মেঘভেলায় প্রেমচিঠি পর্ব-২৬+২৭

0
544

”মেঘভেলায় প্রেমচিঠি ”

২৬.

অনিশ্চিত জীবনের আভাসে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলো রোদসী। অসহ্য দহনে অন্তর আত্মাও কেঁদে উঠলো। যেখানে ভেবেছিলো আর কেউ পাশে না থাকলেও মা বাবার ভরসা অবশ্যই পাবে। অথচ, অন্য লোকের কথায় কান দিয়ে তারাও আরেকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিলো। না না, রোদসীর মতে অত্যন্ত ভুল সিদ্ধান্ত। কেয়া হোসেন কঠোর ভাবে বলেছেন, ‘যার জন্য এই মেয়ে আমাদের ছেড়ে গেছে, ওকে তার কাছেই পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করো। ‘ এটি অবশ্য কেয়ার নিজস্ব মত নয়। আশেপাশের অসংখ্য মানুষরা কানাঘুঁষা করে তার মগজে ঢুকিয়েছে। রাগের মাথায় তিনি তাই সিদ্ধান্ত নিলেন। মেডিকেল টেস্টে বোঝা গেছে, রোদসী ইজ নট রেপড। অতএব, সবার মতে সূর্য মোটেও ধর্ষণের জন্য ওকে নিয়ে যায়নি। তবুও একবার কেউ ভাবলো না, যদি সূর্য তেমন কিছু না-ই করে থাকে তাহলে রোদসী সেরকম অবস্থায় কী করে পৌঁছালো। আবার কেউ কেউ বিশ্বাস করছেনা এ কথা। অনেকের মতে, রোদসীর পরিবার ধর্ষণের ব্যাপারটা ধামাচাপা দিতেই মিথ্যা রিপোর্ট বানিয়েছে। রোদসী খুব ভালো করে বুঝতে পারছে,ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে চলেছে। হাসপাতাল থেকে ওকে বাসায় শিফট হয়েছে খুবই সীমিত সময়ের জন্য। বাসায় আসার পর কেয়া বা মনিরুল কেউই দুই বাক্য উচ্চারণ করেনি ওর সাথে। বিয়ের জন্য মোটামুটি একটা শাড়ি এনে এক প্রকার জোরজবরি করেই পরানো হলো। শাড়ির আঁচল খামচে তখন রোদসী গুণগুণীয়ে কাঁদছে। আপন মানুষ গুলোই যখন অবিশ্বাস করলো, তখন কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলো না। বলতে নিয়েও অপমানিত হলো। কেয়াকে যখন রোদসী বলছিলো, ওর কোনো দোষ নেই। তিনি পরিষ্কার করে বলে দিলেন, এইসব নাটক না করতে।
কাজী এসেছে বিয়ের জন্য। রোদসীকে টেনেহিঁচড়ে সেদিকে নিয়ে যাওয়া হলো। রোদসী বসার পর দেখলো তার পাশেই সূর্য বসে আছে। রোদসীকে দেখে আড়ালে বিদঘুটে এক হাসি দিয়ে ওর হাতটা চেপে বললো,

‘পালিয়ে কী লাভ হলো? সেই আমার কাছেই তো এলে সোনা। ‘

রোদসী রেগে ঘৃণ্য দৃষ্টি দিয়ে বলল,

‘তোর মতো চরিত্রহীনের সঙ্গে আমি জীবনেও থাকবো না! ‘

সূর্য ওর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলল,

‘এই চরিত্রহীনকেই গ্রহণ করতে হবে, নাহলে আমি সব ধ্বংস করবো রোদ ‘

মাথা নিচু করে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে রোদসী। এমন নোংরা একজন মানুষের সাথে কীভাবে থাকবে ভেবেই মরে যেতে ইচ্ছে করছে ওর। কাজী সাহেব ‘কবুল’ বলতে বললেও ঠোট চেপে বসে আছে রোদসী। সূর্য অনেক বার চোখ রাঙিয়ে দিলেও মুখ খুলছে না। অনেক ক্ষণ কেটে যাওয়ার পর যখন আর কোনো উপায় পেলো না তখন হার মেনে কবুল বলতে নিচ্ছিলো। কিন্তু পেছনে থেকে এক নারীকন্ঠে তাতে বাঁধা পড়লো। রোদসী সহ বাকী সবাই তাকিয়ে দেখলো একটা অল্প বয়সী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রোদসী চমকে উঠলো, এটা নদী। উষ্কখুষ্ক চুল, মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছে নদী। রোদসীর আত্মা যেনো এবার পানি পেলো। উঠে দাঁড়িয়ে গেলো ও। সূর্য আমতা আমতা করতে থাকলো। নদী এসেই সূর্যকে থাপ্পড় মেরে দিলো। কলার টেনে বললো,

‘শয়তানের বাচ্চা! আমাকে বিয়ে করে কারো সামনে স্বীকৃতি দিতে চাস না এই কারণে! আমাকে এতিম পেয়ে ফাসিয়ে বিয়ে করলি, এখন আবার আরেক জনের সঙ্গে এমন করছিস! লজ্জা নেই তোর! ‘

সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। রোদসী এগিয়ে এসে নদীকে জিজ্ঞেস করলো ওকে কে এনেছে। নদী বললো, রোদসীর মামাতো ভাই আশরাফ গিয়ে নিয়ে এসেছে। সূর্য কলার ছাড়িয়ে বলে,

‘দেখো নদী, আমি তোমাকে ভালোবাসি না। একজন পুরুষ দুই বিয়ে করতে পারে। তোমার সমস্যা হলে, আমি তোমাকে তালাক দিয়ে দেবো। ‘

নদী আগে থেকেই কাঁদছিলো। এখন অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলো। ঠিক এই মানুষটাকেই একসময় নিজের পৃথিবী ভাবতো নদী। এতিম হওয়ায় মা বাবার সঙ্গ পায়নি। একা একা হোস্টেলে বড় হয়েছে। একটা মামা ছিলো, সে শুধু মাসে মাসে হোস্টেলের টাকা টা দিতো। এভাবেই এক কোচিং থেকে সূর্যের থেকে পরিচয়। নদীর সত্যিকারেই পানির মতো শান্ত। এ কূল কিনারায় কেউ ছিলো না। সব মেয়ের মতো ওরও একটা স্বপ্ন ছিলো স্বামী সংসারের। সূর্যকে ঘিরেই সব স্বপ্ন সাজিয়ে ছিলো। সূর্যের ভালোমানুষির মুখোশটাই দেখেছিলো। আড়ালের কুৎসিত চেহারাটা নজরে পড়েনি। সরল মনটা প্রথম সূর্যকেই দিয়েছিলো। অথচ, এখন এ মানুষটাই এখন বলছে তালাক দিবে। এতক্ষণ নদী সব সয়ে নিয়ে ভেবেছিলো, সূর্যকে আর যাই হোক ছেড়ে দিবেনা। এখন আর কিছু বলার শব্দ পেলো না। চলে যেতে যেতে সূর্যকে শুধু বলল,

‘একদিন তুমি বুঝবে আমি কী ছিলাম। তোমার মতো মানুষের ধ্বংস হবেই, হয় আজ নাহয় কাল। ‘

নদী চলে যাওয়ার পর রোদসীর মা বাবাকে আশরাফ সব কথা বললো। পুলিশও এসেছে। আশরাফই সবকিছুর ব্যবস্থা করেছে। রোদসী আশরাফকে সব খুলে বলেছিলো হাসপাতালেই। বোনের কথায় অবিশ্বাস করেনি ও। আশরাফ পুলিশকে সবকিছু বের করতে অনুরোধ করলো। ধীরে ধীরে আরও অনেক সত্য সামনে এলো। সূর্য এর আগে ড্রাগসের ব্যবসা করতো। নারী পাচারের ব্যবসাতেও হাত ছিলো। পুলিশ ফোর্স এসে সূর্যকে এরেস্ট করে নিয়ে গেলো। রোদসীকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা সবার সামনে আসতেই কেয়া, মনিরুল অপরাধী চোখে তাকালেন। তারা দু’জনই রোদসীর কাছে আসতে নিলে রোদসী বললো, এ বাড়িতে আর থাকবে না সে। দু’জন অনেক আকুতি করলেও রোদসী মনে যে আঘাতটা পেয়েছিলো তা মুছে যায়নি। তারপর অনেক দিন মামাবাড়িতেই ছিলো রোদসী। একা একা একটা আলাদা জগৎ বানিয়ে ফেলেছিলো। আশরাফ ও মামা বাড়ির সবাই অনেক চেষ্টা করে ওকে আবারও টেনে ভর্তি করালো। এসএসসি দিতে পারেনি সেসময়। একরকম ঘরেই সারাক্ষণ বসে থাকতো রোদসী। পড়াশোনা শুরু করলেও কোনো বন্ধু বান্ধব বানায়নি। আর না কোনো ছেলে মানুষের কথায় বিশ্বাস করেছে। নদীকে দেখে ওর ভালোবাসার সাধ মিটেছিলো। আর রিম্মি, সোহাকে দেখে বন্ধুত্বের। সেখানে এসএসসি দিয়ে তারপর বাড়ি ফিরে রোদসী। রোজ রোজ মা বাবার আহাজারি আর সহ্য হচ্ছিল না। তবুও ক্ষত পুরোপুরি মিটেনি। তারউপর কিছু মানুষ তো আছেই এখনো রাস্তায় দেখলে দুই একটা তিক্ত বাণী শোনাতে ভোলেনা।

রোদসী শহরের বুক থেকে মাথা তুললো। শহরের চোখ লাল হয়ে আছে। যেনো একটা ঘোরে আছে সে। রোদসীর গায়ে এখনো জ্বর আছে। আলতো হেঁসে রোদসী শহরকে ঝাকাতেই শহর নড়েচড়ে উঠলো। এসব কিছু শুনে করুণ দৃষ্টিতে তাকালো। রোদসীর গালে হাত রেখে বললো,

‘অনেক হয়েছে ঘুমাও। ‘

রোদসী চোখ বন্ধ করে হেলে ছিলো। চোখ খুলে বলল,

‘আপনাকে আমার আগে এসব বলা উচিত ছিলো। আপনার নিশ্চয়ই এখন আফসোস হচ্ছে, আপনাকে ঠকিয়েছি আমি। ‘

শহর গম্ভীর গলায় বলল,

‘রোদসী, তুমি ধর্ষণ হওনি। কিন্তু যদি হতে, তবুও আমার কোনো সমস্যা ছিলো না। দোষ মোটেও তোমার হতো না, দোষ যা সবটা ওই লোকটার। আমাদের সমাজে ধর্ষকের চেয়েও ধর্ষিতারা বেশি ভোগে। সামনে আট দশটা জ্ঞানের বাণী শোনাতে পারে কিন্তু ওই ধর্ষিতাকে নিজের বাড়ির বউ করতে পারে না। যে মেয়ে হোটেলে গিয়ে বয়ফ্রেন্ডের কাছে একশোবার নিজেকে বিলিয়ে দেয় লুকিয়ে, তাকে ঠিকই বউ করতে পারে কিন্তু যে মেয়ে সারাজীবন পর্দার আড়ালে থেকেছে তাকে জোর করে ধর্ষণের পর গ্রহণ করতে আপত্তি করে। এদের কথায় কান দিলে আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় নেই। এরা একবেলা তোমাকে খাওয়াবে পড়াবে না। অতএব, এদেরকে দেখলে উচিত জবাবটা মুখের উপরই দিয়ে দিবে। এখন ঘুমাও, তুমি অসুস্থ। ‘

মুগ্ধ দৃষ্টিতে রোদসী ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আবারও চোখ বুঁজে নিলো। রোদসীর মাথাটা নিজের বুকের উপর টেনে শহর পাশেই শুয়ে পড়লো। রোদসীর মুখের উপর তাকিয়ে রইলো নিষ্পলক। নিজের চোখ বুঁজে রোদসীর কানের কাছে বিরবির করে বলল,

‘রৌদ্রময়ী, তুমি আমার দিকে একটুকরো প্রেম ছু্ড়ে দিতে পারো না! ‘

চলবে-

“মেঘভেলায় প্রেমচিঠি ”

২৭.

ললাট বেয়ে গড়িয়ে টুপ করে পড়ছে ফোটায় ফোটায় ঘামের কণা। নাকের ডগায় এঁটে আছে ক্লান্তি। চুলের খোঁপাটা ঢিলে হয়ে গেছে। খুলবে খুলবে ভাব। ছিমছাম পাতলা কোমড়ের কাছের বেগুনী শাড়িটা সরে গিয়ে নিষিদ্ধ জায়গায় নজর আঁটকে যায় বারংবার। শহর নিজেকে খুব করে বকে দেয়। অজস্র গালমন্দ করে। কেনো বারবার নজর সেদিকে যাবে! চোখটা বড়ই অসভ্য। যদিও রমনীটি একান্তই বৈধ নিজের। তবুও, আড়ষ্টতা বিরাজমান। শহর চোখ সরায়। পা দুটো সোফায় তুলে হেলান দিয়ে ল্যাপটপে চোখ বুলায়। মনে মনে বিরক্তি জমে। সেই কখন থেকে মেয়েটা ঘর মোছামুছির কাজ শুরু করেছে। থামার নামগন্ধ নেই। শহর জানে রোদসী ভীষণ খুঁতখুঁতে। প্রতিটা জিনিস যেমন তেমনই রাখে। শহরের ঘর আগে যতটা ধুলোপড়া এলোমেলো ছিলো, এখন তার একবিন্দুও নেই। রোদসীর কর্মে শহর মাঝে মাঝে অসহ্য হয়ে ওঠে। যেমন কখনো কখনো রোদসী জানালার কাচ মুছতে মুছতে বাক্যবিনিময় করতে একেবারে ভুলে যায় মেয়েটা। কী হয় শহরের সঙ্গে এটা ওটা নিয়ে একটু কথা বললে! কাজ করার সময় ভুলেই যায়। শহর আজকাল ঘরের ফ্যানটাকেও বড্ড হিংসে করে। দেখো, কীভাবে মেয়েটা শাড়ির আঁচল গুঁজে যত্ন করে ফ্যান মুছে যাচ্ছে! শহর চেঁচিয়ে বলে,

‘এই মেয়ে এই, রাখো তো। সেই কখন থেকে ফ্যানকে ধোয়ামোছা করছো! ‘

রোদসী মাথা নিচু করে ভ্রু কুচকে তাকায়। চেয়ার থেকে নেমে ঝগড়ার মুড নিয়ে কোমড়ে হাত রেখে বলল,

‘কেনো? কী সমস্যা? ‘

‘আবার বলে কী সমস্যা! ফ্যানটাকে তো ঘষতে ঘষতে মেরে ফেলবা তুমি। আমার বেচারা ফ্যানটাকে রেহাই দাও মেয়ে। ‘

রোদসী অবাক কন্ঠে বলে,

‘কীহ! ফ্যান মরে যাবে? ‘

‘তাহলে আবার কী? যাও গোসল করে এসো। গরমে ভিজে গেছো। ‘

রোদসী আলসে দৃষ্টি দিয়ে বলল,

‘কী বলছেন! এটা তো শীতকাল। সকালে একবার গোসল করেছি তো। ‘

‘ওটা গোসল! হাত মুখ ধুয়ে এসেছিলে শুধু। ‘

রোদসী মুখ ঝামটি দেয়। কথায় পরাজিত হয়ে টাওয়াল হাতে ঝুলিয়ে গোসলখানায় ঢোকে। শহর ঠোঁট চেপে হাসে। সব জিনিসে এতো খুঁতখুঁত করে অথচ শীতে পানি ধরতে ভয় পায়। শহর খাটের উপর থেকে চেয়ারটা নামিয়ে রাখে। দেখতে দেখতে কীরকম যেনো বিয়ের ছয়টা মাস কেটে গেছে। ছোট ছোট ঝগড়া, কখনো হুট করে চোখাচোখি আবার অভিমান।
এভাবেই দিন যাচ্ছে। শহরের ইতিমধ্যে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি হয়েছে। ফ্রিল্যান্সিং সঙ্গে চাকরি করে যদিও পরিশ্রম হচ্ছে অনেক। কিন্তু স্কিল উন্নতির জন্য সবই করছে শহর। রোদসী বাসায় বসে হাতের কাজ করে। নাইনে থাকতেই সেলাইয়ের কাজ শিখেছিলো। বাসায় সারাক্ষণ কী করবে ভেবে ডিজাইনিংএর কাজ করে। সময় নিজের মতো করেই চলছে। পড়াশোনা, কাজকর্ম, সংসার বেশ চলছে। কিন্তু এগোচ্ছে কতটুকু তা বলা মুশকিল। রোদসী এবং শহরের মাঝে একটা ভালো বন্ধুত্বের সৃষ্টি হলেও একে অপরকে স্বামী স্ত্রী হিসেবে কতটা আপন করেছে তা বোঝা যায় না। কখনো কখনো রোদসী ভুলেই যায় শহর ওর বন্ধু পরে স্বামী আগে । কারণ শহর কখনোই ওকে অনুভব করতে দেয়না রোদসী এখন নিজের বাবার বাড়িতে নেই। পরিবারের বাকী সবাই এতোটাই সাপোর্টিভ যে তেমন কোনো কাজও করতে দেয়া হয়না। শহরের মা রোদসীকে বলেই দিয়েছেন এখন বেশি পড়াশোনায় মনোযোগী হতে। সংসারের জন্য পুরো জীবন বাকী আছে।

দিন যাচ্ছে এভাবেই। হঠাৎ একদিন শহর অফিসে যাওয়ার সময় টাই বাঁধছিলো। চুলে হেয়ার জেল সেট করে আঁচড়ে নিয়ে আড়চোখে একবার রোদসীর দিকে তাকালল। রোদসী পাশেই আলমারি থেকে কিছু কাপড় বের করছিলো। শহরের কী হলে কে জানে, সে রোদসীর আঁচলটা টান দিতেই রোদসী ধপাস করে শহরের উপর এসে পড়লো। রোদসী হকচকিয়ে গিয়ে বলল,

‘এমন কেউ করে! ভয় পেয়েছি। ‘

শহর রোদসীর কপালের পাশের চুল কানের পাশে গুঁজে দিয়ে মুখ কাছে এনে বলল,

‘রোদচশমার স্বামী করে। ‘

রোদসী রাগতে নিয়েও রাগলো না। শহরের কথায় ফিক করে হেঁসে ফেললো। লজ্জায় নত হয়ে হালকা হাতে শহরের বুকে কিল বসালো। শহর একবিন্দুও ব্যাথা পেলো না। কিন্তু ঢং করে বলল,

‘মারডালা। ‘

রোদসী ইদানীং মনে মনে যে শহরের জন্য কিছু একটা অনুভব করে তা রোদসী নিজেও জানে। কিন্তু মুখফুটে কিছু বলার সাহস হয়না৷ শহরকে দেখলে দূরে ইচ্ছে করেই থাকে। নাহলে, একটা অদ্ভুত লজ্জায় লাল হয়ে যায় সে। এই যে শহরের হাত দুটো রোদসীকে আঁকড়ে লেগে আছে। রোদসীর বুকের ভিতরে হৃদপিণ্ডটা ধিকধিক করছে। শহরের দিকে তাকাতেই শহর অদ্ভুত সুরে বলে,

‘রোদসী, আমি যদি কখনো হারিয়ে যাই মনে রাখবে আমায়?’

অজান্তেই চোখ দুটো ভয়ে চকচক করে উঠলো রোদসীর। চিনচিনে ব্যথায় মুখ লাল হলো। হাতটা অজান্তেই শহরের গালে পৌঁছে গেলো।ঠোঁট উল্টে গিয়ে বলল,

‘এমন বলছেন কেনো? ‘

শহর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

‘হারানোর ভয় পাও? ভালোবাসো আমায়?’

রোদসী মুখ নিচু করে রাখলো। শহর হতাশ হলো হয়তো। রোদসীকে ছেড়ে দিয়ে হাতে ঘড়িটা পড়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,

‘যাচ্ছি। ‘

রোদসী পিছনে থেকে ডাক দিতে চেয়েও দিলো না। শুধু মনে মনে বিরবির করে বললো, ‘যাচ্ছি না আসি বলতে হয় শহর। আপনি গেলে আমি কীভাবে থাকবো!’

শহর যাওয়ার পর এক বিষন্নতায় গুমরে থাকলো রোদসী। খেতে নিয়েও খেতে পারলো না। ঘর গোছানোর বদলে বরং আরও এলোমেলো করে ফেললো। বই পড়তে গিয়ে ‘শহর ‘এর নামে চিন্তা করতে শুরু করলো। বইটা অবশেষে মুখের উপর দিয়ে ঠাস করে শুয়ে পড়লো। চোখ বন্ধ করে রাখলো। ধীরে ধীরে অনুভব করলো, শহরকে রোদসী ভালোবাসে। একটু নয় অনেকটা বেশিই ভালোবাসে।
মুখে একরাশ লজ্জাময় রেখার আবির্ভাব ঘটলো। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে বলল,

‘আপনাকে আমি ভালোবাসি শহর। কীভাবে জানিনা কিন্তু বাসি। ‘

তারপর মনের সুখে রুম থেকে বের হলো। এটা সেটা চিন্তা করে রান্না ঘরে ঢুকলো। দিলারাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, শহরের চিকেন বল খুব পছন্দ। তাই রোদসী ওটাই বানালো। সঙ্গে লাচ্চি তৈরি করলো। অনেক কিছুতেই মন বসানোর চেষ্টা করলো। তবে মনটা বোধ হয় সকালেই শহর সঙ্গে করে নিয়ে গেছে। কেমন যেন একটা ভয় ভয় জড়িয়ে ধরলো রোদসীকে। একটা আফসোসও ঘিরে ধরলো। সকালে যখন শহর ওকে ভালোবাসে কিনা জিজ্ঞেস করলো তখন কেনো রোদসী মনের কথাটা বলল না! শহরের নিশ্চয়ই মন খারাপ হয়েছে। রোদসী জানে, বুঝতে পারে শহর ওকে ভালোবাসে৷ চোখ পড়ার ক্ষমতাটা রোদসীর আছে। শহরের চোখের দিকে তাকালে একসমুদ্র ভালোবাসা দেখতে পায় নিজের জন্য। সেই সমুদ্রের গভীরে নিজে কীভাবে যেন দিন দিন তলিয়ে যাচ্ছে।

রাত তখন সাড়ে দশটা। প্রতি দিন নয়টা বাজলেই দরজায় কলিং বেল বাজে রোজ। রোদসী তখন দৌড়ে
দরজা খুলে দেয়। কী চমৎকার একটা হাসি তখন শহরের মুখে দেখা যায়! ক্লান্তিমাখা মুখটা দেখে রোদসীর মায়া হয়। আজ সেই মুখটা দেখতে না পেয়ে ভারি যন্ত্রণা হতে লাগলো মনে। কেনো এখনো আসছেনা শহর? এত রাত তো কখনোই করেনা! কোনো বিপদ হলো নাকি! দেখতে দেখতে, ঘন্টার কাটা বারো ছাড়ালো। বাড়ি জুড়ে কান্নার রোল শুরু হলো। রোদসীর অশ্রুটলটল করা চোখ দুটো তখনও সদর দরজার দিকে। তবে কী ভালোবাসার কথাটা মানুষটাকে আর বলা হবে না!

চলবে-