মেঘবিলাসী পর্ব-৩৩

0
484

#মেঘবিলাসী
#israt_jahan_arina
#part_33

ভালো লাগার মুহূর্ত গুলো কেনো দীর্ঘস্থায়ী হয় না।মনে হয় এক পলকেই ভালো সময় চলে যায়।অথচ খারাপ সময় হয় অনেক বেশি দীর্ঘস্থয়ী।বর্তমান সময়টাকে জিসানের দীর্ঘ মনে হচ্ছে।মনে হচ্ছে এই প্রহরের শেষ নেই।ভালোবাসার মানুষের অবহেলা গায়ে কাটার মত বিধে।জিসানের বর্তমান অবস্থা অনেকটা এমন।

সেদিন বিকেলে সে তিন্নির সাথে দেখা করতে বাসায় যায়। কিন্তু তিন্নি জিসানের সাথে দেখা করে না।তিন্নি লেখা পড়া নিয়ে ব্যাস্ত।জিসান ভীষণ কষ্ট পেয়েছে।সে তো তিন্নিকে স্টাডিতে বরাবর সাপোর্ট করে এসেছে।এমনকি তার ক্যারিয়ারে যাতে কোনো ভাবে বাধা না আসে তাই সে তিন্নির সাথে অনেকটা দুরত্ব বজায় রেখেছে।তিন্নির মানুষিক অবস্থা বুঝার চেষ্টা করেছে।

পরবর্তী সময় গুলি জিসানের জন্য ছিলো আরো বেশি বিষাদময়।তিন্নি তার কল recived করতোনা।বাসায় গেলে সামনে আসেনা।জিসানকে এড়িয়ে চলতো।তিন্নির এই খামখেয়ালিপনা জিসানকে ক্ষত বিক্ষত করছে।
এতো দিনে কি সে তিন্নির মনে একটুও জায়গা করতে পারেনি?তিন্নিকে তার ভালোবাসা কি সে বুঝাতে পারেনি?তিন্নি মোটেও বোকা না।তার প্রতিটা ফিলিংস এর সাথে তিন্নি পরিচিত।বন্ধু না ভাবলেও একজন শুভাকাঙ্ক্ষী তো ভাবতে পারতো?এই মেয়েটার মনটা এতো পাথর কেনো?যে পাথর হাজারো অশ্রুকণা বিনিময়েও গলেনা।

কয়েক দিন আগে কথা।
জিসান তিন্নিকে এক পলক দেখার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে।একটু কথা বলতে পাগল হয়ে তিন্নির কলেজের সামনে অপেক্ষা করেছে।যদি একটু চোখের তৃষ্ণা মেটানোর যায়।প্রায় তিন ঘন্টা অপেক্ষা করেও তিন্নির দেখা পায়নি।আরো বেশ কয়েক দিন তিন্নির কলেজের সামনে এভাবে অপেক্ষা করেছে।কিন্তু তিন্নি তার কাছে ধরা দেয়নি।এমন কি হলো যে তিন্নি তাকে অভয়েড করছে।সম্পর্কের প্রথম থেকেই তিন্নির গা ছাড়া ভাব।কিন্তু এই কিছুদিন সে তিন্নির চোখে অন্যকিছু দেখেছে।তিন্নির চোখের ভাষা বদলাতে দেখেছে।তিন্নির চোখে নিজের জন্য মুগ্ধতা দেখেছে।তিন্নির চোখে যা ছিলো তাকে অনায়াসে ভালোবাসার নাম দেয়া যায়।ভালোবাসি কথাটা সবসময় মুখে বলতে হয় না।অনেক সময় বুঝে নিতে হয়।তবেকি তার ধারণা ভুল?সে কি তিন্নিকে ভুল বিশ্লেষন করেছে?

জিসানকে একাকীত্ব যেনো আরো ঝাপটে ধরলো।তার মনে জমতে শুরু করলো অভিমানের পাহাড়।সে সব কষ্ট ভুলতে কাজে ডুবে গেলো। সেই মানুষটা যদি তাকে ছাড়া ভালো থাকে,তবে সে কেনো তাকে ডিস্টার্ব করবে?বিদ্যার রানী বিদ্যা গ্রহণ করে বিদ্যাসাগর হয়ে যাক।তাতে সে আর মাথা ঘামাবেনা।হয়তো তার মত এতিমরা করো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না।

জিসানদের পুরো টিম হাইপ্রফাইল কেস বেশি হ্যান্ডেল করে। ইদানিং একটা কেস নিয়ে সে কাজ করছে।বড় বড় কয়েকজন নেতা গুম হয়েছে।পাবলিকালি খবরটা মিডিয়াতে আসেনি।খুব গোপনে কাজ করতে হচ্ছে।জিসান বেশ কয়েক জন ইনফরমারকে কাজে লাগিয়েছে।আর নিজেও বিভিন্ন ইনফরমেশন কালেক্ট করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে।রিয়াজ জিসানের মানুষিক অবস্থা কিছুটা আঁচ করতে পেরে তাকে ধরেবেধে সূচনার কাছে নিয়ে এসেছে।জিসান সবার কাছে নিজের ফিলিংস লুকাতে পারলেও সূচনার কাছে পারেনা।
সূচনার বাসায় এসে কিছুক্ষণ কথা বলে রিয়াজ অন্য রুমে চলে যায়।এখন দুই ফ্রেন্ড সুখ দুঃখের আলাপ করবে। এখানে থেকে তার কাজ কি?
সূচনা বললো

-“কীরে দিন দিন তো রোবটমেন হয়ে যাচ্ছিস।কাজে এভাবে ডুবে আছিস কেনো?টাকা তো কম কামাস না।বেবি প্ল্যান করছিস নাকি?কিন্তু চেহারায় কেমন দেবদাস দেবদাস লুক।”

-“এমন কিছু না।তুই অলয়েজ বেশি বুঝিস।”

-“দেখ এতো সেন্টি খাইসনা।কি হইসে বলে ফেল।”

-“কি হয়েছে জানিনা।জানলেতো আমি নিজেই সমাধান করতে পারতাম।”

-“তিন্নির উপর রেগে আছিস?”

-“যে আমার রাগের পরওয়া করেনা,তার উপর রেগে কি হবে?তুইতো সবই জানিস।আমি কখনো কোনো মেয়ের প্রতি দূর্বল হয়নি।কিন্তু এই মেয়েটা আমাকে এতটা দুর্বল করে দিয়েছে যে একটা ধমকা হাওয়া এলেই আমি ভেঙে গুড়িয়ে যাবো।আমিতো ওকে শর্তহীন ভালোবেসেছি।বিনিময়ে ভালোবাসা পাওয়ার আশা নিশ্চয়ই করেছি,কিন্তু জোর করিনি।এমনটা না যে সে কিছু জানে না।আমি ওকে কতটা ভালোবাসি,কতটা চাই সে এটা ভালো করেই জানে।তবে এতটা অবহেলা কেনো করছে?একটা বার ওকে দেখার জন্য কাতর হয়ে ওর কাছে ছুটে যাই।কিন্তু সে ধরা দেয়না।”

কথা গুলো বলতে বলতে জিসানের চোখ বেয়ে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।কাপা কাপা গলায় আবার বললো

-“আচ্ছা সূচনা,আমি যে ওর চোখে ভালোবাসা দেখতে পেয়েছি সেটা কি ভুল?আমার চোখ এতো বড়ো ধোঁকা কি করে খেতে পারে?এই পুরো পৃথিবীটা আমার কাছে বিষাক্ত মনে হচ্ছে।আমি আর ওর এই অবহেলা নিতে পারছিনা।আজকাল বাসায় থাকতে কষ্ট হয়।আমার বাসার প্রতিটা কোনায় ওর বিচরণ দেখতে পাই।মনে হচ্চে আমার বুকটা জ্বলে যাচ্ছে।”

জিসান কথাগুলো শুনে সূচনার দু চোখ ভিজে উঠলো।এই মানুষটাকে সে কখনো এতটা ভেঙে পড়তে দেখেনি।জিসানকে সান্তনা দেবার মত কোনো ভাষা তার কাছে নেই।
_________________________
বিকেল চারটা বাজে।জিসান কফি খাওয়া জন্য একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলো।আসলে তার মাথাটা ভীষণ ধরেছে।কাজের অনেক বেশি চাপ।বেশ কয়েক জায়গাতে দৌড়াতে হয়েছে তাকে।তাই এই ক্লান্তি দুর করতে কফির বিকল্প কিছু নেই।একটা চেয়ারে বসে সে কফি অর্ডার করলো।

বিকেলের এই ঠান্ডা পরিবেশ জিসানের ভালো লাগে।তবে আজ তার তেমন ভালো লাগছেনা।মন ভালো না থাকলে বোধহয় আশেপাশের সব কিছুই অর্থহীন লাগে।কয়দিন হলো সে তিন্নিদের বাসায় যায় না।আর না তিন্নির নম্বরে কল দেয়।গত কয়েক দিনে সে কতো বার তিন্নির নম্বরে কল করেছে তার কোনো হিসাব নেই।প্রথম দিকে রিং হলেও পরবর্তীতে তার নম্বর বন্ধ বলছে।সে কি তিন্নিকে এতটাই বিরক্ত করছিলো যে ফোন বন্ধ করে রাখতে হচ্ছে।

হাজারো ভাবনার মাঝে কফি খেতে খেতে তার চোখ পড়লো দূরের একটা টেবিলে।সে কি ভুল দেখছে?এতো দিন পর কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে সে দেখছে।তবে জিসান বেশিক্ষণ নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারলো না।তিন্নির পাশে একটা ছেলে বসে আছে।ছেলেটা কিছু বলছে আর তিন্নি মুচকি মুচকি হাসছে।

মুহূর্তেই যেনো তার সকল অভিমান ক্ষোভে পরিণত হলো।সে দ্রুত এগিয়ে গেলো তিন্নির দিকে।জিসান তিন্নির টেবিলের কাছাকাছি আসতেই দুজনের চোখাচোখি হলো।মুহূর্তেই তিন্নি দাড়িয়ে গেলো।এই মুহূর্তে হয়তো সে জিসানকে একদমই আসা করেনি।জিসান এক মুহুর্ত দেরি না করে তিন্নির হাত ধরে নিলো আর সামনের লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বললো

-“সরি আপনাদের ডিস্টার্ব করার জন্য। বাট আমি আমার ওয়াইফকে নিয়ে যাচ্ছি।”

কথাটা বলেই সে তিন্নির হাত ধরে বাইরে বেরিয়ে আসলো।আর লোকটা হা করে তাদের দেখছে।
এই সময়টা তিন্নি নিরব ভূমিকা পালন করলো।জিসান তিন্নিকে গাড়িতে বসিয়ে ড্রাইভে করা শুরু করলো।
জিসান অনেকক্ষণ ড্রাইভ করে নীরব একটা জায়গায় গাড়ি থামালো।কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে জিসান বললো

-“আমাকে ইগনোর কেনো করছো?”

তিন্নির পাস থেকে কোনো জবাব এলো না।জিসান আবার বললো

-“আমার অপরাধ কি?কেনো আমাকে এ ভাবে কষ্ট দিচ্ছ?না দেখা করছো,আর না কল রিসিভ করছো।কতদিন তোমার কলেজের সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িয়ে থেকেছি।কিন্তু তুমি আসোনি।কি চাইছো তুমি?কি করলে বুজবে যে আমি তোমাকে পাগলের মত ভালোবাসি?”

তিন্নি এবার ও কিছু বললোনা। মাথা নিচু করে বসে আছে।তিন্নির এই চুপ থাকাতে যেনো জিসানের রাগকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।জিসান মলিন হেসে বললো

-“আমিকি তোমাকে খুব বেশি ডিস্টার্ব করছি যে ফোনটা বন্ধ করে রেখেছো?চিন্তা করো না আমি আর তোমাকে ডিস্টার্ব করবো না।আমার মত মানুষের যোগ্যতা নেই কাউকে ভালোবাসার।আমার মত এতিমদের করুন করা যায় ভালোবাসা নয়।আমি কখনো তোমার লাইফ হস্তক্ষেপ করিনি,আর ভবিষ্যতেও করবনা।তাছাড়া আমি চাইনা আমার জন্য তোমার স্টাডি কোনো সমস্যা হোক।কোনো সম্পর্কই একা টিকিয়ে রাখা সম্ভব না।আমিও চাইনা তুমি এই মিথ্যা সম্পর্কের মাঝে নিজেকে জরাও।”

কথা গুলো বলতে বলতে জিসানের চোখ ভিজে উঠলো।জিসান আর কিছুই বললো না।আবার ড্রাইভে করতে শুরু করলো।সে সোজা তিন্নিদের বাসার সামনে গাড়ি থামালো।জিসান এবার বললো

-“তোমার গন্তব্যে চলে এসেছি।দোয়া করি অনেক বড় ডক্টর হও।তবে একটা আফসোস রয়ে গেলো।আমার অপরাধ কি সেটা জানা হলোনা।”

তিন্নি কিছুই বলছে না।জিসান চেচিয়ে বললো

-“প্লিজ তিন্নি বাসায় যাও।তুমি আর কিছুক্ষণ থাকলে আমি আমার রাগকে কন্ট্রোল করতে পারবো না।”

কিছুক্ষণ নিরবতা পর তিন্নি কাপা কাপা হাতে গাড়ির দরজা খুলতে গেলেই জিসান একটানে তিন্নিকে নিজের কাছে এনে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়ে বললো

-“তুমিকি কিছুই বুঝিনা তিন্নি?আমার বুকে কি যন্ত্রণা হচ্ছে সেটাকী দেখনা?আমার এই দম বন্ধ করা অনুভূতিকে কি কখনো বুঝেনা?আমাকে কেনো ভালোবাসতে পারলেনা?”

তিন্নির দু চোখ বেয়ে পানি পড়ছে।জিসান দ্রুত তিন্নিকে ছেড়ে দিয়ে বললো

-“সরি তোমাকে এ ভাবে স্পর্শ করা ঠিক হয়নি।বাসায় যাও।”

তিন্নি কোনো মতে গাড়ি থেকে বের হলো।জিসান আর এক মুহুর্ত দারালোনা।সে তার দুর্বলতা আর কাউকে দেখাতে চায়না।আর তিন্নি সেখানে দাড়িয়ে জিসানের যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো।

আজ রাতের আকাশে কোনো চাঁদ দেখা যাচ্ছেনা।চারদিক কেমন অন্ধকার।তিন্নি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আকাশ দেখছে।আকাশে অনেক মেঘ জমেছে।আকাশের মতো তার মনেও মেঘ জমেছে।মানুষ বৃষ্টিবিলাস করে।কিন্তু সে করে মেঘবিলাস।যেই মেঘ কখনো কারো সামনে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়েনা।

আচ্ছা জীবন কেনো আমাদের প্ল্যান মতো চলেনা।যদি চলতো তবে সে ওই মানুষকে কখনো কষ্ট দিত না।তার জন্য একটা মানুষ এতটা কষ্টে আছে,এই অপরাধবোধ তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।এইযে মানুষটা তার বাসায় আসে তাকে একটা ঝলক দেখতে।কিন্তু সে নিজের মুখ লুকাতে তার সামনে যায়না।অনবরত মানুষটা তাকে কল করে যায়।কিন্তু তাকে কি জবাব দিবে সেই ভয়ে কল ধরেনা।এই মানুষটার কল যদি ইগনোর করতে না পারে সেই ভয়ে ফোনটাও বন্ধ করে রেখেছে।মানুষটা তার কলেজের সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করে আর সে আড়ালে থেকে তাকে দেখে।এই মানুষটার কেয়ারিং বিহাভের জন্য তার প্রচন্ড গিলটি ফিল হয়।দিনের পরদিন সে এই মানুষটাকে ঠকাচ্ছে তাই সে এখন মুখ লুকিয়ে ফিরছে।সে তো কাউকে ঠকাতে চায়নি।তবে নিয়তি কেনো তাকে এই অব্দি এনে দার করিয়েছে?