#মেঘবৃত্ত
#পর্ব_১৭
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
অতঃপর, এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। মেঘা লাল বেনারসি সামলে মায়ের সাথে পা মিলিয়ে বসার ঘরে এলো। মেঘার মা মেঘাকে বৃত্তের ঠিক বা পাশটায় বসালেন। মেঘা আড়ষ্ট ভঙ্গিতে মাথা নত করে বসে রইলো। খুব লজ্জা লাগছে তার। গালে ফুটে উঠেছে এক চিমটি লাল আবির। শ্যামলা মুখশ্রীতে লজ্জার আঁকাবাঁকা আঁচড়। বুকের ভিতরে হৃদপিন্ডটা অদ্ভুত ভাবে চঞ্চল ব্যাঙের মতন লাফাচ্ছে। মনে হচ্ছে, হৃদয়টা বুক ছিঁড়ে যেকোনো মুহূর্তে বেরিয়ে আসবে। খুবই হঠাৎ করে, মেঘার নির্লজ্জ মনটা সহসা জানতে চাইলো, তার পাশে বসে থাকা বৃত্তকে বর হিসেবে কেমন লাগছে? ঠিক তখন, পাশ থেকে বৃত্তের হাসির শব্দ মেঘার কানকে স্বার্থক করে দিলো। মেঘা আড়চোখে সেদিকে একবার তাকালো। বৃত্ত হাসছে। সেই প্রাণখোলা হাসিতে বৃত্তের আঁকাবাঁকা দাঁতগুলো বড্ড মোহময় লাগছে। আজকেও বৃত্তের কোলে এক বাচ্চা। কতই বা বয়স বাচ্চাটার? মাত্র দু কি আড়াই বছর? তবুও দেখো কত সহজে বৃত্তের সাথে মিশে গেছে। অন্যের বাচ্চার প্রতি বৃত্তের আদর দেখে মেঘার বড়ই আফাসোস হলো। বৃত্তের নিজের বাচ্চা দুদিন পরেই তাদের ঘর আলো করে আসবে। কিন্তু, সেই বাচ্চার বেলায়ই বৃত্তের যত অবহেলা, যত খামখেয়ালিপনা। বাচ্চাটা তো বৃত্তের কাছে সামান্যই এক দায়িত্ববোধ! শুধু বাচ্চাটার মা মেঘা বলেই কি বৃত্ত এই দায়িত্বগুলো দেখাচ্ছে? বাচ্চাটার মা অন্য কেউ হলে,তখন? তখনও কি বৃত্ত এমনই থাকতো? এরূপ অসংখ্য প্রশ্ন মেঘার মুখের কাছে দলা বাঁধায়। তবে সেসব মুখ ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার পূর্বে মেঘা কঠোরভাবে গলাধঃকরণ করে ফেলে। লাভ কি এসব প্রশ্ন করে? যার উত্তরের ঘটটায় শুধুই বিষাক্ত কিছু শূন্যতা!
অবশেষে এলো সেই সময়, সেই ক্ষণ, সেই হৃদ-কাঁপানো অনুভুতি। কাজি মোলায়েম সুরে বললেন,
— বলো মা, কবুল।
মেঘার এবার কান্না পাচ্ছে। এতটা বছরের প্রতিটা স্মৃতি তার মস্তিষ্ককে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে, এ বাড়ির প্রতিটা জায়গা মেঘাকে চিৎকার করে বলছে, ‘ আমরা তোর ছোটোবেলা, আমরা তোর স্মৃতি, আমরা তোর অভিমান। আমাদের ছেড়ে চলে যাবি? এতটা পাষাণ কেনো রে তুই?’ মেঘার ঠোঁট চিপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করলো। তবে, বরাবরের মত ব্যর্থতার গ্লানি টেনে শব্দ করে কেঁদে উঠলো। মেয়ের কান্না দেখে মেঘার বাবা-মায়ের চোখ দুটো ঝাপসা হলো। চোখে কোন বেয়ে গড়ালো অশ্রু। মেঘার মা মেয়ের কাঁধে হাত রেখে ছলছল চোখে আশ্বাস দিলেন। মেঘা কণ্ঠ ভিজলো, ভিজলো চিবুক, থুতনি। সে কি কান্না মেয়ের!
বৃত্ত মেঘার কান্না দেখে দু মিনিট থ হয়ে বসে ছিলো। যখন মেঘার কান্না থামার নাম নিচ্ছে না, তখন বৃত্ত সজাগ হলো। মেঘার কাঁধে হাত রাখলো। মেঘা করুন চোখে তাকালো বৃত্তের দিকে। বৃত্ত চোখের ইশারায় আশ্বাস দিলো। কিন্তু আফসোস। আজও ওই দু চোখে শুধুই দায়িত্ববোধ। বৃত্তের চোখে নিজের জন্যে দায়িত্ত্ববোধ দেখলে মেঘার মরে যেতে ইচ্ছে হয়। মেঘা দু আঙ্গুল দিয়ে চোখের জল পরিষ্কার করলো। অতঃপর, কম্পমান কণ্ঠে বললো,
— কবুল, কবুল, কবুল।
বৃত্তকে একই নিয়মে কবুল বলতে বলা হলো। বৃত্ত ধীরে সুস্থে কবুল বললো। অতঃপর, তিন অক্ষরের সেই শব্দ দ্বারা দুজন বেঁধে গেলো এক সুন্দর, পবিত্র সম্পর্কে। হয়ে গেলো, একে অপরের সারা জীবনের সঙ্গী! বিয়ে সম্পন্ন হলো মেঘবৃত্তের।
______________________
বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতে বেশ রাত হলো। ঘড়ির কাঁটা এগারোটা পেরিয়ে বারোটায় পা রেখেছে। মেঘা ও বৃত্ত গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়ি চালু হয়েছে দশ মিনিট হলো। মেঘার ফোঁপানো এখনো থামে নি। ইতিমধ্যে টিস্যুর বাক্স অর্ধেক ফাঁকা হয়ে গেছে। একসময় বৃত্ত অতিষ্ট হলো। এত কান্নার কি আছে সেটাই বৃত্তের বোধগম্য হচ্ছে না। এমন তো নয় যে মেঘা অপরিচিত কারো বাড়ি যাচ্ছে। বৃত্ত, যাকে ছোটবেলা থেকে চিনে, যার সাথে একসাথে বড় হয়েছে তার বাড়ি যেতে এত কিসের শঙ্কা? পুনরায় মেঘার কান্নার শব্দ কানে আসলো। বৃত্ত এবার হুট করে মেঘার হাত থেকে টিস্যু ছিনিয়ে নিয়ে জানালা দিয়ে ফেলে দিলো। বৃত্তের এমন আকস্মিক আচরনে মেঘার কান্না থেমে গেছে। বরং, চোখে ভর করেছে চমক। এমন করলো কেনো বৃত্ত? বৃত্ত মেঘার দিকে চেয়ে রাগ দেখিয়ে বললো,
— তোরে আমি সাধে ছিঁচকাদুনে বলি না, মেঘ। তোর এসব কাজের জন্যেই বলি। সেই কখন থেকে কেঁদে কুটে কানের পোকা বের করে দিচ্ছিস। এত কিসের কান্না? তোকে মেরে ফেলবো আমি? নাকি তোর কিডনি বিক্রি করে আই ফোন কিনবো? অবশ্য তোর বেহুদা কিডনি দিয়ে একটা ভালো আই ফোনও হবে না। তার চেয়ে বরং তোকে মেরে ফেলি। কি বলিস?
কথাটা বলে বৃত্ত চোখ সরু করে বেশ রাগ নিয়ে তাকালো মেঘার দিকে। মেঘা দুবার ফুঁপিয়ে উঠলো। নাক টেনে বললো,
— হাত লাগিয়ে দেখ একবার। হাত দুটো ভেঙে গুঁড়ো করে ফেলবো একদম।
বৃত্ত এবার হেসে উঠলো। মেঘার শাড়ীর আঁচল ঠিকঠাকভাবে মাথায় তুলে দিয়ে বললো,
— এই না হলে আমার মেঘ। তোর এই ঝাসি কি রানী রুপই আমার বেশ লাগে। বাকি কিছু ভার মে যাক।
মেঘা ফিক করে হেসে ফেললো। সঙ্গেসঙ্গে দেখা গেলো তার গজ দন্ত। বৃত্ত মেঘার হাসির দিকে একবার স্থির চোখে তাকিয়ে মুহূর্তের মধ্যে চোখ সরালো। মেঘার কান্না এখন সম্পূর্ন থেমে গেছে। আপাতত সিটে মাথা হেলিয়ে বসে আছে সে।
বৃত্ত কতশত কথা বলছে। কখনো হাসছে, কখনো অবাক হচ্ছে, কখনো রাগ দেখাচ্ছে। বৃত্ত নামক প্রেমিকের যে কত রূপ! সেই রূপের বহর এ জন্মে যেনো শেষ হওয়ার নয়।
হঠাৎ, বৃত্তের কথা থেমে গেলো। পাশ থেকে মেঘার কোনোরূপ আওয়াজ না পেয়ে মেঘার দিকে তাকালো। মেঘা সিটে মাথা হেলিয়ে মাতালের মত ঘুমাচ্ছে। মেঘার এমন বাচ্চাদের মত ঘুমানো দেখে বৃত্ত ফিচেল হাসলো। আস্তে করে মেঘার মাথাটা নিজের কাঁধে রাখলো। মেঘার ঘুমন্ত দেহ একটু আরাম পেতেই গুটিসুটি মেরে বৃত্তের কাঁধে নাক ঘষলো। এতে বৃত্তের কেমন যেনো সুড়সুড়ি লাগলো। তবে, মেঘার অসুবিধে হবে তাই বৃত্ত একবিন্দুও নড়লো না। ঠায় বসে রইলো নিজ জায়গায়। ঘুমের ঘোরে মেঘা বৃত্তের এক হাত আকড়ে ধরে বৃত্তের কাঁধে আবারও নাক ঘষলো। বৃত্তের সম্পূর্ণ শরীর যেনো ঝটকা খেলো এতে। এর আগেও মেঘার সাথে একান্ত সময় কাটিয়েছে সে। তবে, সেটা নেশার ঘোরে। তখন মনে না ছিল কোনো অনুভূতি, না ছিলো নিজের সক্রিয় মস্তিষ্ক। যা ছিলো পুরোটাই শারীরিক চাহিদা। কিন্তু, আজ? আজ মেঘার সামান্য স্পর্শ বৃত্তের মনকে মাতিয়ে তুলছে। এই অনুভূতি সম্পূর্ণ নতুন, সদ্য ফোঁটা ফুলের ন্যায় পবিত্র। বৃত্ত মেঘার এহেন কান্ড দেখে হাসলো খুব। ক্লান্ত থাকায় মেঘার মাথায় নিজের মাথাটা হেলান দিয়ে চোখ বুজলো সে। বড্ড ঘুম পাচ্ছে তার।
#চলবে
#মেঘবৃত্ত
#পর্ব_১৮
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
ফুলে ফুলে সজ্জিত পালঙে বসে আছে মেঘা নামক মেয়েটা। অন্যান্য বধূদের মত, মেঘার মুখে লজ্জারা নেই। বরং, তার মুখে খেলা করছে ঘুমেরা। ঘুমে দু চোখ টেনে রাখাই এখন মুশকিল হয়ে পড়েছে। ঘাড় থেকে মাথা অব্দি চিকন এক ব্যথায় কাহিল ও। কাধটাও ম্যাজম্যাজ করছে। মনে হয়, গাড়িতে বৃত্তের কাধে অনেক সময় মাথা ফেলে রাখার কারণে। ঠাট্টার সম্পর্কের আত্মীয়রা মেঘার কাছ থেকে চলে গেলো। খানিক বাদে আগমন ঘটলো মেঘার শাশুড়ির। তিনি ভ্রুতে ভাজ ফেলে মেঘার পাশে এসে বসলেন। মেঘাকে আগাগোড়া একবার নিরীক্ষণ করতেই মেঘা ভয়ে জমে গেলো। নতজানু হয়ে স্থির হয়ে বসে রইলো ও। বৃত্তের মা মেঘার থুতনি আঙ্গুলের ডগা দিয়ে তুলে ধরলেন। মেঘা নিভুনিভু চোখে তাকালো উনার দিকে। বৃত্তের মা বেশ খানিক সময় চুপচাপ চেয়ে রইলেন মেঘার মুখ পানে। অতঃপর, এক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মেঘা জানে এই দীর্ঘশ্বাসের কারণ কি! মেঘার খুব কষ্ট হলো। তবুও ভদ্রতার মুখ বজায় রাখলো ও। বৃত্তের মা বিড়বিড় করে কি যেন আওড়ালেন। মেঘা শুনতে পেলো না। পড়া শেষ হলে তিনি মেঘার মুখে ফুঁ দিলেন, ফুঁ দিলেন সারা অঙ্গে। মেঘা শুধু শীতল চোখে চেয়ে রইলো। বৃত্তের মা আঙ্গুল সরালেন। মেঘা আবারও নতজানু হলো। বৃত্তের মা বললেন,
— শোনো মেঘা। যতই হোক। আজ থেকে তুমি এ বাড়ীর বউ,বৃত্তের স্ত্রী। তার সবার সাথে একজন বউয়ের মত আচরন করবে। এমনকি বৃত্তের সাথেও। বৃত্তের সাথে কিন্তু তুই তোকারি একদম চলবে না। তোমার শ্বশুরের নিষেধ এটা, বুঝলে? আর হ্যাঁ, মেয়েদের কাছে স্বামী হলো পরম সম্মানের। তাই কখনো নিজের স্বামীকে ছোট করে দেখবে না। স্বামীকে মাথায় তুলে রাখবে। মনে থাকবে?
মেঘার গলা শুকিয়ে এলো। বৃত্তের মায়ের ওমন গম্ভীর কথাবার্তা তার মাথায় ঝিমঝিম শব্দ তুলছে। মেঘা বাধ্য বউয়ের মত মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোধক উত্তর দিলো। বৃত্তের মা যেনো শান্তি পেলেন। বুক থেকে পাথর নেমে গেলো তার। তিনি মেঘার শাড়ীর আঁচল ঘোমটার ন্যায় দিয়ে দিলেন। মেঘার দিকে শান্ত চোখে চেয়ে বেরিয়ে পড়লেন সে’ঘর থেকে।
তিনি যেতেই মেঘা যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। ঘোমটা একটু তুলে লম্বা লম্বা শ্বাস টানলো। উফ! দমবন্ধকর পরিস্থিতি!
প্রায় দশ মিনিট পর দরজা আটকানোর শব্দ আসলো। মেঘা ঘোমটার আড়াল থেকে সেদিকে তাকালো। বৃত্ত এসেছে। বৃত্তকে দেখেই মেঘার কেমন যেনো নিঃশ্বাস আটকে আসতে লাগলো। আজ ভয়ংকর সুন্দর লাগছে তাকে। এতটা সুন্দর তাকে আগে কখনো লাগে নি। নাকি বৃত্ত তার স্বামী বলেই এতটা সুন্দর লাগছে। মেঘা আর তাকাতে পারলো না। মনে হলো, চোখটা যেনো ঝলসে যাবে, জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। মেঘা চোখ সরালো।
বৃত্ত এগিয়ে এসেই বিছানায় ধাম করে শুয়ে পড়লো। বিছানাটা যেনো লাফিয়ে উঠলো তাতে। মেঘা চমকিয়ে তাকালো বৃত্তের দিকে। বৃত্ত সেদিকে বেপরোয়া। দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে সে। মেঘা হেসে ফেললো তা দেখে। বৃত্তকে এই মুহূর্তে পাক্কা এক বাচ্চা লাগছে। বিয়ের শেরওয়ানি গায়ে দেওয়া বড় বাচ্চা!
বৃত্ত এখন স্বাভাবিক হলো। চোখ ঘুরিয়ে পাশে গুটিসুটি হয়ে বসে থাকা মেঘার দিকে তাকালো। ঘোমটা দেওয়ায় মুখটা অলক্ষে। বৃত্ত দুষ্টু হেসে চট করে ঘোমটাটা তুলে ফেললো। চোখ টিপ দিয়ে মেঘার ভরকে যাওয়া চেহারার দিকে চেয়ে বললো,
— টুকি।
মেঘা রাগ দেখালো, বৃত্ত পরোয়া করলো না। মেঘার ঘোমটাটা একেবারে মাথা থেকে ফেলে দিয়ে আবারও দুষ্টু হেসে বললো,
— হ্যালো!
মেঘা কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
— পাগলা রোগে ধরসে? এমন করছিস কেনো? সুন্দর করেও তো ঘোমটাটা তুলা যায়। এমন ফকিন্নির মত করে তুললি কেনো?
বৃত্ত এবার উঠে বসলো। বললো,
— কতবড় কথা। দাড়া, তোকে আমার রোমান্টিক সাইট দেখাচ্ছি। ওয়েট।
কথাটা বলে বৃত্ত মেঘার ঘোমটা আবারও নামিয়ে দিল। মেঘার শ্যামলা রঙা মুখখানা ঢেকে গেলো টকটকে লাল রঙে। বৃত্ত আবেগঘন চাওনি নিক্ষেপ করলো মেঘার মুখপানে। মেঘা এতে যেনো শিউরে উঠলো। অন্তরে প্রবাহিত হলো অনুভূতির ঠান্ডা এক স্রোত। বৃত্ত হাত উঁচিয়ে আস্তে করে মেঘার ঘোমটা তুললো। মেঘার উন্মুক্ত মুখের দিকে চেয়ে মায়াবী কণ্ঠে বললো,
— মা শা আল্লাহ! আমার বউ!
‘ আমার বউ ‘ কথাটা মেঘার কি যে ভালো লাগলো! মেঘা সেখানটায় যেনো জমে গেলো, বরফ হয়ে গেলো। কন্ঠনালী আটকে গেলো। কথা বলতে পারলো না আর।
মেঘা যখন অনুভূতির সাগরে ডুবতে ব্যস্ত ঠিক তখনই বৃত্তের উচ্চস্বরের হাসি কানে এলো। বৃত্ত বিছানায় একপ্রকার গড়াগড়ি টাইপ হাসি হাসছে। হাসির চোটে চোখে পানি অব্দি এসে গেছে। মেঘা বোকা বনে গেলো। মনে পড়লো, বৃত্ত তো এতক্ষণ অভিনয় করছিল। মেঘার মনটা নিমিষেই খারাপ হয়ে গেলো। উজ্জ্বল মুখটা মুহূর্তেই কালো হয়ে গেলো। মুখ ফুলিয়ে বৃত্তের ওমন নিষ্টুর হাসির পানে চেয়ে রইলো। একসময় বৃত্ত হাসি থামালো। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
— সিরিয়াসলি, আমার দ্বারা এসব রোমান্টিক অ্যাক্টিং জাস্ট ইম্পসিবল। তোকে দেখলে আমার সব রোমান্টিক সিস্টেম উল্টে পাল্টে যায়। না, না। তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ডই ঠিক আছিস। তোকে বউ-টউ হতে হবে না।
মেঘা যেনো এই কেঁদে ফেলবে, ভাবখানা এমন। তবুও, মেঘা নিজেকে সামলালো। মুচকি হেসে বললো,
— নাহ, বৃত্ত। তুই চমৎকার অভিনয় করিস। আমি তোর অভিনয়টা তো বুঝতেই পারিনি। কি বোকা আমি।
বৃত্ত লাফ দিয়ে উঠে বসলো। বিছানায় হাঁটু গেরে বসে চমক গলায় বললো,
— সত্যি? আমি দারুন অ্যাক্টিং পারি?
মেঘা হাসলো। বললো,
— হ্যাঁ।
বৃত্ত মেঘার গাল দুটো টেনে দিয়ে হেসে বললো,
— কমপ্লিমেন্টের জন্যে আপনাকে লোহার অস্কার দেওয়া হোক, মিস ধানিলঙ্কা।
মেঘা কিছু বললো না, হাসলো শুধু।
ঘড়ির কাঁটায় দুটো বাজতেই বৃত্তের হুশ এলো। ঘড়ি থেকে চোখ সরিয়ে মেঘার দিকে তাকালো। বললো,
— মেঘ, ঝটপট গোসলটা সেরে নে। বেশ রাত হয়ে গেছে। ঘুমাতে হবে না?
মেঘা সম্বিত ফিরে পেলো। ঘুমের কথাটা মনে পড়তেই, চোখ দুটি ভেঙে আসতে লাগলো। আসলেই, বড্ড ঘুম পাচ্ছে তার। মেঘা বললো,
— তুই আগে সেরে নে। আমি গয়না’গুলো খুলে নেই ততক্ষণে।
বৃত্ত সম্মতি দিলো। আলনা থেকে টাওয়াল নিয়ে বাথরুমে চলে গেল। মেঘা বিছানা ছেড়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে বসলো। একে একে সব গয়না খুলতে লাগলো।
তবে, বাঁধ সাধলো গলার চেইন। চেইনের হুকটা চুলের সাথে পেঁচিয়ে গেছে। খুলতে গেলেই চুলে টান পরে আর মেঘা ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে।
বৃত্ত বাথরুম থেকে বেরিয়ে মেঘার এই অবস্থা লক্ষ্য করে ঝটপট মেঘার পিছনে এসে দাঁড়ালো। ধমক দিয়ে বললো,
— কি করছিস? চুল সব ছিঁড়ে ফেলবি, নাকি? দাড়া, আমি দেখছি।
মেঘা হাত সরালো। বৃত্ত ধীরে সুস্থে হুক থেকে চুল সরিয়ে চেইনটা খুলে দিলো। মেঘা যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। চেইনটা হাতে নিয়ে রাগ দেখালো,
— আমার কত চুল ছিঁড়ে ফেলেছে। ফালতু চেইন।
বৃত্ত আয়নায় তাকিয়ে হাত দিয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বললো,
— হুম, তাই জন্যেই সব রাগ চুলের উপর ঝাড়ছিলি?
মেঘা কিছু বললো না। চুপচাপ ব্যাগ থেকে টাওয়াল আর জামা কাপড় বের করে বাথরুমে চলে গেল। কাল সকালে ব্যাগ থেকে জামা কাপড় বের করে গোছাতে হবে।
______________________
— মেঘ, লাইটটা নিভিয়ে দে তো।
মেঘা টাওয়ালটা বারান্দায় মেলে এসে লাইট নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। বৃত্ত তার পাশে নেই। মাটিতে মাদুর পেতে শুয়েছে। মেঘার এতে কেমন যেনো অস্থির অস্থির লাগছে। সারারাত বৃত্ত ওভাবে ঘুমালে তো ঠান্ডা লেগে যাবে। জ্বর বা সর্দিও হতে পারে। মেঘার অস্বস্তি লাগলো। বৃত্তের কিছু হয়ে গেলে, মেঘার কি হবে? মেঘার সে চিন্তায় ঘুম এলো না। বারবার এপাশ থেকে ওপাশ করছে। আর সইতে পারলো না ও।
এক লাফে উঠে বসে বৃত্তের দিকে তাকালো। বৃত্ত ওপাশ ফিরে ঘুমাচ্ছে। এক হাত মাথার নিচে রেখে লম্বাটে আকারে। মেঘা দুবার ঢোক গিললো। নিজেকে ধাতস্থ করে ডাক দিলো,
— বৃত্ত? ঘুমিয়ে গেছিস?
বৃত্ত পাশ ফিরে মেঘার দিকে তাকালো। বললো,
— না। কেনো? কিছু বলবি?
মেঘা ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেললো। কিভাবে বলবে কথাটা?
— কি হলো? চুপ কেনো?
বৃত্তের কথায় মেঘার টনক নড়লো। কয়েকবার উশখুশ করে বলে উঠলো,
— তুই চাইলে বিছানায় এসে ঘুমাতে পারিস। আমি কিছু মনে করবো না।
বৃত্ত যেনো অবাক হলো। এক ভ্রু উচুঁ করে জিজ্ঞেস করলো
— আর ইউ সিউর?
মেঘা মাথা ঝাঁকালো। বললো,
— হুম, হুম।
বৃত্ত অবাক হাসলো। মাদুর থেকে বালিশ হাতে নিয়ে মেঘার পাশে শুয়ে পড়লো। মেঘা স্বস্থি পেলো। বৃত্তের দিকে একপলক চেয়ে বালিশে মাথা রাখলো। এখন তার শান্তি লাগছে। এতক্ষনে জমে রাখা অস্বস্তি হুরহুর করে কেটে গেলো। সেখানটায় ভর করলো রাজ্যের ঘুম।
#চলবে।