে সাজিয়ে রেখেছে!! খুব অবাক লাগছে এই মুহুর্তে।

হঠাৎ করে পাশে কারো অস্তিত্ব অনুভব করলাম। আমি জানি মানুষটা কে তাই পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখতে হলো না। শুভ্র ভাই বেশ শান্ত গলায় বলে উঠলেন-

—” আহনাফ তোকে খুব ভালোবাসে অনন্য। আমি হয়তো কখনো তোকে আহনাফের মতো ভালোবাসতে পারবো না। আচ্ছা অনন্য আমি কি তোদের মাঝে এসে পরেছি?”

আমি শুভ্র ভাইয়ের কাধের মাথা এলিয়ে দিয়ে নরম গলায় বললাম-

—” এটাই হয়তো আমাদের তিনজনের নিয়তি ছিল। আর আমাদের ভাগ্য তো সেই ছোট বেলাই ঠিক হয়ে গেছিলো। তাই এখন এসব ভেবে নিজেকে দায়ী করবেন না।”

শুভ্র ভাই কিছু বললেন না নিশ্চুপ হয়ে বসে আছেন।

চলবে……