#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [২১]
মৃদু আলোয় মেহেরকে দেখে হা করে তাকিয়ে থাকে রাহনাফ। মাথায় এলোমেলো চুল, গাল নাক চোখ ঘুৃমের কারনে কিছুটা ফুলে আছে তার।সদ্য ঘুম থেকে উঠলে যা হয় আর কি। মেহেরের চোখে প্রচুর পরিমান ঘুম এসে ভর করেছে সেটা তার আধো খোলা চোখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। দু-হাতে চোখ ঢলে কিছুক্ষণ পর পর হাই তুলে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে মেহের। রাহনাফ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে মেহেরের মুখ পানে। মেহের রাহনাফ কাছে এসে দাঁড়াতেই রাহনাফ বাইক থেকে নেমে দাঁড়ায়। তারপর সে মেহেরকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– বাইকে বসুন লেখিকা সাহেবা।
রাহনাফের কথা শুনে মেহের তার চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে কপালে কয়েকটা ভাজ ফেলে বলে উঠে,
– বাইকে বসবো মানে কি? কোথায় যাব?
– সেটা গেলেই দেখতে পাবেন, এখন বসুন।
– আমি কোথাও যাচ্ছি না আপনার সাথে। চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ায় মেহের। পিছন থেকে রাহনাফ বলে উঠে,
– আজকের দিনটা আমার নামে করে দিবেন বলছিলেন।তাহলে এখন কেন চলে যাচ্ছেন!
– তাই বলে সূর্য উঠার আগে চলে আসবেন! দাঁড়িয়ে বলে মেহের।
– যেহেতু পুরো দিনটাই আমার তাই সূর্য উঠার আগ থেকে ডুবার পর পর্যন্ত সবটাই আমার করে নিতে চাই।
বাইকে উঠে বসে রাহনাফ। মেহের তাকিয়ে থাকে রাহনাফের দিকে। কি হলো লেখিকা সাহেবা বাইকে বসুন। বলে উঠে রাহনাফ। রাহনাফের কথার কোন প্রতিক্রিয়া করে না মেহের। সে অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রাহনাফের মুখ পানে। রাহনাফ হয়তো মেহেরের এমন চাহনি বুঝতে পারছে তাই সে মেহেরের দিকে এক পলক তাকিয়ে থেকে বলে উঠে,
– আমার উপর কি একটু ভরসা করা যায় না লেখিকা সাহেবা। একবার বিশ্বাস করেই দেখুন, আসুন পাশে বসুন। বিন্দু পরিমাণও যদি বিশ্বাস করে থাকুন তাহলে বসুন আমি আপনার কোন ক্ষতিই হতে দিবো না। সামনের দিকে তাকিয়ে মেহেরের উত্তরের অপেক্ষা করতে থাকে রাহনাফ।
রাহনাফের কথা শুনে মেহেরের মুখে মলিন হাসির রেখা ফুটে উঠে। সে স্মিত হাসে তারপর রাহনাফের পিছনে গিয়ে বসে রাহনাফের কাদে তার হাত রাখে। সামনে থাকা মিররে নিজের আর মেহেরের আধেক প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে রাহনাফ। দু-চোখ বন্ধকরে বড় করে শ্বাস ত্যাগ করে সে। এ যেন এক বড় প্রাপ্তি তার কাছে। মেহের তাকে বিশ্বাস করে তার পাশে বসেছে তার কাছে হাত রেখেছে। এর থেকে বড় প্রাপ্তি আর কি হতে পারে তার কাছে। চোখ খুলে মিররের দিকে তাকায়, মেহেরের আধেক মুখ দেখা যাচ্ছে তাতে। রাহনাফ মিররটা নাড়িয়ে চাড়িয়ে ঠিক করে নিলো। এবার মেহেরের পুরো মুখটাই দেখা যাচ্ছে তাতে। হুম এখন ঠিক আছে। হাত দিয়ে মাথায় চুলগুলো পিছনে ঠেলে দেয় রাহনাফ তারপর সে ছুটে চলে তার গন্তব্যের দিকে।
৩২,
রাহনাফ, চাইল্ড এন্ড ওল্ডএজ কেয়ার হোমের ভিতরে নিয়ে আসে তার বাইক। গেটের ভিতর দিয়ে বাইক প্রবেশ করানোর সময় মেহের বেশ অবাক হয়। রাহনাফ সাতসকালে তাকে এখানে কেন নিয়ে আসলো। আর এত সকলে সে আশ্রামেই বা কেন আসলো। নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মেহেরের মাথায়। সে কিছুক্ষণ পর পর রাহনাফের কাঁধ শক্তকরে চেপে ধরছে। রাহনাফ সামনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
– গেলেই বুঝতে পারবেন কেন এসেছি। এখন শান্ত শিষ্ট ভদ্র মেয়ের মতো বসে থাকুন।
রাহনাফের কথা শুনে শুকনো ডুক গিয়ে মেহের। বাকা চোখে বাইকের মিররের দিকে তাকিয়ে রাহনাফের মুখ দর্শনকরে সে, অমনি রাহনাফ তার বাইক থামিয়ে দেয়। ঘটনাক্রমে মেহেরের পুরো শরীরের ভর গিয়ে পরে রাহনাফের উপর। মেহের দ্রুত নিজেকে সামলে বাইক থেকে নেমে যায়। রাহনাফ ও বাইক থেকে নামে তারপর সে মেহেরের হাত ধরে অপর পাশে চাইল্ড হোমের কাছে নিয়ে যেতে থাকে।
চাইল্ড হোমের কাছে আসতেই অনেকগুলা ছেলে মেয়ে রাহনাফে ঘিরে ধরে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে থাকে। রাহনাফ মেহেরের হাত ছেড়ে দিয়ে বাচ্চাদের সামলাতে ব্যাস্ত হয়ে পরে। মেহের তার হাত উচু করে তাকিয়ে আছে রাহনাফের দিকে। রাহনাফ বাচ্চাদের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে সেটাই দেখছে সে। তারপর সে তার হাতের উপর হাত বুলিয়ে মৃদু হাসে। কেন হাসে সেই কারনটা অজানা তার। হাতের উপর হাত বুলিয়ে দিয়ে আবারও সে রাহনাফের দিকে তাকায়। এই ছেলেটার হাসি এত কিউট কেন? কেন! সে হাসলে আমার বুকটা ব্যাথা করে উঠে। কেন তার সাথে থাকলে আমার নিজেকে পরিপূর্ণ মনে হয়। বুকের উপর হাত রাখে মেহের। তাহলে কি আমিও! মুগ্ধ চোখে রাহনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে সে।
দুপুরে রাহনাফ নিজে বাচ্চাদের নিয়ে ভুনা খিচুড়ি রান্না করে আশ্রামের সব বাচ্চা ও বয়স্কদের খাওয়ায়। সকলে রাহনাফের উজ্জল ভবিষ্যৎ আর দীর্ঘয়ু কামনা করছে। মেহের সারাক্ষণ রাহনাফের পাশে ঘুরে ঘুরে ওকে দেখেছে। মাঝে মাঝে যখন রাহনাফের সাথে তার দৃষ্টি সংযোগ হয়েছে তখনি সে তার দৃষ্টি নামিয়ে কোন এক কাজ করার বাহানা খুজে চলেছে। এটা দেখে মৃদু হাসছে রাহনাফ আর মাথা চুলকাচ্ছে। খাওয়া শেষে সবাই যখন বিশ্রাম নিতে ব্যাস্ত রাহনাফ তখন আশ্রামের পাশে বাগানে বসে গাছের সাথে কথা বলে। কিছুক্ষণ পর মেহের ও এসে রাহনাফের পাশে বসে। রাহনাফ মেহেরের উপস্থিতি টের পেলেও কোন প্রতিক্রিয়া না করে গাছের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে তাকিয়ে থাকে। মেহের আশেপাশে চোখ বুলিয়ে রাহনাফের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
– আজ আপনার জন্মদিন, আগে বলেন নি কেন?
– জানতে চেয়েছেন কখনো?
রাহনাফের প্রশ্নের কোন জবাব দেয়না মেহের। কিছুক্ষণ মৌনতা অবলম্বন করে সে। তারপর বলে উঠে,
– আমাকে এখনে কেন নিয়ে আসলেন? না মানে এই আশ্রম তো আপনি আগে থেকেই চিনেন, আপনি একা আসতে পারতেন তবে আমাকেই কেন নিয়ে আসলেন এখানে।
– আজকের এই দিনটা আমার কাছে খুব স্পেশাল, আর ততটাই আপনি আমার কাছে স্পেশাল। স্পেশাল দিনটা যদি স্পেশাল মানুষের সাথে নাই কাটাই তাহলে কি করে হয় বলুন তো। সামনের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলে উঠে রাহনাফ। মেহের ততক্ষণ রাহনাফের মুখের দিকে তাকিয়েই ছিলো। রাহনাফ তার দৃষ্টি নামিয়ে মেহের দিকে তাকাতেই দুজনের সাথে চোখাচোখি হয়। মৃদু হেসে মেহের তার দৃষ্টি নামিয়ে নেয় আর রাহনাফ সে তাকিয়েই থাকে মেহের মুখপানে। কিছুসময় পর মেহের তার হাত বাড়িয়ে বলে উঠে,
– আপনার মোবাইলটা একটু দেন তো।
দ্বিরোক্তি করে না রাহনাফ। সে তার মোবাইলটা মেহেরের হাতে দিয়ে দেয়। মোবাইল পেয়ে মেহের মৃদু হেসে উঠে চলে যায়। দূর থেকে এক বৃদ্ধা মাহিলা মেহেরকে দেখতে পায় তখন। সে এতক্ষণ বসে বসে একটা সোয়েটার শেলাই করছিলো। মেহেরকে দেখা মাত্রই সে সুই সুতা সোয়েটার রেখে মেহেরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সেই কবে সে দেখেছিলো মেহেরকে তারপর তার মেহেরের দেখা পায়নি সে। নওশাদ কে কত করে বলেছে মেহেরকে দেখবে, কিন্তু সৈদয় নওশাদ তো পৃথিবী সবচেয়ে নিকৃষ্ট বাবা, সে বাবার অধীকার নিয়ে মেয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই পরে না। মেয়ের মুখ থেকে বাবা ডাক শুনতে পারে না সে। বৃদ্ধা তার নাতনী মেহেরকে দেখতে পারে না। আজ কত দিন পর সে আবার মেহেরের মুখ দেখতে পেরেছে তাকে ছুয়ে না দেখলে কি করে হয়। বৃদ্ধা মেহেরকে ছুঁয়ে দেখবে বলে মেহেরের কাছে আসতে থাকে। এদিকে মেহের ফোনে কথা বলে শেষ করে আবার গিয়ে রাহনাফের পাশে বসে ওকে ওর মোবাইলটা ফিরতে দিয়ে দেয়। তারপর দুজনে মিলে তাকিয়ে থাকে গাছের দিকে।
– মে-মেহের।
ফাটানো জড়ানো কারো কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে পিছনে ফিরে তাকায় মেহের আর রাহনাফ। পিছনে থাকা লোকটা দেখে রাহনাফের মুখে এক চিলতে হাসির রেখা ফুটে উঠলেও মেহের মুখখানা বিষন্নতায় ছেয়ে যায়। তিক্ততায় ভরে উঠে তার মন। চোখ ছেয়ে যায় বিরক্ততায়। মুহূর্তেই চোখ-মুখ শক্ত হয়ে আসে তার। উড়নাটা নিজের হাতের মুঠিতে নিয়ে শক্তচোখে বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে থাকে মেহের।রাহনাফ অধোরে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠে,
– আরে আমার কিউট দাদি যে আসুন আসুন।
বৃদ্ধার রাহনাফের দিকে একপলক তাকিয়ে মলিন হাসি উপহার দিকে মেহেরের দিকে তাকায় সে। মেহের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ধীর পায়ে রাহনাফের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বৃদ্ধা ওদের পাশে দাঁড়াতেই উঠে দাঁড়ায় মেহের। ঘৃনাভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে বৃদ্ধার দিকে। আর বৃদ্ধার দৃষ্টি স্থির মেহেরের মুখের দিকে। তার চাহনিতে ছিলো শুধু অনুতাপ মাত্র।
চলবে,,,,,,
#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [২২]
রাহনাফকে নিয়ে সোজা নিজের বাসায় চলে আসে মেহের। যদিও এতে রাহনাফের আপত্তি ছিলো বেশ। মেহের জোর করেই তার সাথে করে বাড়িতে নিয়ে আসে রাহনাফকে। আশ্রমে তার দাদিকে দেখা মাত্রই মেহেরের গা জ্বলে উঠার মতো অনুভব হয়। তার দিকে কটাক্ষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে আসতে নিলে রাহনাফ ওকে আটকানোর চেষ্টা করে কিন্তু মেহের রাহনাফের কোন কথাই শুনে না। সে চলে আসে। পিছন থেকে তার দাদীও অনেকবার ডেকেছে কিন্তু পিছনে ফিরে তাকায়নি মেহের। সে প্রস্হান করে। রাহনাফের আর কি করার, সেও বৃদ্ধাকে বিদায় জানিয়ে মেহেরকে পিছু করতে থাকে। আশ্রমের গেটের বাহিরে আসতেই সে একটা বড় গাড়ি দেখতে পায়। গাড়িটা আশ্রমের ভিতরে প্রবেশ করছে। এত বড় গাড়ি নিয়ে এই আশ্রমে আবার কে আসবে সেটা দেখার জন্যেই গাড়িটাকে ভালো করে পরখ করে রাহনাফ। কেন জানি তার মনে হলো এই গাড়িটা সে আগেও দেখেছে, বেশ চেনা চেনা মনে হচ্ছে গাড়িটাকে। থমকে দাঁড়িয়ে যায় রাহনাফ। দূর থেকে মেহের রাহনাফকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাতের ইশারায় কয়েকবার ডাক দেয় কিন্তু সে খেয়াল নেই রাহনাফের, সে গাড়িটাকে দেখতে ব্যাস্ত। তাই মেহের নিজে রাহনাফের কাছে এসে দাঁড়ায় আর মৃদু সূরে রাহনাফকে ডাক দেয় রাহনাফকে। রাহনাফ এখনো কোন রিসপন্স করে না তার দৃষ্টি দূরের গতিশীল গাড়ির দিকে। রাহনাফের দৃষ্টি অনুসরণ করে মেহের তার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কিন্তু দেখার মতো কোন কিছুই তার চোখের সামনে পরে না। তাই সে রাহনাফ হাতে নাড়া দিয়ে বলে,
– ওদিকে কি এত দেখছেন! কখন থেকে ডাকছি আপনার কোন রিসপন্সই নাই।
নিজের হাতে শীতল স্পর্শ পেতেই সামনে তাকায় রাহনাফ। মেহেরকে দেখে ভ্রু দ্বয়ে কিঞ্চিৎ ভাজ ফেলে জিগ্যেস করে,
– কিছু বলছেন লেখিকা সাহেবা?
– আপনি কি ভাবছেন বলুন তো?
মেহেরের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আবার সেই গাড়ির দিকে তাকায় রাহনাফ। গাড়িটা ততক্ষণ ওদের দৃষ্টির অগোচরে চলে গেছে। রাহনাফ তড়িৎগতিতে মেহেরের হাত চেপে ধরে বলে চলুন, তারপর ওকে নিয়ে সেই গাড়ির পিছু করতে থাকে। এত তাড়াহুড়া করে কোথায় যাচ্ছে রাহনাফ সেটা কয়েকবার জিগ্যেস করে মেহের, কিন্তু কোন জবাব দেয়না রাহনাফ। সে মেহেরের হাত শক্তকরে চেপে ধরে শুধু সামনের দিকে এগোতে থাকে।
কিছুক্ষণ পর সেই বড় গাড়িটা দেখতে পায় রাহনাফ। গাড়ির ভেতর থেকে একটা যুবক কোট প্যান্ট করে বের হয়ে পিছনের দরজা খুলে দিলো। সেখান থেকে একজনক অর্ধবয়স্ক মহিলা বের হলো যার গায়ে জড়ানো সাদা থান আর কাধে একটা কালো শাল। অর্ধবয়স্ক মহিলাটিকে দেখে যেন রাহনাফের পুরো দুনিয়া থমকে যায়। আলগা হয়ে আসে তার হাত। থো মেরে দাঁড়িয়ে থেকে স্থির দৃষ্টিতে সে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে। মেহের তার হাতের দিকে এক পলক তাকিয়ে থেকে রাহনাফের মুখের দিকে তাকায়। রাহনাফের মলিন মুখ দেখে মেহের তার বুকের বা পাশটায় চিনচিন ব্যাথা অনুভব করে। শ্বাস আটকে আসে তার। আচ্ছা রাহনাফের এমন বিষন্নমাখা মুখ দেখে মেহেরের কেন খারাপ লাগছে! তবে কি মেহের রাহনাফকে ভালোবেসে ফেলেছে। প্রিয় মানুষের বিষণ্ণতায় যদি আমি এক পৃথিবী সমান ব্যাথা অনুভব করি তবে এর নাম বুঝি ভালোবাসা। বুকের উপর হাত রেখে রাহনাফের মুখের দিকে দৃষ্টি রাখে মেহের। রাহনাফের দৃষ্টি তখনো স্থির সামনে থাকা সেই অর্ধবয়স্ক মহিলার দিকে। মহিলাটি যখনি পিছনের দিকে ঘুরে তাকায় রাহনাফ খপ করে মেহেরের হাত ধরে পিছনের দিকে ঘুরে যায়। রাহনাফ এতটাই শক্তকরে মেহেরের হাত ধরেছে সে মেহের তার হাতে ব্যাথা অনুভব করছে আর তার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। সেদিকে খেয়াল নেই রাহনাফের, সে নিজের মুখ লুকাতে ব্যাস্ত।
অর্ধবয়স্ক মহিলাটি রাহনাফকে ছাড়িয়ে চলে যায় আশ্রমের ভিতরে। সে চলে যেতেই বড় করে শ্বাস ত্যাগ করে রাহনাফ। পিছনের দিকে ফিরে তাকাতেই দেখতে পায় সেই গাড়ির পিছনে একটা ছোট ট্রাক এসে দাঁড়িয়েছে। দুজন হেল্পার ট্রাকের ভিতরে থেকে বড় বড় খাবারের পাত্র বের করছে। রাহনাফ সে দিকে তোয়াক্কা না করে সেই অর্ধবয়স্ক মহিলাটিকে ফলো করার জন্যে তার পিছু ছুটে। মেহের অবাক চোখে রাহনাফের কার্যকলাপ দেখে যাচ্ছে শুধু।
অর্ধবয়স্ক মহিলা আশ্রমের সকল বৃদ্ধা ও বাচ্চাদের মাঝে খাবার আর বস্র বিতরণ করেন এবং তার ছেলের জন্যে সকলের নিকট দোয়া চায়। এক কৈশোর তার কাছে তার ছেলে সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি মৃদু হেসে বলেন,
– আমি অনেক আগেই তাকে হাড়িয়ে ফেলেছি। মন খারাপ হয়ে যায় মহিলার। থানের আচল দিয়ে চোখ মুছে নেয় সে। এই দৃশ্য দূর থেকে রাহনাফ। তার চোখের কোটর বেদ করে পানি গড়িয়ে পরে। মেহেরের মুখ হা হয়ে যায়। রাহনাফ কাঁদছে! কে এই মহিলা? রাহনাফ কেন তাকে লুকিয়ে দেখছে! আর তাকে দেখে রাহনাফ কেনই বা কাঁদছে। তবে কি এনিই রাহনাফের মা। চোখ বড় বড় হয়ে যায় মেহেরের। রসোগোল্লার মতো চোখ নিয়ে একপলক রাহনাফের দিকে তাকিয়ে আবার সে মহিলার দিকে তাকায়। দুইজনেই কাঁদছে, দুজনের চোখেই রয়েছে আপনজনকে হাড়ানোর তীব্র যন্ত্রনা। মেহের আলতো করে রাহনাফের এক হাত ধরে বলে উঠে,
– এনি কি আপনার,,,,,
– মা। এনিই আমার মা। মেহেরকে থামিয়ে বলে উঠে রাহনাফ। রাহনাফের কথা শুনে একটুও অবাক হয়নি মেহের। কারন সে এমনটাই আন্ধাজ করেছিলো। রাহনাফ অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মেহেরের দিকে। মেহেরের এখন বড্ড অসহায় লাগছে। সে পারছেনা রাহনাফের চোখের পানি মুছে দিতে আর না পারছে ওকে ওর মায়ের সাথে মিলিয়ে দিতে। খুব অসহায় লাগছে মেহেরের। সে করুন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাহনাফের দিকে। তখন দুজনের মাঝে দৃষ্টি সংযোগ হয়। একজন আরেকজনের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কথা হয় চোখে চোখে। দুজন দুজনের চোখের ভাষা বুঝে নেয় কিন্তু সেটা মুখে প্রকাশ করে না কেউ। রাহনাফ মেহেরের হাতটা শক্তকরে ধরে জড়ানো কন্ঠে বলে উঠে,
– চলুন লেখিকা সাহেবা ফিরে যাই।
– রাহনাফের কথায় সায় দেয় মেহের। তারপর দুইজনেই সেখান থেকে প্রস্তান করে। আধেক রাস্তা আসার পর রাহনাফ তার বাসায় ফিরে যেতে চাইলে মেহের জোর করে রাহনাফ তার সাথে তার বাসায় নিয়ে আসে।
৩৩,
মৌ আলিহান আর রাহি তিনজন মিলে রাহনাফের জন্যে নানা রকমের খাবার রান্না করে। আলিহান রাহনাফের পছন্দের কেক তৈরী করে। আশ্রমে মেহের রাহনাফের কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে আলিহান কে কল করে রাহনাফের জন্মদিনের কথা জানায়। আর ওর পছন্দের সব খাবার রান্না করতে বলে। কারন মেহের রাহনাফকে তার সাথে নিয়ে আসবে। আলিহান রাহিকে কল করে বাসায় আসতে বলে। এই সুযোগে যদি মেহের আর রাহির মাঝে একটু ভাব জমে। রাহিও এত ভালো একটা সুযোগ মিছ করতে চায়না। তাইতো আলিহান কল করার সাথে সাথে সে ছুটে চলে আসে মেহেরের বাসায়। মৌ আর আলিহানের সাথে হাতে হাত লাগিয়ে কাজ করে রাহি। সৈয়দ মাহবুবা বিকালে বাসায় ফিরে আজ। তিনি ফিরলে সবাই মিলে একসাথে রাহনাফকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায় আর কেক কাটে। তারপর সবাই মিলে এক সাথে এক টেবিলে খাওয়া দাওয়া করে করে। এতে করে রাহনাফ আর মেহের আজ অনেক কাছাকাছি চলে আসে। রাহনাফ মেহেরকে খাইয়ে দেয়, মেহের দেয় রাহনাফকে খাইয়ে। এই দৃশ্য দেখে হাতের মুঠি শক্ত করে বসে থাকে রাহি। খাবার প্লেটে হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করে শুধু কোন খাবার তার মুখ অব্ধি পৌঁছায় না। আড় চোখে রাহনাফ আর মেহেরের হাসিমুখ দেখে রাহি। কারন এখন রাহনাফ আর মেহের যতটা কাছাকাছি চলে আসছে রাহি ঠিক ততটাই দূরে চলে যাচ্ছে। যথাসম্ভব নিজেকে সামলে নেয় রাহি। একপক্ষ ভালোবাসার চেয়ে দূরে চলে যাওয়াটা ভালো মনে করে সে। কারন তাদের দুজের মিল হওয়ার মাঝে সে নিজেকে মস্ত বড় দেয়াল মনে করে। যে দেয়াল টপকে গিয়ে মিলন হতে পারছে না রাহনাফ ও মেহেরের। মৃদু হাসে রাহি। মেহের ও তার জিবনে ভালোবাসা পেয়েছে। তার বোনটা কাউকে ভালোবাসতে পেরেছ এটা যে তার কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি। অধোর চেপে বড় করে শ্বাস ত্যাগ করে উপরের দিকে তাকিয়ে আল্লাহর দরবারে প্রর্থনা করে, তাদের ভালোবাসা যেন সারাজীবন অটুট থাকে। তারা যেন একে অপরকে এভাবেই ভালোবাসে সবমসময়।
– রাহি, কি এত ভাবছিস বলতো? কিছুই তো খাচ্ছিস না।
-আলিহানের কথায় ঘোর কাটে রাহির। সে আলিহানের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসে।
– এইতো খাচ্ছি। এক লোকমা ভাত মুখে দেয় রাহি। আলিহান ও রাহি একে অপরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে।
চলবে,,,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।