মেঘবৃত্ত পর্ব-৩৪+৩৫

0
448

#মেঘবৃত্ত
#পর্ব_৩৪
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

‘প্রিয় মানুষ’ এর থেকে পাওয়া প্রথম উপহার মেঘার ছোট্ট মনটাকে ক্রমশ খুশির নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে। মেঘার বিশ্বাস হচ্ছে না। সে এখনো বৃত্তের হাতের গাজরাটার দিকে চেয়ে। মেঘা জিজ্ঞেস করলো,
— তুই সত্যিই আমার জন্যে এটা এনেছিস? আমার জন্যে?

মেঘার কণ্ঠ কাঁপছে, থরোথরো করে। বৃত্ত বুঝতে পারছে সেটা। বৃত্ত মাথা নুইয়ে ফেললো। বড্ড লজ্জা লাগছে তার। মাথা চুলকে মৃদু কণ্ঠে বললো সে,
— হুম, ভাবলাম তোর হয়তো ভালো লাগবে। ভালো না লাগলে ফেলে দিতে পারিস। আমি মাইন্ড করবো না।

শেষের বাক্যটা বলতে বৃত্তের মনে একটুখানি কষ্টবোধ হলো। তবুও, সে বললো। কারো উপর যে কিছু চাপিয়ে দিতে নেই, বোঝা মনে হয়। বৃত্ত চায়না, সে মেঘার জন্যে বোঝা হোক। বৃত্তের কথাটা শুনে মেঘার ভারী রাগ হলো। বৃত্তের হাত থেকে গাজরাটা একপ্রকার ছিনিয়ে নিলো সে। বৃত্ত প্রায় বোকা বনে গেলো তাতে। চোখ বড়বড় করে তাকালো মেঘার দিকে। মেঘা আগুন চোখে বললো,
— তুই খুব খারাপ বৃত্ত, আস্ত এক অসহ্য লোক। তোর সাথে আমার কথা বলাই উচিত না।

বৃত্তের সামনে নিজের অভিমানের পাহাড় ধ্বসিয়ে, মেঘা বিছানা ছাড়লো। গাজরাটা চুপচাপ নিজের ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে রেখে হনহন পায়ে হেঁটে বিছানায় শুয়ে পড়লো। বৃত্ত তখনো হতভম্ভ! মেঘার এমন হঠাৎ করে রেগে যাওয়া তার ঠিকঠাক বোধগম্য হচ্ছে না। সে কি কোনো ভুল করলো তবে?
_________________________
রাত বেড়েছে, রাতের সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে পরিবেশের শীতলতা। ঠাণ্ডা হাওয়া ছুঁইয়ে দিচ্ছে বৃত্তকে। ঠাণ্ডায় বৃত্ত প্রায় জমে গেলো। বৃত্তের ঘুম ছেড়ে গেলো। শীতে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে উঠে বসলো সে। চোখ গেলো, নিজের গায়ে জড়িয়ে থাকা মোটা কম্বলের দিকে। কম্বলটা দেখেই বৃত্তের ভ্রু কুঁচকে গেলো। তার যতদূর মনে আছে, সে তো একটা পাতলা কাঁথা গায়ে দিয়ে ঘুমিয়েছে। এখন সেই কাঁথাটা সোফার উপর ভাঁজ করে রাখা। কে রাখলো? নিজের গায়ের এই মোটা কম্বল কেইবা জড়ালো? বৃত্ত এখনো বিস্ময়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ে বিরাজ করছে। বৃত্তের হঠাৎ মেঘার কথা মনে পড়লো? বিছানায় তো নেই, কোথায় মেঘা?

বৃত্ত বাথরুম খুঁজলো, আশপাশ খুঁজলো! কোথায় মেঘার দেখা নেই। অবশেষে, বারান্দায় আসা মাত্রই অস্থির বৃত্ত শান্ত হলো। বারান্দার দোলনায় মেঘাকে দেখে বৃত্ত স্বস্থির শ্বাস ফেললো। পা বাড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে গিয়েও, থমকালো সে। মনে হলো, মেঘা প্রতিদিন বারান্দায় কি করে একবার পরখ করা যাক। ভাবনা অনুযায়ী, বৃত্ত দাঁড়িয়ে রইলো বারান্দার দরজার সামনে।

মেঘার হাতে সেই গাজরা। একবার খোঁপায় গাজরা লাগাচ্ছে, আরেকবার হাতে বাঁধছে বকুল ফুলের গাজরাটা। মাঝেমধ্যে, চুমু খাচ্ছে বকুল ফুলে। মেঘা গাজরাটা নিয়ে পাগলামি করছে আর খিলখিলিয়ে হাসছে। বৃত্ত প্রায় হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছে মেঘার দিকে। বৃত্তের সচেতন মস্তিষ্ক জানান দিল তাকে,
‘বৃত্ত, তোর মেঘ প্রেমে পড়েছে। তোর ন্যায় এক অগোছালো ছেলের প্রেমে পড়ে তোর মেঘ পাগল হয়ে গেছে’

বৃত্ত আর সেখানে দাঁড়ালো না। মেঘার দিকে একপল চেয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো। একহাত মাথার নিচে রেখে স্থির ফ্যানের দিকে তাকিয়ে রইলো সে। তার মাথা আপাতত কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। মেঘা তাকে ভালোবাসে, বিষয়টা তার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। একে একে মনে পড়তে লাগলো, বৃত্তের প্রতি মেঘার একেকটা কেয়ার। তার কাপড় ইস্ত্রি করে দেওয়া, সুন্দর করে সেই কাপড় তাকে সাজানো, প্রতিদিন তাকে অ্যালার্ম বাজিয়ে ঘুম থেকে তোলা, বৃত্তের প্রতিটা সুবিধা অসুবিধার খেয়াল পুঙ্খানুপঙ্খভাবে রাখা, বৃত্তের কি পছন্দ , কি অপছন্দ সবকিছুর খেয়াল রাখা। এসব কিছু কি শুধুই বন্ধুত্বের খাতিরে? নাহ, একদম না। বরং, বৃত্তের প্রতি মেঘার সীমাহীন ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ স্বরূপই এসব। বৃত্ত চোখ বুজে ফেললো। কোথাও যেন এক শান্তির স্রোত বয়ে গেলো। বুকটা বোধহয় আজ একটু বেশিই ‘পূর্ণ,পূর্ণ’ মনে হচ্ছে। কিন্তু, কেনো? কিসের এত শান্তি তার, কিসের এত পূর্ণতা?
__________________________
পরদিন, অফিস থেকে বাসায় একটু তাড়াতাড়ি ফিরলো বৃত্ত। মেঘার সাথে তার অনেক হিসাব-নিকাশ বাকি আছে।
রাতের খাবারের পর্ব শেষ হওয়ার পর, বৃত্ত রান্নাঘরে এলো। মেঘা তখন বাসন পরিষ্কার করছে। বৃত্ত মেঘার পাশে দাঁড়িয়ে গম্ভীর সুরে ডাক দিলো,
–মেঘ?
মেঘা একের পর এক বাসন ধুয়ে তাকে সাজিয়ে রাখতে রাখতে ব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
— হু, বল।
বৃত্ত মেঘার এমন বেপরোয়া আচরণ সহ্য করলো না। মেঘার হাত ধরে জোর করে ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। বৃত্তের এমন অদ্ভুত আচরনে মেঘা চোখ বড়বড় করে তাকালো বৃত্তের দিকে। বৃত্ত মেঘার চোখে চোখ রেখে ভীষন শান্ত সুরে বললো,
— তোর সাথে জরুরি কথা আছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে তোকে আমার রুমে চাই।
বাঁধ সাধলো মেঘা। তাড়াহুড়ো করে বললো,
— কেনো? দেখ, পাগলামি করিস না। তুই যা, আমি কাজ শেষ করে আসছি।

বৃত্ত কিছুক্ষণ মেঘার দিকে শান্ত চোখে চেয়ে বেশ তেজ নিয়ে বললো,
— পাঁচ মিনিট মানে পাঁচ মিনিট। এক মিনিট দেরি হলে, আমি তোর হাল বেহাল করে দিবো। সো, কাম ফার্স্ট!

হনহনিয়ে বৃত্ত চলে গেলো। মেঘা তখনো বিস্ময় নিয়ে দরজার দিকে চেয়ে। আজ এই বৃত্তের হলোটা কি? এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেনো সে?
______________________

বৃত্ত আর মেঘা সামনাসামনি বসে আছে। বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা কাটিয়ে কথা বললো বৃত্ত। তার কথার শুরুটা ছিল খানিক এমন,
— তুই কি আমায় ভালোবাসিস, মেঘ? আমার মনে হয় তুই আমার প্রতি দূর্বল? আমি কি ঠিক বলছি, মেঘ?

#চলবে

#মেঘবৃত্ত
#পর্ব_৩৫ ( ধামাকা ১)
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

বৃত্ত আর মেঘা সামনাসামনি বসে আছে। বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা কাটিয়ে কথা বললো বৃত্ত। তার কথার শুরুটা ছিল খানিক এমন,
— তুই কি আমায় ভালোবাসিস, মেঘ? আমার মনে হয় তুই আমার প্রতি দূর্বল? আমি কি ঠিক বলছি, মেঘ?

বৃত্তের মুখে এহেন সত্য কথা শুনে মেঘা একদফা চমকালো। বৃত্ত জেনে গেছে? তবে, মেঘা নিজেকে সামলালো। অজান্তেই ভিজে যাওয়া দু নয়ন মুছে নিয়ে ধরা কণ্ঠে বললো,
— হ্যাঁ, ভালোবাসি তোকে আমি। একে যদি তুই আমার দোষ বলে আখ্যায়িত করতে চাস, তবে তাই ঠিক। আমি জানিনা কবে, কখন আমাদের বন্ধুত্বের মাঝখানে এই ভালোবাসাটা দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি শুধু জানি, আমি তোকে ভালোবেসেছি। সব সীমা-পরিসীমা অতিক্রম করে নিজের মনকে তোর নামে দলিল করে দিয়েছি। আমি কিছু জানিনা, শুধু জানি আমি তোকে ভালোবেসেছি। শুধু একটুখানি ভালোবেসেছি!

মেঘা কথাটা বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। বৃত্ত তখনো নির্বিকার! তার দৃষ্টি স্থির, মৃত সমুদ্রের ন্যায় শান্ত! যেনো সে জানতো এমন কিছুই হবে! মেঘার উত্তর এমন হবেই! কান্নারত মেঘা দুচোখ মুছলো! চোখের পানিতে তার চিবুক ভিজলো, ভিজলো তার কণ্ঠদেশ! বৃত্ত গম্ভীর সুরে বললো,
— আমি যদি তোকে ভালো না বাসি, তুই কি করবি তখন? আমায় ছেড়ে চলে যাবি?

মেঘা কাঁপলো খানিক। চট করে মাথা তুলে বৃত্তের চোখের পানে তাকালো। বৃত্ত আবারও বললো,
— বল, কি করবি? ছেড়ে যাবি আমাকে?

মেঘা নিজের রাগ আর সংযত করতে পারলো না। রাগে আগুন হয়ে বৃত্তের কলার খামচে ধরে তার চোখের দিকে চেয়ে বললো,
— ডাফার, তোকে ভালোবেসেছি আমি। স্বার্থপর নই আমি। নিজের প্রাণকে একা ছেড়ে যাওয়ার মত মন যেনো আমার কখনো না হয়! আমি সত্যিই মরে যাবো তাহলে! তুই বিহীন আমি অন্ধকার, বৃত্ত। সত্যিই অন্ধকার!

মেঘা কান্না করতে করতে একসময় বৃত্তের কাঁধে মাথা হেলালো। বৃত্তের শার্টের কলার এখনো তার হাতের মুঠোয় মুচড়ে ধরে রাখা। বৃত্ত তখনো নির্বিকার! সে কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। এমন পরিস্থিতির বৃত্ত জীবনেও একবারও পরে নি। একদিকে একটা বন্ধুত্ব অপরদিকে মেঘার ভালোবাসা। কোনটা গ্রহন করবে সে?
হঠাৎ করে কি মনে করে বৃত্ত বলে উঠলো,
— আর আমি যদি তোকে ভালোবাসি, তখন?

মেঘা কান্না চট করে থেমে গেলো। বৃত্তের কাঁধের থেকে মুখ তুলে তাকালো তার ঠিক চোখের দিকে। বৃত্ত তখনো মেঘার দিকে চেয়ে। মেঘা হাসলো একটু। কান্নামাখা মুখশ্রীতে হাসিটা যেন সদ্য ফোঁটা গোলাপের ন্যায় দেখালো। মেঘা বললো,
— আমি সুখে মরেই যাবো সেদিন।
___________________________
গত দুদিন ধরে বৃত্ত একদম চুপচাপ হয়ে গেছে। সর্বক্ষণ মাথার মধ্যে ঘুরছে, মেঘার একেকটা কথা, একেকটা আচরণ! বৃত্ত নিজেকে সময় দিচ্ছে তার অনুভুতিগুলো গোছানোর! হয়তো, সে একটুখানি সফল হয়েছে বটে। বৃত্তের এমন নীরবতার কারণ মেঘার বেশ বুঝতে পারছে। ভয় হচ্ছে তার, তার এমন অনুভূতি জানার পর বৃত্ত যদি তার সাথে আর কখনো সহজ হতে না পারে? তখন? মেঘা তো মরেই যাব। এই দুনিয়ার সব সহ্য করতে পারবে সে, শুধু বৃত্তের অবহেলা সহ্য করার ক্ষমতা তার নেই। কিন্তু, মেঘা আগবাড়িয়ে বৃত্তের সাথে একরত্তিও কথা বলেনি। থাকুক না, সে তার মত। মেঘা নাহয় আড়ালে আবডালে তাকে ভালোবেসে যাবে। ‘একপাক্ষিক ভালোবাসার ন্যায় বিশ্রী সুখ এই পৃথিবীতে দুটো নেই’

আজ রবিবার। হুমায়ূন আহমেদের ‘ আজ রবিবার’ বলে এক নাটক আছে। আপাতত টিভিতে সেই নাটকটাই সম্প্রচারিত হচ্ছে। বৃত্তের মা হুমায়ূন আহমেদের বিশাল ভক্ত বলা যায়। হুমায়ূন আহমেদের লেখা সবগুলো বই দিয়ে উনার বুকশেলফ ঠাসা, ঠাসা। হুমায়ূন আহমেদের নাটকও উনি প্রায় শ বার দেখে ফেলেছেন। তবুও যেনো তার তৃষ্ণা মেটে না। আজও বসেছেন টিভির সামনে। ‘ আজ রবিয়ার ‘ নাটকটা দেখার জন্যে। জোরপূর্বক মেঘাকে পাশে বসিয়েছেন। মেঘা টিভির সামনে বসেছে ঠিকই, তবে মনে মনে সে অস্থির, অবিন্যস্ত! আজ প্রায় চারদিন, বৃত্ত মেঘার থেকে দূরে দূরে থাকে। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি একটা কথাও বলে না। মেঘার এসব দেখে ভীষণ কান্না পায়। তবুও, মুখ আটকে বসে থাকে সে। আজও এমন হচ্ছে। মনে হচ্ছে, চিৎকার করে কান্না করতে। এই দুনিয়াকে জানিয়ে দিতে, ‘শোনো হে পৃথ্বী, ভালবাসার ন্যায় বিষাক্ত তলোয়ার আমার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। আমি মরে যাচ্ছি, ভেঙে যাচ্ছি। ‘সে’ কেনো আমার সাথে কথা বলে না? ‘

হঠাৎ মেঘার ফোন বেজে উঠলো। মেঘা একপ্রকার চমকে উঠলো তাতে। চটজলদি পাশ থেকে মোবাইল হাতে নিয়ে রিসিভ করলো সে। ওপাশ থেকে এক ভরাট কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো,
— মেঘ, একটু আমার কাছে আসবি? একটুখানি দেখতে চাই তোকে। চক্ষের তৃষ্ণা যে মেটে না আমার। তুই মেটাবি, একটুখানি জল হয়ে নামবি আমার চোখে?

সুখে মেঘার চোখে জল নেমে এলো। সত্যিই কি সে দিন এসেছে? যার অপেক্ষায় মেঘা এতটা মাস ধরে জ্বলছে, ভাঙছে, গড়ছে! মেঘা হুট করে কেঁদে ফেললো। ভাঙ্গা গলায় বললো,
— আ-আমি আসছি। এক্ষুনি আসছি আমি।

#চলবে।