#মেঘপিওনের চুপকথা
#লেখিকা_আলো_ইসলাম
“১২তম ও “(শেষ পর্ব )
–” রাত ১২ টা। বিয়ে বাড়ির হৈচৈ কমে আসছে আস্তে আস্তে। যে যার মতো ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়েছে। কেউ কেউ গল্প করছে।
– গ্রামে রাত ১২টা মানে মধ্যরাত। নিশ্চুপ সব। ঘুমে বিভোর থাকে গোটা গ্রাম এই সময়।
– আনভীরের বলা শেষের কথায় রাশির মধ্যে ভয় কাজ করে। সত্যি যদি বউ সেঁজে যেতে হয় ওর সামনে। রাশি এটা কোনো ভাবেই পারবে না। বউ যদি সাঁজতে হয় সেটা সম্রাটের জন্য সাঁজবে। রাশি সামিরাকে জানায় সম্রাটের সাথে দেখা করবে। তাই ছাদে যেনো আসে সবাই ঘুমিয়ে গেলে। সামিরা রাহাত কে জানালে রাহাত সম্রাটকে জানায়।
– বিয়ে বাড়ির সবাই যখন ঘুমে আচ্ছন্ন। তখন দুজন প্রেমিক প্রেমিকা ব্যস্ত তাদের দুঃখ বিলাসে। পাওয়া না পাওয়ার হিসাব কষতে।
– রাশি সম্রাট কে জড়িয়ে ধরে আছে। শুধু জড়িয়ে ধরে আছে বললে ভুল হবে৷ চোখ দিয়ে অনবরত অশ্রুপাত হচ্ছে তার। সম্রাট নিজেকে শক্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রাশির সামনে সে কোনো ভাবে ভেঙে পড়তে চাই না।
– রাশি প্লিজ স্টপ। তোমার কান্না আমার ভালো লাগে না। সহ্য করতে পারিনা। এক কথা কতদিন বলব আমি কিছুটা রাগ দেখিয়ে বলে সম্রাট।
– আমাকে এখানে থেকে নিয়ে চলুন প্লিজ। আপনি যা বলবেন যেখানে নিয়ে যাবেন আমি সেখানে যেতে রাজি। তাও আপনাকে হারাতে পারবো না। আপনার থেকে দূরে যাবো কথাটা ভাবলেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। নিশ্বাস আটকে আসছে আমার। আমি পারবো না থাকতে আপনাকে ছেড়ে। প্লিজ কিছু একটা করুন। আর মাত্র একটা দিন। এরপর কি হবে? সম্রাটের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে রাশি কৌতুহলী হয়ে।
– তুমি কেনো এইসব ভাবছো। আমি তো ভাবছি। মা বলেছে কিছু একটা উপায় বের করবে। তোমার বিয়ে অন্য কোথাও হবে না রাশি।
– আর কত সময় লাগবে আপনাদের ভাবতে৷ যদি বিয়েটা হয়ে যায় তারপর আপনার ভাবনা সব ঠিক করতে পারবে? কেনো অপেক্ষা করছেন? কিসের অপেক্ষা করছেন? চলুন না আমাকে এখানে থেকে নিয়ে। আপনার পায়ে পড়ি সম্রাট আমাকে নিয়ে চলুন এখানে থেকে। আপনাকে হারানোর ভয় নিয়ে আমি এইভাবে থাকতে পারবো না। কথাটা বলে রাশি সম্রাটের পা ধরতে গেলে সম্রাট রাশিকে আটকিয়ে দিয়ে বুকে আগলে নেয়।
– “” তোমাকে হারানোর ভয় কি আমার হচ্ছে না। আমার কি চিন্তা হচ্ছে না? কিন্তু কি করবো বুঝতে পারছি না। তোমার বাবার সম্মানের দিকে তাকিয়ে আমি অন্য কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। উনি কষ্ট পাক এমনটা চাইনা রাশি হতাশার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে সম্রাট । উনার দোয়া যে আমাদের দরকার।
– কিন্তু বাবা তো কিছু মানতে চাইছে না। তাহলে কেনো উনার জন্য এত ভাবনা। কেনো আমাদের সম্পর্কটা নষ্ট করছেন?
–” আমি তোমাকে নিয়ে চলে যাবো কালই। আর কারো কথা শুনবো না। আমি তোমাকে হারাতে পারবো না। অনেক হয়েছে আর নয়। তুমি রেডি থেকো কাল। সম্রাটের কথায় রাশির মুখে হাসি ফুটে। একবুক আশা নিয়ে বলে সত্যি আমাকে নিয়ে যাবেন কাল?
– হ্যাঁ রাশি। আমরা কালই পালিয়ে যাবো। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই আমাদের। সম্রাটের কথায় রাশি স্বস্তি পায়! শান্তি পায়। হারানোর কষ্টটা একটু লাঘব হয়।
– এখন ঘরে যাও রাশি। বিয়ে বাড়ি কেউ না কেউ জেগে আছে৷ আমাদের এইভাবে দেখে নিলে সমস্যা হবে কথা শেষ করতেই সম্রাট সামনে তাকিয়ে চমকে যায়। ঘাবড়ানো চোখে তাকিয়ে থাকে। সম্রাটের দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকিয়ে দেখে রাশি তার বাবাকে দাঁড়িয়ে থাকতে । বাবাকে দেখে আঁতকে উঠে রাশি৷ ভয়ার্ত চোখে নিচে তাকিয়ে বারবার ঢোক গিলতে থাকে।
– রুমে যাও রাশি। গম্ভীর কন্ঠে বলে রিয়াদ ইসলাম। বাবার কথায় ভয়ার্ত চোখে তার দিকে তাকায়।
– আমি ঘরে যেতে বলেছি মৃদু চিৎকার করে বলে রিয়াদ ইসলাম। তার গম্ভীরতা দেখে রাশি আর কিছু বলার সাহস পায়না। দ্রুত পায়ে নেমে যায় ছাদ থেকে। সম্রাট বেশ সাবলীল ভাবে থাকার চেষ্টা করে। নিজেকে নিজে বোঝানোর চেষ্টা করে যে ভয় পেলে চলবে না।
-‘ রিয়াদ ইসলাম সম্রাটের দিকে এগিয়ে আসে। সম্রাট রিয়াদ ইসলামের দিকে কৌতুহল ভরা চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে।
– দেখো সম্রাট! আমি জানি তুমি আমার মেয়েকে অনেক ভালোবাসো আর আমার মেয়েও তোমাকে অনেক ভালোবাসে। আমার মেয়ে তোমার কাছে সুখী হবে এটাও জানি। কিন্তু সব কিছু জানার পর বোঝার পরও আমি অসহায়। তোমাদের জন্য কিছু করতে পারবো না। রাশির বিয়ে আমি অনেক আগে থেকে ঠিক করে রেখেছি এটা শুনেছো৷ আমি আমার বন্ধুকে কথা দিয়েছি রাশি তার ছেলের বউ হবে। আমি আমার কথায় সব সময় অটুট থাকতে পছন্দ করি। আমার জবাণ দিয়ে যেটা একবার বলি সেটা পালন করি। অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। আত্মীয়স্বজনে ভরপুর আমার বাড়ি আর সবাই বিয়ে উপলক্ষে এসেছে। এলাকার সবাই জানে রাশির বিয়ের কথা।
– সম্রাট বুঝতে পারছে না তাকে কেনো এইসব কথা বলছে। সম্রাট কোনো কিছু না বলে রিয়াদ ইসলামের কথা শুনে যাচ্ছে শুধু।
– নিশ্চয় ভাবছো এইসব কথা তোমাকে কেনো বলছি? রাশির বাবার কথায় সম্রাট নড়েচড়ে উঠে খানিকটা ।
– কারণ আমার মান-সম্মান সম্পুর্ণ তোমাদের হাতে এখন। তুমি যদি রাশি কে নিয়ে চলে যাও আমার আটকানোর ক্ষমতা নেই। কিন্তু আমার মান সম্মান রক্ষা করার দায় আমার। আমার মান সম্মান নিয়ে কেউ টানাটানি করবে। কেউ কটুক্তি করবে এটা আমি কখনোই বরদাস্ত করবো। তুমি যদি রাশিকে নিয়ে চলে যেতে চাও তো যেতে পারো কোনো সমস্যা নেই। তবে এটা মনে রেখো! তুমি রাশিকে নিয়ে যাওয়ার পরপরই আমার মৃত্যু সংবাদ পাবে।
– রিয়াদ ইসলামের এই কথায় সম্রাট চমকে উঠে অবাক হয়ে বলে এইসব কি বলছেন আঙ্কেল। সম্রাটের চোখ মুখে এখন ভয়ের ছাপ বিদ্যমান।
– যেটা শুনেছো একদম ঠিক শুনেছো। আমি আমার মেয়ে, পরিবারকে যেমন ভালোবাসি তেমন আমার মান সম্মানও আমার কাছে ততটাই গুরুত্বপূর্ণ। তাই রাশি যাওয়ার পর নানান মানুষ নানান কথা বলবে। আমার বন্ধু আমার দিকে আঙ্গুল উঠাবে সেটা সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। তাই আত্মহত্যা ছাড়া আমার কোনো পথ থাকবে না। এখন আমার বাঁচা মরা তোমার হাতে সম্রাট। আমার মান সম্মানও তোমার হাতে। তাই যা করবে আশা করি ভেবে করবে। কথাটা বলে রিয়াদ ইসলাম চলে যায়। সম্রাট অসহায় চোখে তার চলে যাওয়া দেখে সাথে এক ফোটা পানি গড়িয়েও পড়ে। রাশিকে হারানোর ভয়টা এবার পাকাপোক্ত ভাবে মনে গেঁথে যায় তার। সম্রাট কি করবে বুঝতে পারে না। মাথা চেপে ধরে বসে পড়ে। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তেই থাকে।
— পরের দিন. সম্রাট সারাদিন রাশির সামনে যায় না। রাশি অধীর আগ্রহে সম্রাটের অপেক্ষা করছে। কিন্তু একবারের জন্য সম্রাটের দেখা মেলেনি তার। সামিরাকে দিয়ে অনেকবার খবরও দিয়েছে সম্রাট কে একবার দেখা করার জন্য। কিন্তু সম্রাট দেখা করেনি। রাশি ভেঙে পড়ে অনেক। সম্রাটের এমন করার কারণ বুঝে উঠে না। রাই, সামিরা রাশিকে বোঝানোর চেষ্টা করে কিন্তু রাশি কারো কথায় শুনে না। খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেয়। সব সময় কান্না করতে থাকে।
— সম্রাট গ্রামের একটা পুকুর পাড়ে বসে আছে মন খারাপ করে। পাশে রাহাতও আছে। সম্রাট রিনা খানকে জানায় রিয়াদ ইসলামের কথা গুলো। সব শোনার পর রিনা খান স্তব্ধ হয়ে যায়। আর কোনো উপায় নেই কারো কাছে রাশির বিয়েটা হতে দেওয়া ছাড়া।
– এইভাবে পালিয়ে আর কতখন সমু? রাশির দিকে তাকানো যাচ্ছে না। মেয়েটা অনেক ভেঙে পড়েছে৷ একদিনে অবস্থা খুব খারাপ করে ফেলেছে নিজের। ও শেষ হয়ে যাবে সমু। তুই প্লিজ এইভাবে ঠকাস না মেয়েটাকে। এখনো তোর উপর ভরসা করে আছে মেয়েটা।
– কি করবো আমি বলতে পারিস? আমার কি কষ্ট হচ্ছে না। মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করছি আমি। রাশিকে ছাড়া আমি ভালো থাকবো বলে মনে হয় তোর? কিন্তু আমি নিরুপায়। আঙ্কেল যদি সত্যি তার ক্ষতি করে তাহলে কোনো দিন কি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো। রাশি পারবে কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে না শান্তি পাবে। আমি চাইনা এমনটা রাহাত। রাশির বিয়েটা হতে দেওয়া ছাড়া আমার আর কিছু করার নেই। আঙ্কেল ঠিকই বলেছে। সময়ের সাথে সব মানিয়ে নেবে একদিন। হয়তো আমিও রাশিকে ছাড়া ভালো থাকতে শিখে যাবো। কথাটা সম্রাট বলছে ঠিকই কিন্তু চোখ দিয়ে না পাওয়ার কষ্ট অঝোরে ঝরে পড়ছে।
— আজ রাশির বিয়ে। একটু পরেই বরযাত্রী আসবে। রাশিকে সুন্দর করে সাঁজানো হয়েছে। লাল টকটকে বেনারসি শাড়িতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে তাকে। রাশি একটা পাথরে পরিণত হয়ে গেছে যেনো। কোনো কিছুতে হেলদোল নেই তার। কথায় আছে না অতি শোকে কাতর হয়ে যায় মানুষ। রাশির ক্ষেত্রেও তাই। সামিরা, রাই মনমরা হয়ে বসে আছে রাশির পাশে। রাশির অবস্থা দেখে ওদের কারোই ভালো লাগছে না। সবারই বুকফেঁটে কান্না আসতে চাই।
–” এর মধ্যে বাইরে থেকে শোরগোল আসে বরযাত্রী এসে গেছে। সামিরা আর রাই দুজন দুজনের দিকে আফসোস নিয়ে তাকায়। যতটুকু আশা বিদ্যমান ছিলো সেটুকু শেষ। রাশি একই ভাবে বসে আছে মুর্তির ন্যায়। কোনো কিছুতেই যেনো তার আর যায় আসে না।
— তোমরা একটু বাইরে যাও সামিরা। আমার রাশির সাথে কথা আছে। হঠাৎ সম্রাট এসে বলে। সম্রাট কে দেখে সামিরা রাইয়ের দুজনের ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে। রাশি যেনো এবার নড়েচড়ে উঠে একটু। কিন্তু এখনো আগের ন্যায়ই আছে।
– সম্রাটের কথায় সামিরা আর রাই বেরিয়ে যায়। ওরা যেতেই সম্রাট ক্ষীন কন্ঠে রাশি বলে উঠে। সম্রাটের ডাকে রাশির গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে দীর্ঘ সময় পর।
– কেনো এসেছেন এখন। সব কিছুতো শেষ হয়ে গেছে। তাহলে কেনো এসেছেন এখন? দেখতে এসেছেন এখনো বেঁচে আছি নাকি। রাশির কথায় সম্রাট চমকানো চোখে তাকায়। আহত কন্ঠে বলে, এইভাবে বলো না রাশি। আমার সহ্য করার ক্ষমতা নেই আর।
– সম্রাটের কথায় রেগে যায় রাশি। উঠে এসে সম্রাটের জামার কলার ধরে বলে, আমাকে কি কথা দিয়েছিলেন আপনি আর কি করলেন? আমাকে আশ্বাস দিয়ে আপনি এইভাবে ঠকালেন? কি দোষ করেছি আমি যার প্রতিদান এইভাবে দিলেন আমাকে। আপনাকে ভালোবাসাটা কি ভুল ছিলো সম্রাট বলুন? কেনো আপনি কাল আসলেন না? কেনো আমাকে দূরে সরিয়ে দিলেন। বাইরে কি বলছে সবাই শুনতে পাচ্ছেন। বর এসেছে। এবার বিয়েটাও হয়ে যাবে। আমি অন্য কারো হয়ে যাবো। আপনার জায়গায় অন্য কাউকে বসাতে হবে আমাকে। দিনের পর দিন বেঁচে থেকেও মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে হবে আমাকে। এর থেকে ভালো আমাকে মেরে ফেলতেন৷ কেনো ঠকালেন আমাকে। কেনো আমাকে ভরসা দিয়ে আশাহত করলেন। কি করবো এখন আমি। কি করে এই বিয়ে করবো আমি। আমার যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে সম্রাট। আমাকে প্লিজ একটা উপায় বলুন। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। পাগলের মতো বিলাপ করতে থাকে রাশি। সম্রাট মাথা নিচু করে রাশির সকল অভিযোগ মেনে নিচ্ছে। এছাড়া কি বা করার আছে আর।
– আমাকে আপনি ঠকিয়েছেন সম্রাট। কোনো দিন ক্ষমা করবো না আপনাকে। নিজেকে তিলে তিলে শেষ করে দেবো আমি৷ আর এর জন্য দায়ী থাকবেন আপনি। সম্রাট রাশিকে শক্ত করে চেপে ধরে বক্ষমাঝে।
– আর বলো না রাশি। আমি আর নিতে পারছি না। এর থেকে ভালো আমাকে গলা টিপে মেরে দাও। আমি অসম্ভব ভাবে অসহায়। আমার হাত পা বাধা রাশি। আমি চাইলেও কিছু করতে পারবো না। আমাকে ক্ষমা করে দাও৷ আমি আমার কথা রাখতে পারলাম না। পারলাম না তোমাকে নিজের করে নিতে।
– দুজনেই অঝোরে কান্না করছে। এটাই হয়তো শেষ মিলন সময় তাদের। আর হয়তো কখনো দেখা হবে না৷ কথা হবেনা । আর কখনো এইভাবে জড়িয়ে ধরাও হবে না। সম্রাট রাশির কপালে একটা ভালোবাসার পরশ দিয়ে বলে ভালো থেকো রাশি। এরপর সম্রাট এক সেকেন্ডও দাঁড়ায় না। দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায়। রাশি চিৎকার করে কান্না করতে থাকে। সব আশা ভরসা বিশ্বাস এক নিমিষে শেষ হয়ে গেলো। প্রিয় মানুষ টা খুব সাদরেই দূরে চলে গেলো।
–” রাশিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলা হয়। সম্রাট রাশির ঘর থেকে বেরিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যায়। রাশির বিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে দেখার সাহস বা শক্তি কোনোটাই সম্রাটের মধ্যে নেই।
– জোরে ড্রাইভ করছে সম্রাট। আর রাশির বলা কথা গুলো ভাবছে। সত্যি তো রাশিকে ঠকিয়েছে সে। রাশির কান্নামাখা অসহায় মুখটা বারবার সম্রাটের সামনে ভেসে উঠছে। সম্রাট গাড়ির স্পীড বাড়িয়ে দেয়। আশেপাশে কোনো কিছু দেখার প্রয়োজন মনে করে না। বারবার রাশির মুখশ্রী আর কথা গুলো কানে বাজছে। হঠাৎ একটা ট্রাক সামনে চলে আসে সম্রাটের। সম্রাট খেয়াল করে না। খুব কাছাকাছি আসতেই সম্রাট চমকে উঠে। গাড়ি ব্রেক করার আগে যা হওয়ার হয়ে যায়। ট্রাকের সংঘর্ষে সম্রাটের গাড়ি একটা বড় গাছের সাথে ধাক্কা খায়। সাথে সাথে গাড়ি গুড়িয়ে যায়৷ সাথে সম্রাটের অবস্থাও অনেক খারাপ হয়ে যায়। রক্তাক্ত হয়ে গাড়ির মধ্যে পড়ে থাকে প্রাণহীন দেহটা। এক্সিডেন্ট করার ফলে সম্রাটের স্পটডেথ হয়।
— রাশিকে নিয়ে আনভীরের পাশে বসানো হয়৷ রাশির চোখ দিয়ে এখন আর পানি পড়ে না। বরফের ন্যায় জমে গেছে রাশি। তার সকল অনুভূতি লোপ পেয়েছে। শুধু বেঁচে থাকার দায়ে নিশ্বাস টা যেনো চলছে অনবরত।
– একজন ছুটে এসে খবর দেয় সম্রাটের এক্সিডেন্ট হয়েছে। এটা শোনা মাত্র রিনা খান আঁতকে উঠে। কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। সাজ্জাদ খান ছুটে বেরিয়ে যায় সাথে রাহাত। রাশি থমকে যায়। বিয়ের বাড়ির পরিবেশ থমথমে হয়ে যায়। সবার মধ্যে শোকের ছায়া দেখা দেয়। রাশি উঠে দাঁড়ায় এবার। রাশিকে উঠতে দেখে সবাই কৌতুহলী হয়ে তার দিকে তাকায়।
–‘ রিয়াদ ইসলাম এই সংবাদের জন্য প্রস্তুত ছিলো না। সম্রাটের এক্সিডেন্টের কথা শুনে তিনিও ঘাবড়ে যায়।
– রাশি তুমি উঠে দাঁড়ালে কেনো আনভীর বলে কৌতুহলী হয়ে।
– সামিরা আমাকে সম্রাটের কাছে নিয়ে চল। আমি যাবো উনার কাছে। আমাকে যেতে হবে উনার কাছে কথাটা বলে ছুটে বেরিয়ে আসে রাশি। সদর দরজার কাছে আসতেই রাশির পা থেমে যায়। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সামনে থাকা খাটিয়া আর সাথে মানুষ গুলোর দিকে। রাহাত আর কিছু মানুষ মিলে খাটিয়া ধরে আছে। রাশি বিষ্ময় চোখে তাকিয়ে থাকে। রিনা খান হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। সামিরা, রাই দুইহাতে মুখ চেপে ধরে। তাদের যেনো বিশ্বাসই হচ্ছে না এমনটা হতে পারে।
– খাটিয়াটা নিচে নামালে রাশি আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় সেদিকে। চোখ মুখে ভীষণ কৌতুহল তার। চারিদিকে শুধু কান্নার আর্তনাদ। সাজ্জাদ খান কান্নায় ভেঙে পড়ে, রাহাত কান্না করছে, শান্তা ইসলাম সহ উপস্থিত সবার চোখে পানি। রিনা খানের বিলাপ দেখে আরও বেশি খারাপ লাগে সবার।
– রাশি সম্রাটের কাছে গিয়ে মুখ থেকে কাপড়টা সরাতেই চোখে আঁধার ঘনিয়ে আসে। রাশির মানতে কষ্ট হয় এটা তার সম্রাট। যে কি-না একটু আগেও তার কাছে ছিলো। খুব কাছে। সম্রাটের চোখ মুখে রক্তে ভরা।
– আপনি এইভাবে শুয়ে আছেন কেনো? কি হয়েছে আপনার? রাগ করেছেন বুঝি আমার কথায়? অভিমান হয়েছে? আচ্ছা বাবা আমি সরি বলছি। আমি আর কখনো আপনাকে বকবো না৷ দোষ দেবো না। উঠুন প্লিজ। দেখুন আন্টি কিভাবে কান্না করছে৷ আঙ্কেল কান্না করছে৷ ওরা ভাবছে আপনি মারা গেছেন মুচকি হেসে বলে রাশি।
– রাশির এমন বিহেভে অবাক হয় সবাই। সামিরা এগিয়ে আসে রাশির কাছে। রাশির কাধে হাত রাখলে রাশি সামিরার দিকে তাকিয়ে বলে, উনাকে উঠতে বল সামু। আমি বকেছি বলে রাগ করে শুয়ে আছে। মানুষ টা সত্যি বড্ড ছেলেমানুষী করে।
– সম্রাট ভাই আর নেই রাশি। উনি মারা গেছেন সত্যি কথাটা বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে সামিরা।
– নাহ! তুই মিথ্যা বলছিস সামু। উনি একটু আগেও আমার কাছে ছিলেন৷ আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। আমাকে বিদায় দিয়ে গেছেন। আচ্ছা উনি কি তাহলে শেষ বিদায় দিয়েছে ওইটা। আমাকে ছেড়ে অনেক দূরে যাওয়ার প্ল্যান করেছে। কিন্তু এমন তো হবে না। উনি আমাকে বলেছিলেন বাঁচলে একসাথে বাঁচবো আর মরলে একসাথেই। তাহলে উনি আমাকে একা রেখে কিভাবে যেতে পারে৷ আবারো উনি আমাকে মিথ্যা বলেছেন। আমাকে ধোকা দিয়েছে। রাশির কথায় সবার দমবন্ধ হয়ে আসে। কান্নায় বুকভারী হয়ে আসে।। রাই রিনা খানকে সামলানোর চেষ্টা করছে সাথে গ্রামের কিছু মহিলাও আছে। সাজ্জাদ খান রাহাতকে ধরে কান্না করছে। রিয়াদ ইসলাম স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। নিজেকে অপরাধী লাগছে তার সম্রাটের এক্সিডেন্টের জন্য। নিজেকে নিজে দায়ী করছেন।
– রাশি এবার চিৎকার দিয়ে কান্না করতে থাকে।
– আপনি বারবার আমার সাথে এমনটা করতে পারেন না সম্রাট। আমাকে এইভাবে ফাঁকি দিয়ে যেতে পারেন না। আমার ভালোবাসাকে এইভাবে অপমান করতে পারেন না আপনি। আমাকে কেনো একবার বললেন না। কেনো সাথে নিলেন না। কেনো করলেন এমন? কেনো ঠকালেন আমায় আবারও? কেনো করলেন! কেনো? কথাটা বলতে বলতে রাশি সম্রাটের দিকে ঢলে পড়ে।
– রাশিকে চুপ হয়ে যেতে দেখে সবাই চমকে উঠে। সামিরা রাশিকে ধরে। শান্তা ইসলাম ছুটে আসে মেয়ের দিকে।
– রাশি, এই রাশি। চোখ খোল মা। কি হলো তোর? চোখ খুলছিস না কেনো? কিন্তু রাশি তার মায়ের কথা শুনতে পাইনা। কারণ শোনার মতো অবস্থা রাশি আর নেই। সম্রাটের মৃত্যু শোক মানতে না পেরে রাশিও বিদায় নেই দুনিয়া থেকে। তার ভালোবাসার প্রমাণ দিয়ে যায় সবার সামনে। একটু পর সবাই বুঝতে পারে রাশিও আর নেই তাদের মাঝে। তখন আরেকদফা কান্নার আওয়াজ বৃদ্ধি পায়। দুটি লাশের হাহাকারে চারিপাশ ডুকরে কেঁদে উঠে। সবার মধ্যে হতাশা আফসোস জেগে উঠে। রিয়াদ ইসলাম পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দুটি মানুষের মৃত্যুর কারণ তিনি। একমাত্র তিনি। তার জেদ, অহংকার বজায় রাখতে গিয়ে তার সন্তানকে হারালো। একটা মায়ের বুক খালি করে দিলো। সবটা মেনে নিলে আজ হয়তো এইদিন দেখতে হতো না কাউকে।
– রাশিকেও সম্রাটের পাশে শোয়ানো হয়। দুটি ভালোবাসার মানুষ অনায়াসে ঘুমিয়ে আছে পাশাপাশি। আজ আর কেউ তাদের বাধা দেওয়ার নেই। কারো অধিকার নেই তাদের আলাদা করার।
– সব ভালোবাসার শেষ পরিনতি যে, একজনের যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু আর আরেকজন অন্যের ঘর সাঁজানো দিয়ে শেষ হয় না সেটা প্রমাণ করে দিয়ে গেলো রাশি। ভালোবাসার মানুষটার ডাকে সাড়া দিয়ে সেও চলে গেলো ওপারে। এখানে তাদের ভালোবাসা স্বীকৃতি পায়নি ঠিকই ওপারে হয়তো দুজন দুজনের হয়ে থাকবে। পূর্ণতা পাবে তাদের ভালোবাসা।
– আরেকদিকে বিদেশের মাটিতে কষ্টের পাহাড় বুকে রেখে দিন পার করছে রনি। ভালোবাসার মানুষ থেকে দূরে এসে ভালো থাকবে ভেবেও একই যন্ত্রণা ভোগ করছে। একতরফা ভালোবাসা দিনের পর দিন কুড়েকুড়ে খাচ্ছে তাকে। তবু এটা ভেবে একটু শান্তি খুঁজে পায় তার ভালোবাসার মানুষ টা নিশ্চয় ভালো আছে তার প্রিয় মানুষটার পাশে। সব কিছু ভেবে তার ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাসটাই আসে।
–‘ বিয়ে বাড়ি মৃত্যু বাড়িতে পরিণত হয়। শোকে কাতর সবাই। সম্রাট আর রাশিকে একসাথে গোসল করানো হয়। এরপর দাফনো দেওয়া হয় একসাথে। রিনা খান একটু পর পর সেন্সলেস হয়ে যায়। একমাত্র সন্তান হারানোর ব্যথা তীব্র তার কাছে। রাশির মা তার মেয়ের মৃত্যুর জন্য তার স্বামীকে দায়ী করে। পাগলের মতো বিলাপ করতে থাকে৷ রিয়াদ ইসলাম বাকরুদ্ধ হয়ে সকলের অভিযোগ শ্রবণ করে। সব দোষ তো তারই। তাই সব অভিযোগ তাকেই মানতে হবে। বরযাত্রী ফিরে যায়। আনভীর ভেঙে পড়ে এই দৃশ্য দেখার পর। আগে যদি জানতো সম্রাট আর রাশির প্রেমকাহিনী তাহলে নিশ্চয় তিনি এই বিয়ে করতেন না। কিন্তু এখন সব শেষ। হেরে গেছে জেদ, অহংকার, বিচ্ছেদ। জিতে গেছে তাদের ভালোবাসা। জীবন দিয়ে প্রমাণ দিয়ে গেছে ভালোবাসায় সব করা যায়। বেঁচে থাকতে যেমন পাশে থাকে তেমন মরার পরও সাথে থাকা যায়।
— সমাপ্তি –