#মেঘবৃত্ত
#পর্ব_৪০
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
রাত নেমেছে শহর জুড়ে। বৃত্ত রুমে দাঁড়িয়ে মোবাইলে কার সাথে কথা বলছিলো যেনো। মেঘা গোসল করছে বাথরুমে। মেঘার এই একটা অভ্যাস! বাইরে থেকে আসার পর তার গোসল করা আবশ্যক। নাহলে নাকি তার শরীর খচখচ করে। একটু পর বাথরুমের দরজা খোলার শব্দ হলো। বৃত্ত ফোন কানে রেখেই পিছন ফিরলো। চোখের সামনে জলে ভেজা, স্নিগ্ধ এক মেঘকে আবিষ্কার করতে পেরেই তার বুকটা ধ্বক করে উঠলো। মেঘার মাথায় সাধারণ এক গামছা পেঁচানো, দু একটা ছোট চুল কপালে পড়ে আছে, পরনে পাতলা শাড়ি; যার বেশিরভাগ অংশই ভিজে আছে। ব্লাউজ এর হাতাটাও একটুখানি ভেজা। মেঘার এই নতুন আবেদনময়ী রূপ দেখে বৃত্তের মন তোলপাড় হয়ে গেলো। এই প্রথম বৃত্তের মনে মেঘার জন্যে বন্ধুত্বের বাইরে এক স্পেশাল কিছু অনুভব হচ্ছে।
মেঘা বৃত্তের দিকে একপল চেয়ে বললো,
— ঘুমাস নি এখনো? এত কিসের ফোনে কথা বলিস? রাত কটা বাজে খেয়াল আছে?
কথাটা বলতে বলতে মেঘা চুলের থেকে গামছা খুলে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো। পিঠের থেকে সব চুল কাঁধের একপাশে এনে গামছা দিয়ে চুল ঝাড়তে লাগলো। বৃত্তের এবার গলা শুকিয়ে এলো। মেঘার ব্লাউজের পিঠটা ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। বৃত্তের মনে এবার কাঁপন ধরলো। এ কি করছে মেঘ? তাকে কেনো এমন করে উলোট পালোট করে দিচ্ছে মেঘ? এবার বৃত্ত কি করে নিজেকে সামলাবে? বৃত্তের একবার মনে হলো, মেঘাকে বলবে; শাড়িটা পাল্টে নিতে। কিন্তু, তার কন্ঠনালী আজ যেনো হরতাল ডেকেছে। কথা অব্দি বলতে পারছে না সে। চোখটাও মেঘার দিকে তীরের ন্যায় আটকে আছে। উফ, কি অসহ্য এক অনুভূতি! বৃত্ত আর একমুহুর্ত রুমে থাকলো না। ফোন কেটে দিয়ে হনহনিয়ে বারান্দায় চলে গেলো। আর একটু সময় এ ঘরে থাকলে, একটা দুটো অঘটন ঘটে যাবে। হয়তো সেই অঘটন মেঘার খুব একটা ভালো লাগবে না, বৈ খারাপ লাগবে। বৃত্ত নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো। সে এটা ভেবেই আশ্চর্য্য হচ্ছে, আজ তার হলোটা কি? মেঘাকে নিয়ে তার এমন অনুভূতি কেনো হচ্ছে? কই, আগে তো কখনো এমন হয়নি। উফ, বৃত্তের মাথা ধরে যাচ্ছে। বৃত্ত মনেমনে কয়েকবার ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ জপ করলো। এতে যদি কিছুটা রক্ষা হয়?
মেঘা হাতে পায়ে লোশন দিয়ে চুলটা আঁচড়ে নিলো। হাতের ভেজা গামছাটা বারান্দায় মেলে দিতে যেয়ে বৃত্তকে দেখলো। বৃত্ত গ্রিল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে এক জ্বলন্ত সিগারেট। মেঘা অবাক হলো খানিক। বৃত্ত কি কোনো কারণে চিন্তিত আছে? মেঘা গামছাটা দড়িতে মেলে দিয়ে বৃত্তের কাছে এসে দাঁড়ালো। নিজের পাশে মেঘার অস্তিত্ব পেয়ে বৃত্তের ভেতরকার ছটফটানি যেনো দ্বিগুণ হারে বেড়ে গেলো। সে মুখ ফিরিয়ে নিল। ঘনঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
— জলদি ঘুমিয়ে পড়, মেঘ। রাত অনেক হয়েছে।
মেঘার বিস্ময় এবার শীর্ষে পৌঁছালো। মেঘবৃত্ত যেদিন থেকে এক হয়েছে, সেদিন থেকে মেঘা বৃত্তের বুকে মাথা গুঁজে ঘুমায়। বৃত্তের যতই ব্যস্ততা থাকুক, বৃত্ত সবসময় ঘুমানোর সময় মেঘাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে। তবে, আজ কি হলো? বৃত্ত কি মেঘার উপর রেগে আছে কোনো কারণে? মেঘার বুকটা ধ্বক করে উঠলো। চোখে জল জমলো একটুখানি। মেঘা বৃত্তের কাঁধে হাত রাখলো। ধরা গলায় বললো,
— আমি কি কিছু করেছি, বৃত্ত? তোকে কি কোনো কারণে আমি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি? তুই আমার সাথে এমন করে কথা বলছিস কেনো? এই, বৃত্ত?
মেঘার কণ্ঠে স্পষ্ট কিছু কান্না! বৃত্তের এবার খুব অসহায় বোধ হলো। কি করবে, ভেবে পেল না সে। হাতের সিগারেট বারান্দা দিয়ে ফেলে মেঘার দিকে ফিরল সে। কোনরকম ভনিতা ছাড়া কাটছাঁট কণ্ঠে বললো,
— দেখ, মেঘ! আজ তোকে নিয়ে আমার মনে এক্সট্রা কিছু ফিল হচ্ছে। আমি এই ফিলিংস গুলোকে প্রশ্রয় দিতে চাইছি না। এই মুহূর্তে আমার পাশে থাকা মানে, তোরই বিপদ। আমি চাইনি, আমার দ্বারা আবার কোনো ভুল হোক। তুই কষ্ট পেলে, আমি ভেতরে ভেতরে ছারখার হয়ে যাবো রে মেঘ। তাই, তোর এখন ঘুমানো উচিৎ। তুই ঘুমিয়ে পড়লেই আমি ঘরে আসবো। চিন্তা নেই, তোকে জড়িয়ে ধরেই ঘুমাবো আমি। এখন, যা তুই। জাস্ট গো!
মেঘা রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে বৃত্তের দিকে চেয়ে রইলো। বৃত্তের কথার অর্থ বুঝতে বেশ বেগ পেতে হলো তার। বৃত্তের অযথা অপরাধবোধ তার নিজের ভেতরে স্বস্থির বীজ বোপন করলো। মেঘাকে এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, বৃত্ত ভ্রু কুঁচকালো। বৃত্ত আরো দু একটা কথা বলবে, তার আগেই মেঘা বৃত্তের বাহু দুহাতে আকড়ে ধরলো। বৃত্ত হতবম্ব হয়ে গেলো। মেঘা বৃত্তের চোখে চোখ রাখলো। তুলোর চেয়েও নরম কণ্ঠে সুধালো,
— তুই আমার বর, বৃত্ত। স্ত্রীর কাছে আসা, কোনো গোনাহের কাজ না। বরং, তা পবিত্র। তোর আমার সম্পর্কের মত আমাদের কাছে আসা’টাও পবিত্র। এতে কিসের এত জড়তা?
বৃত্ত মেঘার কথা শুনে মুচকি হেসে ফেললো। সে মেঘার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো,
— আমি তোকে ছুঁলে, তোর খারাপ লাগবে না?
মেঘা লজ্জা পেয়ে গেল। তবুও সকল লজ্জার বাঁধন ছিন্নভিন্ন করে মিহি কণ্ঠে বললো,
— তোর ছোঁয়ায়, আমার সব সুখ বৃত্ত। এই সুখে আমি মরে যেতেও রাজি।
বৃত্ত একটুখানি হাসলো। এতক্ষণ লজ্জা না লাগলেও, এবার মেঘার লজ্জায় মরে যেতে লাগলো। ইশ, এতসব কথা সে কি করে বলে ফেললো। মেঘা লজ্জায় বৃত্তের কাঁধে মুখ লুকালো। বৃত্ত মেঘার এমন কাজে হেসে ফেললো। মেঘাকে আরো একটু লজ্জা দিতে বললো,
— এখন লজ্জা পাচ্ছিস কেন? এখন তো তোর সব লজ্জা ভাঙার সময়।
ইশ, মেঘার তো একদম অদৃশ্য হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। আবার নিজের সবটুকু তুলে দিতে ইচ্ছে করছে, নিজের ‘প্রিয়’র হাতে। মেঘা বৃত্তের কাঁধে চাপর দিলো। মৃদু কন্ঠে বলল,
— তুই অনেক অসভ্য হয়ে গেছিস, বৃত্ত। মাইর খাবি আমার হাতে।
#চলবে
#মেঘবৃত্ত
#পর্ব_৪১
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
জড়তার সুতো কেটে গেলো। পবিত্রতা ঘিরে ধরলো পৃথিবীর এই মেঘবৃত্তকে। আকাশ ঢেকে গেলো মেঘের স্তরে। মেঘ নিংড়ে নামলো অজস্র বৃত্ত। সম্পূর্ণ ধরণী যেনো একজোট হয়েছে, পৃথিবীর এক মেঘবৃত্তকে এক করার জন্যে। বৃত্ত মেঘাকে কোলে তুলে নিল। মেঘা নখের ধারালো আঘাতে খামচে ধরলো, বৃত্তের টিশার্টের কলার। বৃত্ত চেয়ে রইলো মেঘার মুখের পানে। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো ঘরের দিকে।
মেঘাকে বিছানায় শুইয়ে দিতেই, মেঘা লজ্জায় ওপাশ ফিরে গেলো। বৃত্ত মুচকি হাসলো। মেঘার কাঁধ থেকে শাড়ির আঁচল সরিয়ে মুখ ডুবালো, মেঘার ঘাড়ে। মেঘা শিউরে উঠলো। লোমে লোমে কাঁপন ধরলো তার। শরীর শিরশির করে উঠলো। বৃত্ত মেঘার ঘাড়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চুমু খেয়ে ফিসফিসিয়ে ডাক দিল,
— মেঘ?
মেঘা তখন দু চোখ বুজে। বৃত্তের কথা কানে যেতেই সে সম্বিত ফিরে পেলো। তবে, চোখ খুললো না। বুজে রাখা চোখেই জবাব দিলো,
— হু?
বৃত্ত মিহি কণ্ঠে বললো,
— তুই কি আমার মেঘ হবি? পূর্ণ করবি আমাদের? হবি কি সম্পূর্ণ ভাবে আমার? তোর অনুমতি ছাড়া তোকে ছুঁবো না আমি, প্রমিজ।
মেঘা কাঁপলো খানিক। বৃত্ত মেঘার দিকে চেয়ে আছে, বুকভরা আশা নিয়ে। মেঘা ঘুরে গেলো। বৃত্তের কলার ধরলো শক্ত করে। বৃত্ত তখনো স্বাভাবিক। মেঘা বৃত্তের মাথাটা তার দিকে নিচু করলো। আলতো করে বৃত্তের গালে নিজের ওষ্ঠ ছুঁইয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
— পেয়ে গেছিস অনুমতি?
ঠোঁট টিপে হেসে উঠলো বৃত্ত। অতঃপর, বাতি নিভে গেলো। পর্দা সরে গেলো। মেঘবৃত্তকে জড়িয়ে ধরলো, এক মুঠো পূর্ণতার রশ্মি! ইশ, আজ চাঁদও এই পূর্ণতায় মুখ লুকালো মেঘেদের আড়ালে। আজ বৃত্ত আর মেঘ মিলেমিশে সত্যিকার অর্থে ‘মেঘবৃত্ত’-এ পরিণত হলো।
_____________________________
কটা দিন পরের কথা। কাজ শেষ হওয়ায়, বৃত্ত আজ একটু জলদিই বাসায় ফিরেছে। মেঘা তখন শাশুড়ির সাথে বসে গল্প করছিল। আজকাল, বৃত্তের মা মেঘার প্রতি খানিক নরম হয়ে এসেছেন। মেঘার প্রতি জন্মানো তার অযথা ক্ষোভ এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়। বিষয়টা মেঘাকে বেশ স্বস্থি দিচ্ছে। দরজায় কলিং বেল বাজতেই মেঘা একপ্রকার ছুঁটে গেলো দরজা খুলতে। বৃত্ত এসেছে, জানে মেঘা। বৃত্ত আসার আগে ফোন করে জানিয়েছে। মেঘা দরজা খুলতেই বৃত্তের ক্লান্ত দেহ নজরে পড়লো তার। বৃত্তের কপালে ঘাম, শার্টটাও ঘামে ভিজে শরীরের সাথে একদম মিশে গেছে। বৃত্তের এরূপ পরিশ্রম দেখে মেঘার মনে কষ্ট উদয় হলো। মেঘা বৃত্তের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নিল। ব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
— সোফায় বস। আমি লেবু পানি আনছি।
বৃত্ত ক্লান্ত হেসে ভেতরে এসে বসলো। মেঘা ড্রইং রুমের ফ্যানটা বাড়িয়ে দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো। খানিক পর হাতে ঠান্ডা পানির শরবত বৃত্তের সামনে ধরলো। বৃত্ত শরবত খেতে খেতে প্রশ্ন করলো,
— মা রাতের খাবার খেয়েছে?
— হুম।
— আর তুই?
মেঘা উত্তর দিলো না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো বৃত্তের পাশে। বৃত্ত বুঝে গেলো, প্রতিদিনকার মত মেঘা আজও খায় নি। বৃত্তের অপেক্ষায় এতক্ষণ বসে ছিলো। বৃত্ত শার্টের টাই ঢিলে করে বললো,
— অযথা অপেক্ষা না করে, খেয়ে নিলেই পারতি। কি লাভ হয় এভাবে প্রতিদিন আমার জন্যে অপেক্ষা করে বসে থাকতে। সেদিন দেখলি না, মাথা ব্যথা উঠে যাচ্ছেতাই অবস্থা হয়ে গেছিলো। তাও, শুধরাস না তুই।
বৃত্ত নিজের মতোই বকতে লাগলো মেঘাকে। মেঘা চুপটি করে বসে রইলো। একসময় বৃত্ত থামলো। হতাশ চোখে মেঘার দিকে তাকালো সে। সে জানে, এই যে মেঘাকে এত এত বকা দিল সে! এসব মেঘার কোনো কাজেই আসবে না। মেঘা একই ভুল আবার করবে। তারপর, মাথা ব্যথায় চিৎকার করে কান্না করবে। এ আর নতুন কি? বৃত্তকে থামতে দেখে মেঘা মুখ খুললো। মিনমিনিয়ে বললো,
— বকিস কেনো? আমার তোর জন্যে অপেক্ষা করতে ভালো লাগে। তাই করি। আরে, কিছু হবে না আমার। চিন্তা করিস না তো। এখন যা, ফ্রেস হয়ে আয়। ভাত বাড়ছি আমি।
বৃত্ত হতাশ নিঃশ্বাস ফেললো। মেঘার দিকে তীক্ষ্ম এক চাওনি
নিক্ষেপ করে মায়ের সাথে দেখা করতে চলে গেলো।
__________________________
কদিন ধরেই মেঘার শরীর ভালো যাচ্ছে না। হুটহাট বমি, মাথা ঘোরানো এসব যেনো মেঘার পিছই ছাড়ছে না। শরীরটাও সারাক্ষণ যেনো ম্যাজম্যাজ করতে থাকে। মেঘার যা সন্দেহ হচ্ছে, তা যদি সঠিক হয়? ইশ, মেঘা তো খুশির চোটে পাগলই হয়ে যাবে।
রাতে ঘুমানোর সময়, মেঘা বৃত্তের বুকে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে। বৃত্ত ধীরে হাতে মেঘার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। আজকাল বৃত্তের চিন্তার শেষ নেই। কদিন হলো, মেঘার মাথা ব্যথা বেশ বেড়েছে। সারাদিন ব্যথা করলেই, মেঘা তা কাউকে বলে না। কিন্তু, রাত হলে আর সহ্য হয়না এই মাথা ব্যথা। শুধু মাথা দুহাতে খামচে ধরে, কাঁদতে থাকে। বৃত্ত অনেকবার মাথার টেস্ট করিয়েছে। কিন্তু, লাভ হয়নি। কেউ রোগ ধরতে পারছে না। এ নিয়ে বৃত্তের রাতের ঘুম প্রায় হারাম হয়ে গেছে।
— বৃত্ত?
মেঘার ডাকে বৃত্তের ধ্যান ভঙ্গ হলো। সে বেখেয়ালিতে জবাব দিলো,
— হু?
মেঘা বৃত্তের বুকের আরো গভীরে মাথা গুজলো। বৃত্তও সুন্দর করে আগলে নিল তাকে। মেঘা মিনমিনিয়ে বললো,
— বৃত্ত, আই থিঙ্ক আই অ্যাম প্রেগন্যান্ট।
বৃত্তের হাত থেমে গেলো। চুলে বিলি কাটা বন্ধ হয়ে গেলো। এ কি বললো মেঘা? তার কান ধপধপ করছে। সে কি ঠিক শুনলো?
#চলবে।