মুগ্ধতায় তুমি পর্ব-২৭ এবং শেষ পর্ব

0
1471

#মুগ্ধতায়_তুমি
#পর্বঃ২৭(অন্তিম পর্ব)
#Saiyara_Hossain_Kayanat

রাত বারোটা বাজে এই সময় সং সেজে বসে আছি। আরও আধা ঘণ্টা পর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু করবে। সবাই পাগল হয়ে গেছে তা না হলে এই সময় অনুষ্ঠান করার জন্য রাজি হয় কিভাবে ওনারা!! আমার কাজিনদের কথা না হয় বুঝলাম ওরা এমনিতেই তারছিড়া সব গুলা তবে বড়রা রাজি হলো কেন আজব!! বিরক্ত লাগছে না ঘুমিয়ে এভাবে বসে থাকতে। আমার পুরো শরীর তাজা ফুলে সজ্জিত। এটা শুভ্র ভাইয়ের ইচ্ছে নাহ ইচ্ছে বললে ভুল হবে এটা ওনার হুকুম। উনি নিজেই সব কিছু কিনে নিয়ে এসেছে আমার জন্য। আর কড়া গলায় বলে দিয়েছেন আমাকে যেন আর্টিফিশিয়াল ফুল দিয়ে সাজানো না হয়। সাদা গোলাপ, বেলি, আর গাঁদা ফুল দিয়েই সাজাতে হবে। একদমই ভারি মেকআপ করা যাবে না হাল্কা লিপস্টিক,কাজল আর হাতে পায়ে আলতা থাকবে এর বেশি কিছু না। আমার সাজ নিয়ে ওনার এমন কড়া হুকুম শুনে আমি, মিমশি আর অর্থি তিনজনই রেগে গিয়েছিলাম। মেয়েদের সাজ নিয়ে ওনার কেন এতো নাক গোলানো লাগবে অসভ্য লোক!! তবে ওনার কথা মতো সাজানো পর আমি নিজেকে দেখেই চমকে গিয়েছিলাম। শুভ্র সাদা আর হলুদ রঙের জামদানী শাড়ির আর সাথে শুভ্র রঙের গোলাপ, বেলি আর গাদা ফুলের সাজে নিজেকে একদম ফুলের রাজ্যের রানী মনে হচ্ছে। একদম সতেজ ফুলের মতো লাগছে আয়নায় নিজেকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছি। আর মনে মনে ভাবছি লোকটা অসভ্য হলেও সাজগোজের ব্যাপারে রুচি বেশ ভালোই আছে। মিমশি আমাকে দেখে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো-

—”দোস্ত আমি ছেলে হলে আজ শুভ্র ভাইকে কোনো চান্স দিতাম না। তোকে এই বিয়ে বাড়ি থেকেই তুলে নিয়ে ডিরেক্ট বিয়ে করে ফেলতাম।”

মিমশির কথা শুনে আমি আর অর্থি দুজনেই হেসে দিলাম। অর্থিও মিমশির সাথে তাল মিলিয়ে বললো-

—”সত্যি আপু তোমাকে একদম ফুলের মতো সুন্দর লাগছে বলে প্রকাশ করা যাবে না।”

আমি ওদের কথায় মুচকি হাসলাম। বারোটা বিশ বাজতেই শুভ্র ভাই হন্তদন্ত হয়ে আমার রুমে আসলেন। ওনার দিকে তাকিয়ে দেখলাম শুভ্র রঙের পাঞ্জাবির উপর হলুদ রঙের কটিতে বেশ সুন্দর লাগছে ওনাকে। ওনার ফর্সা ত্বকে যেন সব কিছুই একদম ফুটে ওঠে। উনি আমার দিকে বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে একটা মুচকি হাসি দিয়ে নরম গলায় বললেন-

—”আলতা আনতে ভুলে গিয়েছিলাম এখন নিয়ে আসলাম তুই চেয়ারে বস আমি লাগিয়ে দিচ্ছি।”

ওনার কথা শুনে অর্থি দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে বললো-

—”এই মিমশি চল… বর বউকে আলাদা একটু টাইম দেওয়া উচিত। ভাইয়া আপনি আপনার কাজ করুন আমরা যাচ্ছি। তবে বেশি সময় নিয়েন না বিয়ের পর অনেক সময় পাবেন”

ওরা দুজন চলে গেলে শুভ্র ভাই আমার কাছে এসে আমাকে চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। তারপর আস্তেধীরে হাতে আর পায়ে আলতা লাগিয়ে দিলেন। তারপর দাঁড়িয়ে আমাকে দিকে খানিকটা ঝুঁকে কানে ফিসফিস করে বললেন-

—”তোমাকে আজ একদম ফুলের মতো লাগছে। তাজা ফুলের সৌরভে একদম মউ মউ তোমার চারপাশ। মুগ্ধতা ছেয়ে আছে তোমাকে ঘিরে আর আমি সেই মুগ্ধতায় পুড়ছি। তবে আমি ভালোবাসি তোমার মুগ্ধতায় নিজেকে পোড়াতে। কালকেই তুমি এই মুগ্ধ প্রেমিকের শহরে নিখোঁজ হবে যেখান থেকে আর কখনো বের হতে পারবে না।”

ওনার কথা শুনে কিছুক্ষণের জন্য আমি থমকে গেলাম পরক্ষণেই আবার লজ্জার আক্রমণে নুয়ে পরলাম। শুভ্র ভাই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন-

—”চল ছাদে যাই সময় হয়ে গেছে সবাই অপেক্ষা করছে হয়তো।”

আমি চুপচাপ ওনার সাথে চলে গেলাম। ছাদে তেমন মানুষ নেই আমাদের ফ্যামিলির কেউ বড় করে বিয়ের অনুষ্ঠান করা বা জোরে জোরে গানবাজনা করা পছন্দ করে না তাই শুধু আমাদের কাছের মানুষদেরই দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। আর মানুষ দাওয়াত দিলেই বা কি এই মাঝ রাতে কে আসবে পাগলের মতো বিয়ের অনুষ্ঠান দেখতে!! আমি চারপাশে ভালো তাকিয়ে দেখলাম এই অল্প সময়েই খুব ভালো করে সাজিয়েছে। কেউ ঘুমে ঝিমাচ্ছে আবার কেউ কাজ করছে। বেচারাদের এই রাতের বেলায়ও শান্তি নেই। হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হলো তবে অবাকের বিষয় হলো আমার কাজিনরা ঠিক করেছে আগে বর বউ নিজেরা একে অপরকে হলুদ ছোঁয়াবে তারপর অন্য সবাই। তাদের কথা মতোই হলো সব। শুভ্র ভাই আমাকে হলুদ লাগালেন তারপর আমি ওনাকে লাগালাম। এরপরই শুভ্র ভাই আহনাফকে ডাক দিয়ে বললেন-

—”আহনাফ আসো তুমি আগে আমাদেরকে হলুদ লাগিয়ে দিয়ে যাও৷”

এই কথা শুনে আহনাফের চোখ খুশিতে চকচক করে উঠলো। আহনাফ হাসি মুখে আমাদের কাছে এসে আগে আমার গালে হলুদ লাগিয়ে দিয়ে বললেন-

—”শুভকামনা রইলো তোমার নতুন জীবনের জন্য।”

আমি তার কথার বিনিময়ে একটা নম্র হাসি দিলাম। তারপর উনি শুভ্র ভাইকে হলুদ লাগালেন। শুভ্র ভাই হয়তো আহনাফের এই খুশিটাই দেখতে চেয়েছিলেন। এই লোকটা সব কিছুর খেয়াল রাখে।

হলুদের অনুষ্ঠান শেষ করতে করতে দুই টা বেজে গেছে। তারপর গোসল করে এসে আবারও সব কাজিন আর ফ্রেন্ডরা মিলে ছাদে আড্ডা দিলাম। আমি বুঝি না এই মানুষ গুলার এতো এনার্জি আসলো কোথাথেকে এই মধ্য রাতেও এদের কে আড্ডা দিতে হবে!!! ঘুমাতে ঘুমাতে প্রায় তিন টা বাজলো।

————————

সকালের ঘুম ভাঙলো এগারো টায়। নাস্তা করে সবার সাথে আড্ডা দিয়ে সারাদিন কিভাবে চলে গেল বুঝতেই পারলাম না। সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ করেই মনে পরলো আমার বিয়ের জন্য কোনো মার্কেটই করা হয়নি। মিমশিকে জিজ্ঞেস করার পর বললো ও এই ব্যাপারে কিছু জানে না এই সব কিছুর দায়িত্ব শুভ্র ভাইয়ের উপর। শুভ্র ভাইকে গিয়ে বললাম-

—”শুভ্র ভাই বিয়ের মার্কেট তো করা হয়নি আজ বিয়েতে কি পরবো?”

শুভ্র ভাই স্বাভাবিক ভাবেই বললেন-

—”এইসব নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না অনন্য। আমি সব কিছু আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছি। তুই এখন রুমে যা কিছুক্ষণ পর তোর ড্রেস আর তোকে সাজানোর মানুষ চলে আসবে তার কথা মতোই তুই নিজেকে সাজাবি।”

এই কথা বলে একটা মুচকি হাসি দিয়ে চলে গেলেন। আর আমিও আমার রুমে চলে আসলাম।

——————

বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে আর তার হাতের বিয়ের সব জিনিসপত্রের দিকে। ফোনের মেসেজর টুংটাং শব্দে আমি বিস্ময় কাটিয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম শুভ্র ভাইয়ের মেসেজ। স্পষ্ট বাংলা ভাষায় লেখায়-

“আমি জানি তুই খুব অবাক হয়েছিস আহনাফকে দেখে। জানিস এক্সিডেন্টের দিন আমি তোকে প্রায় হারিয়েই ফেলেছিলাম কিন্তু এই মানুষটাই নিজের জীবনের কোনো চিন্তা না করে তোকে আমার কাছে ফিরে দিল। আহনাফের কাছে আমি খুব ঋণী অনন্য। তোকে দেওয়া আহনাফের ডায়েরির একটা পাতায় দেখেছিলাম আহনাফ বিয়েতে তোকে একদম নিজের মতো করে সাজাতে চায়। তোকে তো আর আহনাফের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারবো না তবে ওর এই ছোট ছোট ইচ্ছে গুলো তো পূরন করতেই পারি তাই না অনন্য!! আহনাফ ইতস্ততবোধ করছিলো কিন্তু আমিই জোর করে ওকে তোর কাছে পাঠিয়েছি। তুই কিছু মনে করিস না অনন্য। প্রাক্তন হলেও এই আহনাফই তোর জীবন বাচিয়েছে। ওর জন্যই আমার তোকে পাওয়া।”

শুভ্র ভাইয়ের মেসেজটা পরে কিছুক্ষনের জন্য নিজেকে অনুভূতি শূন্য মনে হচ্ছিলো। আসলেই তো এই মানুষটা না থাকলে হয়তো আজ আমি জীবিত থাকতাম না। উনি তো আমাকে নতুন জীবন দিয়েছে। এই মানুষটার ইচ্ছে পূরণ করা তো তেমন কোনো কঠিন কিছু না।

———————

রাত প্রায় সাড়ে বারো টা লাল টুকটুকে বউ সেজে দাঁড়িয়ে আছি আহনাফের সামনে। আহনাফের দেওয়া লাল শাড়ি, খোপায় লাল গোলাপ, লাল চুড়ি আর লাল দোপাট্টা দিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে আহনাফের কথা মতো সেজেছি। মুখেও তেমন কোনো মকআপ নেই। এই মুহূর্তে আহনাফ আর আমি অবশ্য প্রথমে একটু অস্বস্তিবোধ করছিলাম কিন্তু পরক্ষনেই আমরা নিজেকে স্বাভাবিক করে নেই। আয়নায় নিজেকে দেখে পিছন ফিরে আহনাফের দিকে তাকিয়ে দেখলাম। ওনার ঠোঁটের কোণে এক বিশ্বজয়ী হাসি হয়তো আমাকে তার মন মতো বউ সাজাতে পেরেছে তাই। আমার পুরো জীবনটা অপ্রত্যাশিত মুহূর্তে ঘিরে আছে। মধ্য রাতে বিয়ে নিজের প্রাক্তনের কাছেই বউ সেজে এখন ভালোবাসার মানুষকে আপন করতে যাবো। এসব তো আমি কখনো কল্পনাও করে দেখিনি। আমার ভাবনার মাঝেই আহনাফ বললেন-

—”কেমন লাগছে নিজেকে বউ সাজে বললে না যে!”

আসলেই আজ নিজেকে আমি একদম অন্য রূপে দেখছি। অন্য এক অনন্যার রূপে। আমি মুচকি হাসি দিয়ে বললাম-

—”খুব সুন্দর… মনে হচ্ছে লাল পরিরা এসে এখনই আমাকে নিয়ে চলে যাবে।”

আমার কথায় আহনার একটু হাসলেন পরক্ষনেই হাসিটা আবার ঠোঁটে মিলিয়ে গেল। মাথা নিচু করে আছে উনি হয়তো কিছু একটা ভাবছে। বেশ কিছুক্ষন বাদে নরম গলায় আমতা-আমতা করে বললেন-

—”অনন্যা শেষবারের মতো একটা কথা রাখবে?”

আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালাম। খেয়াল করে দেখলাম উনি বেশ অস্বস্তি বোধ করছে। হয়তো ভাবছে আমি কিছু মনে করবো। ইতস্তত করে শেষমেশ নিম্ন স্বরে বললেন-

—”তোমাকে প্রথম আর শেষ বারের মতো একবার জড়িয়ে ধরতে দিবে?? অন্য কিছু না একজন বন্ধু বা শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে।”

আহনাফের সাথে আমার সম্পর্ক ছিল ঠিকই তবে কখনো হাত ধরা ছাড়া এর বেশি কিছুই চায় নি কখনো। তাই হয়তো এই কথাটা বলতে এতো অস্বস্তিতে ছিলেন। আমি এবারও মাথা ঝাকিয়ে সম্মতি জানালাম। সাথে সাথেই আহনাফ আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। এই জড়িয়ে ধরায় কোনো কিছুর আকাক্ষা নেই… নেই কোনো চাহিদা বা কোনো খারাপ উদ্দেশ্য। আছে শুধু কিছু সুপ্ত অনুভূতি আর স্বার্থহীন ভালোবাসা। আহনাফ বেশ শান্ত গলায় বলে উঠলেন-

—”কখনো এভাবে এই মুহূর্তে তোমাকে জড়িয়ে ধরতে হবে ভাবিনি। তাবে যাইহোক তোমাকে আর শুভ্রকে অনেক ধন্যবাদ আমার ইচ্ছে গুলোকে মূল্য দেওয়ার জন্য। শুভেচ্ছা তোমাদেরকে… তোমার নতুন জীবন সুখের এটাই চাই।”

এই কথা বলে একটু থামলেন। আমি আমার ঘাড়ে গরম কিছু অনুভব করছি ভেজা কিছু আমার দোপাট্টা বেধ করে ঘাড়ে এসে পরছে। তার মানে কি আহনাফ কান্না করছে!! এই গরম ভেজা জিনিসটা কি ওনার চোখেরজল!!

আহনাফ আবারও শান্ত গলায় বললেন-

—আজ তুমি অন্য কারো হয়ে যাবে তাই শেষবারের মতো বলছি “তুমি আমার জীবনের এক ধ্রুবতারা মতো হয়ে এসেছিলে। আমার জীবনের সুপ্ত স্মৃতি হয়ে থাকবে তুমি আজীবন। ভালোবাসি তোমাকে প্রেয়সী আমার। কোনো স্বার্থ ছাড়াই ভালোবাসি।”

এই কথা বলেই আমাকে ছেড়ে দিয়ে হনহনিয়ে চলে গেলেন। আমার দিকে তাকায়নি হয়তো চোখের পানি আড়াল করতে চাইছে। খুব করে দোয়া করি অর্থি যেন ওনার মনে নিজের জায়গা করে নিতে পারে। ওনাকে আমি ভালোবাসা দিতে পারিনি তবে অর্থি যেন ওনার প্রাপ্য ভালোবাসা টুকু ওনাকে দেয়। খুব ভালো থাকুক উনি ওনার জীবন নিয়ে।

——————

রাত একটায় ছাদে দোলনায় আমি আর শুভ্র পাশাপাশি বসে আছি। খুব বেশিই ঘুম পাচ্ছে আমার শুধু আমার কথা বললে ভুল হবে অনেকেই ঘুমে ঝিমাচ্ছে, হামি দিচ্ছে। তবে আমার ভাইয়েরা আর মিমশি খুব ফুর্তিতেই আছে। আহনাফ কিছুটা দূরেই অর্থির সাথে দাঁড়িয়ে আছে। আমার কাজিনদের ছাড়া আর কাউকেই দেখে মনে হচ্ছে না এখানে বিয়ে হচ্ছে। আর আমার আব্বু আম্মুর তো তেমন কোনো অনুভূতিই আমি দেখছি না হয়তো পাশের ফ্ল্যাটই বিয়ে করে যাবো তাই তাদের কোনো ভাবান্তর নেই। কেমন বিয়ে হচ্ছে এটা!!! সব পাগলের দল এভাবে নাকি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কারো বিয়ে হয়!!

ঘুমের জন্য কাজি কবুল বলার সাথে সাথে আমি বলে দিলাম। আমার এমন কাজ দেখে সবাই হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আহনাফও মুচকি মুচকি হাসলেন। শুভ্র ভাই কবুল বলে বিয়ে সম্পূর্ণ করলেন। হ্যাঁ এখন থেকে আমরা ইসলামিক ও আইনের দৃষ্টিতে একে অপরের হয়ে গেলাম। এখন আর কোনো দূরত্ব নেই৷ আমাদের মাঝে। আর কিছু খেয়াল নেই আমার কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি নিজেও জানি না।

———————

ঘুম থেকে ওঠার পর নিজেকে শুভ্র ভাইয়ের রুমে আবিষ্কার করলাম। কেউ নেই আমিই একা এই রুমে। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলাম দশটা বাজে। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বের হতেই দেখলাম ড্রয়িং রুমে সবাই ফোনে কিছু একটা দেখছে আর এক একজন হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আমি উৎসুক হয়ে দেখতে গেলাম। সাইফ ভাইয়ার হাত থেকে ফোন নিয়ে দেখলাম আমাদের বিয়ের ভিডিও। আমি কবুল বলার পরেই দোলনায় শুভ্র ভাইয়ের কাধে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পরেছিলাম তাই শুভ্র ভাই সবার সামনেই আমাকে কোলে তুলে ওনার রুমে নিয়ে এসেছে। এই পুরোটা ভিডিও করেছে আর এক এক জন পাশ থেকে হাসাহাসি করছে। ছিঃ ছিঃ এটা কেমন বিয়ের ভিডিও!! লজ্জায় আমার মাথায় কাটা যাচ্ছে। শুভ্র ভাইও এদের সাথে তাল মিলিয়ে হেসে যাচ্ছে। আমি লজ্জায় আবার রুমে চলে আসলাম। রুমে আসার সাথে সাথেই ঝড়েরবেগে শুভ্র ভাই এসে আমার গালে টুপ করেই একটা চুমু খেলেন। ওনার এমন কাজে আমি পুরোই থ মেরে রইলাম। উনি আমার কানে ফিসফিস করে বললেন-

—”রেডি থেকো বউ আমার নতুন অত্যাচারের জন্য।”

এই কথা বলে উনি হাসতে হাসতে চলে গেলেন। আর আমি এখন মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছি। এ কেমন রূপ শুভ্র ভাইয়ের!! আগে তো এমন অসভ্য ছিলেন না।

——————

সন্ধ্যায় শুভ্র ভাইয়ের বারান্দায় ওনার গোলাপ গাছের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আহনাফ আর অর্থি কিছুক্ষণ আগেই চলে গেছে। আর আমার কাজিনরা সবাই আমাদের ফ্ল্যাটে।
আচমকা শুভ্র ভাই এসে আমার গালে শব্দ করে একটা চুমু খেয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কানে ফিসফিস করে বললেন-

—”চলো বউ বাহিরে হাঁটতে যাই।”

ওনার হঠাৎ করে এই রকম অদ্ভুত আচরণের কারণে আমি বার বার লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পরছি। একদিনেই এই লোকটা পুরো পালটে গেল ভাবতেই অবাক লাগছে। শুভ্র ভাই আমাকে আমাকে মাথা নিচু করে থাকতে দেখে আবারও ফিসফিস করে বললেন-

—”এখন থেকে কিন্তু নিজেকে আর কন্ট্রোল করবো না। এখন আর কোনো বাধা নেই তোমার লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া গাল গুলো দেখলেই কিন্তু খেয়ে ফেলবো অনন্যময়ি।”

এবার আমি নিজেকে সামলিয়ে ওনার কাছ থেকে দূরে সরে রাগি গলায় বললাম-

—”দেখুন শুভ্র ভাই আপনি কিন্তু বার বার ইচ্ছে করে আমাকে লজ্জা দিচ্ছেন।”

আমার কথা শুনে শুভ্র ভাই আহত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে মন খারাপ করে বললেন-

—”নিজের স্বামীকে কেউ ভাই ডাকে না-কি বউ!!”

আসলেই তো উনি এখন আমার স্বামী হয়। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম একথা। আমি স্বাভাবিক ভাবে বললাম-

—”আসলে ভুলে গিয়েছিলাম। আমি আপনাকে শুভ্র ভাই ডেকেই অভ্যস্ত তাই আমার সময় লাগবে এই অভ্যাস পাল্টাতে।”

শুভ্র ভাই কিছু একটা ভেবে বললেন-

—”আচ্ছা ঠিক আছে তবে বেশি সময় পাবা না বউ।”

ওনার কথায় বিরক্ত হয়ে বললাম-

—”কি শুরু করেছেন শুভ্র ভাই প্রতি লাইনেই কি বউ বউ বলা লাগে নাকি!!”

—”তুমি আমার এক মাত্র বউ এটা তোমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি।”

উফফফ৷ এই লোকটা আসলেই পাগল হয়ে গেছে। একদিনের মধ্যে সব কিছু পালটে ফেললেন। তুই থেকে তুমি..,, অনন্য থেকে বউ,,, আর হাতে চুমু দেওয়া থেকে ডিরেক্ট গালে!!!

————————

নির্জন রাস্তায় আমি আর শুভ্র ভাই হাত ধরে হেঁটে চলছি বেশ অনেকটা সময় ধরে। কারও মুখে কোনো কথা নেই পিনপতন নীরবতা। হঠাৎ করেই শুভ্র ভাই আমার সামনে এসে দাড়িয়ে বেশ জোরে জোরেই বললেন-

—”ভালোবাসি অনন্যময়ি খুব বেশিই ভালোবাসি তোমার মুগ্ধতায় মুগ্ধ হতে। ভালোবাসি বউ এক বিশাল শুভ্র আকাশের সমপরিমাণ। এই শুভ্রর শহরের সকল মুগ্ধতায় তুমি… শুধুই তুমি অনন্যময়ি। চলবে তো সারাজীবন এই মুগ্ধ প্রেমিকের হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে?? থাকবে তো আমৃত্যু এই শুভ্রর বুকের খাচায় বন্দী হয়ে?? ভালোবাসবে তো আজীবন তোমার এই অসভ্য লোকটাকে??”

আমি ওনার কথার প্রতিত্তোরে কিছু না বলে ওনাকে পাশ কাটিয়ে সামনের দিকে চলতে চলতে হাত বাড়িয়ে বললাম-

—”হাতটা না ধরলে চলবো কিভাবে সারাজীবন!!”

আমার কথায় উনি দ্রুত এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি ওনার বুকে মুখ গুজে দিয়ে লজ্জামিশ্রিত নিম্ন স্বরে বললাম-

—”শুভ্রর খাচায় তো অনেক আগেই নিজেকে বন্দী করে ফেলেছি আমি। কারণ ভালোবাসি আমি আমার এই অসভ্য রাগী লোকটাকে। প্রচন্ড ভালোবাসি আমার মুগ্ধতায় মুগ্ধ হওয়া এই মুগ্ধ প্রেমিকটাকে। ভালোবাসি এই অসভ্য লোকটার কথায় বার বার লজ্জা পেতে। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এভাবেই এই অসভ্য লোকটার কথায় নিজেকে লজ্জার লাল নীল রঙিন চাদরে জড়াতে চাই। ভালোবাসি আপনার সকল অদ্ভুত রকমের কর্মকাণ্ড উপভোগ করতে। ভালোবাসি ভালোবাসি খুব ভালোবাসি আমার মুগ্ধ প্রেমিককে।”

শুভ্র ভাই আমার মুখ উঁচু করে কপাল একটা গভীর ভালোবাসার স্পর্শ দিয়ে আবারও আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন।

“এই মুগ্ধ প্রেমিকটাই আমার শুধু এবং শুধু মাত্রই আমার।”

__সমাপ্ত__🌺🌿