মেঘ বসন্তের মায়া পর্ব-০৬

0
623

#মেঘ_বসন্তের_মায়া💛
#লেখিকা:#তানজিল_মীম💛
— পর্বঃ০৬

আজ আকাশ তিথির বিয়ে। পুরো বাড়ি জুড়েই বিয়ে নামক উৎসবে মাতোয়ারা চারপাশ। যদিও তিথির মার খুব বেশি ধুমধাম করে বিয়ে দেওয়ার সামর্থ্য নেই তারপরও যথাসম্ভব নিজেদের সামর্থ্য দিয়ে ধুমধাম করে বিয়ের আয়োজন করেছেন। সাথে আকাশের গ্র্যান্ডমারও কিছু সহযোগিতা আছে। আকাশের গ্র্যান্ডমা খুবই ভালো একজন মানুষ তিথিরা তাদের তুলনায় কম সামর্থ্যবান হওয়ার পরও আকাশ তিথির বিয়েতে তার কোনো আপত্তি ছিল না। তিথি বা ওর পরিবার কেউই ভাবে নি এত ইজিলি সবটা হয়ে যাবে।

চারদিকে বিয়ের গন্ধের মাঝে কনে বেসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে আছে তিথি। কিছুটা অস্থিরতা, সাথে অনেকটা ঘাবড়ানো মাখা মুখ নিয়ে বসে আছে সে। সে ভাবতেই পারে নি তার লাইফে বিয়ে নিয়ে এমন কিছু ঘটবে। সব মেয়েরই বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন থাকে তেমনি তিথিরও ছিল কিন্তু পরিস্থিতি তাকে এমন এক জায়গায় দাঁড় করিয়েছে যে তিথি চাইলেও সেটা পাল্টাতে পারবে না ভেবেই দীর্ঘ শ্বাস ফেললো তিথি। এরই মাঝে ব্লাক লেহেঙ্গা পড়ে তিথির কাছে দৌড়ে আসলো সাথী কিছুটা খুশি মাখা মুখ নিয়ে বললো সে,

‘ আপি আকাশ দুলাভাই তো চলে এসেছে।’

সাথীর কথা শুনে বুকের ভিতর দক করে উঠলো তিথির তবে কিছু বললো না হাল্কা নরম কন্ঠে বললো সে,

‘ও।’

তিথির কথা শুনে সাথী চিন্তিতমাখা মুখ নিয়ে বলে উঠল,

‘ আপু তোর কি মন খারাপ?’

তিথির কথা শুনে শুকনো হাসলো তিথি তারপর বললো,

‘ না তেমন কিছু নয় তোদের ছেড়ে চলে যাবো তো তাই আর কি।’

তিথির কথা শুনে সাথী কিছু না বলেই কিছুক্ষন তিথির মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো সে তিথিকে তারপর কান্না ভেঁজা কন্ঠ নিয়ে বললো,

‘ তোকে খুব মিস করবো রে আপু।’

উওরে কিছু না বলে তিথিও জড়িয়ে ধরলো সাথীকে তারপর কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো,

‘ তোকে কিছু কথা বলবো কাউকে বলবি না তো?’

‘ না তুই বল কি বলবি?’

এদিকে,,

জামাই চলে আসায় সবাই মিলে গেটের সামনে দাঁড়ালো আকাশের। তিথির কাকিমা আকাশকে শরবত আর মিষ্টি খাইয়ে দিলো। সাথে যা হয় আর কি বুঝে নিও সবাই 😬

___

অবশেষে সব রিচুয়াল মেনেই ওদের সামনে সাদা পর্দা দিয়ে কাজী ডেকে খুব সুন্দরভাবেই বিয়েটা হয়ে গেল আকাশ তিথির। আকাশের বেশ বিরক্ত লেগেছে সবটায় কিন্তু তারপরও গ্র্যান্ডমার কথা মেনে মুখ বুঝে সবটা সহ্য করেছে সে।’

অতঃপর সবশেষে চলে আসলো বিদায়ের সময়। সবার চোখেই কান্নার আভাস। তিথিও তার মা বোন এছাড়াও কিছু আত্মীয় স্বজনকে জড়িয়ে কেঁদে উঠে বসলো গাড়িতে। আকাশও গিয়ে বসলো গাড়িতে। আকাশ তিথি বসতেই ড্রাইভারও আর দেরি না করে তাড়াতাড়ি গাড়ি চালাতে শুরু করলো। তারপর আর কি একে একে সবাইকে দূরে রেখে চলতে লাগলো এক অজানা গন্তব্যের দিকে আকাশ তিথি।’

জানালার দিকে মুখ করে নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে তিথি। প্রচন্ড খারাপ লাগছে তাঁর। আর অন্যদিকে আকাশ সে বুঝতে পেরেছে তিথি কাঁদছে কিন্তু এই মুহূর্তে তার কিছু বলার নেই। সময়টা একবছরের হলেও এই মুহূর্তের অনুভূতিটা হয়তো এক।’

___

রাত_৮ঃ০০টা…

শরীর আর মনটা কিছুটা খারাপ লাগায় সাথে মাথায় হাল্কা যন্ত্রণা করায় চুপচাপ বিছানায় শুয়ে আছে তিথির মা। মেয়ের জন্য প্রচন্ড খারাপ লাগছে তাঁর যদিও আকাশ আর গ্র্যান্ডমা খুব ভালো হওয়াও একটু চিন্তা মুক্ত সে তারপরও সেই ছোট্ট তিথি মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে তিথির মার। এমন সময় হাতে কিছু খাবার নিয়ে ওনার রুমে ঢুকলো সাথী। মাকে অসময়ে শুঁয়ে থাকতে দেখে চলে যায় সে মোর্শেদা বেগমের কাছে। তিথির মায়ের নাম,

‘ কি হলো মা শুয়ে আছো যে শরীর ভালো লাগছে না?’

আচমকা সাথীর কন্ঠ কানে আসতেই চোখ তুলে তাকালো মোর্শেদা বেগম। সামনেই সাথী আর ওর হাতের খাবার দেখে বলে উঠল,

‘ তুই আর এত খাবার কেন?’

‘ বারে তুমি সেই দুপুর থেকে কিছু খাওনি মা এখনও খাবে না কিছু?’

‘ আমার খিদে নেই সাথী।’

‘ খিদে নেই বললেই হলো নাকি উঠো বলছি আপু কিন্তু আমায় বার বার বলে গেছে আমি যেন তোমার খেয়াল ভালো মতো রাখি তাই কোনো বাহানা চলবে না তাড়াতাড়ি খাবারগুলো খাও মা আর ঔষধগুলো তো খেতে হবে।’

‘ এখন একদমই খেতে ইচ্ছে করছে না সাথী?’

মায়ের কথা শুনে খাবারগুলো বিছানার ওপর রেখে মায়ের পাশে বসে বললো সাথী,

‘ মা তুমি কি চাও আমি আপুর কাছে বকা খাই এমনিতেও তোমার দু’দিন পর অ..আর কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায় সাথী। কারন সে জেনে গেছে তাঁর মায়ের কি রোগ হয়েছে আর তিথিও হুট করে কেন এত বড়লোক বাড়ির ছেলেকে বিয়ে করলো শুধু এতটুকু জানে না যে বিয়েটা এগ্রিমেন্টের। সাথীকে থেমে যেতে দেখে বলে উঠল মোর্শেদা বেগম,

‘ কি হলো থেমে গেলি কেন দু’দিন পর কি?’

মোর্শেদা বেগমের কথা শুনে হাল্কা রেগেই বলে উঠল সাথী,

‘ কিছু না তুমি তাড়াতাড়ি এগুলো খাও তো মা।’

‘ আরে বাবা খাচ্ছি তো রেগে যাচ্ছিস কেন?’

‘ তুমি না বড্ড কথা বলো আপুর মতো?’

এতটুকু বলে নিজ হাতে মাকে খাইয়ে দিতে থাকে সাথী। সাথীর মাও কিছু না বলে খেতে শুরু করলো। কারন সে বুঝে গেছে তার মেয়ে রেগে গেছে,,অন্যদিকে সাথী মায়ের কথা ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে তার। তবে এই মুহূর্তে তা প্রকাশ করলো না সে। হঠাৎই খাওয়ার মাঝখানে বলে উঠল সাথী,

‘ একটা কথা বলবো মা?’

‘ হুম বল।’

‘ আপুর তো বিয়ে হয়ে গেছে আমার মনে হয় না আকাশ দুলাভাই আপুকে আর কাজ করতে দিবে আর তাছাড়া আপুর কাজ করাটাও ভালো দেখায় না তাই আমি ভাবছি আমি যদি জব করি তাহলে কেমন হবে এমনিতেও সংসারটাকেও তো চালাতে হবে আপু আর কত করবে। এখন আপুর নিজেরও সংসার হয়েছে তাই এখন নিজের সংসার দেখবে নাকি আমাদের সংসার দেখবে তাই ভাবছি পার্ট টাইম জব করলে কেমন হবে। সংসারকে তো চালাবে হবে মা। তাই ভাবছিলাম তুমি কি বলো মা,

সাথীর কথা শুনে মোর্শেদা বেগম অবাক হয়ে বললো,

‘ আমার এই মেয়েটাও দেখি খুব বড় হয়ে গেছে।’

উওরে হাল্কা হাসলো সাথী।’

___

ঘড়িতে রাত বারোটার কাঁটায় ছুঁই ছুঁই। গভীর রাত প্রায় সেই সময়ই নিশ্চুপে কনে বেসে ফুল দিয়ে সাজানো বিছানায় বসে আছে তিথি। যদিও সে জানে এসবের কোনো মানে নেই তারপরও একপ্রকার বাধ্য হয়েই বসে আছে সে। কিন্তু আকাশের আসার কোনো নাম গন্ধ নেই আঁধো আসবে কি না এটাও বুঝতে পারছে না তিথি। প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে তার কিন্তু সে ঘুমাতে পারছে না এমন সময় হঠাৎই দরজা খোলার শব্দ কানে আসতেই হাল্কা নড়ে চড়ে বসলো তিথি বুকের ভিতর এক অজানা ভয় এসে গ্রাস করলো তাঁকে।

অন্যদিকে,,

দরজা খুলে সামনেই তিথিকে বসে থাকতে দেখে আকাশ তিথির সামনে এগিয়ে এসে বললো,

‘ এখনও বসে আছো কেন? ঘুমাও নি?’

উওরে তিথি কিছু বললো না তিথিকে চুপ থাকতে দেখে আবারো বলে উঠল আকাশ,

‘ তবে একদিক থেকে ভালো করেছো জেগে আছো তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে,,

বলেই বিছানায় তিথির সামনে বসে পড়ে আকাশ তারপর তিথির দিকে একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলে,

‘ এটায় সাইন করে নিও?’ আমি অলরেডি করে দিয়েছি তুমিও করে রেখো?’

আকাশের কথা শুনে তিথি তার মাথার ঘোমটা সরিয়ে আকাশের হাত থেকে কাগজটা নিয়ে বললো,

‘ এটা কিসের কাগজ?’

‘ এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে এটা এগ্রিমেন্টের কাগজ এই কয়েকদিনের ঝামেলায় এটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম প্রায় এখানে লেখা আছে আগামী এক বছরের জন্য তোমার এবং তোমার পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব আমার আর এক বছর পরও তোমার আর তোমার পরিবারের কোনো সমস্যা হতে দিবো না আমি সাথে এক বছর পর আমরা আমাদের নিজের ইচ্ছেই ডিভোর্স করে নিবো কোনো বাঁধা ছাড়াই।’

‘ডিভোর্সের’ কথা শুনতেই বুকটা কেঁপে উঠলো তিথির তবে কিছু বললো না সে। তিথি পুরো কাগজটায় একবার চোখ বুলিয়ে ছোট্ট একটা দীর্ঘ শ্বাস বললো,

‘ পেন।’

পেনের কথা শুনে আকাশ আশেপাশে তাকিয়ে টেবিলের উপর থেকে পেনটা নিয়ে তিথির হাতে দিয়ে বললো,

‘ এই নেও।’

উওরে তিথিও কিছু না বলে পেনটা হাতে নিয়ে নিজের সাইন দিতে যাবে কিন্তু কলমে কালি না থাকায় অবাক হয়ে বললো সে,

‘ কলমে কালি নেই তো বস?’

‘ কি?’

আকাশের ‘কি’ শুনে তিথি আরেকবার পেপারের নিজের লিখতে লিখতে বললো,

‘ এই দেখুন বস কলমে কালি নেই।’

তিথির কথা শুনে আকাশও তাকায় তিথির হাতের দিকে সত্যি সত্যি কলমে কালি না থাকায় আশেপাশে আর একবার চোখ বুলালো সে কিন্তু কোনো কলম দেখতে না পেয়ে বললো,

‘ আচ্ছা কোনো ব্যাপার না কাগজটা তোমার কাছে রেখে দেও কাল নতুন কলম কিনে সাইন করে নিও।’

‘ ওকে।’

উওরে আকাশ আর কিছু না বলে চলে যায় ওয়াশরুমের দিকে। আকাশ যেতেই তিথি একবার এগ্রিমেন্টের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,

‘ কি ভাগ্যরে তোর তিথি সব মেয়েরা এই বাসর ঘরে স্বামীর সাথে শপথ করে সারাজীবন একসাথে থাকার আর তুই ভাবতে কেমন একটু লাগলো তিথির। হাল্কা মন খারাপ তারও হচ্ছে পরক্ষণেই মায়ের আর গ্র্যান্ডমার কথা চিন্তা করে কিছু ভাবলো না সে।’

বেশ কিছুক্ষন পর ওয়াশরুম থেকে বের হলো আকাশ কিন্তু তখনও তিথিকে বসে থাকতে দেখে বললো সে,

‘ এখনও ঘুমাও নি নাকি আজ রাতে জেগে কাটানোর ইচ্ছে আছে?’

আকাশের কথা শুনে তিথি কিছুটা প্রশ্নসূচক কন্ঠ নিয়ে বললো,

‘ আমি কোথায় ঘুমাবো বস?’
!
!
!
!
!
!
!
#চলবে…..