মেঘভেজা দুপুরের নিমন্ত্রণে ফিরে এসো পর্ব-১০

0
206

#মেঘভেজা_দুপুরের_নিমন্ত্রণে_ফিরে_এসো
#পর্ব-১০

“তোমাদের খুব বিপদে ফেলে দিলাম, তাই না?”
আমি আর রঙ্গন বসে আছি ওনার সামনে। জ্ঞান ফেরার পর ওনাকে কিছুতেই হাসপাতালে রাখা যায়নি। জোর করে বাসায় ফিরে এসেছে কাল। আমি কিংবা রঙ্গন আমরা দু’জনেই ভীষণ ব্যস্ত মানুষ। সারাদিন রোগী, হাসপাতাল নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। তাই দু’জনই চাইছিলাম ওনাকে হাসপাতালে রেখে দিতে। কিন্তু উনিই রাজি হলেন না। বাধ্য হয়ে বাসায় আনতে হয়েছে। মোমেনা খালা তিতুনকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে বলে বাসায় একজন সার্বক্ষনিক নার্সের ব্যবস্থা করে দিয়েছে রঙ্গন। আমরা কাজের ফাঁকে ফাঁকে ওনার খোঁজ রাখছি। বিকেলে চেম্বার করার আগে দু’জনই বাসায় এসেছি। উপলক্ষ দুটো। এক ওনাকে দেখা আর দুই দুপুরের লাঞ্চ।

ওনার প্রশ্ন শুনে আমি রঙ্গনের দিকে তাকালাম। রঙ্গন প্রসঙ্গ পাল্টে জানতে চাইলো-“কতদিন ধরে এই রোগ টানছো খালা?”
উনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো-“অনেকদিন হয়েছে। সিঙ্গাপুর গিয়ে ট্রিটমেন্ট করিয়েছিলাম। ভালোও হয়ে গেছিলাম। ছয়মাস আগে হুট করে আবার শরীর খারাপ লাগায় টেস্ট করালে দেখলাম রোগ আবার ফিরে এসেছে।”
রঙ্গন জানতে চাইলো-“সোমা আর স্বাতী ফোন দেয় না তোমাকে? এখানে এসেছ বেশ ক’দিন, ওরা একবারও ফোন দেয়নি তোমাকে। কেন?”
উনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলেন-“সারোয়ারের নিঁখোজ হওয়ার জন্য নাকি আমি দায়ী। তাই ওরা আমার সাথে সম্পর্ক ছেদ করেছে। দুই বোনই অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে। আমার খোঁজ রাখে না ওরা।”
রঙ্গন কেন যেন অবাক হলো না। শান্ত চোখে তাকিয়ে ওনাকে দেখছে। উনি চোখ মুছলেন-“আচ্ছা বলতো কোন মা কি চাইবে নিজের একমাত্র ছেলে হারিয়ে যাক? ওরা কেন এমন বলে বলতো? তুই তো জানিস রঙ্গন, সারোয়ারকে কি পরিমাণ আগলে রাখতাম আমি। আমি কেন চাইবো ছেলে হারিয়ে যাক?”
রঙ্গন দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো-“তোমার অসুখের কথা ওরা জানে?”
উনি ঠোঁট উল্টে বললেন-“জানবে না কেন? খুব জানে।”
রঙ্গন এবার চুপ করে গেলো। উনি স্বগতোক্তি করলেন যেন-“কতদিন বেঁচে আছি জানি না। শুধু চেয়েছিলাম সারোয়ারকে সুখী দেখতে। কিন্তু সেটা বুঝি আমার কপালে নেই। ছেলেকেই হারিয়ে ফেললাম।”
বলতে বলতে আবারও কেঁদে দিলেন উনি-“দুপুরের খোঁজ পেয়ে তাই খুশি হয়েছিলাম। পরে যখন তিতুনকে দেখলাম খুশি তিনগুণ হলো। ছেলে নেই তো কি হয়েছে ছেলের বউ বাচ্চা তো আছে। কিছু না ভেবে তাই চলে এসেছিলাম এখানে।”
রঙ্গন ম্লান গলায় জবাব দিলো-“কিন্তু তোমার এভাবে বাসায় থাকা তো ঠিক হচ্ছে না খালা। হাসপাতালে থেকে ট্রিটমেন্ট করাতে হবে। না হলে ক’দিন পরে ভীষণ কষ্টে পড়বে।”
“অনেক কষ্ট সয়েছি রঙ্গন, কেমোথেরাপি আর রেডিওথেরাপির যন্ত্রণায় জীবন জেরবার। এখন আমি তিতুনের কাছাকাছি থাকতে চাই কেবল। ও আমার সারোয়ারের ছায়া, যে ক’দিন আছি এ পৃথিবীতে ওর কাছেই আমি ভালো থাকবো।”
“যেমন তোমার ইচ্ছে। তবুও বলবো আবেগপ্রবণ না হয়ে বাস্তবতা ভাবলে ভালো। তোমার জন্য বলছি। না হলে..
“দিদা, তুমি কি করছো? দেখো আমি ঘুম থেকে উঠে গেছি?”
তিতুন এসে ঘরে ঢুকলো। মোমেনা খালা বিব্রত হয়ে তিতুনের পিছু পিছু আসলো-“খালা, ওকে অনেক মানা করছি শুনে না।”
আমি মোমেনা খালাকে হাত নেড়ে আশ্বস্ত করি। রঙ্গন আর আমাকে দেখে তিতুন থমকাল। অবাক হয়ে বললো-“তাত্তু মাম্মা, তোমরা কি আবার দিদুনকে বকতো? দিদুন আবার হাসপাতালে যাবে? আমি কিন্তু তাহলে অনেক কান্না করবো।”
তিতুনের কথায় ওনার মুখে পরিতৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো। রঙ্গন আমায় তাকিয়ে দেখে তিতুনকে কাছে টানে-“দিদুনের শরীর খারাপ তাই চাচ্চু আর মা দিদুনকে দেখছে। মা আর চাচ্চু ডাক্তার না? দিদুন রোগী, চাচ্চু রোগী দেখছে সোনা।”
তিতুন রঙ্গনের গালে চুমো দিলো-“তুমি খুব ভালো তাত্তু। আমার দিদুনকে ঠিক করে দাও। আমি দিদুনের সাথে অনেক খেলা করবো।”
“ঠিক আছে মামনী। আমি দিদুনকে ওষুধ দিয়েছি। দিদুন ভালো হয়ে যাবে। তুমি খেলো দিদুনের সাথে। আমরা হাসপাতালে যাই।”
“টাটা মাম্মা, টাটা চাচ্চু।”
আমি আর রঙ্গন উঠে দাঁড়াই। গাড়িতে যেতে যেতে রঙ্গনকে বললাম-“তুই কি একটু খোঁজ করবি?”
রঙ্গন অন্যমনস্ক হয়ে জবাব দিলো-“কিসের খোঁজ?”
“সবকিছুর। সারোয়ার, সোমা, স্বাতী সবার।”
রঙ্গন হঠাৎ আমার দিকে ফিরে বললো-“দুপুর, তুই তোর বাড়ির লোকের সাথে যোগাযোগ করছিস না কেন?”
আমি চমকে উঠে বলি-“এমন কথা কেন বলছিস রঙ্গন? তুই জানিস কেন যোগাযোগ করছি না। বিয়ের পর থেকে আমি পরিবার থেকে মোটামুটি ডিটাচ।”
“আমার কেন যেন মনেহচ্ছে তোর ঢাকায় ফিরতে হবে।”
“এ কথা মনে হওয়ার কারন?”
অবাক আমাকে আরও অবাক করে বললো-“জানি না। আমার ইনট্যুইশন বলছে তোকে যেতে হবে।”
আমার মন খারাপ হলো। পুরনো স্মৃতিতে ফেরার কোন ইচ্ছে আমার নেই। এখানে ঢের ভালো আছি আমি। তবে ইদানীং সারোয়ারকে মনে পড়ছে বেশি। মনটা খচখচ করে, দেখতে ইচ্ছে করে সারোয়ারকে। ওর খোঁজ পেতে মনচায়। ছেলেটা কি অবস্থায় আছে বড্ড জানার ইচ্ছে হয়।

উনি ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছেন। রঙ্গন বললো, কতদিন সুস্থ থাকবে তা বলতে পারছি না। কারণ দ্বিতীয়বার একই রোগ ফিরলে দ্বিগুন শক্তি নিয়ে ফেরে। আপাতত ওষুধ দিয়ে যতদিন ঠেকানো যায়। তবে মনেহচ্ছে দ্রুত কেমো শুরু করতে হবে। আমি চেষ্টা করছি ওনার খেয়াল রাখার। তবে খুব একটা সফল হচ্ছি বলবো না। আমার ব্যস্ততার কথা অস্বীকার করা যায় না। তবুও ওনাকে সময় দিচ্ছি, টুকটাক কথা বলছি। উনার মনের জোর সাংঘাতিক। সেদিন মোমেনা খালা ফোন করে বললো, উনি আবার তিতুনকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছে। বাসায় নাকি তার দমবন্ধ লাগে। আমি বললাম, ভেব না চলে আসবে।

আজকাল তিতুন খুব খুশি থাকে। আগে আমি বাড়ি ফিরলে তিতুন আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তো, আমার সাথে দুনিয়ায় কথা বলতো। এখন দেখি নিজের মতো খেলে। আমি রাতে শোয়ার সময় গাল ফুলিয়ে বলি-“তিতুন আমাকে ভুলে গেছে। ভালোই বাসে না মাম্মাকে।”
তিতুন ছুটে এসে আদর দেয় আমাকে-“তিতুন মাম্মাকে অনেক ভালোবাসে। সাথে বাবাকেও ভালোবাসে।”
আমি হেসে দিলাম-“বাবাকে পেলে কোথায় তিতুন?”
“ওই যে মার্কেটে এসেছিল। আমার সাথে অনেক খেলা করলো তো।”
আমি চমকে উঠি। অজানা আশঙ্কায় মনটা টলে উঠলো। জানতে চাইলাম-“কবে তিতুন? তুমি মাম্মাকে বললে নাতো? একাই বাবার সাথে খেললে?”
“সরি মাম্মা। কিন্তু বাবা যে মানা করলো তোমাকে বলতে? তুমি জানলে তো আর খেলতে দেবে না বাবার সাথে।”
আমি ভ্রু কুঁচকে তিতুনের সাথে গল্প ফাঁদি-“তাই? তোমাকে কে নিয়ে গেছে বাবার কাছে?”
“দিদুন। জানো বাবা আর দিদুন অনেক কান্না করেছ আমাকে জড়িয়ে ধরে?”
আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে প্রশ্ম করি-“কেন কান্না করেছে?”
তিতুন সোৎসাহে জবাব দিলো-“বাবা পঁচা কাজ করেছে যে, এইজন্য। দাদী অনেক বকেছে বাবাকে।”
আমি বিস্মিত হয়ে বলি-“তুমি বাবাকে চিনলে কেমন করে তিতুন? বাবাকে তো আগে দেখনি কোনদিন?”
তিতুন খেলতে খেলতে অন্যমনস্ক হয়ে গেলো। আমি কয়েকবার জানতে চাইলাম কিন্তু ও জবাব দিলো না। শরীর কাঁপছে রীতিমতো। কি হচ্ছে এসব? সারোয়ার কি এখানে এসেছে? কিভাবে সম্ভব? তাহলে কি এতোদিনের সব ব্যাপার নাটক ছিলো? তিতুন ছোট মানুষ। ছোটরা সহজে মিথ্যে বলে না। তাছাড়া যাকে কোনদিন দেখেনি তাকে নিয়ে গল্প বানানো অসম্ভব। মনে দ্বিধা। বিশ্বাস হচ্ছে না আবার অবিশ্বাস ও করতে পারছি না। তিতুনের কথা সত্য হলে নিখোঁজ রহস্য কেন করলো? মনটা অস্থির হয়ে গেলো। রঙ্গনকে ফোন করতে গিয়েও থেমে গেলাম। মনে হলো সত্যটা আগে জানতে হবে আমার। তারপর রঙ্গনকে জানাব। ভাবছি, একজন অসুস্থ মানুষ কি করে এরকম কুটবুদ্ধি করতে পারে? এই নাটক করেই বা কি লাব হবে ওনার? ভেতর ভেতর উত্তেজিত হয়ে উঠছি। নিজেকে কেমন যেন ‘মোহরা’ মনেহচ্ছে। ভাবছি আর মাথা নাড়ছি। এরা মা ছেলে মিলে কি করতে চাইছে সেটা বুঝতে হবে আমাকে। দ্বিতীয়বার কোন ভুল করতে চাই না আমি। নিজেকে নিয়ে খেলার আর কোন সু্যোগ আমি দেব না কাউকেই। অনেক কিছু হারিয়ে আজ এইটুকু অর্জন করেছি। অর্জনটুকু কিছুতেই হারাতে চাই না আমি। কিছুতেই না।

★আসন্ন বইমেলা উপলক্ষে আমার দু’টো বই আসছে। একটা পলিটিকাল মার্ডার মিস্ট্রি থ্রিলার ‘অন্ধকারে জলের কোলাহল’ অন্যটা সমকালীন রোমান্টিক জনরার ‘আমি ডুবতে রাজি আছি’। চমৎকার বইদুটোর প্রি অর্ডার চলছে রকমারিসহ আপনার পছন্দের বুকশপে। আমার লেখা ভালো লাগলো বইদুটো সংগ্রহ করুন। আশাকরছি ভালো পড়ে নিরাশ হবেন না।★

চলবে—
©Farhana_Yesmin