মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর পর্ব-৪৭

0
537

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [৪৭]

– নিঝুম আফিয়া শিকদার, রাহির মায়ের পুরো নাম। নিভু নিভু কন্ঠে বলে রাহনাফ। মেহের বড় বড় চোখ করে রাহনাফের দিকে তাকায়। সে বলে,

– শিকদার, মানে, আরওয়ান শিকদার আর আফিয়া শিকদার।

– হুম। নিঝুম আফিয়া শিকদার হলো আমার বাবার চাচাতো বোন। যৌথ ফ্যামিলি ছিলো আহমাদের। সেই পরিবারের বড় সন্তান ছিলো আমার বাবা। তারপর আমার চাচা। নিঝুম আর আরমান ওরা দুই ভাইবোন। মোট চারজন ছেলেমেয়ে ছিলো শিকদার বাড়িতে। তারমধ্যে নিঝুম আন্টি একা একটা মেয়ে ছিলো। সকলের আদুরে মেয়ে। যখন যা আবদার করতো সকলেই তার আবদার মেটাতে ব্যাস্ত হয়ে পরতো। আমার বাবা ওকে একটু বেশীই আদর করতো। নিজের ছোট বোন মনে করতো। কিন্তু আফিয়া আন্টি আমার বাবার আদর আর কেয়ারগুলো অন্যচোখে দেতে লাগলো। সে বেশীরভাগ সময় আমার বাবার কাছে বায়না করতো। নানা অজুহাতে তার কাছে থাকার চেষ্টা করতো। বাবা এসব কিছুই বুঝতো না। সে ভাবতো ছোট বোন তো আমার কাছেই বায়না করবে। এদিকে বাবার সম্পর্ক ছিলো আমার মায়ের সাথে। গভীর প্রেম ছিলো তাদের। সারাদিন ব্যাস্ততা কাটিয়ে নয়মাইল রাস্তা পারি দিত মায়ের সাথে দেখা করার জন্যে। অন্যদিকে আন্টির পাগলামি বাড়তে থাকলো। সে সবসময় বাবার কাছে কাছে থাকলো। বাবা যখন কাজ করতো সে নিঃপলক তাকিয়ে থাকতো বাবার দিকে। কলেজে যাওয়া শপিং করতে যাওয়া বন্ধুদের সাথে কোথাও গেল বাবাকে সাথে নিয়ে যেত। বাবাও ওকে পৌঁছে দিয়ে তারপর হসপিটালে যেত। একদিন আন্টি তার বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাবে। সেদিন বাবার একটা ইমারজেন্সি ছিলো তাই সাথে যেতে পারে নি। বাবার পরিবর্তে সেদিন আমার চাচা যায় আন্টির সাথে। আর সেখানে আন্টির এক বান্ধুবী বলে উঠে,’ তোর কাজিনগুলো তো একেকটা কিউটের ডিব্বা, বড়টা তুই বুকিং দিয়েই রেখেছিস। ছোটটা না হয় আমার। তার কথা শুনে চাচা আন্টির দিকে তাকিয়ে ছিলো কিছুক্ষণ। তারপর আন্টির কাছে এসব কথার মানে জানতে চাইলে তখন আন্টি বলে, সে নাকি বাবাকে ভালোবাসে। ছোট চাচা সেদিন নিঃশব্দে সেখান থেকে প্রস্তান করে। কারন সে বাবা আর মায়ের সম্পর্কের কথা জানতো। রাতে যখন বাবা বাসায় ফিরে তখন চাচা তাকে আন্টির ব্যাপারে সব বলে দেয়। তারপর থেকে বাবা আন্টিকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। এতে খুব হতাশ হয় আন্টি। সে আরো বেশী করে বাবার কাছে থাকার চেষ্টা করে। ছোট থেকে নিঝুম আন্টি বদমেজাজি আর বড্ড জেদী ছিলো। রাগের বসে সে যে কোন কাজই করতে পারে। সেই ভয়টাই কাজ করতো বাবার মনে। তাই সে আন্টিকে মায়ের ব্যাপারে বলতে চেয়েও বলতে পারেনি।নিঝুম আন্টির পাগলামি দিন দিন বাড়তেই থাকলো। পরিশেষে বাবা আর চাচা মিলে একটা প্ল্যান করে, আন্টিকে পড়াশুনার জন্যে বিদেশ পাঠায় এই প্রত্যাশা নিয়ে। দূরে গেলে আন্টি হয়তো বাবাকে যাবে ভুলে। আন্টি চলে যায়, আর কিছুূদিন পরেই বাবা আর মায়ের বিয়ে হয়। তাদের একটা সুন্দর সংসার হয়। তারপর আমি আসি তাদের কোলজুরে। পুরো শিকদার বাড়িতে খুশির বন্যা বয়ে যায়। সাথে এলাকা বাসিরও। আনন্দে মেতে থাকে শিকদার বাড়ি। আমার দাদাদাদি তো আমায় চোখে হাড়াতো। এভাবেই কাটে ছয়টা বছর। ছয় বছর পর দেশে ফিরে নিঝুম আন্টি। দেশ থেকে চলে যাওয়া আর দেশে ফিরে আসা নিঝুম আন্টির মাঝে ছিলো বিরাট তফাৎ। সে বাসায় কারো সাথে কথা বলতো না। রাত বিরাতে পার্টি করে মাতাল হয়ে বাসায় ফিরতো। বাড়ির কেউই তার কোন প্রতিবাত করতে পারতো না। একদিন রাতে বাবা লেট কর বাড়ি ফিরে, মা তার জন্যে অপেক্ষা করছিল বাবা আসলে তারা এক সাথে ডিনার করবে। আমি তখন ড্রয়িংরুমে বল নিয়ে খেলছিলাম। বাবার আসে রাত দুটো নাগাত। তারপর বাবা আর মা এক সাথে খেতে বসে আমি তখন বাবার কোলে। বাবা নিজে খাচ্ছে আর আমায় খাইয়ে দিচ্ছে। তখন মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরে আন্টি। বাবা সেদিন রেগে গিয়ে বলছিলো,

“আমাদের পরিবারের একটা মান আছে। কোন ভদ্র বাড়ির মেয়ে রাত দুটোর সময় মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরে না”।

“কে বলেছে আমি ভদ্র মেয়ে। আর এটা ভদ্র পরিবার? এই পরিবারের সবাই বিশ্বাসঘাতক! আমাকে ঠকিয়েছিস তুই আরওয়ান এর এখন আমাকে ভদ্রতা শিখাচ্চিস।ধোকা দিয়েছিস আমায় তুই। বিশ্বাসঘাতক বেইমান। মাতাল হয়ে টলতে টলতে বলে আন্টি।

বাবা খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

” আমি তোকে কোন আশ্বাস দেয়নি। না কখনো ভালোবাসার কথা বলেছি তাহলে তোকে ঠকালাম কি করে! ”

নিঝুম আন্টি আমার দিকে তাকিয়ে আমার গাল টেনে দেয়। তারপর মায়ের দিকে তাকিসে স্মিত হাসে। অতঃপর বলে,

– আমাকে ধোকা দিয়ে তুই সুখের সংসার করবি তাইনা আরওয়ান। আমি তোর এই সুখের সংসারে প্রলয় সৃষ্টি করে দিবো। কথাগুলো বলে টলতে টলতে শিড়ি বেয়ে উপরে চলে যায় আন্টি। মা ভয় পেয়ে বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ালে বাবা মাকে এক হাতে তার বুকে জড়িয়ে অন্যহাতে আমাকে ধরে তারপর,

– ভয় কিসের তোমার। আমি আছি তো তোমাদের পাশে। যতদিন আমি বেচে আছি কোন বিপদ-ই তোমাদের দুজনকে ছুতে পারবে না।

ঠিক সেটাই হলো। বাবা যতদিন বেচে ছিলো ততদিন আমরা সুখের স্বর্গে বাস করতাম। একটা কালো রাত,যে রাত আমাদের সব সুখ কেড়ে নিলো। আমার থেকে আমার বাবাকে কেড়ে নিলো। আমার মা স্বামি হারা হলো। সেদিন রাতে বাবার দুটো অপারেশন ছিলো। সাধারণত অপারেশনের আগে বাবা কিছু খেত না। কিন্তু সেদিন রাতে মায়ের হাতে এক গ্লাস গরম দুধ খেয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। পথিমধ্যে বাবার গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হাড়িয়ে ফেলে সাথে নিজেরও। ফাকা রাস্তায় এক্সিডেন্ট হয় আমার বাবার গাড়ি। এটা নিয়ে পুলিশের বেশ সন্দেহ হয় তাই বাবার লাশটা ফরেনসিক ল্যাবে পাঠিয়ে দেয়। রিপোর্ট অনুযায়ী বাবার পেটে পয়জন পাওয়া যায়। মা যেই দুধটা বাবাকে খাইয়ে দিয়েছিল সেটায় বিশ মেশানো ছিলো। পুলিশ মাকে এরেস্ট করে নিয়ে যাবে তখন আমার দাদা আর চাচা এসে পুলিশকে আটকায়। কারন তারা জানতো আমার মার কখনো এই কাজ করতে পারে না। কিন্তু আমার দাদি সে বাবার মৃত্যুটা মানতে পারেনি। তাই আমার মা-কে বাড়ি থেকে চলে আসতে হয়। দাদাদাদি আমায় রাখতে চেয়েছিলো কিন্তু আমার মায়ের কথা ভেবে আমাকে তার সাথে পাঠিয়ে দেয়। পরে অবশ্য তারা আমার খরচ বহন করতো।

হঠাৎ এদিন নিঝুম আন্টি মাতাল হয়ে গান গাইছে। সেদিন সে মাতাল অবস্থায় বলে, দুধের গ্লাসে সে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল। তার প্ল্যান সাকসেস। সবাইকে সেলিব্রেট করতে বলে। সেদিন তার কথা শুনেছিল আমার ছোট চাচা আর আরমান চাচা। তারপর তারা বাড়ির সবাইকে সবটা বললে, তারা আন্টিকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। মা-কে আবার শিকদার বাড়িতে ফিরে যেতে বলছিলো, কিন্তু আমার নানা যেতে দেয়নি। কারন সে ততদিনে তার মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে শুরু করে দিয়েছিলো। তারপর আমি আশ্রয় পাই আশ্রমে আমার মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে হয় আর আমার পরিবারের সবাই মিলে চলে যায় ইউএসএ।

কথাগুলো শেষ করে সামনের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রাহনাফ। মেহের তাকিয়ে আছে রাহনাফের মুখের দিকে। প্রত্যেকটা মানুষের জিবনে একটা গল্প থাকে। কেউ প্রকাশ করে আর কেউ সেটা আড়াল করে রাখে। তবে মনের ভিতরে লুকিয়ে তাকা গল্পগুলো সত্যিই কষ্টজনক। মেহের তার হাতটা রাহনাফের হাতের উপর রাখে। রাহনাফের মেহেরের দিকে তাকালে মেহের রাহনাফের বুকে মাথা রাখে।

৫৭,
নদীর তীড়ে নৌকায় বসে বসে প্রকৃতির রং বদলানো দেখছে রেদওয়ান। মাথা উপরে থাকা সূর্যটা ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে। চাদিকে লাল আভা। অস্ত যাওয়া বিকালে ঘাটারে পাড়ে যদি প্রিয় মানুষটা সাথে কাটানো যায় তাহলে মনে হয় সময়টা আরো বেশী মধুর হয়ে উঠে। রোজ বিকালে নদী তীরে এসে বসে থাকে রেদওয়ান। রাহির সাথে কাটানো সয়মগুলোর কথা তার বড্ড মনে পরে। এইতো কিছুদিন আগেও এখানে বসে গল্প করছিলো দুজনে। রাহির মাথার খোলা চুলগুলো বাবার রেদওয়ানের মুখের উপর এসে পড়ছিলো। রাহি মৃদু হেসে তার চুলগুলো গুজে দিচ্ছিলো কানের পিঠে। অপলক দৃষ্টি রাহির দিকে তাকিয়ে ছিলো রেদওয়ান। রেদওয়ান সেদিন এর নতুন রুপের সন্ধান পেয়েছিল। যেটাতে সে পুরোপুরিভাবে আসক্ত। কিন্তু তার সেই রুপবতী তো তাকে একা করে পাড়ি জমালো ভীন দেশে।ফিরে আসবে কি রাহি। তার হলুদ পঙ্খীর অপেক্ষার অবসান ঘটিতে সে কি নিজ দেশে ফিরে আসবে।

নদীর পানিতে হাত রাখে রেদওয়ান। তারপর সেখান থেকে উঠে চলে যায়।

রাস্তাদিয়ে হেলেদুলে যাচ্চে রেদওয়ান। কখনো রাস্তায় পরে থাকা খালি বোতলাটাতে লাথি দিচ্ছে। আবার কখনো রাস্তার পাশে থাকা গাছে লাথি দিচ্চে। আজকাল কোন কিছুই ভালো লাগে না তার। কখনো দুই পকেটে হাত গুজে দিয়ে হাটছে সামনের দিকে। তার গন্তব্য কোথায় সেটা জানা নাই। তখন রিক্সায় করে যাচ্ছিল মেহের। মৌ-য়ের জন্যে ঔষুদ কিনতে এসেছে সে। রাস্তা রেদওয়ানকে এভাবে হেলেদুলে হাটতে দেখে রিক্সা থেকে নেমে রেদওয়ানের কাছে আসে মেহের। রেদওয়ান মেহেরকে চিনতে পারেনা তাই ওকে উপেক্ষা করে চলে যেতে নেয়। মেহের আবার গিয়ে রেদওয়ানের সামনে দাঁড়ায়। রেদওয়ান তার চক্ষুদ্বয় সংকোচিত করে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,

– কে আপনি? বারবার আমার পথ আটকে দাঁড়াচ্ছেন কেন?

– তুমি রেদওয়ান না।

– আপনি আমায় চিনেন?

– না, তোমার ড্রেস দেখে মনে হলো তুমিই রেদওয়ান।

রেদওয়ান তার ড্রেসের দিকে একপলক তাকিয়ে মেহেরের দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। অতঃপর বলে,

– কে আপনি? আমাকে চিনেন কি করে।

– আমি মেহের। রাহির বোন।

রেদওয়ানের অধোরে হাসির রেখা ফুটে উঠে। সে অধোর কামড়িয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে হাসি। মেহের অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রেদওয়ানের মুখের দিকে।

চলবে,,,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।