মেঘভেজা দুপুরের নিমন্ত্রণে ফিরে এসো পর্ব-০৯

0
153

#মেঘভেজা_দুপুরের_নিমন্ত্রণে_ফিরে_এসো
#পর্ব-৯

আমার হাতে ধরা ওনার প্রেশক্রিপশন ফাইল। রঙ্গন কাউকে পাঠাতে চেয়েছিল আমিই মানা করেছি। এমন অবস্থায় আমার হাসপাতালে যাওয়া উচিত। হাজার হোক উনি আমার স্বামীর মা। সম্পর্ক, দায়িত্ব, কর্তব্য সবটাতেই ওনার অধিকার ষোল আনা। যদিও ওনার সাথে কখনো মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি আমার তবুও মা সম্বোধনটাই এমন যে হেলা করা যায় না। মানুষটার পরিস্থিতি ভেবে আমার সত্যিই খারাপ লাগছে। ওনার নিজের শরীরের এই হাল তার উপর একমাত্র ছেলে নিখোঁজ। যতটা সহজ মনেহচ্ছে ততটা সহজ নয় পরিস্থিতি। আমি এতোদিন পাত্তা না দিলেও মনেহচ্ছে এবার ব্যাপারটা গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। সারোয়ারের ব্যাপারটা জানতে হবে ঠিকমতো। অবাক কান্ড হলো ওনার দুই মেয়ে সোমা কিংবা স্বাতী কেন ফোন করে মায়ের খোঁজ নিচ্ছে না একবারও? মাথায় অনেক প্রশ্ন ঘুরছে। অতীত হানা দিচ্ছে বারবার। বিয়ের পরের
কতশত স্মৃতি যে মনে পড়ছে আজ।

মোহাম্মাদপুরে সারোয়ারদের দোতলা বাড়ি পুরোটাই একটা চিড়িয়াখানা যেন। ওর দাদী, এক চাচার পুরো পরিবারসহ ওরা ভাইবোন মা মিলিয়ে বারোজনের পরিবার থাকে। এরমধ্যে ওর দুই ফুপুর পালা করে আসা যাওয়া। এক ফুপুর মেয়ে ওই রেবা। অদ্ভুত কারণে সারোয়ারের মা রেবাকে অসম্ভব পছন্দ করতেন আর আমাকে অপছন্দ। মেয়েটা আঠার মতো ওনার সাথে লেগে থাকত। মামী মামী করে মুখে ফেনা তুলে ফেলতো। স্বাতী আর সোমা ওর কারণে মায়ের উপর ভীষণ বিরক্ত থাকতো। মজার ব্যাপার হলো সারোয়ার রেবাকে একদম সহ্য করতে পারতোনা। আর রেবা আমাকে। শুধু রেবা না সারোয়ার বাবার পরিবারের কেউই আমাকে সহ্য করতে পারতোনা। নানাভাবে আমাকে হ্যারাস করার চেষ্টা করতো। মেডিকেলের ফাইনাল ইয়ার তারপর ইন্টার্নি পিরিয়ড কিভাবে শেষ করেছি সেটা ভাবলে আজ আশ্চর্য লাগে বইকি।

সারা সপ্তাহ ব্যস্ত থাকতাম বলে শুক্রবারের সমস্ত রান্নার ভার আমার উপর ছিলো। অপটু হাতে বারোজনের সকালের নাস্তার পালা শেষ করে দুপুরের রান্না করে দিন শেষে আমার নিজ হাতে খাওয়ার রুচি থাকতো না। তারমধ্যে নানাজনের নানা বায়না, রেবার টোন কাটা আছেই। মাঝে মাঝে অসহ্য লাগতো সবকিছু। ইচ্ছে করতো সব ছেড়ে ছুঁড়ে দূরে কোথাও চলে যাই। সারোয়ার কিছু বলতো না এমন নয় তবে জোর দিয়ে কিছু বলতে পারতোনা। আমার শাশুড়ী মা বিয়ের পর বলেই দিয়েছিলেন, আমাকে এডজাস্ট করে চলতে হবে। উনি চাইলেই সারোয়ারের বাবার পরিবারকে বাদ দিয়ে চলতে পারেন না। আইনগত কিছু ঝামেলা আছে। হঠাৎ মৃতুর কারনে সারোয়ারের বাবার সম্পদ কোনটাই ওদের নামে করা যায়নি পুরোপুরি। যেহেতু সারোয়ারের দাদী জীবিত। সন্তানের সম্পদে তার অধিকার আছে। সেই অধিকার নিয়েই হয়েছে যত বিপদ। সারোয়ারের এক চাচার অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ বলে সে সুযোগ পেয়েই বড়ভাইয়ের সম্পদে ভাগ নিতে চলে এসেছে। ওর দাদীও ছেলের সাথে তাল দিচ্ছিল।

এতোকিছু আলোচনায় আসতো না যদি না ব্যাপারটা আমাদের জীবনে ইফেক্ট ফেলতো। নিজের পড়ালেখা আর সারোয়ারদের সাংসারিক জীবনের প্যাচে পড়ে আমি ক্রমাগত সারোয়ারের জীবন থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলাম। ব্যাপারটা আমি যখন বুঝলাম তখন জল অনেকদূর গড়িয়েছিল। সবসময় গায়ে পড়ে থাকা রেবাকে যেদিন প্রথম সারোয়ারের সাথে বসে হাসাহাসি করতে দেখি সেদিনই আমার ভেতরকার মনটা সতর্ক করেছিল। আমি সরাসরি সারোয়ারের কাছে যেয়ে জানতে চাইলাম-“কি ব্যাপার? তুমি কখন এলে অফিস থেকে? আমাকে ডাকলে না যে?”
সারোয়ার ঠোঁট উল্টে জবাব দিয়েছিল-“তোমার সময় আছে? পড়া আর রোগী দেখার বাইরে কিছু দেখার ইচ্ছে আছে তোমার?”
আমি স্তব্ধ। বধির হয়ে সারোয়ারকে দেখেছিলাম। রেবা ঠোঁট উল্টে কর্কশ স্বরে বলে উঠলো-“ওমন জড়বস্তুর মতো দাঁড়িয়ে না থেকে দু’কাপ চা করে দাও। দেখছো না সারোয়ার ক্লান্ত।”
সারোয়ার তাকিয়ে দেখলো না আমাকে। ওর এমন পরিবর্তন ঠিক হজম হলো না আমার। আমি জবাব না দিয়ে ধীর পায়ে চলে আসি। দুইকাপ চা বানিয়ে সারোয়ার আর রেবাকে দিয়ে আমি ঘরে ফিরেছিলাম। আমার ভেতরটা ভীষণ উল্টে পাল্টে গেল। আমি কি সত্যিই নিজেকে নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে গেছি? সারোয়ারকে সময় দেই না একদমই? কই ওতো কিছু বলে না কখনো? সম্পর্কের শুরুতে ও কতবার করে বলেছে, ডাক্তারী মহান পেশা। ও খুব প্রাউড ফিল করে আমাকে নিয়ে। তাই আমার পড়ালেখায় যতটা পারে ও হেল্প করবে। আর আজ! কোথায় গেলো ওর প্রাইড? বাবার বাড়ির সাথে সম্পর্কের সুতো আলগা করে এই বাড়িতে এসেছিলাম যার ভরসায় সে দূরে সরে যাচ্ছে। এটা মেনে নেই কি করে? আমি সিদ্ধান্ত নিলাম বিসিএস বাদ। সম্পর্কের চাইতে কি বিসিএস বড়? কি হবে বিসিএস দিয়ে যদি সারোয়ার না থাকে? আমি সারাদিন একটা মেডিকেলে মেডিকেল অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে সন্ধ্যার পর ভালো বউ হয়ে সারোয়ারকে সময় দেব বলে মনস্থির করি।

কয়েকদিন পরে সারোয়ার নিজ থেকেই বললো-“কি ব্যাপার দুপুর, হুট করে এমন লক্ষী মেয়ে হয়ে গেলে? বিসিএস দেবে না?”
আমি মাথা নাড়ি-“নাহ। তোমাকে সময় দিতে পারি না তাই পড়ালেখা বাদ। আর ভেবে দেখলাম বিসিএসে হলে তোমার থেকে দূরে ঢাকার বাইরে থাকতে হবে। এমনটা কি সম্ভব হবে বলো?”
সারোয়ারের মুখে বিশ্বজয়ের হাসি। আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমুর পর চুমু দিয়ে বললো-“উফফ, কি যে বাঁচানো বাঁচালে দুপুর। আমি সত্যি চাই না তুমি আমার থেকে দূরে সরে যাও। সন্ধ্যায় ফিরে বউকে না পেলে ভালো লাগে বলো? মা বলছিল, বউ মানুষ সন্ধ্যার পর বাইরে থাকাটা খুব খারাপ। মাকে দেখেছ তো, বিকেলের মধ্যে কাজ শেষ করে বাসায় ফিরে আসে। আমি তোমাকে ভালোবাসি দুপুর, আমার থেকে দূরে যেয় না প্লিজ। তাহলে কষ্ট পাবো খুব।”
আমি মনে মনে থমকাই। সারোয়ারের ধ্বসে পড়া বিবেক দেখে অবাক হই। ধাক্কাটা আমার জন্য বেশ জোড়ালো ছিল বলে আমি চুপ করে থাকি। মনে মনে স্বান্তনা দেই সারোয়ার সত্যি ভালোবাসে আমাকে তাই এমন করেছে। দিন ভালোই কাটতে লাগলো। কি জানেন, সবার মনের মতন চললে দিন ভালোই যাবে শুধু একসময় দেখবেন আপনার মনটা মরে গেছে। কোন কাজ করতেই আর ভালো লাগবে না তখন। আমারও তেমন অবস্থা হয়েছিল।

“ম্যাডাম, চলে আসছি।”
ড্রাইভার ডাকলে আমি স্মতির ডায়েরি বন্ধ করে গাড়ি থেকে নামলাম। সাততলায় আইসিইউ, আমি অবশ্য গেলাম পাঁচ তলায় রঙ্গনের চেম্বারে। ওখানে ডাক্তার মইনকেও বসে থাকতে দেখলাম। আমি কথা না বাড়িয়ে ফাইলটা রঙ্গনের দিকে বাড়িয়ে দিলাম। ও দ্রুত হাতে ফাইল উল্টে দেখে ডাক্তার মইনের দিকে বাড়িয়ে দিলো-“যা ভাবছিলাম মইন ভাই।”
ডাক্তার মইন ফাইল ঘেটে দেখে উঠে দাঁড়ালেন-“আমি দেখছি রঙ্গন। তুমি ভেবো না। জ্ঞান ফিরলে আরও কয়েকটা টেস্ট করিয়ে ক্যান্সারের বর্তমান কন্ডিশন দেখবো। টেস্ট রিপোর্টগুলো তিনমাস পুরনো। জানোই তো ক্যান্সারের ক্ষেত্রে তিনমাস অনেক সময়।”
রঙ্গন মাথা নাড়লো। ডাক্তার মইন চলে যেতেই আমি রঙ্গনের সামনে বসলাম-“আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছি না রঙ্গন, এই ক’দিনে সোমা কিংবা স্বাতী আপু কেউ ফোন করেনি ওনাকে। কি ঘটনা বলতো?”
রঙ্গন মাথা নাড়লো-“আমি জানি নারে। খালাদের সাথে টোটালি যোগাযোগ ছিলো না আমার। ইচ্ছে করেই রাখিনি। যদি কোনভাবে তোর খোঁজ পেয়ে যায় এই ভয়ে।”
“তাহলে সারোয়ারের খবর কিভাবে পেয়েছিলি?”
“সারোয়ারের এক বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছিল ফ্লোরিডাতে। তখন শুনেছিলাম। আমার অবশ্য বিশ্বাস হয়নি।”
রঙ্গনের কথায় আমার কপালে ভাজ পড়ে-“পুরো ব্যাপারটা ধোঁয়াশা লাগছে আমার কাছে। কেমন যেন খাপছাড়া। যতদূর শুনেছিলাম সারোয়ার কাঁকন মেয়েটাকে বিয়ে করতে চাইছিল৷ আমি কিন্তু কখনোই কিছু বলিনি সারোয়ারকে। সারোয়ার আমাকে ডিভোর্স দিতে চায় এই খবর পেয়েছিলাম। তখনই নিজ থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নেই। এখন আমার প্রশ্ন হলো, সারোয়ার কোথায় গেলো? আর কেমনইবা গেল?”
রঙ্গন চুপচাপ বসে থেকে ভাবলো কিছুক্ষণ-‘আমিও অনেকবার ভেবেছি জানিস। যতদূর শুনেছি খালা থানা পুলিশও করেছিলেন। তারপরের ঘটনা জানি না। খালা কেন তোর কাছে এসেছেন সেটা এখনো বোধগম্য না আমার। এতটুকু বুঝতে পারছি খোঁজ খবর করেই এসেছেন। তাহলে এটাও তার জানার কথা এখানে সারোয়ার নেই। অথচ সারোয়ার নিখোঁজ হওয়াতে সে আমাকেই দায়ী করেছে। এমন নাটুকেপনার কারনটা কি হতে পারে?”
আমি চমকে উঠলাম। আসলেই তো। আমাকে খুঁজে এতোদূর এসেছেন, এমনি এমনি তো না। তাহলে এমন ভাব কেন করলেন যে আমি সারোয়ারকে নিয়ে পালিয়ে এসেছি। আবার রঙ্গনকে বলছে সারোয়ারের নিরুদ্দেশ হওয়ার কারণ সে। আমি রঙ্গনকে বলি-“এমন কি হতে পারে উনি আমাদের দু’জনকে বাজিয়ে দেখছে। কিছু যাচাই করতে চাইছে। সারোয়ারের ঘটনাটা সাজানো নয় তো?”
রঙ্গন মাথা নাড়লো-“হতে পারে। এখন এসব প্রশ্নের উত্তর আসলে খালাই দিতে পারে। তার সুস্থ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।”

চলবে—
©Farhana_Yesmin