মেঘবৃত্ত পর্ব-৪৪+৪৫

0
484

#মেঘবৃত্ত
#পর্ব_৪৪
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

নতুন অতিথি আসার খুশিতে বৃত্তদের ঘরে যেনো উৎসব লেগে গেছে। মেঘার বাবা মাও আজ এ বাড়ি এসেছেন। পাড়ার চেনা পরিচিত মহিলারা মেঘার মাথায় হাত বুলিয়ে কতশত দোয়া পড়লেন। সর্বোপরি, এক এলাহী কাণ্ড! এসবের মধ্যে বৃত্ত একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। বুকে হাত ভাঁজ করে স্থির দৃষ্টিতে পরখ করছিল সবার খুশি, আনন্দ। নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে তার। কি করবে, কোথায় যাবে কিছুই মাথায় ঢুকছে না। মেঘার চিন্তায় চিন্তায় তার মাথাটা মনে হচ্ছে, পেঁচিয়ে যাচ্ছে। কিন্ত, এই মেঘাকে দেখো না? আজ তার মুখ থেকে হাসি সরছেই না। কথা বলছে আর ক্ষণে ক্ষণে হাসছে শুধু। সবার থেকে ক্রমাগত দোয়া নিচ্ছে বাচ্চার জন্যে। এবার যেনো বাচ্চাটার আর কোনো ক্ষতি না হয়! এবার বাচ্চাটার কিছু হলে মেঘাকে বাঁচানো যাবে না একদম। দূর থেকে মেঘার খুশি দেখে বৃত্ত প্রচন্ড কষ্ট হলো। কান্না পাচ্ছে খুব তার। সে বারবার আঙ্গুলের ডগা দিয়ে চোখ মুছে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে। আজ মেঘা বাচ্চাটা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় বৃত্তের দিকে তাকানোর সময় নেই তার। মেঘা ওর মত অনাগত বাচ্চাকে নিয়ে সুন্দর সময় কাটাচ্ছে। বৃত্তের এমন অসহায়ত্ব আর কারো নজরে না পড়লেই বৃত্তের মায়ের নজরে ঠিকই পড়েছে। তিনি দূর থেকে ভ্রু কুঁচকে বৃত্তের দিকে চেয়ে আছেন। বৃত্তের ভেজা চোখ তার মনকে চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে। বৃত্তের মা এগিয়ে আসতে যাবেন, তার আগেই তাকে একজন মহিলা টেনে নিয়ে গেলেন কথা বলার জন্যে। বৃত্তের সাথে কথা বলা আর হলো না তার। তবে মনেমনে তিনি প্রচন্ড উশখুশ করতে লাগলেন। এই মুহূর্তে বৃত্তের সাথে কথা বলাটা খুব দরকার!
_______________________
মধ্য রাত, মেঘা বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। এই একটু আগে অব্দি মেঘা মাথা ব্যথায় চিৎকার করে কেঁদেছে। বৃত্ত আর কোনো উপায় না পেয়ে মেঘাকে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। বৃত্ত মেঘার ঘুমন্ত মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। মুগ্ধ হলো সে, প্রিয় মানুষের নিষ্পাপ মুখখানা দেখে!
পৃথিবীর সবচেয়ে সবচেয়ে মুগ্ধকর মুহূর্ত হলো, যখন প্রিয় মানুষটা নিজের পাশে ঘুমিয়ে থাকে। তার একেকটা নিঃশ্বাস জানান দেয়, মানুষটার প্রতি এক বুক ভালোবাসা! তার বুজে থাকা চোখ জানান দেয় প্রিয় মানুষটাকে ঘিরে থাকা তার নিদারুণ ভরসা। ঘুমন্ত অবস্থায় এই পৃথিবীর সকল প্রিয় মানুষকেই সুন্দর লাগে।

বৃত্ত মাথা ঝুঁকে মেঘার কপালে নিজের ঠোঁট ছোঁয়ালো। মেঘা ঘুমের মধ্যেই বৃত্তের হাত ছুঁয়ে একটু নড়েচড়ে আবার শুয়ে পড়লো। বৃত্ত সরে এলো। শীত প্রায় কমে এসেছে। ঈষৎ গরম পড়েছে দেশে। বৃত্ত মেঘার গা কাঁথা দিয়ে ঢেকে দিলো। অতঃপর, সে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।

বৃত্তদের ঘরের ড্রইং রুমে এক বড় বারান্দা আছে। বৃত্ত সে বারান্দায় গিয়ে গ্রিল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গেলো। নিজের ঘরে সিগারেট খেলে মেঘার ঘুমে সমস্যা হতে পারে। মাথা ব্যথাটাও আবার চাড়া দিতে পারে। সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিয়ে তাতে আগুন ধরালো। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বৃত্ত ভাবলো খুব। এই বাচ্চাটা তার চাই, তেমন করে মেঘাকেও তার চাই। কোন মুখে সে মেঘাকে বলবে, বাচ্চা অ্যাবোরেশনের কথা! মেঘা তো ওকে মেরেই ফেলবে। একবার বাচ্চা হারিয়ে মেঘার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। মেঘার কষ্টের সাক্ষী স্বয়ং সে নিজেই। আরো একবার বাচ্চা স্বেচ্ছায় নষ্ট করার কথা বললে, মেঘা হয়তো সারাজীবনের জন্যে বৃত্তের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিবে। তখন, বৃত্ত বাঁচবে কাকে নিয়ে? উফ, বৃত্তের মাথা ধরে যাচ্ছে। সিগারেটের ধোঁয়ায় বৃত্তের চোখ জ্বলছে। তবুও সে একটার পর একটা সিগারেট শেষ করছে।

— এসব কি, বৃত্ত? তুই এই মাঝরাতে সিগারেট খেয়ে ঘর ধোঁয়া করছিস কেনো? তোর বাবা দেখলে কুরুক্ষেত্র ঘটে যাবে।

মায়ের কন্ঠ শুনে বৃত্ত তটস্থ হয়ে উঠলো। চটজলদি হাতের সিগারেটটার আগুন নিভিয়ে বারান্দা দিয়ে ফেলে দিলো। দু চোখ মুছে মায়ের দিকে ফিরল সে। নত কণ্ঠে বললো,
— আসলে, ঘুম আসছিলো না। তাই ভাবলাম….
— মেঘা কোথায়?
— ঘুমাচ্ছে।
— তাহলে, তুই এখানে কি করছিস?
— ঘরে সিগারেট খেলে মেঘার ঘুমাতে প্রবলেম হবে, তাই ভেবেছিলাম এখানে এসে…

কথা অসম্পূর্ণ রেখে বৃত্ত থামলো। বৃত্তের মা এবার দমলেন একটু। হঠাৎ বিকেলের কথা মনে পড়ায় তিনি কালবিলম্ব না করে বললেন,
— তুই কি কোনো কারণে কষ্টে আছিস বৃত্ত? আজ বিকালেও দেখলাম তুই কেমন উদাস। কি হয়েছে মাকে বল। মেঘা কিছু করেছে?

বৃত্ত মায়ের কথা শুনে মুখটা ভার করে ফেললো। কথা এড়িয়ে যাবার চেষ্টায় বললো,
— না, কিছু হয়নি মা। তুমি খামোকা চিন্তা করছ!
— তাই? মাকে মিথ্যা বলছিস? এত সাহস কোথা থেকে এলো তোর, হ্যাঁ?
বৃত্ত অনেক চেষ্টা করলো কথা লুকানোর। কিন্তু মায়ের এমন ভরসার হাত নিজের কাঁধে পেতেই এবার আর নিজেকে আটকাতে পারলো না। মাকে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। চোখ থেকে দু ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিয়ে বললো,
— মা, আমার সব শেষ মা। সব শেষ। তোমার বৃত্ত মরে যাচ্ছে, মা। তুমি কিছু একটা করে আমাকে বাঁচাও প্লিজ। আমি মেঘ ছাড়া শেষ হয়ে যাবো মা। প্লিজ মা, আমার মেঘকে বাঁচাও!

বৃত্তের মা বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে গেলেন। বৃত্তের নীরব কান্নার জলের অস্তিত্ব নিজের কাঁধে পেতেই তিনি সম্ভিত ফিরে পেলেন। বৃত্তের পিঠে একহাত রেখে বললেন,
— বৃত্ত, কি হয়েছে মেঘার? বল মাকে।
বৃত্ত থামলো খানিক। ধরা গলায় খুব কষ্টে মুখ খুললো সে। বললো,
— ওর ব্রে-ব্রেইন টিউমার।
বৃত্তের মায়ের হাত থেমে গেলো। অসার হয়ে গেলো সম্পূর্ণ শরীর। নিজের অজান্তেই তার হাত নিচে পড়ে গেল। অবাক কণ্ঠে বললেন তিনি,
— ব্রেইন টিউমার?
— হ্যাঁ! কাল ডাক্তার বলেছে হয় বাচ্চাকে বাঁচাতে নয় মেঘকে। টিউমারের পজিশন এত ক্রিটিকাল যে মেঘের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুব কম। মা, ডাক্তার কি করে এমন কথা বলতে পারলো? আমি আর মেঘ মাত্রই তো এক হলাম। এত জলদি দুজন আবার আলাদা হয়ে যাবো কি করে মা? মা প্লিজ, আমার মেঘকে বাঁচাও। আমি মরে যাবো মা। সত্যিই মরে যাবো। আমার কোনো বাচ্চা চাইনা, আমার শুধু মেঘকে চাই, মা। শুধু মেঘকে চাই। আল্লাহ আমাকে এত বড় শাস্তি কি করে দিতে পারলেন, মা?

বৃত্তের মা ছেলের এমন ভেঙে পড়া দেখে কি বলবেন খুঁজে পেলেন না। ছেলের এহেন কষ্টে তার চোখেও জল জমে গেলো। বৃত্ত যথেষ্ট শক্ত এক ছেলে। ছোটবেলা থেকে তার কান্নার অভ্যাস খুব কম। বড় হওয়ার পর থেকে যতই কঠিন পরিস্থিতি হোক না কেনো, বৃত্তের চোখ ভেজে না। সে জানে পরিস্থিতি কি করে সামলাতে হয়। কিন্তু, আজ এক অন্য বৃত্তকে আবিষ্কার করলেন বৃত্তের মা। এই বৃত্ত কাঁদছে, নিজের ভালোবাসার জন্য। হু হা করে কাঁদছে সে। বৃত্তের মা ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে স্বান্তনা দিতে লাগলেন। কিন্তু আজ তিনি নিজেও ভেঙে পড়েছেন। মেঘার এহেন অবস্থা তিনি মোটেও মেনে নিতে পারছেন না। কি থেকে কি হয়ে গেল? তার সাজানো গোছানো সংসারটা এভাবে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে দেখে তার মনটা হাহাকার করে উঠলো।

#চলবে

#মেঘবৃত্ত
#পর্ব_৪৫
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

অতঃপর কেটে গেলো কতক দুঃসহ দিন। এ কদিনে বৃত্ত বহু চেষ্টা করেছে মেঘাকে বাচ্চা অ্যাবোরেশনের কথা বলতে। কিন্তু, মেঘার বাচ্চা নিয়ে পাগলামি দেখে বৃত্তের সাহস হয়ে উঠেনি। শেষ পর্যন্ত বৃত্ত নিজে নিজেই সিদ্ধান্ত নিলো, বাচ্চাটা জন্ম নেওয়ার পরই মেঘার অপারেশন হবে। বৃত্ত পারবে না, মেঘার মনটা আবার টুকরো টুকরো করে ভেঙে ফেলতে।
বৃত্তের অফিস থেকে কক্সবাজারের একটা ট্যুরের আয়োজন করেছে। ট্যুরটা মূলত অফিসের কাজ ডেভেলপ করার জন্যেই আয়োজিত হয়েছে। কিন্তু, বৃত্ত মেঘাকে এমন অবস্থায় রেখে ট্যুরে যেতে নারাজ। মেঘা অনেকবার বুঝিয়েছে বৃত্তকে। বারবার বলেছে, ‘ সে আর বাচ্চা দুজনেই ঠিক আছে! তাদের নিয়ে এত চিন্তা করতে হবে না। বৃত্তের ট্যুরে যাওয়াটা দরকার। খামোকা মানা করে লাভ কি ‘

অবশেষে , বৃত্ত রাজি হয়েছে। তবে সে একা যাবে না। মেঘাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে। বৃত্তের কথা শুনে মেঘার খুশি দেখে কে? মেঘা একদিনের ভেতরেই সমস্ত লাগেজ রেডি করে ফেললো। ট্যুরের সবাই অফিসের টাকায় বাস দিয়ে গেলেও বৃত্ত মেঘার কথা ভেবে প্লেইনের টিকেট বুক করেছে। মেঘাকে নিয়ে সে কোনো রিস্ক নিতে চায়না।
এ ছ মাস মেঘবৃত্তের জীবনের স্বপ্নের সময় হবে। এই ছ মাসে মেঘবৃত্ত এক হবে, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত তাদের ঝুলিতে পুড়বে। সারা জনমের একসাথে থাকার তৃষ্ণা এ ছয়মাসে তারা পূরণ করবে। ভালবাসার এক নতুন অধ্যায় গড়বে এই ছোট্ট মাসগুলোতে।
______________________________
মেঘবৃত্ত মাত্রই রিসোর্টে এলো। ইতিমধ্যে মেঘার দুবার বমি হয়েছে। মাথা ব্যথায় চোখে পানি চলে এসেছে তার। মেঘাকে এত কষ্ট পেতে দেখে বৃত্তের নিজের চোখেও পানি চলে এলো। বৃত্ত মেঘার হাত ধরে বললো,
— খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে, মেঘ?
মেঘা একহাতে মাথা খামচে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো। ঠোঁট কামড়ে ধরে বললো,
— বৃত্ত, আমার মাথা! আমার মাথাটা ফেঁটে যাচ্ছে বৃত্ত। মাথার ভেতর মনে হচ্ছে কেউ ছুরি ঢুকিয়ে দিয়েছে। ইয়া আল্লাহ, এত কষ্ট কেন হচ্ছে আমার?

মেঘা ক্রমশ আর্তনাদ করতে লাগলো। বৃত্ত নিজের চোখের জল মুছে মেঘার মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলো। মাথায় ঘনঘন হাত বুলিয়ে ধরা গলায় বললো,
— আল্লাহকে ডাক মেঘ। সব ঠিক হয়ে যাবে। কিচ্ছু হবে না তোর। তোর কিছু হয়ে গেলে আমার কি হবে রে মেঘ? আমি মরে যাবো রে। খুন হয়ে যাবো আমি। আল্লাহকে ডাক মেঘ।

মেঘা বৃত্তের কথার অর্থ ধরতে পারলো না। বৃত্তের পিঠের শার্ট খামচে ধরে ঘাপটি মেরে মিশে রইলো বৃত্তের বুকের সাথে।
______________________
মেঘা মাত্রই গোসল করে বের হলো। ঔষধ খাওয়ার পর মাথা ব্যথাটা খানিক কমেছে। নাক মুখ লাল টকটকে হয়ে গেছে মেঘার। কান্না করতে করতে শ্বাসকষ্ট উঠে গেছে তার। এখন গোসল করায় একটুখানি শান্তি লাগছে।

বৃত্ত বিছানায় বসে আছে। মুখখানা ভার, থমথমে। হাঁটু ক্রমাগত নাড়িয়ে নত মুখে কি একটা চিন্তা করেই যাচ্ছে সে।
মেঘা হাতে পায়ে ক্রিম দিতে দিতে বৃত্তের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলো,
— ওই, কি হলো তোর? এমন করে বসে আছিস কেনো?

মেঘার কণ্ঠ শুনে বৃত্তের মুখ স্বাভাবিক হলো। মাথা উঁচু করে মেঘার দিকে তাকালো সে। মেঘার শরীর ভেজা, চুল থেকে টপটপ পানি পড়ছে। শাড়ীর আঁচল মাটি ছুঁইছুঁই। কি সুন্দর দৃশ্যখানা। বৃত্ত বড়ই মুগ্ধ হলো। ভুলে গেলো যতসব সব চিন্তা, ভয়। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো মেঘার দিকে।

ঘাড়ে তপ্ত নিঃশ্বাসসের অস্তিত্ব পেতেই মেঘার শরীর শিরশির করে উঠলো। কোমরে বৃত্তের হাতের ছোঁয়া পেতেই তার শ্বাস আটকে যেতে লাগলো। এ কি করছে বৃত্ত? বৃত্তের এমন আগুন ছোঁয়ায় মেঘার যেনো মরণ নিশ্চিত! বৃত্ত মেঘার শরীর নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
— নিড অ্যা কিস রাইট নাও, মিসেস বৃত্ত!

ইশ, কিসব অশ্লীল কথা। মেঘা বরাবরের মত লজ্জা এর অস্বস্তিতে লাল হয়ে গেলো। মেঘা দেয়ালের সাথে একদম মিশে আছে। বৃত্ত মেঘার দুপাশে দুহাত দেয়ালে ঠেসে রেখে ঝুঁকে আছে মেয়েটার দিকে। ঘরের একপাশের বিশাল জানালা থেকে ভেসে আসছে, সমুদ্রের গর্জন-তর্জন। মৃদু মন্দ দখিনা বাতাস দুজনের গা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে। উড়ছে মেঘার চুল, মেঘার শাড়ির আঁচল। বৃত্ত নেশাময় চোখ রাখলো মেঘার পানে। আলতো হাতে মেঘার বেবি হেয়ার কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে ওষ্ঠ ছোঁয়ালো মেঘার দু ভ্রুয়ের ঠিক মধ্যখানটায়। মেঘা কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠে চোখ খিঁচলো। খামচে ধরলো বৃত্তের কাঁধের টিশার্ট। বৃত্ত সরে এলো মেঘার থেকে। চোখ রাখলো মেঘার দু আফিমসম নেশালো চোখে। সঙ্গেসঙ্গে ডুবে গেলো সে, হারিয়ে গেলো, মত্ত হলো ওই কাজল কালো চোখ জোড়ায়। বৃত্ত ফিসফিসিয়ে বললো,
— তুই এত সুন্দর কেন রে মেঘ? কি মাখিস বল তো, আমাকে তোর নেশায় বুদ করে রাখতে?

মেঘার মনটা ভরে গেলো। চোখ ভিজে এলো, গলা শুকিয়ে গেলো। মনে হলো, এক জীবনে আর কি চাই তার। বৃত্ত নামক প্রেমিক পুরুষটা তাকে ভালোবাসে। নিজ পুরুষের চোখে মেঘা সবচেয়ে সুন্দরতম নারী। এর চেয়ে শ্রেষ্ট অনুভূতি আর কিইবা হতে পারে। মেঘার ভয় হলো। যদি বৃত্তকে সে হারিয়ে ফেলে? তখন কি হবে মেঘার? এত এত ভালোবাসা হারিয়ে ফেললে মেঘা তো মরেই যাবে।
মেঘাকে চিন্তায় দেখে বৃত্ত হালকা ভ্রু কুচকালো। মেঘার থুতনি আঙ্গুলের ডগায় ধরে উচুঁ করলো। মেঘা চিন্তা ভেঙে বৃত্তের দিকে তাকালে বৃত্ত বললো,
— কি ভাবিস এত?
মেঘা ঢোক গিললো। কম্পিত কণ্ঠে বললো,
— আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
বৃত্ত মুচকি হাসলো। বললো,
— হুম, বল।
— আমি মরে গেলে তুই কি করবি বৃত্ত? আমার ভাগের ভালোবাসা তুই অন্য কাউকে দিয়ে দিবি?
মেঘার কথা শুনে হুট করেই বৃত্তের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। দাঁতে দাঁত চেপে অদ্ভুত এক শব্দ তুললো সে। জোরে জোরে কতক নিঃশ্বাস ফেলে হঠাৎ করেই খামচে ধরলো মেঘার নরম দুগাল। মেঘা বোকা বনে গেলো। হুট করে বৃত্তের এমন রাগ দেখে ভয়ে তার আত্মা শুকিয়ে গেলো। বৃত্ত দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে বললো,
— আবার মরার কথা বলে দেখ না? মাটিতে পুঁতে ফেলবো একদম। মরার শখ জাগছে না তোর? এক কাজ করি, বিষ এনে তোকে প্রথমে খাইয়ে আমিও খেয়ে নেই। তারপর, দুজনেই একদম পগার পা। ভালো আইডিয়া না? এখন চুপ কেন? উত্তর দে?

মেঘা গাল দুটো মনে হচ্ছে বৃত্তের আঙ্গুল দেবে যাচ্ছে। মেঘা ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো। বৃত্ত সঙ্গেসঙ্গে মেঘাকে ছেড়ে দিলো। মেঘা ছাড়া পেয়ে গালে হাত রেখে আহত চোখে বৃত্তের দিকে চেয়ে রইলো। বৃত্ত সরে দাঁড়ালো। দুবার ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে খামচে ধরলো নিজের মাথার চুল। এতেও যখন তার রাগ ঠান্ডা হলো না, সে বেরিয়ে গেলো রুম ছেড়ে। যাওয়ার আগে মেঘার দিকে আঙুল উচিয়ে বলে গেলো,
— থাক তুই, তোর এসব লেইম মরার চিন্তা নিয়ে। আমি চলে যাচ্ছি। খবরদার, আমাকে ফোন দিবি না, খুঁজবিও না।

বৃত্ত চলে গেলো। মেঘা সেখানে হাঁটু গেরে বসে গেল। কি থেকে কি হয়ে গেল, সে বুঝতেই পারলো না। এমন নয় যে, মরার কথা মেঘা এর আগে কখনো বলে নি। বলেছে সে। তবে, আজকের মত বৃত্ত এতটা রাগ দেখায় নি। আজ কি হলো তার? তবে, মেঘা জানে। বৃত্ত আসবে। রাত গভীর হলেই বৃত্ত তার কাছেই ফিরে আসবে। প্রতিদিনের মত মেঘাকে বুকে জড়িয়ে ঘুমাবে। এটাই যে মেঘবৃত্তের রোজকার নিয়ম!
________________________
ঘুমের মধ্যেই মেঘা উপলব্ধি করল, বৃত্ত তার পাশে নেই। মেঘার চোখ খুলে গেল। রুমের চারপাশ পরখ করলো। বারান্দা থেকে সিগারেটের গন্ধ নাকে আসতেই মেঘার ভ্রু কুঁচকে গেলো। ছিঃ, বৃত্ত আবার সিগারেট খাচ্ছে? একে তো আজ একটা বেদম গালি দিতেই হবে। সিগারেট খাবে আর হার্ট নষ্ট করবে। বৃত্তের কিছু হয়ে গেলে, মেঘার কি হবে? মেঘা বেশ রাগ নিয়ে বিছানা ছাড়লো।

হোটেলের বারান্দায় ডিভানে বসে আছে বৃত্ত। হাতে সিগারেট। যে বৃত্ত এককালে মেঘার জন্যে সিগারেট ছেড়ে দিয়েছিল, আজ সেই বৃত্ত ইতিমধ্যে এক প্যাকেট সিগারেট শেষ করে ফেলেছে। আজ বৃত্তের খুব কষ্ট হচ্ছে। তুফানের ন্যায় কান্নার গলার মাঝখানটায় ধুম্রজাল তৈরি করছে। সেই ধোঁয়ায় বৃত্তের নিঃশ্বাস আটকে আসছে। বৃত্তের চোখে জল জমতেই হাত দিয়ে সে জলটুকু মুছে ফেললো সে। তবে, বাহ্যিক কান্না লুকাতে পারলে কি হবে? বুকের ভিতরে এক সর্বগ্রাসী কান্না ভিতরে হৃদয়টাকে একদম এফোঁড়ওফোঁড় করে দিচ্ছে।

— বৃত্ত?
পিছন থেকে মেঘার ডাক শুনে বৃত্ত স্থির হয়ে গেলো। সিগারেটের শেষ অংশটুকু একটানে শেষ করে বাইরে ফেলে দিলো। চোখ মুছে বললো,
— ঘুম শেষ তোর?
মেঘা জবাব দিলো না। বরং, ধীরে ধীরে বৃত্তের পাশে এসে দাঁড়ালো। বৃত্তের মুখ ভেজা, চোখের কোণায় এখনো জল জমে আছে। মেঘার বুঝতে একটুও অসুবিধা হলো না, বৃত্ত কান্না করেছে। মেঘা বললো,
— কান্না করেছিলি কেনো?
বৃত্ত অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। তাড়াহুড়ো করে নিজের চোখের জল মুছে বললো,
— কোথায় কান্না করেছি? আচ্ছা। বাদ দে সেসব। মাথা ব্যথা কমেছে?
মেঘা বৃত্তের বাম হাত জড়িয়ে তার কাঁধে মাথা রাখলো। মৃদু হেসে বললো,
— হুম। আগের চেয়ে বেটার। তুই ঘুমাস নি?
— নাহ। ঘুম আসে নি।
— কেনো আসে নি?
— জানিনা।
— কি জানিস তাহলে? শুধু সিগারেট ফুঁকতে?
বৃত্ত মৃদু হাসলো। মেঘার কোমরে চিমটি কেটে বললো,
— উহু! আরো একটা জিনিস পারি। তোকে কুটকুট করে খেয়ে ফেলতে। সেটা আমি ভালোই পারি। আই থিঙ্ক ইউ নো দ্যাট। হুম?
মেঘা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। বৃত্তের পিঠে কতক ঘুষি দিয়ে বললো,
— তুই আজকাল খুব খারাপ হয়ে গেছিস। সারাক্ষণ মুখে শুধু অশ্লীল কথা। মুখ সেলাই করে দিবো একদম।
— দে তাহলে। আমি চুপ করে গেল তোর সহ্য হবে? সেদিনের কথা মনে নেই। একদিন কথা বলে নি দেখে কেঁদে কেটে তো সমুদ্র বানিয়ে দিয়েছিলি। বাপরে। তোর কান্না দেখে আমি তো পুরাই ভয় পেয়ে গেছিলাম। ভাবলাম, কে না কে মরে গেছে।

বৃত্তের কথা শুনে মেঘা হু হা করে হেসে দিলো। আর বৃত্ত নির্নিমেষ চেয়ে রইলো সেই প্রাণ খোলা হাসির দিকে। আবারো চোখ ভরে এলো তার। এত কেনো কষ্ট হচ্ছে ওর? সহ্য করতে পারছে না আর। দম বন্ধ হয়ে আসছে। কি ক্ষতি হতো, মেঘবৃত্তের সুন্দর এক সংসার হলে? কি এমন ক্ষতি হতো মেঘবৃত্তে সারাটাজনম হাতের উপর হাত রেখে কাটিয়ে দিলে? ব্রেইন টিউমারের রিপোর্টটা কি কি একবারের জন্যেও মিথ্যে প্রমাণিত হতে পারে না?

#চলবে।